Blog Archive

Tuesday, May 31, 2022

ভক্তিসূত্র

আমাদের মতন explorer সংসারীদের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেব বারেবারে চারটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন, মাঝেমাঝে সাধুসঙ্গ করো, মাঝেমাঝে নির্জনে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তা করো, মনে মনে বিচার করো আর প্রার্থনা করো যাতে তিনি ভক্তি-বিশ্বাস দেন। ঠাকুর বলছেন, "বদ্ধ জীবেরা ঈশ্বরচিন্তা করে না। যদি অবসর হয় তাহলে আবোল তাবোল ফালতো গল্প করে, নয় মিছে কাজ করে। জিজ্ঞাসা করলে বলে আমি চুপ করে থাকতে পারিনা, তাই বেড়া বাঁধছি। হয়তো সময় কাটে না। দেখে তাস খেলতে আরম্ভ করে।" যা যা ঠাকুর করতে বলেছেন সেগুলির প্রত্যেকটির এক একটা উল্টোদিক আছে, যেগুলি বর্জনীয়। অসাধু সঙ্গ ত্যাগ করো, সবসময় কোলাহলের মধ্যে থেকো না, আসক্তি আর বাসনার গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যেও না আর শুকনো বইপড়া জ্ঞানের পেছনে না দৌড়ে, সীমিত বুদ্ধি দিয়ে Abstarct এবং Impersonal-কে বুঝতে চেষ্টা না করে, ভক্তি এবং বিশ্বাসকে ধরে এগোবার চেষ্টা করো কারণ সেটা অপেক্ষাকৃত সহজ। আর কি বলছেন? বলছেন খামোখা আড্ডা মেরে, পার্টি করে, হাহা হিহি করে, নাচানাচি করে সময় নষ্ট করো না, যে কাজের জন্য এতগুলো যোনির মধ্যে বিরলতম মানুষের শরীর ও মস্তিষ্ক লাভ করেছ, সময় থাকতে সেই আসল কাজে লেগে পড়ো।

নারদীয় ভক্তিসূত্রে ৪৬ নং সূত্রে নারদমুনি বলছেন 'কস্তরতি কস্তরতি মায়াম? যঃ সঙ্গাংস্ত‍্যজতি, যো মহানুভবং সেবতে, যো নির্মমো ভবতি।' কস্তরতি মানে কঃ তরতি অর্থাৎ কে পেরিয়ে যায়? Emphasise করার জন্য মুনি দুবার জিজ্ঞেস করছেন, কে পেরিয়ে যায় কে পেরিয়ে যায়? কি অতিক্রম করে? না, মায়া। তারপর উত্তর দিচ্ছেন, যে অসৎ সঙ্গ আর আসক্তি দুটোই ত্যাগ করে, যে মহৎ ব্যক্তির সেবা বা সঙ্গ করে আর সেটা করতে করতে যে নির্মম হতে শেখে বা সোজাকথায় ধীরে ধীরে মোহমুক্ত, মমত্বত্যাগী এবং নিরহঙ্কারী হয়ে ওঠে। ওই একই কথা, যা ঠাকুর বলছেন। যে সঙ্গ তোমায় রিপুর দিকে টেনে নিয়ে যায়, তা কুসঙ্গ - তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করো। সুসঙ্গ কি? না মহৎব্যক্তির সঙ্গ, সাধুসঙ্গ। ঠাকুর বলতেন, "সাধুকে দিনে দেখবি রাতে দেখবি তবে বিশ্বাস করবি"। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
জ্ঞেয়ঃ স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি । 
নির্দ্বন্দ্বো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাৎ প্রমুচ্যতে ।। ৫.৩
অর্থাৎ, তাঁকেই নিত্যসন্ন্যাসী বলে জানবে, যিনি রাগদ্বেষ রহিত, কারণ হে মহাবাহাে, যিনি দ্বন্দ্বমুক্ত, তিনিই সহজে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হন।

এখন সাধুসঙ্গ করলে কি হয়? যত তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় তত তাঁদের জীবনবোধ, তাঁদের ধর্মবোধ আর তাঁদের আধ্যাত্মিক শক্তি সংসারী ব্যক্তির ভাবনাচিন্তাকে postively influence করতে শুরু করে। আমাদের নিরিখে সামাজিক প্রতিষ্ঠায়, প্রতিপত্তিতে এবং প্রভাবে যিনি হয়তো কোনো তুলনাতেই আসেন না, যিনি হয়তো কপর্দকশূন্য, হয়তো recluse, তাঁর প্রতি আমি আকৃষ্ট হবো কেন, কেন তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হবো? কারণ তাঁর কাছে সেটা আছে যা আমার পরিচিত বৃত্তের মধ্যে  কারো কাছে নেই। ঠাকুর যেমন বলতেন, "যার কাছে গুড়ের নাগরি আছে, সে যদি রােগীকে বলে, 'গুড় খেয়াে না', রােগী তার কথা তত শুনে না।" সাধুর কাছে গুড় নেই, অমৃত আছে, তাই তাঁর কথা শুনবো, সেগুলি নিয়ে ভাববো, সত্যাসত্য বিচার করবো। নারদমুনি বলছেন 'লভ্যতেহপি তৎকৃপয়ৈব' (ভক্তিসূত্র, ৪০) অর্থাৎ ঈশ্বরের কৃপা থাকলেই সাধুসঙ্গ লাভ হয়। সেইজন্যে প্রার্থনা করতে হয়। তারপরের ৪১নং সূত্রতেই বলছেন, 'তস্মিংস্তজ্জনে ভেদাভাবাৎ'। এখানে তস্মিন্ মানে ভগবান, তজ্জনে মানে ভক্ত আর ভেদাভাবাৎ মানে ভেদের অভাব। অর্থাৎ ভগবান ও তাঁর ভক্তের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই বলেই একের অনুগ্রহেই অপরের অনুগ্রহ পাওয়া যায় (পূজ্যপাদ স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ কৃত ভাবানুবাদ)। এঁদের সঙ্গ পেলে মনে বিচার উঠতে শুরু করে, 'আমি কে'? ওইখান থেকেই আধ্যাত্মপথে যাত্রার শুরু।

এইবার আসল কথা - ভক্তি। ঠাকুর বলছেন, "একটা পথ দিয়ে ঠিক যেতে পারলে তাঁর কাছে পৌঁছানো যায়। তখন সব পথের খবর জানতে পারে। যেমন একবার কোন উপায়ে ছাদে উঠতে পারলে, কাঠের সিঁড়ি দিয়াও নামা যায়; পাকা সিঁড়ি দিয়াও নামা যায়; একটা বাঁশ দিয়াও নামা যায়; একটা দড়ি দিয়াও নামা যায়"। ভক্তি যেমন একটা পথ, তেমনি একটি পাথেয়ও বটে। নারদ বলছেন, ভক্তি স্বয়ংই ফলরূপা, স্বয়ং ফলরূপতা ইতি ব্রহ্মকুমারঃ (ভক্তিসূত্র, ৩০)। কেন সাক্ষাৎ ফল না বলে ফলরূপা বলছেন? পরম পূজনীয় ভূতেশানন্দজী বুঝিয়ে দিচ্ছেন, 'যে কোনো কর্মের ফল হচ্ছে উৎপন্ন বস্তু। কিন্তু ভক্তি উৎপন্ন বস্তু নয়, ভক্তি আমাদের অস্তিত্বের, আমাদের স্বত্তারই উপাদান। কর্ম বা সাধন দ্বারা যে বস্তু লাভ করি তা আবার বিনষ্ট হতে বাধ্য। ...কিন্তু যদি কেউ একবার ভক্তি লাভ করেন, সে ভক্তির আর ক্ষয় নেই। এইটি বোঝানোর জন্য ফলরূপা বলা হয়েছে'। ভক্তির মূল element হলো প্রেম বা ভালোবাসা, যে ভালোবাসায় কোনো স্বার্থগন্ধ নেই। যাঁকে ভালোবাসি তাঁকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ না করতে পারলেও ক্ষতি নেই, তাতে ভালোবাসার টান একটুও কমে না। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, "কোন কামনা-বাসনা রাখতে নাই কামনা-বাসনা থাকলে সকাম ভক্তি বলে! নিষ্কাম ভক্তিকে বলে অহেতুকী ভক্তি। তুমি ভালবাসো আর নাই বাসো, তবু তোমাকে ভালবাসি। এর নাম অহেতুকী।" নারদীয় ভক্তিসূত্র ব্যাখ্যা করে পরম পূজনীয় ভূতেশানন্দজী বলছেন 'ভক্তি শব্দটির মধ্যে সাধন-সাধ্য দুটি ভাবই আছে। ...ভক্তির চরম অবস্থাই ভক্তের পরম সাধ্যবস্তু। ...ভক্তের কিছু ত্যাগ করতে হয়না। ...কারণ তিনি দেখেন অন্যভাবে। তিনি যা কিছু দেখেন সবই তাঁর কাছে ঈশ্বর। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তিনি আমাকে তথা বিশ্বজগৎকে ব্যাপ্ত করে আছেন। তিনি ছাড়া কোনো বস্তুর অস্তিত্বই নেই।' 

মজাটা হলো, যোগ বা জ্ঞানের পথে চললেও অনেক ঠোক্করটোক্কর খেয়ে অবশেষে ঠিক এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে হয় যে তিনি ছাড়া আর কিছু নেই, সবই ব্রহ্ম। 

শ্রীরামকৃষ্ণ — বিজ্ঞানী কেন ভক্তি লয়ে থাকে? এর উত্তর এই যে, ‘আমি’ যায় না। সমাধি অবস্থায় যায় বটে, কিন্তু আবার এসে পড়ে। আর সাধারণ জীবের ‘অহং’ যায় না। অশ্বত্থগাছ কেটে দাও, আবার তার পরদিন ফেঁক্‌ড়ি বেরিয়েছে। (সকলের হাস্য)

“জ্ঞানলাভের পরও আবার কোথা থেকে ‘আমি’ এসে পড়ে! স্বপনে বাঘ দেখেছিলে, তারপর জাগলে, তবুও তোমার বুক দুড়দুড় করছে। জীবের আমি লয়েই তো যত যন্ত্রণা। গরু ‘হাম্বা’ (আমি) ‘হাম্বা’ করে, তাই তো অত যন্ত্রণা। লাঙলে জোড়ে, রোদবৃষ্টি গায়ের উপর দিয়ে যায়, আবার কসাইয়ে কাটে, চামড়ায় জুতো হয়, ঢোল হয় — তখন খুব পেটে। (হাস্য)

“তবুও নিস্তার নাই। শেষে নাড়ীভুঁড়ি থেকে তাঁত তৈয়ার হয়। সেই তাঁতে ধুনুরীর যন্ত্র হয়। তখন আর ‘আমি’ বলে না, তখন বলে ‘তুঁহু’ ‘তুঁহু’ (অর্থাৎ ‘তুমি’, ‘তুমি’)। যখন ‘তুমি’, ‘তুমি’ বলে তখন নিস্তার। হে ঈশ্বর, আমি দাস, তুমি প্রভু, আমি ছেলে, তুমি মা।

“রাম জিজ্ঞাসা করলেন, হনুমান, তুমি আমায় কিভাবে দেখ? হনুমান বললে, রাম! যখন ‘আমি’ বলে আমার বোধ থাকে, তখন দেখি, তুমি পুর্ণ, আমি অংশ; তুমি প্রভু, আমি দাস। আর রাম! যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি, তুমিই আমি, আমিই তুমি।

“সেব্য-সেবক ভাবই ভাল। ‘আমি’ তো যাবার নয়। তবে থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে।”
(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, পঞ্চম পরিচ্ছেদ, ১৮৮২, ৫ই অগস্ট)

Sunday, May 29, 2022

ষোড়শীরূপে শ্রীশ্রীমা

আজ ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। এই মুহূর্তে জ্যৈষ্ঠ কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথি চলছে, আর কিছুক্ষন পর ১৪.৫৬ মিঃ অমাবস্যা পড়ে যাবে। একে সাবিত্রী চতুর্দশীও বলে। আজই রাতে ফলহারিনী কালীপূজা। জ্যৈষ্ঠমাসে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি নানারকমের মরসুমি ফল পাওয়া যায়। সাধক তাঁর ইষ্টদেবীকে বিভিন্ন ফল দিয়ে প্রসাদ নিবেদন করে থাকেন। একদিকে ফলহারিণী মা সাধকের কর্মফল হরণ করেন। অপর দিকে কর্মফল হরণ করে সাধককে তাঁর অভীষ্টফল, মোক্ষফল প্রদান করেন।

এই সেই বিশেষ রাত যেদিন ১২৮০ বঙ্গাব্দে, আজ থেকে ১৪৯ বছর আগে, ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব শ্রীশ্রীমাকে দশ মহাবিদ্যার অন্যতম দেবী ষোড়শী রূপে ষোড়শোপাচারে পূজা করেছিলেন। মায়ের নিজের বর্ণনা অনুযায়ী ঠাকুরের এক জ্ঞাতিভাইয়ের ছেলে দিনু আর ভাগ্নে হৃদয় দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে পুজোর সব আয়োজন করে দিয়েছিলেন। মা চৌকির উত্তর পাশে গঙ্গাজলের জালার দিকে মুখ করে বসেছিলেন আর ঠাকুর উত্তর-পূর্বদিকে মুখ করে পশ্চিমদিকের দরজার কাছে বসেছিলেন। ঠাকুর প্রথমে মায়ের গায়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেন। তারপর মায়ের পায়ে আলতা পরিয়ে দিলেন, সিঁদুর দিলেন, কাপড় পরিয়ে দিলেন, পান মিষ্টি খাওয়ালেন। সব দরজা বন্ধ ছিল আর মায়ের ডান পাশে সব পূজার জিনিষপত্র ছিল। পুজোয় বসে বিধিপূর্বক আচমন ইত্যাদি করার পর ঠাকুর ৺দেবী ত্রিপুরসুন্দরীর কাছে প্রার্থনা করলেন, "হে বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরসুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর মা, এঁর শরীরমনকে পবিত্র করে এঁতে আবির্ভূতা হয়ে সর্বকল্যাণ সাধন কর!" 

যে মুহূর্তে এই শব্দগুলি মায়ের কানে গেল, তাঁর বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত হলো এবং তিনি গভীর সমাধিতে ডুবে গেলেন। তারপরেই ঠাকুরও অর্ধবাহ্যদশায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে সম্পূর্ণ সমাধিমগ্ন। পূজকও সমাধিস্থ, সামনে পুজিতা দেবীও সমাধিস্থা - এইভাবে আত্মস্বরূপে পূর্ণভাবে মিলিত ও একীভূত হয়ে কতক্ষণ যে কেটে গেল কে জানে। খানিকটা বাহ্যজ্ঞান ফিরে আসার পর ঠাকুর শ্রীশ্রীমায়ের পাদপদ্মে নিজের সারা জীবনের সাধনার ফল ও জপের মালা অর্পণ করে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বললেন, "হে সর্বমঙ্গলের মঙ্গলস্বরূপে, হে সর্বকর্ম নিষ্পন্নকারিণী, হে শরণদায়িনী, ত্রিনয়নী, শিবগেহিনি গৌরি, হে নারায়ণি, তোমাকে প্রণাম করি।" পূজা শেষ হলো। মা কোনোমতে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন, তখনো সম্পূর্ণরূপে তাঁর বাহ্যজ্ঞান ফেরেনি।

এই কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে মাত্র কিছুদিন আগে, স্বয়ং শিব সশরীরে পূজা করেছেন তাঁর শক্তিকে - ভাবা যায়? অনন্দলহরী স্ত্রোত্রের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে,
তনিয়াংসং পাংশুন তব চরণপঙ্কেরুহভবং  
বিরিঞ্চি সঞ্চিবন বিরচয়তি লোকানবিকলম ।
বহতোনং শৌরীঃ কথমপি সহস্রেন শিরসং
হরঃসংক্ষু দৈনয়ং ভজতি ভসিতো দ্ধুলনবিধিম ।।
অর্থাৎ, জননী তোমার চরণপদ্ম হইতে উদ্ভূত ধূলির কনা মাত্র কুড়াইয়া লইয়া ব্রহ্মা যথাযতভাবে এই জগৎ প্রপঞ্চ সৃষ্টি করেন, আর এই ধূলিকনাকেই সহস্র শিরের দ্বারা বিষ্ণু অনন্তরূপে কোনো প্রকারে বহন করেন। আর প্রলয়সময়ে তাহাকেই  (ধূলিকনাকেই) চূর্ণ করিয়া শিব স্বীয় অঙ্গে বিভূতিলেপন ক্রিয়ায় নিরত হন।
ঠাকুর পরে বলেছিলেন, “ও সারদা – সরস্বতী – জ্ঞান দিতে এসেছে। রূপ থাকলে পাছে অশুদ্ধ মনে দেখে লোকের অকল্যাণ হয়, তাই এবার রূপ ঢেকে এসেছে। ও জ্ঞানদায়িনী, মহাবুদ্ধিমতী। ও কি যে সে ! ও আমার শক্তি!” 

