Monday, January 22, 2024

রাক্ষসবধ

রাক্ষসরা বারেবারে ঋষিদের যজ্ঞ পন্ড করার চেষ্টা করতো, মনে আছে তো? এখনো করে। তখনও শ্রীরাম রাক্ষস বধ করে ঋষিদের পরিত্রাণ করেছিলেন, আজ আবার নতুন মন্দিরে নতুন বিগ্রহে তাঁর প্রাণপ্রতিষ্ঠা হলো, আবার তিনিই ভারতের ত্রাতা, তিনিই এখন থেকে ধর্মপ্রাণ সৎ ব্যক্তিদের রক্ষা করবেন। আগামী ৯০০ দিনের মধ্যে ভারত আবার রাক্ষসমুক্ত হবে। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আগামী ৯০ দিনের মধ্যেই তার পূর্ণ আভাস আপনারা অনুভব করবেন, তখন মিলিয়ে নেবেন। 

এমনি এমনি তো আর প্রধানমন্ত্রী ওই নতুন কালচক্রের শুরুর কথা বলেননি, উনি অকারণে একটিও শব্দ খরচ করেন না। শ্রীরামকে রাষ্ট্রের চেতনার সঙ্গে জুড়ে যে চারটি কথা উনি বলেছেন, তার মধ্যেই এর অন্তর্নিহিত বার্তা লুকিয়ে আছে, ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন। উনি বলেছেন, "রাম আগুন নন, রাম প্রেরণা। রাম বিবাদ নন, রাম সমাধান। রাম শুধু আমাদের নন, রাম সবার। রাম শুধু বর্তমান নন, রাম অনন্তকাল।" আজ উনি বারেবারে বলেছেন, "দেবতা থেকেই দেশ, আর রাম থেকেই রাষ্ট্রের চেতনা" - বুঝো লোক যে জানো সন্ধান। 

রামের রাক্ষসবধ রাজনীতির ক্ষেত্র দিয়ে শুরু হবে আর সমাজচেতনায় গিয়ে শেষ হবে, যার পরে কেন "আমাদের প্রজন্মকে কালজয়ী হিসেবে বাছা হয়েছে" সেটা সারা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। আজ থেকে হাজার বছর পর নরেন্দ্র মোদি অবশ্যই শরীরে থাকবেন না কিন্তু রাষ্ট্রচেতনারূপী শ্রীরাম থাকবেন কারণ "রামমন্দির স্থাপনা শুধুই বিজয়ের নয়, বিনয়েরও"।

একআধবার যে না ভেবেছি তা তো নয় যে কেন মাত্র বছর পঞ্চাশেক আগে জন্মালুম না, শ্রীশ্রীমাকে সশরীরে দেখতে পেতাম, ঠাকুরের সন্তানদের দেখতে পেতাম, রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পেতাম, ডাক্তারজিকে দেখতে পেতাম, নেতাজিকে দেখতে পেতাম, ইত্যাদি। মনে হতো হয়ত জন্মজন্মান্তরে এত সুকৃতি জমা হয়নি যে ওঁদের সাক্ষাৎ দর্শন পাবো। আজ বুঝছি সেই ভাবনাটা ঠিক ছিল না, আমার জন্যেও মা এক অনাবিল আনন্দের হাট খুলে রেখেছিলেন। 

এই বিশেষ সময়টাতে কেন আমি এই শরীরটায় আছি? নিজের চোখে রামমন্দিরের পুনর্নির্মাণ, রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা এবং তদ্পরবর্তীকালে মর্য্যাদা পুরুষোত্তমের আশীর্বাদে ভারতবর্ষের জনমানসে ধর্ম-আধারিত ব্যাপক সদর্থক পরিবর্তন এবং শ্রীজির আশীর্বাদে পুনরায় ভারতের জগৎশীর্ষে আরোহণ স্বজ্ঞানে অনুভব করতে পারবো বলে। এই তো প্রারব্ধ। This life is certainly worth living. জয় শ্রীরাম, জয় জয় শ্রীরাম। যেমন শ্রী অর্থাৎ সীতা ছাড়া রাম অসম্পূর্ণ, তেমনই রাম ছাড়া ভারতও শ্রীহীন, মলিন।

