Monday, September 19, 2022

রানী ও আমরা

আজ ব্রিটেনের প্রয়াত রানীর রাষ্ট্রীয় অন্তেষ্টিতে চার্চে যে সব ভাষণ হলো তাতে তাঁকে এক বিশেষ ধারার খ্রিষ্ট পন্থাবলম্বীদের রক্ষাকর্ত্রী এবং একজন পরম খ্রিষ্টান বলে বারেবারে সম্বোধিত করা হলো। দিন দশেক আগে যখন রাজা তৃতীয় চার্লস দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তখন গোটা প্রিভি কাউন্সিলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনিও নিজেকে defender of the faith বলেই অবিহিত করেছিলেন এবং স্কটল্যান্ডের চার্চের রক্ষক হিসেবেও শপথ নিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য faiths নয় কিন্তু, faith এবং সেই faith অবশ্যই খ্রিষ্টান পন্থের একটি ধারাবিশেষ, যাকে protestant বলে। 

অর্থাৎ ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি অন্যান্য এমন কিছু দেশেরও রাষ্ট্রপ্রধান যেখানকার মূল জনজাতিরা খ্রিষ্ট পন্থাবলম্বী নন, তিনি সমস্ত পন্থ তো দূর, খ্রিষ্টানদেরই অন্য ধারাগুলির রক্ষক নন। এত কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে রাজা এবং তাঁর দৌলতে রাষ্ট্রের একটি বিশিষ্ট পন্থীয় ধারা থাকা স্বত্তেও ব্রিটেনকে কি কেউ theocratic রাষ্ট্র বলে? বলে না তার কারণ রাষ্ট্রশক্তি বিভিন্ন পন্থাবলম্বীদের মধ্যে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করে না, দুর্ভাগ্যজনকভাবে যা অনেক ইসলামিক দেশেই সরকারিভাবে করা হয়ে থাকে। 

এখন প্রশ্ন হলো যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান স্বয়ং নিজেকে একটি মাত্র পন্থের রক্ষাকর্তা হিসেবে সরকারিভাবে শপথ নেওয়া স্বত্তেও রাষ্ট্র পন্থনিরপেক্ষ থাকতে পারে, সেখানে ভারতবর্ষের বেলায় শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ইত্যাদি পন্থাচারের প্রাধান্যকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র প্রাচীনকাল থেকে প্রবাহমান ধর্মবোধ এবং একীভূত সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে কেন? প্রবঞ্চনার মাধ্যমে সংবিধানে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া socialist আর secular শব্দগুলির জেরে এখন কি আমরা খুব ভালো আছি? ওগুলোর মধ্যে কি আমাদের existential ethos আছে?

এই যে এত মারামারি কাটাকাটি - সেসব কিসের জন্য? মতবাদ-অসহিষ্ণুতার জন্য, যা ভারতীয় সংস্কৃতিতে কস্মিনকালে ছিল না, পুরোটাই বিজাতীয় পন্থের সাথে সাথে আমদানিকৃত। অর্থাৎ, অন্য অপসংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যত আমরা আমাদের সহিষ্ণু, সংস্কারমুক্ত, সদাচারী জীবনবোধ থেকে সরে গেছি, তত আমাদের অনেকের মধ্যে অন্যের মতকে সন্মান দেওয়ার প্রবণতা কমেছে এবং সেই সাথে নিজের মতকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। 

পন্থ যার যার কিন্তু ধর্ম সবার। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজে থাকতে গেলে এবং সততার সাথে নিজের নিজের কর্তব্য নির্বাহ করতে গেলে গোটা সমাজে ভালো-মন্দের মাপদন্ড একটাই হওয়া উচিত - আমাদের পূর্বপুরুষ হাজার হাজার বছর ধরে মাজাঘষা করতে করতে যার একেবারে একটা perfect model তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন, যাকে আমরা হিন্দুধর্মবোধ বা হিন্দুত্ব বলি। ভারতকে আবার অর্থ কাম এবং মোক্ষলাভের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে গেলে ফের সেটাই করতে হবে যেটি আমাদের পূর্বপুরুষ অনুসরণ করে হাতে হাতে সুফল পেয়েছিলেন - ধর্মীয় হতে হবে। পন্থীয় নয় কিন্তু, ধর্মীয়। আর তার জন্য প্রথমে আমাদের হিন্দুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার কারণ অন্য কোনো সভ্যতায় 'ধর্ম' বলে কোনো বস্তু নেই, আছে কেবল পন্থ বা religion। 

