Sunday, October 31, 2021

হিন্দুর কেন শত্রুবোধ থাকবে?

আজকাল প্রযুক্তির যুগে যা শুনতে চাইনা, তাও কিভাবে যেন ঠিক কানে চুঁইয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কবে যেন শোনা গেল একজন বিদগ্ধজন একটি চমৎকার বক্তৃতার শেষে বলছেন যে আজকে হিন্দুদের 'শত্রুবোধ' থাকা উচিত। ভদ্রলোক কি অর্থে এই কথাটি বলেছেন আমি তার মধ্যে ঢুকছি না কিন্তু কাকে আমরা শত্রু বলছি, সবার আগে বোধহয় সেই বোধটা থাকা দরকার - তারপর প্রয়োজনীয়তা বা অপ্রয়োজনীয়তার প্রশ্ন আসে। ইংরেজিতে কয়েকটি উৎকৃষ্ট শব্দ আছে, যার মধ্যে কোনটা যে ঠিক ঠিক শত্রুত্বকে ব্যাখ্যা করে, স্পষ্ট করে বুঝতে পারলে বড় সুবিধা হতো। Enemy, Opponent, Adversary, Foe না Antagonist - কে আসল শত্রু কারণ সবই তো কেবল ভিন্ন ভিন্ন স্তরের অ-মিত্রতা? 

বাংলা অভিধানেও শত্রুর অর্থ হিসেবে দুটি আলাদা পর্যায়ের অ-মিত্রতার ব্যাখ্যা আছে - ১. মনে মনে বা প্রকাশ্যে ঘৃণা করে কিংবা ক্ষতিসাধন করে এমন ব্যক্তি; অরি, বৈরী; ২. প্রতিপক্ষ, বিপক্ষ। আবার আমাদের প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে একটু অন্যরকম শত্রু দেখছি - তার কয়েকটি negative, আবার কয়েকটি positive ও বটে। ওতে যেমন বাতশত্রু, পিত্তশত্রু, কাফশত্রু ইত্যাদি আছে, তেমনিই ঘৃতশত্রু, দুগ্ধশত্রুও আছে আবার বুদ্ধিশত্রু, জ্ঞানশত্রু আর আত্মশত্রুও আছে। বিষয়টা তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় যে শত্রুতা একটি দৈহিক বা মানসিক অবস্থান বিশেষ, যাকে opportunityতে বদলে দেওয়ার উপায় খোঁজাই হলো সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি।

আবার অন্যদিকে ঋগ্বেদে প্রথম যেখানে শত্রুতার উল্লেখ পাচ্ছি তা বৈরী মানসিকতা সংক্রান্ত, সরাসরি বৈরীতা সংক্রান্ত নয়। ঋষি প্রশ্ন করেছেন,

ज्योक्चि॒दत्र॑ तस्थि॒वांसो॑ अक्रञ्छत्रूय॒तामध॑रा॒ वेद॑नाकः ॥ ১.৩৩.১৫

jyok cid atra tasthivāṃso akrañ chatrūyatām adharā vedanākaḥ ||

ইংরেজিতে: “do you inflict sharp pains on those of hostile minds, who have long stood against us.”

এক্ষেত্রে এমন একজনকে আঘাত করার কথা বলা হচ্ছে যিনি বৈরী মানসিকতার বশবর্তী হয়ে দীর্ঘদিন বিরুদ্ধতা করে আসছেন। অর্থাৎ যিনি একত্রে মানসিকরূপে ও সামাজিকরূপে আমার বিরোধী এবং যাঁর কর্মকান্ডের ফলে আমি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত - তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, প্রয়োজনে প্রত্যাঘাতও করা যায়, কিন্তু সবটাই অনেকদিন সহ্য করার পর এবং ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে। উল্লেখ্য যে এখানে গোটা প্রতিক্রিয়াটাই কিন্তু retrospective ও reciprocal - পূর্বনির্ধারিত বা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, অর্থাৎ শত্রুবোধজাত নয় - কর্তব্যজাত, প্রতিকারগত, deterrent।