ত্রিপুর, অর্থাৎ তিনটি পুর, বা তিনটি অবস্থা। যিনি পরাশক্তি, মহাদেবী ও মহাবিদ্যা অর্থাৎ সৃষ্টির কারণ, সৃষ্টির পালন এবং অবিদ্যার বিনাশের মূল শক্তি হয়ে বিরাজ করছেন, তিনিই ত্রিপুরসুন্দরী। সৃষ্টি আর স্থিতি তাঁতেই আধারিত। কালীরূপে সেই তিনিই রয়েছেন। তবে কালী অবিদ্যা বিনাশের প্রতীক। অর্থাৎ বিলীন বা সমাধি। তাই ঠাকুর শূন্য থেকে শুরু করে পূর্ণের দিকে গেলেন। 'যে মা স্বয়ং মন্দিরে আছেন', সেই ভবতারিণী মহাকালীকে 'সমাধিমন্দির' থেকে নামিয়ে প্রতিষ্ঠা করছেন জীবন আর জাগরণের অলিন্দে। দায়ভার সঁপে দিচ্ছেন। 'কলকাতার লোকগুলো যেন পোকার মতো কিলবিল করছে। তুমি তাদের দেখো।' এই দায় কালী রূপটি নিতে পারেন না। এই দায় নিতে পারেন একমাত্র ষোড়শী ত্রিপুরসুন্দরী। তাই তাঁকেই শ্রীশ্রীমায়ের মূর্তিমতী বিদ্যারূপিণী মানবীশরীরে উদ্ভোদিত করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।

এর অনেকবছর পর আর এক ফলহারিণী পূজার দিনে ঠাকুরের মাতৃউদ্দীপনের কথা মাষ্টারমশাই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতেএইভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন:
'আজ জৈষ্ঠ কৃষ্ণা চতুর্দশী। সাবিত্রী চতুর্দশী। আবার অমাবস্যা ও ফলহারিণী-পূজা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে নিজ মন্দিরে বসিয়া আছেন। ভক্তেরা তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিতেছেন। সোমবার, ইংরেজী ৪ঠা জুন, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ।

মাস্টার পূর্বদিন রবিবারে আসিয়াছেন। ওই রাত্রে কাত্যায়নীপূজা। ঠাকুর প্রেমাবিষ্ট হইয়া নাটমন্দিরে মার সম্মুখে দাঁড়াইয়া, বলিতেছেন, 
“মা, তুমিই ব্রজের কাত্যায়নী:
তুমি স্বর্গ, তুমি মর্ত মা, তুমি সে পাতাল।
তোমা হতে হরি ব্রহ্মা, দ্বাদশ গোপাল।
দশ মহাবিদ্যা মাতা দশ অবতার।
এবার কোনরূপে আমায় করিতে হবে পার।”
ঠাকুর গান করিতেছেন ও মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন। প্রেমে একেবারে মাতোয়ারা! নিজের ঘরে আসিয়া চৌকির উপর বসিলেন।'

জয় জয় গুরুমাতা জগৎ-জননী ।
রামকৃষ্ণ ভক্তিদাত্রী চৈতন্যদায়িনী ।।

Saturday, May 28, 2022

সংস্কার ও বৃত্তি

মহর্ষি পতঞ্জলি তাঁর যোগসূত্র বইটিতে চারটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন - সংস্কার, বৃত্তি, জ্ঞান ও স্মৃতি। উনি বলছেন, 'অনুভূত বিষয় অসম্প্রমোষঃ স্মৃতিঃ' অর্থাৎ কোনো বিষয় অনুভূত হলে যে সংস্কার উৎপন্ন হয়, সেই সংস্কার উদ্বুদ্ধ হলে যে জ্ঞান হয়, তাকে স্মৃতি বলে। যে অবস্থায় সমস্ত বৃত্তি নিরুদ্ধ হয়ে কেবলমাত্র সংস্কার অবশিষ্ট থাকে, তাকেই যোগসূত্রে নিরুদ্ধ অবস্থা বলা হয়েছে। নিরুদ্ধভূমিতে চিত্ত সম্পূর্ণরূপে শান্ত, স্থির ও বৃত্তিহীন থাকে। এই অবস্থাকেই অসম্পরাজ্ঞত যোগ বা অসম্পরাজ্ঞত সমাধি বলে, যখন জ্ঞাতৃ-জ্ঞেয় ভেদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। 

তাহলে জ্ঞানের পথে হাঁটার গোড়ার বিষয় হলো সংস্কার আর বৃত্তি। আমাদের মা ঠাকুমারা এতকিছু না পড়েই সহজাত হিন্দু জীবনবোধের উত্তরাধিকারের কারণে কত সহজেই না বলতেন, "অমুকের কত জন্মের সংস্কার কে জানে বাপু, অত সহজে কি যায়?" এর পেছনে যে গভীর দর্শন লুকিয়ে আছে, সেটা হয়তো তাঁরা জানতেন না কিন্তু সংস্কার যে একটা storehouse of memories from past lives, সেটা তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন।

আমরা এক্ষুনি যা ভাবছি সেটা আমাদের সংস্কার থেকে উঠে আসছে। এই ভাবনাটাকেই বলে বৃত্তি। আবার, বৃত্তিই ঘুরে সংস্কারে গিয়ে জমা হচ্ছে এবং এই cycle গোলগোল ঘুরেই চলেছে। সংস্কার যেহেতু sub-conscious বা অবচেতনে গচ্ছিত থাকে, ফলে আত্মা যখন দেহ থেকে দেহান্তরে ভ্রমণ করেন, তখন তাঁর সাথে সাথে সূক্ষ্মশরীররূপী মনও জন্ম মৃত্যুর সাথে সাথে এক দেহ থেকে অন্য দেহে ভ্রমণ করে। ফলে তার অঙ্গরূপে সংস্কারও একই কারণে নতুন দেহে গিয়েও পুরানো বৃত্তি উৎপন্ন করতে থাকে। এই সংস্কারের ওপর আমাদের কোনো হাত নেই, আবার আছেও। কিভাবে?

বৃত্তি জমে জমে সংস্কার তৈরি হয় ঠিকই কিন্ত আমরা কি ভাববো বা না ভাববো, কিভাবে ভাববো বা না ভাববো, সেটা সম্পূর্ণভাবে আমাদেরই হাতে থাকে। হয়তো কেউ কোনো কিছু করলেন যেটা আমার মনঃপুত নয়। আমি দুরকমভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি। হয় উত্তেজিত হয়ে তাকে গর্ধব, বুদ্ধিহীন ইত্যাদি বলে গালাগাল দিতে পারি অথবা সে যেমন তাকে তেমনভাবেই গ্রহণ করে শান্ত এবং অবিচলিত থাকতে পারি। আমি নিজের মনকে যেভাবে গড়ে তুলবো, সংস্কারের storehouse থেকে আমার মনে ঠিক সেই গোত্রের ভাবনাই প্রতিগ্রহিত হবে, অনেকটা যেমন AI এর ক্ষেত্রে হয়। হয়তো গুগুলে একবার কোনো একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের বিস্কুট সার্চ করলাম, তারপর নিজে থেকেই কিছুদিন ধরে নানারকমের বিস্কুট search engine নিজেই throw up করতে থাকবে। আমাদের বৃত্তি যদি সদর্থক থাকে তাহলে সংস্কারের মধ্যে থেকে সদর্থক দিকটিই ওপরে উঠে আসতে থাকবে এবং নেতিবাচক দিকটি অব্যবহৃত থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে একেবারে মুছে যাবে।

অন্তর্মুখী হতে গেলে মনকে শান্ত করা অত্যন্ত জরুরি। মন যদি বিক্ষিপ্ত থাকে তাহলে নানা বিষয়ের পেছনে ছুটে ছুটে সে এমন রজঃ ও তমগুনের আধিক্য সৃষ্টি করে যে ইন্দ্রিয়াশক্তি বেড়ে গিয়ে অসংখ্য কামনা বাসনা তৈরি হয়। আর তার থেকেই না পাওয়ার যন্ত্রণা, অন্যের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ, জীবনের প্রতি তিক্ততা আর সবার শেষে সামগ্রিকভাবে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়। এমনটা হলে অতীন্দ্রিয় বিষয়ের ব্যাপারে চিন্তা করার মতো ইচ্ছা বা ধৈর্য্য কোনোটাই আর থাকে না। যেখানে ভোগ সেখানে যোগ নেই। মন বুদ্ধি এবং অহঙ্কার - এই তিনটি অন্তঃকরণকেই যোগদর্শনে চিত্ত বলা হয়েছে। অচেতন প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত বলে চিত্তও অচেতন। চৈতন্য প্রতিবিম্বিত হওয়ায় চিত্ত চেতন বলে প্রতিভাত হয়।

পতঞ্জলি বলছেন 'যোগঃ চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ' অর্থাৎ চিত্তবৃত্তি নিরোধই যোগ। কেউ বলতেই পারেন যে যেহেতু যুজ্ ধাতু যোগ শব্দ নিষ্পন্ন, ফলে যোগ হলো সংযোগ, নিরোধ নয়। এখন, যুজ্ ধাতুর প্রয়োগ কেবল সংযোগ অর্থেই হয় না, সমাধি অর্থেও হয়। মহাত্মা পাণিনি বলেছেন, 'যুজ্ সমাধৌ', আচার্য ব্যাসদেবও বলেছেন, 'যোগঃ সমাধিরিতি'। সবসময় যে সবকিছুর ব্যুৎপত্তিগত অর্থই ধরতে হবে, এমন কোনো কথা নেই যেমন গো বলতে আমরা যেকোনো গমনশীল বস্তু না বুঝে কেবল গরুই তো বুঝি। এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হলো চিত্ত বৃত্তি নিরোধ, সমাধি তার by product মাত্র। ফলে আমরা বৃত্তিকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করি তার ওপরেই নির্ভর করে আমাদের সংস্কার আর সেখান থেকেই জ্ঞানের সূত্রপাত। ভগবান বলছেন 'জ্ঞানী ত্বাত্মৈব মে মতম্' (গীতা ৭/১৮), জ্ঞানী আমার আত্মস্বরূপ।

মনের মধ্যে একটা একাগ্রভূমি আছে যেখানে সত্ত্বগুণের প্রাধান্য থাকে এবং সেখানে ধ্যেয় বিষয়ক বৃত্তি ছাড়া অন্য সব বৃত্তি নিরুদ্ধ হয়। মনকে শান্ত করতে গেলে ধ্যেয়রূপী একটা শুদ্ধ অবলম্বন চাই। সেটি কিভাবে পাবো? না, সদগুরু দেবেন। আমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে যুগে যুগে তাই হয়ে এসেছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। পঞ্চদশীতে বিদ্যারণ্য স্বামী এর একটি সুন্দর চিত্রকল্প তৈরি করেছেন,
কুর্বতে কর্ম ভোগায়, কর্ম কর্ত্তুঞ্চভুঞ্জতে
নদ্যাং কীটা ইব, অবর্তাৎ আবর্তান্তরম্ আশু তে
ব্রজন্তো জন্মনো জন্ম, লভন্তে নৈব নির্বৃতিম্।
সৎকর্ম-পরিপাকাৎ তে, করুণানিধিনোদ্ধৃতাঃ।
প্রাপ্য তীর-তরুচ্ছায়াং, বিশ্রাম্যন্তি যথাসুখম্।।
অর্থাৎ, নদীর স্রোতের মধ্যে আপতিত অসহায় এক ক্ষুদ্র কীট যতবার স্বচেষ্টায় স্রোতের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে, ততই কোনও না কোনও ঘূর্ণাবর্ত তাকে গ্রাস করে, ফলে এক ঘূর্ণাবর্ত থেকে অন্য ঘূর্ণাবর্তে - ঘূর্ণির পরম্পরাচক্রে (vicious circle) সে ঘুরতে থাকে। অবশেষে এক শুভক্ষণে সে এক মহাপুরুষের দয়ার্দ্র দৃষ্টির সীমার মধ্যে এলে, পরমকরুণাময় ওই পুরুষ কীটটিকে ঘূর্ণাবর্ত থেকে তুলে তীরবর্তী এক বৃক্ষছায়ায় ছেড়ে দেন। (ভাবানুবাদ স্বামী সর্বাত্মানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন) এরপর সে কিভাবে জ্ঞানলাভের পথে চলবে, সেটা সম্পূর্ণরূপে তার নিজের ব্যাপার।

Thursday, May 26, 2022

আরাত্রিক ভজন, নবম স্তবক

শ্রীরামকৃষ্ণ মঠে স্বামীজীরচিত যে আরাত্রিক ভজনটি প্রতিদিন সন্ধ্যায় গাওয়া হয় তার নবম স্তবকে কিছু অদ্ভুত শব্দবন্ধ আছে, যেটি আসলে স্বামীজী প্ৰথমে দ্বিতীয় স্তবক হিসেবে লিখেছিলেন, পরে আগের স্তবকগুলি লিখে গানটি অনেকটাই পরিবর্তন করেন। রামকৃষ্ণ-অনুরাগীরা সকলেই এই ভজনটি by heart জানেন। অদ্ভুত এই কারণে বলছি কারণ যাঁর সম্পর্কে তিনি এই কথাগুলি লিখেছেন তাঁকে তিনি রক্ত-মাংসের শরীরে অন্তরঙ্গভাবে দেখেছেন, পাঁচ বছরের কিছু কম সময়ে লাগাতার তাঁর দিব্য সঙ্গ করেছেন, নানাভাবে তাঁকে পরীক্ষা করেছেন, তাঁর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক শক্তি গ্রহণ করেছেন, তিনি যখন অসুস্থ তখন তাঁকে খাইয়ে দিয়েছেন, ক্ষত পরিষ্কার করে দিয়েছেন, রাতদিন সেবা করেছেন - কাউকে একেবারে যতদূর কাছ থেকে দেখা সম্ভব, ঠাকুরকে ততটাই কাছ থেকে দেখেছেন। আর দেখার মতন দেখেছেন বলেই স্বামীজী লিখেছেন,
নমো নমো প্রভু বাক্যমনাতীত
মনোবচনৈকাধার ।
জ্যোতির জ্যোতি উজল হৃদিকন্দর 
তুমি তমোভঞ্জনহার ॥ 
অর্থাৎ, তোমায় বারবার প্রণাম করি প্রভু, তুমি একইসাথে বাক্য ও মনের অতীত আবার বাক্য ও মনের আধারও। হৃদয়ের মাঝে সদা প্রদৃপ্তমান যে জ্যোতি, তুমি সেই জ্যোতির জ্যোতি, তুমি অজ্ঞানতার অন্ধকার নাশ করো।

বাক্য মানে পূর্ণ অর্থজ্ঞাপক ও অন্বয়বিশিষ্ট পদসমষ্টি, যা বুদ্ধিনির্ভর, শরীরনির্ভর এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতি-নিৰ্ভর। মন মানে সূক্ষ্ম শরীর, যাকে সাহেবরা Soul বলেন, আমরা বলি মানস। এটি আত্মার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে এবং তাঁর সাথে সাথেই মৃত শরীর ত্যাগ করে কর্মফল অনুযায়ী বিভিন্ন স্তরের স্বর্গ ঘুরে অবশেষে আবার নতুন শরীর গ্রহণ করে। একমাত্র মুক্ত আত্মাই নির্ণয় করতে পারেন তিনি তাঁর মন রাখবেন না ত্যাগ করবেন, বাকি কারো পক্ষে সেটা সম্ভব নয়*। এই বাক্য ও মনের অতীত কে? নির্গুণ ব্রহ্ম। আবার বাক্য ও মনের আধার কি? না মায়া, শক্তি, সগুণ ব্রহ্ম। জীবের এই অন্নময় কোষ আর মনোময় কোষ তো মহামায়ার ভানুমতির খেল, ওতেই তো অহংকারের উৎপত্তি এবং ওর জন্যই তো যত রাজ্যের ভোগান্তি। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়ালো? স্বামীজী ঠাকুরকে ব্রহ্ম এবং শক্তি, পুরুষ এবং প্রকৃতি, নির্গুণ এবং সগুণ - একাধারে দুটোই বলে বর্ণনা করছেন যা আসলে দুই নয়, একই - ঠাকুরের কথা অনুযায়ী যেমন আগুন আর তার দাহিকাশক্তি, সমুদ্র আর তার ঢেউ - আপাতদৃষ্টিতে আলাদা অথচ এক এবং অবিভাজ্য।

এরপরে ঠাকুরকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন 'জ্যোতির জ্যোতি'। কবীরের দোহায় আছে, 
কবীরা সকলী বৌলে বাণী সব ঘটমে ঘর ছান্না।
অনংত লুট হোত ঘট ভিতর ঘটকা মর্ম ন পায়া।।
অর্থাৎ,
কবীর অখন্ড কহিতেছেন বাণী
সকল ঘটে ব্যাপ্ত করিয়াছেন তিনি (তাঁহার) ঘর
ঘটের ভিতর অনন্তের হইতেছে লুট
ঘটের মর্ম না পাইলাম।
(কবীর, ক্ষিতিমোহন সেন)
আমাদের পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, মন বুদ্ধি অহংকার আনন্দ সবকিছুর দ্রষ্টা তো সেই একম অদ্বিতীয়ম আত্মা, যাঁকে বেদপড়া সাবেবরা বলেন Self আর আমরা বলি তুরীয়। জলভরা প্রত্যেকটি ঘটে অর্থাৎ জীবদেহে তো সেই একই সূর্য্যের প্রতিবিম্ব। ইনি অবিনশ্বর, অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকারী। এঁর সম্পর্কে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২৩ ও ২৪ নং শ্লোকে ভগবান বলছেন,
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ ।
ন চৈনং ক্লেদযন্ত্যাপো ন শোষযতি মারুতঃ ।।
অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ ।
নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ ।।
অর্থাৎ, আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা ছিন্ন করা যায় না, আগুনে পোড়ান যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা হাওয়াতে শুকানোও যায় না। এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশোষণীয়। তিনি চিরস্থায়ী, সর্বব্যপ্ত, অপরিবর্তনীয়, অচল ও সনাতন।
এই আত্মা কে? না সেই এক অনাদি অনন্ত ব্রহ্ম। জীবের জীবনজ্যোতি আসলে কার জ্যোতি? সেই অদ্বৈত ব্রহ্মের। তাই তিনি হলেন জ্যোতির জ্যোতি। অর্থাৎ ঠাকুরই সাক্ষাৎ ব্রহ্ম, এই কথাটিই একটু অন্যভাবে বললেন স্বামীজী। 

শেষে বলছেন, 'তুমি তমোভঞ্জনহার'। স্বামীজী ১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর জাফনার বক্তৃতায় আত্মার প্রকাশ সম্পর্কে বলছেন, 'The difference is not in the soul, but in the manifestation. Between me and the smallest animal, the difference is only in manifestation, but as a principle he is the same as I am, he is my brother, he has the same soul as I have. This is the greatest principle that India has preached'. এখানে স্বামীজি মিশনারিদের তখনকার চালু বাক্য-ব্যবহার অনুযায়ী আত্মা অর্থেই soul শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যদিও আত্মা আর soul এক নয়। খানিকক্ষণ পরেই উনি বলছেন, 'And what are our relations with this Impersonal Being (ব্রহ্ম)? — that we are He. We and He are one. Every one is but a manifestation of that Impersonal, the basis of all being, and misery consists in thinking of ourselves as different from this Infinite, Impersonal Being; and liberation consists in knowing our unity with this wonderful Impersonality. ....It is only through the idea of the Impersonal God that you can have any system of ethics. In every nation the truth has been preached from the most ancient times — love your fellow-beings as yourselves — I mean, love human beings as yourselves. In India it has been preached, "love all beings as yourselves"; we make no distinction between men and animals'. যে মুহূর্তে আমি সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারবো যে আমি শরীর নই, মন নই, বুদ্ধি নই, আমিই ব্রহ্ম, 'অহং ব্রহ্মাস্মি'- অমনি আমার মন থেকে অজ্ঞানতার অন্ধকার মুছে যাবে, আমার স্বরূপ দর্শন হবে। 