Saturday, January 20, 2024

শ্রীরামমন্দির

আমরা ভারতীয়রা এবং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ যে মন্দিরটির জন্য নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী কিছু না কিছু অর্থ বা শ্রমদান করেছি, শ্রীরামচন্দ্র ভগবানের সেই মন্দির আজ সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। যা প্রয়োজন ছিল তার দশগুন বেশি অর্থদান দিয়েছি আমরা, ফলে মন্দির প্রাঙ্গণ দশগুন বেশি ভব্য হয়ে উঠছে, যে দরজা কাঠের হওয়ার কথা ছিল, তা সোনার হয়েছে। এই মন্দির আমাদের সকলের একান্ত ইচ্ছা, আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং দীর্ঘ সংঘর্ষের প্রতীক - এক কথায় বলতে গেলে শ্রীরামজন্মভূমি মহাতীর্থক্ষেত্র সামগ্রিকভাবে আধুনিক ভারতীয়দের ধর্মাশ্রিত জীবনযাপনের ইচ্ছার প্রতিভূ, যে ধর্মবোধ হাজার হাজার বছরের আঘাত সহ্য করেও আমাদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে এখনো জীবন্ত এবং চলমান রাখতে সাহায্য করেছে। 

আমরা অন্যদের চেয়ে আলাদা, তাই আজ পর্যন্ত কেউ গায়ের জোরে বা লোভ দেখিয়ে আমাদের গিলে ফেলতে পারেনি - এই মন্দির সেই অন্যনতার জ্বলন্ত নিদর্শন। আমরা সবাই মিলে চেয়েছি, তাই রামমন্দির সম্ভব হয়েছে। এ কেবল আমাদের আস্থার বিষয় নয়, এ আমাদের জাতীয় অস্মিতার বিষয়, আমাদের মূল সংস্কারকে সংরক্ষিত রাখার বিষয়, জাতি হিসেবে আমাদের সম্মিলিত চেতনার বিষয়। আগামীকাল যখন শ্রীশ্রীরামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে, তখন আমরা প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ ভারতবাসী যজমান হিসেবে ওখানেই উপস্থিত থাকবো - হয়তো সশরীরে নয়, আমাদের প্রতিনিধি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে। এবং প্রধানমন্ত্রী সেটা জানেন বলেই ১১দিন ধরে যজমানের কৃতকর্তব্য হিসেবে এত যম-নিয়ম-দর্শন পালন করছেন। 

যখনই সামাজিক মাধ্যমে ফুটে ওঠা শ্রীরামমন্দিরের দিব্য সাজসজ্জার ছবি দেখছি, গর্বে আনন্দে শ্রদ্ধায় বিশ্বাসে আমার মাথা নত হয়ে যাচ্ছে। আহা, এ কি মনোরম রূপ তুমি গ্রহণ করেছ প্রভু, দেখে দেখে যে আর আশ মেটে না ! ছোটবেলা থেকে শুনতাম চোখের দেখা সার্থক হলো কিন্তু তার সত্যিকারের মানে কখনো বুঝিনি, আজ বুঝলাম। যা দেখছি তা আমার স্বপ্নের প্রতিরূপ, আমার অভিলাষার প্রতিরূপ, আমার অস্তিত্বের প্রতিরূপ, আমার বোধের প্রতিরূপ, আমার ভারতীয়ত্বের প্রতিরূপ। কেবল এই তীর্থদর্শনটুকুর স্বাদ পাওয়ার জন্যই বারেবারে যেন এ দেশের মাটিতেই আমার জন্ম হয়, কারণ এর মাধ্যমেই একদিন আমি শুদ্ধ মুক্ত চৈতন্য হবো।

