Tuesday, February 13, 2024

সঙ্কটমোচন, কাশী

আজ সকালে তীর্থযাত্রা সেরে বাড়ি ফিরে এসেছি কিন্তু মন জুড়ে শুধুই তাঁরা সবাই, যাঁদের সান্নিধ্যে গত একটা সপ্তাহ কাটিয়ে এলাম। চোখ বন্ধ করে তো বটেই, চোখ খুলেও তাঁদেরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। গত ৫ই ফেব্রুয়ারি কাশীতে নেমেই এযাত্রায় প্রথম দর্শন করেছিলাম সঙ্কটমোচনকে। এখনো আমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছি আর ঠিক তাঁর বুক বরাবর উল্টোদিকের এক অতি প্রাচীন মন্দিরে বিরাজমান তাঁর ইষ্টদেবকেও, যাঁকে এই মুহূর্তেও হৃদয়ে ধারণ করে তিনি মর্তে বিরাজ করছেন। 

আজ যখনই চোখের সামনে সঙ্কটমোচন ভেসে উঠছেন অমনি মনে পড়ছে তুলসীদাসবাবাজিকেও কারণ তাঁর নিজের হাতে মাটি দিয়ে গড়া ওই অপুরূপ বিগ্রহের মধ্যেই শুধু নয়, তুলসী ছড়িয়ে আছেন ওই ভূমির প্রতিটি কণায়। রচিত হওয়ার সাথে সাথে মানসের কত না দোহা প্রথম শুনেছেন তাঁর প্রাণনাথ আমাদের বাল ব্রহ্মচারী, ওখানকার জঙ্গলের বৃক্ষরাজি, ওখানকার আকাশ, বাতাস, মাটি। 

এখনো ক্রমাগত তাঁর রচিত স্তবই পাঠ হয়ে চলেছে ওই মন্দির চত্বরে, কথক লাগাতার ব্যাখ্যা করে চলেছেন মানসের, ভক্তরা তাঁরই প্রদর্শিত পথে ওখানে যে যাঁর মতন জায়গা খুঁজে নিয়ে রামনামের জপে-ধ্যানে মগ্ন। আমাকে একজন মহাত্মা বলেছিলেন যে মহাবীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গেলে তাঁর সামনে আর তাঁর নিজের সুখ্যাত করতে নেই, রামের গুণগান গাইতে হয়, তাহলেই উনি যারপরনাই প্রসন্ন হন। 

গেট থেকে বাগানের পথ পেরিয়ে আমি যখন তাঁকে দর্শন করতে পৌঁছিয়েছিলাম তখন মন্দিরে বেশ কয়েকজন সমবেত কণ্ঠে জোরে জোরে হনুমান চল্লিশা পাঠ করছিলেন, আমি চুপ করে এককোণে দাঁড়িয়ে প্রথমে মন দিয়ে গোটাটা শুনলাম। তারপর তাঁদের পাঠ শেষ হলে 'জয় রাম জয় রাম জয় জয় রাম' গাইতে গাইতে মহাবীরের সামনে যেতেই কেন জানি না অনুভব হলো যে উনি আমার গান শুনছেন - আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উনি রাম নাম শুনছেন।

ভিড় না থাকলেও লাইন তো একটা ছিলই কিন্তু কেউ আমায় ধাক্কা দিলেন না, কেউ ঠেলে সরিয়ে দিলেন না, ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিশ্চিন্তে তিন তিনবার গোটা নামমন্ত্রটা গাইলাম, তারপর প্রণাম করে ওনার সামনে থেকে চুপচাপ বাঁদিকে সরে গেলাম - এটা আমার মনে আছে। যতক্ষন আমি ওনার সামনে ছিলাম, আমার এই ক্ষীণদৃষ্টি নিয়েই ওই মেটে সিঁদুরের প্রলেপ ভেদ করে ওনার চোখদুটিকে একটু ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করছিলাম আর আমি নিশ্চিত যে উনিও মাথাটা সামান্য বেঁকিয়ে একদৃষ্টিতে আমার দিকেই তখন তাকিয়েছিলেন। 

তুলসী লিখেছিলেন 'শঙ্কর সুবন কেশরী নন্দন, তেজ প্রতাপ মহাজগবন্দন', যদিও তুলসীপীঠাধিশ্বর স্বামী রামভদ্রাচার্য্যজির মতে ওটা ভুল, আসলে তুলসী লিখেছিলেন 'শঙ্কর স্বয়ং কেশরী নন্দন, তেজ প্রতাপ মহাজগবন্দন', যা পরে সাধারণ মানুষের মুখে 'সুবন' হয়ে যায়। আসলে, কেশরী নন্দন মহাদেবের অবতারই হন বা মহাদেব স্বয়ং, তাতে সত্যিই কিই বা আসে যায়?  