মানুষ হয়ে জন্মেছি, মাথার মধ্যে এত বুদ্ধি গিজগিজ করছে, এত পড়াশুনা করেছি, তাহলে এই সহজ সত্যটা ধারণা করতে পারছি না কেন? ঠাকুর বলছেন 'অহংকার'। বলছেন, "মানুষ আপনাকে চিনতে পারলে ভগবানকে চিনতে পারে। 'আমি কে' ভালরূপ বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, 'আমি' বলে কোন জিনিস নেই। হাত, পা, রক্ত, মাংস ইত্যাদি - এর কোনটা 'আমি'? যেমন প্যাঁজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কেবল খোসাই বেরোয়, সার কিছু থাকে না, সেইরূপ বিচার কল্লে 'আমি' বলে কিছুই পাইনে! শেষে যা থাকে, তাই আত্মা - চৈতন্য। 'আমার' 'আমিত্ব' দূর হলে ভগবান্ দেখা দেন।" স্বামীজী বলছেন অজ্ঞানতার কারণেই আমাদের বারবার পৃথিবীতে আসা, 'How did It (আত্মা) come down to earth? There is but one answer to that in our scriptures. Ignorance is the cause of all this bondage. It is through ignorance that we have become bound; knowledge will cure it by taking us to the other side. How will that knowledge come? Through love, Bhakti; by the worship of God, by loving all beings as the temples of God. He resides within them. Thus, with that intense love will come knowledge, and ignorance will disappear, the bonds will break, and the soul will be free'. এই পরম জ্ঞানলাভ একমাত্র ব্রহ্মকৃপা দ্বারাই সম্ভব আর সেই জন্য নিরন্তর প্রার্থনা করতে হয়। ঠাকুর স্বয়ং ব্রহ্ম, ফলে তাঁর কৃপা হলেই অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়ে গিয়ে আমাদের হৃদয় জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হবে।

১৮৮৫ সালের ৭ই মার্চ শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করছেন, "আচ্ছা, কেউ কেউ যে আমাকে ঈশ্বরের অবতার বলে, তোর কি বোধ হয়?" উত্তরে নরেন্দ্রনাথ বললেন, "অন্যের মত শুনে আমি কিছু করব না; আমি নিজে যখন বুঝব, নিজের যখন বিশ্বাস হবে, তখনই বলব।" বহুবছর পর এই আরাত্রিক ভজনের মাধ্যমে ব্রহ্মজ্ঞানী স্বামী বিবেকানন্দজী মহারাজ সবাইকে শোনালেন তাঁর গুরুকে তিনি কি চোখে দেখেন। গুরু শব্দের অর্থ, যিনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যান। এক্ষেত্রে অন্ধকার কী? অন্ধকার আমাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অজ্ঞতা, সংশয়, জিজ্ঞাসা, ইত্যাদি। এইসব যিনি অনায়াসে দূর করেন, তিনিই গুরু। তিনি নিজে যেহেতু জ্ঞানালোকিত, ফলে তিনি জ্যোতির্ময় হয়ে শিষ্যদের হৃদয়ও সেই পরমজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেন। তাই গুরুপ্রণাম মন্ত্রে বলা আছে,
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।।
অর্থাৎ, যিনি অজ্ঞান নামক অন্ধকার থেকে জ্ঞান নামক কাজলকাঠি ব্যবহার করে শিষ্যের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করেন, সেই গুরুকে প্রণাম জানাই। জ্ঞানাঞ্জন মানে জ্ঞান রূপ অঞ্জন অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞানরূপ কাজল যার দ্বারা অজ্ঞানরূপ অন্ধকার দূর হয় বা তিমিররোগ নিরাময় হয় এবং সমস্ত কিছুর প্রকৃত রূপ অর্থাৎ সবই যে ব্রহ্ম, এই সত্যটি উপলব্ধি করা যায়। গুরুরূপে ঠাকুর স্বামীজীর মধ্যে এই পরমজ্ঞানের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। ঠাকুরের নিজের কথায়, "যেমন পায়ে জুতা পরা থাকলে লোকে স্বচ্ছন্দে কাঁটার ওপর দিয়ে চলে যায়, তেমনি তত্ত্বজ্ঞানরূপ আবরণ পরে মন এই কণ্টকময় সংসারে বিচরণ করতে পারে।"

*'Atman is separate from the mind, as well as from the body, and that this Atman goes through birth and death, accompanied by the mind, the Sukshma Sharira. And when the time comes that it has attained to all knowledge and manifested itself to perfection, then this going from birth to death ceases for it. Then it is at liberty either to keep that mind, the Sukshma Sharira, or to let it go for ever, and remain independent and free throughout all eternity. The goal of the soul is freedom. That is one peculiarity of our religion.' (Swami Vivekananda, Lectures from Colombo to Almora, Vedantism)

শ্রীঅদিনাথসপ্তকম

ওঁ নমঃ শিবায় শ্রীআদিনাথায় ।
জয় আদিনাথ জটামৌলি দর্পচূর্ণকারী
জয় শঙ্কর শশীশেখর পাপতাশহারী ।।
জয় দেব দেব মহাদেব বাঞ্ছাপূর্ণকারী
জয় শিব অবিনাশী অনঘ দুঃখহারী ।।
জয় কৈলাশী শশীশেখর যোগী ত্রিপুরারী
জয় ডম্বরুধর দীননাথ বিভুতিভূষণধারী ।।
জয় অনেকাত্মা প্রজাপতি মদভঞ্জনকারী
জয় ত্র্যম্বকেশ বিষম্ভর সর্ববিঘ্নহারী ।।
জয় সদানন্দ গঙ্গেশ উমেশ মোহমারী
জয় ভোলানাথ আদিনাথ পাণ্ডুয়াবিহারী ।।
দেবাদিদেব আদিদেব বিজ্ঞান দানকারী  
নাথ আদিনাথ বিশ্বনাথ পরম কৃপাকারী ।।
নমঃ নমঃ শিব আদিনাথ চ শক্তিরূপা শিবদ্যুতি
আজন্মকৃতং কর্মফলং ভবতঃ স্মরণেণ বিনষ‍্যতি ।।
ওঁ শ্রীআদিনাথায় নমঃ ।
ইতি আদিনাথসপ্তকম সমাপ্তম ।

Wednesday, May 25, 2022

মিথ্যা অধিকারবোধ ভয়ঙ্কর

পূজনীয় স্বামী সর্বপ্রিয়নন্দজী মহারাজের একটি বক্তৃতার একটি ছোট অংশ শুনলাম যেখানে হার্ভার্ডে পাঠরত কিছু ভারতীয় ছাত্রদের আচরণে ব্যথিত হয়ে উনি বলেছেন যে বিদেশে নিজের মাতৃভূমির বিরুদ্ধে অনভিপ্রেত বিক্ষোভ প্রদর্শন নিজেদের হীনমন্যতা থেকে আসে। সে তো বটেই। আমার মতে তার থেকেও বেশি আসে sense of entitlement অর্থাৎ প্রয়োজনাতিরিক্ত অধিকারবোধ থেকে। এটি মারাত্মক একটি মানসিক দুর্দশা, যা যে কোনো ব্যক্তি, পরিবার, ব্যবসা, জাতি, রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যকে একেবারে শেষ করে দিতে পারে। কবি দার্শনিক যুবরাজ দারা সিকোহ তৈরি থাকতেও ছোটভাই ঔরঙ্গজেব তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সম্রাট হয়েছিল, আজ সাড়ে তিনশ বছর পরেও দেশসুদ্ধু লোক সেই খুনিকে ছিঃ ছিঃ করেন, তার নামাঙ্কিত রাস্তার নাম পাল্টে দেওয়া হয়। নেহেরুর পরিবার কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্বের জায়গাটিকে নিজেদের জন্মসিদ্ধ অধিকার বলে ধরে নিয়েছে, ফল কি হয়েছে তা লাগাতার নির্বাচনী বিপর্যয় এবং প্রতিদিন নেতা-কর্মীদের দল ছেড়ে চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে দেশ নতুন করে দেখছে। ছোটভাই অনিল আম্বানি বাবার তৈরি বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে ভুল অধিকারবোধের তাড়নায় অকারণে দুভাগ করেছিলেন, আজ প্রভাব প্রতিপত্তির নিরিখে বড়ভাই মুকেশ কোথায় আর তিনি কোথায়! 

একই অবস্থা পাকিস্তানেরও। হিন্দু সভ্যতার চেয়ে বেশি উদার এবং সর্বব্যাপী ভাবধারা সারা বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই অথচ সেই সভ্যতার উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করে এই ভূমিরই কিছু কুসন্তান একটি অনধিকার অধিকারবোধের বশে মাতৃভূমি ভাগ করেছিলেন। তাদের সেই কৃত্তিম বিধ্বংসী sense of entitlement-এর জন্য কত লক্ষ মানুষের হত্যা হয়েছিল, কত লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছিলেন, কত শতসহস্র মা-বোনের সতীত্বনাশ করা হয়েছিল, কত অসহায় মানুষকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল ও কত নিরীহ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন, ইতিহাসের পাতায় তা রক্তাক্ষরে লেখা আছে। সারা বিশ্ব দেখছে আজ সেই পাকিস্তানের অস্তিত্ব কোন অন্ধগলিতে আটকে গেছে আর ভারত কত দ্রুত সারা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম শক্তি এবং অগ্রগণ্য দেশ হয়ে উঠছে। 

একই অবস্থা হবে দেশের ভেতরের সেই সব সমুদায়ের যাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও কর্তব্যবোধের বদলে মেকি অধিকারবোধের আধিক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদি দ্রুত বোধোদয় না ঘটে, আর কয়েকদশকের মধ্যে তাদের সমূহের অবস্থা সেটাই হবে, যা আজ পাকিস্তানের হয়েছে। প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত যে শ্রীকৃষ্ণ কৌরবসভায় দৌত্য করতে গিয়ে পাণ্ডবদের জন্য শেষমেশ পাঁচটি মাত্র গ্রাম চেয়েছিলেন। দুর্যোধনের sense of entitlement ওটুকুও তাঁদের দিতে দেয়নি। শেষে কি হলো? পরিবার পরিজন বন্ধু মিত্র অমাত্য সব তো বধ হলোই, রাজ্যটিও খুইয়ে শেষে অপমানের চূড়ান্ত হয়ে নিজের প্রাণটিও তাঁকে খোয়াতে হয়েছিল। 

এটাই ঈশ্বরের নিয়ম, যুগে যুগে এটাই হয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও এটাই হবে। ভগবান বলছেন, ধর্মপথে থেকে জীবনধারণের জন্য যেটুকু তোমার প্রয়োজন, সেটুকুই তোমার প্রাপ্য। তারচেয়ে বেশি যদি কিছু পাও, তা কেবলমাত্র মানবকল্যাণে ব্যবহার করার জন্য। আর যা তোমার প্রাপ্য, তার চেয়ে বেশি কিছুর জন্য যদি লোভ করো বা অন্যায়ভাবে ভোগ করো, তাহলে সেটা অন্যের অধিকারহরণ। আমি সেটুকু তো কেড়ে নেবই, তোমার যা আসলে প্রাপ্য ছিল, শাস্তিস্বরূপ সেটাও কেড়ে নেব এবং অপরপক্ষকে দিয়ে দেবো।

The sun never sets on the British Empire! কি হলো তার শেষ পর্য্যন্ত? আমাদের চামড়া সাদা তাই আমরা কালোদের ওপর প্রভুত্ব করবো, আমরা তাদের হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা নিজস্ব শিক্ষা সংস্কৃতি ঐতিহ্য সব ভুলিয়ে দিয়ে আমাদের মতোই আধুনিক বস্তুবাদী করে তুলব, ইত্যাদি কত কিই না সেকালের সাহেবরা ভেবেছিলেন। আর্য অনার্যর মনগড়া কাহিনী আমদানি করে প্রায় ২০০ বছর ধরে ভারতীয়দের মধ্যে হীনমন্যতা গড়ে তোলার কত চেষ্টাই না তারা করেছিলেন। আজ বস্তুস্থিতি এই, ভাগ্যের ফেরে স্বাধীন ভারত এখন ইউনাইটেড কিংডমে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদেশি নিবেশক দেশ এবং সাহেবরা যদি ভারতীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোতে চাকরি না করেন, তাঁদের অনেকের বাড়িতেই হাঁড়ি চড়বে না।

আসলে চূড়ান্ত অধর্মের কিছু tell-tale signs আছে। ওই যে ভগবান বলেছেন না, "যখন যখন ধর্মের অধঃপতন আর অধর্মের উত্থান হয়, তখন তখন ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি প্রকট হৈ", ওটা দৈববচন, শুধুমাত্র কথার কথা নয়। যে প্রতীকের মধ্যে মহাদেবের দিব্যপ্রকাশকে মন্ত্রবলে আবাহন করে এনে শ্রদ্ধা-ভক্তির সাথে একজায়গায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, জোর করে তাঁর সেই মন্দির দখল করে, তাঁকে যখন হাত-পা ধোয়ার এবং কুলকুচি করার নোংরা জলের মধ্যে চুবিয়ে রাখা হয় এবং পরবর্তীকালে তিনি আবিষ্কৃত হওয়ার পরেও মেকি অধিকারবোধের বশবর্তী হয়ে একশ্রেণী জেদ ধরে বসে থাকে যে মহাদেবের ওই প্রাত্যহিক অবমাননা শ্রদ্ধালুদের সবাইকে মেনে নিতে হবে, তখন বুঝতে হবে যে জল মাথার ওপর উঠে গেছে। বাকি যা হবে সব ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হবে, যেমনটা দৈবইচ্ছায় এর আগেও অজস্রবার হয়েছে।

Sunday, May 15, 2022

গৌতম বুদ্ধ

আজ বিশ্বজুড়ে ভগবান গৌতম বুদ্ধের ২৫৬৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। বুদ্ধ মানে উদ্বোধিত, যাঁর মধ্যে শাশ্বত বোধ জাগরিত হয়েছে অর্থাৎ যিনি সাধনাবলে পরম জ্ঞান লাভ করেছেন। এই পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে যুগে যুগে অনেক বুদ্ধ এসেছেন, মানুষকে মুক্তির উপায় বলে গেছেন, গৌতম বুদ্ধ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য একজন দেবপুরুষ। পালিকা স্নেহময়ী সৎমা মহাপজাপতি গোতমীর পুত্র বলে গৌতম, পিতৃদত্ত নাম সিদ্ধার্থ। কেবল তাঁর পরম্পরাতেই তাঁর আগে আরো ২৭জন বুদ্ধ এসেছিলেন, তিনি ২৮তম এবং পরবর্তীতে যিনি আসবেন তাঁর নাম হবে আর্যমিত্র বুদ্ধ। আর অন্যান্য হিন্দু মতাবলম্বীদের কাছে গৌতম বুদ্ধ হলেন বিষ্ণুর একজন অবতার।

গৌতম বুদ্ধ অবশ্য নিজেকে তথাগত বলেই সাধারণত উল্লেখ করতেন - একভাবে দেখলে মানে দাঁড়ায় 'যে প্রকারে গত বা আগত/নির্গত/নিশ্চল' আর অন্যভাবে দেখলে 'তথা অর্থাৎ পরম অবস্থা, গত অর্থাৎ প্রাপ্ত'। লক্ষণীয়রূপে সম্বোধনটি বিশেষ্য নয়, বিশেষণপদ। তাঁর অনেকগুলি উপদেশের মধ্যে এমন পাঁচটি ব্যাপার ভগবান বুদ্ধ খুব জোর দিয়ে বারেবারে বলে গেছেন, যেগুলি যে কোনো মানুষের পক্ষেই ধর্মআধারিত জীবনযাপন করার জন্য একেবারে ন্যূনতম আবশ্যিক শর্ত:
মিথ্যে কথা বলবে না
চুরি করবে না
মাদকাসক্ত হবে না
ব্যভিচার করবে না
হিংসা করবে না

আর বলেছিলেন দুধরণের সম্যক প্রজ্ঞা আর তিন ধরণের সম্যক শীলের কথা, যেগুলির প্রত্যেকটিই মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করার সহজপাঠ। কিন্তু আমার কাছে ওঁর সবচেয়ে আকর্ষণীয় শিক্ষা হলো সম্যক সমাধি সংক্রান্ত। সম্যক সমাধি হলো তিন ধরণের: 
সম্যক প্রযত্ন - ব্যায়াম, ইন্দ্রিয় সংযম, কুচিন্তা ত্যাগ এবং সৎ চিন্তার চেষ্টা ও তাকে স্থায়ী করার চেষ্টা;
সম্যক স্মৃতি - কায়া, বেদনা, চিত্ত ও মনের চলনের সঠিক স্থিতিগুলি ও তাদের ক্ষণবিধ্বংসী চরিত্রকে সর্বদা স্মরণে রাখা;
সম্যক সমাধি -  চিত্তের একাগ্রতা।
(দর্শন দিগদর্শন- রাহুল সাংকৃত্যায়ন)

স্বামী বিবেকানন্দ ভগবান বুদ্ধ সম্পর্কে ১৯শে মার্চ ১৮৯৪ সালে ডেট্রয়েটে একটি দারুন বক্তৃতা করেছিলেন, যেটি ডেট্রয়েটে ট্রিব্যুন পত্রিকায় পরেরদিন প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি বলেছিলেন,
"...এক এক ধর্মে আমরা এক এক প্রকার সাধনার বিশেষ বিকাশ দেখিতে পাই। বৌদ্ধধর্মে নিষ্কাম কর্মের ভাবটাই বেশী প্রবল। আপনারা বৌদ্ধধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের সম্বন্ধ-বিষয়ে ভুল বুঝিবেন না, এদেশে অনেকেই ঐরূপ করিয়া থাকে। তাহারা মনে করে, বৌদ্ধধর্ম সনাতনধর্মের সহিত সংযোগহীন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধর্ম; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা নহে, ইহা আমাদের সনাতনধর্মেরই সম্প্রদায়বিশেষ।... 

