Thursday, August 31, 2023

শি জিন পিং এবং জি২০

চীনের ১৮ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির গল্পটা কেবল গল্পই, আসলে ওটা খুব বেশি হলে ৭.৭৫ট্রিলিয়ন, তাতেও কিঞ্চিৎ জল মেশানো থাকতে পারে। দেঙ্গ জিয়াও পেং যে রাস্তায় হেঁটেছিলেন তাতে সত্যি সত্যিই চীন একদিন ১৮ট্রিলিয়নে পৌঁছত কিন্তু তাতে ধীরে ধীরে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র সিসিপির হাত থেকে টেক জারদের হাতে চলে যেত। মুস্কিল হলো কম্যুনিস্ট একনায়করা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে চিরকাল সিঁটিয়ে থাকেন কারণ ওটাই ওঁদের এলিট বিলাসবহুল জীবনযাপনের একমাত্র চাবিকাঠি।

ফলে শি জিন পিং দেশের অগ্রগতির সর্বনাশ করে চীনকে আবার মাওয়ের রাস্তায় নিয়ে চলেছেন, অর্থনীতিতে যার ভয়ঙ্কর প্রতিফলন ইতিমধ্যেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চীনের ৭.৭৫ট্রিলিয়নের অর্থিনীতির তুলনায় রাষ্ট্রীয় ঋণ সাড়ে পাঁচ গুণ বেশি, তার ওপর জিরো কোভিড পলিসির জন্য সাপ্লায়ার হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতাও তলানিতে এসে ঠেকেছে, ফলে ভবিষ্যতে চীনের আবার উঠে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম। 

এমত অবস্থায় শি বা এই ধরণের অটোক্র্যাটদের হাতে ব্রাভাডো ছাড়া করে দেখানোর মতন খুব একটা কিছু থাকে না। তাই 'বসুধৈব কুটুম্বকম' শব্দের ওপর আপত্তি জানানো থেকে নিয়ে সম্ভাব্য জয়েন্ট স্টেটমেন্টের শব্দবন্ধ নিয়ে নানা ব্যাগড়া দেওয়া থেকে নিয়ে দালাল বুড়োখোকাকে লাদাখে পাঠিয়ে ভারতের কতটা জমি চীন কব্জা করে রেখেছে সেটা তার মুখ দিয়ে বলিয়ে কৌশলে নেহেরু, ইন্দিরা আর রাজীবের অপদার্থতাকে সেনা ও মোদীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করার পর ঠিক জি২০ শুরুর আগেই একটা মনগড়া ম্যাপ জারি করে খানিকটা হওয়া গরম করার চেষ্টা করে ভারত এবং আসিয়ান দেশগুলি থেকে চূড়ান্ত ঝাড় খেয়ে শেষে মিটিং ছেড়েই পালিয়ে গেলেন। 

এমনিতেও ভারতে চীনের ডাল আর গলছে না। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিক্সের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মোদীজি শিকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে যতক্ষণ না চীন গোটা ৩৪৪০ কিমি লম্বা এলএসি জুড়ে ২০১৩র আগের অবস্থানে ফিরে না যায়, ততক্ষন অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা হবে না। ইতিমধ্যে আদানি নিঃশব্দে বিশ্বজুড়ে ভারতের হয়ে ভারতীয় বেল্ট এন্ড রোড তৈরি করে চলেছেন, যা আটকাতে সোরস এবং চীন মরিয়া কিন্তু অপারগ। চীন আমাদের শত্রু নয়, সিসিপি আমাদের শত্রু - এটা যেন আমরা না ভুলি। যেদিন সিসিপির অবসান হবে সেদিন শত্রুতাও শেষ হয়ে যাবে। 

দেঙ্গের পরবর্তী প্রজন্মের নেতারা চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি থেকে নিজেদের ক্ষমতা আহরণ করতেন কারণ অবশেষে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পেয়ে সাধারণ গরিব মানুষ খুশি ছিলেন। শি-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো হয়ে গেছে, কারণ ওঁর ভ্রান্ত পলিসির জন্য চীন এখন অর্থনৈতিক অবনতির শিকার এবং দেশজুড়ে ডিফ্লেশনের সাথে পাল্লা দিয়ে বেকারত্বও মাত্রাছাড়া। এই অবস্থা বেশিদিন চলতে পারেনা, শি বা সিসিপির পতন অনিবার্য। 