আমাদের রাষ্ট্র যদি সত্যি সত্যিই পন্থনিরপেক্ষ হতে চায়, তাহলে তাকে সত্যিকারের ধর্মনিষ্ঠ হতেই হবে। আর সত্যিকারের ধর্মনিষ্ঠ হতে গেলে মনে প্রাণে সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দু হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায়ই নেই, কারণ অন্য কোনো সংস্কৃতিতে ধর্মের কোনো প্রতিশব্দই নেই যে। সারা বিশ্বজুড়ে মানুষ আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে protestant মতানুসারে পালিত একজন protestant নারীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখছেন, কারণ সেটাই সমীচীন। যদি নিজেদের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার কারণে বিভিন্ন মতানুসারে রানীর একটা খিচুড়ি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হতো, সেটা বরং ভড়ং হতো। আমরা গত ৭৫ বছর ধরে এই মিথ্যে ভড়ংটাই করে আসছি, আর না। আমাদেরও শিকড়ে ফেরার সময় হয়ে গেছে। আমাদের রাষ্ট্রের জন্য হিন্দুত্ব ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানক নেই। জয় মা ভারতী, জয় হিন্দুরাষ্ট্র।

Tuesday, September 6, 2022

দেবী দুর্গা

দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবী ভাগবত - এইসব পুরাণ ও উপ-পুরাণে দেবী মাহাত্ম্য আলোচনা করা হয়েছে। তাতে মা দুর্গার নামের বর্ণনা এইভাবে করা হয়েছে:
দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।

অর্থাৎ, "দ" অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, "গ" অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
(পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৪)

এই দশপ্রহরণধারিনি দুর্গা রূপে ভগবতী দেবী পার্বতী দুর্গমনাশিনী। তিনি মহাযোগিনী। বন্ধুবর শ্রী সৈকত বসু মহাশয় দেবীসূক্তের এক অসামান্য যৌগিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তাঁর এক লেখায়: 'মহিষ বেশী অসুর মদগর্ব বা অহঙ্কার-এর প্রতীক। দেবীর মূল অস্ত্র ত্রিশুূল ইড়া পিঙ্গলার সুষুম্নার প্রতীক । এই ত্রিশুল মহিষাসুর এর হৃদয় বিদীর্ণ করছেন।  মানে অনাহত চক্র জয়ের প্রতীক।  মনিপুর চক্রের তত্ব জল। তাই দুর্গা জল হতে উদ্ভূতা। 

দুর্গা শরীর নামক দুর্গে স্থিত তাই তিনি দুর্গা।  তিনি ভ্রুযুগলের মধ্যে স্থিত তাই তিনি গুহাবাসীনিম।  তিনি বিন্দুতেও স্থিত তাই তিনি বিন্দুবাসীনিম। প্রথম কুম্ভক পদ্মনাভিতে এবং পূজক পুস্পাঞ্জলি দেবেন  তার নাভিপদ্মে।  দ্বিতীয় কুম্ভক অনাহতে এবং পূজক পুস্পাঞ্জলি দেবেন অনাহত চক্রে এবং শেষ পুস্পাঞ্জলি মস্তকে অথবা ব্রহ্মরন্ধ্রে।  এবার তিনি দেবীকে আবাহন করবেন ঘট পূর্ণ জলে।  দেবীর তত্ব জল। ঘটের ওপর শীর্ষযুক্ত ডাব।  ডাব জরায়ুর প্রতীক। দেবী জগৎ প্রসবিনী।'  

