Blog Archive

Tuesday, December 26, 2023

শ্রীরাম ও বাম

শ্রীরামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা দিবসে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের দ্বারা সিপিএমের নেতাদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর পরাধীন পলিটব্যুরোর বিদেশি প্রভু-নির্দেশিত প্রেস বিবৃতিটি পড়লাম। যথারীতি, ভারতের কোটি কোটি মানুষের দানের অর্থে গড়ে ওঠা ভারতীয় অস্মিতার প্রতীক এই পুনর্নির্মিত মন্দিরটিকে সরকার এবং একটি বিশেষ দলের সাথে জুড়ে দিয়ে নিজেদের ধর্মবিরোধী এবং ভারতবিরোধী অবস্থানকেই তারা আবার ব্যক্ত করেছে, যা ১৯৬২ সালে চিনের ভারত আক্রমণের সময় চিনকে সমর্থন করার সময় থেকেই এই মতাবলম্বীরা দৃঢ়ভাবে পালন করে আসছে।

আসলে জরুরি অবস্থা জারি করে বিরোধী দলগুলির নেতাদের জেলে পুরে ভগ্ন সংসদে সম্পুর্ন অনৈতিকভাবে সংবিধানের মূলে আঘাত করে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যে দুটি শব্দ ঢুকিয়েছিলেন - সমাজবাদী আর পন্থনিরপেক্ষ, তাকেই নিজেদের স্বার্থে অতঃপর ছদ্মবামপন্থীরা ধর্মনিরপেক্ষ বলে সংজ্ঞায়িত করেছে। ইন্দিরার সংবিধানও কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে না, পন্থনিরপেক্ষতার কথা বলে - ধর্ম আর পন্থ সম্পূর্ণ আলাদা, যে পার্থক্যটা এই অশুভ শক্তির ইচ্ছে করেই গুলিয়ে দিতে চায়। এরা 'ধর্ম মানি না' বলে আসলে ধর্মাশ্রিত প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার একাত্মতার মূল ভিত্তিটিকে কেটে ফেলতে চেয়েছে, যাতে anarchy সৃষ্টি করে ভারতবিরোধী শক্তিদের উদ্দেশ্য সাধন করা যায়।

শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, মহাবীর, শ্রীচৈতন্য, গুরুনানক,  শ্রীরামকৃষ্ণ - এঁরা সমাজ জীবনে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে এসেছিলেন, সম্প্রদায় গড়তে নয় কারণ মানবিকতার ভিত্তিই ধর্ম। পরে ওঁদের কারো কারো অনুসারীরা আলাদা আলাদা সম্প্রদায় গড়ে তোলেন, সেটা অন্য বিষয়। যারা অমানবিক, পাপাচারী, দুর্জন তারাই অধার্মিক, ফলে ভারতের অন্যতম মুখ্য এবং পুরোধা ধর্মপ্রবর্তনকারীর স্মৃতিমন্দির নির্মাণের মাধ্যমে যখন বৃহত্তর সমাজ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে আবার হারিয়ে যাওয়া ধর্মবোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে, তখন তার বিরোধিতা কারা করছে সেটা মানুষের কাছে স্পষ্ট না হলে মানুষ বুঝবেন কিভাবে যে নেতৃত্বের নিরিখে সমাজের ধর্মবোধ রক্ষার স্বার্থে কাকে বর্জন আর কাকে আলিঙ্গন করতে হবে?

ব্যাক্তিগতভাবে আমি খুব খুশি হয়েছি যে অমন পবিত্র দিনে এই অপবিত্র মতাদর্শের ছায়া ওই পবিত্র স্থানে পড়বে না। আরো কিছু কলুষিত চরিত্র ট্রাস্টের আমন্ত্রণ অস্বীকার করলে আমি আরো খুশি হবো। ভারতের ভিত্তিই হলো ধর্ম। 'ভয়ম্ রতম্ ইতি ভারতম্' - 'ভ' অর্থাৎ আলোর খোঁজে যে রত, সেই ভারত। সেই আলো বেদান্তের আলো, অন্তরাত্মার আলো, ধর্মের আলো, সভ্যতার আলো, মর্য্যাদার আলো, মানবিকতার আলো, সদাচারের আলো। যে আলো ভারত থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, বহির্বিশ্ব থেকে ভারতে আসেনি। যারা তা মানে না এবং আলো ছেড়ে অন্ধকারের পেছনে দৌড়োয়, আলোর দিশারীর মন্দিরে তাদের কি কাজ?

Sunday, December 24, 2023

লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ

কলকাতার গীতা জয়ন্তী বলতে ছেলেবেলায় আমরা দক্ষিণ কলকাতার ট্রায়াংগুলার পার্কের এককোনে প্যান্ডেল করে সপ্তাহখানেক ধরে চলা গীতাপাঠ, কীর্তন, গান, প্রবচন ইত্যাদির কথাই জানতাম। খুব মেরেকেটে জনা পঞ্চাশ-ষাটেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সন্ধ্যাবেলায় বসে শুনতেন, দিনেরবেলায় খিচুড়ি ভোগ খাওয়ানোর সময় ছাড়া অতজন শ্রোতাও হতো না। কাপড়া যখন বহুবছর যতীন দাস রোডে ছিল, তখন ওই দিনগুলোতে মাঝেমাঝেই আমি ওখানে গীতাপাঠ বা কীর্তন ইত্যাদি শুনতে যেতাম।

আর আজ সেই অবহেলিত গীতা জয়ন্তীকে এক সম্পূর্ণ অন্য রূপ নিতে দেখলাম। কি উদ্দীপনা, কি involvement, কি ব্যাপ্তি ! বাঙালি যেন হটাৎ করে জেগে উঠেছে ! কেউ কেউ এতে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন, কেউ হিন্দু consolidation দেখছেন, কেউ বা সাম্প্রদায়িকতা খুঁজছেন, কেউ কেউ আরো এগিয়ে গিয়ে এরই মধ্যে প্রচুর টাকার বেসাতিও বুঝে ফেলেছেন। 

সে যার যেমন রুচি সেই মোতাবেক ভাবতেই পারেন কিন্তু আমি দেখছি এতদশকের বামপন্থী influence কাটিয়ে অবশেষে হিন্দু বাঙালির নিজের মূলকে খোঁজার শুরু হওয়া। নিন্দুকে আবার taunt করে জিজ্ঞেস করছে 'কজন বাঙালি ছিল?' আরে, আজ ময়দানে ১,৩৭,০০০ মানুষজন শতকরা ১০০% বাঙালিই ছিলেন রে মূর্খ, এই প্রদেশের যাঁরা বাসিন্দা তাঁরা সবাই তো বাঙালিই কারণ এই প্রদেশ তো আর ভাষার ভিত্তিতে তৈরি হয়নি, পন্থের ভিত্তিতে হয়েছিল। 

আর কি দেখলাম আমরা? বন্ধুবর সৈকত বসু দারুন বিশ্লেষণ করলেন।  আমরা দেখলাম discipline, যা নাকি বাঙালি হারিয়ে ফেলেছে। আর কি দেখলাম? ধর্মের পুনরুত্থানের জন্য বঙ্গের সমস্ত মঠ, মিশন, সাধু, sect সবাই এককথায় এক হয়ে যেতে পারেন - এর মাধ্যমে বাঙালি হিন্দুর জন্য এক অসীম সম্ভাবনার দরজা কিন্তু খুলে গেল। আর কি দেখলাম? The star power of Sri Krishna - একবার খবরটা ঠিক মতন ছড়িয়ে দিতে পারলেই হলো - কি রাম, কি কৃষ্ণ, কি শিব, কি কালী - এই level-এর আকর্ষণীশক্তি কোনো মেগা মাপের রাজনীতিবিদ বা ফিল্মস্টারেরও নেই। 

একজন দেখলাম লিখেছেন যে গীতা সবার জন্য নয়। একদম ভুলভাল কথা। একমাত্র গীতাই সবার জন্য। Infact পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো জাতির যে কোনো পন্থাবলম্বী যদি নিজের জীবনকে ধর্মপথে চালনা করতে চান তাহলে একমাত্র গীতাতেই তিনি তাঁর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেতে পারেন। গীতা সবার জন্য নয় বলে তাকে তুলে রাখলে হবে? পড়বে, তবে তো জানবে রে বাবা! আমি সাচ্চা সনাতনী হবো অথচ আমার guiding philosophical principlesই জানবো না, এ আবার কি কথা?

Thursday, December 21, 2023

কৃপা অর্থাৎ সদবুদ্ধি

যুদ্ধকাণ্ডে বানরসেনার হাতে রাবণের গুপ্তচরেরা ধরা পড়ার পর যখন সুগ্রীব তাদের হত্যা করার জন্য উদ্যত হলেন, তখন আর উপায়ন্তর না দেখে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে তারা প্রাণভিক্ষা করাতে কৃপানিধান সুগ্রীবকে আটকে দিয়ে বলছেন,
"সকৃদেব প্রপন্নায় তবাস্মীতি চ যাচতে ।
অভয়ং সর্বভূতেভ্যো দদাম্যেতদ্ ব্রতং মম ।।" (১৮/৩৩)
অর্থাৎ, যে একবার আমার শরণাগতি যাচনা করবে, তাকে সর্বভূতে অভয় প্রদান করা আমার ব্রত। এখন, শরণাগত হওয়া কি আর ঈশ্বরের কৃপা ব্যতীত সম্ভব? 

এইখানেই প্রশ্ন ওঠে ঈশ্বরের কৃপা বলতে আমরা কি বুঝি? তিনি কি নিজে চেক কেটে আমাদের ল্যাম্বরগিনি হুরাকান কিনে দেবেন নাকি আমাদের নিজেদের ধনসম্পদ আর সন্তান-সন্ততিদের প্রচুর রোজগার এবং তাদের মনের সব জাগতিক বাসনা মেটানোর বন্দোবস্ত করে দেবেন? লোকে চায় বটে, কার কাছেই বা আর চাইবে, কিন্তু এই ক্ষুদ্রবুদ্ধি যতক্ষণ আছে ততক্ষণ বুঝতে হবে ঈশ্বরের কৃপা হয়নি। তাঁর কৃপা হওয়া মানে তিনি সর্বদা এমন সদবুদ্ধি যোগাবেন যাতে জীবনে যে যে সময়ে ধর্মত যা যা করণীয়, তাই তাই করার মতন মানসিক স্থিতি নিজে থেকেই সৃষ্টি হয়ে যাবে। 

আমরা গৃহস্থরা যখন যে আশ্রমে আছি তখন ধর্মত সেই আশ্রমের জন্য যা যা নির্ধারিত কর্তব্য তা যদি ঠিক ঠিক নির্বাহ করতে পারি, সেটাই ঈশ্বরের কৃপা। যেমন, ব্রহ্মচর্যাশ্রম হলো জ্ঞান আহরণের সময় এবং তার ভিত্তিতে নিজের জীবনের মানক নির্ধারণ করার সময়। ঠাকুর বলতেন 'একটা খুঁটি ধরে ঘুরলে আর পড়বি না'। তখন সেদিকে concentrate না করে যদি আমরা পলিটিক্স ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকি, বুঝতে হবে আমাদের ভেতরের অসুর তখনো জেগে আছে। 

তেমনিই, যখন গার্হস্থ্যাশ্রমের সময় তখন বাপ-মা, স্ত্রী-পরিবার, আশ্রিত-পরিজনদের ভরণপোষণ করা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য যা যা একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির করণীয় এবং তার জন্য সৎপথে যতটা আয়, ব্যয় এবং সঞ্চয় করা প্রয়োজন তা না করে যদি ক্লাব, পার্টি, শুঁড়িখানায় হৈহৈ করে বেড়াই, যদি গৃহীচিত ব্রহ্মচর্য্য রক্ষা করতে না পারি অর্থাৎ বহুগামী হৈ, বুঝতে হবে যে ঈশ্বরের কৃপা পাওয়ার আমরা তখনও যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি। 

তারপর বানপ্রস্থের সময় যদি আমরা বিষয়-সম্পত্তি যশ-প্রতিপত্তি আর কর্তৃত্বের অহঙ্কার ত্যাগ না করতে পারি, যদি ৮০ বছর বয়সেও গায়ে গাউন চাপিয়ে কোর্টে গিয়ে জেনেশুনে দোষীর পক্ষে সওয়াল করি, তখন বুঝতে হবে এই শরীরে এবারে হয়তো আর কৃপালাভ হবে না। বানপ্রস্থের পরেই সন্ন্যাস - মানসিকভাবে ওটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। গৃহীর সন্ন্যাসাশ্রম আর সন্ন্যাসীর সন্ন্যাসের nature কিন্তু আলাদা কিছু নয়, কেবল দুটির মাঝখানে অনেক অনেক জন্মের শুভকর্মফলজনিত প্রারব্ধ, জন্মাবধি ঈশ্বরকৃপা আর কয়েক দশকের সাধনার ব্যবধান থাকে। 

পূজ্যপাদ স্বামী ঈশ্বাত্মানন্দজী মহারাজ তাঁর প্রবচনে বলেন ঈশ্বর মানে প্রেম আর নিঃস্বার্থতা। তাহলে নিশ্চয় সন্ন্যাস মানে 'আমি'কে ত্যাগ করে নিঃস্বার্থ হয়ে সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে যাওয়া। এই প্রেম জাগতিক প্রেম নয়, আত্মপ্রেম। এই মানুষরূপী শরীরের উদ্দেশ্যই হলো নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করতে চেষ্টা করা। সন্ন্যাসীর যেহেতু কোনো পিছটান থাকে না, পুরো সময়টাই এতে ব্যয় করা যায়, সেটা একটা মস্ত বড় সুবিধা। তাঁর সব কাজই নিরাসক্ত সেবা আর গৃহীর অধিকাংশ কাজই বাসনাপূর্তির অঙ্গ। 

গৃহস্থের জীবনে এই শেষ আশ্রমের চেয়ে শুভসময় আর কিছু নেই, মুক্তকচ্ছ হয়ে ঈশ্বরের কৃপা অনুভব করার এটাই তো শ্রেষ্ঠ সময়। শরীর হয়তো ক্রমশ অশক্ত হতে থাকবে কিন্তু সেই শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও ঈশ্বরের এই বার্তাই তো আছে যে এখন যা করছো তার memory তুমি পরের শরীরেও carry forward করবে আর ওটাই তখন তোমার প্রারব্ধ হয়ে যাবে। এই করতে করতেই একদিন কোনো না কোনো এক শরীরে তুমি সুস্থাবস্থায় কমবয়সেই সন্ন্যাসী হয়ে এই নশ্বর সংসারের মায়াকে ত্যাগ করবে আর তারপর তো it is just a matter of time, তোমার আত্মজ্ঞান হবেই হবে। 

পরিবারের কাছে ছোটবেলা থেকে ঠিক ঠিক সংস্কার পেলে এ পথে এগোনো খানিকটা সহজ হয় কারণ দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ কজনই বা আর হন? যখন কোনো শিশুর সংস্কারিত পরিবারে জন্ম হয়, সেটাই তার ওপর ঈশ্বরের প্রথম কৃপার নিদর্শন। তারপরের দায়িত্ব তার বাপ-মায়ের, তার গুরুর আর সবচেয়ে বেশি তার নিজের। মনে রাখা প্রয়োজন যে বেশিরভাগ মানুষকেই কিন্তু কৃপা অর্জন করতে হয়, মাত্র কয়েকজন অতি ভাগ্যবানই তা অহেতুকি পান - যেমন দীক্ষান্তে শিষ্য শ্রী ক্ষীরোদ মুখোপাধ্যায়কে শ্রীশ্রীমা কৃপা করেছিলেন, "আজ থেকে তােমার ইহকাল ও পরকালের পাপ গেল।" বাপরে !!

Saturday, December 16, 2023

মাতৃগুরু

শ্রীহনুমানচল্লিশা এক চমৎকারী স্তবমালা, সেটা যাঁরা মানেন তাঁরা জানেন। নানান পন্ডিত ব্যক্তি নানান দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর নানা রকমের ব্যাখ্যা করেছেন, ব্যক্তিগতভাবে তুলসীপিঠাধীশ্বর স্বামী রাম্ভদ্রাচার্য্যজী মহারাজের টিকা এবং চল্লিশার সংস্কারিত সংস্করণ আমার সবচেয়ে ভালো লাগে, যার মানে মোটেও এই নয় যে অন্যগুলি খারাপ। যাইহোক, যাঁরা শ্রীহনুমানচল্লিশা পাঠ করেন তাঁরা জানেন যে মঙ্গলাচারণের পরে এবং মূল স্তব শুরু করার আগে ভক্তশিরোমণি শ্রীতুলসীদাস গোস্বামীজী তাঁর শ্রীগুরুর চরণবন্দনা করে একটি প্রতিজ্ঞাবাক্য লিখেছিলেন,
শ্রীগুরু-চরণ-সরোজ-রজ    নিজ-মন-মুকুর সুধাহি
বরণওঁ রঘুবর-বিমল-যশ     যো দায়ক ফল চারি ।।
[শ্রীগুরুদেবের চরণকমলের পরাগরূপ ধূলি দিয়ে নিজের মনরূপ দর্পণকে পরিষ্কার করে (তাতে ফুটে ওঠা) রঘুকূলশ্রেষ্ঠ শ্রীরামচন্দ্রের উজ্জ্বল যশের বর্ণনা করছি, যা চারটি ফলই (ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) প্রদান করবে।]

স্বামীজী এই 'শ্রীগুরু' শব্দটির দুর্দান্ত ব্যাখ্যা করেছেন। ওনার কথাগুলোই আমি মূল হিন্দি থেকে নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী যথাসম্ভব বাংলায় ভাবানুবাদ করার চেষ্টা করছি। উনি লিখছেন যে গোস্বামীজী প্রতিজ্ঞাবাক্যে প্রথমেই 'শ্রী' শব্দটি আদিশক্তি শ্রীসীতাজীকে স্মরণ করে ব্যবহার করেছেন কারণ সীতাজী হলেন ব্রহ্মময়ী মহাশক্তি, স্বয়ং ব্রহ্মরূপী শ্রীরামচন্দ্রের বাম দিকে অবস্থান করে জীবের ভগবৎপ্রতিকূলতাকে নিরস্ত করেন। 'শ্রীগুরু' শব্দটির দুরকমের সমাস হয়:
১. মধ্যমপদলোপী তৃতীয়াততৎপুরুষ সমাস - শ্রীয়া অনুগৃহীতৌ গুরুঃ ইতি শ্রীগুরুঃ, অর্থাৎ শ্রীজীর (মহাশক্তির) অনুগ্রহপ্রাপ্ত গুরুদেব হলেন শ্রীগুরু। এর কারণ এই যে শক্তির কৃপা বিনা অবিদ্যার দোষ খন্ডন করা যায় না, ফলে যিনি সদগুরু, অর্থাৎ যাঁর অজ্ঞানতা দূর হয়েছে, তাঁর মধ্যে মহাশক্তির কৃপা প্রকাশিত। 
২. কর্মধারায় সমাস - শ্রীরেব গুরুঃ ইতি শ্রীগুরুঃ, অর্থাৎ শ্রীসীতাই হলেন গুরু। লক্ষণীয় যে শ্রীসম্প্রদায়ের জগৎবিখ্যাত সব আচার্য্যরা, যেমন শ্রীরামানুজাচার্য্যজী বা শ্রীরামানন্দাচার্য্যজীরা, শ্রীজীকেই পরমগুরু বলে স্বীকার করেছেন। এঁরা সীতাজীইকেই শ্রীহনুমানজীর আধ্যাত্মিক আচার্য্য মানেন, যে হনুমানজী কিনা আবার দেবগুরু বৃহস্পতিরও গুরু। তাই শ্রীহনুমানচল্লিশা যে শ্রীহনুমানজীর গুরুকে স্মরণ করে শুরু করা হয়েছে, এতে আশ্চর্যের তো কিছু নেই। 

আমরা গুরুপ্রণাম করতে গিয়ে বলি না, 'গুরুরেব পরং ব্রহ্ম', শ্রীরামকৃষ্ণদেব সেই তত্বটিই সহজ করে বুঝিয়ে বলেছেন, "ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে, শক্তিকে ছেড়ে ব্রহ্মকে ভাবা যায় না।…আদ্যাশক্তি লীলাময়ী, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, বহ্মই কালী। একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয় সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কোনও কাজ করছেন না– এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ।" শ্রীরামচন্দ্র আর শ্রীসীতামাতা একই, ঠিক যেমন পরবর্তী অবতারে শ্রীরামকৃষ্ণ আর শ্রীশ্রীমা এক এবং অভিন্ন। ঠাকুর নিজেই তো বলেছেন, "ও কি যে সে! ও আমার শক্তি!" তাইতো ঠাকুর ভাবস্থ অবস্থায় দক্ষিনেশ্বরের গঙ্গাতীরে দেখা শ্রীশ্রীসীতামায়ের হাতে পরা ছিলেকাটা বালা দেখে ওইরকমই বালাজোড়া শ্রীশ্রীমায়ের জন্যেও গড়িয়ে দিয়েছিলেন। জয় শ্রীগুরুমহারাজজী কি জয় ! জয় মহামায়ী কি জয় !