"অনেকের পক্ষে একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিতে পারিলে সাধনপথ খুব সহজ হইয়া থাকে। কিন্তু বুদ্ধের জীবনালোচনায় স্পষ্ট প্রতীত হয় যে, যদি কোনও ব্যক্তি আদৌ ঈশ্বরে বিশ্বাসী না হয়, তাহার যদি কোন দার্শনিক মতে বিশ্বাস না থাকে, সে যদি কোন সম্প্রদায়ভুক্ত না হয়, অথবা কোন মন্দিরাদিতেও না যায়, তথাপি সে সেই চরমাবস্থা লাভ করিতে সমর্থ।...

"তিনি এমন এক ধর্ম প্রচার করিলেন, যাহাতে সকাম ভাবের লেশমাত্র ছিল না, আর তিনি দর্শন ও ঈশ্বর সম্বন্ধে নানাবিধ মতবাদ আলোচনা করিতে চাহিতেন না; ঐ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন। অনেক অনেক সময় তাঁহাকে ঈশ্বর আছেন কি না জিজ্ঞাসা করিলে তিনি উত্তর দিতেন, ‘ও-সব আমি কিছু জানি না।’ মানবের প্রকৃত কর্তব্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিতেন, ‘নিজে ভালো কাজ করো এবং ভালো হও।’...

"একবার তাঁহার নিকট পাঁচজন ব্রাহ্মণ আসিয়া তাঁহাকে তাঁহাদের তর্কের মীমাংসা করিয়া দিতে বলিলেন।... (তাঁরা) ঈশ্বরের স্বরূপ ও তৎপ্রাপ্তির উপায় সম্বন্ধে নিজ নিজ শাস্ত্রের দোহাই দিয়া ভিন্ন ভিন্ন অভিপ্রায় প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তিনি প্রত্যেকের কথা বেশ মনোযোগ দিয়া শুনিয়া প্রত্যেককে এক এক করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের কাহারও শাস্ত্রে কি এ কথা বলে যে, ঈশ্বর ক্রোধী হিংসাপরায়ণ বা অপবিত্র?’ ব্রাহ্মণেরা সকলেই বলিলেন, ‘না, ভগবান, সকল শাস্ত্রেই বলে ঈশ্বর শুদ্ধ ও কল্যাণময়।’ ভগবান বুদ্ধ বলিলেন, ‘বন্ধুগণ, তবে আপনারা কেন প্রথমে শুদ্ধ, পবিত্র ও কল্যাণকারী হইবার চেষ্টা করুন না, যাহাতে আপনারা ঈশ্বর কি বস্তু জানিতে পারেন?’

"অবশ্য আমি তাঁহার সকল মত সমর্থন করি না। আমার নিজের জন্যই আমি দার্শনিক বিচারের যথেষ্ট আবশ্যকতা বোধ করি। অনেক বিষয়ে তাঁহার সহিত আমার সম্পূর্ণ মতভেদ আছে বলিয়াই যে আমি তাঁহার চরিত্রের, তাঁহার ভাবের সৌন্দর্য দেখিব না, ইহার কি কোন অর্থ আছে? জগতের আচার্যগণের মধ্যে একমাত্র তাঁহারই কার্যে কোনরূপ বাহিরের অভিসন্ধি ছিল না। অন্যান্য মহাপুরুষগণ সকলেই নিজদিগকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া ঘোষণা করিয়া গিয়াছেন, আর ইহাও বলিয়া গিয়াছেন, ‘আমাকে যাহারা বিশ্বাস করিবে, তাহারা স্বর্গে যাইবে।’ কিন্তু ভগবান বুদ্ধ শেষ নিঃশ্বাসের সহিত কী বলিয়াছিলেন? তিনি বলিয়াছিলেন, ‘কেহই তোমাকে মুক্ত হইতে সাহায্য করিতে পারে না, নিজের সাহায্য নিজে করো, নিজের চেষ্টা দ্বারা নিজের মুক্তিসাধন করো।’ 

"নিজের সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন, ‘বুদ্ধ-শব্দের অর্থ আকাশের ন্যায় অনন্তজ্ঞানসম্পন্ন। আমি গৌতম, সেই অবস্থা লাভ করিয়াছি; তোমরাও যদি উহার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা কর, তোমরাও উহা লাভ করিবে।’ তিনি সর্ববিধ কামনা ও অভিসন্ধিবর্জিত ছিলেন, সুতরাং তিনি স্বর্গগমনের বা ঐশ্বর্যের আকাঙ্ক্ষা করিতেন না। তিনি রাজসিংহাসনের আশা ও সর্ববিধ সুখ জলাঞ্জলি দিয়া ভারতের পথে পথে ভ্রমণ করিয়া ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা উদরপূরণ করিতেন এবং সমুদ্রের মত বিশাল হৃদয় লইয়া নরনারী ও অন্যান্য জীবজন্তুর কল্যাণ যাহাতে হয়, তাহাই প্রচার করিতেন। 

"জগতের মধ্যে তিনিই একমাত্র মহাপুরুষ, যিনি যজ্ঞে পশুহত্যা-নিবারণের উদ্দেশ্যে পশুগণের পরিবর্তে নিজ জীবন বিসর্জনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন। তিনি একবার জনৈক রাজাকে বলিয়াছিলেন, ‘যদি যজ্ঞে ছাগশিশু হত্যা করিলে আপনার স্বর্গগমনের সহায়তা হয়, তবে নরহত্যা করিলে তাহাতে তো আরও অধিক উপকার হইবে, অতএব যজ্ঞস্থলে আমায় বধ করুন।’ রাজা এই কথা শুনিয়া বিস্মিত হইয়াছিলেন। অথচ এই মহাপুরষ সর্ববিধ অভিসন্ধিবর্জিত ছিলেন। তিনি কর্মযোগীর আদর্শ; আর তিনি যে উচ্চাবস্থায় আরোহণ করিয়াছিলেন, তাহাতেই বেশ বুঝা যায়, কর্ম দ্বারা আমরাও আধ্যাত্মিকতার চরম শিখরে আরোহণ করিতে পারি।..."

Friday, May 13, 2022

জ্ঞানবাপী

একটা কথা জেনে রাখবেন: যে মন্দিরে একবার দিব্যশক্তির প্রকাশ ঘটেছে, তার গর্ভগৃহ থেকে উৎপন্ন শক্তিপুঞ্জ যুগ যুগ ধরে আধ্যাত্মিক বিচ্ছুরণ ঘটাতে থাকে। সামান্য দুশো পাঁচশো হাজার বছরের ব্যবধানে কল্যাণকারী দৈবী প্রভা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন হয়না, তা সে মন্দির বাস্তবে থাকুক বা ধ্বংস হয়ে যাক, তাতে নিত্যপূজা হোক বা নাই হোক।

একটি বিশেষরূপে চিহ্নিত ক্ষেত্র একবার যখন মন্দির হিসেবে গড়ে ওঠে এবং তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠাকৃত হয়ে অথবা স্বয়ম্ভু অবস্থায় দেবতা কিছুদিন নিবাস করেন তখন স্থানমাহাত্মবলে সেই ক্ষেত্রটি চিরদিন মন্দিরই থাকে, আর সুপ্ত অথবা জাগ্রত অবস্থায় দেবতার প্রসাদও সেখানে অবিকৃতই থাকে। কার হাতে কখন তিনি কিভাবে পূজিত হবেন, সেটা অবশ্য তাঁর ইচ্ছা। 

আমি নিজেই কতবার কত তীর্থে যাওয়ার সবরকম বন্দোবস্ত করেও শেষ মুহূর্তে সফর বাতিল করতে বাধ্য হয়েছি কারণ তিনি হয়তো তখন আমার পূজা নিতে চাননি, চেয়েছিলেন আরো প্রস্তুত হয়ে আসি। সাধারণের ক্ষেত্রে মন্দিরে প্রবেশের বিষয়টিও ঠিক তাই। তিনি রুষ্ট হয়েছিলেন, তাই তাঁর দরবারে প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছিলেন। আবার তিনিই হয়তো কৃপাবশতঃ নতুন করে প্রবেশাধিকার দিচ্ছেন, তাই এতসব কিছু হচ্ছে। 

একমাত্র দেবতার নিজের ইচ্ছা ছাড়া কেউই তাঁর দর্শন পায়না, হাজার চেষ্টা করলেও নয়। হয়তো আবার সঠিক সময় এসেছে তাই তিনিই আবার পূর্বাবস্থায় প্রকাশিত হতে চাইছেন, কে জানে! তবে এই দর্শন আর অদর্শন সবটাই হলো প্রারব্ধজনিত, মানুষকে এবং সমাজকে তার কর্মফল ভুগতেই হয়। দেবতা যখন স্বয়ং অবতাররূপে শরীরধারণ করেন, তাঁকে পর্য্যন্ত শিষ্যদের কর্মফলের দায় নিয়ে কষ্ট ভুগতে হয়। 

দেবতার বিচারপদ্ধতি কেমন তা শ্রীকৃষ্ণ  নিজেই দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। পাণ্ডবরা বনবাস আর অজ্ঞাতবাস সেরে ১৩ বছর বাদে যখন ফিরে এলেন, তখন তাঁরা ইন্দ্রপ্রস্থ ফেরত চাইলেন কিন্তু কৌরবরা সটান না করে দিলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ গিয়ে ওঁদের জন্য পাঁচটি মাত্র গ্রাম চেয়েছিলেন, তাও আবার রাজ্যের উপান্তে, সেটাও তাঁরা দিতে রাজি হলেন না, উল্টে শ্রীকৃষ্ণকেই গ্রেফতার করার চেষ্টা করলেন। আখেরে কি হলো সেটা সবারই জানা - চিরকালের জন্য গোটা রাজ্যটাই কৌরবদের হাতছাড়া হয়ে গেল আর যাঁদের প্রাপ্য তাঁরাই তা ফিরে পেলেন।

Thursday, May 12, 2022

ভারত ও অমরত্ব


ভূগোল যখন রাজনীতি দ্বারা নির্মিত হয়, তখন সে দেশ; যখন সংস্কৃতি দ্বারা নির্ধারিত হয়, তখন সে রাষ্ট্র; যখন বলপ্রয়োগের দ্বারা নির্দেশিত হয়, তখন সে সাম্রাজ্য; আর যখন মনন দ্বারা নির্ণায়িত হয়, তখন সে সভ্যতা। ইতিহাস আর ভূগোলের মধ্যে কার ভূমিকা আগে আর কারটি পরে এই আলোচনা এখানে নিরর্থক কারণ এরা একে অপরের পরিপূরক, দুটিতে প্রায় একসাথেই হাতে হাত ধরে পথ চলে। ভারত কেবল একটি দেশমাত্র নয়, ভারত এক সভ্যতা, এক অনবদ্য ও অনন্য সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার, যাকে হিন্দু সভ্যতাও বলে। এই সহজ ঐতিহাসিক সত্যটি না বুঝলে কেন যে আমাদের মাতৃভূমি পুণ্যভূমি, ধর্মের ধাত্রী এবং মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের তপোভূমি, সেটা বুঝতে অসুবিধা হবে।

মানুষের ব্যাপারটাও প্রায় এইরকমই। যখন সে শুধুই শরীর, তখন সে অন্নময়; যখন সে শরীর এবং মন, তখন সে মনোময়; যখন সে শরীর এবং মন এবং বুদ্ধি, তখন সে বিজ্ঞানময়; আর যখন সেই বুদ্ধিকে পার করে গিয়ে সে বিবেকি, তখন সে আনন্দময়। অন্যভাবে দেখতে গেলে, মানুষ যখন শারীরিক, তখন সে পাশবিক; মানুষ যখন মানসিক, তখন সে  অহংকারী; মানুষ যখন বৌদ্ধিক, তখন সে বৈচারিক; আর মানুষ যখন সাধক, তখন সে অন্বেষী। ভূগোল যদিও সভ্যতার গন্ডিতে সীমাবদ্ধ, মানুষের কিন্তু এরপরেও একধাপ এগোবার সুযোগ আছে, যাকে ঋষিরা সমাধি অবস্থা বলেন - যখন তার আর কোনো সীমা নেই, সে অসীম, অনন্ত, যখন সে ব্রহ্মস্বরূপ। 

সমস্ত জীবজগতের মধ্যে যেহেতু একমাত্র মানুষই স্থান কাল পাত্রের গন্ডি পেরিয়ে অধিভৌতিকে পৌঁছতে পারে, তাই একমাত্র মানুষই ভৌতিক প্রয়োজনে দেশ তৈরি করে, দেশের মধ্যে সমাজ তৈরি করে, নিয়ম নীতি তৈরি করে আর জীবনকে ভোগ এবং ত্যাগ করার বিভিন্ন পন্থাও তৈরি করে। তারপর সেই জীবনবোধ ছড়ায়, তাকে ঘিরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক সভ্যতা। প্রত্যেক প্রাচীন সভ্যতারই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, ভারতেরও আছে। ভারতীয় সভ্যতার বিশেষত্ব হলো তার অন্তর্নিহিত ধর্মবোধ, যা মানুষকে পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে এবং মনুষ্যত্ব থেকে দেবত্বে উত্তিরণের পথ দেখায়। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, "প্রত্যেকের অন্তরে যে দেবত্ব (ঐশ্বরীয় সত্ত্বা) আছে, তার পূর্ন বিকশিত রূপই ধর্ম।" তাই মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের সাথে তার ভারতে জন্মগ্রহণ করার অবশ্যই কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে, নইলে এত হাজার হাজার বছর ধরে এত এত মহামানব এই বিশেষ ভূমিতে প্রকাশিত পল্লবিত বিকশিত হলেন কি ভাবে?

স্বামীজী তাঁর 'ভারত প্রসঙ্গে' গ্রন্থে (বাণী ও রচনা, পঞ্চম খণ্ড, ভূমিকা) নিজের মাতৃভূমি সম্পর্কে বলছেন, 
'আমার দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক যাহা কিছু সম্বল—সে-সবই তো আমি এই দেশের কাছে পাইয়াছি, এবং যদি আমি কোন ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করিয়া থাকি, সে গৌরব আমার নয়, তোমাদের। কিন্তু দুর্বলতা ও ব্যর্থতা—সেগুলি আমার ব্যক্তিগত; সে-সবই এই দেশবাসীকে যে মহতী ভাবধারা আজন্ম ধারণ করিয়া রাখে, তাহা দ্বারা সমৃদ্ধ হইবার শক্তির অভাববশতঃ।

আর কী দেশ! বিদেশী অথবা স্বদেশী, যে-কেহ এই পবিত্রভূমিতে আসিয়া দাঁড়াইবে—যদি তাহার মন পশুস্তরে অধঃপতিত না হইয়া থাকে, তাহা হইলে ইতিহাসের বিস্মৃত অতীত হইতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম যে-সন্তানেরা পশুসত্তাকে দিব্যসত্তায় উন্নীত করিবার সাধনা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের জীবন্ত চিন্তারাশি দ্বারা নিজেদের পরিবৃত অনুভব করিবে। সমগ্র বায়ুমণ্ডল আধ্যাত্মিকতায় স্পন্দিত হইতেছে।

দর্শন, নীতিশাস্ত্র ও আধ্যাত্মিকতা—যা কিছু মানুষের অন্তর্নিহিত পশুসত্তা বজায় রাখিবার নিরন্তর প্রচেষ্টায় বিরতি আনিয়া দেয়, যে-সকল শিক্ষা মানুষকে পশুত্বের আবরণ অপসৃত করিয়া জন্মমৃত্যুহীন চিরপবিত্র অমর আত্মা-রূপে প্রকাশিত হইতে সাহায্য করে—এই দেশ সেই সব-কিছুরই পুণ্যভূমি। এই দেশ—যেখানে আনন্দের পাত্রটি পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল, বেদনায় পাত্রটি পূর্ণতর হইলে অবশেষে এইখানেই মানুষ সর্বপ্রথম উপলব্ধি করিল—এ সবই অসার; এখানেই যৌবনের প্রথম সূচনায়, বিলাসের ক্রোড়ে, গৌরবের সমুচ্চ শিখরে, ক্ষমতার অজস্র প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ মায়ার শৃঙ্খল চূর্ণ করিয়া বাহির হইয়াছে।'

স্বামীজীর কথাগুলি কিন্তু কেবল কথার কথা নয়, তাঁর সারা জীবনের উপলব্ধি। আসলে এই দেশে জন্মানো কখনোই অকারণে ঘটে না, কোথাও না কোথাও পরমাত্মার কৃপা কাজ করে। এই যে দেশের সম্মিলিত বোধে ত্যাগকে ভোগের অনেক ওপরে রাখার সংস্কৃতি, এ তো আর অকস্মাৎ হতে পারেনা, বোধের কত না গভীর স্তরে উঠে নিঃস্পৃহ চিন্তন মননের ফসল এই অনন্য জীবনদর্শন। এই যে ধনীকে ছেড়ে সন্ন্যাসীকে শ্রদ্ধা করার শিক্ষা, সর্বত্যাগীর সামনে দুর্বিনীতকেও বিনীত হতে বাধ্য করা, কখনো খালি হাতে দেব ও সাধুদর্শন না করার সংস্কার, আশৈশব এইসব কর্তব্যবোধ এই দেশে না জন্মালে পেতাম কিভাবে?