প্রচলিত দুর্গা বানানটি আমাদের বাড়িতে ব্যবহৃত হয়না যদিও দুর্গা = দুর্গ + স্ত্রী, 'দুঃখে প্রাপ্যা'; দেবীবিশেষ। আমরা বিজয়ার দিন গোটা পরিবার একশআটবার 'শ্রী শ্রী দূর্গা সহায়' লিখি কারণ আমাদের পূর্বপুরুষরা ওই বানানই নির্দিষ্ট করে গেছেন। তার কারণ দূর শব্দটি হলো বিশেষণ {দূর্ + √ই + র (রক্)} যার অর্থ মনোবাক্যের অতীত আর 'গা' হলো বিশেষ্য, গাত্র, দেহ, শরীর। অর্থাৎ যিনি অব্যক্ত, তিনি যখন শরীর ধারণ করে মর্তে আগমন করেন, তিনিই দূর্গা।

আবার অন্যদিকে শ্রীবিষ্ণুর যে অবতার অকাল বোধন করে এই আশ্বিনমাসের দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন, আদি শঙ্করাচার্য্যের টীকা অনুসারে (রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী তপস্যানন্দের অনুবাদ) "রাম" শব্দের অর্থ হলো যোগীরা যাঁর সঙ্গে রমণ (ধ্যান) করে আনন্দ পান, সেই পরব্রহ্ম বা সেই বিষ্ণু, যিনি দশরথের পুত্ররূপে অবতার গ্রহণ করেছিলেন। আবার সন্ত কবিরদাস তাঁর দোহায় চার রকমের রামের কথা বলেছেন "এক রাম দশরথ কা বেটা, এক রাম ঘট ঘট মে বৈঠা; এক রাম কা সফল পাসারা, এক রাম হ্যায় সবসে ন্যায়ারা।"

মানে একজন রাম যিনি দশরথ পুত্র অর্থাৎ রাজা, যাঁকে আমরা "মর্যাদা পুরুষোত্তম" বলি, অর্থাৎ, "শ্রেষ্ঠ পুরুষ" বা "আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিপতি" বা "গুণাধীশ"। দ্বিতীয় রাম যিনি প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আছেন অর্থাৎ সাক্ষাৎ ঈশ্বর। তৃতীয় রাম যিনি সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডময় প্রসারিত অর্থাৎ স্রষ্টা। আর চতুর্থ রাম যিনি সবচেয়ে অপূর্ব এবং আশ্চর্যময় অর্থাৎ যিনি সমস্ত কল্পনার অতীত সাক্ষাৎ পরব্রহ্ম।

রামবতারে লক্ষ্মীদেবীই সীতাদেবী। মা লক্ষ্মীর অপর নাম শ্রী। শ্রীবিষ্ণু, শ্রীরাম আর সীতারাম বা সিয়ারাম তাই একই। অর্থাৎ যুগলে লক্ষ্মী আর বিষ্ণু। বিভিন্ন শব্দবন্ধে ওঁদের জয়ধ্বনিও ওই একই যুগলের জয়ধ্বনি, কোনো পার্থক্য নেই। যাহা জয় শ্রীরাম তাহাই জয় সিয়ারাম। মূলত মা দুর্গা এবং শ্রীরাম একই আদিশক্তির ভিন্ন প্রকাশ, যিনি যে ভাবে দেখতে চান, দেখতে পারেন। এসব নিয়ে বৈষ্ণব এবং রামায়িতদের সাথে অযথা অনবগত বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।

পরম বৈষ্ণব শ্রীজীব গোস্বামী ভাগবতের ব্যাখ্যায় বলেছেন - যঃ কৃষ্ণ সৈব দুর্গা স্যাৎ যা দুর্গা কৃষ্ণ এব সঃ (শ্রী জীব গোস্বামী , ব্রহ্ম সংহিতা -টীকা -ধৃত গৌতমীয় কল্পবচন) অর্থাৎ যিনি কৃষ্ণ, তিনিই দুর্গা; যিনি দুর্গা, তিনিই কৃষ্ণ; ওনারা অভিন্ন। শক্তিমান ও শক্তি যেমন অভিন্ন, সেই ভাবেই, কৃষ্ণ ও দুর্গা এক ও অভিন্ন। তিনি আরও বলেছেন, অতঃ স্বয়মেব শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ শক্তিরুপেন দুর্গানাম অর্থাৎ শক্তিরূপিণী দুর্গার নামই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ। স্বয়ং নিত্যানন্দ প্রভুর বাড়িতে আজও জাঁকজমক করে দুর্গা পুজা হয়। 

