Sunday, July 30, 2023

ছিলেন, আর নেই

আসেপাশে যেদিকে তাকিয়ে দেখি সেদিকেই মনে হয় যাঁদের সাথে আত্মিক বন্ধন ছিল তাঁরা প্রায় কেউই আর নেই। যাঁরা জন্ম দিয়েছিলেন তাঁরা নেই, যাঁরা লালন পালন করেছিলেন তাঁরা নেই, যাঁরা শিক্ষা দীক্ষা দিয়েছিলেন তাঁরাও প্রায় কেউই আর নেই, মায় বাল্যবন্ধু, পাড়া প্রতিবেশী এবং বড়বেলার পরিচিতদের মধ্যেও কত মানুষই তো চলে গেছেন - যেদিকে দেখি সেদিকেই যেন সবাই ছিলেন, এখন আর নেই। উত্তমকুমার নেই, আশাপূর্ণা দেবী নেই, লীলা মজুমদার নেই, সত্যজিৎ রায় নেই, তুলসী চক্রবর্তী নেই, রবি ঘোষ নেই, কতজনই তো নেই। তা ছাড়া আমি নিজেও তো আর আগের আমি নই, ফলে কত পরিজন এমনিই ঝরে গেছেন জীবন থেকে, যাঁদের থাকাটা এক সময় অপরিহার্য মনে হতো। আমার গার্হস্থ্য জীবনের কাজ সারা হয়ে গেছে, গুরুত্বপূর্ণ কোনো জাগতিক কর্তব্যই আর বাকি নেই। এবার যেটুকু সময় আছে সেটুকু একান্তভাবে আমার নিজের। সত্যি বলতে কি এই বানপ্রস্থে আমার আগের আমিগুলোও তো আর নেই, ফলে আনুষঙ্গিক বাকিটাও না থাকাটাই স্বাভাবিক। নিজেকে খোঁজার যে কটা দিন পাচ্ছি তা যেন আনন্দময় হয়, মায়ের কাছে নিয়ত সেই প্রার্থনাই করি। ক্রমশ শরীর অশক্ত হচ্ছে, দৃষ্টি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে, শিরদাঁড়া পীড়া দিচ্ছে, এখন আর নিজের প্রাণশক্তিকে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়ার মতন সময়ও বাকি নেই। এবারের মতন নেই হয়ে যাওয়ার আগে পরের জন্মের খেইটা ধরিয়ে দেওয়ার সুযোগটি মা করে দিন, তাঁর এটুকু কৃপা পেলেই যথেষ্ট।

যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে,
দু হাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই শিশুর মতো হেসে॥
যাবার বেলা সহজেরে
যাই যেন মোর প্রণাম সেরে,
সকল পন্থা যেথায় মেলে সেথা দাঁড়াই এসে॥
খুঁজতে যারে হয় না কোথাও চোখ যেন তায় দেখে,
সদাই যে রয় কাছে তারি পরশ যেন ঠেকে।
নিত্য যাহার থাকি কোলে
তারেই যেন যাই গো ব'লে--
এই জীবনে ধন্য হলেম তোমায় ভালোবেসে॥

Friday, July 21, 2023

দুর্ভাগা বাঙালি



চাল ডাল আলু পেঁয়াজ পেট্রোলের জন্য যদি রাজনৈতিক নেতাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়, সেটা জনগণের নিজেদের অক্ষমতা। রাজনৈতিক দল বা নেতাদের কাজ হলো রাষ্ট্রনির্মাণ, কর্মঠ নাগরিকদের দৈনন্দিন চাহিদা যোগানো নয় - জনগণ নিজেরা খেটেখুটে রোজগার করে নিজেদের চাহিদা নিজেরা মেটাবেন, এটাই তাঁদের সামাজিক কর্তব্য - কেবল অসুস্থ ও বৃদ্ধ অকর্মঠদের ভার রাষ্ট্র নেবে। 

পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এই মূল পার্থক্যটি ভুলে গেছেন বলেই বহুদিন ধরে আলু পেঁয়াজের রাজনীতিকে মাথায় তুলে নাচ্ছেন। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। রাজ্যের সর্বনাশ হচ্ছে, যাদের নেতা হওয়ার যোগ্যতা নেই তারা ছড়ি ঘোরাচ্ছে আর জনগণ ক্ষুদ্র দৈনন্দিন স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে আসল রাজনৈতিক সচেতনতা হারিয়ে বসে আছেন। 