একই দেশে যাজ্ঞবল্ক্য আর অষ্টাবক্র, বাক আর গার্গী, বাল্মীকি আর বেদব্যাস, আত্রেয়ী আর মৈত্রেয়ী, বুদ্ধ আর শংকর, অতীশ দীপঙ্কর আর অভিনব গুপ্ত এবং বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথ জন্মান, এটা নেহাতই কাকতলীয় বলে তো মনে হয়না। দেশের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে দেশবাসীর বেড়ে ওঠাটা একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে, যুগে যুগে সব দেশের ক্ষেত্রেই তাই হয়ে এসেছে। আমাদের দেশে আমরা বেড়ে উঠেছি ধর্মের পথে থেকে সমাজের স্বার্থে সৎপথে অর্থ উপার্জন করে জাগতিক কামনা মিটিয়ে নিয়ে মোক্ষের পথে পাড়ি জমানোর একটা প্রক্রিয়ার আবহে, এর কিন্তু কোনো জুড়ি নেই। আমাদের এই অনন্য দেশে কখন যে ভোগের ভেতর দিয়ে যোগ তার রাস্তা তৈরি করে নেবে, বোঝা দুষ্কর।

বৃহদারণ্যকোপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য নারীপুরুষের প্রেমকে পর্য্যন্ত ব্ৰহ্মপোলব্ধির উপমারূপে উপস্থাপন করছেন - 'যেমন প্রিয় স্ত্রীর দ্বারা আলিঙ্গিত পুরুষের বাহ্যজগতের কিছুরই বোধ থাকে না, তেমনই ব্ৰহ্মজ্ঞান হলে বাহ্যবস্তুর কোনও বোধই থাকে না।' বোঝো কান্ড!
জনক রাজা ওনাকে প্রশ্ন করছেন, 'পুরুষের জ্যোতি কি?'
যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তর, 'সূৰ্য'
'সূর্য অস্ত গেলে?'
'চন্দ্ৰমা'
'চন্দ্ৰমা না থাকলে?'
'অগ্নি'
'তাও না থাকলে?'
'বাক'
'তাও নীরব হয়ে গেলে?'
‘আত্মাই পুরুষের জ্যোতি। এই আত্মার লীলাই লোকে দেখে, তাকে কেউ দেখে না'।

আর্যাবর্তে বহু খণ্ড-রাজ্য ছিল, নানা রাষ্ট্রব্যবস্থা, নানা জাতি মত ও আচার। উপনিষদ সবাইকে এক করে দিয়ে বলল, 'সবই সেই একক সত্তার প্রকাশ, সত্য সেই এক, সেই বৃহৎ ব্ৰহ্ম, সেই পরম-সত্তা আত্মা, স্ব-রূপ'। ব্যস, গল্প শেষ হয়ে গেল। একটা গোটা জাতি একসাথে অদ্বৈতজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে গেয়ে উঠলো,
শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা
আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূ॥
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ২.৫) 
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্‌
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি
নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়॥
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ৩.৮)
শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি।
(রবীন্দ্রনাথ, রূপান্তর)

আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন যে মৃত্যুতে সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। তাই জন্মান্তরবাদে মৃত্যু আপেক্ষিক হলেও, উপনিষদগুলি জুড়ে মৃত্যুর সঙ্গে অমরত্বের এমন মধুর সমন্বয় এত কার্যোপযোগীভাবে  ফুটে উঠেছে। মৈত্ৰেয়ী যখন যাজ্ঞবল্ক্যকে বললেন, "যাতে অমর হব না তা দিয়ে আমি কী করব?" তখন তার উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য তাঁকে উপদেশ দিলেন, "ব্যক্তিসত্তাকে বিশ্বসত্তার মধ্যে স্থাপিত করে স্ব-রূপে তাকে জানো; সেই সত্তাই আত্মা, সেইই ব্ৰহ্ম"। এই সেই জ্ঞান, যা মানুষকে অমরত্ব প্রদান করে, নিত্য করে তোলে, সত্য করে তোলে, বলে যে ব্যক্তি-শরীরের নাশ থাকলেও ব্রহ্মের নাশ নেই, ফলে সে শুধু ক্ষণকালীন শরীর-মন-বুদ্ধি নয়, সে চিরকালের - এই বোধই মানুষকে দেবতা করে তোলে। 

এইটি জেনে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার দিনে মানুষ আশ্বস্ত হয়ে যেতে পারে যে, নিরবধি কাল ও বিপুলা ধরায় সে অক্ষয়, অমর। এর চেয়ে বড় মুক্তির বার্তা সভ্যতার ইতিহাসে আর কে কবে দিতে পেরেছেন? ঋষি বলছেন,
যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যে অস্য হৃদি শ্রিতাঃ 
অথ মর্তোঽমৃতো ভগবত্যত্র ব্রহ্মা সমশ্নুতে ।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/৪/৭) এবং তেঽর্চিরভিসম্ভবন্তি (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/২/১৫) অর্থাৎ যাঁরা হৃদয়ের রােগরূপী সমস্ত জড় বাসনা থেকে মুক্ত হয়েছেন, তাঁরা মৃত্যুকে জয় করে ভগবদ্ধামে প্রবেশ করেন, তাকে বলা হয় সদ্য-মুক্তি। আর যারা অর্চি আদি মার্গে ধীরে ধীরে উচ্চ থেকে উচ্চতর লােক অতিক্রম করে অবশেষে ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হন, তাকে বলা হয় ক্ৰম-মুক্তি। যেভাবেই হোক, মুক্তি কিন্তু অনিবার্য, ফলে শুদ্ধ হও, পবিত্র হও, ধর্মকে ধরে থাকো, যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষ সারা বিশ্বকে এই ঐশ আশ্বাসবার্তাই দিয়ে চলেছে।

Wednesday, May 11, 2022

হিন্দু মন্দির

আমাদের হিন্দু মন্দিরের একটা পারম্পরিক গঠনশৈলী আছে। সিঁড়ি, তারপর প্রথমে অর্ধমণ্ডপ (porch), তারপর মণ্ডপ (hall), তারপর অন্তরাল (vestibule), আর সবশেষে গর্ভগৃহ বা মূলস্থান (sanctum sanctorum)। বেলুড়মঠের সামগ্রিক গঠনটি কল্পনা করলেই চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথমে পশ্চিমদিকের মুখ্য সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম, তারপর একটা খোলা চাতাল, তারপর সদর দরজা পেরিয়ে বিরাট পিলারওলা হলঘর, তারপর একটা আয়তক্ষেত্রাকার ফাঁকা জায়গা যার দুদিকে দুটি দরজা আর তার সামনে গর্ভগৃহে ঠাকুর পূর্বাশ্য হয়ে শ্বেতপদ্মাসনের ওপর সমাধিস্থ। গঠনটি যেন ঠিক মানুষের শায়িত দেহের মতো - প্রথমে নিম্নাঙ্গ, তার ওপরে পেট, তার ওপরে বুক আর সবার ওপরে মাথা। এই যে সিঁড়ি থেকে গর্ভগৃহ অবধি যাত্রা, এটাই হলো journey of many lifetimes, এ যেন আসলেই এক অনন্তযাত্রা। 

রাস্তা পেরিয়ে নিজের ইচ্ছায় প্রথম যেদিন কেউ মন্দিরের সিঁড়িতে পা দেন, সেইদিন থেকেই কিন্তু তিনি seeker, তাঁর মধ্যে কৌতুহল জেগেছে। কিসের কৌতুহল? না ভেতরে কি আছে একবার দেখি, তা সে মন্দিরেরই হোক বা নিজের। কারো মনে হয় যাই, স্থাপত্য দেখি, কারো মনে হয় মূর্তিটি কেমন দেখে আসি, কারো মনে হয় একবার দেবতার পায়ে মাথা ঠেকালে বেশ হয়, আর কারো বা মনে হয় দেবতার কাছে অধরা কিছু চেয়ে তো দেখি, যদি পেয়ে যাই! মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে চাতালে উঠে ভেতরের দিকে তাকালে সাধারণত একটি ছায়াঘন শান্ত সুশীতল মণ্ডপ নজরে পড়ে। কেউ সোজা ঢুকে পড়েন, কেউ বা একবার উঁকি মেরেই নীচে নেমে যান, যাঁর যেমন ভবিতব্য। এই চাতাল অবধি সবটাই পরিচিত স্বদেশ, মণ্ডপে পা দেওয়া মাত্র কিন্তু অচেনা ভিনদেশের শুরু। ওই যে অর্ধমণ্ডপ আর মণ্ডপের মাঝের কাঠের কারুকার্য করা ভারী দরজাটি, ওটিই হলো immigration gate, ওটি পেরোলেই দেশান্তর।

মণ্ডপ বা হলঘর পেরোনোর journey-টা কিন্তু খুব interesting, কারো খুব কম সময় লাগে, কারো বা অনেকগুলো জীবন। এখানেই প্রথম নিঃশব্দের সাথে পরিচয়, এখানেই প্রথম বাইরের জগৎকে shut-out করতে শেখা, এখানেই প্রথম বহু সাধকের বহুদিন ধরে ধ্যান-জপ-সাধনা-স্বাধ্যায় করার সম্মিলিত শক্তিকে অনুভব করতে পারা, এখানেই প্রথম নিজের মনের ভেতর সুপ্ত প্রশ্নের জেগে ওঠা আর পরিচিতদের কাছে উত্তর খুঁজে না পেয়ে এখানেই প্রথম দেবতার কাছে আত্মসমর্পণ। হলঘরের এক একটা কারুকাজ করা স্তম্ভ যেন প্রার্থনা থেকে নিয়ে আত্মানুসন্ধানের আধ্যাত্মিক যাত্রাপথের এক একটি মাইলফলক। ওই দরজা থেকে অন্তরাল অবধি সফর আসলে বাইরেকে পেছনে ফেলে ধীরে ধীরে অন্তরের দিকে এগোনো, যত এগোবে তত সত্য আর অসত্য অর্থাৎ নিত্য আর অনিত্যের পার্থক্য বোধগম্য হবে আর তত পরিচিত পরিবেশকে অপরিচিত বলে মনে হতে শুরু করবে। এ এক যাত্রা বটে - এই ফুটকয়েকের মধ্যেই মহাকুম্ভ আর তারই ভেতর মহাসঙ্গম।

অন্তরালে পৌঁছে সবাই সাষ্টাঙ্গ, ওখানে কিন্তু এতদিনের এতসব নাটকের একেবারে ইতি। ততদিনে বোঝা হয়ে গেছে যে যা হয়েছে সব তাঁর কৃপাতেই হয়েছে, ভবিষতে যা হবে তাও তাঁর ইচ্ছাতেই হবে, আমি বলে আলাদা করে কোনো বস্তু কিছু নেই, 'আমি' যেমন রসের মধ্যে চিনি বা ফুলের মধ্যে গন্ধ বা বরফের মধ্যে ঠান্ডা। ওই সামনে যাঁকে গর্ভগৃহের মধ্যে দেখছি, তিনি যেমন রেখেছেন, আমিও তেমন রয়েছি। তিনি আমার আরাধ্য আবার আমিও আমার আরাধ্য। তিনি পবিত্র, তাই আমিও পবিত্র। তিনি শাশ্বত, তাই আমিও শাশ্বত। আমি যেমন তাঁকে চোখের সামনে দেখছি, তিনিও তেমনিই আমায় দেখছেন, শুনছেন। তিনি সমুদ্র, আমি তাঁরই জলের ঢেউ হয়ে তাঁরই বুকে উঠছি আবার তাঁতেই মিশে যাচ্ছি। তিনি অপরিবর্তনীয়, আমিও তাই, কারণ মূলে তো সেই একই নোনাজল। কেবল সাময়িকভাবে 'আমি'রূপী এক একটা ঢেউয়ের form তৈরি হচ্ছে আবার নষ্ট হচ্ছে, আবার তৈরি হচ্ছে , আবার নষ্ট হচ্ছে আর এই সাময়িক form-কেই আমি এতদিন গর্ব করে 'আমি' 'আমি' বলে বেড়িয়েছি। মন্দিরের এই অংশটিকে অন্তরাল বলে কারণ এই 'আমি'টুকুই হচ্ছে আমার আর গর্ভগৃহে যিনি অধিষ্ঠান করছেন, দুজনের মধ্যে একমাত্র অন্তরাল।

সাধারণত গর্ভগৃহ বলতে আমরা সূতিকাগৃহ বা অন্তকক্ষ বা আঁতুরঘর বুঝি, যেখানে মায়েরা সন্তান প্রসব করেন। মন্দিরের ক্ষেত্রেও কিন্তু তাই। মাতৃগর্ভে ভ্রুন যেমন ভূমিষ্ঠ হওয়া অবধি মাতৃস্নেহে লালিত পালিত হয়, এখানেও তেমনি আত্মসমর্পণ থেকে নিয়ে আত্মসাক্ষাৎকার পর্য্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটাই এই বিশেষ অন্তকক্ষের যিনি অধিষ্ঠাত্রী, তাঁর কৃপায় ঘটে এবং সাধকের 'আমি' মুছে গিয়ে এক ব্রহ্মজ্ঞানীর জন্ম হয়। অবশ্য গর্ভগৃহ তখনই সন্নিধিঃ হয়ে ওঠে যখন মন্ত্রশক্তির দ্বারা জাগরিত এবং বিধিবৎ নিত্যপূজিত হয়ে দেবতা মৃন্ময়ের মধ্যে চিন্ময়রূপ ধারণ করেন, ওখানে তাঁর সাক্ষাৎ প্রকাশ ঘটে এবং নিয়মিত গুণকীর্তনের আবহে তিনি ওখানে নিত্য বিরাজ করেন। সন্নিধিঃ কারণ এই জায়গা থেকে যে শক্তিপুঞ্জ নিঃসৃত হয়, তা সরাসরি সাধকের বোধকে স্পর্শ করে এবং উৎসের সাথে সাক্ষাৎ সান্নিধ্য বা সামীপ্য সম্ভব করে তোলে। সদ্গুরু জাগ্গি বাসুদেব বিষয়টিকে এইভাবে বর্ণনা করেছেন, "Sannidhi means presence. A Sannidhi establishes an energy presence that naturally takes you to the realm of devotion, where something far bigger than you becomes an experiential reality for you."

হিন্দুর মন্দির জীবন্ত দেবতার বাসস্থান, কোনো সাধারণ প্রার্থনাগৃহ নয়। প্রত্যেকটি মন্দির আসলে এক একটি শক্তিকেন্দ্র (energy source)। আমাদের প্রার্থনা মানে তো খালি চাওয়া, সাধারণত পার্থিব কোনো সাময়িক সুখশান্তি চাওয়া - তার জন্য আবার শক্তিক্ষেত্রের প্রয়োজন কি? নিজের বাড়িতে বসেই তো নিশ্চিন্তে ভিক্ষাবৃত্তি চলতে পারে। মন্দির হলো এক জীবন্ত দেবতার সাথে ভক্ত বা সাধকের আলাপচারিতার পবিত্র সাক্ষাৎস্থল এবং আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিসঞ্চার ও গ্রহণ করার শুদ্ধ পরিকাঠামোও বটে। দেবতা আমাদের অন্তরের মধ্যে আছেন ঠিকই কিন্তু মাঝেমধ্যে যতক্ষণ না তাঁর কায়িক সান্নিধ্যে বসে একমনে তাঁর কথা চিন্তা করতে পারা যায়, ততক্ষণ তাঁকে যেন ঠিক অনুভব করা যায়না - সেইজন্যই মন্দির দরকার। হিন্দু মন্দির মোটেও কোনো হইহট্টগোলের জায়গা নয়, গাড়ি বাড়ি সম্পদ ইত্যাদি চাওয়ার জায়গা তো নয়ই। তাঁর নামজপের মধ্যে দিয়ে তাঁর দরজায় টোকা দেওয়ার জায়গা, ধ্যানের মাধ্যমে তাঁর প্রত্যক্ষ উপস্থিতিকে অনুভব করার জায়গা আর তাঁর অসীম কৃপার জন্য তাঁর সামনে শ্রদ্ধায় ভক্তিতে সতত প্রণত হয়ে গুণকীর্তন করার জায়গা। চাইলেই যিনি ষড়ৈশ্বর্য দিতে পারেন, তাঁর কাছে সামান্য কলাটা-মুলোটা চেয়ে লাভ কি, বিশেষতঃ যেখানে দেহ থেকে দেহাতীত, মুলাধার থেকে সহস্রার আর অজ্ঞান থেকে জ্ঞানলোকে যাত্রার সহযোগী মাধ্যম এই পুণ্যভূমির চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে।

২১শে ফেব্রুয়ারি : প্রাক কথন



বড় অশুভ সময় এখন বাংলার, মানে যে বাংলায় এখনো বাঙালি নাম, বাংলা ভাষা, বাঙালি বেশ, বাঙালি মনিষীদের স্মরন, বাঙালি রান্না ইত্যাদি যা কিছু চিরাচরিতরূপে বাঙালি, তার স্বাদ পাওয়া যায়, সেই পশ্চিমবঙ্গের। অশুভ এই কারণে, যা যা বাঙ্গালিত্বকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত ওপার বাংলায় ঘটছে দেখতে পাচ্ছি, সেই আরবিকরণের রাস্তা প্রশস্ত করতে কিছু প্রাক্তন বাঙালি সীমান্ত পেরিয়ে এসে ইদানিং আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গেও অতিসচেষ্ট। তাদের দাপটে এপারবাংলাও যেন একটা অবক্ষয়ের ঘূর্ণাবর্তে ক্রমশ অচেনা এক প্রদেশ হয়ে উঠছে, ছেলেবেলায় যে বাংলামায়ের রূপ আমরা দেখেছি, উত্তরোত্তর তাঁর হাত আজ কালো দস্তানায়, মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা কেন? 

সময়টা অদ্ভুতও বটে। যেদিন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হল, সেদিন কিন্তু বাঙ্গালিত্ব, বাঙ্গালিয়ানা, বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতি কিচ্ছু মাথায় ছিলনা, শুধু পন্থ আর সব কিছু ছাপিয়ে তার সার্বজনীন আধিপত্য। যে যোগেন মণ্ডল সেই বিচ্ছিন্নতাবাদকে আশ্রয় করে একমাত্র বাঙ্গালিত্বের ভরসায় পূর্ব পাকিস্তানে নমঃশূদ্রদের আলাদা পরিচয় তৈরি করে ক্ষমতার দর কষাকষি করতে গিয়েছিলেন, তাঁকেও মন্ত্রিত্ব ছেড়ে কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদের বাড়িতে পালিয়ে এসে প্রাণরক্ষা করতে হয়েছিল। তর্কের খাতিরে যদি ধরেওনি যে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙালি আইডেন্টিটি রক্ষা করার জন্যই পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের আদর্শগত লড়াই, তাহলে বাংলাদেশ আজ আর একটি আরবিস্থানের কিম্ভূতকিমাকার প্রতিরূপ হওয়ার দৌড়ে পাকিস্তানের সঙ্গে তেড়ে পাল্লা দিচ্ছে কেন? কেবল ২১শের আবেগ দিয়ে কি আর দা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিঙ্গের অন্যতম খলনায়ক মুজিবের জাতির জনক হয়ে ছড়ি ঘোরাবার অদম্য ক্ষমতালিপ্সাকে ঢাকা দেওয়া যায়? মুক্তিযোদ্ধাদের জেন্যুইন সেন্টিমেন্টকে মুজিব ব্যবহার করেছিলেন সুকৌশলে, ঐ তরতাজা প্রাণগুলো কিন্তু সত্যিকারের বাঙালি ছিলেন।

এই অদ্ভুত অশুভ অবহে ফিরে আসি আজকের বিভাজিত দুইবঙ্গে। প্রতিটি মননশীল বাঙালি যারা আগামিকাল ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ভাষা দিবসের গান গাইবেন, এপার বাংলায় এবং ওপার বাংলায়, আশাকরি তাঁরা নিজেদের প্রশ্ন করবেন তাঁরা আদপে কতটা বাঙালি? এপারে, কারণ পালিয়ে রক্ষে নেই, বাংলাবিদ্বেষীরা সিঁদ কেটে এখানেও ঘরে ঢুকে নাকে ক্লোরোফর্ম দেওয়ার তোড়জোড় করছে দেখেও আপনারা যারা ভয়ে চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে আছেন, আপনারা কি নিজেদের জাত্যাভিমান ভুলে যাননি? একই ভুল কোন মূর্খ দুবার করে? আর ওপারেও, কারণ যে বাঙ্গালিত্বকে রক্ষা করার জন্য অতজন টগবগে নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা জাত্যাভিমানের বশে নিজেদের সবকিছু আহুতি দিলেন, সেই আইডেন্টিটি বাঁচানোর বদলে, আপনারা যারা তাঁদের বৌদ্ধিক উত্তরাধিকারী, তাঁরা কি করে চুপচাপ রোজ বাঙ্গালিত্বের স্লোপয়সন হওয়া দেখছেন? 