আসলে সর্বক্ষেত্রে বিফল শি জিন পিং আর বিশ্বনেতৃত্বের সামনে মুখ দেখানোর মতন অবস্থায় নেই, বিশেষত ৭.৮% হারে জিডিপি বৃদ্ধির সুফল ভোগকারী ভারতীয় জনগণের সামনে তো নয়ই, আমেরিকা এবং ইউরোপের সামনেও নয়। মাওবাদী কম্যুনিস্ট শি স্রেফ লজ্জায় ভারতে আসছেন না। একদিকে কম্যুনিসমের ব্যর্থতা আর অন্যদিকে গণতন্ত্রের সাফল্যের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত আজকের ভারত - জি২০ থেকে পালিয়ে গিয়ে না চাইতেও বিশ্বকে শি জিন পিং দুটি বিপরীতধর্মী মতাদর্শের ব্যর্থতা বনাম সাফল্যের বার্তাই দিয়ে গেলেন।

Friday, August 4, 2023

তিনটি শব্দ

ভারতকে ইন্ডিয়া বলা বন্ধ হোক;
পূজাকে প্রার্থনা বলা বন্ধ হোক;
পন্থকে ধর্ম বলা বন্ধ হোক।

- ভারত এক প্রাচীন রাষ্ট্র, ইন্ডিয়া একটি দেশ;
- পূজা মানে দেবার্চনা, প্রার্থনা মানে আবেদন;
- পন্থ মানে মতবাদ, ধর্ম মানে আদর্শ জীবন যাপনের জন্য মূল্যবোধভিত্তিক সনাতন দার্শনিক মানদণ্ড।

প্রতিদিনের ব্যবহারিক প্রয়োগে এক্ষুনি এই তিনটি শব্দের পরিবর্তন না হলে শাশ্বত ভারত খুব শিগগির শিগগির আবার জেগে উঠবে না।

এই পরিবর্তন হলে কি হবে?

১. ভারত মানে এক বিরাট ইতিহাস : ইতিঃ হ আস্ : 'ইতিঃ' মানে এই রকম, 'হ' মানে নিশ্চয়, 'আস্' মানে ছিল - ভারত বললেই জনমানসে তাঁদের পূর্বপুরুষের সত্যিকারের অতুল কীর্তি পুনর্জাগরিত হবে। সেই ইতিহাস কি রকমের? 'ধর্মার্থকামমোক্ষাণাম উপদেশ সমন্বিতম্, পূর্ববৃত্তকথোপিতম্, ইতিহাসম্ প্রচক্ষ্যতে' - ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষলাভের উপদেশ সমন্বিত, পূর্বের বৃত্তান্ত যেখানে বলা আছে, সেটাই আসল ইতিহাস। অর্থাৎ ইংরেজ আর বামপন্থীদের দ্বারা তৈরি করা ইন্ডিয়ার দাসত্বের মেকি ইতিহাস নয়, প্রাচীন ভারতের ধর্ম আধারিত জীবনযাপনকারী জনগণের সত্যিকারের উপলব্ধি ও গৌরবগাথা, যা ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও databaseএর কাজ করবে। কোথাকার কোন আরাকোশিয়ার বাসিন্দা (বর্তমানে কান্দাহারের উত্তরপশ্চিম কোণে অবস্থিত আর্ঘ্যান্দব) মূলগ্রীকদেশীয় রাজদূত মেগাস্থেনিস পাটুলিপুত্রে (বর্তমানে পাটনা) সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের রাজসভায় এসে সম্রাটকে স্যান্ড্রকোটাস আর ভারতকে ইন্ডিয়া নাম দিয়ে দিলেন আর আমাদের সমস্ত পূর্বইতিহাস মুহূর্তের মধ্যে myth বা গল্প হয়ে গেল - মজা নাকি?