প্রাচীন ভারতে মর্য্যাদা-আধারিত সামাজিক সীমারেখার বিশেষ সন্মান ছিল এবং এই মর্য্যাদা নির্ধারিত হতো ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত ধর্মবোধের দ্বারা। সমস্ত সম্পর্কের ভিত্তি ছিল এই স্বতন্ত্রতার সীমারেখা আর তা লঙ্ঘন করা পাপ বলেই বিবেচিত হতো। শ্রীরামচন্দ্রের বা শ্রীকৃষ্ণের জীবন দেখলেই আমরা বুঝতে পারি যে কিভাবে ধর্মভিত্তিক দায়িত্ববোধ তাঁদের সমস্ত নির্ণয়কে আলোকিত করতো। সাথে সাথে এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিরোধিতা কখনোই শক্তির প্রমাণ নয়। শক্তিমান তিনি, যিনি সহনশীল, সহ্য করতে পারেন। সাধারণত অপরে সীমারেখা অতিক্রম করলে ক্রোধ উৎপন্ন হয় আর ক্রোধ থেকেই শত্রুবোধের জন্ম হয়। ক্রোধ বুদ্ধিকে বিচলিত করে তোলে। আর বুদ্ধিবিভ্রাট মানেই পতন। যখন হৃদয় থেকে ক্রোধ দূর হয়ে যায়, তখনই সহনশক্তি ধর্মের শক্তিতে পরিণত হয়। ক্রোধ থেকে প্রতিশোধের জন্ম হয় আর ধর্ম থেকে ন্যায়ের। এই দুই অবতারের জীবনে শুধুই ন্যায়, মর্য্যাদারক্ষা আর কর্তব্যবোধ, কোথাও কোনো ক্রোধও নেই, শত্রুবোধও নেই। এটা শিক্ষণীয়।

আসলে মানুষের সত্যিকারের শত্রুকে চিহ্নিত করার উপায় শ্রীকৃষ্ণ গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন:

উদ্ধরেদাত্মনাত্মনং নাত্মনমবসাদয়েৎ। 

আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।।৫।।

অনুবাদঃ মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্বারা আত্মাকে  অধঃপতিত করা কখনই উচিত নয়। মনই জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে। 

বন্ধুরাত্মনস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ। 

অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ।।৬।।

অনুবাদঃ যিনি তাঁর মনকে জয় করেছেন, তাঁর মন তাঁর পরম বন্ধু কিন্তু ‍যিনি তা করতে অক্ষম, তাঁর মনই তাঁর পরম শত্রু। 


আসল জীবনটা তো সরলরেখায় চলে না, ফলে সামাজিক শত্রুতারও বিভিন্নতা আছে, সময় বিশেষে যার স্তরান্তরণও ঘটে, বাস্তবিকই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। মতান্তর থেকে মনান্তর, মনান্তর থেকে ক্রোধ, ক্রোধ থেকে বিদ্বেষ, বিদ্বেষ থেকে শত্রুভাবাপন্নতা, এবং শত্রুভাব থেকে অনাত্মীয়তা, অসামাজিকতা, অসহিষ্ণুতা এবং দৌরাত্ম - এটাই যেন ইদানিং অহিন্দুসুলভ অসামাজিক যাপনের অঙ্গ হয়ে পড়েছে। বস্তুতঃ, মতান্তর যদি শত্রুতার ভিত্তি হয় তাহলে সামাজিক ভিন্নতা এবং বহুমাত্রিকতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে এবং সমাজে মানুষের স্বাধীন চিন্তার কোনো স্থান থাকে না, যা হিন্দুদের সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতির একেবারে বিপরীত। আমাদের প্রত্যেকের ভেবে দেখা উচিত ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য শত্রুবোধের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে নাকি ধর্মবোধ আর নিজের সমাজ-সংস্কৃতিকে রক্ষা করার প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা ও উপলব্ধিসঞ্জাত কর্তব্যবোধই যথেষ্ট।


আমাদের ভেবে দেখা দরকার যে ভবিষ্যতে আমরা আদৌ প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতির প্রকৃত ধারক এবং বাহকরূপে এক স্থিতপ্রজ্ঞ বহুমাত্রিক modern achiever race হিসেবে চিহ্নিত হতে চাই নাকি পন্থতান্ত্রিকদের মতন ভিন্নতাবিরোধী কুপমণ্ডূক জঙ্গি মানসিকতাসম্পন্ন এক ঘৃণ্য জনগোষ্ঠী হিসেবে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করতে চাই। চিরায়ত ভারত এই অনিত্য শত্রুবোধ-মিত্রবোধের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে জীবনের আসল মানে খুঁজে পেয়েছিল। সেটাই শাশ্বত, বাকিটা কেবল দুপয়সার সস্তা রাজনীতি।