আগামীকাল, বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসে, দুই বাংলায় বাঙ্গালিত্ব পুনর্জাগরিত হোক এই প্রার্থনা করি। এই বাংলা অতিশ দীপঙ্করের বাংলা, এই বাংলা চাঁদ বনিকের বাংলা, এই বাংলা বিজয় সিংহের বাংলা, এই বাংলা শ্রী চৈতন্যের, কৃত্তিবাসের, বঙ্কিমচন্দ্রের, ডঃ কাদম্বিনী বসুর, স্বামী বিবেকানন্দের, রাজা রামমোহনের, বিদ্যাসাগরের, রবীন্দ্রনাথের, নজরুলের, সুভাষ বসুর, শ্যামাপ্রসাদের, বেগম রকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের, সৈয়দ মুজতবা আলীর, কাজী আবদুল ওদুদের, হুমায়ুন আজাদের এমন আরো কত গুণীজনের বাংলা। কোন অবস্থাতেই আমাদের সাধের বাংলা যেন এক বিজাতীয় বর্বর অন্ধকারের গহ্বরে তলিয়ে না যায়, আমরা যেন আমাদের গৌরবময় অতীত এবং শক্তিসাধনার উত্তরাধিকার ভুলে আত্মসন্মান খুইয়ে না বসি, আমরা যেন আবার সত্যিকারের বাঙালি হয়ে উঠতে পারি, ভাষা দিবসের প্রাক্কালে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে করজোড়ে সেই প্রার্থনা করি।

গীতা ৮.৩

অষ্টম অধ্যায়ের তৃতীয় শ্লোকে শ্রীভগবান বলছেন, 
অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং সভাবোহধ্যাত্মমুচ্যতে।
ভূতভাবোদ্ভবকরো বিসর্গঃ কর্মসংজ্ঞিতঃ।।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার বেশিরভাগ শ্লোকের ক্ষেত্রেই একেকদিন এক এক রকমের মানে মনের মধ্যে ভেসে ওঠে, মন যেদিন যে ভাবে থাকে সেই ভাব অনুযায়ী আরকি। আজ সকালে যেভাবে এই শ্লোকটির মানে বুঝতে পারলাম, তা নিজের জন্যই লিখে রাখছি যাতে পরে ভুলে না যাই:

অক্ষরম মানে 'ন ক্ষরতি' - that which does not perish - অক্ষয়। 'অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং' মানে যাঁর নাশ নেই তিনিই পরমব্রহ্ম। 
'সভাবঃ-অধ্যাত্মম্-উচ্যতে' মানে স্বভাবই আধ্যাত্ম বলে উল্লিখিত হয়। সেটা কিরকম? না, জীব আর ব্রহ্মের স্বভাব একই। ব্রহ্মই জীবরূপে উৎপন্ন হয়ে সুখ দুঃখ ভোগ করেন আর এইজন্যই তাঁকে আধ্যাত্ম বা জীবচৈতন্য বলে। অর্থাৎ এখানে প্রতি জীবদেহে পরব্রহ্মের প্ৰত্যগাত্মরূপে অবস্থানকেই একটি শব্দে বোঝানো হয়েছে।

'ভূত-ভাব-উদ্ভবকরঃ বিসর্গঃ' - ভূত মানে পৃথিবী, তার যে ভাব অর্থাৎ বস্তু, সেটাই ভূতভাব। সেই ভূতভাব অর্থাৎ এই মায়ার জগতের মূলে যে কামনা বাসনা - আমার বিবেচনায় তাকেই এখানে 'ভূতভাবোদ্ভবকর' বলা হয়েছে। বিসর্গঃ কি? নির্বাসনা, ভূতভাবের উৎপত্তিকারক সবকিছুকে ত্যাগ করার যজ্ঞ। কি ত্যাগ? যা কিছু ক্ষয়িষ্ণু, অনিত্য, সাময়িক, সে সবকে পাওয়ার বাসনা ত্যাগ। আর বস্তুজগৎরূপ যজ্ঞকুণ্ডে প্রজ্জ্বলিত ত্যাগরূপ যজ্ঞাগ্নিতে দেহধারণের ফলে উৎপন্ন হওয়া বাসনারূপ যজ্ঞহবির আহুতিদানের এই engagement-কেই বলা হচ্ছে 'কর্ম', যার সম্পাদন সগুণ ব্রহ্মস্বরূপা মহামায়ার কৃপা হলে সম্ভব হয়। এটাই হলো নিষ্কাম কর্ম, যে কর্মের দ্বারা জগতের কল্যাণ হয় আর নিজেরও মোক্ষলাভ অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান হয়। 

তাহলে সংক্ষেপে কি দাঁড়ালো? ব্ৰহ্ম = অবিনাশী পরম সত্তা = পরম অক্ষর। অধ্যাত্ম = দেহকে আত্মভাবে অধিকার করে যা কিছু আছে = স্বভাব। কৰ্ম্ম = ভূতনিচয়ের উৎপাদক যজ্ঞ = ভূতভাবোদ্ভবকরো বিসর্গঃ। বাউলরা বলেন যে এই দেহে অধিযজ্ঞরূপে ভগবান বিদ্যমান আছেন (অধিযজ্ঞোহহমেবাত্র দেহে দেহভূতাং বর - গীতা ৮.৪)। অধিযজ্ঞ মানে যিনি সমস্ত যজ্ঞের প্রবর্তক ও ফলদাতা, যিনি অন্তর্যামীরূপে দেহমধ্যে বাস করেন। যেহেতু দেহ দ্বারাই যজ্ঞাহুতি অর্থাৎ মায়াজগতের প্রতি মোহ ত্যাগ হয়, সেইজন্য লিঙ্গশরীরকে আশ্রয় করে আত্মসুখের জন্য যজ্ঞাভিমানিনী ভগবান এই দেহেই বসবাস করেন। ওঁরা তাই তাঁকে নিজের দেহের মধ্যে খোঁজেন, তাতে অসুবিধের তো কিছু নেই। বাউলদের দর্শন তো আর অদ্বৈতের বাইরে নয়। তাঁর সংসারে তিনি নেই এমন জায়গা কই?

Tuesday, May 10, 2022

প্রেম

জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখছি বাইরেটা ঝাপসা হয়ে গেছে, মাতার স্তন্যসুধা-হেন বৃষ্টির জীবনদায়িনী ফোঁটা ঝরে ঝরে পড়ছে অঝোরে। গাছের পাতাগুলো সব যেন স্নেহচুম্বনের পরিপূর্ণতায় একেবারে টগবগ করছে, বহতি ঝোড়ো হাওয়ার সাথে সাথে যেন মায়ের কোলে ওঠা শিশুর হটাৎ আনন্দের উচ্ছলতার স্পর্শ সবকিছুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিভেজা মাটি যেন উদ্ভিন্নযৌবনা সদ্যযুবতীর মতো আরক্তমুখে সোহাগে সিঞ্চিত হতে হতে প্রেমে নিশ্চিন্ত নির্ভর নিবেদিতা হয়ে পড়ছেন। একটু পরেই রোদ উঠবে, আলোর কণায় কণায় ভরে যাবে এই ভোর, পাতাদের ভিজে গায়ে যেন হাজার হাজার জোনাকি জ্বলে উঠবে, তার ফাঁক দিয়ে জীবন উঁকি মেরে মুচকি হেসে বলবে, "কেমন আছো?" হয়তো তারপর আবার আকাশ মেঘে ঢেকে যাবে, আবার বৃষ্টি নামবে, আবার আলো আর কালোর লুকোচুরি খেলা শুরু হবে। দেখছি আর রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ছেন, মনে পড়ছে শেষের কবিতার অমিত আর লাবণ্যকে, মনে পড়ছে শিলং পাহাড়ে এমনই এক বৃষ্টিস্নাত দিনে অমিতের সেই কথাগুলো, "বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি"। ওই হলো আসল কথা - 'ভালো'।

শিলং পাহাড়ে একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে অমিত যখন লাবণ্যকে একটা ছ্যাৎলাপড়া পাথরের ওপর বসতে অনুরোধ করেছিল, তখন লাবণ্য ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, "কিন্তু সময় যে অল্প।" উত্তরে অমিত কি বলেছিল মনে পড়ে? বলেছিল, "জীবনে সেটাই তো শোচনীয় সমস্যা লাবণ্যদেবী, সময় অল্প।… সময় যাদের বিস্তর তাদের পাঙ্কচুয়াল হওয়া শোভা পায়। দেবতার হাতে সময় অসীম; তাই ঠিক সময়টিতে সূর্য ওঠে, ঠিক সময়ে অস্ত যায়। আমাদের মেয়াদ অল্প, পাঙ্কচুয়াল হতে গিয়ে সময় নষ্ট করা আমাদের পক্ষে অমিতব্যয়িতা।" সবটাই তো সময়ের খেলা প্রভু। সময় হলে পাওয়া আবার সময় না হলে না-পাওয়া আর এই পাওয়া না-পাওয়ার মাঝের সময়টিতে নিজেকে বোঝা।
"ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ‘হারাই হারাই’ সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।
আশ না মিটিতে হারাইয়া– 
পলক না পড়িতে হারাইয়া–
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে। 
কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।"

অমিত একদিন বুঝেছিল যে প্রেমেরও বাহির আর ভেতর আছে, তার মধ্যে ওপরে ভেসে ওঠা আর ভেতরে ডুব দেওয়ার খেলাও আছে। তাই তো সে বলেছিল, "কেতকীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালোবাসারই। কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যের ভালোবাসা, সে রইল দীঘি। সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।" আসলে ভেতরের জগতের মধ্যেই বাইরের জগৎটাও বিরাজ করে, ওটা যেমন, এটাও তেমনই সজীব - ফলে গোটাটাকে চাই, সুপুরিগাছ বেয়ে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া লতাগুল্মের মতন একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে চাই। যাকে বাইরে দেখা যায়, তাকেই ভেতরে দেখা যায়, ঠিক যেন আয়নার সামনে দাঁড়ানোর মতন। আবার, চোখ খুললে যে আলো, চোখ বন্ধ করলেও তো সেই আলো, কেবল আলোর রকমফের কারণ চোখের নিজের যে কোনো আলো নেই। অন্ধকার মানে তো আসলে আলোই, আলোর বাইরের রূপ। যেমন প্রেম মানেই অপ্রেম আর অপ্রেম মানেই প্রেম। প্রেমের ওপর বাইরের আলো পড়লে তাকে খালি চোখে দেখা যায়, আর ভেতরে ঢুকলে সে আত্মগত হয়, তখন তাকে অন্তরের আলোয় দেখতে হয়। অমিতের সেই কথাগুলো মনে পড়ছে? "যে ভালোবাসা ব্যাপ্তভাবে আকাশে থাকে অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ; যে ভালোবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সব-কিছুতেই যুক্ত হয়ে থাকে সংসারে সে দেয় আসঙ্গ। দুটোই আমি চাই।"

Sunday, May 8, 2022

মৃত্যু ও রবীন্দ্রনাথ

আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। বেশ কয়েক ঘন্টা হয়ে গেল ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, রাস্তাঘাট জনশূন্য, পাখিদের ডাকও তেমন শুনতে পাচ্ছি না।কেন জানিনা আমার মন গতকাল বিকেল থেকেই বড় মৃত্যুময়। আসলে গতকালই আরো এক বছর এগিয়ে গেছি মৃত্যুর দিকে, ফলে খালি মনে হচ্ছে আর বেশি সময় নেই - হয়তোবা আর মাত্র পনেরো-কুড়ি বছর, এটুকুর মধ্যে কি সেই চিরকালীন অধরা ক্ষণকালীন হয়ে আমার বোধে, চেতনায় ধরা দেবেন? নাকি এই জীবনটা সত্যিই একেবারে বৃথা যাবে?

রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
"পৃথিবীতে সকল বস্তুই আসিতেছে এবং যাইতেছে-- কিছুই স্থির নহে; সকলই চঞ্চল-- বর্ষশেষের সন্ধ্যায় এই কথাই তপ্ত দীর্ঘনিশ্বাসের সহিত হৃদয়ের মধ্যে প্রবাহিত হইতে থাকে। কিন্তু যাহা আছে, যাহা চিরকাল স্থির থাকে, যাহাকে কেহই হরণ করিতে পারে না, যাহা আমাদের অন্তরের অন্তরে বিরাজমান-- গত বর্ষে সেই ধ্রুবের কি কোনো পরিচয় পাই নাই-- জীবনে কি তাহার কোনো লক্ষণ চিহ্নিত হয় নাই? সকলই কি কেবল আসিয়াছে এবং গিয়াছে? আজ স্তব্ধভাবে ধ্যান করিয়া বলিতেছি তাহা নহে-- যাহা আসিয়াছে এবং যাহা গিয়াছে তাহার কোথাও যাইবার সাধ্য নাই, হে নিস্তব্ধ, তাহা তোমার মধ্যে বিধৃত হইয়া আছে। যে তারা নিবিয়াছে তাহা তোমার মধ্যে নিবে নাই, যে পুষ্প ঝরিয়াছে তাহা তোমার মধ্যে বিকশিত-- আমি যাহার লয় দেখিতেছি, তোমার নিকট হইতে তাহা কোনোকালেই চ্যুত হইতে পারে না। আজ সন্ধ্যার অন্ধকারে শান্ত হইয়া তোমার মধ্যে নিখিলের সেই স্থিরত্ব অনুভব করি। বিশ্বের প্রতীয়মান চঞ্চলতাকে অবসানকে বিচ্ছেদকে আজ একেবারে ভুলিয়া যাই।" (বর্ষশেষ)

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে প্রাচীন ভারতের ঋষি মানুষকে অমৃতের পুত্র বলে সম্বোধন করে বলছেন,
‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’ (শ্বেতাশ্বতর-২/৫)। 
তিনি আরো বলছেন, মৃত্যুকে অতিক্রম করার পন্থা -
‘বেদাহ্‌মেতং পুরুষং মহান্তম্‌ আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ। 
তমেব বিদিত্বাহ্‌তি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহ্‌য়নায়।।’ (শ্বেতাশ্বতর-৩/৮)। 
দেখছি এই দিব্যচেতনার অসামান্য অনুবাদ করছেন আধুনিক ভারতের ঋষি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থে -
‘শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে,
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে, তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি’।
দুই যুগ এক হয়ে যাচ্ছে এক অনন্ত অখন্ড বোধের প্রবাহমান ধারায়। কি অপূর্ব, কি অপূর্ব!

উপনিষদে ঋষি প্রার্থনা করছেন,
ওঁ মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মাধ্বীর্ন সন্তোষধীঃ।।
মধু নক্তমুতোপষো মধুমত্পার্থিবং রজঃ।
মধু ধৌরস্তু নঃ পিতা।।
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাং অস্তু সূর্যঃ।
মাধ্বীর্গাবো ভবন্তু নঃ।। (বৃহদারণ্যক ৬॥৩॥৬॥)
(বায়ু মধু বহন করিতেছে। সমুদ্রসকল মধুক্ষরণ করিতেছে। রাত্রি মধু হউক, ঊষা মধু হউক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হউক। যে আকাশ পিতার ন্যায় সমস্ত জগৎকে ধারণ করিয়া আছে তাহা মধু হউক। ঔষধি বনস্পতি সকল মধুময় হউক। সূর্য মধুমান হউক। গাভীরা জগতের জন্য মাধ্বী হউক।)

আর রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
"হে বিশ্ববিধাতঃ, আজ আমাদের সমস্ত বিষাদ-অবসাদ দূর করিয়া দাও-- মৃত্যু সহসা যে যবনিকা অপসারণ করিয়াছে তাহার মধ্য দিয়া তোমার অমৃতলোকের আভাস আমাদিগকে দেখিতে দাও। সংসারের নিয়ত উত্থানপতন, ধনমানজীবনের আবির্ভাব-তিরোভাবের মধ্যে তোমার ‘আনন্দরূপমমৃতং’ প্রকাশ করো। কত বৃহৎ সাম্রাজ্য ধূলিসাৎ হইতেছে, কত প্রবল প্রতাপ অস্তমিত হইতেছে, কত লোক-বিশ্রুত খ্যাতি বিস্মৃতিমগ্ন হইতেছে, কত কুবেরের ভাণ্ডার ভগ্নস্তূপের বিভীষিকা রাখিয়া অন্তর্হিত হইতেছে–কিন্তু হে আনন্দময়, এইসমস্ত পরিবর্তনপরম্পরার মধ্যে ‘মধু বাতা ঋতায়তে’, বায়ু মধুবহন করিতেছে, ‘মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ’, সমুদ্রসকল মধুক্ষরণ করিতেছে–তোমার অনন্ত মাধুর্যের কোনো ক্ষয় নাই–তোমার সেই বিশ্বব্যাপিনী মাধুরী সমস্ত শোকতাপবিক্ষোভের কুহেলিকা ভেদ করিয়া অদ্য আমাদের চিত্তকে অধিকার করুক।" 

১৯০৫এ পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়ানের পর রবীন্দ্রনাথ ১৭ই পৌষ ১৩১৬ (ইং ১৯১০) তাঁকে উদ্দেশ্য করে একটি গান লিখেছিলেন যেটি পরে গীতাঞ্জলিতে ৫১ নম্বর কবিতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। গানটি হলো:
কোন্‌ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস।
সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো, ধরায় আস।
এই অকুল সংসারে,
দুঃখ-আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝংকারে।
ঘোরবিপদ-মাঝে 
কোন্‌ জননীর মুখের হাসি দেখিয়া হাস।
তুমি কাহার সন্ধানে
সকল সুখে আগুন জ্বেলে বেড়াও কে জানে।
এমন ব্যাকুল করে 
কে তোমারে কাঁদায় যারে ভালোবাস।
তোমার ভাবনা কিছু নাই -
কে যে তোমার সাথের সাথি ভাবি মনে তাই।
তুমি মরণ ভুলে 
কোন্‌ অনন্ত প্রাণসাগরে আনন্দে ভাস।

আমি বহুক্ষণ গানটি গেয়ে বা না গেয়ে গুনগুন করছি কিন্তু একে এতদিন যেভাবে বুঝতাম, আজ যতবার পড়ছি, সেই বোঝার সমস্তটাই কেমন যেন পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। আজ আর খেই পাচ্ছি না, যত এক একটি শব্দবন্ধ ধরে ধরে মনে মনে ব্যাখ্যা করছি তত স্তর থেকে স্তরান্তরে চালে যাচ্ছে ভাবনা, অর্থের নতুন নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছে। এক একটা যতিচিহ্নর ব্যবহার সম্পুর্ন স্তবকের ব্যঞ্জনা পাল্টে দিচ্ছে, এ যেন বোধের এক অদ্ভুত অনিঃশেষ ধাঁধা। এটুকুই কেবল নিশ্চিতরূপে বুঝছি যে এতদিন কিছুই বুঝিনি আর চোখ দুটো আপনা থেকেই বারেবারে জলে ভরে উঠছে।
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা ॥
কত জনম-মরণেতে     তোমারি ওই চরণেতে
আপনাকে যে দেব,      তবু বাড়বে দেনা ॥

Thursday, May 5, 2022

কর্মফল

তিনি নিজের ইচ্ছাতেই নির্গুণ থেকে সগুণ হন, তাঁর ইচ্ছাতেই জগৎ সৃষ্টি হয়, তাঁর ইচ্ছাতেই জীবের জন্ম এবং মৃত্যুর কালচক্র চলতে থাকে এবং তাঁর ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি পাতারও নড়বার যো নেই, এমনটাই তো বিভিন্ন শাস্ত্রে শোনা যায়। তাহলে আমাদের পাপ এবং পুণ্যের জিম্মেদারও নিশ্চয় তিনি। খামোখা আমরা কর্মফল ভোগ করি কোন দুঃখে! অন্ততঃ যুক্তির দিক দিয়ে তাই তো হওয়া উচিৎ। ইচ্ছাধারীর ইচ্ছামাত্র যখন জীব সৃষ্টি হচ্ছে, তখন ইচ্ছাপ্রসূতদের কর্মকাণ্ডের দায় তো তাঁরই ওপর বর্তায়, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?