২. পূজাস্থল আর প্রার্থনাস্থল এক নয়, ফলে হিন্দুর মন্দির আর অন্য প্রার্থনাগৃহসমূহ সমগোত্রীয় নয়। প্রার্থনা তো এয়ারপোর্ট, হোটেল, রাস্তাঘাটে - যেখানে ইচ্ছা করা যায়, পূজা একমাত্র বিধিবদ্ধভাবে বিধিসম্মত উপায়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহেরই করা যায় এবং যতক্ষণ বিধিসম্মতভাবে তাঁর বিসর্জন না হচ্ছে, সেই পূজাস্থলের মালিক তিনিই থাকেন (আইনি ভাষায় বলে তিনি forever minor), তাতে মন্দিরের stucture থাকলো কি না থাকলো, মায় বিগ্রহ স্বয়ং সেখানে থাকলেন কি না থাকলেন, কিছু আসে যায় না। হিন্দুদের পূজা এবং বাকি মতাবলম্বীদের প্রার্থনার মধ্যে মূল পার্থক্যকে গুলিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রটি বুঝতে হলে হিন্দুদের মন্দিরের বিশেষত্বকে বুঝতে হবে, যা অন্য মতাবলম্বীদের প্রার্থনাগৃহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্যই নয়। মন্দির এমন একটি উর্যাক্ষেত্র যেখানে স্বয়ং ঈশ্বর বাস করেন, যেখান থেকে সেই উর্যা আহরণ করে মানুষ আধ্যাত্মপথে অগ্রসর হতে পারেন, সেটি ঈশ্বরের কাছে সুখ শান্তি সমৃদ্ধি ইত্যাদির জন্য আবেদনস্থল ও সামাজিক কর্মাদির জন্য মণ্ডপমাত্র নয়।

৩. সারা বিশ্ব জুড়ে বহু পন্থ অর্থাৎ religion এসেছে আর গেছে, পন্থ অর্থাৎ পথ চিরস্থায়ী নয়। আজকের পরিবেশে অনুসন্ধিৎসুর যেটিকে আদর্শ পথ বলে মনে হচ্ছে, কয়েক হাজার বছর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্যদের তা নাও মনে হতে পারে; পারস্য, মেশোপটেমিয়া, আরব, গ্রীস, মিশর বা পেগানদের ইতিহাস ঘাঁটলেই এর প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়। কিন্তু ধর্ম সনাতন, আদি এবং অন্তহীন, চিরসত্য, চিরনির্ভর। ধর্ম সেই সনাতন মূল্যবোধ যা সর্বযুগে সমাজকে ধারণ করে। তাই ধর্মের ওপর যদি আঘাত আসে তখন সর্বশক্তি দিয়ে তাকে রক্ষা করতে হয়, কারণ ধর্মহীন জীবন পাপের, জন্তুরও অধম। ধর্ম নষ্ট হলে সে ধর্মনষ্টকারীকেও নাশ করে তাই ঋষিরা বলছেন, 'ধর্ম এব হতো হস্তি ধর্মে রক্ষতি রক্ষিত:, তস্মাৎ ধর্মে ন হস্তব্যে মা নো ধর্মে হতো বধীৎ' - ধর্মকে যদি তুমি রক্ষা করো তাহলে ধর্মই তোমাকে রক্ষা করবে। আর যদি তুমি ধর্ম থেকে বিচ্যুত হও, ধর্মই তোমার নাশ করবে। পথ বদলায় কিন্তু ধর্ম বদলায় না, ঠিক যেমন খাদ্যাভ্যাস পাল্টায় কিন্তু ক্ষুধা বদলায় না।

হিন্দুস্থান প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুদের বাসভূমি, সনাতন ধর্মের সূত্রগুলি অর্থাৎ পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-বেঠিক, অধিকার-অনধিকার, কর্তব্য-অকর্তব্য, ভালো-মন্দ, গ্রহণযোগ্য-ত্যাজ্য ইত্যাদির মানদন্ড এখানেই উন্মোচিত হয়েছে এবং ব্যবহারিকরূপে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই হিন্দু সংস্কৃতিতে মতান্তর কখনোই মনান্তরের কারণ হতে পারেনা এবং এখানে যত্র জীব তত্ৰ শিব। বেদ বলছেন "একং সৎ বিপ্রা বহুদা বদন্তি"(যা সৎ তা এক, পন্ডিতেরা তা নানা নামে অভিহিত করেন)। , যে পন্থ সনাতন ধর্মাশ্রয়ী নয়, অর্থাৎ পরপন্থদ্বেষী, সেই পন্থগুলির এই ভারতরাষ্ট্রে কোনো স্থান নেই।