দেখি কখনো তিনি রামেশ্বররূপে শ্রীরামচন্দ্রের আরাধ্য, আবার কখনো হনুমানরূপে শ্রীরামচন্দ্রই তাঁর আরাধ্য, এখানে কে ভক্ত আর কেই বা ভগবান, সবই তো এক! ওখানে প্রদক্ষিণ করতে করতে এই কথাটাই ভাবছিলাম আর মনে পড়ে যাচ্ছিল ঠাকুর বলতেন 'ভাগবত ভক্ত ভগবান, তিন এক'। শিব, মহাবীর, রাম, মানস, কাশী - সব এক, সব এক। 

সঙ্কটমোচনে কাশীপতি আর অযোধ্যাপতি দুজনে যেন মিলেমিশে যাচ্ছেন, আবার মন চাইলে আলাদা আলাদা হয়েই চোখের সামনে এখন ভেসেও উঠছেন। এঁদের মধ্যে কে যে কার ভক্ত আর কে যে কার আরাধ্য, তাঁরাই জানেন। মা বলতেন না, 'যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন' - ওটাই সার কথা। সঙ্গে একটি ছবি দিলাম রাম-জানকি মন্দিরের গর্ভগৃহের, অত সুন্দর রামমূর্তি আমি খুবই কম দেখেছি। পরেরবার যখন কাশী যাবো তখন ঐ মন্দিরে দীর্ঘক্ষণ কাটানোর ইচ্ছা প্রবল।

Friday, January 26, 2024

ধর্ম ছাড়া গতি নেই

আমরা যখন জন্মেছিলাম তখন বিশ্বজুড়ে বামপন্থার খুব রমরমা এবং সারা ভারতের মধ্যে অগ্রগণ্য আমাদের এই রাজ্যের সর্বনাশ করার জন্য একদিকে বামেরা আর অন্যদিকে অতিবাম নকশালরা তাদের নিজের নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী তথাকথিত জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য জমি প্রস্তুত করা শুরু করে দিয়েছে। সে হলো কোল্ডওয়ারের যুগ, পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুই ভাবধারাকে আশ্রয় করে দুই মহাশক্তির জোটের মধ্যে শীতল যুদ্ধ, যেখানে আমাদের দেশকে কেউ তেমন পাত্তাই দিত না। 

একটু জ্ঞান হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন বলতে আমরা বুঝতাম খুব উচ্চ কোয়ালিটির কাগজে ছাপা খুবই সস্তার ম্যাগাজিনের রংচঙে হাসিখুশি এক স্বপ্নের মুলুক আর চীন বলতে বুঝতাম প্রচন্ড ডিসিপ্লিনড, কর্মঠ একটা জাতি যেখানে সবাই কাজ পায়, খাবার পায়, চিকিৎসা পায়, ঘর পায়, সবাই সুখী - আমাদের দেশের মতন অভাগা নয়, অসুখী নয়, আমাদের মতন ভয়ঙ্কর অভাবী, ভয়ঙ্কর গরিব, ঘনঘন লোডশেডিং আক্রান্ত, গুচ্ছের শিক্ষিত বেকারওয়ালা, সতীদাহ-জাতপাত কলঙ্কিত, গুরুবাদ-কবলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাপখেলা-বাঁদরখেলা সর্বস্ব একটা অনুন্নত দেশ নয়। 

এদিকে দিদি-জামাইবাবু আমেরিকায় গেল, সেখান থেকে জাপানে, পিকচার পোস্টকার্ডে চিঠি পাঠাতো, দেখে বিস্মিত হতাম। সেও তো স্বর্গ! তারপর দাদারা সব স্কলারশিপ নিয়ে নিয়ে আমেরিকায় পড়তে গেল, গল্প শুনতাম, বিস্মিত হতাম, নিজেদের সাথে মেলাতে পারতাম না। ছোট ছিলাম তো, আমাদের দেশের এই বেহাল দশার অত কার্য কারণ বুঝতাম না, খালি মনে হতো আহা, আমাদের দেশটাও যদি ঐ ছবির দেশগুলোর মতন হতো! সোভিয়েত ইউনিয়নের বইগুলো খুব সস্তায় পাওয়া যেত ফলে ছোটবেলায় যত না আমি ইংলিশ ক্লাসিকাল লিটারেচার পড়েছি তার চেয়ে ঢের বেশি পড়েছি পুশকিন, দোস্তোভয়েসকি, গোর্কি, তলস্তয়, প্রমুখ। 

ব্রন্টে বা ডিকেন্স বা অরওয়েল বা মার্ক টোয়েন বা এইচ জি ওয়েলস বা ডুমা ইত্যাদি ইস্কুলের লাইব্রেরী থেকে নিয়ে পড়েছি, কিনে পড়িনি কোনোদিন কারণ এফর্ড করতে পারতাম না, বাবা ছিলেন না তো। আর পড়েছি বাড়ির আলমারিতে থাকা পোকায় না কাটা বা অল্পকাটা বইগুলো - রবীন্দ্র রচনাবলী, স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী, রামকৃষ্ণ কথামৃত, কিছু পুরাণ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, কালকূট, লীলা মজুমদার, শিবরাম চক্রবর্তী, এলডাস হাক্সলে, বার্থনার্ড রাসেল, জঁ পল সাত্রে, এলবার্ট কামু, ভল্টেয়ার, কান্ট, কে নয় - বুঝি, না বুঝি অবিচারে পড়ে গেছি। 

আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্যি যে আমি বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, শরৎচন্দ্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আশাপূর্না দেবী, বুদ্ধদেব বসু, শক্তি, সুনীল, সমরেশ বসু, বিদ্যা নয়পল, ওরহান পামুখ, গ্যাব্রিয়েল সানচেজ ইত্যাদি অনেকের লেখাই ভালোভাবে পড়েছি অনেক পরে, যবে নিজে রোজগার করে কিনতে পেরেছি। একটা সুবিধা অবশ্য আমার ছিল, আমি যখন যেখানে পড়াশুনা করেছি, ফরচুনেটলি কোথাওই স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নামক রাজনৈতিক অনাচারটির খপ্পরে আমায় পড়তে হয়নি, ফলে আমি 'দাস ক্যাপিটাল' আর 'লেকচার্স ফ্রম কলম্বো টু আলমোড়া' একই উৎসাহের সাথে পড়ার সুযোগ পেয়েছি, কেউ আমার মাথায় ism-এর হাতুড়ি দিয়ে কখনো আঘাত করেনি। 

তাই আমার যে ওয়ালর্ড  ভিউ সেটা সংকীর্ণ নয়, তাতে সবাই আছেন এবং সবটাই অভিজ্ঞতাভিত্তিক। সেই কারণেই তার মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার ব্যাপার তো থেকেই যায়, তাই না? যেদিন সিএনএনের পর্দায় তিয়ানআনমেন স্কয়ারে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে ট্যাঙ্ক চালিয়ে দিতে দেখলাম সেদিন মনে হলো দেং জিয়াও পেং তো মাওয়ের দুষ্ট চতুষ্টয়ের চেয়ে কিছু আলাদা নন, একইরকমের নৃশংস। এরপর যেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল আর একের পর এক সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলোয় মানুষ বিদ্রোহ করতে শুরু করলেন, সেদিন বুঝলাম বৈকি যে ঐ চকচকে ভাবটা কেবল ম্যাগাজিনের প্রোপাগান্ডাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, আসলে তো আম জনতার ঢুঁ ঢুঁ গোপাল আর চাউসেস্কুর বাথরুমে সোনার কল। 

এই ঘটনার অবিলম্বেই যেদিন নিজের রাজ্যে মনের মতন চাকরি না পেয়ে পেটের তাগিদে পৈতৃক বাড়ি, বৃদ্ধা মা, বন্ধুবান্ধব এবং প্রেয়সীকে ছেড়ে চলে যেতে হলো, সেদিন বুঝলাম আমার জন্মের সময়কার ভরা সংসারগুলোকে বামপন্থীরা কিভাবে শ্মশান বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তারপর তো সারা পৃথিবী ঘুরেছি, কত কিছু দেখেছি, কত কিছু পড়েছি, কত অভিজ্ঞতা, জীবনকে উভয়ত কাছ থেকে এবং দূর থেকে দেখতে শিখেছি। যেহেতু কোনো রঙিন কাঁচের বালাই ছাড়াই খোলা মন নিয়ে জীবনকে দেখতে পেরেছি আর ভালো মন্দের বিচার করতে পেরেছি, আমি বিশ্বাস করি আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা objectivity আছে, যা অনেক indoctrinated মানুষেরই নেই। 

এখন সার কথা এই বুঝেছি যে ধর্ম ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানক নেই যার নিরিখে জীবনকে evaluate করা যায়। আমাদের ছেলেবেলায় পা-চাটা আমলা অনেক কমসংখক ছিলেন তো, মন্ত্রী কোনো বেআইনি আদেশ করলে প্রথমে বুঝিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করতেন আর নেহাত fail করলে বলতেন, "লিখে দিন"। ওটাই মোক্ষম দাওয়াই ছিল, বাবা-কাকাদের কাছে শুনেছি। ধর্ম হলো সেই কাগজ যাতে লিখতে গেলে কলজে লাগে। Moralityর বাইরে মন যেতে চাইলেই বলতে হয় "লিখে দিন"। Indic religionগুলো ছাড়া অন্যান্য মতবাদের বহু বইও পড়েছি, তাতে অনেক জায়গাতেই দেখেছি যা লেখা আছে তা ধর্মত ঠিক দাঁড়ায় না, শোধরানো দরকার। কিন্তু যেখানে অন্ধ বিশ্বাসের প্রশ্ন, সেখানে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবেটা কে? সৌদি আরবের যুবরাজ আশার আলো জ্বালিয়েছেন বটে, কতদূর সফল হন সেটা দেখার। 