দুটি মানব মানবী পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেন, তাঁদের প্রেম গভীর হলো, তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন, তাঁদের প্রেম সর্বাত্মক হওয়ার কারণে পরস্পরের মন এবং দেহ দুটিই সংযুক্ত হলো এবং ফলত জৈবিক কারণেই একদিন সন্তান উৎপন্ন হলো। সেই সন্তান এই দম্পতির প্রেমের মূর্ত প্রকাশ হলেও পক্ষান্তরে তাঁদের ইচ্ছার ফসলও তো বটে। এইবার সেই সন্তানকে তাঁরা সযত্নে লালন পালন করলেন, নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিলেন, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিলেন, ভালো মানুষ হতে শেখালেন। ক্রমে সন্তান বড় হলেন, কর্মক্ষম হলেন, তাঁর নিজস্ব পরিবার গড়ে উঠলো, পিতা-মাতা বৃদ্ধ হলেন, অশক্ত হলেন, সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হলেন। এইবার সন্তান কর্মক্ষেত্রে এমন একটি পরিস্থিতির শিকার হলেন যেখানে তাঁকে বেশ কিছু অধস্তন কর্মচারীকে বিনা দোষে ছাঁটাই করতে হলো। তিনি জানেন যে তাঁর নির্ণয়ের কারণে এতগুলো পরিবার পথে বসবে, সেই পরিবারগুলির নিষ্পাপ শিশুদের দুর্দশা হবে। কিন্তু তাও তিনি নিরুপায় কারণ নিজের পরিবারের আর্থিক সুরক্ষার জন্য নিজের চাকরিটি বাঁচানো তাঁর কাছে ভীষণ জরুরি এবং সেই কারণেই তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অবাধ্য হতে পারলেন না। তিনি এও জানেন যে তিনি যদি বেঁকে বসেন তাতেও আখেরে কারো লাভ হবে না - তাঁর জায়গায় অন্য কাউকে দিয়ে কর্তৃপক্ষ ছাঁটাই ঠিকই করিয়ে নেবেন। এখন প্রথম প্রশ্ন হলো, সন্তান যেহেতু পিতা-মাতার ইচ্ছার ফসল, তাহলে সন্তানের কর্মফলের দায় তাঁদের নেওয়া উচিত - কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা কি যুক্তিযুক্ত? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, সন্তান যা করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন, তার কারণ তাঁর বৃদ্ধ, অশক্ত পিতা-মাতাকে এবং পরিবারকে সুখে স্বস্তিতে রাখা ধর্মত তাঁর দায়িত্ব এবং তিনি চাইলেই হুট করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেই দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না - সেক্ষেত্রে কর্মফল কার? আর তৃতীয় প্রশ্ন হলো, যাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে, তাঁদের দুর্ভোগ কি ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে নাকি তাঁদের নিজেদের প্রারব্ধের ফলে?

যুবাবস্থায় শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দজীর অন্যতম প্রিয় জার্মান দার্শনিক ইমেন্যুয়েল কান্ট তাঁর বিখ্যাত Groundwork of the Metaphysic of Morals বইতে categorical imperative থিওরি অনুযায়ী কর্মকে চারটি মুখ্য পর্য্যায় ভাগ করেছেন:
১. Act as if the maxims of your action were to become through your will a universal law of nature.
২. Act in such a way that you treat humanity, whether in your own person or in the person of any other, never merely as a means to an end, but always at the same time as an end.
৩. Thus the third practical principle follows [from the first two] as the ultimate condition of their harmony with practical reason: the idea of the will of every rational being as a universally legislating will.
৪. Act according to maxims of a universally legislating member of a merely possible Kingdom of Ends.
এই সূত্র ধরেই উনি perfect duty আর imperfect duty তত্বের অবতারণা করেছিলেন, যেখানে যে কোনো কৃতকর্মের বিশ্বজনীন মান্যতা পেতে গেলে তার ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একটা সার্বজনীন প্রয়োগযোগ্যতা থাকতে হবে। সম্ভবত ওনার এই hypothetical Kingdom of Ends হলো সেই মানসিক স্থিতি যেখান 'all people should consider themselves never solely as means but always as ends.' কান্টসাহেবের থিওরির স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে  নানান মত থাকতে পারে এবং আছেও, কিন্তু তাঁর duty for duty's sake বক্তব্য যে পাশ্চাত্যকে এককালে কর্তব্যের দিশা দেখিয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের সংস্কৃতিতে কিন্তু কর্ম সম্পর্কে কোনো অস্পষ্টতা কোনোকালেই ছিল না, তা সে ঈশ্বরবিশ্বাসী মতবাদসমূহেই হোক বা মীমাংসাসূত্রধারী নিরীস্বরবাদীদেরই হোক।

তুমি যদি ব্যক্তিগত ফললাভের আশায় কোনো কাজ করো, অর্থাৎ যা করছো তার পেছনে যদি তোমার ব্যক্তিগত কোনো ভোগেচ্ছা কাজ করে, তাহলে বাপু তার কর্মফলও সব তোমার, অতএব জন্মজন্মান্তর ধরে সব ভোগান্তিও তোমার। অর্থাৎ বাসনা থাকলেই জন্মান্তর থাকবে। আর যদি নিষ্কাম হয়ে কোনো কাজ করো, অর্থাৎ অনাসক্ত হয়ে, ফলাকাঙ্খাহীন হয়ে, কেবল কর্তব্যবোধের খাতিরে কিছু করো, তাহলে তার দায় বাপু তোমার নয়। এই হলো সাধারণ নিয়ম। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানপথে সকাম কর্মের উদ্দেশ্য হলো সাময়িক জাগতিক শারীরিক ও মানসিক সুখ আর নিষ্কাম কর্মের উদ্দেশ্য হলো সরাসরি ঈশ্বরের সাথে যোগস্থাপন কারণ মানুষ তখন নিজেকে সৃষ্টজীব হিসেবে বুঝতে পেরে এটাও বোঝে যে তার সব কর্ম ঈশ্বরের দ্বারাই পরিচালিত, সে নিমিত্তমাত্র, অর্থাৎ যন্ত্রীর হাতের যন্ত্র। একেই যজ্ঞার্থ কর্ম বলে অর্থাৎ যে কাজ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যজ্ঞরূপে কার্য্যকারী করা হয়। আর নিঃস্পৃহতারূপ অগ্নিতে কর্মফলরূপ হবি অর্পণ করে নিজে দায়মুক্ত হয়ে ঈশ্বরের সাথে সংযুক্ত হয়ে যাওয়ার নামই মুক্তি।

'অনিত্যাশুচিদুঃখানাত্মসু নিত্যশুচিসুখাত্মখ্যাতিরবিদ্যা।' 
(যোগসূত্র : ২/৫) ।।
বিবেকখ্যাতিরবিপ্লবা হানোপায়ঃ। 
(যোগসূত্র ২/২৬) ।।
‘ইত্যেষ মোক্ষস্য মার্গো হানস্যোপায় ইত্যি’। (যোগভাষ্য ২/২৬)।।
অর্থাৎ :
অনিত্যকে নিত্য, অশুচিকে শুচি, দুঃখকে সুখ এবং অনাত্মাকে আত্মাবোধ করা বা খ্যাতিই হলো অবিদ্যা (যোগসূত্র ২/৫)।।  
সত্যজ্ঞান প্রদায়িনী বিবেকপ্রসূত প্রজ্ঞাই অবিদ্যা ত্যাগের প্রধান উপায়। (যোগসূত্র ২/২৬)।।  
এই অবিদ্যা থেকে পরিত্রাণই মোক্ষ বা মুক্তির উপায়। (যোগভাষ্য ২/২৬)।।

মহাভারতে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন,
'বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে।
তস্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।।'  
(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ২/৫০)
বলছেন যে নিষ্কাম কর্মযোগী ঐহিক জীবনেই পাপ ও পুণ্য উভয় হতে মুক্ত হন। সুতরাং তুমি নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান করো। কর্মফল নিজের নয় বলে আবার হেলাফেলা করে কাজ করো না যেন। সমস্ত কাজ ভীষণ নিপুনতার সাথে করবে কারণ যে কোনো কাজে নৈপুণ্য অর্জনের নামই হলো যোগ। 
যোগসূত্রকার মহর্ষি পতঞ্জলি আবার যোগের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন- 'যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ'
অর্থাৎ : চিত্তবৃত্তির নিরোধই যোগ। সেইজন্যই চিত্তশুদ্ধি, সংযম ও ধ্যানের আলোচনা ওনার শাস্ত্রে এত গুরুত্ব পেয়েছে। এসব নাহলেই যারপরনাই ক্লেশ উৎপন্ন হয়।
অবিদ্যাস্মিতারাগদ্বেষাভিনিবেশাঃক্লেশাঃ।’ 
(যোগসূত্র ২/৩)
অর্থাৎ : অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশই পঞ্চপ্রকার ক্লেশের পঞ্চনাম।

যোগশাস্ত্র চারটি অঙ্গবিশিষ্ট - হেয়, হেয়হেতু, হান ও হানোপায়। হেয় হলো সংসার, হেয়হেতু হলো সংসার হেতু। এখানে হেতু বলতে প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ বোঝায়। হান হলো মোক্ষ বা কৈবল্য এবং হানোপায় হলো মোক্ষের বা কৈবল্যের উপায়। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
১. ‘হেয়ং দুঃখমনাগতম্’- (যোগসূত্র ২/১৬)
অর্থাৎ : সংসার দুঃখময় বলে তা পরিত্যাজ্য।
২. ‘দ্রষ্টদৃশ্যয়োঃ সংযোগো হেয়হেতুঃ’- (যোগসূত্র ২/১৭)
অর্থাৎ : পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ হলো হেয়-হেতু বা দুঃখের কারণ।
৩. ‘তদভাবাৎ সংযোগাভাবো হানং তদ্দৃশেঃ কৈবল্যম্’- (যোগসূত্র ২/২৫)
অর্থাৎ : পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগাভাব হলো হান বা কৈবল্য।
৪. ‘বিবেকখ্যাতিরবিপ্লবা হানোপায়ঃ’- (যোগসূত্র ২/২৬)
অর্থাৎ : সত্যজ্ঞান প্রদায়িনী বিবেকপ্রসূত প্রজ্ঞাই কৈবল্য লাভের প্রধান উপায়, যার কথা আগেই বলা হয়েছে।

এই কথাগুলিই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কত সহজভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন,
১৪। জলে নৌকা থাকে ক্ষতি নেই, কিন্তু নৌকার ভেতর যেন জল না ঢোকে, তা হলে ডুবে যাবে। সাধক সংসারে থাকুক ক্ষতি নেই কিন্তু সাধকের মনের ভেতর যেন সংসারভাব না থাকে।
১৫। সংসার কেমন? যেমন আমড়া - শাঁসের সঙ্গে খোঁজ নেই, কেবল আঁটি আর চামড়া; খেলে হয় অম্লশূল।
১৬। যেমন কাঁঠাল ভাঙতে গেলে লোকে আগে বেশ ক'রে হাতে তেল মেখে নেয় তা হলে আর হাতে কাঁঠালের আঠা লাগে না; তেমনি এই সংসাররূপ কাঁঠালকে যদি জ্ঞানরূপ তেল হাতে মেখে সম্ভোগ করা যায়, তা হলে কামিনীকাঞ্চনরূপ আঠার দাগ আর মনে লাগতে পারবে না।
১৭। সাপকে ধরতে গেলে তখনই তাকে দংশন ক'রে দেবে, কিন্তু যে ব্যক্তি ধুলোপড়া জানে, সে সাতটা সাপকে ধরে গলায় জড়িয়ে বেশ খেলা দেখাতে পারে; তেমনি বিবেকবৈরাগ্যরূপ ধুলোপড়া শিখে কেউ যদি সংসার করে, তাকে আর সাংসারিক মায়া-মমতায় আবদ্ধ করতে পারে না।
২। গুটিপোকা যেমন আপনারই নালে ঘর ক'রে আপনি বদ্ধ হয়, তেমনি সংসারী জীব আপনার কর্মে আপনি বদ্ধ হয়। যখন প্রজাপতি হয়, তখন কিন্তু ঘর কেটে বেরোয়, তেমনি বিবেক-বৈরাগ্য হলে বদ্ধজীব মুক্ত হয়ে যায়।
(শ্রীমৎ স্বামী ব্রহ্মানন্দজী সঙ্কলিত "শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপদেশ" - প্রথম চারটি উপদেশ 'সংসার ও সাধন' এবং শেষেরটি 'কর্মফল' অধ্যায় থেকে উদ্ধৃত)

Wednesday, May 4, 2022

অক্ষয়তৃতীয়া ২

সবটাই হলো প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার খেলা। আমরা বাইরের প্রকৃতিকে নিজেদের বাসনা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছি, নিজেদের সাময়িক সুখের জন্য তাকে যথেচ্ছ শোষণ করেছি, দোহন করেছি, ধ্বংস করেছি, যার ফলে সসাগরা বসুন্ধরা আজ সুস্থ বসবাসের প্রায় অযোগ্য হয়ে উঠেছেন। একমুঠো মাটি তৈরি করার মুরোদ নেই অথচ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে করে সেই মাটিকেই বন্ধ্যা বানাতে আমাদের জুড়ি নেই। সূর্যের আল্ট্রা ভায়োলেট বিকিরণ থেকে রক্ষা করার জন্য ভগবান যে ট্রাইঅক্সিজেনের আবরণ দিয়ে পৃথিবীকে ঢেকে দিয়েছিলেন, তার আমরা এমন দুর্দশা করেছি যে মানুষের বেঁচে থাকাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যে জল জীবনদায়ী অমৃত হিসেবে প্রকৃতির বদান্য, সেই জলের আমরা এমন দুরাবস্থা করেছি যে আগামী বিশ্বযুদ্ধ নাকি স্বচ্ছ পানীয় জলের দখলদারির জন্য হবে বলে শোনা যায়। কারণ একটাই - লোভ। আত্মবিস্মৃতির কারণে আমরা অনেকেই নিজেদের পরিচয় এই শরীরের ঊর্ধ্বে কিছু ভেবে উঠতে পারিনি এবং মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মাত্র কয়েক দশকের জীবিতকালের সুখের জন্য চিরকালের অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়াতেও দ্বিধা করিনি। আমরা একশ্রেণীর মানুষ এক বিধ্বংসী আসুরিক ভোগবাদীর দল এবং আজকের পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলও বটে। 

এর একেবারে উল্টো অবস্থানে আছেন শাশ্বত ভারতের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা, যাঁরা অন্তরের আসুরিক প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন যাতে বাইরের প্রকৃতি অবিকৃত সুজলা সুফলা থাকেন, সেখানে যেন সমস্ত জীব জগৎ জুড়ে এক অবিচ্ছিন্ন, অর্থপূর্ণ এবং পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক চিরকাল বিরাজ করে। তাঁরা বলতেন সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত, ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি (বৃহদারন্যক উপনিষদ ১/৪/১৪)। তাঁদের মননে সর্বে বলতে শুধু সমস্ত মানবজাতি নয়, সর্বে বলতে এই গোটা  বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত জড় ও চেতন বস্তু, ঈশ্বরের গোটা সৃষ্টিসমূহ। তাঁরা ভোগ নয়, ত্যাগে বিশ্বাসী ছিলেন, লোভ নয়, অল্পেতে সন্তুষ্ট ছিলেন, পূর্ববর্ণিত অবৈদিক সংস্কৃতির দলের চেয়ে একেবারে বিপরীতধর্মী পথের পথিক ছিলেন তাঁরা। তাঁরা নির্লোভ ছিলেন।