বিভীষণ

বিভীষণ - বিশেষরূপে ভীষণ - কার জন্য? প্রজাপতি ব্রহ্মার বরে বিভীষণ অমর, ফলে যুদ্ধারোপিত মৃত্যুভয়ে তো আর তিনি রামের পক্ষ অবলম্বন করেননি, রাজ্যলাভের লোভেও নয় কারণ তিনি যে জন্মাবধি ধর্মাত্মা, তাঁর জন্মের সময় দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করেছিলেন (তস্মিন্ জাতে মহাসত্ত্বে পুষ্পবর্ষং পপাত হ - উত্তরকান্ড ৯/৩৬)। রাবণের ভয়ঙ্কর ক্রোধ এবং তাঁর চাটুকার সভাসদদের অবজ্ঞার মুখেও আমরা কিন্তু বিভীষণকে অটল দেখি - যিনি অবলীলায় রাবণের মুখের ওপর "রাজার পাপেই রাজ্য নষ্ট হয়" বলে দিতে পারেন, তাঁর বুক কাঁপে না। 

বিভীষণ সম্পর্কে তাঁর অন্যান্য ভাইবোনদের কি মহৎ ধারণা সেটা আমরা সূর্পনখার কথাতেই দেখতে পাই - "বিভীষণস্তু ধর্মাত্মা ন তু রাক্ষসচেষ্টিতঃ" - রাক্ষসকুলে একমাত্র বিভীষণই ধর্মনিষ্ঠ (অরণ্যকান্ড ১৭/২৩)। তাহলে মোদ্দা কথা এই যে ঠোঁটকাটা তপঃক্লিষ্ট ধর্মনিষ্ঠ নির্ভীক বিবেকবান ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত অমর বিভীষণকে সবচেয়ে বেশি ভয় কে পেতেন? রাবণ নিজে। আসলে বিভীষণ রাবণের কাছে বিশেষরূপে ভীষণ বা ভয়ঙ্কর বিভীষিকা ছিলেন কারণ দুর্যধনের মতোই রাবণও জানতেন যে তিনি অধার্মিক। 

সেই বিভীষণকে বাঙালি কি বলতে শিখেছে? 'ঘরশত্রু'। ঠিক যেমন দেশের জন্য নিজের প্রাণ হেলায় বলিদান দেওয়া হুতাত্মা বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে বাঙালি 'বার খাওয়া ক্ষুদিরাম' বলে অপমান করে। আজ যখন অযোধ্যাধামে শ্রীরামচন্দ্র স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন তখন বাঙালি তার মানসিক দৈন্য ঝেড়ে ফেলে আবার ধর্মপথে ফিরে যাবে কিনা সেটা বাঙালিকেই ঠিক করতে হবে। অনেক তো নষ্টামী হলো, এবার রাবণ অনুরাগ ত্যাগ করে শাশ্বতকে মানক বলে মেনে নিলে ভালো হয়না?

Wednesday, January 17, 2024

র‍্যালিতে রাম নেই

সনাতন ধর্ম বিশ্বাস নির্ভর নয়, চিন্তন, মনন এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতি নির্ভর। হ্যাঁ, কারোর integrity-র ওপর যদি আমার অপার আস্থা থাকে, তাঁর প্রত্যক্ষ অনুভূতির কথা যদি যুক্তি দিয়ে নতুন করে independently বিচার করার কোনো প্রয়োজনই বোধ না হয়, তাঁর মুখের কথাকেই যদি আমি সত্য বলে বিশ্বাস করি, সেটা অন্য বিষয় যেমন শিশু সরল বিশ্বাসে তার মায়ের কথা মেনে নেয়। কিন্তু by and large ভারতীয় সংস্কৃতিতে blind faith-এর কোনো চলন নেই, প্রশ্ন করার, বাজিয়ে নেওয়ার, তর্ক করার এবং convinced না হলে না মেনে নেওয়ারও সম্পুর্ন অবকাশ আছে। 