এতদিন ধরে এতকিছু দেখে আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাদের ছেলেবেলায় যে অনুন্নত ভারত আমরা দেখেছি তা আমাদের ধর্মহীনতার ফল। রাষ্ট্রের জীবনে ধর্ম যদি আবার অর্থ এবং কামকে guide করতে শুরু করে, তাহলে এককালে যেমন ভারত বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে বিত্তশালী, সবচেয়ে আধ্যাত্মিক, সবচেয়ে বিজ্ঞানমনস্ক এবং সাংস্কৃতিকভাবেও সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ ছিল, সেই জায়গাটা সে কয়েক দশকের মধ্যেই ফের ফিরে পাবে। হাজারটা মতবাদ থাকতে পারে, হাজার রকমের বিজাতীয় influence থাকতে পারে, কিন্তু এ দেশের প্রাণভোমরা বেদ আর উপনিষদের মধ্যেই বসে আছে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার অন্যথা হয়নি। 

তর্জমা ছাড়া ওগুলো মূল ভাষায় পড়বো বলেই আমি নিজের চেষ্টায় অল্পস্বল্প সংস্কৃত শিখেছি, খানিকটা পড়েছি, এখনো পড়ছি, ভবিষ্যতেও যতদিন চোখে দেখতে পাবো পড়বো। আমি না পড়ে বা না জেনে বা না ভেবে কোনো কথা বলছি না। যা আমাদের ঋষিরা বলে গেছেন, ওগুলোই ধ্রুববাক্য, আমাদের আর বাইরের মানক দরকার নেই। এত প্রাচীন একটা চলমান সভ্যতার অভিজ্ঞতার ফলে এমন কোনো প্রশ্ন নেই যার উত্তর ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতিতে নেই। যাঁরা এর ছোঁয়া পাননি তাঁরা ডক্টরেট হয়েও মহামূর্খ। আর যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা সামান্য অক্ষরজ্ঞানযুক্ত হলেও মহাজ্ঞানী। প্রমান চাই? একবার রামকৃষ্ণ মিশনের দিকে ভালভাবে তাকিয়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন।

Monday, January 22, 2024

রামের ইচ্ছা

অবধে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার খুশিতে চতুর্দিকে তারস্বরে মাইকে রাম সংক্রান্ত গান বাজছে আর ঘন ঘন পটকা ফাটছে - আজ যেন নতুন এক দিওয়ালির দিন। মন্দির তো কতই তৈরি হয়, বিগ্রহের প্রাণপ্ৰতিষ্ঠাও হয়, কৈ, তাদের ঘিরে এমন আবেগ তো তৈরি হয় না? কেন? অযোধ্যাধামে শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির সবার থেকে আলাদা কারণ এই মন্দির মানুষের ইচ্ছায় তৈরি হয়নি। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি। 

ভারতের মুখ্য চারটি উপাসনার ধারা হলো শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত ও রামায়িত। এছাড়া শিব-পার্বতীর পুত্র কন্যারাও সবাই আলাদা আলাদাভাবে পূজিত হন। লক্ষ্য করে দেখবেন মোটামুটি একই কালখণ্ডে আক্রমণকারীরা মুখ্য ধারাগুলির মধ্যে প্রত্যেকটির মুখ্য পূজাস্থলী - কাশীতে বাবা বিশ্বেশ্বরের জ্ঞানবাপি মন্দির, গোয়ায় শ্রীমাঙ্গেসি শিবমন্দির, মথুরায় শ্রীকৃষ্ণজন্মভূমি মন্দির, অযোধ্যায় শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির, কাশ্মীরে মা ক্ষীরভবানীর মন্দির, কাশ্মীরেই সারদাপীঠ, পাঁচকুলায় ভীমাদেবীর মন্দির, হিরাপুরের চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির ইত্যাদি ধ্বংস করেছিল - অর্থাৎ হিন্দুদের প্রতিটি ধারার মূলেই আঘাত করা হয়েছিল। 

এত অনাচার কি ভগবতেচ্ছা ছাড়াই সম্ভব হয়েছিল যেখানে সবাই জানেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না? যা হয়েছিল তা ভারতবাসীকে ধর্মপথে আনার জন্য ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়েছিল। দীর্ঘদিন বিত্তের জোয়ারে গা ভাসিয়ে আমরা ক্রমশ ধর্মভ্রষ্ট হয়ে পড়ছিলাম এবং আমাদের মধ্যে স্বার্থপরতা তুঙ্গে উঠেছিল। ফলে আমরা একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেছিলাম।