Thursday, August 3, 2023

কে জানে কালী কেমন

মান্না দের অনবদ্য কণ্ঠে সাধক রামপ্রসাদের লেখা একটি কালীকীর্তন শুনছিলাম, 'কে জানে কালী কেমন? ষড়দরশনে না পায় দরশন ৷৷ মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন ।' বড় সুন্দর, বড়ই সুন্দর এই গান। যোগের দিকটা ছেড়ে আমার কেবল মনে হলো সত্যিই তো, মা কালী আসলে দেখতে কেমন? তিনি কালো না নীল, তাঁর গলায় মুন্ডমালা না জবার মালা, তাঁর হাত দুটি না চারটি, তাঁর পরণে লাল বেনারসি না তিনি বস্ত্রহীনা, তাঁর পায়ে কি মল থাকে আর সেগুলি কি ঝম ঝম করে বাজে, ইত্যাদি। 

কালী কেমন জানতে গেলে তো সাধনায় অনেক দূর যেতে হবে, যেটা তাঁরই কৃপা ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি দেখতে কেমন, সেটি তো যাঁর যাঁর তাঁর তাঁর বিষয়। রামপ্রসাদের কাছে তিনি ছোট একটি মেয়ে হয়ে এসেছিলেন, যিনি তাঁকে বেড়া বাঁধতে সাহায্য করতেন। শ্রীশ্রীমায়ের কাছে তিনি এক আদিবাসী যুবতী কন্যা হয়ে এসেছিলেন, যিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে অসুস্থতা চলে যায় আর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তিনি মাতৃরূপা, বোধে সদাজাগ্রতা, একাধারে জননী এবং জগ্গজননী। ভাবছিলাম আমাকে যদি মা কালী কোনোদিন কৃপা করে দর্শন দেন, কি রূপে তিনি আমার সামনে আসবেন, বা বলা ভালো কোন রূপে আমি তাঁকে দেখতে চাইবো, এইসব আরকি। 

যতক্ষণে এইসব ভাবছি ততক্ষণে রামপ্রসাদী শেষ হয়ে আমার হেডফোনে শ্রীমৎ স্বামী সর্বজ্ঞানন্দজি মহারাজের গাওয়া অন্য গান বাজতে শুরু করেছে,
'দেবী প্রসন্নবদনে করুণাবতারে দিব্যোজ্জ্বলদ্যুতিময়ী ত্রিজগজ্জনিত্রি।'
ব্যাস, যেই দেবীর এই অপূর্ব বর্ণনা কানে গেল, ঝপ করে ১৯১৩ সালে ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথের তোলা শ্রীশ্রীমায়ের সেই ছবিটা মনের মধ্যে বিদ্যুতের মতন জ্বলে উঠলো, যেখানে জয়রামবাটিতে পুরানো বাড়ির দাওয়ায় তিনটি কাঠের খুঁটির মাঝামাঝি জায়গায় তিনি বসে আছেন, পাদুটি উঠোনে পাতা, তার পায়ের দুই তর্জনীতে দুটি লোহার আঙ্গট, হাতদুটি কোলের উপর জোড় করা, দুহাতে ঠাকুরের উপহার দেওয়া গঙ্গাপাড়ে সীতামাঈর হাতে দেখা ছিলেকাটা বালাজোড়া, পরণে সরু লালপেড়ে সাদা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, গলায় দুছড়া রুদ্রাক্ষের জপমালা, মুখে স্মিত হাসি, দাওয়ায় মায়ের পেছনদিকে একটা খুঁটের ওপর গোটাকয়েক ধানের বস্তা। 

এই তো আমার মা কালীর সত্যিকারের রূপ, কল্পনা নয়, একেবারে জলজ্যান্ত, যাঁর পাদপদ্মে মাতৃময় শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সমস্ত সাধনার ফল, মায় নিজের জপমালাটি পর্য্যন্ত নিবেদন করেছিলেন! জ্ঞানপথে এঁকে বুঝতে গেলে মুলাধার থেকে সহস্ররার পর্য্যন্ত উঠতেই হবে আর সহজে পেতে গেলে একবার সর্বশক্তি দিয়ে 'মা' বলে ডাকলেই হলো, কিছুতেই দূরে দূরে থাকতে পারবেন না, একেবারে দুহাত বাড়িয়ে আগলাতে চলে আসবেন। আহা, কি সুন্দরই না গানটা! তিনি ত্রিজগতের জননী, তাঁর শরীর থেকে এক দিব্য উজ্জ্বল দ্যুতি নির্গত হয়ে চারপাশে এক জ্যোতিবলয় সৃষ্টি করেছে (যা ওই ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও স্পষ্ট দেখা যায়), তিনি করুণার প্রতিমূর্তি আর শ্রীমুখমন্ডল জুড়ে যেন এক অপার্থিব প্রসন্নতা। আমার মন জানে কালী কেমন। 