লক্ষণ

শ্রীরামচরিতমানসটি আবার পড়তে পড়তে কৌতূহলবসত মাঝে মাঝে মূল বাল্মীকি রামায়ণটিও আবার উল্টেপাল্টে দেখছি আর অন্যান্যবার যে সমস্ত শ্লোক নজর এড়িয়ে গিয়েছিল, সেগুলি এবার চোখে পড়ছে আর তাতে বিস্ময়ের অন্ত নেই। শ্রীরামের প্রতি ছোটভাই লক্ষণের শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা, আনুগত্য ইত্যাদির বিষয়ে তো আমরা সকলেই জানি, কিন্তু শ্রীরাম যে লক্ষণের মধ্যে নিজের পিতা মহারাজ দশরথের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে মানসিকভাবে তাঁর ওপর কতটা নির্ভর করতেন, সেটা কি আমরা লক্ষ্য করেছি? দুটি শ্লোক উল্লেখ করছি, একটি শ্রীরামের নিজের মুখের কথা আর একটি মা জানকির। 

অরণ্যকাণ্ডে একজায়গায় শ্রীরাম লক্ষণকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, "ভাবজ্ঞেন কৃতজ্ঞেন ধর্মজ্ঞেন চ লক্ষণ । ত্বয়া পুত্রেণ ধর্মাত্মা ন সংবৃতঃ পিতা মম ।।" অর্থাৎ হে লক্ষণ, তুমি ভাবজ্ঞ, কৃতজ্ঞ ও ধর্মজ্ঞ। আমাদের ধর্মাত্মা পিতার প্রতিমূর্তি হিসেবে তুমিই তাঁর স্থান গ্রহণ করেছ (অরণ্য ১৫/২৯)। লক্ষণ সম্পর্কে এই একই কথা আবার সুন্দরকাণ্ডে মা সীতাও হনুমানকে বলছেন "যং দৃষ্টা রাঘবো নৈব বৃত্তমার্যমনুস্মরেৎ" অর্থাৎ  যাঁকে দেখলে রাম আর পিতার অনুপস্থিতি অনুভব করেন না (সুন্দর ৩৮/৬১)। বনবাসকালে লক্ষণ যে ধীরে ধীরে শ্রীরামের পিতার স্থান, যাকে ইংরেজিতে বলে strength and stay, অধিকার করে নিয়েছেন, এটা যেমন বিস্ময়কর তেমনিই মধুর। আসলে লক্ষণ যে শ্রীরামচন্দ্রের জীবনে কতখানি জুড়ে ছিলেন তা মা সীতার একটি কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, "মত্তঃ প্রিয়তরো নিত্যং ভ্রাতারামস্য লক্ষণঃ", আমার চেয়েও ভ্রাতা লক্ষণ রামের বেশি প্রিয় (সুন্দর ৩৮/৬০)।

আর একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না, যদিও এর context সম্পূর্ণ আলাদা। রাম লক্ষণ আর সীতা বনে চলে যাওয়ার পর শোকে অধীর হয়ে মহারানী কৌশল্যা মহারাজ দশরথকে বহু কটুবাক্য শোনানোর পর যখন realise করেছেন যে পুত্রশোকে বিহ্বল হয়ে নিজের ধর্মপরায়ণ স্বামীকে যা বলার নয় তাও বলে ফেলেছেন, তখন আক্ষেপ করে বলছেন, "শোকো নাশয়তে ধৈর্যং শোকো নাশয়তে শ্রুতম্ । শোকো নাশয়তে সর্বং শোকসমো রিপুঃ ।।" অর্থাৎ শোক ধৈর্য নাশ করে, শোক শিক্ষা নাশ করে, শোক সমস্ত গুনাগুন নাশ করে, শোকের সমান শত্রু নেই (অযোধ্যা ৬২/১৫)। পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম যে এইখানে শোকের জায়গায় হিংসে, অহংকার, রাগ, ঘৃণা, দ্বেষ, স্বার্থপরতা, যা ইচ্ছে দুর্গুণ লাগানো যেতে পারে - মানুষের পক্ষে তার ফল একই রকমের বিনাশকারী হবে।

Saturday, December 9, 2023

গুরুকৃপা

কজ্জল কে ঘর মে যেতনা সিয়ানা রহে,
থোড়া বুঁদ লগে পর লগে, কাম জাগে পর জাগে।

সঙ্ঘগুরুরূপে যতদিন তিনি শরীরে ছিলেন ততদিন আমার পরমারাধ্য গুরুদেব আমার ইষ্টদেবের সচল বিগ্রহরূপেই পূজ্য ছিলেন, আর তাঁর মহাসমাধির পর ইষ্টপদে বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণে তাঁদের দুজনের সেই পার্থিব শারীরিক ব্যবধানটুকুও বহুদিন হলো মিটে গেছে। এখন যিনি আমার ইষ্ট তিনিই আমার গুরু, তিনিই সূক্ষ্মশরীরে ধ্যানগম্য হয়ে আমার হৃদয়ে প্রতিনিয়ত অবস্থান করছেন। আমি যখন প্রতিদিন 'জয় শ্রীগুরুমহারাজজি কি জয়' 'জয় মহামায়ী কি জয়' বলে জয়ঘোষ দিই, তখন গুরু আর ইষ্টকে এক এবং অভিন্ন জেনেই এই বাক্যগুলি বলি। এই জয়ঘোষ দেওয়ার সময় আমার বড় রোমাঞ্চ বোধ হয়, বড় ভালো লাগে।

তিনি কৃপা করে তাঁর শ্রীচরণে আশ্রয় দিয়েছিলেন বলেই না আজ তাঁকে নিজের ভেতর অনুভব করার চেষ্টা করতে পারছি, তা না হলে কোথায় তিনি এক সর্বজনপূজ্য সর্বত্যাগী ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ আর কোথায় আমি এক ঘোর সংসারী জীবনাশক্ত অর্বাচীন। তার ওপর, তাঁর শিক্ষা তো আর একমুখী কোনো বিশ্বাসতন্ত্রের নয়, ভারতের অন্তরাত্মায় নিহিত ঋষিদর্ষিত আত্মজ্ঞানের একটা গোটা আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার, যা ঠাকুরের হাত ধরে জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম আর রাজযোগের perfect synthesis বা পূর্ণাঙ্গ সংশ্লেষণরূপে এ যুগের উপযোগী হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আসলে বাবুরাম মহারাজের কথায়, ঠাকুর হলেন 'জীবন্ত উপনিষদ' - উনি একাধারে শ্রীকৃষ্ণের নিষ্কাম কর্ম, বুদ্ধদেবের ত্যাগ, আচার্য্য শঙ্করের জ্ঞান আর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমের ধারার সমাবেশক। 

এই যে আমার গুরুবাড়ি, যে মঠে আমার গুরুদেব সশরীরে থাকতেন, তা তো আর কেবল ইঁট কাঠ পাথরের গোটাকতক বাড়িঘর বা মন্দির নয়, একটা অনবদ্য অপ্রতিম প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে মধ্যমনি হয়ে মূলমন্দিরে আমার ইষ্টদেব স্বয়ং বসে আছেন, এখানেই গঙ্গাতীরে সঙ্ঘজননী জগজ্জননী মহামায়ার পূতপবিত্র মহাশক্তিপীঠরূপী মাতৃমন্দির আছে, আর আছে ঠাকুরের দুই প্রধান লীলাসহচরের দুটি সমাধিমন্দির, ঠাকুরের অধিকাংশ পার্ষদদের দাহক্ষেত্রের ওপর নির্মিত স্মৃতিসৌধ, সঙ্ঘাধ্যক্ষ ও সন্ন্যাসীদের দাহক্ষেত্র, এবং বিভিন্ন অফিস, মঠ বাড়ি, মিউজিয়াম, ভোজনশালা, অতিথিশালা ইত্যাদি। এই মঠের প্রতিটি ইঞ্চি ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষদের সান্নিধ্যধন্য এক দৈব বিচরণক্ষেত্র। বহু বহু উচ্চকোটির সন্ন্যাসীদের aura বা সাধনালব্ধ অলৌকিক আভামন্ডলের ধারকও এই মহাপূণ্যভূমি। বাবুরাম মহারাজ বেলুড় মঠ সম্পর্কে বলতেন 'এ তো বৈকুণ্ঠ'।

কিন্তু এসবের বাইরে এই প্রতিষ্ঠানের যেটি মূল সম্পদ সেটি হলো সনাতন ধর্ম, দর্শন এবং আধ্যাত্ম সম্পর্কিত বিশুদ্ধ জ্ঞানের এক অফুরন্ত প্রবাহমান ধারা। ঠাকুর মা স্বামীজী এবং ঠাকুরের পার্ষদ ও শ্রীশ্রীমা ও স্বামীজীর শিষ্যদের সম্মিলিত বাণী ও রচনায় তো তা প্রতিফলিত বটেই, পরবর্তীকালে যাঁরা সঙ্ঘগুরু হয়েছেন এবং যে সব মহাজ্ঞানী সন্ন্যাসীরা ঠাকুরের প্রদর্শিত পথে ভারতীয় আধ্যাত্মিক ভাবধারার সর্বসমাবেশী রূপটি নিয়ে চিন্তন মনন ও গ্রন্থন করেছেন, তাঁদের সকলের সম্মিলিত প্রজ্ঞার প্রকাশিত রূপ এই প্রতিষ্ঠানের সাহিত্যভান্ডার। ফলে রামকৃষ্ণ মিশন সনাতনী ধর্মজীবন এবং সনাতন সংস্কৃতির এমন একটি অমূল্য repository, যেটি অনবদ্য, সহজলভ্য এবং যে কেউ চাইলেই এর মধ্যে ডুব দিতে পারেন। 

দীক্ষান্তে গুরুদেব যখন প্রথম তাঁর দক্ষিণহস্তটি আশীর্বাদস্বরূপ আমার মাথার ওপর রেখেছিলেন, তখন আমার ১৪-১৫ বছর বয়স, সেই মুহূর্তে কোন দরজা যে আমার জন্য খুলে যাচ্ছে তা বোঝার মতন  বুদ্ধিই আমার ছিল না। স্বামীজীর অন্যতম প্রিয় বই The imitation of Christ এ একজায়গায় লেখা আছে, 'What canst thou see abroad which thou seest not at home? Behold the heaven and the earth and the elements, for out of these are all things made.' আমার চোখে তখন পার্থিব পৃথিবীটাকে উল্টেপাল্টে দেখার স্বপ্ন, পঞ্চতত্বীয় দর্শনের গভীরতার আমি কি বুঝবো? গুরুদেবের প্রতি ভক্তিতে ওনার শঙ্করভাষ্যের ব্যাখ্যাসহ একটি 'ব্রহ্মসূত্র' কিনে এনেছিলাম এবং একবর্ন বুঝতে না পেরে ভক্তিভরে তুলে রেখে দিয়েছিলাম। 

কিন্তু তাঁর কৃপা এমনই যে কৈশোর-আসন্ন যৌবনের অপুষ্ট মননকে উপেক্ষা করেই গুরুদেব সেদিন আমার হাতে একটা ঝাঁঝরি ধরিয়ে দিয়েছিলেন আর যে বীজ উনি কানের মধ্যে দিয়ে হৃদয়ে বপন করেছিলেন, আমার দায়িত্ব ছিল কেবল রোজ তার ওপর অল্প অল্প জল ঢালা, ওটুকুও আমি সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। এখন বুঝি কত অবুঝ ছিলাম। কিন্তু এমনই তাঁর অহেতুকি কৃপা যে আমায় কাজের কাজ কিছুই করতে হয়নি। বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম কখন হলো আমি জানিনা, তাতে কে বেড়া দিলেন আমি জানি না, ঝাঁজরির জল ফুরিয়ে যাওয়ার পরে তাতে নতুন করে জল কে ভরে দিলেন তাও আমি জানিনা, সে গাছ যে আমার অজ্ঞাতেই কবে বড় হয়ে আমারই মাথার ওপর ছাতা হয়ে দাঁড়ালো, তার কিছুই আমি জানিনা। 'আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল তিমিরনিবিড় রাতে।'

আমার গুরুদেব শ্রীশ্রীমায়ের আশ্রিত সন্তান ছিলেন, ফলে ছেলের মাধ্যমে জগজ্জননীর কোন আশীর্বাদ সেদিন এই অকিঞ্চনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল তার আমি কি জানি? আমি শুধু জানি যে যখন ঘুম ভাঙল তখন সেই গাছে ফুল ফুটেছে, আর বুকের মধ্যে কে যেন বলছে এবার কাজে লাগো মালি, একটু যত্নআত্তি করো, তবে না ফল ফলবে। স্বামীজীর সেই প্রিয় বইটির কথা যেন তাঁরই নির্দেশ হয়ে কানে বেজে উঠলো, 'Loose not, brother, thy loyal desire of progress to things spiritual. There is yet time, the hour is not passed. Why whilt thou put off thy resolution? Arise, begin this very moment, and say, "Now is the time to do: now is the time to fight, now is the proper time for amendment."

ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি গুরুকৃপা কোনো কথার কথা মাত্র নয়, ও সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করার চাবি। যত দিন যাচ্ছে তত বুঝতে পারছি গুরুর মাধ্যমে কিভাবে ইষ্ট কাজ করেন আর একবার তাঁর কৃপা হলে 'মুকং করতি বাচালং পঙ্গুং লংঘয়তে গিরিম্' - মুকও গড়গড় করে কথা বলে, পঙ্গুও পাহাড় ডিঙিয়ে যায়। খাওয়া ঘুম সব কমে গেছে, মনটা ধীরে ধীরে যেন কাদার মতন নরম হয়ে যাচ্ছে। বাইরের কুটিল জগতের সাথে লেনদেন, কোলাহল, বিষয়-আশয়, স্বার্থযুক্ত কাজ ইত্যাদিতে আর রুচি নেই, নেহাত সংসারের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষা করা গৃহস্থের কর্তব্য, তাই প্রয়োজনটুকুই কেবল সম্পন্ন করি। আমি যা শুনতে ভালোবাসি তার ধরণ বদলে গেছে, যা পড়তে ভালোবাসি, তার ধরণ পাল্টে গেছে আর যা দেখতে ভালোবাসি, তার ধরণও এখন ভিন্ন। আমি যে ক্রমশ বদলাচ্ছি, সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি।

পশু পাখি কীটপতঙ্গ সব যেন আপন বলে মনে হচ্ছে - কোন কুকুর বেড়াল কাঠবেড়ালি খেতে পেল না, কার চোট লাগলো, কে নির্দয়ভাবে গাছের ডাল কাটছে - ওদের যন্ত্রণা আমায় বড় পীড়া দেয়। আজকাল ফুল তুলতে দ্বিধা হয়, পোকাও মারতে পারিনা, বুকে বাজে। কাউকে অভুক্ত বা বিপদগ্রস্ত দেখলে চোখে জল আসে, মনে হয় কি করে একটু সেবা করতে পারি। আমি কি ছিলাম আর নিজেরই অজান্তে ইদানিং কি হয়েছি, ভাবলে নিজেই বড় বিস্মিত হই। মাঝেমাঝে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করে পরম কৃতজ্ঞচিত্তে দীনতার সাথে ঠাকুর আর মাকে কেবল এটুকুই বলি,
আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে।
তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর
তুমি তাই এসেছ নীচে।।

Friday, December 8, 2023

সমর্পণ

অর্পণ আর সমর্পণ শব্দদুটির মধ্যে একটাই নির্ণায়ক পার্থক্য বা defining difference - স উপসর্গটির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি। যদিও 'স' মানে 'সঙ্গে' যেমন সজোরে মানে জোরের সঙ্গে, কিন্তু এক্ষেত্রে উপসর্গটির ব্যবহার স্বয়ং অর্থে স্ব-এর মতন - অর্পণ মানে দেওয়া আর সমর্পণ মানে নিজেকে দেওয়া। কিভাবে সমর্পণ করা যায়? প্রথমে এই ধারণা বদ্ধমূল হওয়া দরকার যে আমি মালিক নই, 'পরের জায়গা পরের জমিন, ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো সেই ঘরের মালিক নই'। মহাভারতের শান্তিপর্বে ভীষ্ম একজায়গায় যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়ে বলছেন, 
"যচ্চ কামসুখং লোকে যচ্চ দিব্যং মহত্সুখম্৷
তৃষ্ণাক্ষয়সুখস্যৈতে নার্হতঃ ষোড়শীং কলাম্৷৷" অর্থাৎ, লৌকিক বাসনাপূর্তি বা অভ্যন্তর-শৌচ জনিত যে সুখ তা তৃষ্ণা ক্ষয় হওয়ার যে সুখ, সেই সুখের তুলনায় ষোল ভাগের এক ভাগও নয়। এখানে তৃষ্ণা মানে ভোগ-তৃষ্ণা। যতক্ষণ 'আমি' ভাব আছে ততক্ষণই ভোগের ইচ্ছা, যেই নিজেকে গুরু বা ইষ্টের হাতে অর্পণ করে দেওয়া গেল, অমনি 'আমি রথ, তুমি রথী, যেমন চালাও তেমনি চলি' হয়ে গেল, তখন 'তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে'।

এ কথা মুখে বলা যত সোজা, কাজে করে দেখানো ততটাই কঠিন কারণ মাঝখানে একটি দেহের সাথে সম্পৃক্ত পরিচয়সূচক 'আমি' সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে যে, যাকে অস্বীকার করা একটা দুরূহ ব্যাপার। অথচ না করলেও নয় কারণ ঠাকুরের পার্ষদ শ্রীশ্রীবাবুরাম মহারাজ একজায়গায় ভক্তদের বলছেন, "অহংকারের লেশমাত্র থাকলে বকলমা দেওয়া যায় না। ঠাকুর বলতেন এতে ঝরে এঁটো পাতার মতো থাকতে হয়। যেমন বিড়ালী তার ছা কে কখনো বড়লোকের বিছানায়, আবার কখনো বা ছাইয়ের গাদায় শুইয়ে রাখে। সুখে-দুঃখে যিনি বিচলিত না হয়ে তাঁতে মনোনিবেশ করে রাখতে পারেন, যিনি নিষ্ঠুর কর্তব্যের মধ্যেও বলতে পারেন 'ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি', তিনিই প্রকৃত বকলমা দিয়েছেন।" (কথাপ্রসঙ্গে স্বামী প্রেমানন্দ, পৃ ১২৯)

এখন, দেহ থাকলে দেহবোধ থাকাটাই তো স্বাভাবিক। দেহবোধ থাকবে অথচ দেহযুক্ত আমি-বোধ থাকবে না, এ বড় গোলমেলে ব্যাপার - a very evolved State - ও বেশিরভাগেরই কম্ম নয়। ওদিকে, বকলমা দিতে গেলে তো সেই 'আমি'কেই অর্পণ করতে হবে। 'আমি'র পারে যাওয়ার একটা পথ, বস্তুত জ্ঞানের পথ, মহামন্ডলেশ্বর স্বামী স্বরূপানন্দজি মহারাজ একজায়গায় দেখিয়েছেন,
'দেহ না থাকিলে তুমি আত্মার পরিচয় পাইতে না। দেহ আছে বলিয়াই তুমি অনুভব করিতে পারিতেছ যে, এই দেহের ভিতরে "তুমি" আছ। 
সেই "তুমি" দেখিতে কেমন, তাহা তুমি এখনও জান না। 
কিন্তু তুমি অনুমান করিতে সমর্থ হইতেছ যে, এই দেহকে যেমন সহজে দেখিতে পাওয়া যায়, দেহের ভিতরে "তুমি" নামে পরিচিত যিনি আছেন, তাঁহাকে তেমন সহজে দেখা যায় না, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেহ সসীম কিন্তু সেই "তুমি" অসীম। 
"তুমি" অসীম বলিয়াই তোমার শ্লাঘা, সম্মান, মর্য্যাদা এবং আত্মপ্রসাদ অসীম হইবে। 
তুমি তোমার জীবনের প্রতিটি পাদ-সঞ্চালনে, তোমার এই অসীমত্বের ধারণাটীকে সঙ্গে লইয়া চলিও।'
(প্রবুদ্ধ যৌবন, শ্রীশ্রীস্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব)

কিন্তু এর আরো একটা পথ আছে, যা অপেক্ষাকৃত সহজ, যা ভক্তির পথ এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকেই যার নির্যাস গ্রহণ করা যায় - মায়ের ওপর শিশুসন্তানের সম্পুর্ন নির্ভরতার পথ। বাবুরাম মহারাজ বলছেন, "মার কাছে ঠাকুর বকলমা দিয়ে দেহ ধারণ করেছিলেন" - কত বড় কথা! সমর্পণের এই পথ জ্ঞানের নয়, স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস আর অধিকারবোধের পথ। গর্ভধারিণী মা আর জগজ্জননী মায়ের মধ্যে মাতৃত্বের বহমান ধারাটি তো একই, তাই এতে একদিকে যেমন মায়ের আপত্যস্নেহ যা উঁচ-নিচ বিচার করে না, অন্যদিকে সন্তানের সম্পুর্ন নির্ভরতা - আমার অসুবিধে হলেই আমি ট্যাঁ করে কেঁদে উঠবো আর মা ছুটে এসে আমার দুঃখমোচন করবেন। এছাড়া মা আমাকে যখন যেভাবে মোড়ামুড়ি দিয়ে যেখানেই শুইয়ে রাখবেন, আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ওখানেই সম্পূর্ন সুরক্ষিত অবস্থায় শুয়ে থাকবো। 

কোনো বড় কাজ করার আগে মাকে একবার জানিয়ে রাখা, কোথাও বেরোনোর আগে মাকে বলে বেরোনো, কোনো অসুবিধে হলে মাকে স্মরণ করা, সারাদিনের শেষে মাকে একবার দিনলিপি জানিয়ে দেওয়া - এগুলো করতে তো কোনো অসুবিধা নেই, এতে নির্ভরতা বাড়ে। ওই যে মাকে "মা আসছি" বলে বেরোলাম, জানি পেছন থেকে মা "দুর্গা দুর্গা" বলছেন, আমি সুরক্ষিত। হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবো, মাকে আগে তার details জানিয়ে, pros and cons সব বলে অনুমতি চাইলাম - যদি দেখি নিজের মনের মধ্যে কোনো দ্বিধা উৎপন্ন হলো না, জানলাম মায়ের এতে সম্মতি আছে। যখন দিনের শেষে সারাদিনের কাজের ফিরিস্তি দিচ্ছি, তখন সব কাজ ধর্মত ঠিক ঠিক হয়েছে কিনা তার হিসেবও তো সাথে সাথে হয়ে যাচ্ছে - কোনো ভুল করে থাকলে তা সুধরোবার উপায়ও মায়ের ইচ্ছায় মনের মধ্যেই ভেসে উঠবে, ইত্যাদি।

মায়ের ওপর আমাদের নির্ভরতা কেমন হবে, বাঁদরের বাচ্চার মতন হবে যে মাকে নিজের চার হাত-পা দিয়ে সর্বক্ষণ আঁকড়ে ধরে থাকে নাকি বেড়ালের বাচ্চার মতন হবে যাকে ঘেঁটি ধরে মা যেখানে নিয়ে গিয়ে রাখে, সে সেখানেই পড়ে থাকে, তা আমাদের নিজেদের স্বভাবের ওপর নির্ভর করছে। ওই যে বাবুরাম মহারাজ পাণ্ডবগীতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন না, "ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি", রবীন্দ্রনাথ তার ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে:
'এ শ্লোকের মানে এমন নয় যে, আমি ধর্মেই থাকি আর অধর্মেই থাকি তুমি আমাকে যেমন চালাচ্ছ আমি তেমনি চলছি। এর ভাব এই যে, আমার প্রবৃত্তির উপরেই যদি আমি ভার দিই তবে সে আমাকে ধর্মের দিকে নিয়ে যায় না, অধর্ম থেকে নিরস্ত করে না ; তাই হে প্রভু, স্থির করেছি তোমাকেই আমি হৃদয়ে রাখব এবং তুমি আমাকে যেদিকে চালাবে সেই দিকে চলব। স্বার্থ আমাকে যেদিকে চালাতে চায় সেদিকে চলব না, অহংকার আমাকে যে পথ থেকে নিবৃত্ত করতে চায় আমি সে পথ থেকে নিবৃত্ত হব না। অতএব তাঁকে হৃদয়ের মধ্যে স্থাপিত করে তাঁর হাতে নিজের ভার সমর্পণ করা, প্রত্যহ আমাদের ইচ্ছাশক্তির এই একটিমাত্র সাধনা হোক।'

Thursday, December 7, 2023

বিধানসভায় বিজেপি

পশ্চিমবঙ্গের নেগেটিভ ধ্বংসাত্মক ব্যক্তিস্বার্থসর্বস্ব নীতিহীন রাজনীতি দেখে দেখে একসময় ক্লান্ত হয়ে গিয়ে নিজের ভূমিকার ওপর ঘেন্নায় আমি টিভিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছি, তাও বছর দুয়েক হয়ে গেল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি রাজনীতির ওপর আর নজর রাখি না। দেশের দশের খবর ঠিকই রাখি, তবে সেটা অবশ্যই চ্যানেলগুলোর অন্তঃসারশূন্য মারামারিসর্বস্ব টিভি ডিবেট দেখে নয়। 