ভেবে দেখবেন, যে সময় যবন আক্রমণ হয় ভারত এক অত্যন্ত উন্নত এবং বড়লোক দেশ ছিল, যার সে সময়ের লোকসংখ্যা অন্ততপক্ষে ১৫/১৬কোটি, অথচ একদল বর্বর গরিব মরুভূমিবাসী ট্রাইবাল লুটেরা এসে আমাদের দেশের বেশ কিছুটা অংশের ওপর ৮০০ বছর ধরে প্রভুত্ব করে গেল যেহেতু আমরা বিভক্ত ছিলাম আর দস্যুরা ছিল একাট্টা। 

একই ব্যাপার ইংরেজ বা পর্তুগিজদের ক্ষেত্রেও খাটে। কজনই বা ইংরেজ থাকতো ভারতবর্ষে? খুব বেশি হলে লাখখানেক। এই লাখখানেক ইংরেজ ৩০ কোটি ভারতীয়র ওপর ২০০ বছর শাসন আর শোষণ করে গেল, ওই একই কারণে - ওরা এক ছিল আর আমরা বিভক্ত। ওরা শান্তি, মনুষ্যত্ব, সৌহার্দের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আমাদের প্রাচীন সভ্যতাকে ভয় করতো কারণ ভালোকে মন্দ চিরকালই ভয় পায়। ফলে ওরা শিক্ষার নাম করে আমাদের নিজেদের সনাতন সংস্কৃতিকেই ঘেন্না করতে শিখিয়েছিল।

সেই সনাতন সংস্কৃতির মূলে প্রাচীন ভারতীয় ঋষি দর্শন বা সনাতন ধর্মবোধ। ধর্ম হলো সেই স্থায়ী মানক যা মানুষকে জাতি, বর্ণ, পন্থ, প্রাদেশিকতা নির্বিশেষে একটা আদর্শ জীবনকে যাপনের জন্য বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। আর যে মুহূর্তে জাতির মধ্যে ধর্মবোধ জাগরিত হয়, সেই মুহূর্তে জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় - সে অনেক বেশি খোলামেলা হয়, অনেক বেশি সহ্যশীল হয়, অনেক বেশি বিবেকবান হয়, তার কামনা পূর্তি আর অর্থলাভের পথ ধর্মের অনুসারী হয় এবং শেষে সে মোক্ষ লাভ করে।

রাম হলেন মূর্তিমান ধর্ম। তিনি মর্য্যাদাপুরুষোত্তম। জাতি হিসেবে যখন আমরা ধীরে ধীরে ধর্মের পথ থেকে সরে যাচ্ছিলাম এবং অতিরিক্ত ভোগবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছিলাম, তখন রামের ইচ্ছাতেই তাঁর মন্দির ধ্বংস হয়েছিল। তারপর গত পাঁচশ বছর ধরে ভারতীয়রা অজস্র মানসিক জ্বালা যন্ত্রণা আর দৈহিক অত্যাচার সহ্য করতে করতে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তাদের ভুলটা কি ছিল। তাই আজ তাদের সকলের হয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

এখন, এত শতাব্দী পরে কেন রামজন্মভূমি মন্দিরের পুনঃপ্রকাশ ঘটলো? কারণ শ্রীরাম চাইলেন, তাই। জাতি হিসেবে আমাদের শাস্তির মেয়াদ শেষ হলো। উনি চাইছেন যে আবার ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করুক এবং তা দেশের প্রত্যেকটি মানুষের ঐক্য ছাড়া সম্ভব নয়। সেই ঐক্য কিভাবে আসবে? একমাত্র ধর্মশ্রয়ী সনাতন সাংস্কৃতির মাধ্যমে। যেই মনে হবে আমরা ধর্মের মাপকাঠি থেকে বিচ্যুত হচ্ছি, অমনি রাম ওই একই অবস্থায় থাকলে কি করতেন, সেটা ভাবলেই সমাধান বেরিয়ে আসবে।

আজ ভারতের জনমানসে রাম আবার নতুন করে জাগ্রত হয়েছেন, জাতির ধর্মবোধ জাগ্রত হওয়ার এটাই পূর্বশর্ত। তাই ভেঙে দেওয়া সমস্ত মন্দিরগুলোর মধ্যে রামমন্দিরই প্রথম পুনর্নির্মিত হলো। রাম কেবল আস্থা নন, আধারও। এখন থেকে আগামী অনেক শতাব্দী এই দেশ রামের ইচ্ছাতেই চলবে, তিনিই পথপ্রদর্শক, তিনিই বিচারক, তিনিই সংস্কারক, মেলাবেন তিনিই মেলাবেন। রাম থাকলে রাক্ষসরা বাঁচতে পারেনা। রামের আশীর্বাদে ভারতে রামরাজ্য ফিরে আসার সূচনা হলো আজ।