Monday, October 25, 2021

কর্পোরেট বার্নআউট থেকে মুক্তির উপায়

 চোখের সামনে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে কর্পোরেট বার্নআউটের বীভৎস রূপটি দেখছি আর ভাবছি মানুষের মনে জাগতিক চাহিদা সম্পর্কে একটু awareness জগলেই তারা আখেরে কি পাওয়ার জন্য 'চাই চাই' করে দিকবিদিকজ্ঞানশূন্যের মতন আচরণ করতে শুরু করে? এত কষ্ট করে চোখকান বন্ধ করে পড়াশুনা করা, এত compitition এর মধ্যে দিয়ে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করা, তারপর কর্পোরেট হানিমুন শেষ হয়ে গেলেই গুচ্ছের বিরক্তি, অশান্তি, ভয়, বেদনা, anxity, stress নিয়ে আধপাগল হয়ে যাওয়া- আখেরে কিসের জন্য? 


জীবনধারণের জন্য রোজগার চাই, অবশ্যই চাই - সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু জীবনের মূল উদ্দেশ্যটাই যদি রোজগারের হাঁড়িকাঠে বলি হয়ে যায়, তাহলে সেই প্রাণঘাতি রোজগারের প্রয়োজন কোথায়? কর্পোরেটদের যাঁতাকলে পিষে পিষে - এটাকেই সারা জীবনের ভবিষৎ বলে ধরে নিয়ে জীবনের প্রতিই কি মারাত্মক bitterness জন্মায় - অবিশ্বাস্য! সমস্ত সময় মন খারাপ, সমস্ত সময় অপ্রাপ্তি, সর্বক্ষণ দুঃশ্চিন্তা, কিছুতেই শান্ত না হতে পারা, কোনোকিছুই নিরবিচ্ছিন্নভাবে সম্পুর্নরূপে উপভোগ করতে না পারা - এই জন্যই কি ঈশ্বর মানুষের দেহ-মন দিয়েছেন?


এরা কেউ আশেপাশে থাকলে অজান্তেই একটা অশান্তির বলয় সৃষ্টি হয়। এদের আচার-ব্যবহারে কিছু telltale signs থাকে যেমন কথায় কথায় বিরক্তি প্রকাশ করা, ঝাঁঝিয়ে উঠে কথা বলা, যেখানে সম্ভব oneupmanship, একটু নরম মাটি পেলেই ভেতরের যন্ত্রণার ঠান্ডা বা গরম ক্রোধরূপে বহিঃপ্রকাশ, সর্বক্ষণ স্মার্টফোনে আর ল্যাপটপে ডুবে থাকা, মন সম্পূর্ণরূপে নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, জাগতিক খেলনায় ক্ষনিকের আনন্দ খোঁজা আর পয়সার জন্য সর্বদা লালায়িত - যেন অনেক বেশি পয়সা জমানো থাকলেই মন নিশ্চিন্ত থাকবে আর সমস্ত দুঃখকষ্টের অবসান হবে! আবার মজার ব্যাপার হলো, হাতে টাকা থাকা স্বত্তেও এরা ফস করে যেখানে সেখানে ক্রেডিট কার্ড বের করেন কারণ ক্রেডিট হিস্ট্রি তৈরি করা দরকার - ঋণী হওয়ার পথ সুগম করার জন্য! হায়রে! 


আসলে এদের দোষ নেই - দুনিয়াটাই ভুল ছন্দে চলছে। ছোটবেলা থেকে মানুষ শিখছে কিভাবে অন্যের দুঃখে সুখী হতে হয়, কিভাবে অনিত্যের নিরিখে নিজের মূল্যায়ন করতে হয়, কিভাবে অন্দরের দ্বার বন্ধ করে শুধুমাত্র বাইরে সুখের চাবিকাঠির জন্য হাতড়ে মরতে হয়। লেখাপড়ার মধ্যে ইতিহাস, ভূগোল, রসায়ন, পদার্থ সবকিছু আছে, কেবল উপলব্ধির অঙ্কটি নেই। শিক্ষার পুরো বৃত্তটাই জাগতিক - সেই জগৎ যা নতুন শরীর ধারণ করলে আর চেনার উপায় নেই - সেই ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, সম্পত্তি, সোনাদানা, পরিবার পরিজন যা প্রতিদিন গভীর ঘুমে গায়েব হয়ে যায় আর চোখ খুললেই ফিরে আসে কিন্তু বর্তমান শরীর parmanently চোখ বোঝার পর parmanently গায়েব হয়ে যায় - নতুন শরীর নিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও যাকে আর চেনা যায়না - এর জন্যই জীবনপাতের কুশিক্ষা এবং যুক্তিহীন যাপন।