যাইহোক, তিনটি রাজ্যে বিজেপির জয় নিয়ে এখানে অনেকেই দেখছি এটাকে সেমিফাইনাল ইত্যাদি বলে খুব লাফাচ্ছেন, যার মধ্যে সারবত্তা কিছুই নেই। বস্তুত এটা ভারতীয় মতদাতার প্রজ্ঞাকে অসম্মান করার সমান। ভারতে গণতন্ত্র এতটাই matured যে মতদাতা local body, legislature আর parliament-এর মধ্যে পার্থক্য খুব ভালো বোঝেন, তাঁদের যে স্তরে যে দলকে উপযোগী মনে হয়, সেই স্তরে তাকে ভোট দেন যেমন দিল্লির জনতা বিধানসভায় আম আদমি পার্টিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা দেওয়ার পরেই লোকসভার সাতটি আসনেই বিজেপিকে জেতান। 

এটা কেন সেমিফাইনাল নয়, সেই বিষয়ে ফিরে আসি। গতবার, অর্থাৎ ২০১৮তে এই তিনটি বিধানসভাতেই কংগ্রেস জিতেছিল আর তার ঠিক চার মাস পরে এই তিনটি রাজ্যের মিলিত ৬৫টি লোকসভা আসনে লড়ে কংগ্রেস জিততে পেয়েছিল মাত্র ৩টি আসন - ছত্তিশগড়ে ২টি, রাজস্থানে শূন্য এবং মধ্যপ্রদেশে ১টি - মনে পড়ে? এবারেও যদি বিজেপি এই তিনটি রাজ্যেই বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যেত তাতেও ২০২৪এর লোকসভার তাদের resultএ বিন্দুমাত্র আঁচ আসতো না, ওখানে শ্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই - অর্থাৎ দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনমানসে যে charisma আর হিমালয়সর্দিশ বিশ্বাসযোগ্যতা ওনার আছে, তার ধারেকাছেও অন্য কোনো নেতা নেই। 

এই যে বিশ্লেষকরা বলছেন না যে hidden Modi wave, তাঁরা বুঝতে পারেননি, আসলে কোনোকিছুই hidden নয়, সবটাই স্পষ্ট, কিন্তু এতটাই স্পষ্ট যে হয়তো নজর এড়িয়ে গেছে। আমিই তো কত সময় চোখে চশমাটা পরে ভুলে সেই চশমাই এখানে ওখানে খুঁজে বেড়াই। বহু মানুষ এখন মনে করতে শুরু করেছেন যে আমার রাজ্যের ক্ষেত্রেও এবার মোদিজি যে নেতৃত্বেকে choose করে বসাবেন, তিনিই রাজ্যটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবেন আর মানুষের এই আস্থা মোদিজি দেশের মুখিয়া হিসেবে তাঁর মন্ত্রীসভার performance এর ভিত্তিতেই অর্জন করেছেন। ভারতীয় মতদাতার বোধবুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও স্বাভিমানকে কখনো ছোট করে দেখবেন না। এদেশের গণতন্ত্র অত ঠুনকো নয়। 

নোট: আমার ভরসার দায়রা থেকে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা বাদ। এই দুটি প্রদেশের মানসিকতা আমি সত্যিই বুঝি না।

Wednesday, December 6, 2023

৬ই ডিসেম্বর

আমরা এমনই - খুবই গোঁয়ার। গোঁড়া নই কিন্তু, গোঁয়ার, অর্থাৎ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আপনি ১৭ বার সোমনাথের মন্দির ভাঙ্গুন, আমরা ১৭ বারই নতুন করে তৈরি করবো। আমরা তো আর রোমান না, আমরা হিন্দু। তাই আমাদের মন্দির আমরা reclaim করি, ওখানে আবার নতুন করে মূর্তি স্থাপনা করি, এপেলো বা ভেনাস বা মিনার্ভাদের পূজা করা ছেড়ে দিয়ে তাঁদের মিউজিয়ামে showpiece করে দাঁড় করিয়ে রাখি না। 

হিন্দু আর জাপানি শিন্তোরাই বোধহয় বিশ্বের দুটি মাত্র জীবন্ত মূর্তিউপাসক প্রাচীন সভ্যতা এবং সে জন্য আমরা ভীষণ গর্বিত। আমরা হিন্দুরা বিশ্বাস করি নুড়ি পাথর কাঠ কাটালি গাছ পালা ইঁদুর বাঁদর সব সেই একই ঈশ্বরের প্রতিরূপ, তাই তাঁরা সবাই শ্রদ্ধেয়, পূজ্য। আপনার সেই বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গি নেই, সেটা আপনার সমস্যা, আমাদের নয়। 

আবার বলছি, অজস্র বিধ্বংসী আক্রমণের পরও আমরা যে এত হাজার হাজার বছর ধরে বহাল তবিয়তে টিকে আছি, তার কারণ জাতি হিসেবে আমরা ভয়ানক গোঁয়ার। আপনি আমার সঙ্গে যত ইচ্ছে তর্ক করুন আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, কিন্তু যেই জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন সেটা আমি কিছুতেই মানবো না। আমি নিজে সেই বেড়া ভেঙে না ফেলতে পারলে আমার সন্তান সন্ততি কেউ না কেউ তা ভাঙবেই - সে আজ হোক বা পাঁচশ বছর পর - ভাঙবেই ভাঙবে।

এইভাবেই এমনই এক দিনে শ্রীরামজন্মভূমিকে ধ্বংস করে যে ধাঁচা মঙ্গোলরা গড়েছিল, তাকে করসেবকরা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন। সেই শৌর্যদিবসের পূণ্যদিনে মোঘলদের সঠিক নামে ডাকা শুরু হোক - মঙ্গোল। এই দানব আক্রমণকারীগুলো এসেছিল তুর্কমেনিস্থান-মঙ্গোলিয়া থেকে, ঠিক যেমন ইংরেজরা এসেছিল ইংল্যান্ড থেকে। দুটোই বিদেশি শক্তি, দুজনেরই উদ্দেশ্য এক ছিল - আমাদের গোলাম বানিয়ে আমাদের সম্পদ লুটে নেওয়া। খাঁড়ার ওপর বিষফোঁড়া, ওরা কেবল লুটেই সন্তুষ্ট ছিল না, আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নষ্ট করার খেলাতেও মেতে উঠেছিল। 

এই দস্যু মঙ্গোলগুলো আমাদের হাজার হাজার মন্দির ভেঙেছে, ভারতীয়দের জোর করে বা লোভ দেখিয়ে পন্থ পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে, এত অত্যাচার করেছে যে সারা উত্তরভারত জুড়ে মানুষ বাড়িতে ঠাকুরঘর তৈরি করে মন্দিরকে replace করতে বাধ্য হয়েছে, পূর্বভারতে দিনের আলোয় মেয়ের বিয়ে দেওয়াই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। 

যে সংস্কৃতিতে কন্যার সয়ম্বর হতো, সেই সমাজকে শিশুঅবস্থায় কন্যাকে গৌরীদান করতে এই লুটেররাই বাধ্য করেছে। ইংরেজও কিছু কম অত্যাচার করেনি, পাদ্রীদের মাধ্যমে ইংরিজি আর ভুলভাল ইতিহাস শিখিয়ে আর conversion করে করে আমাদের সমাজের ভিতকে নাড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। আমাদের নিজস্বতা claim back করার সময় এসে গেছে। যে যা, তাকে সেই নামে ডাকা দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হোক। আর তার জন্য আজকের চেয়ে শুভ দিন আর কি হতে পারে?

Monday, December 4, 2023

বিজেপিকেই চাই

ইদানিং ভারত যে দ্রুতগতিতে আবার এক উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার রাস্তায় এগিয়ে চলেছে, তার কারণ কি? কেউ হয়তো বলবেন মোদি কিন্তু আরো একটু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এটা আবহমান কাল ধরে চলে আসা হিন্দুর আত্মপরিচয়কে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, জনসঙ্ঘ এবং পরে বিজেপি মিলে পুনরুদ্ধার করে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করানোর ফল। 

এর মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকের বদবুদ্ধির ফসল caste census-এর মাধ্যমে ভারতীয়দের ওপর চাপিয়ে দেওয়া জাতপাতের বিভাজনকে হাতিয়ার করে একটা অতি উন্নত সভ্য জাতিকে দাবিয়ে রাখার যে ষড়যন্ত্র এখনো অবধি চলে আসছে, তার মূলে আঘাত করা হয়েছে। গত দশ বছরে বিজেপি পূর্ণ বহুমতের সরকার গড়তে সক্ষম হওয়ার ফলে এখন জাতপাত, প্রাদেশিক পরিচয় ইত্যাদির ওপরে উঠে অন্তত উত্তরভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে 'আমি হিন্দু' - এই ধারণাটি বেশ জেঁকে বসেছে, যা সমাজের একসাথে একইদিকে এগোনোর জন্য দারুন সহায়ক হচ্ছে, ফলে উন্নতিও দ্রুততর হচ্ছে। 

দেশে বিজেপির শাসন যত বেশিদিন বলবৎ থাকবে, একটা overall হিন্দুত্বের আবহ থাকার ফলে তত বেশি দিন বাকি হিন্দু সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনগুলিও তৃণমূলস্তরে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করতে পারবে এবং এই cultural integration আর common identity-র বন্ধন, যাকে 'সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদ' বলা হয়, তা ধীরে ধীরে প্ৰথমে দ্রাবিড় রাজনীতির ভুয়ো বিভাজনের শিকার দক্ষিণ ভারতে এবং পরে সংখ্যালঘুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। 

নিদেনপক্ষে আরো কুড়ি বছর ভারতে বিজেপির একচ্ছত্র শাসন চাই, তারপরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। তিনশ বছরের অপশাসন, অবনমন, অতিক্রমণ এবং বিভাজনের প্রক্রিয়াকে reverse করতে অন্তত ত্রিশ বছর তো চাই, নাকি? দিশা যেহেতু স্পষ্ট আর একত্রিত হওয়ার ফলও যেখানে হাতে হাতে পাওয়া যাচ্ছে, বহু মানুষ এবার আসল আর নকলের ফারাক বুঝতে পারছেন। এই 'বহু'টা একদিন 'সবাই' হবে। যেদিন হবে সেদিন ভারতবর্ষ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।

Friday, December 1, 2023

ভিক্ষা নৈব নৈব চ

যদি গৃহস্থ হন তাহলে কোনো তীর্থক্ষেত্রে কখনো কারো দান নেবেন না। ধরুন বৃন্দাবনে পরিক্রমা করছেন, দেখলেন হয়তো কেউ হালুয়া বিলোচ্ছেন, নমস্কার করে এগিয়ে যাবেন, মোটেও হাত পাতবেন না। একইভাবে, কোনো মঠে, মন্দিরে, মিশনে বিনা দান দিয়ে কখনো প্রসাদ গ্রহণ করবেন না বা থাকবেন না। অন্নসত্ৰ সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের জন্য, আমাদের জন্য নয়। গৃহস্থ ভিক্ষান্নের অধিকারী নন, ওই ব্যবস্থা কেবলমাত্র সন্ন্যাসীর জন্য, যা সমাজের ধর্মীয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাই সন্ন্যাসীকে খালি হাতে প্রণাম করতে নেই, সামর্থ অনুযায়ী কিছু না কিছু দিতে হয়। আর গৃহস্থ যদি অন্যের দান নিয়ে তীর্থযাত্রা করেন তাহলে তার পূণ্যফল সেই দানীর হয়, গৃহস্থের নয়। সন্ন্যাসীর সাথে আমরা গৃহস্থরা যেন কখনো নিজেদের গুলিয়ে না ফেলি। বেদে চারটি অত্যন্ত মূল্যবান মন্ত্র আছে, যা যে কোনো গৃহস্থের পক্ষে জীবনযাপনের মানক:

১. বিষয়মুখত্যাগং বা সমাজং প্রতি যৎ কর্তব্যম্ । 
তৎ ত্যাগং নৈব ত্যাগমীশ্বর প্রােণিতম্ 
কামপাশ - বিমােচনবিতি ত্যাগমীশ্বরসম্মতম । 
অর্থাৎ, দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করা ও সামাজিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি ঈশ্বরের অভিপ্রেত নয়। তিনি শুধু চান যে জীব বাসনা-কামনার পাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করুক।

২. প্রাণরক্ষার্থমাবশ্যকীয় দ্রব্যজাতস্য ভােগং ন তু পাপম্ । 
শরীরং স্বাস্থ্যরক্ষণং সবৈদ কর্তব্যং ধর্মসাধনার্থম্ । 
তেন বৈ বৰ্ততে প্রােজ্জ্বলঃ প্রজাপ্রদীপঃ সাধ্যতে চাধকৃৎ প্রতিরােধম্ । 
অর্থাৎ, জীবনের প্রয়ােজনসমূহ সাধন করা পাপ নয়, শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা কর্তব্য, নচেৎ জ্ঞানের প্রদীপ প্রজ্বলিত রাখা সম্ভব নয়, দুবৃর্তকে প্রতিহত করাও সম্ভব হয় না। 

৩. কামী ইন্দ্রিয়দাসােআস্তি কামভােগলালসা নীচত্বং নয়তি 
নিষ্ঠ জগতি পদ্মপত্রমিবাংভসা । এতদ্বৈ ঈশ্বরানুশাসনম্ । 
অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়াসক্ত ব্যক্তিরা প্রবৃত্তির দাস। ইন্দ্রিয় সুখের সন্ধান মানুষকে হীন করে। ঈশ্বরের বিধান মানুষকে পদ্মের পাপড়ির মতাে হতে হবে, জলের দ্বারা পরিবৃত হয়েও যে সিক্ত হয় না। 

৪. আস্তে ভগ আসীনস্য - চরৈবেতি চরৈবেতি 
চরণ্ বৈ মধু বিন্দতি চরন্ স্বাদু উদুম্বরম্ । 
পশ্য সূর্যস্য শ্ৰেমাণং যাে ন তন্দ্রয়তে চরণ্  
চরৈবেতি চরৈবেতি চরৈবেতি । 
অর্থাৎ, অকর্মন্য ব্যক্তির জন্য ঈশ্বর কপালে দুঃখ লিখে দেন। সুতরাং অক্লান্ত কর্মে ব্যাপৃত হও। অরণ্যে রােদন করলে মধু পাওয়া যায়। মধু আহরণের জন্য পরিশ্রম করতে হয়। দেখ সূর্য সারাক্ষণ এগিয়ে যাওয়ার ব্রত নিয়েছেন, কখনাে আলস্য করেন না, তাই সূর্য চিরযৌবনময়। ঈশ্বরে ভরসা রেখে কর্মকান্ডে এগিয়ে চলো, তাতেই সৌভাগ্যের দ্বার খুলবে।

Saturday, November 25, 2023

বৃক্ষেই প্রত্যক্ষ

বৃক্ষেই প্রত্যক্ষ

নর্মদার তীরে অখন্ড নিরাহার অবস্থায় দাদাগুরু নামক এক যোগী মহাত্মা আছেন, ইউটিউবে ওঁর একটি অনবদ্য বাণী শুনলাম, "बृक्ष ही प्रत्यक्ष है", অর্থাৎ বৃক্ষই (তাঁর) প্রত্যক্ষ রূপ। যখন থেকে শুনেছি তখন থেকে মনের মধ্যে ক্রমাগত বাক্যটি ঘুরে চলেছে আর যত ভাবছি তত ধীরে ধীরে এর গুঢ়ার্থ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। কত রকমের angle যে এই ছোট্ট কথাটার মধ্যে আছে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। এ যেন সেই উপনিষদীয় মহাবাক্যের মতো - codified - যত ছাড়াবে তত ভেতরের শাঁস বেরোবে। ওই মধ্যপ্রদেশেই একজন স্বামী চিদানন্দ মহারাজ আছেন, উনি আবার বৃক্ষকেই প্রত্যক্ষ শিব বলেন (वृक्ष ही प्रत्यक्ष शिव हैं, जो कार्बन डाइऑक्साइड रूपी विष को ग्रहण कर हमें अमृत रूपी ऑक्सीजन दान देते हैं) কারণ বৃক্ষ কার্বনডাইঅক্সাইডরূপী বিষ নিজে গ্রহণ করে আমাদের অক্সিজেনরূপী প্রাণবায়ু প্রদান করে। 

আমার মনে পড়ছে আসানসোলে বাবার সরকারি বাংলোর গেটে ঢোকার মুখে বাঁ ধারে একটা অর্জুন গাছ ছিল। অর্জুন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ঋজু শব্দ থেকে। ঋজু মানে একদিকে যেমন সোজা, straight, আবার অন্যদিকে সরল। কারো সরল স্বভাব মানে কিন্তু তাঁর সংস্কার অতি উচ্চমানের, এ এক দারুন strength। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের অর্জুনকে বলছেন দেহাভিমান জয় করতে হলে শরীর, মন ও বাণী সরল হতে হবে, প্যাঁচঘোঁচ থাকলে চলবে না বাপু। আমাদের সেই অর্জুন গাছটি ছিল সরলতার প্রতিমূর্তি - কেউ তার বাকল ছিঁড়ে নিয়ে যেত বেটে খোশ পাঁচড়ায় লাগাবে বলে, কেউ তার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যেত ফুটিয়ে কত্থটি আমাশয়ের ওষুধ হিসেবে খাবে বলে, পারলে কেউ তার কান্ডটাও হয়তো কেটে নিয়ে যেত গরুর গাড়ির চাকা বানাবে বলে, ভাগ্যক্রমে আমরা থাকাকালীন সেটা আর সম্ভব হয়নি। কাউকে কোনোদিন ওর গোড়ায় জল বা সার কিছুই দিতে দেখিনি - ও গাছ কেবল দিত, নিত না কিছুই। 

আসলে আমাদের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে বৃক্ষ বারবার ফিরে এসেছে ত্যাগের প্রতীক হয়ে। পুরাণে যে কল্পতরুর কথা বলা আছে, সেই বৃক্ষের কাছে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। তাই যেদিন কাশীপুর বাগানবাড়িতে একটি বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেব ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরুরূপে ধরা দিয়ে বলেছিলেন, "আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হোক", সেইদিনটি কল্পতরু দিবস হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় হলো ঠাকুরের শরীর চলে গেছে কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে সেই বৃক্ষটি কিন্তু আজও রয়ে গেছে - মানুষ ওখানে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে। একইভাবে রয়ে গেছে কামারপুকুরে ঠাকুরের নিজের হাতে পোঁতা আমের আ‌ঁটির গাছ, ঠাকুরের স্মৃতি হিসেবে যার একটি পাতা আমাদের বাড়িতেও সংরক্ষিত আছে। এই বৃক্ষগুলিকে দেখলে ঠাকুরের কথা মনে পড়ে - ওরা যেন ঠাকুরেরই extension, তাঁরই লীলাসঙ্গী।

একই কথা বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বুদ্ধদেবের সময়কার সেই অশ্বথ গাছটি আর বেঁচে নেই, কিন্তু বুদ্ধদেবের সেই লীলাসঙ্গীর সন্তান সন্ততিরা ছড়িয়ে রয়েছে সারা বিশ্বজুড়ে। সাধনকালে বোধিবৃক্ষ বুদ্ধদেবকে ছায়া প্রদান করেছিল বলে পরে তিনি ওই বোধিবৃক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। এখনও ভক্তদের মনে বুদ্ধদেবের স্মৃতিকে নতুন করে জাগরিত করতে প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে বোধিবৃক্ষের উপস্থিতি একান্তই আবশ্যক। এমনকি সম্রাট অশোক তার পুত্র মহেন্দ্র ও তার কন্যা সংঘমিত্রাকে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে সিংহলে পাঠানোর সময় ওই বোধিবৃক্ষের চারাই সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। এখনো শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধরা পবিত্র বোধিবৃক্ষের শাখাতেই পরলোকগত জ্ঞাতিবর্গের উদ্দেশে শ্বেতবর্ণের কাপড়ের তৈরি স্তম্ভক আকৃতির অর্ঘ টাঙিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।

দেখছি শান্তিনিকেতনে দশম সাম্বৎসরিক ব্রহ্মোৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তৃতায় সবটা কেমন সুন্দরভাবে মিলিয়ে দিচ্ছেন। আচার্য্য বলছেন, "বৃক্ষে যে ফল থাকে সে ফল হইতে রস আকর্ষণ করিয়া পরিপক্ব হইয়া উঠে। যতই সে পরিপক্ব হইতে থাকে ততই বৃক্ষের সহিত তাহার বৃন্তবন্ধন শিথিল হইয়া আসে, অবশেষে তাহার অভ্যন্তরস্থ বীজ সুপরিণত হইয়া উঠিলে বৃক্ষ হইতে সে সহজেই বিচ্ছিন্ন হইয়া বীজকে সার্থক করিয়া তোলে। আমরাও সংসারবৃক্ষ হইতে সেইরূপ বিচিত্র রস আকর্ষণ করি-- মনে হইতে পারে তাহাতে সংসারের সহিত আমাদের সম্বন্ধ ক্রমেই দৃঢ় হইবে-- কিন্তু তাহা নহে, আত্মার যথার্থ পরিণতি হইলে বন্ধন আপনি শিথিল হইয়া আসে। ফলের সহিত আমাদের প্রভেদ এই যে, আত্মা সচেতন; রস নির্ব্বাচন ও আকর্ষণ বহুল পরিমাণে আমাদের স্বায়ত্ত। 

"আত্মার পরিণতির প্রতি লক্ষ করিয়া বিচারপূর্ব্বক সংসার হইতে রস গ্রহণ ও বর্জ্জন করিতে পারিলেই সংসারের উদ্দেশ্য সফল হয় এবং সেই সঙ্গে আত্মার সফলতা সম্পন্ন হইলে সংসারের কল্যাণবন্ধন সহজেই শিথিল হইয়া আসে। অতএব ঈশ্বরের দ্বারা সমস্ত আচ্ছন্ন জানিয়া সংসারকে তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা, তাঁহার দত্ত সুখসমৃদ্ধির দ্বারা ভোগ করিবে-- সংসারকে শেষ পরিণাম বলিয়া ভোগ করিতে চেষ্টা করিবে না। অপর পক্ষে সংসারের বৃন্তবন্ধন বলপূর্ব্বক বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহার মঙ্গলরস হইতে আত্মাকে বঞ্চিত করিবে না । ঈশ্বর এই সংসারবৃক্ষের সহস্র তন্তুর মধ্য দিয়া আমাদের আত্মার কল্যাণরস প্রেরণ করেন; এই জীবধারয়িতা বিপুল বনস্পতি হইতে দম্ভভরে পৃথক্‌ হইয়া নিজের রস নিজে যোগাইবার ক্ষমতা নাই।"

বিভিন্ন আধ্যাত্মিক আলোচনায় 'দেহবৃক্ষ' শব্দটিরও একটি বিশেষ মাহাত্ম আছে, অর্থাৎ দেহকে বৃক্ষের সাথে তুলনা করে একটা বৌদ্ধিক allegory টানা হয় - বৃক্ষের ক্ষেত্রে যেমন জাইলেমের মাধ্যমে জল ও খনিজ পোষণ মাটির নিচ থেকে ওপরে পাতা অবধি ওঠে, তেমনি দেহের মূলাধারে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা কুলকুন্ডলিনী যোগক্রিয়ার মাধ্যমে ব্রহ্মতালুতে অর্থাৎ সহস্ররারে গিয়ে পৌঁছয়। অন্যভাবেও, মানবদেহকে নানা মতাবলম্বীরা নানাভাবে বৃক্ষের সাথে তুলনা করেছেন - সেই গোবিন্দ দাসের কড়চায় আছে না,
এই বিশ্ব ঢাকিয়াছে পাপ অন্ধকারে ।
হরি ভিন্ন কিছু সত্য নাহিক সংসারে ।।
পাখি দুটি দেহবৃক্ষ যেদিন ছাড়িবে ।
সেদিন জড় দেহ পড়িয়া রহিবে ।।