রাক্ষসবধ

রাক্ষসরা বারেবারে ঋষিদের যজ্ঞ পন্ড করার চেষ্টা করতো, মনে আছে তো? এখনো করে। তখনও শ্রীরাম রাক্ষস বধ করে ঋষিদের পরিত্রাণ করেছিলেন, আজ আবার নতুন মন্দিরে নতুন বিগ্রহে তাঁর প্রাণপ্রতিষ্ঠা হলো, আবার তিনিই ভারতের ত্রাতা, তিনিই এখন থেকে ধর্মপ্রাণ সৎ ব্যক্তিদের রক্ষা করবেন। আগামী ৯০০ দিনের মধ্যে ভারত আবার রাক্ষসমুক্ত হবে। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আগামী ৯০ দিনের মধ্যেই তার পূর্ণ আভাস আপনারা অনুভব করবেন, তখন মিলিয়ে নেবেন। 

এমনি এমনি তো আর প্রধানমন্ত্রী ওই নতুন কালচক্রের শুরুর কথা বলেননি, উনি অকারণে একটিও শব্দ খরচ করেন না। শ্রীরামকে রাষ্ট্রের চেতনার সঙ্গে জুড়ে যে চারটি কথা উনি বলেছেন, তার মধ্যেই এর অন্তর্নিহিত বার্তা লুকিয়ে আছে, ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন। উনি বলেছেন, "রাম আগুন নন, রাম প্রেরণা। রাম বিবাদ নন, রাম সমাধান। রাম শুধু আমাদের নন, রাম সবার। রাম শুধু বর্তমান নন, রাম অনন্তকাল।" আজ উনি বারেবারে বলেছেন, "দেবতা থেকেই দেশ, আর রাম থেকেই রাষ্ট্রের চেতনা" - বুঝো লোক যে জানো সন্ধান। 

রামের রাক্ষসবধ রাজনীতির ক্ষেত্র দিয়ে শুরু হবে আর সমাজচেতনায় গিয়ে শেষ হবে, যার পরে কেন "আমাদের প্রজন্মকে কালজয়ী হিসেবে বাছা হয়েছে" সেটা সারা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। আজ থেকে হাজার বছর পর নরেন্দ্র মোদি অবশ্যই শরীরে থাকবেন না কিন্তু রাষ্ট্রচেতনারূপী শ্রীরাম থাকবেন কারণ "রামমন্দির স্থাপনা শুধুই বিজয়ের নয়, বিনয়েরও"।

একআধবার যে না ভেবেছি তা তো নয় যে কেন মাত্র বছর পঞ্চাশেক আগে জন্মালুম না, শ্রীশ্রীমাকে সশরীরে দেখতে পেতাম, ঠাকুরের সন্তানদের দেখতে পেতাম, রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পেতাম, ডাক্তারজিকে দেখতে পেতাম, নেতাজিকে দেখতে পেতাম, ইত্যাদি। মনে হতো হয়ত জন্মজন্মান্তরে এত সুকৃতি জমা হয়নি যে ওঁদের সাক্ষাৎ দর্শন পাবো। আজ বুঝছি সেই ভাবনাটা ঠিক ছিল না, আমার জন্যেও মা এক অনাবিল আনন্দের হাট খুলে রেখেছিলেন। 

এই বিশেষ সময়টাতে কেন আমি এই শরীরটায় আছি? নিজের চোখে রামমন্দিরের পুনর্নির্মাণ, রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা এবং তদ্পরবর্তীকালে মর্য্যাদা পুরুষোত্তমের আশীর্বাদে ভারতবর্ষের জনমানসে ধর্ম-আধারিত ব্যাপক সদর্থক পরিবর্তন এবং শ্রীজির আশীর্বাদে পুনরায় ভারতের জগৎশীর্ষে আরোহণ স্বজ্ঞানে অনুভব করতে পারবো বলে। এই তো প্রারব্ধ। This life is certainly worth living. জয় শ্রীরাম, জয় জয় শ্রীরাম। যেমন শ্রী অর্থাৎ সীতা ছাড়া রাম অসম্পূর্ণ, তেমনই রাম ছাড়া ভারতও শ্রীহীন, মলিন।

Saturday, January 20, 2024

শ্রীরামমন্দির

আমরা ভারতীয়রা এবং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ যে মন্দিরটির জন্য নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী কিছু না কিছু অর্থ বা শ্রমদান করেছি, শ্রীরামচন্দ্র ভগবানের সেই মন্দির আজ সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। যা প্রয়োজন ছিল তার দশগুন বেশি অর্থদান দিয়েছি আমরা, ফলে মন্দির প্রাঙ্গণ দশগুন বেশি ভব্য হয়ে উঠছে, যে দরজা কাঠের হওয়ার কথা ছিল, তা সোনার হয়েছে। এই মন্দির আমাদের সকলের একান্ত ইচ্ছা, আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং দীর্ঘ সংঘর্ষের প্রতীক - এক কথায় বলতে গেলে শ্রীরামজন্মভূমি মহাতীর্থক্ষেত্র সামগ্রিকভাবে আধুনিক ভারতীয়দের ধর্মাশ্রিত জীবনযাপনের ইচ্ছার প্রতিভূ, যে ধর্মবোধ হাজার হাজার বছরের আঘাত সহ্য করেও আমাদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে এখনো জীবন্ত এবং চলমান রাখতে সাহায্য করেছে। 