আমি এই রাজ্যের কোনো ভবিষ্যৎ দেখিনা। হয়তো ভারতের প্রধান বিচারপতিও দেখেন না। নইলে দুমাস আগে ঘটে যাওয়া মণিপুরের এক জঘন্য ঘটনায় উনি এত বিচলিত হন অথচ পশ্চিমবঙ্গে ঘটে চলা লাগাতার ঘটনাসমূহ সম্পর্কে ওঁর বা অন্য কোনো সমগোত্রীয় সাংবিধানিক পদাধিকারীর সেই আবেগ দেখা যায়না কেন ? 

নির্বাচকরা কেন দলদাস হবেন ? উল্টে দল নির্বাচকদের কৃতদাস হবে, তবেই তো সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে - এই সাধারণ কথাটা বুঝতে কি খুব বেশি বুদ্ধি লাগে? এখানে তো যাকেই দেখি তিনিই কোনো না কোনো দলীয় লাইন নিয়ে পড়ে আছেন, নাগরিক হিসেবে স্বাধীনভাবে চিন্তার যেন কোনো অবসরই নেই ! যে রাজ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণপোকার মতন আলু-পেঁয়াজ-পেট্রোলের রাজনীতি ঢুকে গেছে, সেই নির্বোধ নাগরিকদের কূপমণ্ডূক মানসিকতা পাল্টানো আর অশিক্ষিত আম পাকিস্তানিদের হিন্দু ও ইহুদিবিদ্বেষ থেকে মুক্ত করা প্রায় একইরকমের দুঃসাধ্য। এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে এক কণা আলোর রশ্মি দেখতে পেলে অবশ্যই স্বস্তি পেতাম, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না যে। 

বড় কষ্ট হয়, বিশ্বাস করুন, খুব কষ্ট হয়। সেই অতীশ দীপঙ্করেরও আগের আমল থেকে নিয়ে এই সেদিনের স্বামী বিবেকানন্দ ঋষি অরবিন্দ পর্য্যন্ত আলোর দিশারীদের স্বজাতকে যখন ফুটপাথে বাবু হয়ে বসে ভিক্ষার মাংস ভাত খেয়ে তৃপ্ত হতে দেখি, বড় কষ্ট হয় গো। একইরকমের কষ্ট হয় যখন 'ওরা ৫০০ দিয়েছে, আমরা ২০০০ দেবো' বলে ভিক্ষান্নের পরিমান বাড়িয়ে দিয়ে ভোট কেনার চেষ্টা দেখি, যার মধ্যে না আছে কোনো নীতি, না কোনো আদর্শ, না স্বচ্ছতা। ভাগ্য পরিবর্তন যে হবে, তার সঠিক দিশা কোথায় ? সবই তো সেই একই চাল ডাল তেলের তাৎক্ষণিক ক্ষুদ্র রাজনীতির চর্বিত চর্বন, সামগ্রিক চিত্র এবং বাঙালির গাড্ডায় যাওয়া ভবিষ্যৎ নিয়ে সোজা কথা সোজাভাবে বলার লোক কোথায় ?

Sunday, July 16, 2023

চীন থেকে শিখি

আমরা চীনকে দুচোক্ষে না দেখতে পারি কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের প্রযুক্তির ওপর নির্ভর না করে চীন যে উইচ্যাট বা সিনা উইবো বা রেনরেন বা দুবান ইত্যাদি তৈরি করে নিজেদের সামাজিক আদানপ্রদান এবং তথ্যভান্ডার নিজেদের দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছে, সেটা অবশ্যই শেখার মতন বিষয়। 

আমরা তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে জিডিপির বড্ড কম শতাংশ ব্যয় করি, চীন এই বিষয়ে অনেক এগিয়ে। আমাদের মস্তিষ্ক আমরা ভাড়ায় খাটিয়ে বিদেশ থেকে টাকা অবশ্যই কামাই কিন্তু তাঁরা যা কিছু তৈরি করেন তা বিদেশিদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হিসেবেই রয়ে যায়, আমরা পরে সেগুলোকেই আবার অনেক টাকা খরচ করে কিনি - চীন কিন্তু তা করে না। 