তখন শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে আছেন, সেদিন শুক্রবার বেলা ৫টা, চৈত্র শুক্লা পঞ্চমী। ৯ই এপ্রিল, ১৮৮৬। ঠাকুর বলছেন,
"হৃষীকেশের সাধু এসেছিল। সে (আমাকে) বললে, কি আশ্চর্য! তোমাতে পাঁচপ্রকার সমাধি দেখলাম!
"কখন কপিবৎ — দেহবৃক্ষে বানরের ন্যায় মহাবায়ু যেন এ-ডাল থেকে ও-ডালে একেবারে লাফ দিয়ে উঠে, আর সমাধি হয়।
"কখন মীনবৎ — মাছ যেমন জলের ভিতরে সড়াৎ সড়াৎ করে যায় আর সুখে বেড়ায়, তেমনি মহাবায়ু দেহের ভিতর চলতে থাকে আর সমাধি হয়।
"কখন বা পক্ষীবৎ — দেহবৃক্ষে পাখির ন্যায় কখনও এডালে কখনও ও-ডালে।
"কখন পিপীলিকাবৎ — মহাবায়ু পিঁপড়ের মতো একটু একটু করে ভিতরে উঠতে থাকে, তারপর সহস্রারে বায়ু উঠলে সমাধি হয়। 
"কখন বা তির্যক্‌বৎ — অর্থাৎ মাহবায়ুর গতি সর্পের ন্যায় আঁকা-ব্যাঁকা; তারপর সহস্রারে গিয়ে সমাধি।”

শেষ করছি আমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে প্রত্যক্ষ ব্রহ্মরূপী বৃক্ষের কি স্থান, প্রাচীন text থেকে তার উদাহরণ দিয়ে। নিশ্চয় জানা আছে যে অত্যন্ত প্রয়োজনে কোনো জীবিত বৃক্ষকে কাটার আগে তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে তার প্রাণ বিসর্জনের রীতি এখনো এ দেশে প্রচলিত আছে। তিনটি মাত্র উদ্ধৃতি দেবো, আমাদের সভ্যতার অন্তরাত্মাকে বোঝার জন্য তাই যথেষ্ট:
১. যদি কোন দরিদ্র ব্যক্তি একটিমাত্র গাছও রোপণ করেন তবে তিনি ব্রহ্মসদনে যাবার অধিকার অর্জন করেন এবং তার তৃতীয় পুরুষ পর্যন্ত সেই ফল ভোগ করে। (ব্রহ্মনারদীয় পুরাণ, ১৩/৫২)
২. উদ্ভিদাদি রোপণ ও পরিচর্যা করলে ভূমিদান ও গোদানের সমতুল্য পুণ্য অর্জিত হয়। (বরাহপুরাণ, ১৭২/৩৫)
৩. যদি কেউ স্বীয় রন্ধনের উদ্দেশ্যে জ্বালানির জন্য অপরিপক্ক বৃক্ষ ভূপাতিত করে তবে তাকে চরম পতিত বলে গণ্য করা হবে। (মনুস্মৃতি, ১১/৬৬)

Wednesday, November 22, 2023

অন্তরতর



রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে ও কবিতায় একাধিকবার 'অন্তরতর' শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যেমন 'অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে, নির্মল করো উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে' অথবা 'কে গো অন্তরতর সে, আমার চেতনা আমার বেদনা তারি সুগভীর পরশে' ইত্যাদি। লক্ষ্য করে দেখেছি যখনই রবীন্দ্রনাথ এই শব্দটি ব্যবহার করে গান বেঁধেছেন, অধিকাংশ সময়ই হয় ইমন নয় ঝিঁঝোটী নয় ভৈরবী রাগের ওপর নির্ভর করেছেন অর্থাৎ যথাক্রমে রাত্রির প্রথম প্রহর, দ্বিতীয় প্রহর ও দিনের প্রথম প্রহরের রাগ, সবকটিই ধ্যানের পক্ষে একেবারে আদর্শ সময়। এখন প্রশ্ন হলো অন্তর মানেই তো ভিতর, তাহলে বিশেষ করে 'অন্তরতর' (যার অর্থও ভিতর) শব্দটি ব্যবহার করার প্রয়োজন কি এবং যদি innermost বলতে হতো তাহলে অন্তরতম কেন ব্যবহৃত হলো না? 

আসলে বিশেষণ হিসেবে অন্তরের অর্থ 'অপর' হলেও, বিশেষ্য হিসেবে অন্তর মানে কিন্তু 'মন' বা 'হৃদয়'। ওদিকে আবার হরিচরণ বন্ধ্যোপাধ্যায় বলছেন বাংলা অন্তরের মূলে হলো সংস্কৃত ‘অনন্তর’, অব্যয় পদ, যার অর্থ 'তাহার পর' বা 'অতঃপর'। ন + ব্যয় = অব্যয় - যার পরিবর্তন বা ব্যয় হয় না, অর্থাৎ যা অপরিবর্তনীয় তাই অব্যয়, এই পদটির বিশেষত্বও এখানে বিবেচ্য। আমার ধারণা এখানে রবীন্দ্রনাথ অন্তর বলতে প্রচলিত অর্থে 'মন'কে এবং অন্তরতর বলতে 'মনের পারে' অর্থাৎ মনের দ্রষ্টাকে বুঝিয়েছেন। মনের যিনি দ্রষ্টা, যিনি তুরীয়, যাঁর বিনাশ নেই, বিন্যাসও নেই, যিনি অপরিবর্তনীয়, তিনিই রবীন্দ্রনাথের অব্যয় পদধর্মী 'অন্তরতর'। 

অন্যদিকে, বাংলা ভাষায় 'অন্তরতম' শব্দটি সাধারণত 'প্রিয়তম' বা 'ঘনিষ্টতম' অর্থে ব্যবহার করা হয়, অর্থাৎ এই শব্দটির মূলে একটা দ্বৈতভাব আছে - আমার প্রিয়তম, অর্থাৎ আমি আর আমার প্রিয়তম দুটি ভিন্ন স্বত্তা। এক্ষেত্রে মনেরও একটা বড় ভূমিকা আছে - মন যাকে সবচেয়ে বেশি প্রিয় মনে করে, তিনিই অন্তরতম। অন্তরতর কিন্তু মনের পারে - তিনি স্থির, নিশ্চল, তিনি খালি মনের গতিবিধি লক্ষ্য করে চলেছেন কিন্তু লিপ্ত হচ্ছেন না। তিনি আত্মা, অবিনশ্বর। তিনি একম্ সৎ, বিপ্রঃ বহুধা বদন্তি, যা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক ব্রাহ্ম মতাবলম্বী রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের সাথেও সম্পূর্ণরূপে সম্পৃক্ত। 

শাস্ত্রের সাথে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে অদ্বৈত বেদান্তের আকর গ্রন্থ দৃগ্-দৃশ্য-বিবেকে ভারতীতীর্থস্বামী প্রথম শ্লোকে এঁর সম্পর্কেই বলেছেন, 
रूपं दृश्यं लोचनं दृक् तद्दृश्यं दृक्तु मानसम् । 
दृश्या धीवृत्तयः साक्षी दृगेव न तु दृश्यते ॥ १॥ 
দেখছে যে চোখ , হচ্ছে সে 'দৃক', যা দেখি তাই 'দৃশ্য',
আবার চোখ কে দেখে মন যখন - চক্ষু সেথায় দৃশ্য ।
আবার মন আর মনের ভাবনাগুলি 'আত্মা' তাদের দেখে,
সে আত্মা দৃশ্য তো নয় - 'দৃক্' কহি মোরা যাকে ।।
রবীন্দ্রনাথ তো বোধি, বোধের উচ্চতম শিখরে তাঁর অবস্থান। তাঁর কাছে আত্মা আর পরমাত্মা এক এবং অবিচ্ছেদ্য। তাই কবি যখন অন্তরাত্মার কাছে প্রার্থনায় নত, তখন তিনি অবলীলায় গেয়ে ওঠেন,
"হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর,
এ জীবনে যা-কিছু সুন্দর
সকলি আজ বেজে উঠুক সুরে
প্রভু, তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে।"

এমন কথা এত সহজে কি আর সবাই বলতে পারেন? আমরা কজনই বা আর অন্তর পেরিয়ে অন্তরতরকে প্রাত্যহিক যাপনে অনুভব করতে পারি? যদি পারতাম তাহলে আমাদের আত্মকথনও হয়তো এমনতর হতো:
"সোনালি রুপালি সবুজে সুনীলে      
সে এমন মায়া কেমনে গাঁথিলে--
তারি সে আড়ালে চরণ বাড়ালে, ডুবালে সে সুধাসরসে।
কত দিন আসে কত যুগ যায়,      
গোপনে গোপনে পরান ভুলায়,
নানা পরিচয়ে নানা নাম ল'য়ে নিতি নিতি রস বরষে॥"

আত্মপ্রত্যয় নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপলব্ধি বর্ণনা করে লিখছেন, 'আমরা সামজকে যে এক বলে জানি সেই জানবার ভিত্তি হচ্ছে আমাদের আত্মা-- মানবকে এক বলে জানি, সেই জানার ভিত্তি হচ্ছে এই আত্মা-- বিশ্বকে যে এক বলে জানি তারও ভিত্তি হচ্ছে এই আত্মা এবং পরমাত্মাকে যে অদ্বৈতম্‌ বলে জানি তারও ভিত্তি হচ্ছে এই আত্মা। এইজন্যই উপনিষৎ বলেন, সাধক-- আত্মন্যেবাত্মানং পশ্যতি-- আত্মাতেই পরমাত্মাকে দেখেন। কারণ, আত্মাতে যে ঐক্য আছে সেই ঐক্যই পরম ঐক্যকে খোঁজে এবং পরম ঐক্যকে পায়। যে জ্ঞান তার নিজের ঐক্যকে আশ্রয় করে আত্মজ্ঞান হয়ে আছে সেই জ্ঞানই পরমাত্মার পরম জ্ঞানের মধ্যে চরম আশ্রয় পায়। 

'এইজন্যই পরমাত্মাকে "একাত্মপ্রত্যয়সারং" বলা হয়েছে। অর্থাৎ নিজের প্রতি আত্মার যে একটি সহজ প্রত্যয় আছে সেই প্রত্যয়েরই সার হচ্ছেন তিনি। আমাদের আত্মা যে স্বভাবতই নিজেকে এক বলে জানে, সেই এক জানারই সার হচ্ছে পরম এককে জানা। তেমনি আমাদের যে একটি আত্মপ্রেম আছে, আত্মাতে আত্মার আনন্দ, এই আনন্দই হচ্ছে মানবাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি, বিশ্বাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি, পরমাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি। অর্থাৎ এই আত্মপ্রেমেরই পরিপূর্ণতম সত্যতম বিকাশ হচ্ছে পরমাত্মার প্রতি প্রেম-- সেই ভূমানন্দেই আত্মার আনন্দের পরিণতি। আমাদের আত্মপ্রেমের চরম সেই পরমাত্মায় আনন্দ। তদেতৎ প্রেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োহন্যস্মাৎ সর্বস্মাৎ অন্তরতর যদয়মাত্মা।'

এটা পড়ার পর মনে হয়েছে যে আমি যেভাবে রবীন্দ্রনাথের দ্বারা অন্তরতর শব্দটির ব্যবহারকে বুঝেছি, সেটা বোধহয় ঠিকই আছে। এ বিষয়ে অন্য রবীন্দ্রানুরাগীদের মধ্যে যদি কেউ ভিন্ন মত পোষণ করেন, দয়া করে জানাবেন - সমৃদ্ধ হবো। সত্যি কথা বলতে কি, ওনাকে বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের জন্য একটাই কথা প্রযোজ্য:
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না। 
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা ॥

Tuesday, November 21, 2023

শিক্ষা, বিদ্যা ও জ্ঞান



যিনি অনেক পড়েছেন এবং জেনেছেন, বিদেশে সাধারণত তাঁকেই জ্ঞানী বলা হয়। ইংরেজ আমল থেকে বিদেশি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে আমাদের দেশেও বিদ্বজনদের জগতে বিদ্যার মানদণ্ড হিসেবে প্রাথমিকভাবে ডিগ্রিকেই ধরে নেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ যাঁর যত বেশি ডিগ্রি তিনি তত বেশি শিক্ষিত এবং যিনি যত বেশি শিক্ষিত তিনি তত বেশি জ্ঞানী। আমরা সনাতনীরা বাপু এর উল্টোটাই জেনে এসেছি। যিনি নিজেকে জানেন তিনি জ্ঞানী, বাকি সব অজ্ঞানী, তা তাঁদের প্রথাগত বা পুঁথিগত বিদ্যা যতই থাক না কেন। আমাদের বোধে বিদ্যা আর জ্ঞান এক নয়। বস্তুত, সংস্কৃতে বিদ্যার মূলে হল 'বিদ্' ধাতু, যার অর্থ 'বিবেচনা করা'। যেখানে বিবেচনা করে গ্রহণ বা বর্জন করার সুযোগ নেই, সে আর যাই হোক, বিদ্যা নয়।

মূলত জ্ঞানমার্গ বলতে সনাতন সংস্কৃতিতে যা আমরা বুঝি তা শাস্ত্রীয় সূত্রগুলিকে চুলচেরা বিচার ও বিশ্লেষণ করে আত্মজ্ঞান অর্জন করার ছয়টি মার্গ বা ছয়টি দর্শনের অধ্যয়নকে নির্দেশ করে - ন্যায়, যোগ, বৈশেষিক, সাংখ্য, পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা। যেমন আজকাল ডাক্তাররা theory of elimination মেনে একগাদা টেস্ট লিখে দেন না, অনেকটা সেরকম। হয়তো সর্দি কাশি জ্বর হয়েছে, চেস্ট এক্সরে লিখে দিলেন, তারপর রিপোর্ট দেখে নিশ্চিন্ত হলেন যে যাক বাবা, নিউমোনিয়া হয়নি। অর্থাৎ যাবৎ কিছু আছে সবকিছু ভালো করে দেখে নাও, বুঝে নাও, তারপর একে একে 'এটা নয়' 'এটা নয়' করতে করতে একেবারে মূল জায়গায় পৌঁছে যাও। তারপর হলো theory of affirmation - clinically যে ব্যামো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে কেবল সেটারই পরীক্ষা করে রেসাল্ট দেখে নিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া যে 'আমিই সেই' - ঠাকুর একে বলতেন 'বিজ্ঞান'। 

আসলে বিদেশি জাগতিক জ্ঞান আরোহণের প্রয়াসকে সনাতনী অখন্ড বা অদ্বৈতজ্ঞানের অন্বেষণের দিকে ঘোরানোর জন্য গোটাকতক ব্যক্তিগত গুণের প্রয়োজন হয় যেমন বিবেক, শমদমাদি (আত্মশাসন), উপরতি (নিবৃত্তি), তিতিক্ষা (ধৈর্য্যশীলতা), সমাধি (মনের একীকরণ), শ্রদ্ধা, বিরাগ (ঔদাসীন্য) ও মুমুক্ষুত্ব (মোক্ষলাভের ইচ্ছা)। আর এই অন্বেষণের তিনটি stage আছে - প্রথমে শ্রবণ (শোনা বা পড়া), তারপর মনন (যুক্তি-বুদ্ধিদ্বারা বিশ্লেষণ) ও শেষে নিদিধ্যাসন (নিরন্তর ধ্যান)। এটা অনেকটা কোনো যুগান্তকারী বিজ্ঞানীর দীর্ঘদিনের intense গবেষণার মতো - খোঁজ খোঁজ খোঁজ, এটা নিয়ে পরীক্ষা, ওটা নিয়ে পরীক্ষা, বছরের পর বছর ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে শেষে হটাৎ একদিন কাঙ্খিত বস্তুটিকে আবিষ্কার - ইউরেকা! তবে আত্মোপলব্ধি সকলের জন্য নয়, ফলে সেখানে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে ঠাকুরের lesson plan মেনে চললেই হবে। 

শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষাদান পদ্ধতির দুটি বিশেষত্ব হলো অধিকারীভেদ এবং রুচিভেদ। "কি জানো রুচিভেদ, আর যার যা পেটে সয়। তিনি নানা ধর্ম নানা মত করেছেন, আর যার যা পেটে সয়। তিনি নানা ধর্ম নানা মত করেছেন অধিকারী বিশেষের জন্য। সকলে ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী নয়। তাই আবার তিনি সাকার পূজার ব্যবস্থা করেছেন। মা ছেলেদের জন্য বাড়িতে মাছ এনেছে। সেই মাছ ঝোল, অম্বল, ভাজা আবার পোলাও করলেন। সকলের পেটে কিন্তু পোলাও সয় না। তাই কারও কারও জন্য মাছের ঝোল করেছেন তারা পেট রোগা। আবার কারও সাধ অম্বল খায়, বা মাছ ভাজা খায়। প্রকৃতি আলাদা - আবার অধিকারীভেদ।" (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ৩য় খণ্ড, ৯ম অধ্যায়, ৫ম পরিচ্ছেদ)

ফিরে যাওয়া যাক বিদেশি education বা শিক্ষার বিষয়ে, যাকে বিদেশিরা বিদ্যা বলেই মনে করেন। এনক্লাইকোপেডিয়া ব্রিটানিকায় educationকে সংজ্ঞায়িত করে বলা হচ্ছে, 'Education: discipline that is concerned with methods of teaching and learning in schools or school-like environments as opposed to various nonformal and informal means of socialization. Education can be thought of as the transmission of the values and accumulated knowledge of a society.' এর ঠিক বিপরীতমেরুতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয় (পল্লীপ্রকৃতি, পল্লীর উন্নতি)। বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হলো social being তৈরি করা আর সনাতনী বিদ্যাভাসের উদ্দেশ্য হলো জিজ্ঞাসু তৈরি করা - আমি আসলে কে, কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাবো ইত্যাদি, দুটোর approach-এ বিস্তর ফারাক।

আধুনিক মনীষীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা নিয়ে যত ফলিত প্রয়োগ করেছেন, সেই অভিজ্ঞতার বলে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার অসারতাকে বুঝে কবি তাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বলছেন, 'যে-কাঁচাবয়সে মন অজ্ঞাতসারে আপনার খাদ্য শোষণ করিতে পারে, তখনই সে জ্ঞান ও ভাবকে আপনার রক্তমাংসের সহিত পূর্ণভাবে মিশাইয়া নিজেকে সজীব সবল সক্ষম করিয়া তোলে। সেই সময়টাই আমাদের মাঠে মারা যায়। সে-মাঠ শস্যশূন্য অনুর্বর নীরস মাঠ। সেই মাঠে আমাদের বুদ্ধি ও স্বাস্থ্য কত যে মরিয়াছে তাহার হিসাব কে রাখে' (প্রবন্ধ 'শিক্ষা-সংস্কার')। রোগশয্যায় শুয়ে ঠাকুর বলেছিলেন, "নরেন শিক্ষে দিবে। যখন ঘরে বাইরে হাঁক দিবে"। ঈশ্বরে অবিশ্বাসী নরেন্দ্রনাথ বহুদিন শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে অতিবাহিত করার পরে উপলব্ধি করেছিলেন যে ঈশ্বর তাঁর নিজের মধ্যেই অবস্থান করছেন। 

স্বামীজী সেই পরমজ্ঞানের শিক্ষাই জগৎকে দিয়েছিলেন বটে, যা আসলে সনাতন ভারতের চিরন্তন শিক্ষা। সিংহবিক্রমে একেবারে বিশ্ববাসীর ঘাড় ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "মানুষ পাপী নয়, মানুষ দেবতা", বলেছিলেন, "প্রত্যেকের মধ্যে অন্তর্নিহিত দেবত্ব রয়েছে ও তাকে প্রকাশ করাই জীবনের লক্ষ্য", "সমস্ত শক্তি তোমার মধ্যেই আছে, তুমি যা চাইবে তাই করতে পারবে", "যে নিজেকে বিশ্বাস করে না সেই নাস্তিক", বলেছিলেন, "ওঠো, জাগো এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে থেমো না"। আমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে একেই প্রকৃত শিক্ষা বলে। যে উপনিষদীয় শিক্ষা আমরা স্কুলে পাইনি, আমি চাই এখনকার ও ভবিষ্যতের প্রজন্ম সেই শিক্ষা পাক। অন্তত ভারতের বিদ্যালয়গুলিতে ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান গণিত কম্পিউটার ইত্যাদির সাথে সাথে এটাও পড়ানো হোক যে every man is potentially Divine - নইলে social being তৈরি হলেও, eternal being হিসেবে তার মানসিক উত্তরণ ঘটবে কি করে?