আসলে নির্লোভ মানেই তো নির্দোষ। যত গভীরভাবে 'সমগ্র সৃষ্টি একই শক্তির প্রকাশ'রূপী অবধারণা অন্তঃস্থ করা যাবে, তত মনের মধ্যে বিশ্বজনীন একাত্মতার বোধ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে আর নিজেকে শুধু শরীর বা মন নয়, সেই অখন্ড অনন্ত দৈবীশক্তির বিশালতা ও ব্যাপকতার সাথে সম্পৃক্ত ভাবাও সম্ভব হবে। তখন কে কাকে দোহন করবে? শ্রীশ্রীমা একজনকে বলেছিলেন, "যদি শান্তি চাও মা, কারাে দোষ দেখােনা, দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয় মা, জগৎ তােমার"। সত্যি সত্যিই কেউ যে আর পর নন, কিছুই তো পর নয়, সব আপন, সবাই যে আপনার। একমাত্র মনের আসুরিক প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেই যে এই মানবিক একাত্মতাবোধ জাগতে পারে, এই আসল কথাটা আমাদের পূর্বপুরুষ বুঝতে পেরেছিলেন। যদি বিজাতীয় ভোগবাদী নির্মমতা আর নির্দয়তার দোষ আমাদের অনেকের বোধ-বুদ্ধি দূষিত না করে দিত, হয়তো আজও আমরা সবাই নির্দোষই থাকতাম।

অবশ্য এক অর্থে আমরা কেউই আসলে নির্দোষ নই। নির্দোষ হলে কর্মফলের বোঝা মাথায় করে প্রারব্ধ ভোগার জন্য বারেবারে শরীরধারণ করতে হতো না, তারতম্যটি কেবল মাত্রার এবং মানের। এবং এই তারতম্যের জন্যই কিন্তু আমরা কেউ মানুষেতর, কেউ মানুষ, কেউ বা দেবতা। প্রারব্ধ যাই থাকুক না কেন, নিজেদের যাপনের মাধ্যমে আমরা দোষের ঢিপি আরো উঁচু করবো না সমস্ত দোষ যাতে স্খলন হয়, অন্তত ঈশ্বরের কাছে এমন প্রার্থনাটুকু করার মতন নিজেকে যেন উপযুক্ত বিবেচনা করতে পারি, সেটা একমাত্র আমাদেরই বিবেচ্য। অর্থাৎ আমরা বাইরের প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামাবো না অন্তরের প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামাবো, তার ওপর নির্ভর করে আমরা কোন দলের - বেশিদের দলে না কমদের দলে।

আমাদের আর পশুদের মধ্যে যদি একটি মূল পার্থক্য থেকে থাকে, সেটি হলো চেতনা। আমরা সত্য আর মিথ্যা, সৎ আর অসৎ, ন্যায় আর অন্যায়, ধর্ম আর অধর্ম বিচার করতে পারি, তারা পারেনা। আরো একটা বড় পার্থক্য আছে। আমরা স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বিবেকের মাথা খেয়ে অসৎকেও অনায়াসে আপন করে নিতে পারি, সে বেচারারা পারেনা। পশুদের মধ্যে প্রাণরক্ষার তাগিদে আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ অবশ্যই আছে কিন্তু কোনো ছল কপট নেই। ফলে, আমাদের মনে আমরা বিষ ধারণ করবো না অমৃত নাকি কিছু কিছু মাত্রায় দুটোই, সেই মন্থনের প্রক্রিয়া কিন্তু আমাদেরই হাতে। ঠাকুর ছিপ ফেলে মাছধরা খুব অপছন্দ করতেন কারণ তাতে খাবারের লোভ দেখিয়ে একটি প্রাণীকে প্রতারণা করে তার প্রাণহরণ করা হয়। এই পছন্দ অপছন্দগুলোই আমাদের নিয়ন্ত্রিত মনের ফসল, যা আমাদের মানুষ করে তোলে, ক্রমাগত আমাদের ধর্মাশ্রয়ী জীবন যাপনের দিকে এগিয়ে দেয়।

ভাগবতে রাজা পরীক্ষিৎ শুকদেবকে জিজ্ঞেস করছেন, 'হে মহাভাগ, মানুষ পাপকাজ থেকে কিভাবে বিরত থাকতে পারে আর নিজের পাপকর্মজনিত বিভিন্ন ভয়ানক যন্ত্রণাদায়ক নরকভোগ থেকে কিভাবে নিষ্কৃতি পেতে পারে?' (এই যে উন্নয়নের নামে যথেচ্ছাচারের ফলে উষ্ণায়নের ফলস্বরূপ আর্কটিক আইস গলে গলে সমুদ্রের জলস্তর বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছিয়েছে যে বহু দ্বীপপুঞ্জভিত্তিক দেশের চিরতরে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেইসব দেশের নাগরিকরা অনিশ্চয়তা আর প্রবল আতঙ্কে রোজ দিনযাপন করছেন, এটাই তো নরক - জীবন্ত নরক।) তখন শুকদেব উত্তর দিচ্ছেন, 'অগ্নি যেমন বৃহৎ বেণুগুল্মকে দগ্ধ করে, তেমনি শ্রদ্ধাযুক্ত  ব্যক্তিগণও তপস্যা, ব্রহ্মচর্য, শম, দম, ত্যাগ, সত্য, শৌচ, যম, নিয়ম ইত্যাদি সহায় করিয়া বুদ্ধি ও বাক্যকৃত সমূহ পাপ বিনষ্ট করিতে সমর্থ হয়'। শম মানে শান্তি, দম মানে সংযম, যম মানে অহিংসা আর নিয়ম মানে নিয়ন্ত্রণ। অন্তে সেই নিয়ন্ত্রণেই ফেরা। ওটাই যে মূল।

আত্মনিয়ন্ত্রণ

সবটাই হলো প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার খেলা। আমরা বাইরের প্রকৃতিকে নিজেদের বাসনা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছি, নিজেদের সাময়িক সুখের জন্য তাকে যথেচ্ছ শোষণ করেছি, দোহন করেছি, ধ্বংস করেছি, যার ফলে সসাগরা বসুন্ধরা আজ সুস্থভাবে বসবাসের জন্য প্রায় অযোগ্য হয়ে উঠেছেন। একমুঠো মাটি তৈরি করার মুরোদ নেই অথচ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে করে সেই মাটিকেই বন্ধ্যা বানাতে আমাদের জুড়ি নেই। সূর্যের আল্ট্রা ভায়োলেট বিকিরণ থেকে রক্ষা করার জন্য ভগবান যে ট্রাইঅক্সিজেনের আবরণ দিয়ে পৃথিবীকে ঢেকে দিয়েছিলেন, তার আমরা এমন দুর্দশা করেছি যে মানুষের বেঁচে থাকাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যে জল জীবনদায়ী অমৃত হিসেবে প্রকৃতির বদান্য, সেই জলেরও এখন এমন দুরাবস্থা যে আগামী বিশ্বযুদ্ধ নাকি স্বচ্ছ পানীয় জলের দখলদারির জন্য হবে বলে শোনা যায়। কারণ একটাই - লোভ। আত্মবিস্মৃতির কারণে আমরা অনেকেই নিজেদের পরিচয় এই শরীরের ঊর্ধ্বে কিছু ভেবে উঠতে পারিনি এবং মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মাত্র কয়েক দশকের জীবিতকালের সুখের জন্য চিরকালের অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়াতেও দ্বিধাবোধ করিনি। আমরা একশ্রেণীর মানুষ এক বিধ্বংসী আসুরিক ভোগবাদীর দল এবং আজকের পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলও বটে। 

এর একেবারে উল্টো অবস্থানে আছেন শাশ্বত ভারতের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা, যাঁরা অন্তরের আসুরিক প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন যাতে বাইরের প্রকৃতি অবিকৃত সুজলা সুফলা থাকেন, সেখানে যেন সমস্ত জীব জগৎ জুড়ে এক অবিচ্ছিন্ন, অর্থপূর্ণ এবং পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক চিরকাল বিরাজ করে। তাঁরা বলতেন সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত, ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি (বৃহদারন্যক উপনিষদ ১/৪/১৪)। তাঁদের মননে সর্বে বলতে শুধু সমস্ত মানবজাতি নয়, সর্বে বলতে এই গোটা  বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত জড় ও চেতন বস্তু, ঈশ্বরের গোটা সৃষ্টিসমূহ। তাঁরা ভোগ নয়, ত্যাগে বিশ্বাসী ছিলেন, লোভ নয়, অল্পেতে সন্তুষ্ট ছিলেন, পূর্ববর্ণিত অবৈদিক সংস্কৃতির দলের চেয়ে একেবারে বিপরীতধর্মী পথের পথিক ছিলেন তাঁরা। তাঁরা নির্লোভ ছিলেন।

আসলে নির্লোভ মানেই তো নির্দোষ। যত গভীরভাবে 'সমগ্র সৃষ্টি একই শক্তির প্রকাশ'রূপী অবধারণা অন্তঃস্থ করা যাবে, তত মনের মধ্যে বিশ্বজনীন একাত্মতার বোধ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে আর নিজেকে শুধু শরীর বা মন নয়, সেই অখন্ড অনন্ত দৈবীশক্তির বিশালতা ও ব্যাপকতার সাথে সম্পৃক্ত ভাবাও সম্ভব হবে। তখন কে কাকে দোহন করবে? শ্রীশ্রীমা একজনকে বলেছিলেন, "যদি শান্তি চাও মা, কারাে দোষ দেখােনা, দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয় মা, জগৎ তােমার"। সত্যি সত্যিই কেউ যে আর পর নন, কিছুই তো পর নয়, সব আপন, সবাই যে আপনার। একমাত্র মনের আসুরিক প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেই যে এই মানবিক একাত্মতাবোধ জাগতে পারে, এই আসল কথাটা আমাদের পূর্বপুরুষ বুঝতে পেরেছিলেন। যদি বিজাতীয় ভোগবাদী নির্মমতা আর নির্দয়তার দোষ আমাদের অনেকের বোধ-বুদ্ধি দূষিত না করে দিত, হয়তো আজও আমরা সবাই নির্দোষই থাকতাম।

অবশ্য এক অর্থে আমরা কেউই আসলে নির্দোষ নই। নির্দোষ হলে কর্মফলের বোঝা মাথায় করে প্রারব্ধ ভোগার জন্য বারেবারে শরীরধারণ করতে হতো না, তারতম্যটি কেবল মাত্রার এবং মানের। এবং এই তারতম্যের জন্যই কিন্তু আমরা কেউ মানুষেতর, কেউ মানুষ, কেউ বা দেবতা। প্রারব্ধ যাই থাকুক না কেন, নিজেদের যাপনের মাধ্যমে আমরা দোষের ঢিপি আরো উঁচু করবো না সমস্ত দোষ যাতে স্খলন হয়, অন্তত ঈশ্বরের কাছে এমন প্রার্থনাটুকু করার মতন নিজেকে যেন উপযুক্ত বিবেচনা করতে পারি, সেটা একমাত্র আমাদেরই মাথায়। অর্থাৎ আমরা বাইরের প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামাবো না অন্তরের প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামাবো, তার ওপর নির্ভর করে আমরা কোন দলের - বেশিদের দলে না কমদের দলে।

আমাদের আর পশুদের মধ্যে যদি একটি মূল পার্থক্য থেকে থাকে, সেটি হলো চেতনা। আমরা সত্য আর মিথ্যা, সৎ আর অসৎ, ন্যায় আর অন্যায়, ধর্ম আর অধর্ম বিচার করতে পারি, তারা পারেনা। আরো একটা বড় পার্থক্য আছে। আমরা স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বিবেকের মাথা খেয়ে অসৎকেও অনায়াসে আপন করে নিতে পারি, সে বেচারারা পারেনা। পশুদের মধ্যে প্রাণরক্ষার তাগিদে আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ অবশ্যই আছে কিন্তু কোনো ছল কপট নেই। ফলে, আমাদের মনে আমরা বিষ ধারণ করবো না অমৃত নাকি কিছু কিছু মাত্রায় দুটোই, সেই মন্থনের প্রক্রিয়া কিন্তু আমাদেরই হাতে। ঠাকুর ছিপ ফেলে মাছধরা খুব অপছন্দ করতেন কারণ তাতে খাবারের লোভ দেখিয়ে একটি প্রাণীকে প্রতারণা করে তার প্রাণহরণ করা হয়। এই পছন্দ অপছন্দগুলোই আমাদের নিয়ন্ত্রিত মনের ফসল, যা আমাদের মানুষ করে তোলে, ক্রমাগত আমাদের ধর্মাশ্রয়ী জীবন যাপনের দিকে এগিয়ে দেয়।

ভাগবতে রাজা পরীক্ষিৎ শুকদেবকে জিজ্ঞেস করছেন, 'হে মহাভাগ, মানুষ পাপকাজ থেকে কিভাবে বিরত থাকতে পারে আর নিজের পাপকর্মজনিত বিভিন্ন ভয়ানক যন্ত্রণাদায়ক নরকভোগ থেকে কিভাবে নিষ্কৃতি পেতে পারে?' (এই যে উন্নয়নের নামে যথেচ্ছাচারের কারণে বিশ্ব জুড়ে উষ্ণায়নের ফলস্বরূপ আর্কটিক আইস গলে গলে সমুদ্রের জলস্তর বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছিয়েছে যে বহু দ্বীপপুঞ্জভিত্তিক দেশের চিরতরে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেইসব দেশের নাগরিকরা অনিশ্চয়তা আর প্রবল আতঙ্কে রোজ দিনযাপন করছেন, এটাই তো নরক - জীবন্ত নরক।) তখন শুকদেব উত্তর দিচ্ছেন, 'অগ্নি যেমন বৃহৎ বেণুগুল্মকে দগ্ধ করে, তেমনি শ্রদ্ধাযুক্ত  ব্যক্তিগণও তপস্যা, ব্রহ্মচর্য, শম, দম, ত্যাগ, সত্য, শৌচ, যম, নিয়ম ইত্যাদি সহায় করিয়া বুদ্ধি ও বাক্যকৃত সমূহ পাপ বিনষ্ট করিতে সমর্থ হয়'। শম মানে শান্তি, দম মানে সংযম, যম মানে অহিংসা আর নিয়ম মানে নিয়ন্ত্রণ। অন্তে সেই আত্মনিয়ন্ত্রণেই ফেরা। ওটাই যে মূল।

Tuesday, May 3, 2022

অক্ষয়তৃতীয়া

সংশ্লিষ্ট সকল সনাতনীকে জানাই অক্ষয় তৃতীয়ার আন্তরিক শুভেচ্ছা। এই তিথিতে যা কিছু শুভকর্ম করা হয়, তার ফল হয় অক্ষয় পূণ্যদায়িনী। এই তিথিতে যা জ্ঞান আহরণ করা হয়, তাও অক্ষয় প্রভাব ফেলে বুদ্ধিতে, চিত্তে। আজকের এই বিশেষ দিনে দানের ফলও অক্ষয় হয়। এই তিথিতে পুণ্যতোয়া, পুণ্যসলিলা ভগবতীদেবী গঙ্গা মর্ত্যে অবতরণ করেন। তারপর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অক্ষয় জলসম্ভার সমেত মর্ত্যবাসীর জীবনদায়িনী তথা পাপনাশিনী নদীরূপে তিনি প্রবাহমানা। তাই আজ অনুশোচনা, প্রায়শ্চিত্ত ও প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে পাপস্খলনের দিনও বটে।

বহুযুগ আগে এই শুভদিনের একটি বিশেষ ঘটনার বিবরণ ভাগবৎ পুরাণে লেখা আছে। 

দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকার অধিনায়ক। বাল্যসখা সুদামা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বৃন্দাবন থেকে সুদূর দ্বারকায় এলেন কিছু অর্থসাহায্য চাইতে। দরিদ্র সুদামা কৃষ্ণের জন্য কাপড়ের পুটুলিতে বেঁধে এনেছিলেন তিনমুঠো চালভাজা। প্রাসাদের দ্বারীরা তো তাঁকে দূরছাই করে তাড়িয়েই দিচ্ছিল কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ জানতে পেরে বন্ধুর জন্য যে রাজাতিথেয়তার আয়োজন করলেন, তাতে মুগ্ধ হয়ে সুদামা আর নিজের দৈন্যাবস্থার কথা মুখ ফুটে বলতেই পারলেন না। এমনকি কৃষ্ণের প্রাসাদে সম্পদের বৈভব দেখে, তাঁর জন্য আনা কাপড়ে বাঁধা সামান্য চালভাজাটুকুও লজ্জায় আর দিতে পারেননি সুদামা। কিন্তু ভক্তবৎসল ভগবান বাসুদের যে ভাবগ্রাহী। তিনি ভাবটুকু গ্রহণ করেন, কেবল ভেট নয়। তাই নিজেই সেই চালভাজা চেয়ে খেয়ে পরম তৃপ্তি প্রকাশ করলেন। আর সুদামা নিজের মুখে কিছু না চাইলেও, বাড়িতে ফিরে দেখেন যে তার ক্ষুদ্র কুঠিরের পরিবর্তে বৃহৎ এক অট্টালিকা দাঁড়িয়ে আছে! ভগবান অযাচিত করুণাভরে সবকিছু সাজিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন তাঁর একান্ত প্রিয় সখা তথা ভক্তপ্রবর সুদামাকে। এই লীলার দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে, ভক্তের চাওয়ার অপেক্ষা করেন না ভগবান। অহৈতুকী অযাচিত কৃপা তিনি নিজে থেকেই করেন তাঁর ভক্তের প্রতি। 

যিনি সকল গুনের আকর, তাঁর মতো সুহৃদ, তাঁর মতো ভক্তবৎসল পরমবান্ধব আর কে কোথায় আছেন? তাঁর কাছে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করলে তিনি ভক্তের মনোবাঞ্চা সবসময়ই পূর্ণ করেন। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণও আছে। সবাই জানেন যে কৌরব রাজসভায় রথী-মহারথীদের সামনে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের চেষ্টা করেছিলেন দুঃশাসন কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের করুণায় সে চেষ্টা সফল হয়নি। পাঞ্চালীর কাতর প্রার্থনা শুনে তাঁর লজ্জা নিবারণ করেছিলেন বাসুদেব। সেই দিনটিও ছিল অক্ষয় তৃতীয়া। আজ ভগবৎকৃপা প্রার্থনা করার অন্যতম উৎকৃষ্ট সেই দিন, যার আধ্যাত্মিক প্রসাদলাভ জন্মজন্মান্তর ধরে অক্ষয় হয়।