স্বয়ং মহাপ্রভু মা দুর্গার রুপ ধরে ভক্তদের দর্শন দিয়েছেন (চৈতন্য ভাগবত, ১৮ অধ্যায়)। তাহলে বৈষ্ণবে আর শাক্তে প্রভেদ কোথায়? বৈষ্ণবদের সবথেকে প্রধান শাস্ত্র ভাগবত পুরাণে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর যোগমায়া শক্তি দুর্গাকে বলছেন, তুমি পৃথিবীতে নানা নামে পূজিত হবে এবং ভক্তগণ নানা পূজা সামগ্রীর দ্বারা তোমার আরাধনা করবে (ভাগবত, ১০/২/ ১০-১২)। মহাভারতের যুদ্ধের পূর্বে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দুর্গা স্তব করতে আদেশ করেন (মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ২৩/ ৪-১৬)। স্বয়ং শ্রীহরি শ্রীরামরূপে যাঁর অকালবোধন করেন, তাঁর পূজার বিষয়ে দুই ধারার মধ্যে কিসের বিভেদ?

ইদানিং জায়গায় জায়গায় শান্তি ও সম্প্রীতির নামে দেবীমুর্তির হাতে অস্ত্রের বদলে ফুল গুঁজে দেওয়া হচ্ছে অথবা কার্তিকের বাহন পাল্টে ঘোড়া করে দেওয়া হচ্ছে, এতটাই 'ধর্মনিরপেক্ষ' হয়ে গেছেন কেউ কেউ। অনেকেই আবার এসব দেখে না বুঝে বাহবা দিচ্ছেন, বিশেষতঃ তাঁদের জন্যই আজ দুর্গাপূজার প্রাক্কালে মাদুর্গার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

ঋকবেদে স্বয়ং দেবী নিজের স্বরূপ উদঘাটন করতে গিয়ে বলছেন,
অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিযানাম্ ।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশযন্তীং ।।.. ৩.. দেবীসুক্তম
(আমি রাষ্ট্রী, রাষ্ট্রের অধিশ্বরী, রাষ্ট্রারক্ষার্থে যে সম্পদের প্রয়োজন আমি তার বিধানকারীনী, সংসারে শান্তিলাভের জন্য যে ব্রহ্মজ্ঞান প্রয়োজন আমিই তা দান করতে পারি, আমি বহুরূপে সর্বভূতে শক্তিরূপে বিরাজ করি, দেবতাদের সব কাজই আমি সমাধা করতে পারি।)

বুদ্ধিজীবী, বৃত্তিজীবী, শৌর্যজীবী ও শ্রমজীবী, রাজ্যচালনায় এই চারটি শ্রেণী অপরিহার্য এবং মা দুর্গাকে ঘিরে তাই যথাক্রমে বুদ্ধিবৃত্তির প্রতীক বিদ্যাদেবী সরস্বতী, ব্যবসাবৃত্তির প্রতীক ধনদেবী লক্ষ্মী, ক্ষত্রিয়শৌর্য্যের প্রতীক দেবসেনাপতি কার্তিক এবং গণ বা জনশক্তির প্রতীক সিদ্ধিদাতা গণেশ। মা স্বয়ং রাষ্ট্রের অধিশ্বরী, তিনি স্বয়ং শক্তিস্বরূপিনী এবং একচালায় গোটা দুর্গা পরিবারটি হলো সম্পূর্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক। 