চীন মাথা বেচে যা কমায় তার প্রায় অর্ধেক নিজেদের দেশে গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রে খরচ করে, যা অধিকাংশ ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো করে না। সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রেও চীন চিন্তার দৌড়ে আমাদের থেকে অনেকগুণ এগিয়ে আছে। ওরা হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ডদের নিজেদের দেশে ঢুকতে দেয় না আর আমরা হীনমন্যতায় ভুগে এখন ওদেরকেই ডেকে ডেকে দেশে নিয়ে আসছি। 

প্রত্যেক দেশের সমাজ ব্যবস্থা তার নিজের মতো করে গড়ে ওঠে, আমাদেরটি তো হাজার হাজার বছর ধরে পরিপক্ক হয়েছে। পাশ্চাত্য সমাজ চার্চের সাথে সরকারের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে আর আমাদের সভ্যতায় ধর্ম রাজ্যশাসনের মানদণ্ডের কাজ করেছে - তেলে আর জলে মিস খাবে কি করে? ওরা ওদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সামাজিক গঠনতন্ত্র, পন্থকে ধর্মের জায়গায় বসিয়ে সংখ্যালঘুর অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে পড়াতে শুরু করলে তো মহাবিপদ - এ দেশে ঘরে ঘরে বিভ্রান্ত ভারতীয় গজিয়ে উঠবে, যারা নিজেদের পরম্পরাকেই অশ্রদ্ধা করতে শিখবে! 

চীনের উন্নতি এমনি এমনি হয়নি, চীন বৌদ্ধিক স্তরে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেছে এবং এখনো করে চলেছে। চীনের পতন হবে ওদের শাসকশ্রেণীর সাম্রাজ্যবাদী অতিলোভের জন্য, বৌদ্ধিকতার জন্য নয়। একটি প্রাচীন সভ্যতা হিসেবের আমরা কোনদিকে যাচ্ছি সেটা কিন্তু নিজের নিজের thought bubble থেকে বেরিয়ে এসে independent thinker হিসেবে আমাদের নতুন করে পর্য্যালোচনা করা উচিত। আমরা কি যথেষ্ট পরিমাণে আত্মনির্ভর হতে পারছি? 

যদি না পেরে থাকি, তাহলে কি কি করলে আমরা চীনের করা ভুলগুলো এড়িয়ে কেবল ভালোদিকগুলোকে আত্মসাৎ করে একটা ফুলপ্রুফ ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি, সেটা নিয়ে সর্বস্তরে আলোচনা করা উচিত। চীন বিশ্বের কারখানা হতে গিয়ে প্রত্যেক ক্ষেত্রে নিজের উৎপাদন ক্ষমতা এমন একটা চরম জায়গায় নিয়ে গেছে যে আজ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার মার আর কিছুটা নিজেদের হঠকারিতা চীনের অতিবৃহৎ অর্থনীতিকেও নাড়িয়ে দিয়েছে, এক এক করে উৎপাদনের প্রতিটি সেক্টরে ভূমিকম্প পরিলক্ষিত হচ্ছে। 

আমরাও মেক ইন ইন্ডিয়া নিয়ে এগোতে চাইছি। আমাদের কিন্তু ভেবে দেখা উচিত রপ্তানির জন্য অভ্যন্তরীণ উপভোগের কত শতাংশ বেশি উৎপাদন ক্ষমতা আমাদের তৈরি করা উচিত যাতে কোনোদিন চীনের মতন সমস্যায় পড়তে না হয়। আমাদের রাষ্ট্রজীবনে আগামী পঁচিশ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ - make or break years, ভুল করার কোনো জায়গা নেই। আর একটা বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে পর্য্যালোচনা করা উচিত - আমাদের সংবিধান কি ভবিষ্যতের ভারতের পক্ষে উপযুক্ত? 