বাবা মা হিসেবে আমাদের ভেবে দেখা দরকার কি ধরণের সংস্কার আমরা আমাদের সন্তানদের দিচ্ছি - তারা কিন্তু আমাদের দেখেই শিখছে। যা নিয়ে তারা জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে নামছে তার ভেতর চক্রবুহ্য থেকে বেরোনোর শিক্ষাও আছে তো? আমরা আমাদের নিজেদের সারাজীবনের অকারণ পাগলামি তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি না তো? আমরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মচিন্তন আর আত্মবোধ শেখাচ্ছি তো? তবে সবার আগে, আমরা নিজেরা ইঁদুর দৌড়ের অসারতা উপলব্ধি করে তার থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছি তো? কাজ তো করতেই হবে, জরুরিও বটে। কিন্তু সেই কাজের উদ্দেশ্যটি কি আমরা ছেলেমেয়েদের শিখিয়েছি? শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী খুব সহজ করে বুঝিয়েছেন, “কাজ করা চাই বইকি; কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন কেটে যায়, তবে নিষ্কাম ভাব আসে। একদন্ডও কাজ ছেড়ে থাকা উচিত নয়”। কিন্তু সেই কর্ম নিষ্কাম হতে হবে, বাসনা থাকলেই বিপদ। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলছেন, "যতক্ষন তোমার সঙ্গে বাসনা, ততক্ষণই ভাবনা আর এই ভাবনাই হল তোমার দুঃখ কষ্ট মোহ মায়ার কারণ.."। এই হলো লাখ কথার এক কথা।


প্রথম শিক্ষা হলো প্রেম - সার্বজনীন প্রেম। উদাহরণস্বরূপ, আমার ফুসফুস কি শুধুই আমার শরীরের ভেতরে, তার বাইরে নেই? ওই যে জানলা দিয়ে রাস্তার ধারের গাছটা দেখতে পাচ্ছি, সে কি আমার ফুসফুসের অন্য অংশটি নয়? সে যা ছাড়ছে সেটাই তো আমার প্রাণবায়ু - সেই অক্সিজেন দিয়েই তো আমার ফুসফুস কাজ করছে। আর আমি যা ছাড়ছি সেটা ওই গাছটির প্রাণবায়ু, তা দিয়ে সে বেঁচে আছে, আমার জন্য অক্সিজেন তৈরি করছে। তাহলে আমারই ফুসফুসের অন্য অংশটির ক্ষতি কি আমার ক্ষতি নয়? তারপর ধরুন তাতে যে পাখিরা বাসা বেঁধে আছে, তার ফুলের মধু খেতে যে মৌমাছিরা আসছে - তাদের মাধ্যমেই তো তার বীজ ছড়াচ্ছে, তার ফল ফলছে, আমার জন্য আরো প্রাণবায়ু তৈরি হচ্ছে - তারাও কি আমার অস্তিত্বের অংশ নয়, তাদের প্রত্যেকের প্রতি প্রেমও কি আমার আত্মপ্রেমেরই প্রকাশ নয়? শ্রীশ্রীমা বলছেন, “জগৎকে নিজের করে নিতে শেখো | কেউ পর না, জগৎ তোমার”। সর্বজনে প্রেম, সর্বভূতে প্রেম - এই অখিল ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি কণা আমারই extension, ফলে ভেতরে বাইরে সবই আমি আর সবই আমার - এটা হলো প্রথম শিক্ষা।