মা আসলেই শক্তির বিভিন্ন রূপ ধারণ করে বিভিন্ন সময়ে হাতেগোনা কয়েকজন ভক্তকে কৃপাদর্শন দিয়েছেন, এটা কোনো কল্পনার বিষয় নয়, যদিও তিনি নিজের দৈবী স্বরূপকে ঢেকে রাখতে প্রাণপন চেষ্টা করতেন। এমনই একটি ঘটনা একবার শারদীয় দুর্গোৎসবের সময়কার। মা সেবার পুজোর ঠিক আগে বিষ্ণুপুরের সেনবাড়ি হয়ে কলকাতা যাত্রা করবেন। সঙ্গে বাঁকুড়ার বিভূতি ঘোষ, ডাক্তার মহারাজ প্রমুখ। এমন সময় সেন বাড়িরই অধীরেশ্বর নামের এক কিশোর বায়না ধরলে মায়ের সাথে কলকাতা যাবে। সে কখনো কলকাতার দুর্গাপ্রতিমা দেখেনি, এবারে প্রাণভরে দেখতে চায়। নানাভাবে ছেলেকে বোঝানো-ভোলানোর চেষ্টা হল। বাড়ির কর্তারা নানারকম সুখাদ্যের লোভ দেখালেন। তাতেও কাজ না হলে কড়া ধমক দেওয়া হলো কিন্তু অধীরেশ্বর একেবারেই নাছোড়বান্দা। তখন মা নিজেই তাকে অন্য একটি ঘরে নিয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে মা বেরিয়ে এলে সবাই তো থ। যে কিনা তিষ্ঠোতে দিচ্ছিল না কাউকে, এরই মধ্যে একেবারে সুবোধ বালক হয়ে গেছে! মা হেসে বললেন, “ছেলেমানুষকে কি বকতে আছে? ওরা তো বায়না করবেই… আদর করে ভোলাতে হয়।” এর বেশ কয়েক বছর পর, মা তখন আর নশ্বর দেহে নেই, এক দুর্গাপুজোয় আবার সেই অধীরেশ্বর বিভূতিবাবুর গৃহে এসেছেন। তাঁকে প্রতিমা দর্শনের জন্য ডাকা হলে তিনি বললেন, “জ্যাঠামশাই, আমি আর দুর্গাপ্রতিমা দর্শন করি না। শ্রীশ্রীমা যে জ্যান্ত দুর্গা দর্শন করিয়েছিলেন, সে মূর্তির পর আর কোনো মূর্তিই মনে ধরে না।”

Tuesday, August 1, 2023

উপলব্ধি

মানুষই নাম দেয়, আবার মানুষই সেই নামের বশ হয়ে পড়ে। বাইরের খোসাটার যে নাম, ভাবে ভেতরের শাঁসটারও বুঝি তাই নাম। যেমন কাঁঠালের খোসাটার তো কোনো ব্যবহার নেই, ভেতরের কোয়াগুলোই আসল, কিন্তু যেহেতু ওই খোসাটা না থাকলে কাঁঠালই থাকে না, আমরা কাঁঠালের কথা ভাবলেই একটা ভোঁতাকাঁটাদার মোটাখোসাওলা ভারী ঝুলন্ত লম্বাটে ফলের কথাই ভাবি, ভেতরের কোয়ার কথা ভাবি কই? কলার খোসা ছাড়িয়েই খাই কিন্তু কলা বলতেই যে ছবিটা মনে ভেসে ওঠে সেটা কি হলদে বা সবজে খোসাওলা ফলের না ভেতরের সাদা শাঁসটির?

আমরাও আমাদের খোসা দিয়েই পরিচিত হই, ওটার নামই আমাদের নাম হয়ে ওঠে। ওটার ভেতরে যিনি আছেন, যাঁকে খোসাটা ধরে রেখেছে, তিনি নাম-রূপের পারে, তিনি অনাদি, অব্যক্ত, অসীম। অস্ত্র তাঁকে কাটতে পারে না, আগুন তাঁকে পোড়াতে পারে না, জল তাঁকে ভেজাতে পারে না, হওয়া তাঁকে শুকাতে পারে না - নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ॥ জানি, কিন্তু মানি কই?