এই যে রাজ্যের পর রাজ্যে অর্থনীতির পক্ষে বিধ্বংসী ফ্রি-হরিরলুটের রাজনীতি দেখা যাচ্ছে, এর উৎস কি আমাদের সাংবিধানিক পরিকাঠামো এবং সংসদীয় গণতন্ত্র ভিত্তিক প্রধানমন্ত্রী নির্ভর শাসন ব্যবস্থা? জনতার দ্বারা সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে কি তিনি বেশি চাপমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবেন, যেমন চীনের রাষ্ট্রপতি পারেন? আমি আশা করবো আগামী দশকগুলিতেও ঈশ্বর আমাদের এমন বৌদ্ধিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব জুগিয়ে যাবেন যাঁরা এই কঠিন সময়ে শক্ত হাতে হাল ধরে থাকতে পারবেন এবং ভারত যাতে কোনোভাবেই পরমুখাপেক্ষী না হয়ে সর্বতোভাবে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে, সেটা নিশ্চিত করতে পারবেন। জয় ভারতমাতার জয়।

শ্রীশ্রীগীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের সার



অধ্যায় ১ : জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অজ্ঞানতা
অধ্যায় ২ : জ্ঞানই সমস্ত সমস্যার সমাধানের উপায়
অধ্যায় ৩ : নিঃস্বার্থপরতা হলো আত্মোন্নতির একমাত্র পথ
অধ্যায় ৪ : প্রতিটি কর্মই পূজাকর্ম হতে পারে
অধ্যায় ৫ : ক্ষুদ্র আমিত্ব ত্যাগ করে অসীমত্বের আনন্দ ভোগ করো
অধ্যায় ৬ : নিয়মিত অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক চেতনাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করো
অধ্যায় ৭ : শিখতে থাকো আর নিজের যাপনে অনুরূপ পরিবর্তন আনতে থাকো
অধ্যায় ৮ : নিজের ওপর কখনো আস্থা হারিয়ে ফেলো না
অধ্যায় ৯ : যতটুকু দৈবাশীর্বাদ পেয়েছ তার মূল্য অনুধাবন করতে শেখো
অধ্যায় ১০ : ঈশ্বরই চতুর্দিকে নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছেন
অধ্যায় ১১ : পরম সত্যকে জানতে হলে আগে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে শেখো
অধ্যায় ১২ : নিজের মনকে সর্বদা ঈশ্বরের সাথে জুড়ে রাখো
অধ্যায় ১৩ : মায়ার মোহ ত্যাগ করে ঈশ্বরের সাথে সম্পৃক্ত হও
অধ্যায় ১৪ : তোমার জীবনযাপনের শৈলী জীবনের লক্ষ্যের অনুরূপ হতে হবে
অধ্যায় ১৫ : জীবনের লক্ষ্য আত্মোপলব্ধি
অধ্যায় ১৬ : শুদ্ধ জীবন নিজেই একটি মহাপ্রাপ্তি
অধ্যায় ১৭ : সাময়িক সুখের ওপর সত্যিকারের আনন্দকে স্থান দেওয়াকেই প্রকৃত ক্ষমতায়ন বলে
অধ্যায় ১৮ : ভোগ ত্যাগ করো, ঈশ্বর লাভ করো

(ডঃ শ্রীমতি শশী তিওয়ারি, সংস্কৃত ভাষার প্রখ্যাত অধ্যাপিকা এবং বেদ বিশেষজ্ঞের রচনা থেকে অনূদিত)

Sunday, July 2, 2023

আমার ভোট



আমি জীবনে প্রথমবার ভোট দিয়েছিলাম ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে। এখন যদিও আসনটি দক্ষিণ কলকাতা হয়ে গেছে, আমাদের তখনকার যাদবপুর লোকসভা আসনে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন শ্রী উত্তম বসু, নামটা এখনো আমার মনে আছে। সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন শ্রীমতি মালিনী ভট্টাচার্য, উনিই জিতেছিলেন। সেবার বিজেপি পেয়েছিল ১২০টি আসন আর সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়েও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন শ্রী পি ভি নরসিংহ রাও। 

তার পরপরেই আমি দিল্লি চলে যাই এবং দ্বিতীয়বার লোকসভায় ভোট দিই ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে। সেবার আমাদের দক্ষিণ দিল্লির আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন শ্রীমতি সুষমা স্বরাজ, হারিয়েছিলেন কংগ্রেসের শ্রী কপিল সিব্বলকে। সেইবারই অটলজীর প্রধানমন্ত্রীত্বে বিজেপি তথা NDAর প্রথম তেরোদিনের সরকার গঠিত হলো, তারপর তো দেবেগৌড়া গুজরাল ইত্যাদি খিচুড়ি পাকিয়ে যা তামাশা হলো সেটা কোনো গণতন্ত্রের পক্ষেই খুব একটা ভালো বিজ্ঞাপন নয়। 