Wednesday, November 15, 2023

প্রারব্ধ

গতকাল ইউটিউবে দেখলাম বৃন্দাবনে শ্রীরাধা কেলিকুঞ্জে বাবা প্রেমানন্দ মহারাজের কাছে এক মা তাঁর ক্যান্সার রোগগ্রস্ত শিশুকে নিয়ে এসেছেন। বাবা অনেকভাবে সেই দুঃখিনী মাকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলেন এবং শেষে ভেবে দেখতে বললেন যে এ তো শিশু, এর তো কোনো কর্মফল জমা হয়নি, তাহলে একে কেন এত ভুগতে হচ্ছে? তারপর নিজেই এর উত্তর দিলেন, "इसकी शरीर नवीन है पर ईसके अंदर जो प्राणी है वे प्राचीन है, ये व प्राणी का प्रारब्ध है" - এর শরীর নবীন কিন্তু এর ভেতরে যে প্রাণী আছে সে প্রাচীন, এটা সেই প্রাণীটির প্রারব্ধ। আরো বললেন, যে কোনো কাজ করার আগে ভেবে দেখতে হয় ধর্মত ঠিক পথে আছি কিনা নাহলে ধর্মভ্রষ্ট হওয়ার ফল কোনো এক শরীরকে তো ভুগতেই হবে। আসলে রোজই চোখের সামনে এই সত্যটি ঘটতে দেখি কিন্তু হয়তো তার মর্মকে উপলব্ধি করতে পারিনা। কত রাস্তার কুকুরকে দেখি খেতে পায়না, পা খোঁড়া, গায়ে ঘা, লোকের লাথি ঝাঁটা খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে, আবার কোনো কোনো কুকুরকে দেখি গাড়ি চড়ে গড়ের মাঠে হওয়া খেতে যাচ্ছে, সকাল সন্ধ্যে আদর খাচ্ছে, নিয়মিত স্নান করিয়ে সুগন্ধ মাখিয়ে গ্রূমিং করা হচ্ছে, এসিতে ঘুমাচ্ছে - দেখি কিন্তু কারই বা মনে হয় যে কুকুরের তো আর মানুষের মতন পাপ করার ক্ষমতা নেই, তাহলে ওদের মধ্যে এই বৈষম্য কেন?
Now, verily, a man consists of will. As he wills in this world, so does he become when he has departed hence. Let him [with this knowledge in mind] form his will. (3.14.1 Chandogya Upanishad)

Sunday, November 12, 2023

আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ

সংস্কৃতে 'মন্ত্র' শব্দের অর্থ হলো 'আহ্বান করা'। আমরা পূজার সময় মন্ত্র পড়ি, অর্থাৎ দেবতাকে আহ্বান করি। এই মন্ত্র শব্দে যখন আলাদা আলাদা উপসর্গ অর্থাৎ prefix লাগে যেমন 'আ' অথবা 'নি', তখন দুটি আলাদা শব্দ তৈরি হয় - আমন্ত্রণ এবং নিমন্ত্রণ, যাদের আমরা সমার্থক বলেই মনে করি। আসলে কিন্তু তা নয়। 'আ' হচ্ছে আকর্ষণসূচক - to attract - কর্ষণ মানে টানা আর আকর্ষণ মানে নিজের দিকে টানা। তাহলে আমন্ত্রণ মানে হোলো কাউকে নিজের বাড়িতে অথবা নিজস্ব কোনো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আহ্বান করা। ওদিকে 'নি' মানে 'খুব বড়' যেমন নিকুঞ্জ মানে খুব বড় লতাগৃহ। তাহলে নিমন্ত্রণ মানে হলো খুব জমকালো কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে কাউকে আহ্বান করা, যেমন বিয়েতে নিমন্ত্রণ বা নেমন্তন্ন করা হয় কারণ বেশ জমজমাট ব্যাপার, দুটি প্রাণের মিলন, প্রচুর লোকজন, খাওয়া দাওয়া, হুল্লোড়,  হৈহৈ ব্যাপার একেবারে। এই দুটি শব্দই যেহেতু সরাসরি সংস্কৃত থেকে এসেছে, অর্থাৎ তৎসম শব্দ, তাই এদের ব্যবহার সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী সঠিক হওয়াই শ্রেয়। এক জায়গা থেকে একটি 'আমন্ত্রণ পত্র' এসেছে। পড়েই মনে হলো উদ্যোক্তাদের ডেকে বলি এটা সর্বজনীন সামাজিক অনুষ্ঠান, এক্ষেত্রে 'নিমন্ত্রণ পত্র' হবে। তারপর ভাবলাম, থাক। বাঙালি সবই তো ভুলে গেছে, ভাষাটাই বা আর বাকি থাকে কেন।

Friday, November 10, 2023

শরীরের পারে

আমি শরীর নামক একটা জামা পরে আছি যার বাহ্যিক রূপটি পুরুষের। এটা স্ত্রীরও হতে পারতো, কুকুর বেড়াল কীট পতঙ্গ গাছ উদ্ভিদ যা কিছুরই হতে পারতো যেমন একই কাপড়ের থান থেকে হাফ শার্ট ফুল শার্ট পাঞ্জাবি ফতুয়া যা ইচ্ছে বানানো যেতে পারে। আর আমার এই পুরুষ শরীরটির সাথে কয়েকটি attributes জুড়ে আছে - যে পরিবারে ও দেশে আমার জন্ম, তাদের কিছু বিশেষত্ব জুড়ে আছে, এই শরীরকে কেন্দ্র করে যে সম্পর্কের বলয় তৈরি হয়েছে, তার টান জুড়ে আছে, শিক্ষকদের ও গুরুর মার্গদর্শন ও আশীর্বাদ জুড়ে আছে এবং যাপন করতে করতে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, তার প্রভাব জুড়ে আছে। 

সেই সাথে ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, কর্মফল, অহঙ্কার ইত্যাদি নানারকমের ব্যাপার তো আছেই, যারা জামার বোতাম খুলতে চাইলেই প্রলয় নাচন নাচতে শুরু করে দেয়। সব মিলিয়ে এই শরীরকে কেন্দ্র করে অর্থাৎ বাইরের জামাটাকে ঘিরে আমার একটা পরিচয় তৈরি হয়েছে যার ভিত্তিতে লোকে আমায় অমুক বলে চেনে। ওটা অনেকটা ওইরকমই - জিন্স আর টি-শার্ট পরে রাস্তায় বেরোলে মডার্ন আর ধুতি পাঞ্জাবি পরে বোরোলে সেকেলে - judging a book by it's cover আরকি। সেই জামাটা কিন্তু আমি নই।

আসলে এই শরীরের কাজ খুবই নির্দিষ্ট এবং সীমিত, আমরা বোধহয় তাকে অতিরিক্ত বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। উদাহরণস্বরূপ খাবার। আপনি করোলা সেদ্ধই খান বা জনাইএর মনোহরা - পরদিন সকালে দুটোরই পরিণতি কিন্তু এক। ওদিকে আপনি লাখ টাকা পাউন্ডের দামি দার্জিলিং চাইই খান বা গুমটির দশ টাকার কাটিং চা, কয়েকঘন্টা পর সেই তো বর্জ্যপদার্থ হিসেবে বেরিয়েই যায়। শরীরও সেইরকম - টাটা বিড়লা যেই হও না কেন, শেষে পঞ্চভূতে বিলীন। এখানেই বিপত্তি - যা ক্ষণস্থায়ী তার জন্য মারামারি আর যা চিরকালীন তার পাত্তা নেই। নাম-রূপে ফেঁসে আছি, স্বরূপের আর জানি কি? 

প্রকৃতির নিয়মেই এই শরীরজাত যে সন্তান, তাদের প্রতি যে attachment, সেও এক বিড়ম্বনা। সন্তান সুখে থাকলে আমি সুখী, সন্তান দুঃখে থাকলে আমি দুখী, আর সন্তান সমস্যায় পড়লে আমি দুর্ভাবনায় একশেষ - অথচ আমার এই শরীর না থাকলে তাদের বর্তমান বাহ্যিক রূপের কোনো অস্তিত্বই থাকতো না। তাদের এবং আমার প্রারব্ধই আমার এই শরীরের সাথে তাদের জুড়ে দিয়েছে, প্রারব্ধ অন্যরকম হলে তারা অন্যশরীর পেত। অথচ যবে এই শরীরগুলো থাকবে না, তখনও বাপ-ছেলের সম্পর্ক থাকবে কারণ মাঝখানে সামাজিক স্বীকৃতি নামক একটি অশরীরী বস্তু দাঁড়িয়ে আছে - কি অদ্ভুত না? 

যত নিজেকে নিজেরই বাহ্যিক রূপের খপ্পর থেকে উদ্ধার করে অন্তরে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছি, তত দেখছি মায়া তার সর্বশক্তি দিয়ে resistance গড়ে তুলছেন - কেমন কেমন করে জানি এই শরীর এবং তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলিকে দিয়ে মনকে মাঝেমাঝেই ভয়ঙ্কর বিক্ষিপ্ত করে তুলছেন। আর এই টানাপোড়েনে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ছে ওই শরীরের ওপরেই, মজাটা এখানে। অনেকদিন হয়ে গেল এই খেলা চলছে, আমি এখনো দশ গোল খেয়ে পিছিয়ে আছি, কিন্তু খেলা ছেড়ে মোটেও পালাচ্ছি না। 

রবীন্দ্রনাথ 'মায়ার খেলা' গীতিনাট্যে মায়াকুমারীগণকে দিয়ে বলিয়েছিলেন না, ওটাই আসল কথা:
"মনের মতো কারে খুঁজে মর,
সে কি আছে ভুবনে,
সে তো রয়েছে মনে।
ওগো, মনের মতো সেই তো হবে,
তুমি শুভক্ষণে যাহার পানে চাও।"
চাতক পাখির মতন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছি সেই শুভক্ষণের প্রতীক্ষায় যেদিন জননী কৃপা করে মনের গোপন দরজাটা খুলে দেবেন। সেদিন হয়তো আয়নার সামনে দাঁড়ালেও এই জামাটা আর তেমনভাবে চোখে পড়বে না।

Thursday, November 2, 2023

সনাতনের ভবিষ্যত

একদিকে আব্রাহামীয় বা কম্যুনিস্টদের 'একটাই জীবন - খাও পিও ঔর মৌজ করো', যাকে one life consumption model বলে আর অন্যদিকে ভারতের সেই সনাতন ঋষিবাক্য 'শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা' - বিশ্ববাসী, তুমি অমৃতের পুত্র, তুমি মৃত্যুহীন - বহু শতাব্দী জুড়ে বৌদ্ধিকস্তরে এই দুই বিপরীতমেরুর দ্বন্ধ চলছে তো চলছেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যখন এক জীবনে বিশ্বাসী অসনাতনীরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যেকার একাংশের মতের প্রভুত্ব অন্যদের ওপর কায়েম করতে চায়, তখন এই দ্বন্ধ চরম সংঘাতে পর্য্যবসিত হয় এবং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কিছুসময়ের জন্য তা আবার ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে এবং ব্যাপক লোকক্ষয়ের কারণ হবে। সবের মূলে কিন্তু জীবনে চলার পথে শুভ আর অশুভের মধ্যে থেকে অনেক সংখ্যক মানুষের অশুভকে বরণ করে নেওয়া। বেশিদূর যেতে হবে না, এই তো সেদিন ১৯৬৬-৭৬ চিনে cultural revolution হলো, ঈশ্বরই জানেন আসলে কত মানুষ সেই পাগলামোতে প্রাণ খোয়ালেন। 

ঠিক তার আগেই ১৯৬২তে চিন কেন ভারত আক্রমণ করেছিল জানেন? রকমারি থিওরি শোনা যায় বটে কিন্তু আসল কারণ হলো তার আগের ২০০০ বছর ধরে চিনারা ভারতীয় আধ্যাত্মিক জ্ঞানতন্ত্র এবং মন্দির বাস্তুতন্ত্রের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত ছিলেন যে মাও জে দংকে সেই মানসিক অবকাঠামো ভাঙতে হলে আগে ভারতকে চিনবাসীর চোখে হেয় প্রতিপন্ন করতে হতো - তিনি ঠিক সেটাই করেছিলেন। চিনারা মানসিকভাবে এমনই যে ও দেশে যদি রাস্তায় কেউ কাউকে bully করে, যে bully হয় লোকে উল্টে তাকেই ঘিরে ধরে দুয়ো দেয়, কমজোরের প্রতি সহানুভূতি চিনাদের রক্তে নেই, ওঁরা শক্তের ভক্ত। আর এই গাজোয়ারী মানসিকতাকেই মাও চার বছর পরে কম্যুনিজম কায়েম করার কাজে ভরপুর লাগিয়েছিলেন। 

সেদিন পড়লাম কে যেন লিখেছেন যে এখনকার চিনারা ভারতীয়দের নাকি হীনদৃষ্টিতে দেখেন কারণ ১০০০ বছর ধরে আমরা নিজেরাই নিজেদের জাতভাইদের পরের গোলামী মেনে নিতে বাধ্য করেছি। কতজনই বা ইংরেজ থাকতো ভারতবর্ষে, ভারতীয় চাকরদের দিয়েই তো তারা এত কোটি ভারতীয়দের ওপর দুশো বছর ধরে শাসন চালিয়ে গেল। মুঘল আমলেও তাই। ব্যাপারটা পড়ে আমার মনে হলো কেউ কি চিনাদের জিজ্ঞেস করবেন যে এই যে cultural revolutionএর নামে কোটি কোটি চিনার গলা কেটে নামিয়ে দেওয়া হলো - কে কাটলো রে ভাই? নিজেরাই নিজেদের কাটলেন তো, তাহলে আবার এত বড় বড় কথা কিসের? আসলে বিষয়টা তা নয়, একটা জীবনদর্শনকে শেষ করে দিতে গেলে তার মূলে আঘাত করতে হয়। ফলে মাওয়ের প্রোপাগান্ডা মেশিনারি পুরোদমে সক্রিয় ছিল ভারত, ভারতীয়তা, ভারতীয় সভ্যতা, ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় ধর্মবোধ এবং ভারতীয় দর্শনকে চিনাদের মাথা থেকে মুছে ফেলতে, এবং তার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায়টাই তারা বেছে নিয়েছিল, যা আজও সমানভাবে সক্রিয়। ভারত অর্থাৎ সনাতন ধর্মবোধযুক্ত একমাত্র জীবিত প্রাচীন সভ্যতা।

এই যে one life থিওরি, এরই একটা অব্যর্থ পরিণতি হলো radicalisation বা অতিবাদ-মনস্কতার বৃদ্ধি। মানুষের সামনে যদি কোনো বৃহত্তর লক্ষ্য না থাকে, যদি কর্মফল ভোগ করা এবং কর্মফল ত্যাগ করে মোক্ষপ্রাপ্তিই উদ্দেশ্য এবং নিজের যাপনের মাধ্যমে তা সাধিত করার উপায় না থাকে তাহলে তাৎক্ষণিক সুখ ছাড়া তার আর জীবনে চাওয়ার কিই বা থাকতে পারে? আজকের হামাস বা দায়েশ বা হিজবুল্লারা যতটা অতিবাদী, পল পট বা মাও বা স্ট্যালিনের cultও ঠিক ততটাই অতিবাদী - ফারাক কেবল ফলিত প্রয়োগে। যে কোনো অতিবাদের পেছনে আবার একটাই মূল factor - অতিলোভ। বৌদ্ধিকতার আড়ে বিশ্বের ইতিহাসে এই লোভে লোভে ঠোকাঠুকি যত হয়েছে, সত্যিকারের বৈচারিক বিবাদ তার ধারে কাছেও হয়নি। আর লোভ মানেই গা জোয়ারী, যা স্বাভাবিক উপায়ে পাওয়ার উপায় নাই তাকে জোর করে কেড়ে নিতে হবে, তা সে আনুগত্য হোক বা অনুগ্রহ। 

একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখবেন যে consumerism এর মূলে হলো want আর profit - একদলের রাস্তা হলো মানুষের মনে একটা চাহিদা তৈরি করো, সেই চাহিদা পূরণ করার একটা তন্ত্র বানাও, খুব মাল বেচো আর মুনাফা কামাও আর অন্যদলের রাস্তা হলো যা আছে তার চেয়ে অন্যরকম কিছু চাই, নতুন কিছু চাই যা আমায় নতুন করে সুখ দেবে আর যা পাওয়ার জন্য আমি নিজেকে বিকিয়ে দিতেও রাজি আছি। এবার সেই want যদি সেকালে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার উৎস হয়ে ওঠা হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো চার্চ আর গ্যালিলিওর গৃহবন্ধি হওয়া, যদি আজকের সময়ের narcotics বা অবৈধ অস্ত্র হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো জিহাদের নামে ইসলামিস্ট সন্ত্রাসবাদ, যদি দেশের মানুষের সম্মিলিত সম্পদকে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের ভোগযোগ্য সম্পদে পরিণত করতে হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো কম্যুনিস্ট শাসনব্যবস্থা, যদি সারা বিশ্বকে নিঃস্ব করে নিজেদের দেশকে ধনবান করতে হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো ছদ্মসাম্রাজ্যবাদ আর যদি বিশ্বের বৃহৎ ধনীদের পকেট আরো ভরতে হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো যুদ্ধ আর মহামারি - আখেরে তো এই। 

হামাস, হুতি, হিজবুল্লাহ আর ইরানি শিয়া জঙ্গিরা সব একসাথে ইজরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে দেখে আমরা কেউ কি একটুও আশ্চর্য্য হচ্ছি? এটাই তো হওয়ার ছিল কারণ অসনাতনীদের জমি দখলের লড়াই চিরকাল নিজেদের পন্থীয় অথবা মতবাদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে সামনে রেখেই করা হয়ে এসেছে। আসলে পন্থসহ যে জীবনদর্শনের ভিত্তিটাই transactional, সেখানে মানুষে মানুষে সম্পৰ্কটাও তো তাইই। সনাতনীদের বৈদিক বিবাহপদ্ধতি বিচ্ছেদবিহীন আর আব্রাহামীয়দের বিবাহ নিকাহনামা নামক চুক্তিভিত্তিক - কেন? সনাতনীর সন্তান জন্মসূত্রেই সনাতনী আর আব্রাহামীয়দের সন্তানকে baptise করে পন্থগ্রহণ করাতে হয় - কেন? সনাতনী মৃত্যুর পর শরীরকে পঞ্চভূতে বিলীন করে দেয় আর অসনাতনী শেষ বিচারের অপেক্ষায় কফিনে শুয়ে থাকে - কেন?

সনাতনী আর অসনাতনীদের মধ্যে এই যে সম্পুর্ন দুই বিপরীতমুখী জীবনদর্শন, এরই ফলে সনাতনী কারো ওপর কোনোদিন কোনোকিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়না - সে জানে যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তা সাময়িক আর যা কিছুই সাময়িক তাই অনিত্য, ফলে মূলত অসত্য। আর যা সত্য, যা সনাতন, তা জাগতিক লেনদেনে নেই, তার খোঁজ আছে অদ্বৈত বেদান্তে। এই জন্যই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে বিশ্বের অগ্রণী শক্তি হওয়া সত্ত্বেও ভারত কোনোদিন কাউকে আক্রমণ করেনি, উল্টে বিশ্বের সমস্ত আক্রান্তাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। নিঃস্বার্থভাবে ভারত জ্ঞান বিতরণ করেছে, বিনিময়ে কোনো কিছুই সে চায়নি। বিশ্বজুড়ে এত সভ্যতার উদয় হয়েছে, কিন্তু একমাত্র ভারতীয় সভ্যতা ছাড়া তারা সব আজ অস্তমিত, অলক্ষ্যে কোনো তো একটা কারণ আছে, তাই না? 

একবার চোখ মেলে চেয়ে দেখুন ভারতের ভেতরে ও বাইরে ইদানিং কি ঘটছে, বুঝতে পারবেন। দেখবেন অযোধ্যায় যখন শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির দ্রুত প্রাণপ্রতিষ্ঠার শুভক্ষণের দিকে এগোচ্ছে, সুদূর চিনের গ্রামেগঞ্জে সদ্য রোজগার হারানো সাধারণ মানুষ এতবছর পর আবার বন্ধ হয়ে যাওয়া গ্রাম্য মন্দিরগুলি খুলছেন, তাঁরা ওই মন্দির ecosystemটি ফিরে পেতে আগ্রহী। মন্দির মানে ধ্যান, মানসিক শান্তি, মন্দির মানে দান দক্ষিণা, মন্দির মানে লঙ্গর, মন্দির মানে স্থানীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের রোজগার, মন্দির মানে সামাজিক ধর্মচেতনার উৎস, মন্দির গরিবের আশ্রয়স্থল। খোদ আরবের বুকে এখন বিশালাকায় মন্দির নির্মাণ হচ্ছে, আমেরিকায় হচ্ছে, আফ্রিকা জুড়ে হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে না? এমনকি পাক অধিকৃত কাশ্মীরের তথাকথিত সংসদে resolution নেওয়া হচ্ছে যে মা সরদার বিধ্বস্ত প্রাচীন পূজাস্থল ভক্তদের জন্য আবার খুলে দেওয়া হোক। বিশ্বজুড়ে যত দ্বন্দ্ব বাড়ছে, সংঘাত বাড়ছে, তত বেশি করে হটাৎ মন্দির তৈরি হওয়া বা সংস্কার হওয়াও বেড়ে গেছে, এটা কি লক্ষ্য করেছেন? কেন? 

কারণ ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে পারছেন যে one life consumption model পুরোপুরি ফেল করে গেছে, ক্যাপিটালিসম এবং কম্যুনিসম দুটোই অসাড় প্রমাণিত হয়েছে, এবার পন্থীয় অতিবাদেরও শেষ হওয়ার পালা। এই যে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এর অন্তে অতিবাদীরা নিজেরাই অতিবাদ শেষ করবে, যে প্রক্রিয়াটিকে de-radicalisation বলে। তারপর? শ্রীকৃষ্ণ নিশ্চয় আজকের অর্জুনকে আবার মনে করিয়ে দেবেন, "তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ" - হে কুন্তীপুত্র, যুদ্ধের জন্য কৃতসংকল্প হও, তোমায় নগ্ন ভোগস্পৃহার সাথে নির্ণায়ক লড়াই লড়তে হবে। বিশ্ব যাতে লোভ ঈর্ষা আর ভোগবাদের তাড়না ত্যাগ করে সকলে মিলেমিশে বাঁচার আনন্দ উপভোগ করতে পারে, সেই পথ তুমি দেখাবে। আর কি?  আর বোঝাবে, "কেউ পর নয় মা, জগৎ তোমার। যদি শান্তি চাও মা, কারও দোষ দেখোনা। দোষ দেখবে নিজের।"

Saturday, October 21, 2023

বীরাষ্টমী

জনচেতনা অনুযায়ী, নবরাত্রির অষ্টম দিন বা ‘অষ্টমী’ বোধহয় দুর্গাপূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে দেবী দুর্গার অস্ত্রগুলিকে দেবজ্ঞানে অর্ঘ্য প্রদান করা হয় কারণ দেবগণ নানা অস্ত্র প্রদানের মাধ্যমে এই মহাষ্টমী তিথিতেই দেবীকে রণসাজে সাজিয়ে তুলেছিলেন। এই দিনটিকে বীরাষ্টমীও বলা হয়। আবার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই দিনটিতে ‘অস্ত্র পূজা’ করা হয়, যেমন উত্তর ভারতে বিজয়া দশমীর দিনে। এদিন দেবী রাজরাজেশ্বরী মূর্তি ধরে দু’হাতে বর দেন ভক্তদের তাই বাঙালিরা যেমন অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে উন্মুখ, বীর সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে এই বিশেষ তিথিতেই বীরাষ্টমী ব্রত পালন করেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মহিলারা। এদিন দেবী মহাগৌরীরূপা বৈষ্ণবী শক্তি।

ব্রিটিশ জমানায় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে মাতৃভূমিকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার সংগ্রামকে অসুরনাশ ও শুভশক্তির উদয়সূচক বিপ্লবের সাথে মিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার করে তুলেছিলেন আমাদের বীর বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। সেইসময়ই বিভিন্ন কুস্তির আখড়ায় দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু হয়। সেসময় অষ্টমী তিথিতে আখড়ায় আখড়ায় এবং দুর্গামণ্ডপে কুস্তি প্রদর্শিত হত এবং বাঙালি ভিড় করে দেখতো। একইসঙ্গে এই দিনে বীরদের সম্মান জানানোরও রেওয়াজ ছিল। কিন্তু যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে অষ্টমীর সাথে বীরত্বের কি সম্পর্ক। থিমের ঠেলায় আর দেবীর আরাধনাকে সামাজিক উৎসবে পর্য্যবসিত করার তাগিদে বাঙালি অস্ত্রপূজার রীতিও আজ হারিয়ে ফেলেছে।

বাঙালি হিন্দু যে একসময় অস্ত্র ধরতে পারত, অস্ত্র নিয়ে প্রবল তেজে যুদ্ধ করতে পারত, সেকথা আজ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বীরাষ্টমী সম্পর্কে তাই বর্তমান প্রজন্ম অজ্ঞান। তারা হয়তো জানেও না যে বাঙ্গালী হিন্দুরা কেন এককালে ছড়া বেঁধেছিল 'আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে। ঢাঁই মিরগেল ঘাঘর বাজে॥' বাঙালি এককালে যেমন গাজা বাজা বাজিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধে যেত, তেমনিই নিজেদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি বজায় রাখতে পাল্লা দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় লাঠি আর তলোয়ারও খেলত, আজকের মতন রাজনীতির ধামা ধরে ফোকটে সুবিধা আদায়ের ফিকির খুঁজতো না। 