ঠিক যেমন কাঁঠালের খোসাকে বাদ দিয়ে কাঁঠালের কথা ভাবা যায় না, সেরকমই আমরা আমাদের শরীরকে দেওয়া নামকে বাদ দিয়ে ভেতরের আমিত্বকেও ভাবতে পারি না, ফলে আমরা নিজেদের এই বাইরের শরীরটিকে খোসার জায়গায় ভুল করে গোটা ফল হিসেবেই ভেবে বসি। যতক্ষণ কাঁঠালের খোসা থাকে ততক্ষণ যেমন ভেতরের কোয়া দেখা যায় না, তেমনই যতক্ষন শরীরবোধ প্রবল থাকে ততক্ষণ তার ভেতরটা দেখার ইচ্ছাই হয় না। শরীরবোধ মানে অহংকার, শারীরিক চাহিদা, জাগতিক বাসনা, ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি ইত্যাদির সংমিশ্রণ। 

তবে গাছে কাঁঠাল রেখে দিলে যেমন বাড়তে বাড়তে একসময় পেকে এত ভারী হয়ে যায় যে বোঁটা থেকে খসে মাটিতে পড়ে ছেতড়ে যায়, ঠিক সেইরকমই ভোগ যখন পর্য্যাপ্ত পর্যায়ে পৌঁছায় তখন হটাৎ একদিন মনে হয়, সবই তো হলো, অতঃ কিম্? কার পক্ষে কোন পর্য্যায়ের ভোগ সম্পুর্ন হলে তা পর্য্যাপ্ত হয়, সেটা অবশ্য তাঁর নিজস্ব ব্যাপার তবে কোনো না কোনো এক মনুষ্যজন্মে সবার মনেই এই প্রশ্নটি উঠবেই উঠবে, নইলে তিনি মানুষের শরীর পেতেন না। মানুষের শরীর পেলে কি হয়? একমাত্র মানুষই নিজের খোসা নিজে ছাড়াতে পারে। 

ভেতরে যিনি আছেন, যিনি এক শরীর থেকে অন্য শরীরে যাওয়ার সময় সাথে সাথেই যান, তিনি নামহীন। খোসা যখন বোঝে সে কেবল খোসা তখন সে ভেতরের শাঁসের জন্য একটা আলাদা নাম খোঁজে আর তার একটি রূপও কল্পনা করে নেয় কারণ খোসা তার ভেতরে থাকা শাঁসকে দেখতে পায়না। এই নাম কল্পিত, এই রূপও কল্পিত, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত ক্ষমতা অসীম কারণ যাঁকে উদ্দেশ্য করে এই নাম-রূপের কল্পনা, তিনি নিজেই যে অসীম। তবে তিনি যেহেতু জানেন যে আমরা নিজেদের মতো করে তাঁকেই ডাকছি, তাঁরই দর্শনের প্রতীক্ষায় বসে আছি, ফলে আমাদের কল্পনায় তিনি যেমনই হোক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না, তিনি ঠিকই সারা দেন।

এইখানেই নাম জপের মাহাত্ম। নাম মানেই তিনি। আর তিনি মানেই আমি। এটা এমন একটা একমুখী রাস্তা যার তিনটি স্তর আর তিনটি বাঁক - প্রথমে তিনি প্রভু আমি ভৃত্য, তারপর তিনি আর আমি পরমাত্মীয়, তারপর তিনিই আমি আর আমিই তিনি; একবার একটি বাঁক পেরিয়ে গেলে আর পেছন ফিরে আগের রাস্তাটা দেখা যায় না। তবে শুরুটা বড্ড গোলমেলে। প্রথমত, যে নামটা জপ করছি সেটা কোনো প্রিয় শরীরের নাম নয়, তাই তার সাথে কোনো ভৌতিক বন্ধন নেই। দ্বিতীয়ত, যাঁর নাম জপ করছি তাঁকে আমি দেখিনি, তাঁর কন্ঠস্বর শুনিনি, তাঁর সম্পর্কে কল্পনা ব্যতিরেকে আর কোনো মানবিন্দু নেই। তৃতীয়ত, এই অচেনা অজানা অস্তিত্বের নাম ধরে লাগাতার ডেকে যাওয়ার সময় আমি নিশ্চিত নই যে এর পরিণতি কি হবে।

