আমরা চীনকে দুচোক্ষে না দেখতে পারি কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের প্রযুক্তির ওপর নির্ভর না করে চীন যে উইচ্যাট বা সিনা উইবো বা রেনরেন বা দুবান ইত্যাদি তৈরি করে নিজেদের সামাজিক আদানপ্রদান এবং তথ্যভান্ডার নিজেদের দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছে, সেটা অবশ্যই শেখার মতন বিষয়।
আমরা তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে জিডিপির বড্ড কম শতাংশ ব্যয় করি, চীন এই বিষয়ে অনেক এগিয়ে। আমাদের মস্তিষ্ক আমরা ভাড়ায় খাটিয়ে বিদেশ থেকে টাকা অবশ্যই কামাই কিন্তু তাঁরা যা কিছু তৈরি করেন তা বিদেশিদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হিসেবেই রয়ে যায়, আমরা পরে সেগুলোকেই আবার অনেক টাকা খরচ করে কিনি - চীন কিন্তু তা করে না।
চীন মাথা বেচে যা কমায় তার প্রায় অর্ধেক নিজেদের দেশে গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রে খরচ করে, যা অধিকাংশ ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো করে না। সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রেও চীন চিন্তার দৌড়ে আমাদের থেকে অনেকগুণ এগিয়ে আছে। ওরা হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ডদের নিজেদের দেশে ঢুকতে দেয় না আর আমরা হীনমন্যতায় ভুগে এখন ওদেরকেই ডেকে ডেকে দেশে নিয়ে আসছি।
প্রত্যেক দেশের সমাজ ব্যবস্থা তার নিজের মতো করে গড়ে ওঠে, আমাদেরটি তো হাজার হাজার বছর ধরে পরিপক্ক হয়েছে। পাশ্চাত্য সমাজ চার্চের সাথে সরকারের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে আর আমাদের সভ্যতায় ধর্ম রাজ্যশাসনের মানদণ্ডের কাজ করেছে - তেলে আর জলে মিস খাবে কি করে? ওরা ওদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সামাজিক গঠনতন্ত্র, পন্থকে ধর্মের জায়গায় বসিয়ে সংখ্যালঘুর অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে পড়াতে শুরু করলে তো মহাবিপদ - এ দেশে ঘরে ঘরে বিভ্রান্ত ভারতীয় গজিয়ে উঠবে, যারা নিজেদের পরম্পরাকেই অশ্রদ্ধা করতে শিখবে!
চীনের উন্নতি এমনি এমনি হয়নি, চীন বৌদ্ধিক স্তরে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেছে এবং এখনো করে চলেছে। চীনের পতন হবে ওদের শাসকশ্রেণীর সাম্রাজ্যবাদী অতিলোভের জন্য, বৌদ্ধিকতার জন্য নয়। একটি প্রাচীন সভ্যতা হিসেবের আমরা কোনদিকে যাচ্ছি সেটা কিন্তু নিজের নিজের thought bubble থেকে বেরিয়ে এসে independent thinker হিসেবে আমাদের নতুন করে পর্য্যালোচনা করা উচিত। আমরা কি যথেষ্ট পরিমাণে আত্মনির্ভর হতে পারছি?
যদি না পেরে থাকি, তাহলে কি কি করলে আমরা চীনের করা ভুলগুলো এড়িয়ে কেবল ভালোদিকগুলোকে আত্মসাৎ করে একটা ফুলপ্রুফ ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি, সেটা নিয়ে সর্বস্তরে আলোচনা করা উচিত। চীন বিশ্বের কারখানা হতে গিয়ে প্রত্যেক ক্ষেত্রে নিজের উৎপাদন ক্ষমতা এমন একটা চরম জায়গায় নিয়ে গেছে যে আজ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার মার আর কিছুটা নিজেদের হঠকারিতা চীনের অতিবৃহৎ অর্থনীতিকেও নাড়িয়ে দিয়েছে, এক এক করে উৎপাদনের প্রতিটি সেক্টরে ভূমিকম্প পরিলক্ষিত হচ্ছে।
আমরাও মেক ইন ইন্ডিয়া নিয়ে এগোতে চাইছি। আমাদের কিন্তু ভেবে দেখা উচিত রপ্তানির জন্য অভ্যন্তরীণ উপভোগের কত শতাংশ বেশি উৎপাদন ক্ষমতা আমাদের তৈরি করা উচিত যাতে কোনোদিন চীনের মতন সমস্যায় পড়তে না হয়। আমাদের রাষ্ট্রজীবনে আগামী পঁচিশ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ - make or break years, ভুল করার কোনো জায়গা নেই। আর একটা বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে পর্য্যালোচনা করা উচিত - আমাদের সংবিধান কি ভবিষ্যতের ভারতের পক্ষে উপযুক্ত?
এই যে রাজ্যের পর রাজ্যে অর্থনীতির পক্ষে বিধ্বংসী ফ্রি-হরিরলুটের রাজনীতি দেখা যাচ্ছে, এর উৎস কি আমাদের সাংবিধানিক পরিকাঠামো এবং সংসদীয় গণতন্ত্র ভিত্তিক প্রধানমন্ত্রী নির্ভর শাসন ব্যবস্থা? জনতার দ্বারা সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে কি তিনি বেশি চাপমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবেন, যেমন চীনের রাষ্ট্রপতি পারেন? আমি আশা করবো আগামী দশকগুলিতেও ঈশ্বর আমাদের এমন বৌদ্ধিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব জুগিয়ে যাবেন যাঁরা এই কঠিন সময়ে শক্ত হাতে হাল ধরে থাকতে পারবেন এবং ভারত যাতে কোনোভাবেই পরমুখাপেক্ষী না হয়ে সর্বতোভাবে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে, সেটা নিশ্চিত করতে পারবেন। জয় ভারতমাতার জয়।
No comments:
Post a Comment