পরম পূজনীয় ডাক্তারজির সময়ের রাইফেল অনুশীলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও বহুকাল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখাগুলিতে তলোয়ার খেলা প্রচলিত ছিল, এখন সেখানেও নাকি কেবল লাঠি বা কাঠের তলোয়ার ব্যবহার হয় বলে শুনেছি। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রাচীন রীতি যাঁরা আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভারত সেবাশ্রম সংঘ। এছাড়া উত্তর কলকাতার বাগবাজার সার্বজনীনেও পালিত হয় বীরাষ্টমী ব্রত। অনুশীলন সমিতি খ্যাত পুলিন বিহারী দাস যতদিন শারীরিকভাবে সক্ষম ছিলেন, ততদিন তাঁর উপস্থিতিতেই বাগবাজারে এই ব্রত পালিত হতো, এখনো হয়, তবে ধীরে ধীরে বাঙালিদের মধ্যে লাঠি আর অস্ত্র ধরার লোকের সংখ্যা কমে আসছে।

Friday, October 20, 2023

নবপত্রিকা

যাঁরা মনে করেন নবরাত্রি অবাঙালিদের আর দুর্গাপূজা বাঙালিদের অনুষ্ঠান, তাঁরা নিশ্চয় আজ সপ্তমীর পূজার শুরুতেই নবপত্রিকার স্নান ও স্থাপনা দেখেছেন। আসলে ইনি হলেন নয়টি গাছ বা উদ্ভিদ - 
রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িম্বৌ
অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।
অর্থাৎ, রম্ভা (কলা), কচ্চী (সাধারণ কচু), হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী (একটি ভেষজ উদ্ভিদ যার আয়ুর্বেদিক নাম নাদেয়ী), বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু ও ধান মিলিয়ে হলেন নবপত্রিকা, যাঁদের শ্বেত অপরাজিতার লতা দিয়ে একসাথে বেঁধে দুটি বেল সহ কাপড় ও সিঁদুর পরিয়ে গণেশের পাশে স্থাপন করা হয়। অনেকেই মনে করেন নবপত্রিকা বা প্ৰচলিত ভাষায় কলা বউ নাকি গণেশের স্ত্রী, আসলে মোটেও তা নয়। 

এই নয়টি গাছ বা উদ্ভিদ হলেন মা দুর্গারই নয়টি রূপের প্রতীক। বলা হচ্ছে -
রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা, ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী।
অর্থাৎ, কলা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী;
সাধারণ কচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা;
হলুদ গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা;
জয়ন্তী গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী;
বেল গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা;
ডালিম গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা;
অশোক গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা;
মানকচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা;
ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী।

কি, নবরাত্রির সঙ্গে বাংলার দুর্গাপূজার সম্পর্ক নেই? নবরাত্রির নয়টি দিনের প্রতিদিন মাকে তাঁর এই নয়টি রূপের এক একটি রূপ ধরে ধরেই তো আরাধনা করা হয়, অন্য কিছু তো নয়।

Tuesday, October 17, 2023

চতুর্থী

আজ চতুর্থী - মৃন্ময়ী মূর্তিতে মা হয় অধিকাংশ পূজাস্থলে ইতিমধ্যেই এসে পৌঁছিয়েছেন অথবা আজ পৌঁছবেন। আজ আর আগামীকাল বাড়ি বা আবাসনের পুজোগুলোতে মাকে খুব করে সাজানো গোজানো হবে, তারপর ষষ্ঠীতে সকালে কল্পারম্ভ আর বিকেলে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের পর মা তাঁর চিন্ময়ীরূপ ধারণ করবেন। 

এই তো মাত্র শতখানেক বছর আগেও এই মহাশক্তি জগজ্জননী মহামাঈ মানুষের শরীর ধারণ করে বহুবছর প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে ছিলেন, তাই স্বামীজী শ্রীশ্রীমাকে বলতেন জ্যান্ত দুর্গা। এখনও মা সূক্ষ্মশরীরে বিদ্যমানা, তাই বেলুড় মঠে দুর্গা পূজার সংকল্প মায়ের নামেই করা হয়। মা এখন ইষ্টরূপে ভক্তের হৃদয়ে বাস করেন। 

শ্রীশ্রীমায়ের কথা বইটির ১৯০ পৃষ্ঠায় স্বামীজী আর মায়ের একটি অসাধারণ সরস কথোপকথনের উল্লেখ আছে, যার গভীরতা সীমাহীন। স্বামীজী একদিন মাকে বলছেন, "মা, আমার আজকাল সব উড়ে যাচ্ছে।" মা হেঁসে বললেন, "দেখো দেখো, আমাকে কিন্তু উড়িয়ে দিও না!" তখন স্বামীজী মহাব্যস্ত হয়ে উত্তর দিচ্ছেন, "মা, তোমাকে উড়িয়ে দিলে থাকি কোথায়? যে জ্ঞানে গুরুপাদপদ্ম উড়িয়ে দেয় সে তো অজ্ঞান। গুরুপাদপদ্ম উড়িয়ে দিলে জ্ঞান দাঁড়ায় কোথায়?" 

এটি তো কেবল একজন শিষ্য ও গুরুপত্নীর মধ্যে কথোপকথন নয়, এক ব্রহ্মজ্ঞ মহর্ষি এবং পরমাপ্রকৃতির মধ্যে, ভক্ত আর ভগবানের মধ্যে আর শিষ্য ও সদগুরুর মধ্যে চিরকালীন সম্বন্ধের একটি অনবদ্য দলিল, যার প্রত্যেকটি শব্দের মধ্যে গভীর দর্শন লুকিয়ে রয়েছে। 

স্বামীজী বলছেন, মা, আজকাল সব উড়ে যাচ্ছে - এর অর্থ কি? বোধের এমন এক সীমায় স্বামীজী তখন অবস্থান করছেন যে এই শরীর, এই পার্থিব জগৎ, মায়ার বন্ধন ইত্যাদি কোনো কিছুই আর তাঁকে ধরে রাখতে পারছে না, তিনি যে সত্যি সত্যিই অজড় অমর আত্মা, এই ব্রহ্মজ্ঞান তাঁর মধ্যে মূর্তরূপ ধারণ করে তখন সর্বক্ষণ বিরাজমান। 

স্বামীজীর 'বাঙাল' শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা 'স্বামী শিষ্য সংবাদ' আর মানসকন্যা সিস্টার নিবেদিতার লেখা 'The Master, as I saw Him' বইগুলোতে তাঁর এই ধরণের ইন্দ্রিয়াতীত নানা অনুভূতির বর্ণনা রয়েছে। ঠাকুরের মধ্যেও আমরা ঘনঘন 'এই আছি এই নেই' ভাব দেখেছি, মহারাজ এবং ঠাকুরের অন্যান্য সন্তানদের মধ্যেও দেখেছি - আত্মজ্ঞানীদের যে এমনটা হয়, তা শাস্ত্রেও বর্ণিত।

যাইহোক, গুরুর কৃপায় যে তাঁর আত্মদর্শন হয়েছে, স্বামীজী মাকে সেটাই বলছেন। আর মা কি বলছেন? সেটা আরো মারাত্মক - দেখো, আমায় কিন্তু উড়িয়ে দিও না! ঠাকুর নয় কিন্তু, 'আমি'! এই আমি কে? স্বামী অভেদানন্দজি তাঁর মাতৃস্তোত্রে যাঁর সম্পর্কে বলছেন, "শরণাগত-সেবকতোষকরীং, প্রণমামি পরাং জননীং জগতাম্" অর্থাৎ, শরণাগত সেবকের তুষ্টিবিধানকারিণী এই পরমা জগজ্জননীকে প্রণাম করি। শরণাগতি - এটি ছেড়ো না বাপু, এটি ছাড়লেই সর্বনাশ! তোমার এই যে তুরীয় অবস্থা, সেটি আমারই দেওয়া, আমিই 'জননীং জগতাম্' - ভুল করে আমাকেই যেন আবার উড়িয়ে বোসো না। 

এরপর স্বামীজীর যে উত্তর, সেটা classic - স্বামীজী তো ততক্ষনে বুঝে ফেলেছেন আবেগের বশে কার সামনে কি কথা বলে ফেলেছেন, তিনি একেবারে শশব্যস্ত, সামান্য যে অহংবোধটুকু শরীরধারণ করার জন্য প্রয়োজন হয়, সেটুকুকেও যেন সম্পূর্ণভাবে মায়ের পায়ে অর্পণ করে দিয়ে বলছেন, মা, তোমা ছাড়া আমার আর আলাদা অস্তিত্ব কোথায়? তুমি আছো তাই আমি আছি, তোমায় উড়িয়ে দিলে যে আমার অস্তিত্বটুকুও উড়ে যায়।

তারপরেই স্বামীজী নিজের মনের গোপন কথাটি মায়ের সামনে তুলে ধরছেন। মা, তুমিই আমার গুরু, তুমি ঠাকুর নামক ব্রহ্মাগ্নির দাহিকাশক্তি, তুমি কৃপা করে আমায় আত্মজ্ঞান দিয়েছো - সেই তোমাকেই যদি অস্বীকার করি, তাহলে তো সে আমার অজ্ঞান। গুরু আর ইষ্ট এক, গুরু বিনা জ্ঞান নেই, আমার যা কিছু realisation হয়েছে সব তোমার দয়ায় - 'তাং সারদাং ভক্তিবিজ্ঞানদাত্রীং, দয়াস্বরূপাং প্রণমামি নিত্যম্' - তুমি সারদা, সরস্বতী, ভক্তিবিজ্ঞান-দায়িনী, দয়াস্বরূপিনী, তোমায় নিত্য প্রণাম করি। 

ওই বইটিরই পরের পাতায় মায়ের আর একটি কথা লিপিবিদ্ধ আছে, যা স্বামীজী আর মায়ের মধ্যে এই বার্তালাপকে sum up করে। মা বলছেন, "জ্ঞান হলে ঈশ্বর-টীশ্বর সব উড়ে যায়। 'মা' 'মা' শেষে দেখে। মা আমার জগৎ জুড়ে। সব এক হয়ে দাঁড়ায়। এই তো সোজা কথাটা।" আহা, এই সোজা কথাটাকে উপলব্ধি করা যে আসলে কত কঠিন, মহামাঈর অহেতুকি কৃপা না হলে যে সমগ্র জীবজগৎকে জগৎপ্রসবিনীরূপে দেখা সম্ভবই নয়, আর সেটাই যে আসল জ্ঞান, তা আর আমরা বুঝি কই? বুঝলে, মায়ের কাছে নির্বাসনা আর শরণাগতি প্রার্থনা করার এটাই কিন্তু সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

নবরাত্রি

সারা বছরের মধ্যে শুভতমকাল নবরাত্রির আজ তৃতীয় দিন - তৃতীয়া। বিজয়া দশমী অবধি দেবীপক্ষের এই অতি পূণ্য দিনগুলিতে এক একদিন মহাশক্তির এক একটি রূপ ধারণ করে মা দৈহিকভাবে ধরায় উপস্থিত হন, ফলে ধরাতলে এমন এক দিব্য আধ্যাত্মিক আভামন্ডল তৈরি হয়, যা বছরের অন্য কোনো সময় আর হয়না।

এই দৈবীবলয় অনুভব করতে হলে কিছু সংযম, কিছু নিয়ম পালন আর যথাসম্ভব বেশি জপ তপ সাধন ভজন করতে হয়, যাতে শরীর মন সবসময় একেবারে শুচিশুদ্ধ থাকে, মাতৃআরাধনায় লীন থাকে। আমরা অনেকেই হয়তো উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ভক্তদের সারা রাত জেগে কীর্তন ইত্যাদি সহযোগে 'জাগরণ' করতে দেখেছি, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুরী-হালুয়া প্রসাদ বিতরণ হতে দেখেছি, এই দশ দিন ওখানে আমিষ খাদ্য প্রায় পাওয়াই যায়না - খাদ্যাভ্যাসের বিতর্কে না ঢুকেও বলা চলে যে ওসব অঞ্চলে এই শুভকালের প্রস্তুতির একটা বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা আছে। 

আমরা হয়তো ৭৩ বর্ষীয় অতিব্যস্ত এবং অতিজনপ্রিয় এক শিবভক্তের কথা জানি যিনি গত ৪০ বছর ধরে প্রত্যেক নবরাত্রিতে দিনে কেবল একবার একটি ফল আর বাকি সময়ে কয়েক গেলাস নিম্বুপানি খেয়ে নিজেকে সার্বজনীন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন ও একান্তিক আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য প্রস্তুত রাখেন। এই যে নিজেকে মায়ের অমৃতস্পর্শের জন্য প্রস্তুত রাখা এবং বছরের পর বছর ধরে প্রস্তুত রাখা - কৃপাময়ী যদি কৃপা করে একবার অন্তর্দৃষ্টি দেন আমরা যেন তা অনুভব ও গ্রহণ করার মতন আধাররূপে তৈরি থাকতে পারি - এই প্রক্রিয়াটিও সাধনার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

আমাদের বাঙালিদের মধ্যে হুল্লোড় বেশি, গভীরতা কম। আমাদের কাছে পুজোর প্রস্তুতি মানে নতুন কাপড় জামা কেনা, আড্ডা মারা, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠেলাঠেলি করে ঠাকুর দেখা, খাওয়া দাওয়া, মোটের ওপর মোচ্ছব করা আর নিয়ম করে অষ্টমীর অঞ্জলিটি দিয়ে কোনোমতে পুজোর ব্যাপারটা থেকে রেহাই পাওয়া। পুজো কিন্তু আসলে এর কোনোটাই নয়। কাকে পুজো করা হচ্ছে, কেন হচ্ছে আর এই পুজোর ফলে জীবনের ওপর কি প্রভাব পড়ে, এগুলো নিয়ে একটু ভাবা দরকার বৈকি। 

যেদিন আমরা বাহ্যিক পরিমণ্ডল থেকে একটু গুটিয়ে নিয়ে নিজেদের উৎপত্তি ও সদগতি নিয়ে ভাববো, সেদিন হয়তো আমরা থমকে দাঁড়াবো। সেদিন প্যান্ডেলের মাইকে চন্ডীপাঠে 'ইয়া দেবী সর্বভূতেষু' শুনলে আমাদের হয়তো মনে হবে সর্বভূতে কে থাকতে পারেন? যখন শুনবো তিনি ক্ষান্তিরূপেণ সংস্থিতা, জাতিরূপেণ সংস্থিতা, শান্তিরূপেণ সংস্থিতা, শ্রদ্ধারূপেণ সংস্থিতা, কান্তিরূপেণ সংস্থিতা, লক্ষ্মীরূপেণ সংস্থিতা, বৃত্তিরূপেণ সংস্থিতা, স্মৃতিরূপেণ সংস্থিতা, দয়ারূপেণ সংস্থিতা, তুষ্টিরূপেণ সংস্থিতা, মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, আবার ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতাও, তখন হয়তো বুঝবো যে দুর্গাপুজো নিয়ে আমাদের বাঙালিদের মনে যে ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, সেটা আমাদের কর্মফলেরই কারণে, এটাই আমাদের প্রারব্ধ। 

দিনকে দিন জাতি হিসেবে আমরা যে পিছিয়ে যাচ্ছি - কটুভাষী, ঈর্ষাকাতর, অর্বাচীন, নিম্নমেধার উপাসক - এক পশ্চাদমুখী ধারা বইছে খোদ মাতৃসাধনার পীঠস্থানে - এর শেষ মায়ের কৃপাতেই হবে, আর তার জন্যই আমাদের নিজেদের তৈরি করতে হবে। নবরাত্রি হলো সেই শুভকাল, যখন মা স্বয়ং সশরীরে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হন। আসুন না, আমরা নিজেদের তাঁর পাদপদ্মে সমর্পণ করে শুদ্ধ হই। 

"ইন্দ্রিয়ানামধিষ্ঠাত্রী ভূতানাং চাখিলেষু ইয়া।
ভূতেষু সততং তসৈ ব্যাপ্তৈ দেব্যৈ নমো নমঃ।।
চিতিরূপেণ ইয়া কৃৎস্নমেতদ্‌ ব্যাপ্য স্থিতা জগত।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।"

Sunday, October 15, 2023

অর্গলাস্তোত্রম

আজ দেবীপক্ষের দ্বিতীয়া - মা আসছেন। মায়ের স্বরূপ বর্ণনা করে ঋষি মার্কণ্ডেয় অর্গলাস্তোত্রমের প্রথম দিকে বলছেন,
শ্লোক ১
"হে দেবী চামূণ্ডা, তোমার জয় হোক। হে দেবী, তুমি জীবের দুঃখনাশকারিণী; তুমি সর্বভূতে অবস্থিতা; আবার তুমিই প্রলয়ের অন্ধকার স্বরূপিণী কালরাত্রি। তোমায় নমস্কার করি।"
শ্লোক ২
"হে দেবী, তুমি সর্বোৎকৃষ্টা জয়যুক্তা দেবী জয়ন্তী; তুমি জন্মমৃত্যুবিনাশিনী মোক্ষপ্রদায়িনী দেবী মঙ্গলা; তুমি সর্বসংহারকারিণী কালী; তুমি সুখদায়িনী ভদ্রকালী; আবার তুমিই প্রলয়কালে ব্রহ্মা প্রমুখের মাথার খুলি হস্তে নৃত্যরতা কপালিনী। তুমি দুর্গা, কারণ বহু কষ্ট স্বীকার করে তবে তোমায় লাভ করা যায়; তুমি চৈতন্যময়ী শিবা; তুমি করুণাময়ী ক্ষমা; তুমি বিশ্বধারিণী ধাত্রী; তুমি দেবগণের পোষণকর্ত্রী স্বাহা ও পিতৃগণের পোষণকর্ত্রী স্বধা। তোমায় নমস্কার করি।"

এ দুটি শ্লোক থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে জগজ্জননী মহামায়াই যে ব্রহ্মের শক্তিস্বরূপিণী অক্ষয়রূপ, তা মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি প্রত্যক্ষভাবে জেনেছেন। তাই সেই ঋষিই যখন পরবর্তী শ্লোকগুলিতে বারেবারে মায়ের কাছে প্রার্থনা করছেন, "রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি", অর্থাৎ আমায় রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও আর আমার শত্রু নাশ করো, তখন তিনি স্বয়ং মোক্ষদায়িত্রীর কাছে সামান্য কোনো সাময়িক জাগতিক সুখ প্রার্থনা করে সময় নষ্ট করছেন, এমনটি কি কল্পনা করা সম্ভব?

মিশনে দুর্গাপূজার সময় ওই যে বিখ্যাত গানটি গাওয়া হয় না, "একবার বিরাজ গো মা হৃদি কমলাসনে। তোমার ভুবন-ভরা রূপটি একবার দেখে লই মা নয়নে।।" - যাঁরা শুনেছেন তাঁরা বুঝবেন এখানে যখন 'রূপং দেহি' বলা হচ্ছে তখন সেটা মোটেও 'আমায় রূপ দাও' হতে পারেনা; মা, তোমার ভুবন-ভরা রূপটি যেন সদা সর্বদা হৃদয়ে দেখতে পাই, জগন্মাতার কাছে সেই কৃপাই প্রার্থনা করা হচ্ছে। আমার শারীরিক রূপ নিয়ে কি হবে, ও তো অস্থায়ী। আজ লোকে আহা আহা করছে, কালের নিয়মেই একদিন চামড়া কুঁচকে যাবে, দাঁত পড়ে যাবে, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে যাবে, শরীর নড়বড় করবে - ও ছাইপাঁশ চেয়ে লাভ কি? চাইতে হলে এমন জিনিস চাও যা জন্মজন্মান্তরেও ফুরাবে না, যা ধীরে ধীরে বাহ্যিক বাঁধন কেটে অভ্যন্তরীণ অনন্তের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

এরপর বলছেন 'জয়ং দেহি' - জয় দাও। শত্রুতা মিত্রতা সবই তো সাময়িক, যতক্ষণ শরীর আছে ততক্ষণ জয়-পরাজয়, যেই শরীর গেল অমনি সব শেষ। জয় আর ভোগেচ্ছা তো একে অপরের পরিপূরক - ভোগও কেবলই জাগতিক। তাহলে কিসের ওপর জয় প্রার্থনা করছেন ঋষি? চোদ্দটি ইন্দ্রিয়ের ওপর জয়। এই যে আমাদের পাঁচটি অনিয়ন্ত্রিত কর্মেন্দ্রিয় : বাক্ পাণি পাদ পায়ু উপস্থ, পাঁচটি নিয়ন্ত্রণহীন জ্ঞানেন্দ্রিয় : চক্ষু কর্ণ নাসিকা জিহ্বা ত্বক, আর চারটি অন্তরিন্দ্রিয় : মন বুদ্ধি অহঙ্কার চিত্ত - এদের ওপর জয় চাই। যতক্ষণ এরা আমার বশে নেই, ততক্ষণ এরাই আমায় চালনা করবে আর বাসনায় বাসনায় জর্জরিত করে বারেবারে ভোগের চোরাবালিতে নিয়ে যাবে; আমার আর মনুষ্য জীবনের আসল উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব হবে না। মা, তুমি কৃপা না করলে এই ভয়ঙ্কর চোদ্দ শত্রুর বিরুদ্ধে জয়যুক্ত হওয়া আমার পক্ষে সম্ভবই নয়, তুমিই আমায় এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় প্রদান করো মা। 

কর্ণ-কুন্তী সংবাদের একেবারে শেষ পংক্তিটি মনে আছে? কর্ণ জানেন তাঁর মা আসলে তাঁর কাছে কি চাইতে এসেছেন, তাই মহাবীর তাঁর গর্ভধারিণীর কাছে কেবল এটুকুই প্রার্থনা করছেন যেন তিনি তাঁর যোদ্ধার ধর্ম পালন করতে করতেই মরতে পারেন, তিনি যেন কখনো স্বধৰ্মচ্যুত না হন। কর্ণ বলছেন, 
"শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে
জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদ্‌গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।"
জয়, যশ আর রাজ্য - এই তিনটির লোভই তো কুন্তী দেখিয়েছিলেন কর্ণকে - তোমার পাঁচ ভাই তোমায় মাথায় করে রাখবে, তুমি সূতপুত্র নও, পাণ্ডবকূলশ্রেষ্ঠ বলে পরিচিত হবে, তুমি সসাগরা পৃথিবীর সম্রাট হবে, তোমার নাম যশ কীর্তি অমর হয়ে থাকবে পৃথিবীর বুকে - কর্ণ সে সব হেলায় ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন। আসল যশ হলো ঠিক ঠিক ধৰ্ম পালন করতে পারার যশ - আমি সমস্ত প্রলোভনকে জয় করে আমার রাজধর্ম, বন্ধুধর্ম, স্বধর্ম ইত্যাদি সব ধৰ্ম ঠিক ঠিক পালন করতে পেরেছি - তার যশ। তাই "যশো দেহি"।