এইখানে দুটি বিষয় খুব সাহায্য করে - গুরু এবং ইষ্ট। আর সেই ইষ্ট যদি অবতাররূপ গ্রহণ করে ধরায় অবতীর্ণ হয়ে থাকেন, তাহলে তো সাধকের সামনে একেবারে জলজ্যান্ত মানবিন্দু আছে, কল্পনার কোনো অবকাশই নেই। এ যে কি সুবিধার বিষয়, যাঁরা অনুভব করেছেন, তাঁরা সবাই জানেন। যিনি নাম-রূপহীন, তিনি স্বয়ং সশরীরে বর্তমান, তাঁর নির্দেশ লেখা আছে - পড়া যায়, তাঁকে চোখ খুলে ছবিতে দেখা যায়, আবার চোখ বন্ধ করে হৃদয়েও দেখা যায় আর তাঁর সাক্ষাৎ কায়িক ও বৌদ্ধিক প্রতিনিধি আমার গুরুদেব, যাঁকে সত্যি সত্যিই দেখেছি, ছুঁয়েছি, কথা বলেছি, যিনি আমাকে কৃপা করে কানে ইষ্টনাম শুনিয়েছেন এবং সেইসাথে আমার আধ্যাত্মপথের ভারও নিয়েছেন।

দুটো জিনিস আছে যার ওপর নির্ভর করে এগোতে পারলে এই যাত্রা সহজ হয়। এক, ভরসা আর দুই, অধ্যবসায়। নিজের ওপর ভরসা - ঠিক পথ বেছে নিয়েছি এবং শরীররূপী জীবনে যখন সফলতা পেয়েছি তখন আধ্যাত্মিক জীবনেও সফলতা পাবো। গুরুর ওপর ভরসা - যিনি নিজে ব্রহ্মজ্ঞানী, যিনি নিজে আত্মোপলব্ধি করেছেন, তিনি কৃপা করে আমায় যে মহামন্ত্র দিয়েছেন সেটি ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এবং তার ফল ফলবেই। তাছাড়া, ভুল করলে গুরুমহারাজ ঠিকই শুধরে দেবেন, তা তিনি শরীরে থাকুন বা নাই থাকুন। নামের ওপর ভরসা - নিরন্তর নামজপ করতে থাকলে তিনি একদিন না একদিন সারা দিতে বাধ্য হবেন কারণ এটি কোনো কল্পিত নাম নয়, তাঁর সত্যিকারের নাম। আর দ্বিতীয় হলো অধ্যবসায় - ওটি না থাকলে যেমন শরীররূপী জীবনেও জাগতিক নিরিখে সফল হতে পারতাম না, আধ্যাত্মিক জীবনেও সফল হতে পারবো না। জীবনে যদি কিছু পেতে হয়, লেগে থাকতেই হবে। জীবন যেন পদ্মফুলের পাপড়ির মতন - ধীরে ধীরে পরতে পরতে খোলে আর শেষে একটা গোটা ফুল হয়ে মায়ের পদপ্রান্তে নিবেদিত হয়।

সবার ওপর হলো দৈবকৃপা। স্থির বিশ্বাস - আমি ঠাকুরকে যেমন দেখছি, ঠাকুরও তেমনি আমায় দেখছেন। আমি যেমন ঠাকুরের জন্য হৃদয়ে সহস্র শতদলবিশিষ্ট পদ্মাসন পেতে রেখেছি, যার ওপরে তিনি ইষ্টরূপে উপবেশন করে আছেন, তেমনি তাঁর হৃদয়েও আমার জন্য জায়গা নির্ধারিত আছে। তিনি যখন কৃপা করে গুরুকে পাঠিয়ে তাঁর পূণ্যনাম আমার কান অবধি পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, সেই নাম যাতে আমি আত্মসাৎ করতে পারি, নিশ্চয় তাঁর সেই আশীর্বাদও অবশ্যই আমার ওপর আছে। তাঁর সবটুকু কৃপাতে আমার জন্মগত অধিকার এবং তা আমি আদায় করেই ছাড়বো, তাতে যত জন্মই লাগে লাগুক, কুছ পরোয়া নেহি। দৈবকৃপা ছাড়া মায়াকে উপেক্ষা করার আর কোনো উপায় নেই। আর মায়ার পাল্লায় পড়লেই সে আবার টেনে নিয়ে সেই খোসার ওপরেই ফেলবে - আবার সেই শরীর, আবার সেই নাম, আবার সেই ইন্দ্রিয়ের হাতছানি, আবার শুরু থেকে শুরু।