এক হিসেবে আমাদের দুর্গাপূজা আসলে রাষ্ট্রশক্তিস্বরূপা স্বর্গাদপি গরীয়সী জননীর পূজা, বিশ্বাস না হয় উপরোক্ত ঋকবেদের দেবীসুক্তমের তৃতীয় সুক্তটি পড়ুন যেখানে দেবী স্বয়ং নিজেকে 'অহং রাষ্ট্রী' বলে পরিচয় দিচ্ছেন। দেবী ত্রিনয়নী, তাঁর একটি নয়ন চন্দ্রস্বরুপ, একটি সূর্যস্বরুপ এবং তৃতীয়টি অগ্নিস্বরুপ, অর্থাৎ তিনি সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের প্রতীক। তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই নিয়ন্ত্রিত হয় রাষ্ট্রের ত্রিকাল। দেবী দশভূজা, কারণ দশদিশার তিনি অধিশ্বরী, যা রাষ্ট্রের ব্যাপ্তির পরিচায়ক। দশদিশা মানে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, অগ্নি, বায়ু, নৈঋত, ঊর্ধ্ব এবং অধঃ। 

তাঁর ডানদিকের পাঁচ হাতে পাঁচটি অস্ত্র এবং বামদিকের পাঁচ হাতে চারটি অস্ত্র এবং একটি ঘন্টা। দেবী যা যা ধারণ করে আছেন তার প্রত্যেকটির প্রতীকী তাৎপর্য আছে। ডানদিকের হাতের অস্ত্রগুলি হল: মা ত্রিগুনময়ী এবং ত্রিতাপহরণী তাই ত্রিশূল, অবিদ্যানাশিনী তাই খড়্গ, সংসারচক্র থেকে মুক্তিদায়িনী তাই সুদর্শন চক্র, মায়ের কৃপায় পরমব্রহ্মে লীন হওয়ার লক্ষ্য ভেদ হয় তাই বান, আর মা কামনানাসিনী তাই কুঠার বা ক্ষেত্রবিশেষে গদা। বামদিকের হাতের অস্ত্রগুলি হল: মা আশ্রিতের পরম আশ্রয় এই বোধ থাকা প্রয়োজন তাই খেটক বা বর্ম, ঈশ্বর উপলব্ধিতে গতিশক্তির প্রয়োজন তাই ধনুক, অসংযত মনকে শান্ত রাখা প্রয়োজন তাই নাগপাশ, অহংকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন তাই অঙ্কুশ আর মা শব্দব্রহ্মময়ী, নাদধ্বনির মাধ্যমেই সৃষ্টির সূচনা, তাই মায়ের হাতে ঘন্টা। 

এককথায় বলতে গেলে দেবীর ডানদিকে কার্য্য আর বামদিকে কারণ। দেবী সিংহবাহনা কারণ তামসিক পশুশক্তির অধিপতি পশুরাজ সিংহ তাঁর বশে আর মহিষাসুর কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যরূপী দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক, তাই বধ্য। গোটা কাঠামোটি পরিবেষ্টিত চালচিত্রে সবার মাথার ওপর দেবাদীদেব মহাদেব, তিনি সদাশান্তম, তিনি মঙ্গলময়তা, ঔদার্য ও স্থিরত্বের প্রতীক, অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রগুরু। তাই তো স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, "মনে রাখবে তোমরা জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত"। কে এই মা? অবশ্যই জননী জন্মভূমি।

এই সূত্রেই কার্তিকের প্রসঙ্গে বিশেষরূপে আসা প্রয়োজন কারণ কার্তিকপূজাকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালীদের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি আছে। দেব সেনাপতি কার্তিক বা মুরুগণ বা সুব্রহ্মণ্য ঠাকুরের অপর নাম হচ্ছে ষড়ানন অর্থাৎ ছয়টি মুখ যাঁর। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো মানব জীবনের ষড়রিপু- কাম (কামনা), ক্রোধ (রাগ), লোভ (লালসা), মদ(অহং), মোহ (আবেগ) এবং মাৎসর্য (ঈর্ষা)কে সংবরণ করে দেব সেনাপতি কার্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে সদাজাগ্রত ও সচেতন থাকেন, তার বাহ্যিক প্রতীকিকরণ। আর তাঁর বাহন হলেন ময়ূর কারণ প্রাণীটি অত্যন্ত কর্মঠ ও সদাচঞ্চল এবং সর্পভক্ষী। এই সর্পটি আসলে অহংবোধ, যা তিনি আগেই গ্রাস করে নেন বলে কার্তিকের পক্ষে ষড়রিপুদমন করা সহজ হয়, তিনি জীবনযুদ্ধে সর্বদা জয়ী হন। আদর্শ রাষ্ট্র আসলে একটি পুণ্য ধর্মক্ষেত্র এবং তাকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য। সেইজন্যই দেবতাদেরও একজন বীর সেনাপতির প্রয়োজন হয়।