শেষে ঋষি বলছেন, "দ্বিষো জহি" - শত্রু নাশ করো মা। আমাদের আসল শত্রু তো বাইরে নেই, সবই ভেতরে। ষড়রিপু অর্থাৎ কাম ক্রোধ লোভ মোহ অহংকার আর ঈর্ষা - এই হলো আমাদের প্রত্যেকের ছয়টি আসল শত্রু। আমাদের যা কিছু দুর্গতি, সব এই রিপুগুলোর জন্যই, এগুলোই আমাদের ক্রমাগত আঘাত করে করে এমন একটা অন্ধকূপে আটকে ফেলে যে আমরা আর আমাদের অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করতে পারিনা। আমরা ভুলে যাই যে আমরা potentially Divine, আমরা অমৃতের পুত্র, যাকে আমরা হিংসা করছি বা যার ওপর রাগ করছি সেও আমারই অংশ, আলাদা কেউ নয়। আমার যা কিছু কর্মফল, সব বাসনা থেকে উদ্ভূত আর তার পেছনে ক্রমাগত ইন্ধন যোগায় এই ষড়রিপু। মা আমার অন্তরের শত্রু নাশ করো, কৃপা করে আমায় নির্বাসনা দাও, আমি যেন এই জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি, তার উপায় করো মাগো।

Wednesday, October 4, 2023

বোধবুদ্ধি



বোধ আর বুদ্ধি এক নয়। বোধ বললেই আমার জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনদুটি মনে পড়ে - ' স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!' বোধ মানে চেতনা, অন্যভাবে দেখলে উপলব্ধি। বুদ্ধি কম বেশি সমস্ত প্রাণীকুলেরই আছে কিন্তু বোধকে আত্মবোধে উন্নীত করার ক্ষমতা একমাত্র মানুষের আছে বলেই জানি, হয়তো ভবিষ্যতে গবেষকরা অন্য খোঁজও করতে পারেন। 

গাছের স্নায়ুতন্ত্র নেই, অথচ বেদনাবোধ আছে, এমনটা জগদীশচন্দ্র হাতে কলমে প্রমান করে দেখিয়েছিলেন। স্নায়ুতন্ত্র নেই মানে বুদ্ধি নেই অথচ বোধ আছে। মস্তিষ্ক না থাকলে অনুভূতি আসে কিভাবে এই মুহূর্তে সেই প্রসঙ্গে না ঢুকেও, এক্ষেত্রে বোধ আর দুঃখ বা সুখের অনুভূতি সমার্থক, সব ক্ষেত্রে যদিও নয়। কেবল মানুষই একমাত্র অদ্ভুত জীব যার গঠনতন্ত্রে সমস্ত রকমের সিস্টেম inbuilt থাকা স্বত্তেও, বাস্তবে দেখা যায় অনেকের মধ্যেই বুদ্ধি আছে কিন্তু বোধের উন্মেষ নেই। 

এ কিন্তু এক মারাত্মক বস্তু - মানুষকে অসম্পূর্ণ মানুষ করে তোলে। বুদ্ধি একটি বৃত্তি, যা rationally চিন্তা করে কোনো নির্ণয়ে পৌঁছতে সাহায্য করে। বুদ্ধির দুটি দিক আছে : ১. আমানতি, অর্থাৎ অতীতের অভিজ্ঞতা বা অর্জিত জ্ঞান থেকে নিষ্কর্ষ টেনে আনার ক্ষমতা আর ২. বিশ্লেষাত্মক, অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করে অতীতের অভিজ্ঞতা বা অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে এখন কি করণীয়, সেই নির্ণয়ে সহায়ক হওয়া। বুদ্ধি knowledge ভিত্তিক আর বোধ super knowledge বা conciousness ভিত্তিক - দুটো সম্পুর্ন পৃথক বস্তু। বুদ্ধি সমকালীন আর বোধ চিরকালীন। 

গাছ বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে গেলে দুঃখ পায়, নির্জীব হয়ে যায়, আবার অনেকগুলো বন্ধু গাছের সান্নিধ্য পেলে আনন্দে চাঙ্গা হয়ে ওঠে, সেটা যাঁরা বাগান করেন তাঁরা রোজই উপলব্ধি করেন। কেন হয়? মস্তিষ্ক নেই, স্নায়ুতন্ত্র নেই, বুদ্ধি নেই কিন্তু চেতনা আছে - সে চেতন স্বত্তা, ফলে তার মধ্যে বোধ কাজ করে। সেই বোধ বা conciousness এর স্তর কি এমন যে তা তার আত্মবোধ জাগাতে সক্ষম? না। ওটা গোটা চেতন জগতে একমাত্র মানুষের জন্যেই তুলে রাখা আছে। 

কিন্তু মানুষ কি তার সদ্ব্যবহার করে? অধিকাংশই করে না। কারণ? সে সেই বর্তমানে বাঁচতে চায় যার কোনো অস্তিত্ব নেই। ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বর্তমান যে ক্রমাগত অতীত হয়ে যাচ্ছে, সেই বোধ তার প্রবৃত্তির নিচে চাপা পড়ে থাকে, ফলে সে এমন এক অনিত্যকে ধরে বাঁচতে চায়, বোধের জগতে যার কোনো relevence নেই। রামপ্রসাদ বলছেন, 'প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া, তার নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি', কিন্তু কে আর নিবৃত্তি চায়? আজকাল তো অনেক সাধু সন্ন্যাসীরা তীব্র বৈরাগ্যের তাড়নায় গৃহত্যাগ করেও পরবর্তীকালে আনুষ্ঠানিক দায়িত্বপালন করতে গিয়ে জাগতিক প্রবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছেন দেখছি। 

অলীক সুখের খোঁজে আমাদের বুদ্ধি আমাদের দিয়ে এমন খাটান খাটিয়ে নেয়, যে যখন বেলাশেষে আমরা realise করি 'এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়', তখন আর নতুন করে বোধের রাস্তায় হাঁটার মতন শারীরিক বা মানসিক রেস্ত অবশিষ্টই থাকে না। বস্তুতঃ, কেবল বুদ্ধির কথা শুনে চললে বেদনা ছাড়া আর কিছু জোটে না - সে বেদনা নিজেরও হতে পারে আবার অপরের ওপর চাপিয়েও দেওয়া যেতে পারে। অবশ্য ঈশ্বরের কৃপা হলে 'আমি জীবনের উদ্দেশ্যকে বুঝতে না পেরে বৃথা সময় নষ্ট করছি' এই বেদনাও বুদ্ধির মাধ্যমেই মনকে পীড়া দেয়।

মজার ব্যাপার হলো এইরকমই কোনো এক বেদনা থেকে বোধের উদয় হয় - জীবনে যত বেশি বেদনা তত বেশি উপলব্ধি, যত বেশি উপলব্ধি তত বেশি নিবৃত্তি, যত বেশি নিবৃত্তি তত বেশি অহঙ্কারের ক্ষরণ আর আর তত বেশি ইন্দ্রিয়ের বাঁধা ভেঙে চেতনার উদয় - যে চেতনা চিরকালীন প্রেম আর চিরকালীন আনন্দ, অর্থাৎ সত্যের দিকে নিয়ে যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপের কাছে এই বৌদ্ধিক প্রার্থনা করছেন, 
আরো বেদনা আরো বেদনা,
প্রভু, দাও মোরে আরো চেতনা।
দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে
মোরে করো ত্রাণ মোরে করো ত্রাণ।
আরো প্রেমে আরো প্রেমে
মোর আমি ডুবে যাক নেমে।
সুধাধারে আপনারে
তুমি আরো আরো আরো করো দান ॥

Thursday, September 21, 2023

ভারত সঙ্ঘ বনাম প্রদেশিকতা

এক বুড়োখোকা সারাক্ষন 'India is not a Nation but an Union of States' বলে বলে মাথা খারাপ করে দেন, তিনি কি জানেন শ্রী ভীমরাও আম্বেদকর সংবিধানের আর্টিকেল ১এর বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যায় কি বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন 'India is an indestructible Union with destructible States' অর্থাৎ ভারত একটি অবিনাশী Union বা সঙ্ঘ, আর রাজ্যগুলি অনিত্য - তারা ভাঙতে পারে, জুড়তে পারে, অন্য রাজ্যে বিলয় হতে পারে, তারা কেন্দ্র দ্বারা শাসিতও হতে পারে, ইত্যাদি। 

আমেরিকার ফেডারেশন, যার ভিত্তিতে বুড়োখোকা এইসব আজেবাজে কথা বলে বেড়ান, সেটা কিন্তু সম্পুর্ন ভিন্ন একটা কনসেপ্ট যেখানে বিভিন্ন রাজ্য সম্মিলিতভাবে একটি রাষ্ট্রগঠনের জন্য চুক্তিবদ্ধ। ভারতের ক্ষেত্রে একেবারেই তা নয় এবং ফেডারেশনের বদলে ইউনিয়ন শব্দটি সংবিধান সভায় প্রচুর আলোচনার পরেই প্রয়োগ করা হয়েছিল। তার কারণ, এক, ভারতীয় ফেডারেশন আমেরিকান ফেডারেশনের মত রাজ্যগুলির মধ্যে একটি চুক্তির ফলাফল নয়; এবং দুই, রাজ্যগুলির ফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো অধিকারই নেই৷ 

এখন মুস্কিল হলো 'এক রাষ্ট্র' বা 'one Nation' এর ধারণা রাষ্ট্র্ববাদের ভাবনাকে সুদৃঢ় করে, nationalism এর জন্ম দেয়, আর এর ঠিক উল্টোটা, অর্থাৎ প্রাদেশিকতা বা আঞ্চলিকতাকে মুখ্যধারা করতে পারলে উগ্র sub nationalism এবং আখেরে বিচ্ছিন্নতাবাদকে ছড়াতে সাহায্য করে রাজনৈতিক লাভ ওঠানো যায়। আজ বহুবছর ধরে তামিলনাড়ুতে যে ধরণের Dravidian রাজনীতি আমরা দেখছি - উত্তর ভারতের প্রতি ঘৃণা, মুখ্য উত্তর ভারতীয় ভাষার প্রতি অবজ্ঞা আর হিন্দুত্ব অর্থাৎ আসমুদ্র হিমালয় একটাই single entity, সমস্ত নাগরিকের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মূল রাষ্ট্রীয় পরিচয় হিন্দু এবং এই সমাজ এক সনাতন ধর্মবোধ দ্বারা চালিত - এর বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে ইচ্ছে করে সেই বাতিল হয়ে যাওয়া আর্য - অনার্য বিভাজনের থিওরিকে তুলে এনে আঞ্চলিকতাকে খুঁচিয়ে তোলা হচ্ছে যাতে ভারতীয় সঙ্ঘকে কমজোর করা যায়।  

এই একই ক্ষুদ্র রাজনৈতিক লাভের জন্যই বুড়োখোকা টুকরে টুকরে গ্যাংকে তোল্লা দেন অথবা সারা দেশে জাতিভিত্তিক জনগণনা করার জন্য জোরাজুরি করেন বা বিদেশে গিয়ে ভারত এক রাষ্ট্র নয় বলে বেড়ান। এই জন্যই ভারতের দখল হয়ে যাওয়া জমির ওপর দিয়ে যখন চীন তার নিজের বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের রাস্তা বানায়, বুড়োখোকা তাকে চীনের visionary পদক্ষেপ বলেই প্রচার করেন। এখন ব্যাঙ্গালোরে আছি, সহায়িকারা কেউ হিন্দি বুঝতে পারেন না কিন্তু ইংরিজি বুঝতে পারেন - এতদিনের ইন্ডি গোষ্ঠীর শাসনের ফলে এখানকার এই অদ্ভুত দ্বিচারিতা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি ! 

আমি আশা করবো বুড়োখোকাদের গুষ্টিকে এবার জনতা আগাপাসতলা বর্জন করবেন এবং যে বীর সভারকারকে এঁরা মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন, মাঝেমাঝেই বীরদর্পে "I am not Savarkar" বলে নিজেদের হিন্দুবিরোধী মানসিকতাকে উজাগর করেন, হিন্দুরাষ্ট্র সম্পর্কে সেই শ্রী বিনায়ক দামোদর সভারকারের ব্যাখ্যাই একেবারে সঠিক এবং সর্বজনগ্রহণযোগ্য বলে প্রতিপন্ন হবে। পুরাণ বলছেন,
आसिंधु सिंधु पर्यन्ता यस्य भारतभूमिका ।
 पितृभू: पुण्यभूश्चैव स वै हिंदुरिति स्मृत: ॥
(সিন্ধু নদী থেকে নিয়ে সিন্ধু সাগর পর্য্যন্ত বিস্তৃত ভারতভূমিকে যে নিজের পিতৃভূমি এবং পূণ্যভূমি মানে, সেই হিন্দু।)
সাভারকার এই ব্যাখ্যাকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, 'Hindu is one who considers India to be his motherland (matrbhumi), the land of his ancestors (pitrbhumi), and his holy land (punya bhumi).'

Monday, September 18, 2023

দেশের ক্ষতি

সংসদীয় গণতন্ত্রের নিজস্ব একটা মর্য্যাদা আছে কারণ সংসদে সরকারপক্ষ এবং বিরোধীপক্ষ উভয়ই কিন্তু জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি - জনপ্রতিনিধি হিসেবে ধারে ভারে কেউ কারো থেকে কম বা বেশি ক্ষমতাবান নন। দুপক্ষের সাংসদরাই একই শপথবাক্য পাঠ করেন, দুপক্ষই সংবিধানের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা রাখার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ, সেখানেও দুপক্ষের ভূমিকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বাকি, সরকারপক্ষের কাজ শাসন করা আর বিরোধীপক্ষের কাজ ভুল ধরিয়ে দেওয়া - মিটে গেল। তাহলে একপক্ষের এত হীনমন্যতা কিসের?

খুবই খারাপ লাগে যখন দেখি নেহাত বিরোধিতার জন্য বিরোধীপক্ষের কেউ কেউ বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালনের মধ্যেও ক্ষুদ্র দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থকে টেনে এনে গণতান্ত্রিক পরম্পরাকে হেয় করছেন। এঁদের কখনো দেখি নতুন সংসদভবনের নির্মাণ আটকানোর জন্য বারেবারে আদালতে ছুটে যাচ্ছেন, তাতে জাতীয় প্রতীক প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে সঙ্গে সিংহের হিংস্রতা নিয়ে অকারণে বিতর্ক সৃষ্টি করে সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন, ভবন উদ্ঘাটনের দিন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বয়কট করছেন, আর আজ যখন প্রথমবার নতুন সংসদে রাষ্ট্রীয় ধ্বজারোহন হলো, তখন রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা চিঠি লিখে জানিয়ে দিলেন তিনি আসতে পারবেন না, অন্যত্র দলীয় কার্য্যক্রমে ব্যস্ত। 

এটা যদি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতো, খুশি হতাম কিন্তু বাস্তবিক তা নয়। এর আগেও স্বাধীনতা দিবসে এই একই ভদ্রলোক লালকেল্লার জাতীয় অনুষ্ঠানকে এড়িয়ে দলীয় অনুষ্ঠানে চলে গিয়েছিলেন। আমার মনে হয় প্রতিষ্ঠান ও পরম্পরার ওপর বারবার এই আঘাত আসলে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপরেই আঘাত। রাজনীতিকে যদি এত নিচু স্তরে নামিয়ে আনা হয় যেখানে সরকারি অনুষ্ঠানকে অন্য পক্ষের দলীয় অনুষ্ঠানের মতন তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা উপহাস বা অবজ্ঞা করা যেতে পারে, তাতে সংবিধানকে কতদূর শ্রদ্ধা বা তার প্রতি কতটা নিষ্ঠা প্রদর্শিত হয়, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। 

আমি জানি না যে দলটি ৬০ বছর দেশের শাসনভার সামলেছেন, তাঁরা আজ এত বেসামাল কেন। এমনটা তো আগে ছিল না - তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরসিংহ রাও ভারতের পক্ষ রাখতে তৎকালীন বিরোধী নেতা শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে জাতিসংঘের জেনারেল এসেম্বলিতে পাঠিয়েছিলেন। সংবিধান প্রধান বিরোধীপক্ষকে যে ভূমিকা দিয়েছে তাঁরা যদি তা ঠিকমত পালন না করেন তাহলে সেই ভূমিকা যে তাঁরা অচিরেই হারিয়ে বসবেন, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই কারণ গণতন্ত্রের ওই স্তরে শূন্যস্থান পূরণ হতে বেশিক্ষন সময় লাগে না। 

বিরোধীপক্ষ হয়তো এই ভেবে খুশি হচ্ছেন যে সরকার অপদস্থ হচ্ছেন আর সরকারপক্ষ হয়তো এই ভেবে আনন্দিত যে দেশের সামনে বিরোধীদের নেতিবাচক ভূমিকা প্রকাশিত হচ্ছে কিন্তু আখেরে এতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে, সংসদ নামক মহান প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতি হচ্ছে, জনপ্রতিনিধিত্ব সম্পর্কেই প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিচ্ছে আর গণতান্ত্রিক পরম্পরার প্রতি সম্মান ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে এঁরা অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পর্ককেও একইভাবে তলানিতে এনে ফেলেছেন - এতটাই যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৭৩তম জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতেও অনেকে অক্ষম। 'দোল দোল দুলুনি রাঙা মাথায় চিরুনি' করতে করতে কখন যে ক্ষতিটা মাত্রাছাড়া হয়ে যাবে, নিজেদের ক্ষুদ্র রাজনীতি নিয়ে মশগুল এই মানুষগুলো হয়তো আজ বুঝতেও পারছেন না।

Tuesday, September 12, 2023

সফলতার চাবি

যদিও আগে একাধিকবার পড়েছি, তবু আজ সকাল থেকে সেই প্রিয় বইটিই আবার পড়ার চেষ্টা করছি যদিও চোখের কারণে খুবই মন্থরগতিতে পড়তে হচ্ছে। বইটির নাম The Divine Life, পূজ্যপাদ স্বামী যতিস্বরানন্দজি মহারাজের লেখা। আসলে লেখা না বলে সংকলন বলাই ভালো যেখানে ৭৮ পৃষ্ঠার এক দীর্ঘ introduction লেখার পর পূজনীয় মহারাজ গীতা, উপনিষদ, ভাগবত, মনুস্মৃতি, পুরাণ ইত্যাদি নানা শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে নানা শ্লোক তুলে তুলে একত্রিত করে এক আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় structure তৈরি করেছেন। 

Introduction ছাড়া মোট ১৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত ছোট একটি বই, অসাধারণ বই, সবসময় সঙ্গে রাখার মতন বই। বইটার বক্তব্য আত্মস্থ করতে গেলে অন্তত বার কয়েক পড়তে হবে আর জীবনে যাঁদের দেখেছি, ভালো মন্দ indifferent, তাঁদের সাথে এবং অবশ্যই নিজের আচরণের সাথে শ্লোকগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে হবে, তবে theory আর practice এর মধ্যে কোথায় মিল আর কোথায় গরমিল আর তার ফলে একজন মানুষ ঠিক কি ধরণের legacy রেখে গেছেন বা তৈরি করছেন, তা স্পষ্ট বোঝা যাবে। 

প্রায় গোটা পঞ্চাশেক মানক আছে আধ্যাত্মিক জীবনে অগ্রগতির জন্য কিন্তু আমি নিজের মতো করে তার মধ্যে থেকেই শুধুমাত্র স্বভাবগত কয়েকটিকে আলাদা করে নিয়েছি নিজের ও অপরের আচরণকে সহজে analyse করার জন্য। এখন এই একই মানকগুলি ধরে ধরে যদি আমরা দুটি আলাদা আলাদা field এর আলাদা আলাদা দুজন বিখ্যাত ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পর্য্যালোচনা করি - ধরা যাক শ্রী নারায়ণমূর্তি এবং শ্রী রাহুল গান্ধীর, তাহলে মানুষ হিসেবে তাঁদের অগ্রগতি কতটা, তাও খানিকটা বোঝা যাবে আবার নিজে কতটা পিছিয়ে আছি সেটাও বোঝা যাবে। আমার দুর্ভাগ্য যে এই ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়ে আমি এই শরীরে আর মনু সংহিতা পড়তে পারলাম না, পারলে হয়তো আরো কিছু শিখতে পারতাম।

মানকগুলি হলো:
কর্মযোগী বনাম ফলপ্রত্যাশী
বিশ্বাসী বনাম বোধহীন
প্রত্যয়ী বনাম নিয়তিবাদী
উৎসাহী বনাম উদাসীন
ত্যাগী বনাম অহঙ্কারি
বিবেকি বনাম ভয়ার্ত
সেবাব্রতী বনাম শ্লাঘাপূর্ণ
সংস্কারী বনাম অভব্য
সমাবেশী বনাম বিভাজনী
ধর্মবোধী বনাম অধার্মিক
আধ্যাত্মিক বনাম ভৌতিক
যে কাউকে, তা তিনি আধাত্মপথের যাত্রী হন বা নাই হন, কেবল মানুষ হিসেবে কেমন তা এই মানকগুলি ধরে ধরে চরিত্র বিশ্লেষণ করলে বুঝতে সুবিধা হবে এবং কার সঙ্গ কাম্য আর কোন ধরণের সঙ্গ ত্যাজ্য, সে বিষয়ে নির্ণয় নেওয়াও সহজতর হবে।

কেবল প্রথম মানকটি বুঝিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি - যিনি কর্মযোগী তিনি তাঁর সম্পুর্ন ফোকাসটি নিজের কাজের ওপরেই রাখেন যেমন ইনফসিস গড়ে তোলার সময় শ্রী নারায়ণমূর্তি নিজে বছরে ৩০০ দিন বাড়ির বাইরে থাকতেন অথচ ত্রিশ বছর নিজের পরিবারকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের বাইরে কোথাও ঘুরতে যাননি। এই ধরণের মানুষ resultএর ওপর ফোকাস করেন না - ওটা by product - বৃহত্তর selfless goal থাকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও তাই - যবে থেকে দলীয় বা সাংবিধানিক দায়িত্বে এসেছেন, তাও প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেল, একদিনও ছুটি নেননি কারণ ওনার কাছে দেশের জন্য কাজ করে যাওয়াটাই জীবনের লক্ষ্য।

কোনো ফললাভ লক্ষ্য থাকলে এমন নিরবিচ্ছিন্ন পরিশ্রম এঁরা করতে পারতেন না কারণ একজন সাধারণ মানুষ যে সামাজিক সন্মান, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার কথা কল্পনাও করতে পারেন না, সেটা তো অনেক আগেই ওঁরা পেয়ে গেছেন, তারপর এখনো এত খাটনির কি প্রয়োজন? আচ্ছা, মজার ব্যাপার হলো কেবল শাস্ত্রপথে থেকেও যে উচ্চতম জাগতিক সুখ ও সমৃদ্ধির প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে, এঁরা তারও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বটে। এঁদের দুজনকে চোখের সামনে দেখছি তাই এঁদের কথা বললাম নাহলে সফলতম কর্মযোগী হিসেবে আদি শঙ্করাচার্য্য থেকে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে পরম পূজনীয় ডাক্তারজি - অনেকের কথাই বলা যেত। একইভাবে যদি এক এক করে বাকি মানকগুলোর নিরিখেও নিজের ও মানুষের স্বভাব বিশ্লেষণ করা যায়, আপনেআপ দুধ কা দুধ ঔর পানি কা পানি হো জায়গা।