আমরা অন্যদের চেয়ে আলাদা, তাই আজ পর্যন্ত কেউ গায়ের জোরে বা লোভ দেখিয়ে আমাদের গিলে ফেলতে পারেনি - এই মন্দির সেই অন্যনতার জ্বলন্ত নিদর্শন। আমরা সবাই মিলে চেয়েছি, তাই রামমন্দির সম্ভব হয়েছে। এ কেবল আমাদের আস্থার বিষয় নয়, এ আমাদের জাতীয় অস্মিতার বিষয়, আমাদের মূল সংস্কারকে সংরক্ষিত রাখার বিষয়, জাতি হিসেবে আমাদের সম্মিলিত চেতনার বিষয়। আগামীকাল যখন শ্রীশ্রীরামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে, তখন আমরা প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ ভারতবাসী যজমান হিসেবে ওখানেই উপস্থিত থাকবো - হয়তো সশরীরে নয়, আমাদের প্রতিনিধি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে। এবং প্রধানমন্ত্রী সেটা জানেন বলেই ১১দিন ধরে যজমানের কৃতকর্তব্য হিসেবে এত যম-নিয়ম-দর্শন পালন করছেন। 

যখনই সামাজিক মাধ্যমে ফুটে ওঠা শ্রীরামমন্দিরের দিব্য সাজসজ্জার ছবি দেখছি, গর্বে আনন্দে শ্রদ্ধায় বিশ্বাসে আমার মাথা নত হয়ে যাচ্ছে। আহা, এ কি মনোরম রূপ তুমি গ্রহণ করেছ প্রভু, দেখে দেখে যে আর আশ মেটে না ! ছোটবেলা থেকে শুনতাম চোখের দেখা সার্থক হলো কিন্তু তার সত্যিকারের মানে কখনো বুঝিনি, আজ বুঝলাম। যা দেখছি তা আমার স্বপ্নের প্রতিরূপ, আমার অভিলাষার প্রতিরূপ, আমার অস্তিত্বের প্রতিরূপ, আমার বোধের প্রতিরূপ, আমার ভারতীয়ত্বের প্রতিরূপ। কেবল এই তীর্থদর্শনটুকুর স্বাদ পাওয়ার জন্যই বারেবারে যেন এ দেশের মাটিতেই আমার জন্ম হয়, কারণ এর মাধ্যমেই একদিন আমি শুদ্ধ মুক্ত চৈতন্য হবো।

বিভীষণ

বিভীষণ - বিশেষরূপে ভীষণ - কার জন্য? প্রজাপতি ব্রহ্মার বরে বিভীষণ অমর, ফলে যুদ্ধারোপিত মৃত্যুভয়ে তো আর তিনি রামের পক্ষ অবলম্বন করেননি, রাজ্যলাভের লোভেও নয় কারণ তিনি যে জন্মাবধি ধর্মাত্মা, তাঁর জন্মের সময় দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করেছিলেন (তস্মিন্ জাতে মহাসত্ত্বে পুষ্পবর্ষং পপাত হ - উত্তরকান্ড ৯/৩৬)। রাবণের ভয়ঙ্কর ক্রোধ এবং তাঁর চাটুকার সভাসদদের অবজ্ঞার মুখেও আমরা কিন্তু বিভীষণকে অটল দেখি - যিনি অবলীলায় রাবণের মুখের ওপর "রাজার পাপেই রাজ্য নষ্ট হয়" বলে দিতে পারেন, তাঁর বুক কাঁপে না। 

বিভীষণ সম্পর্কে তাঁর অন্যান্য ভাইবোনদের কি মহৎ ধারণা সেটা আমরা সূর্পনখার কথাতেই দেখতে পাই - "বিভীষণস্তু ধর্মাত্মা ন তু রাক্ষসচেষ্টিতঃ" - রাক্ষসকুলে একমাত্র বিভীষণই ধর্মনিষ্ঠ (অরণ্যকান্ড ১৭/২৩)। তাহলে মোদ্দা কথা এই যে ঠোঁটকাটা তপঃক্লিষ্ট ধর্মনিষ্ঠ নির্ভীক বিবেকবান ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত অমর বিভীষণকে সবচেয়ে বেশি ভয় কে পেতেন? রাবণ নিজে। আসলে বিভীষণ রাবণের কাছে বিশেষরূপে ভীষণ বা ভয়ঙ্কর বিভীষিকা ছিলেন কারণ দুর্যধনের মতোই রাবণও জানতেন যে তিনি অধার্মিক। 

সেই বিভীষণকে বাঙালি কি বলতে শিখেছে? 'ঘরশত্রু'। ঠিক যেমন দেশের জন্য নিজের প্রাণ হেলায় বলিদান দেওয়া হুতাত্মা বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে বাঙালি 'বার খাওয়া ক্ষুদিরাম' বলে অপমান করে। আজ যখন অযোধ্যাধামে শ্রীরামচন্দ্র স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন তখন বাঙালি তার মানসিক দৈন্য ঝেড়ে ফেলে আবার ধর্মপথে ফিরে যাবে কিনা সেটা বাঙালিকেই ঠিক করতে হবে। অনেক তো নষ্টামী হলো, এবার রাবণ অনুরাগ ত্যাগ করে শাশ্বতকে মানক বলে মেনে নিলে ভালো হয়না?