ফলে এই ধরণের খোলা মনের চিন্তক এবং তার্কিক একটি সমাজের পক্ষে বিনা বিতর্কে কেবল বিশ্বাস নির্ভর কোনো মতাদর্শকে মেনে নেওয়া তার মূল প্রাচীন কাঠামোটারই পরিপন্থী। এইজন্যই ধর্ম আর পন্থ (faith) আলাদা। There can be a dialogue between faiths, there could even be an interfaith congress where, in the garb of finding commonality, everyone tries to establish how infaliable or brilliant his own faith is (always as a counter perspective to other faiths), but there can never be real harmony between faiths as faith is essentially blind. একজন অন্যজনের মতবাদ সহ্য করতে পারেনা। শ্রীরামকৃষ্ণদেব কেন 'যত মত তত পথ' বলেছিলেন, কেন 'যত ধর্ম' বলেননি, সেটা ভেবে দেখার বিষয় বৈকি।

এখানেই all faith rally নিরর্থক হয়ে যায় কারণ পন্থ নয়, সেই ধর্মবোধ যার আদিও নেই, অন্তও নেই, বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন জাতির মানুষকে একমাত্র সেইই জীবনযাপনের দিশা দেখাতে পারে, সবাইকে মনুষ্যত্বের ছাতার তলায় একাট্টা করতে পারে কারণ তা হাজার হাজার বছর ধরে বহমান human values ভিত্তিক সভ্যতার উপলব্ধির ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে। শ্রীরাম ধর্মের প্রতীক, পন্থের নয়। শ্রীরামকে নিয়ে গত ৭০০০ বছর ধরে যত কাটাছেঁড়া হয়েছে, তাঁর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় যেমন বালীবধ, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, বনবাস এবং মা ধরিত্রীর বুকে ফিরে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর ভূমিকা নিয়ে যত তর্কবিতর্ক হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এটা কিন্তু ভারতবর্ষ ধর্মবোধি বলেই সম্ভব হয়েছে। 

শ্রীরামকে একদিকে বিষ্ণুর অবতার বলে পূজা করা হচ্ছে আর অন্যদিকে তাঁকে নিয়ে তির্যক সমালোচনা চলছে, এটির মূলে একমাত্র পারম্পরিক righteousness, এতটা ছুট অক্ষরে অক্ষরে পন্থীয় নির্দেশ মেনে চলা blind faithful-রা তাঁদের এক-ঈশ্বর সম্পর্কে কল্পনাও করতে পারেন না। ফলে, আগামী ২২শে জানুয়ারি গোটা ভারতবর্ষ এবং সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মের পুনর্জাগরণের পূণ্যদিন, ওদিন মোটেও বিভিন্ন গোঁড়া পন্থাবলম্বীদের একত্রিত করে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার দিন নয়। অবশ্য এর একটা অন্যদিকও আছে। যদি অযোধ্যাধামে পুনর্নির্মিত শ্রীরামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার দিনে এই কার্যক্রমের আড়ে 'পন্থ যার যার, সনাতন ধর্ম সবার' বার্তা দেওয়াই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বিষয়টি অবশ্য অন্য মাত্রা পায়। আমি তো রাজনীতি বুঝি না, ফলে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল ঠিক ধরতে পারছি না।