শক্তি আরাধনা ছেলেখেলার বস্তু নয়, দুর্গাপূজাও নিছক কোনো শারদোৎসবও নয়, একদম একশ শতাংশ খাঁটি হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান। সবশেষে আবার বলি, ঋকবেদের দশম মণ্ডলের ১২৫তম সূক্তটিতে দেবী আদ্যাশক্তি ভগবতীর স্বরূপ ও মহিমা প্রকাশিত। সূক্ত শব্দের মানে সু-উক্ত, বিশেষ ভাবে যেটি বলা হয়, তাই সূক্ত। বৈদিকস্তোত্রকে সূক্ত বলা হয় আর মাতৃস্তোত্রগুলিকে ঋকবেদে দেবীসূক্ত বলে। দেবীসূক্তেই মা চণ্ডীর দৈবী মাহাত্ম্য বীজাকারে প্রচ্ছন্নভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, চাইলে গোটাটা পড়ে নিতে পারেন। তান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে ছেলেখেলা করলে তন্ত্রধারক ও তাঁর পরিবারের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

দেবী প্রসঙ্গে একসময় পূজ্যপাদ স্বামী সোমেশ্বরানন্দজী মহারাজের একটি লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, সেটি এখানে উদ্ধৃত করার প্রয়োজন বোধ করলাম:
'দুর্গা মানে যাকে জানা কঠিন। দুঃ=কঠিন। গ=যাওয়া। যেমন দুর্গে (fort) ঢোকা কঠিন। দুর্গম, যেখানে যাওয়া কঠিন। দুর্গের সাথে আ-কার যোগ করে দুর্গা। মাকে জানা বা পাওয়া খুবই কঠিন। তাই তাঁর নাম দুর্গা।

মায়ের দশ হাত। অর্থাৎ দশদিকেই তিনি রয়েছেন, সর্বত্রই তাঁর অস্তিত্ব। পাশে শিব, সাথে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। মায়ের কৃপায় সাধক সবকিছু পান। শিব বা ব্রহ্মজ্ঞান যেমন পাওয়া যায়, তেমনি লাভ করা যায় বিদ্যা, সম্পদ, শৌর্য, সিদ্ধি। চণ্ডীতে আছে, সুরথ ও সমাধি একই সাথে তপস্যা করেছিলেন। কিন্তু মায়ের বরে সুরথ ফিরে পেলেন তার রাজ্য, সমাধি লাভ করলেন ব্রহ্মজ্ঞান।

মাতৃমন্ডপে কলাগাছ? অনেকে বলেন গণেশের বউ! না। একে নবপত্রিকা বলা হয়। সাত রকম গাছ। পত্রিকা=যার পত্র (পাতা) আছে তাকে বলে পত্রিকা। কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, দাড়িম, অশোক, মান ও ধান। নবদুর্গার অন্য রূপ। এরও পুজো হয়। কেন? বলছি তা একটু পরে।

মন্ডপে মায়ের প্রতিমা মাটির। আর অষ্টমীর দিনে কুমারী পুজো। মাকে পুজো করা হচ্ছে গাছ, মাটি, মানুষ রূপে। মাটি জড়, গাছ যেন জড় ও জীবের মধ্যে (প্রাণ আছে কিন্তু সচল নয়), আর কুমারী হলো মানুষ। অর্থাৎ মাকে তিন রূপে আবাহন করা হয়। বিভিন্ন রূপে তিনিই রয়েছেন সর্বত্র।