Wednesday, January 17, 2024

র‍্যালিতে রাম নেই

সনাতন ধর্ম বিশ্বাস নির্ভর নয়, চিন্তন, মনন এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতি নির্ভর। হ্যাঁ, কারোর integrity-র ওপর যদি আমার অপার আস্থা থাকে, তাঁর প্রত্যক্ষ অনুভূতির কথা যদি যুক্তি দিয়ে নতুন করে independently বিচার করার কোনো প্রয়োজনই বোধ না হয়, তাঁর মুখের কথাকেই যদি আমি সত্য বলে বিশ্বাস করি, সেটা অন্য বিষয় যেমন শিশু সরল বিশ্বাসে তার মায়ের কথা মেনে নেয়। কিন্তু by and large ভারতীয় সংস্কৃতিতে blind faith-এর কোনো চলন নেই, প্রশ্ন করার, বাজিয়ে নেওয়ার, তর্ক করার এবং convinced না হলে না মেনে নেওয়ারও সম্পুর্ন অবকাশ আছে। 

ফলে এই ধরণের খোলা মনের চিন্তক এবং তার্কিক একটি সমাজের পক্ষে বিনা বিতর্কে কেবল বিশ্বাস নির্ভর কোনো মতাদর্শকে মেনে নেওয়া তার মূল প্রাচীন কাঠামোটারই পরিপন্থী। এইজন্যই ধর্ম আর পন্থ (faith) আলাদা। There can be a dialogue between faiths, there could even be an interfaith congress where, in the garb of finding commonality, everyone tries to establish how infaliable or brilliant his own faith is (always as a counter perspective to other faiths), but there can never be real harmony between faiths as faith is essentially blind. একজন অন্যজনের মতবাদ সহ্য করতে পারেনা। শ্রীরামকৃষ্ণদেব কেন 'যত মত তত পথ' বলেছিলেন, কেন 'যত ধর্ম' বলেননি, সেটা ভেবে দেখার বিষয় বৈকি।

এখানেই all faith rally নিরর্থক হয়ে যায় কারণ পন্থ নয়, সেই ধর্মবোধ যার আদিও নেই, অন্তও নেই, বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন জাতির মানুষকে একমাত্র সেইই জীবনযাপনের দিশা দেখাতে পারে, সবাইকে মনুষ্যত্বের ছাতার তলায় একাট্টা করতে পারে কারণ তা হাজার হাজার বছর ধরে বহমান human values ভিত্তিক সভ্যতার উপলব্ধির ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে। শ্রীরাম ধর্মের প্রতীক, পন্থের নয়। শ্রীরামকে নিয়ে গত ৭০০০ বছর ধরে যত কাটাছেঁড়া হয়েছে, তাঁর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় যেমন বালীবধ, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, বনবাস এবং মা ধরিত্রীর বুকে ফিরে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর ভূমিকা নিয়ে যত তর্কবিতর্ক হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এটা কিন্তু ভারতবর্ষ ধর্মবোধি বলেই সম্ভব হয়েছে। 

শ্রীরামকে একদিকে বিষ্ণুর অবতার বলে পূজা করা হচ্ছে আর অন্যদিকে তাঁকে নিয়ে তির্যক সমালোচনা চলছে, এটির মূলে একমাত্র পারম্পরিক righteousness, এতটা ছুট অক্ষরে অক্ষরে পন্থীয় নির্দেশ মেনে চলা blind faithful-রা তাঁদের এক-ঈশ্বর সম্পর্কে কল্পনাও করতে পারেন না। ফলে, আগামী ২২শে জানুয়ারি গোটা ভারতবর্ষ এবং সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মের পুনর্জাগরণের পূণ্যদিন, ওদিন মোটেও বিভিন্ন গোঁড়া পন্থাবলম্বীদের একত্রিত করে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার দিন নয়। অবশ্য এর একটা অন্যদিকও আছে। যদি অযোধ্যাধামে পুনর্নির্মিত শ্রীরামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার দিনে এই কার্যক্রমের আড়ে 'পন্থ যার যার, সনাতন ধর্ম সবার' বার্তা দেওয়াই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বিষয়টি অবশ্য অন্য মাত্রা পায়। আমি তো রাজনীতি বুঝি না, ফলে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল ঠিক ধরতে পারছি না।