Saturday, January 13, 2024

রামলালা ও রোমলালা

ইউটিউবে আজ অযোধ্যায় রামপথ, ধর্মপথ ইত্যাদির শোভা দেখতে দেখতে আমার শ্রদ্ধেয় লালকৃষ্ণ আদবানিজি, শ্রদ্ধেয় মুরলি মনোহর যোশীজি, স্বর্গীয় প্রমোদ মহাজনজি, মা স্বাদ্ধী ঋতম্ভরাজি, মা উমা ভারতীজি, আচার্য্য গিরিরাজ কিশোরজি, শ্রদ্ধেয় অশোক সিংহলজি, শ্রদ্ধেয় বিনয় কাটিয়ারজি, শ্রদ্ধেয় কল্যাণ সিংজি, শ্রদ্ধেয় প্রবীণ তোগাড়িয়াজি, শ্রদ্ধেয় বিষ্ণু হরি ডালমিয়াজি, এমন আরো কত মহান বিভূতিদের কথা মনে পড়ছে, যাঁরা হিন্দু সমাজকে প্রেরণা না যোগালে আজ এই পূণ্যদিন হয়তো আমরা দেখতেই পেতাম না। 

৫০০ বছর ধরে অজস্র সংঘর্ষের কথা যদি ছেড়েও দিই, আমাদের জীবদ্দশাতেই কি কঠিন যে ছিল এই লড়াই, যাঁরা মুলায়ম সিংয়ের আদেশে রামভক্তদের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখেছেন বা যাঁরা দিগ্বিজয় সিংয়ের আদেশে রাত আড়াইটার সময় মা ঋতম্ভরাজির গ্রেফতারি এবং তারপর চারদিন ধরে আদালতে পেশ না করে অবৈধভাবে জেলে নির্যাতন করার কথা শুনেছেন অথবা যাঁরা লালু প্রসাদ যাদবের আদেশে পাটনায় শ্রী লালকৃষ্ণ আদবানিজিকে গ্রেফতার করা দেখেছেন, যাঁরা ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দলকে ব্যান করে দেওয়া দেখেছেন বা রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জনপ্রিয় নির্বাচিত সরকারদের বরখাস্ত করে দেওয়া দেখেছেন, তাঁরা জানেন। 

কিছু করেই কেউ কিছু আটকাতে পারেনি, রামমন্দির আজ এক reality, এমনি এমনিই হলো? প্রভু চেয়েছিলেন তাই ধ্বংস হয়েছিল, আজ প্রভু চেয়েছেন, তাই পুনর্নির্মিত হচ্ছে। আর কোনো মহৎ কাজই বলিদান ছাড়া সম্ভব হয় না, যেমন প্রোপাগান্ডায় বিপ্লবীদের আত্মবলিদান আর সুভাষ বসুর সর্বোচ্চ sacrificeকে লুকিয়ে দিয়ে দেশভাগ করা যেতে পারে কিন্তু কোনোদিন স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা যায় না। কিছু ধূর্ত দেখছি রামজন্মভূমি ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক শ্রী চম্পত রাইজিকে নিয়ে প্রচুর জলঘোলা করছেন। ওরা জানেন কি যে কেমেস্ট্রির অধ্যাপক শ্রী রাইকে এমার্জেন্সির সময় ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ১৮মাস জেলবন্ধি করে রেখেছিলেন এবং উনি না থাকলে ওই অবৈধ ধাঁচাটা হয়তো আজও অক্ষত থাকতো? যত্তসব!

দুটো কথা:
১.
ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহু ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ।
যৎস্যাদ্ধারণ সংযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ।।
(মহাভারত : কর্ণপর্ব, ৬৯. ৫৮)
সমাজকে, জনসাধারণকে যা ধারণ করে রাখে, তাই ধর্ম। তাই যাতে জনসাধারণের, সমাজের সমৃদ্ধি এবং কল্যাণ হয়, তার সাথে যুক্ত হওয়াই ধর্ম, এ কথা নিশ্চিতরূপে জেনো।
২.
ন বিভেতি রণাদ্ যো বৈ সংগ্রামেঽপ্যপরাঙ্মুখঃ।
ধর্মযুদ্ধে মৃতো বাপি তেন লোকত্রয়ং জিতম্।। (মহানির্বানতন্ত্র : ৮.৬৭)
যিনি যুদ্ধে ভয় পান না, যিনি সংগ্রামে অপরাঙ্মুখ বা যিনি ধর্মযুদ্ধে মৃত হন, তিনি ত্রিভুবন জয় করেন। যদি স্বদেশের বা স্বধর্মের জন্য যুদ্ধ করিয়া গৃহস্থের মৃত্যু হয় - যোগিগণ ধ্যানের দ্বারা যে পদ লাভ করেন, তিনিও সেই পদ লাভ করিয়া থাকেন। (অনুবাদ: স্বামী বিবেকানন্দ)