ইতিমধ্যে অবশ্য ১৯৯৩ সালে প্রথমবার দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন হলো, তাতেও ভোট দিলাম। আমাদের কালকাজি বিধানসভা আসনে জিতেছিলেন বিজেপির শ্রীমতি পূর্ণিমা শেঠি আর দিল্লি সরকারে তার পরের পাঁচ বছরে বিজেপির পক্ষ থেকে তিনজন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন - প্রথমে শ্রী মদন লাল খুরানা, তারপর শ্রী সাহেব সিং ভার্মা আর ১৯৯৮ এর নির্বাচনের ঠিক আগে আগেই মাসকয়েকের জন্য শ্রীমতি সুষমা স্বরাজ। এরপর যখন ১৯৯৮ সালে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন হয়, ১৩ মাসের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অটলজী আবার ফিরে আসেন, আমি তখন দেশের বাইরে। ওই ১৯৯৮ সালেই দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনও হয়েছিল, আমি সেবারও বিদেশে। 

এরপরের লোকসভা নির্বাচন ১৯৯৯ সালে, আমরা থাকি পূর্ব দিল্লিতে কিন্তু আমাদের ভোটার কার্ড তখনো দক্ষিণ দিল্লির, ব্যস্ততার জন্য ঠিকানা পাল্টানো হয়নি। ভোটের দিন ভোট দিতে গিয়ে দেখি ভোটার লিস্ট থেকে নাম কেটে দিয়েছে। মনে আছে খুব রেগে গিয়েছিলাম কিন্তু চেঁচামেচি করেও কোনো ফল হয়নি। সেবার দক্ষিণ দিল্লি থেকে কে যে বিজেপির বিজয়ী প্রার্থী ছিলেন তা এখন আর মনে নেই, সম্ভবত শ্রী বিজয় কুমার মালহোত্রা কারণ সেবার মাত্র কয়েকদিনের নোটিসে শ্রীমতি সুষমা স্বরাজ কর্ণাটকের বেল্লারি থেকে শ্রীমতি সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিলেন এবং হেরে গেলেও বিপক্ষকে যথেষ্ট বেগ দিয়েছিলেন। 

যাইহোক, তারপর নয়ডায় থাকাকালীন ইউপিতে ভোট দিয়েছি, ফরিদাবাদে থাকাকালীন হরিয়ানায় ভোট দিয়েছি আর কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকে, অর্থাৎ ২০০৭এর পর থেকে তো পশ্চিমবঙ্গেই সব স্তরে ভোট দিয়ে চলেছি, যদিও এখানে যাঁদের ভোট দিয়েছি তাঁরা কেউই নির্বাচিত হননি। শেষবার ভোট দিয়েছি ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বেহালা পশ্চিম আসনের এমন একজন থার্ড ক্লাস প্রার্থীকে, যাঁর নাম মুখে আনতেও লজ্জা করে, যদিও লজ্জাটা আসলে হওয়া উচিত তাঁদের যাঁরা তাঁকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। আমার ব্যক্তিগত ভোটের ইতিহাসের এত বড় গৌরচন্দ্রিকা করার কারণ হলো এই - আজকেই মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগছিলো যে এই যে ৩০-৩২ বছর ধরে ক্রমাগত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভোট দিয়ে যাচ্ছি, তাও আদর্শ মেলে এমন একটাই দলকে ভোট দিয়ে যাচ্ছি, দেশে তার কোনো positive effect কি দেখতে পেলাম? 

হ্যাঁ পেলাম। অবশ্যই পেলাম। প্রথম হলো একটা ব্যক্তিগত বৌদ্ধিক অন্তর্বেদনা থেকে মুক্তি। কি সেই বেদনা? ১২০ আসন পাওয়ার পর, আহা রে, আরো কিছু বেশি মানুষ যদি আমাদের আদর্শ এবং দিশাকে একটু ভালোভাবে বুঝতেন তাহলে আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়তে পারতাম আর দেশকে বেপথ থেকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য যা যা করার দরকার, সব করতে পারতাম। তার পরেরবার ১৮২ আসন পাওয়ার পর বেদনা - মানুষ আশীর্বাদ দিলেন কিন্তু কেন যে ছাই পুরোটা দিলেন না, এবারেও ওই পাঁচভূতের চাপে আসল কাজ কিছুই করা যাবে না। তারপর অত বড় golden quadrilateral বানানো ও কার্গিলের যুদ্ধ জেতার পরেও অপ্রত্যাশিতভাবে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার চরম বেদনা - ব্যস সব আশা বুঝি শেষ হয়ে গেল! ২০১৪তে এই নিয়মিত যন্ত্রণার অবসান হয়েছে, দশ বছর পেরিয়ে গেছে এবং অন্তত আগামী দুদশকের জন্যেও নিশ্চিন্ত আর ততদিনে দেশের যা ভালো হওয়ার সবটাই হয়ে যাবে। যত দেশ এগোবে তত শত্রুদের শক্তিক্ষয় হবে এবং শেষে একেবারে নির্বিষ হয়ে পড়বে, এটাও কম পাওয়া নয়।