দ্বিতীয় শিক্ষা হলো মন ও মনের মধ্যে ক্রমাগত বুদবুদের মতন ভেসে ওঠা বাসনাদের নিয়ন্ত্রণ - যেটুকু প্রয়োজন শুধু সেটুকুই চাওয়া, তার ওপরে বাকি সব চাওয়া হলো চৌর্যবৃত্তি, অর্থাৎ অন্যের allocation এ ভাগ বসানো। বাসনা প্রসঙ্গে ঠাকুর বলছেন, "যার যেমন ভাব তার তেমনি লাভ; ভগবান্ কল্পতরু। তাঁর কাছে যে যা চায়, সে তাই পায়। গরীবের ছেলে লেখাপড়া শিখে হাইকোর্টের জজ হয়ে মনে করে, "আমি বেশ আছি।" ভগবানও তখন বলেন, "তুমি বেশ থাক।" তারপর যখন সে পেনশন নিয়ে ঘরে বসে, তখন সে বুঝতে পারে এ জীবনে কল্লুম কি? ভগবানও তখন বলেন, "তাই তো, তুমি কল্লে কি?"। আবার অন্য একজনকে বাসনাহীনতা সম্পর্কে বলছেন, "বাসনাহীন মন কেমন জান? যেন শুকনো দেশলাই - একবার ঘষলে দপ করে জ্বলে উঠে। আর ভিজে হলে ঘষতে ঘষতে কাঠি ভেঙ্গে গেলেও জ্বলে না। সেইমত সরল, সত্যনিষ্ঠ, নির্মল-স্বভাব লোককে একবার উপদেশ দিলেই ঈশ্বরানুরাগের উদয় হয়। বিষয়াসক্ত ব্যক্তিকে শত শতবার উপদেশ করলেও কিছু হয় না।" এই বাসনা নিয়ন্ত্রণ একমাত্র সবার প্রতি প্রেম থেকেই আসে অর্থাৎ 'আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেলে আমারই আত্মজর জন্য খাবার কম পড়ে যাবে, বেচারা অভুক্ত থাকবে' - এই একাত্মবোধটা থাকা খুব দরকার। এর থেকেই দয়াভাব আসে। শ্রীশ্রীমা বলছেন, “যে অল্পেতে তুষ্ট থাকে, তার কাছে এই পৃথিবীর সব কষ্ট সহজ হয়ে যায়”। আবার অন্য আরেকজনকে শ্রীশ্রীমা বলছেন, “ভগবান দর্শন বলো, ধ্যান বল, সবই মন। নিত্য ধ্যান করবে। কাঁচা মন কিনা? ধ্যান করতে করতে মন স্থির হয়ে যাবে। সর্বদা বিচার করবে। যে বস্তুতে মন যাচ্ছে তা অনিত্য চিন্তা করে ভগবানে মন সমর্পণ করবে”। এই হলো দ্বিতীয় শিক্ষা।


তৃতীয় শিক্ষা হলো মায়াকে বোঝা ও তাকে পাশ কাটিয়ে আত্মোপব্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়া। আসলে ঠাকুরের মতন সহজ করে বোঝানো মুশকিল, তাই এই প্রসঙ্গেও ঠাকুরের কথাই তুলে ধরা যাক, "জীবাত্মা-পরমাত্মার মধ্যে এক মায়া-আবরণ আছে। এই মায়া-আবরণ না সরে গেলে পরস্পরের সাক্ষাৎ হয় না। যেমন অগ্রে রাম, মধ্যে সীতা এবং পশ্চাতে লক্ষ্মণ। এস্থলে রাম পরমাত্মা ও লক্ষ্মণ জীবাত্মাস্বরূপ, মধ্যে জানকী মায়া-আবরণ হয়ে রয়েছেন। যতক্ষণ মা জানকী মধ্যে থাকেন, ততক্ষণ লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পান না। জানকী একটু সরে পাশ কাটালে তখন লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পান"। আবার অন্যত্র ঠাকুর বলছেন, "মায়া কাকে বলে জান? - বাপ, মা, ভাই, ভগ্নী, স্ত্রী, পুত্র, ভাগ্নে, ভাইপো, ভাইঝি - এই সব আত্মীয়দের প্রতি টান ও ভালবাসা; আর দয়া মানে - সর্বভূতে আমার হরি আছেন এই জেনে সকলকে সমান ভালবাসা"। কথায় বলে মায়ার সংসার বা সংসারের মায়া - দুটি যেন সমার্থক।


কথামৃত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংসার প্রসঙ্গে শ্রীমতি মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ব্লগে বড় ভালো লিখেছেন:

'সংসার। বড় মোহের আর বড় মায়ার জায়গা। মায়া নেই তো সংসারও নেই। মায়া থেকেই তো বহু। আর বহু থেকেই সংসার।

উপনিষদের আদি অনন্ত নিরাকার সত্তা যেদিন ইচ্ছে করেছিলেন—‘বহু স্যাম’, আমি বহু হব, প্রকৃতপক্ষে সেদিন থেকেই সংসারের শুরু।

মায়া জাগল তাঁর। যোগমায়া। আপন স্বরূপকেই ভিন্ন ভিন্ন রূপ দিতে শুরু করলেন।

তবে যোগমায়ায় যোগ আছে। ইচ্ছেমাত্র যোগে যুক্ত হতে পারেন। সমস্ত খণ্ড আবার এক বিরাট ‘আমি’তে লয় পেতে পারে।

অনন্তের সে সংসার বিদ্যার সংসার।

আর আমাদের?

সংসার মানে বহু তো বটেই। তবে শুধু জনে নয়, মনে বহু।

বাবা মা ভাই বোন স্বামী স্ত্রী ছেলে মেয়ে—মাথাগুন্তি এত বহু‘র সমাহারে সংসার আর একা থাকলে নেই, তা কিন্তু নয়।

সংসার আসলে মনে।

সংসার আসলে চিন্তায়।

যার যেমন প্রকৃতি, যার যেমন সঙ্গ, তার চিন্তাও সেই অনুযায়ী।'


চতুর্থ এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা হলো আত্মজ্ঞান। ঠাকুর বলছেন, "মানুষ আপনাকে চিনতে পারলে ভগবানকে চিনতে পারে। 'আমি কে' ভালরূপ বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, 'আমি' বলে কোন জিনিস নেই। হাত, পা, রক্ত, মাংস ইত্যাদি - এর কোনটা 'আমি'? যেমন প্যাঁজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কেবল খোসাই বেরোয়, সার কিছু থাকে না, সেইরূপ বিচার কল্লে 'আমি' বলে কিছুই পাইনে! শেষে যা থাকে, তাই আত্মা - চৈতন্য। 'আমার' 'আমিত্ব' দূর হলে ভগবান্ দেখা দেন"। আবার বলছেন, "যতক্ষণ সেথা সেথা (অর্থাৎ বাহিরে), ততক্ষণ অজ্ঞান; যখন হেথা হেথা (অন্তরের দিকে), তখন জ্ঞান। যার হেথায় আছে (অর্থাৎ অন্তরে ভাব আছে), তার সেথায়ও আছে (অর্থাৎ ভগবৎপদে স্থান আছে)"। 


কি দারুন কথা! একবার যদি বোঝা যায় যে আমি বলে আলাদা কিছু নেই, তখন কিসের ভেদাভেদ আর কিসের লোভ - সব দ্বন্ধ মিটে গিয়ে তো জীবনের অভিমুখটাই ঘুরে যাবে। এমন হলে কুলোক, কুচিন্তা ইত্যাদি আশেপাশে ভিড়তে পারেনা, তাদের মনমতো কিছু এখানে পাওয়া যায়না বলে। তার মানে কিন্তু কাজকম্ম ছেড়ে মুক্তকচ্ছ হয়ে 'শিবোহম শিবোহম' বলে চেঁচিয়ে বেড়ানো নয়। রামচন্দ্র নামক এক জটাজূটধারী ব্রহ্মচারী একদিন ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে দর্শন করতে এসেছিলেন। তিনি বসে অন্য কোন কথাবার্তা না বলে কেবল 'শিবোঽহম্' 'শিবোঽহম্' করতে লাগলেন। ঠাকুর খানিকক্ষণ চুপ ক'রে থেকে অবশেষে বল্লেন, "কেবল 'শিবোঽহম্' 'শিবোঽহম্' করলে কি হবে? যখন সেই সচ্চিদানন্দ শিবকে হৃদয়ে ধ্যান ক'রে তন্ময় হয়ে গিয়ে বোধে বোধ হয়, সেই অবস্থায় বলা চলে। তা ছাড়া শুধু মুখে 'শিবোঽহম্' বল্লে কি হবে? যতক্ষণ তা না হয়, ততক্ষণ সেব্য-সেবক-ভাবে থাকাই ভাল।" ঠাকুরের এইরূপ নানা উপদেশে ব্রহ্মচারীর চৈতন্য হল এবং তিনি নিজের ভ্রম বুঝতে পারলেন। যাবার সময় দেওয়ালের গায়ে লিখে রেখে গেলেন, "স্বামী-বাক্যে আজ হতে রামচন্দ্র ব্রহ্মচারী সেব্য-সেবক-ভাব প্রাপ্ত হল"। তাহলে সংসারে আনন্দে থাকার উপায় কি? 