আর রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
মুক্ত করো ভয়, নিজের’পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।
ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরি দিয়ো কঠিন পরিচয়॥

Thursday, January 11, 2024

অধিকারবোধ

আমার গুরুবাড়িতে একটি অপূর্ব মাতৃসংগীত গাওয়া হয়, যার কয়েকটা লাইন এমন:
'অহেতুক তব এই ভালোবাসা পারি কিগো মোরা বুঝিতে,
শত জনমের যত পাপ হায় 
দিয়াছি ঢালিয়া ওই রাঙা পায়ে,
সকলই তো তুমি সহিলে হেলায় কোল দিতে কত তাপিতে।'
সত্যি সত্যিই মায়ের শ্রীচরণে দেওয়ার মতন প্রারব্ধ আর কর্মফল ছাড়া কিই বা আছে আমাদের? বাকি কিছুই তো থাকে না - এই শরীর, সম্পত্তি, নাম-যশ সবই তো চলে যায়, একমাত্র কর্মফলটাই বয়ে বেড়াতে হয় জন্ম থেকে জন্মান্তরে। তা, ব্রহ্মময়ীর কাছে ওই কর্মফলটুকু ছাড়া নিবেদন করার মতন আমাদের আর কিই বা আছে? একমাত্র তিনিই তো পারেন প্রারব্ধ নাশ করে মুক্তি দিতে, ফলে ঐটি যদি ঠিকঠিক তাঁর পায়ে সঁপে দেওয়া যায়, কাজ হয়ে যায়। 

বলে নাকি ঈশ্বর যখন অবতার বেশে আসেন, তখন নিজের অসীম ক্ষমতা ভুলে সাধারণ মানুষের মতোই থাকেন, তাঁদের স্বরূপের কথা মনে করিয়ে দিতে হয়। হনুমানজীর ক্ষেত্রে বা শ্রীরামচন্দ্রের ক্ষেত্রে, এমনকি ঠাকুরের ক্ষেত্রেও আমরা বারবার তা দেখেছি। সেই অবতারত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অবস্থাতেও আমরা দেখেছি ঠাকুর মায়ের পায়ে তাঁর সারা জীবনের সাধনার ফল, মায় জপের মালা পর্য্যন্ত অর্পণ করে দায়মুক্ত হচ্ছেন! তবে মা কিন্তু চিরকাল জানতেন তিনি কে, তবুও নিজের রূপ খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখতেন যাতে আমরা সহজেই তাঁর কাছে পৌঁছতে পারি, আবদার করতে পারি, তাঁকে দেবীরূপে নয়, মাতৃরূপে আপনার জন ভাবতে পারি। মা ধরা দেবেন বলেই তো এসেছিলেন, নইলে তাঁকে ধরে এমন সাধ্য কার?