দ্বিতীয় হলো সব জেনেও কিছু না করতে পারার অসহায়তা থেকে মুক্তি। চোখের সামনে দেখছি ব্রাউন সাহেবরা বাচ্চাদের কেবল হেরে যাওয়ার ইতিহাস পড়াচ্ছে, আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিকে হেয় করে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে মূল্য দিতে শেখাচ্ছে, একশ্রেণীকে তোষামোদের চূড়ান্ত করে তাদের মধ্যে নতুন করে আবার একটা অদ্ভুত false sense of entitlement তৈরি করে দেশের ভবিষ্যতকে চরম বিপাকে ফেলছে, বিজাতীয় ভাবধারা আর বিদেশি পণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে দেশীয় enterpriseকে শেষ করে দিচ্ছে, কিছুতেই সোভিয়েত অর্থনীতির লেগেসি বজ্রআঁটুনির ভূতকে ঘাড় থেকে নামাতে পারছে না - কিন্তু কিছুই করার নেই। আজকে ওই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই corrective action নেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে এবং খুব দ্রুত সেই পরিবর্তনের প্রভাব সমাজে পরিলক্ষিতও হচ্ছে, এটা খুবই তৃপ্তিদায়ক। 

তৃতীয় হলো ভারতীয় হিসেবে যে যে বিষয়ে গর্বিত হওয়া উচিত, সেগুলো নাকচ হয়ে যেতে দেখে শুধুই হাত কামড়ানো। ভারতীয় অস্মিতা ও শৌর্যবীর্য্যের চিহ্ন বহনকারী ভূলুণ্ঠিত প্রতীকের পুনির্নির্মাণ করা, ঔপনিবেশিক ইতিহাসের বদলে ভারতের গৌরবগাথা - চোলা, চৌহান, অহম ও মারাঠাদের ইতিহাসকে প্রাধান্য দেওয়া, এক প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী হিসেবে অধিকাংশ ভারতীয়দের আস্থা যেখানে যেখানে জড়িত সেই স্থানগুলির কেবল সংরক্ষণ নয়, তার পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা, ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হিসেবে গর্ববোধ করানোর রাস্তা খুলে দেওয়া এবং প্রাচীন ভারতীয় দর্শন, তার value system, তার উৎকর্ষকে আজকের জীবনে প্ৰতিষ্ঠা করা - কিছুই তো হতো না, এখন হচ্ছে। এখন যখন নতুন শিক্ষানীতি দেখি, যখন অযোধ্যা বা কাশীর দিকে তাকাই, যখন ধারা ৩৭০ ও ৩৫এ সরে যাওয়ার পর কাশ্মীরে smart city তৈরি হতে দেখি, যখন শুনি যে CAA লাগু হবে, NRC হবে, UCC হবে, তখন মনে হয় বৈকি যে একদম ঠিক দিকে চলছে আমার দেশ।

চতুর্থ হলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে ভয়ানক চুরি দেখেও তাকে আটকাতে না পারার যন্ত্রণা। বফোর্স স্ক্যাম, 2G, 3G স্ক্যাম, কমনওয়েলথ গেমস স্ক্যাম, কয়লাখনি বন্টন স্ক্যাম, হেলিকপ্টার স্ক্যাম, কেন্দ্র ১ টাকা পাঠালে গরিবের হাতে মাত্র ১৫ পয়সা পৌঁছনো - আরো কত কত দুর্নীতি - যে যেখান থেকে পারছে দেশের টাকা লুট করে নিয়ে চলে যাচ্ছে আর নেতা রেনকোট পরে স্নান করছেন! বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে গেছে এখন। না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা। পুরো তালা পরে গেছে কেন্দ্রীয় সরকারের upper level corruptionএ, এবার জোরকদমে রাজ্যগুলিতেও চোর ধরার কাজ শুরু হয়েছে প্রতিটি স্তরে। কত আমলার চাকরি গেছে আর কত দুর্নীতিবাজ যে ভয়ে সিঁটিয়ে আছে, তার ইয়ত্তা নেই। ভালো লাগছে দেখে। এখন JAM খেল দেখাচ্ছে, এখন শুধুই direct cash transfer, সমস্ত পেমেন্ট ধীরে ধীরে ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে, শক্ত শক্ত আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, নে কিভাবে চুরি করবি এবার করে দেখা!