এক ব্যক্তি ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, "সংসারে থেকে ঈশ্বর-উপাসনা কি সম্ভব?" পরমহংসদেব একটু হেসে বললেন, "ও দেশে দেখেছি, সব চিড়ে কোটে; একজন স্ত্রীলোক এক হাতে ঢেঁকির গড়ের ভেতর হাত দিয়ে নাড়ছে, আর এক হাতে ছেলে কোলে নিয়ে মাই খাওয়াচ্ছে, ওর ভেতর আবার খদ্দের আসছে, তার সঙ্গে হিসাব করছে - 'তোমার কাছে ওদিনের এত পাওনা আছে, আজকের এত দাম হল।' এই রকম সে সব কাজ করছে বটে, কিন্তু তার মন সর্বক্ষণ ঢেঁকির মুষলের দিকে আছে; সে জানে যে ঢেঁকিটি হাতে পড়ে গেলে হাতটি জন্মের মতো যাবে। সেইরূপ সংসারে থেকে সকল কাজ কর; কিন্তু মন রেখো তাঁর প্রতি। তাঁকে ছাড়লে সব অনর্থ ঘটবে"। শ্রীশ্রীমা এই একই কথা খুব সহজভাবে বোঝাচ্ছেন, "যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি আর তিনিই মা। দরকার নেই ফুল, চন্দন, ধূপ, বাতি,  উপাচারের। মাকে আপন করে পেতে শুধু মনটাকে দেও তাঁরে”। এর ওপরে আর কথা নেই, তা যিনি যতই কর্পোরেট হঞ্চ হন না কেন। মনটা কর্পোরেটকে নয়, নিজেকে দিলেই আসল কাজ হয়ে যাবে। বাইরে নিষ্কামভাবে কাজ করে যাওয়া আর মনটা নিজের ভেতরে ঘুরিয়ে দেওয়া - ব্যাস, সব অশান্তি, অপ্রাপ্তির শেষ।


আবার শ্রীমতি মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্লগের সূত্র ধরেই সকলের শান্তি কামনা করে শেষ করি:

'যার যেমন প্রকৃতি, যার যেমন সঙ্গ, তার চিন্তাও সেই অনুযায়ী।

কোনও একটিমাত্র চিন্তা নয়। চিন্তার স্রোত। তরঙ্গ।

সেই তরঙ্গ কোনও ব্যক্তি মানুষকে নানা কাজে প্রবৃত্ত করে।

তার জন্য তার আশপাশে কেউ আছে কি নেই, তাতে বিশেষ কিছু যায় আসে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ এর পরে যেমন বলবেন, তিন কুলে কেউ না থাকলেও মহামায়া একটা বেড়াল পুষিয়েও সংসার করান।

অর্থাৎ সংসারের মূল হল মনের প্রকৃতি।

এখন একবার জড়িয়ে গেলে জড়াতেই থাকে। তার কারণ আসক্তি। প্রতিটি কাজ বা চিন্তার সঙ্গে আমার আমিকে ওতপ্রোত যুক্ত করে ফেলি।

সেই আমি যত সঙ্কুচিত হয়, তাকে জড়িয়ে ধরা জালটা তত সমুদ্রের মতো অনন্ত হয়ে পড়ে।

এখন উপায়?

শ্রীরামকৃষ্ণ বলবেন, বড় মানুষের বাড়ির দাসীর মতো থাকতে হবে। সবই করা হচ্ছে অথচ অনাসক্ত ভাব। মনে জানে, এরা আমার নিজের কেউ নয়।

তবে নিজের কে?

সেই মাস্তুল। যাঁকে ধরলে সমুদ্রে ডোবার ভয় আর নেই।

মাস্টারমশাই চিনলেন ওই বারান্দাতেই। সংসার কী আর তার কর্ণধার কে।

এবার তাঁর অন্য আমি-র জাগরণ। সে আমি ভক্তের আমি।'

ওঁ শান্তি শান্তি শান্তিঃ।