শিহড়ে সারদা মঠে এখনো সেই বেলগাছটি আছে যার তলায় দিদিমা শ্যামাসুন্দরী দেবী বসেছিলেন আর তখনই লাল চেলি পরা একটি ফুটফুটে পাঁচ-ছ বছরের মেয়ে গাছ থেকে নেমে এসে পিঠের দিক থেকে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে, 'আমি তোমার ঘরে এলাম মা' বলে তাঁর উদরে প্রবেশ করে আর তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েন। মা তো তাঁর জন্মবৃত্তান্ত জানতেন, নিজের মুখেই পরে বলেছেন। মায়ের সেবক স্বামী সারদেশানন্দজী লিখেছেন, 'মায়ের করতল ছিল রক্তাভ, অনেকেই তা দেখার সুযোগ পেয়েছেন। পদতলও ছিল লাল - ঠিক স্থলপদ্মের আভা।... দৃষ্টি প্রশান্ত, স্থির, কৃপা মাখানো - যা সকলের অন্তরে সর্বদা করুণা বর্ষণ করতো। প্রশস্ত উজ্জ্বল কপাল, প্রসন্ন মুখ - দেখলেই চিত্ত শান্ত হয়ে যায়'। মায়ের স্বরূপ সম্পর্কে তাঁর নিকটজনদের কোনো বিভ্রান্তি ছিল না, কিন্তু তাও তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ভাব গোপন করে রাখতেন। এই জন্যই তিনি কেবল মা, সকলের মা, তাঁর ঘরের আগল তিনি নিজেই খুলে দিয়েছেন। মায়ের অবারিত দ্বার, যা আর কোনো অবতারে আমরা পাইনা। ঠাকুরের কাছেও কিন্তু অত সহজে যাওয়া যায় না।

আমি আজ ভোরবেলায় ভাবছিলাম মাকে কিভাবে সবচেয়ে বেশি আপন করে পাওয়া যায় - ভক্তি দিয়ে, মনন দিয়ে, তাঁর মনের মতন কাজ দিয়ে, নাকি ভালোবাসা দিয়ে। তারপর মনে হলো মা তো দুহাত বাড়িয়েই রয়েছেন, নিজের মায়ের সাথে কি কেউ লৌকিকতা করে? মা মানেই মাঠ থেকে ধুলো কাদা সব মেখে এসে সন্তানের অধিকারবোধ থেকে নির্বিকারে 'মা খেতে দাও' বলে হাঁক পারা। তারপর মা ঘটি ঘটি জল ঢেলে চান করিয়ে গামছা দিয়ে গা মুছিয়ে পরিষ্কার জামাটামা পরিয়ে ভাত বেড়ে দেবেন, ওটাই মাতৃত্ব। মুখে হয়তো বকাবকি করবেন, কিন্তু ওই একটা জায়গায় কোনো শাস্তির বিধান নেই। ওই কাদা মাখা অবস্থায় বাবার ঘরে ঢুকলে হয়তো সোজা তাড়িয়ে দেবেন, মা কিন্তু কাদা ধোয়ার জন্যই উন্মুখ কারণ রান্না তিনি করেই রেখেছেন আর সন্তান পেটভরে তৃপ্তি করে খেলে, তবেই তাঁর সুখ। তাই মাকে কাছে পেতে গেলে অধিকারবোধ চাই। আমার মা, আমার উদ্ভব যাঁর থেকে, তিনি কোলে টেনে নেবেন না তো কি অন্য পাড়ার খগেন নেবে? আমি যতই কালিঝুলি মেখে আসি না কেন, মা ঠিক পরিষ্কার করে দেবেন, কারণ তিনি আমার মা, আমার নিজের মা। ব্যাস এটুকুই।

আজকের বাঙালি

রাস্তায় বেরোলেই দেখি লোকজন কেমন যেন ক্ষেপে রয়েছে, যেন ধনুকে তির লাগানোই আছে বা ছাইচাপা আগুন, একটু ঘি পড়লেই দপ করে যেন জ্বলে উঠবে। বাড়ির ভেতরে বসেও প্রায়ই শুনি রাস্তায় অচেনা লোকেরা তারস্বরে ঝগড়া করছে, যেন একজন আর একজনকে চূড়ান্ত হেয় করতে পারলে খানিক শান্তি পায়! ঠাকুর বলেছিলেন 'শ স ষ - যে সয় সে রয়, যে না সয় সে নাশ হয়'। সইবার ক্ষমতা তো কোন ছাড়, এখন তো দেখি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে অন্যের ওপর গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে যেন মানুষ একটু হালকা হতে চাইছে, ভেতরে এমন পরিমানে অতৃপ্তির বিষ জমে আছে! 