সবচেয়ে বড় কথা হলো এখন একটা স্পষ্ট দিশা দেখতে পাচ্ছি - দেশ কোনদিকে যাচ্ছে সে বিষয়ে আর কোনো ambiguity নেই। ভারত তো আর ইংরেজের India নয়, ভারত হলো হিন্দু সভ্যতার ধাত্রীভূমি, সিকন্দরের সাথে মেগাস্থেনিস আসার এবং হেরে ফিরে যাওয়ার অনেক আগেই এই সভ্যতার হিন্দু নামকরণ হয়ে গিয়েছিল। এই ভূমি সভ্যতার আদিভূমি, যে সভ্যতা বিশ্বকে শূন্য দিয়েছে, পাই-এর value দিয়েছে, সূর্য্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের মাপ দিয়েছে, প্লাস্টিক সার্জারি সহ শল্যচিকিৎসা দিয়েছে, dentistry দিয়েছে, আয়ুর্বেদ দিয়েছে, যোগ দিয়েছে, flush toilet দিয়েছে, ২ মিলিমিটারের ভাগ ওলা ruler দিয়েছে, পিথাগোরাসের অনেক আগেই পিথাগোরিয়ান থিওরাম দিয়েছে, ত্রুসিবেল স্টিল দিয়েছে, সর্বোপরি ভারতীয় দর্শনসমূহ দিয়েছে, আরো কত কিই। আমাদের ভাণ্ডারে গচ্ছিত নিজেদের পারিবারিক সম্পদ ছেড়ে আমরা ভিখারির মতন পরের সম্পদের পেছনে এতদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, সেটা অবশেষে বন্ধ হয়েছে। 

আমাদের দেশীয় উৎপাদন বাড়ছে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে সরকারের আয় বাড়ছে, অবকাঠামোয় বিনিয়োগ বিপুল পরিমাণে বাড়ছে, ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বাড়ছে, প্রতিদিন আমরা অর্থনৈতিকভাবে এবং সামরিকভাবে আরো শক্তিশালী হচ্ছি এবং ধীরে ধীরে আত্মনির্ভরও হয়ে উঠছি। দেশে দারিদ্র কমছে, অশিক্ষা কমছে, ধীরে ধীরে একটা welfare stateএর রূপরেখা দেখা যাচ্ছে, না খেতে পেয়ে আর কেউ মরে না, আমাদের পাসপোর্টের কদর বাড়ছে, renewable energyর ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, export বাড়ছে, ব্যাঙ্কগুলো পোক্ত হচ্ছে, আমরা রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকমুক্ত বিষমুক্ত কৃষির দিকে ঝুঁকছি, সারা বিশ্বজুড়ে ভারত নেতৃত্বের জায়গায় উঠে আসছে, আরো কতকিছুই না হচ্ছে।

জনজীবনে সংস্কৃত ফিরে আসছে, সংস্কার ফিরে আসছে, সেঙ্গোল ফিরে আসছে। যত আমরা নিজেদের সত্যিকারের ইতিহাসকে জানতে পারছি তত আমরা নিজেদের অতীতের গৌরবকে উপলব্ধি করছি আর তত আমাদের জিদ চেপে যাচ্ছে যে তার থেকে আরো গৌরবময় ভবিষ্যত আমরা বানিয়ে দেখাবোই। এই দেশকে ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়া থেকে আটকাবে, এমন সাধ্য কার? তাই যতদিন শরীর দেবে ততদিন নিজের ভোটটা ঠিক জায়গাতেই দিয়ে যাবো কারণ আমি নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সার কথা এই বুঝেছি যে democracy indeed delivers if one votes right.