মাতৃপ্রতিমার সামনে ঘট রাখা হয় কেন? ঐ ঘট হলো ভক্তের প্রতীক। ঘট=শরীর। ঘটের মধ্যে জল=মন (mind)। ঘটের মুখে আম পাতা= ইন্দ্রিয়। আর জলের নীচে রাখা সোনা (gold) = জীবাত্মা। অর্থাৎ সমবেত ভক্তদের প্রতীক এই ঘট। 

দেবতাদের সমবেত শক্তির ফলে মায়ের আবির্ভাব। অর্থাৎ ঐক্যই শক্তি। আজ সমাজে ভাল লোকেরা, সৎ মানুষেরা কেন নিজেদের অসহায় মনে করে? কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ নয় যেখানে অসৎ লোকেরা দলবদ্ধ। চণ্ডীর তাৎপর্য এটাই। সংঘে শক্তি কলৌ যুগে = কলিযুগে সংঘবদ্ধ হলেই শক্তি।

মায়ের হাতে অস্ত্র কেন? কারণ ভাল লোকদের হাতেই অস্ত্র থাকা দরকার। তারাই সঠিক প্রয়োগ করতে সক্ষম। অসৎ লোকের হাতে অস্ত্র সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর।

শিবের তেজে সৃষ্টি হলো মায়ের মুখ। শিব সারাক্ষণ ধ্যানস্থ। অর্থাৎ কঠিন পরিস্থিতি এলে শান্ত মনে তার মোকাবিলা করতে হয়, এই শিক্ষাই দেওয়া হচ্ছে এখানে।

বিষ্ণুর তেজে মায়ের হাত। বিষ্ণু স্থিতি বা পালনের দেবতা। এর তাৎপর্য, আমাদের কর্মের দ্বারা জগতের বা সমাজের কি কোনো উপকার হচ্ছে অথবা শুধু নিজের জন্যই কাজ করি? যদি অন্যদের উপকারের জন্য হয় তবে তা দিব্য কর্ম।

ব্রহ্মার তেজে মায়ের পা। চলতে হয় পদক্ষেপ নিতে নিতে। ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা। কিন্তু আমাদের পদক্ষেপ বা কাজ কি সৃজনশীল (creative) ? চণ্ডীর উপদেশ, গতানুগতিক কাজের উপরে উঠে সৃষ্টিশীল হও।

শিব নিজের শূল দিলেন মাকে। ত্রিশূল অর্থাৎ সত্ত্ব, রজ, তম। এই তিনের উপরে উঠতে পারলেই প্রকৃত জ্ঞান লাভ হবে। দন্ডের একমুখে ত্রিশূল, অন্যমুখে এক শূল। জগতের দুই রূপ। একদিকে ত্রিগুণের খেলা, অন্যদিকে অদ্বৈত অনুভব। মহিষাসুর ত্রিগুণে মত্ত ছিল বলে মা তাকে এক শূল দিয়ে মুক্তি দিলেন।

বিষ্ণু নিজের চক্র দিলেন মাকে। চক্র অর্থাৎ সংসারের আবর্তন। চক্র সবসময়েই ঘুরছে, পরিস্থিতি বদলাচ্ছে সর্বদা। কিন্তু চক্রের মাঝে যে ছিদ্র, ঐ কেন্দ্রে আঙ্গুল রাখলে স্থির থাকা যায়। চণ্ডীর উপদেশ, শ্রীরামকৃষ্ণের মতই, বুড়ি  ছুঁয়ে খেলা করো, বাসা পাকড়ে রঙ দেখো। অর্থাৎ ঈশ্বরকে ধরে কাজ করো।

ব্রহ্মা মালা দিলেন। এই মালা ফুলের নয়, রুদ্রাক্ষের মালা। সাধনার মালা। তাৎপর্য? মানুষের জীবন এক সাধনা। পশু জন্ম থেকেই পশু, পাখী ডিম ফুটে বাইরে বেরিয়েই পাখী। কিন্তু মানুষ জন্মের পর এক জীব মাত্র। তাকে সাধনা করতে হয় মনুষ্যত্ব লাভের জন্য। এই কথারই ইঙ্গিত চণ্ডীতে।'