একজায়গায় শুনেছিলাম একজন যুবক সাধু তাঁর ঊর্ধ্বতন কোনো প্রিয় প্রবীণ সাধুকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে আশ্রমের toxic পরিবেশ তাঁর আর সহ্য হচ্ছে না, তিনি ছেড়ে চলে যাবেন। ভেবেছিলেন বুঝি সহানুভূতি পাবেন। এক লাইনের উত্তর এসেছিল, 'মনে রেখো তোমাকেও অন্যরা সহ্য করছে'। বাঙালি তো বাংলাভাগ পর্য্যন্ত মুখবুজে সহ্য করেছে, আজ তার হটাৎ কি হলো? এত খারাপ মুখের ভাষা, এত কদর্য অঙ্গভঙ্গি, অসুস্থ বা বয়স্ক বা মহিলা বা শিশুর জন্য কোনো বিবেচনা নেই, নামতে নামতে এতটা নীচে নেমে যাওয়া কেন? আমাদের মায়েরাই তো একদিন রাসবিহারী বোস, যতীন মুখার্জি, নরেন দত্ত বা অরবিন্দ ঘোষদের জন্ম দিয়েছিলেন, আজ তাঁরা কোথায় গেলেন?

সেদিন মেট্রো চড়ে কোথাও যাচ্ছিলাম, দেখলাম প্রবীণদের জন্য সংরক্ষিত আসনে এক চ্যাংড়া বসে আছে আর সামনে যে পক্ককেশ মানুষটি হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর দিকে যেন দেখেও দেখছে না। এক ধমক দিতে বাধ্য হলাম, তখন 'দেখে নেব' ভাব করে সে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে কৃতার্থ করলো। আর একদিন অটোয় করে ফিরবো, স্ট্যান্ডে পেছনেই বসে ছিলাম, এক ভদ্রমহিলা আসাতে উঠে সামনে বসতে যাচ্ছি, অটোর চ্যাংড়া হটাৎ তাঁকে বলে কিনা 'এত নখরা থাকলে অটোয় ওঠেন কেন'? ভদ্রমহিলা কিছুই করেননি, আমিই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলাম, ফলে অপমানে থতমত খেয়ে গেছেন। আসলে মহিলা তো, কুশিক্ষার জন্য চ্যাংড়ারা বোধহয় মায়ের জাতকে নরম মাটি ভাবে, তাই একেবারে খ্যাঁক করে উঠলো। বোঝাতে হলো, বেশ কড়া করেই বোঝাতে হলো। স্ট্যান্ডের মাতব্বররা রং দেখাতে এসেছিল, আমাকেও ফোঁস করতে হলো। আসলে এগুলো যেন সব বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। 

নৈরাশ্য থেকে নৈরাজ্য, দশকের পর দশক ধরে সামাজিক, আর্থিক আর নৈতিক অধঃপতন আর স্বপ্নহীনতা এই রাজ্যকে সামাজিকভাবে এমন এক চরম সংকটের মুখে এনে ফেলেছে, যে নিজেরাই নিজেদের আর সহ্য করতে পারছে না, সুযোগ পেলেই একে ওপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পাকিস্তানের টিটিপি যখন পাকিস্তানেরই আর্মিকে আক্রমণ করে, আমরা হাসি আর টিটকিরি দিই। আজ সারা ভারত যে আমাদের দেখে হাসে, টিটকিরি দেয়, সেটা কি আমরা বুঝি? ঠাকুরের পার্ষদ গঙ্গাধর মহারাজ বলেছিলেন, "মাথায় গীতা, হাতে লাঙ্গল আর মুখে রামনাম, তবেই আমাদের পরিত্রাণ"। যত তাড়াতাড়ি এই গুঢ় কথার সারমর্ম বাঙালি অনুধাবন করতে পারবে, ততই তার মঙ্গল।