Saturday, September 2, 2023

মিথ্যেকথা

দেশে রাজনৈতিক পারদ যত চড়ছে তত চতুর্দিকে নেতাদের গলায় মিথ্যে কথার ফুলজুরি ফুটছে। আসলে আমাদের দেশে রাজনীতি বস্তুটাই এখনো একটা বিরাট বড় মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে - "গরিবের দুঃখে আমার বুক ফাটে" - সত্যি সত্যিই ক'জনের ফাটে ভাই? যাইহোক, যারা বলার তারা বলুক, আমরা সাধারণ মানুষ কি ব্যক্তিগত জীবনে মিথ্যাকথা না বলার অভ্যেস করতে পারি না? আমি চেষ্টা করে দেখেছি, খুব খুব কঠিন জিনিস। চতুর্দিকে মিথ্যে শুনতে শুনতে আর ছেলেবেলা থেকে অকারণে "খুচরো নেই", "বাড়িতে নেই", "টেলিফোন খারাপ", "পেট খারাপ", ইত্যাদি মিথ্যেকথাগুলোকে পারিবারিক স্বীকৃতি পেতে দেখে আমাদের এমন মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে আমরা বেশিরভাগ মানুষই আদতে এক একটি compulsive lier তৈরি হয়ে গিয়েছি। কাউকে খুশি করার জন্য মিথ্যা বলছি, কাউকে দুঃখ না দেওয়ার জন্য মিথ্যা বলছি, তাও নাহয় বোঝা গেল, কিন্তু অকারণে কেন? কোনো ট্রেনের অচেনা সহযাত্রীকে "আচ্ছা আবার দেখা হবে" বলে বিদায় দেওয়ার মধ্যেও যে মিথ্যে আছে, সেটা আমরা হয়তো বুঝতেও পারিনা, ওটাকে সামাজিকতা বলে সহজেই স্বীকার করে নিই। আর স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইচ্ছে করে মিথ্যে কথা বলা তো আছেই, সারাদিন ধরে ক্রমাগত বলেই চলেছি। আমি একদিন চেষ্টা করলাম একটাও মিথ্যে বলবো না, পারলাম না। আবার পরদিন চেষ্টা করলাম, পারলাম না। আবার একদিন করলাম, আবার ব্যর্থ। তারপর লিখতে শুরু করলাম - যেই মিথ্যে বলি অমনি কি বললাম আর কেন বললাম লিখে রাখি। কিছুদিন পর পড়তে গিয়ে দেখলাম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিথ্যে কথা বলার প্রয়োজনই ছিল না, চুপ করে থাকলে বা সরে গেলেই হতো। সেদিন থেকে আমি বাকসংযমের উপকারিতা উপলব্ধি করতে পেরেছি। এখনো মাঝে মাঝে মিথ্যেকথা বলি, তবে আগের তুলনায় অনেক অনেক কম। হয়তো লুকিয়ে মিষ্টি খেয়ে ধরা পড়ে গেলে এখনো হাবেভাবে না জানার ভান করি আর মনেপ্রাণে চেষ্টা করি যাতে স্পষ্টভাবে "আমি খাইনি" বলতে না হয়, তবে বকুনি খাবার ভয়ে অনেকসময় বলেও ফেলি, which I regret later, এইরকম আরো কত কিই। অন্যের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিথ্যে কথা বলা আর ক্ষমতা, যশ ও অর্থলাভের লোভের বশে রাজনীতি করা সমগোত্রীয় - যে কোনো ভদ্রলোকের জীবনে একেবারেই unacceptable - ওটা বর্জন করা গেছে অনেকদিন আগেই। কিন্তু মিথ্যেকে এখনো যাপন থেকে পুরোপুরি বর্জন করা যায়নি - তবে চেষ্টা চলছে।

Thursday, August 31, 2023

শি জিন পিং এবং জি২০

চীনের ১৮ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির গল্পটা কেবল গল্পই, আসলে ওটা খুব বেশি হলে ৭.৭৫ট্রিলিয়ন, তাতেও কিঞ্চিৎ জল মেশানো থাকতে পারে। দেঙ্গ জিয়াও পেং যে রাস্তায় হেঁটেছিলেন তাতে সত্যি সত্যিই চীন একদিন ১৮ট্রিলিয়নে পৌঁছত কিন্তু তাতে ধীরে ধীরে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র সিসিপির হাত থেকে টেক জারদের হাতে চলে যেত। মুস্কিল হলো কম্যুনিস্ট একনায়করা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে চিরকাল সিঁটিয়ে থাকেন কারণ ওটাই ওঁদের এলিট বিলাসবহুল জীবনযাপনের একমাত্র চাবিকাঠি।

ফলে শি জিন পিং দেশের অগ্রগতির সর্বনাশ করে চীনকে আবার মাওয়ের রাস্তায় নিয়ে চলেছেন, অর্থনীতিতে যার ভয়ঙ্কর প্রতিফলন ইতিমধ্যেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চীনের ৭.৭৫ট্রিলিয়নের অর্থিনীতির তুলনায় রাষ্ট্রীয় ঋণ সাড়ে পাঁচ গুণ বেশি, তার ওপর জিরো কোভিড পলিসির জন্য সাপ্লায়ার হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতাও তলানিতে এসে ঠেকেছে, ফলে ভবিষ্যতে চীনের আবার উঠে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম। 

এমত অবস্থায় শি বা এই ধরণের অটোক্র্যাটদের হাতে ব্রাভাডো ছাড়া করে দেখানোর মতন খুব একটা কিছু থাকে না। তাই 'বসুধৈব কুটুম্বকম' শব্দের ওপর আপত্তি জানানো থেকে নিয়ে সম্ভাব্য জয়েন্ট স্টেটমেন্টের শব্দবন্ধ নিয়ে নানা ব্যাগড়া দেওয়া থেকে নিয়ে দালাল বুড়োখোকাকে লাদাখে পাঠিয়ে ভারতের কতটা জমি চীন কব্জা করে রেখেছে সেটা তার মুখ দিয়ে বলিয়ে কৌশলে নেহেরু, ইন্দিরা আর রাজীবের অপদার্থতাকে সেনা ও মোদীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করার পর ঠিক জি২০ শুরুর আগেই একটা মনগড়া ম্যাপ জারি করে খানিকটা হওয়া গরম করার চেষ্টা করে ভারত এবং আসিয়ান দেশগুলি থেকে চূড়ান্ত ঝাড় খেয়ে শেষে মিটিং ছেড়েই পালিয়ে গেলেন। 

এমনিতেও ভারতে চীনের ডাল আর গলছে না। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিক্সের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মোদীজি শিকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে যতক্ষণ না চীন গোটা ৩৪৪০ কিমি লম্বা এলএসি জুড়ে ২০১৩র আগের অবস্থানে ফিরে না যায়, ততক্ষন অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা হবে না। ইতিমধ্যে আদানি নিঃশব্দে বিশ্বজুড়ে ভারতের হয়ে ভারতীয় বেল্ট এন্ড রোড তৈরি করে চলেছেন, যা আটকাতে সোরস এবং চীন মরিয়া কিন্তু অপারগ। চীন আমাদের শত্রু নয়, সিসিপি আমাদের শত্রু - এটা যেন আমরা না ভুলি। যেদিন সিসিপির অবসান হবে সেদিন শত্রুতাও শেষ হয়ে যাবে। 

দেঙ্গের পরবর্তী প্রজন্মের নেতারা চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি থেকে নিজেদের ক্ষমতা আহরণ করতেন কারণ অবশেষে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পেয়ে সাধারণ গরিব মানুষ খুশি ছিলেন। শি-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো হয়ে গেছে, কারণ ওঁর ভ্রান্ত পলিসির জন্য চীন এখন অর্থনৈতিক অবনতির শিকার এবং দেশজুড়ে ডিফ্লেশনের সাথে পাল্লা দিয়ে বেকারত্বও মাত্রাছাড়া। এই অবস্থা বেশিদিন চলতে পারেনা, শি বা সিসিপির পতন অনিবার্য। 

আসলে সর্বক্ষেত্রে বিফল শি জিন পিং আর বিশ্বনেতৃত্বের সামনে মুখ দেখানোর মতন অবস্থায় নেই, বিশেষত ৭.৮% হারে জিডিপি বৃদ্ধির সুফল ভোগকারী ভারতীয় জনগণের সামনে তো নয়ই, আমেরিকা এবং ইউরোপের সামনেও নয়। মাওবাদী কম্যুনিস্ট শি স্রেফ লজ্জায় ভারতে আসছেন না। একদিকে কম্যুনিসমের ব্যর্থতা আর অন্যদিকে গণতন্ত্রের সাফল্যের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত আজকের ভারত - জি২০ থেকে পালিয়ে গিয়ে না চাইতেও বিশ্বকে শি জিন পিং দুটি বিপরীতধর্মী মতাদর্শের ব্যর্থতা বনাম সাফল্যের বার্তাই দিয়ে গেলেন।

Friday, August 4, 2023

তিনটি শব্দ

ভারতকে ইন্ডিয়া বলা বন্ধ হোক;
পূজাকে প্রার্থনা বলা বন্ধ হোক;
পন্থকে ধর্ম বলা বন্ধ হোক।

- ভারত এক প্রাচীন রাষ্ট্র, ইন্ডিয়া একটি দেশ;
- পূজা মানে দেবার্চনা, প্রার্থনা মানে আবেদন;
- পন্থ মানে মতবাদ, ধর্ম মানে আদর্শ জীবন যাপনের জন্য মূল্যবোধভিত্তিক সনাতন দার্শনিক মানদণ্ড।

প্রতিদিনের ব্যবহারিক প্রয়োগে এক্ষুনি এই তিনটি শব্দের পরিবর্তন না হলে শাশ্বত ভারত খুব শিগগির শিগগির আবার জেগে উঠবে না।

এই পরিবর্তন হলে কি হবে?

১. ভারত মানে এক বিরাট ইতিহাস : ইতিঃ হ আস্ : 'ইতিঃ' মানে এই রকম, 'হ' মানে নিশ্চয়, 'আস্' মানে ছিল - ভারত বললেই জনমানসে তাঁদের পূর্বপুরুষের সত্যিকারের অতুল কীর্তি পুনর্জাগরিত হবে। সেই ইতিহাস কি রকমের? 'ধর্মার্থকামমোক্ষাণাম উপদেশ সমন্বিতম্, পূর্ববৃত্তকথোপিতম্, ইতিহাসম্ প্রচক্ষ্যতে' - ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষলাভের উপদেশ সমন্বিত, পূর্বের বৃত্তান্ত যেখানে বলা আছে, সেটাই আসল ইতিহাস। অর্থাৎ ইংরেজ আর বামপন্থীদের দ্বারা তৈরি করা ইন্ডিয়ার দাসত্বের মেকি ইতিহাস নয়, প্রাচীন ভারতের ধর্ম আধারিত জীবনযাপনকারী জনগণের সত্যিকারের উপলব্ধি ও গৌরবগাথা, যা ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও databaseএর কাজ করবে। কোথাকার কোন আরাকোশিয়ার বাসিন্দা (বর্তমানে কান্দাহারের উত্তরপশ্চিম কোণে অবস্থিত আর্ঘ্যান্দব) মূলগ্রীকদেশীয় রাজদূত মেগাস্থেনিস পাটুলিপুত্রে (বর্তমানে পাটনা) সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের রাজসভায় এসে সম্রাটকে স্যান্ড্রকোটাস আর ভারতকে ইন্ডিয়া নাম দিয়ে দিলেন আর আমাদের সমস্ত পূর্বইতিহাস মুহূর্তের মধ্যে myth বা গল্প হয়ে গেল - মজা নাকি?

২. পূজাস্থল আর প্রার্থনাস্থল এক নয়, ফলে হিন্দুর মন্দির আর অন্য প্রার্থনাগৃহসমূহ সমগোত্রীয় নয়। প্রার্থনা তো এয়ারপোর্ট, হোটেল, রাস্তাঘাটে - যেখানে ইচ্ছা করা যায়, পূজা একমাত্র বিধিবদ্ধভাবে বিধিসম্মত উপায়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহেরই করা যায় এবং যতক্ষণ বিধিসম্মতভাবে তাঁর বিসর্জন না হচ্ছে, সেই পূজাস্থলের মালিক তিনিই থাকেন (আইনি ভাষায় বলে তিনি forever minor), তাতে মন্দিরের stucture থাকলো কি না থাকলো, মায় বিগ্রহ স্বয়ং সেখানে থাকলেন কি না থাকলেন, কিছু আসে যায় না। হিন্দুদের পূজা এবং বাকি মতাবলম্বীদের প্রার্থনার মধ্যে মূল পার্থক্যকে গুলিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রটি বুঝতে হলে হিন্দুদের মন্দিরের বিশেষত্বকে বুঝতে হবে, যা অন্য মতাবলম্বীদের প্রার্থনাগৃহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্যই নয়। মন্দির এমন একটি উর্যাক্ষেত্র যেখানে স্বয়ং ঈশ্বর বাস করেন, যেখান থেকে সেই উর্যা আহরণ করে মানুষ আধ্যাত্মপথে অগ্রসর হতে পারেন, সেটি ঈশ্বরের কাছে সুখ শান্তি সমৃদ্ধি ইত্যাদির জন্য আবেদনস্থল ও সামাজিক কর্মাদির জন্য মণ্ডপমাত্র নয়।

৩. সারা বিশ্ব জুড়ে বহু পন্থ অর্থাৎ religion এসেছে আর গেছে, পন্থ অর্থাৎ পথ চিরস্থায়ী নয়। আজকের পরিবেশে অনুসন্ধিৎসুর যেটিকে আদর্শ পথ বলে মনে হচ্ছে, কয়েক হাজার বছর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্যদের তা নাও মনে হতে পারে; পারস্য, মেশোপটেমিয়া, আরব, গ্রীস, মিশর বা পেগানদের ইতিহাস ঘাঁটলেই এর প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়। কিন্তু ধর্ম সনাতন, আদি এবং অন্তহীন, চিরসত্য, চিরনির্ভর। ধর্ম সেই সনাতন মূল্যবোধ যা সর্বযুগে সমাজকে ধারণ করে। তাই ধর্মের ওপর যদি আঘাত আসে তখন সর্বশক্তি দিয়ে তাকে রক্ষা করতে হয়, কারণ ধর্মহীন জীবন পাপের, জন্তুরও অধম। ধর্ম নষ্ট হলে সে ধর্মনষ্টকারীকেও নাশ করে তাই ঋষিরা বলছেন, 'ধর্ম এব হতো হস্তি ধর্মে রক্ষতি রক্ষিত:, তস্মাৎ ধর্মে ন হস্তব্যে মা নো ধর্মে হতো বধীৎ' - ধর্মকে যদি তুমি রক্ষা করো তাহলে ধর্মই তোমাকে রক্ষা করবে। আর যদি তুমি ধর্ম থেকে বিচ্যুত হও, ধর্মই তোমার নাশ করবে। পথ বদলায় কিন্তু ধর্ম বদলায় না, ঠিক যেমন খাদ্যাভ্যাস পাল্টায় কিন্তু ক্ষুধা বদলায় না।

হিন্দুস্থান প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুদের বাসভূমি, সনাতন ধর্মের সূত্রগুলি অর্থাৎ পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-বেঠিক, অধিকার-অনধিকার, কর্তব্য-অকর্তব্য, ভালো-মন্দ, গ্রহণযোগ্য-ত্যাজ্য ইত্যাদির মানদন্ড এখানেই উন্মোচিত হয়েছে এবং ব্যবহারিকরূপে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই হিন্দু সংস্কৃতিতে মতান্তর কখনোই মনান্তরের কারণ হতে পারেনা এবং এখানে যত্র জীব তত্ৰ শিব। বেদ বলছেন "একং সৎ বিপ্রা বহুদা বদন্তি"(যা সৎ তা এক, পন্ডিতেরা তা নানা নামে অভিহিত করেন)। , যে পন্থ সনাতন ধর্মাশ্রয়ী নয়, অর্থাৎ পরপন্থদ্বেষী, সেই পন্থগুলির এই ভারতরাষ্ট্রে কোনো স্থান নেই।

Thursday, August 3, 2023

কে জানে কালী কেমন

মান্না দের অনবদ্য কণ্ঠে সাধক রামপ্রসাদের লেখা একটি কালীকীর্তন শুনছিলাম, 'কে জানে কালী কেমন? ষড়দরশনে না পায় দরশন ৷৷ মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন ।' বড় সুন্দর, বড়ই সুন্দর এই গান। যোগের দিকটা ছেড়ে আমার কেবল মনে হলো সত্যিই তো, মা কালী আসলে দেখতে কেমন? তিনি কালো না নীল, তাঁর গলায় মুন্ডমালা না জবার মালা, তাঁর হাত দুটি না চারটি, তাঁর পরণে লাল বেনারসি না তিনি বস্ত্রহীনা, তাঁর পায়ে কি মল থাকে আর সেগুলি কি ঝম ঝম করে বাজে, ইত্যাদি। 

কালী কেমন জানতে গেলে তো সাধনায় অনেক দূর যেতে হবে, যেটা তাঁরই কৃপা ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি দেখতে কেমন, সেটি তো যাঁর যাঁর তাঁর তাঁর বিষয়। রামপ্রসাদের কাছে তিনি ছোট একটি মেয়ে হয়ে এসেছিলেন, যিনি তাঁকে বেড়া বাঁধতে সাহায্য করতেন। শ্রীশ্রীমায়ের কাছে তিনি এক আদিবাসী যুবতী কন্যা হয়ে এসেছিলেন, যিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে অসুস্থতা চলে যায় আর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তিনি মাতৃরূপা, বোধে সদাজাগ্রতা, একাধারে জননী এবং জগ্গজননী। ভাবছিলাম আমাকে যদি মা কালী কোনোদিন কৃপা করে দর্শন দেন, কি রূপে তিনি আমার সামনে আসবেন, বা বলা ভালো কোন রূপে আমি তাঁকে দেখতে চাইবো, এইসব আরকি। 

যতক্ষণে এইসব ভাবছি ততক্ষণে রামপ্রসাদী শেষ হয়ে আমার হেডফোনে শ্রীমৎ স্বামী সর্বজ্ঞানন্দজি মহারাজের গাওয়া অন্য গান বাজতে শুরু করেছে,
'দেবী প্রসন্নবদনে করুণাবতারে দিব্যোজ্জ্বলদ্যুতিময়ী ত্রিজগজ্জনিত্রি।'
ব্যাস, যেই দেবীর এই অপূর্ব বর্ণনা কানে গেল, ঝপ করে ১৯১৩ সালে ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথের তোলা শ্রীশ্রীমায়ের সেই ছবিটা মনের মধ্যে বিদ্যুতের মতন জ্বলে উঠলো, যেখানে জয়রামবাটিতে পুরানো বাড়ির দাওয়ায় তিনটি কাঠের খুঁটির মাঝামাঝি জায়গায় তিনি বসে আছেন, পাদুটি উঠোনে পাতা, তার পায়ের দুই তর্জনীতে দুটি লোহার আঙ্গট, হাতদুটি কোলের উপর জোড় করা, দুহাতে ঠাকুরের উপহার দেওয়া গঙ্গাপাড়ে সীতামাঈর হাতে দেখা ছিলেকাটা বালাজোড়া, পরণে সরু লালপেড়ে সাদা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, গলায় দুছড়া রুদ্রাক্ষের জপমালা, মুখে স্মিত হাসি, দাওয়ায় মায়ের পেছনদিকে একটা খুঁটের ওপর গোটাকয়েক ধানের বস্তা। 

এই তো আমার মা কালীর সত্যিকারের রূপ, কল্পনা নয়, একেবারে জলজ্যান্ত, যাঁর পাদপদ্মে মাতৃময় শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সমস্ত সাধনার ফল, মায় নিজের জপমালাটি পর্য্যন্ত নিবেদন করেছিলেন! জ্ঞানপথে এঁকে বুঝতে গেলে মুলাধার থেকে সহস্ররার পর্য্যন্ত উঠতেই হবে আর সহজে পেতে গেলে একবার সর্বশক্তি দিয়ে 'মা' বলে ডাকলেই হলো, কিছুতেই দূরে দূরে থাকতে পারবেন না, একেবারে দুহাত বাড়িয়ে আগলাতে চলে আসবেন। আহা, কি সুন্দরই না গানটা! তিনি ত্রিজগতের জননী, তাঁর শরীর থেকে এক দিব্য উজ্জ্বল দ্যুতি নির্গত হয়ে চারপাশে এক জ্যোতিবলয় সৃষ্টি করেছে (যা ওই ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও স্পষ্ট দেখা যায়), তিনি করুণার প্রতিমূর্তি আর শ্রীমুখমন্ডল জুড়ে যেন এক অপার্থিব প্রসন্নতা। আমার মন জানে কালী কেমন। 

মা আসলেই শক্তির বিভিন্ন রূপ ধারণ করে বিভিন্ন সময়ে হাতেগোনা কয়েকজন ভক্তকে কৃপাদর্শন দিয়েছেন, এটা কোনো কল্পনার বিষয় নয়, যদিও তিনি নিজের দৈবী স্বরূপকে ঢেকে রাখতে প্রাণপন চেষ্টা করতেন। এমনই একটি ঘটনা একবার শারদীয় দুর্গোৎসবের সময়কার। মা সেবার পুজোর ঠিক আগে বিষ্ণুপুরের সেনবাড়ি হয়ে কলকাতা যাত্রা করবেন। সঙ্গে বাঁকুড়ার বিভূতি ঘোষ, ডাক্তার মহারাজ প্রমুখ। এমন সময় সেন বাড়িরই অধীরেশ্বর নামের এক কিশোর বায়না ধরলে মায়ের সাথে কলকাতা যাবে। সে কখনো কলকাতার দুর্গাপ্রতিমা দেখেনি, এবারে প্রাণভরে দেখতে চায়। নানাভাবে ছেলেকে বোঝানো-ভোলানোর চেষ্টা হল। বাড়ির কর্তারা নানারকম সুখাদ্যের লোভ দেখালেন। তাতেও কাজ না হলে কড়া ধমক দেওয়া হলো কিন্তু অধীরেশ্বর একেবারেই নাছোড়বান্দা। তখন মা নিজেই তাকে অন্য একটি ঘরে নিয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে মা বেরিয়ে এলে সবাই তো থ। যে কিনা তিষ্ঠোতে দিচ্ছিল না কাউকে, এরই মধ্যে একেবারে সুবোধ বালক হয়ে গেছে! মা হেসে বললেন, “ছেলেমানুষকে কি বকতে আছে? ওরা তো বায়না করবেই… আদর করে ভোলাতে হয়।” এর বেশ কয়েক বছর পর, মা তখন আর নশ্বর দেহে নেই, এক দুর্গাপুজোয় আবার সেই অধীরেশ্বর বিভূতিবাবুর গৃহে এসেছেন। তাঁকে প্রতিমা দর্শনের জন্য ডাকা হলে তিনি বললেন, “জ্যাঠামশাই, আমি আর দুর্গাপ্রতিমা দর্শন করি না। শ্রীশ্রীমা যে জ্যান্ত দুর্গা দর্শন করিয়েছিলেন, সে মূর্তির পর আর কোনো মূর্তিই মনে ধরে না।”