Blog Archive

Saturday, December 31, 2022

কল্পতরু


তাঁর শরীরটাই কেবল চোখের সামনে নেই, ফলে ইচ্ছে করলেই আমরা আর তাঁকে বাইরে দর্শন করতে পারিনা। কিন্তু সূক্ষ্মশরীরে তিনি রয়েছেন আমাদের চেতনায়, আমাদের গোটা অস্তিত্ব জুড়ে, ফলে তিনি সর্বদা ধ্যানগম্য। যেই আমরা অন্তর্মুখী হৈ এবং তাঁকে স্মরণ করি অমনি তাঁর অমৃতস্পর্শ হৃদয়ে অনুভব করা সহজেই সম্ভব হয়। তিনি নিজের মুখে হয়তো সকলের সাথে কথা বলেন না কিন্তু লিখিত আকারে তাঁর বাণী আমরা নিরন্তর শুনতে পাই কথামৃত বা লীলাপ্রসঙ্গ বা তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদদের স্মৃতিকথার মাধ্যমে। 

তিনি যে এখনো সূক্ষ্মশরীরে সাক্ষাৎ আছেন তার অজস্র প্রমাণ ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে - বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতেও বহু মানুষ তাঁকে নিজেদের চোখ দিয়ে দেখেছেন, কেউ কেউ হয়তো এখনো দেখেন, তাঁর নির্দেশ পান। রাজা মহারাজের শিষ্য এবং সেবক সুয্যি মহারাজ অর্থাৎ পরম পূজ্যপাদ স্বামী নির্বাণানন্দজী মহারাজের যখন শেষের দিক, তখন তাঁর দিনক্ষণ ইত্যাদির বোধ চলে গিয়েছিল। এমন হতো যে তিনি হয়তো তিনদিন ধরে ঘুমাচ্ছেন আবার তারপর টানা তিনদিন সমানে জেগে আছেন। এ হেন সুয্যি মহারাজ হঠাৎ তাঁর নিজের এক জন্মদিনে সেবককে বলছেন তাঁকে চান টান করিয়ে দাঁড়ি কামিয়ে পরিষ্কার জামা পরিয়ে দিতে কারণ সেদিন অনেক লোক তাঁকে দেখতে আসবেন, খুব আনন্দ হবে। 

সেবক সব জেনেও ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করলেন যে আজ কি কোনো বিশেষ দিন? তখন সুয্যি মহারাজ উত্তর দিলেন যে ঠাকুর এসে তাঁকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বলেছেন যে আজ মহারাজের জন্মদিন, শিষ্যরা সব আসবেন, খুব আনন্দ হবে, তাই তিনি যেন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেন। তিনি পাত্তা না দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কিন্তু ঠাকুর দ্বিতীয়বার তাঁকে ঠেলে তুলে একই কথা বলাতে, তাঁর মনে হয়েছে যে সত্যি সত্যিই আজ তাঁর জন্মদিন এবং তাই তাঁর ফিটফাট হয়ে থাকা প্রয়োজন। শেষের দিকে মাঝেমাঝেই মহারাজ তাঁর সাথে ঠাকুরের সূক্ষ্মশরীরের কথোপকথন প্রকাশ করে ফেলতেন, এ সব এখন যাঁরা বেলুড় মঠের সিনিয়র সাধু, তাঁরা ব্রহ্মচারী অবস্থায় নিজেদের কানে শুনেছেন। 

এগুলো কোনোটাই miracle নয়, এ বাস্তব সত্যি। ঐ যে সেদিন বরানগরে সেই আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে ঠাকুর সবাইকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন 'চৈতন্য হোক', সেটা কি দেশ কালের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল? অবতারতত্ত্ব কি এতোই হালকা আর এতটাই অল্প তার দায়রা? হয় কখনো? সেই কবে শ্রীকৃষ্ণ শরীরে এসেছিলেন, আজও সারা বিশ্বজুড়ে তাঁর নাম নিয়ে মানুষ জীবনের দিশা খুঁজে পাচ্ছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের ক্ষেত্রেও তো আমরা তাই দেখি। কোথায় আমেরিকা, কোথায় ইউরোপ, কোথায় আফ্রিকা, কোথায় অস্ট্রেলিয়া আর কোথায়েই বা বাকি এশিয়া - সর্বত্র তাঁর মন্দির, সর্বত্র প্রতিদিন বেদান্তের চর্চা হচ্ছে, সর্বত্র মানুষ প্রতিদিন তাঁর পুণ্যনামে আকৃষ্ট হয়ে জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছেন। 

এখন তাঁকে চোখে দেখতে গেলে সঙ্ঘগুরুর মধ্যে তাঁর সচল বিগ্রহ যে কেউ যে কোনোদিন চাইলেই দেখতে পারেন আর সাধনজীবনের যে কোনো প্রশ্নের উত্তরও তাঁকে বেলুড় মঠের ঠিকানায় চিঠি লিখলেই জবাবে আসে। আজকের এই বিশেষ দিন, যাকে ভক্তরা কল্পতরু উৎসব বলেন, সেটি কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আনন্দ উৎসবই নয়, সেটি গোটা প্রাণী জগৎ যাতে আত্মদর্শন করে জীবনের উদ্দেশ্য সফল করতে পারে, তার জন্য একজন জাগ্রত, present and contemporary অবতারের শুভ আশীর্বাদ। তিনি বর্তমান, তাঁর aura বর্তমান, তাঁর উপস্থিতি বর্তমান - He is a living God. এখনো বহুদিন ঠাকুরের সূক্ষ্মশরীর থাকবে, ফলে তাঁর আশীর্বাদ এখনো অনেক প্রজন্ম ধরে মানুষের ওপর বর্ষিত হবে, যেমনটি এই মুহূর্তে আমাদের সকলের ওপর হচ্ছে। খালি আমাদের মাথা পেতে সেটি গ্রহণ করার অপেক্ষা মাত্র। 

জয় শ্রীগুরুমহারাজজী কি জয়। জয় মহামায়ী কি জয়। জয় স্বামীজী মহারাজজী কি জয়।

Friday, December 30, 2022

নতুন ভারত


মাত্র কয়েক শ বছর আগেও, ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে, আমাদের দেশে জনসংখ্যা আজকের তুলনায় এক ভগ্নাংশ হওয়া স্বত্তেও সে সময়ে দেশের মোট সাড়ে সাত লক্ষ গ্রামে সাত লক্ষ বত্রিশ হাজার গুরুকুল ছিল, ভারতবাসী মোটেও অশিক্ষিত ছিলেন না। ইংল্যান্ডে ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে যখন প্রথম পাব্লিক স্কুল খোলে, ভারতে তখন already সাত লক্ষের ওপর গুরুকুল বর্তমান আর ম্যাকলে যখন উত্তরভারতে G.W. Luther আর দক্ষিণভারতে Thomas Munroe কে দিয়ে সার্ভে করিয়েছিলেন তখন তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী সে সময়ে উত্তর ও দক্ষিণভারতে সাক্ষরতার হার ছিল যথাক্রমে ৯৭% এবং ১০০%। তখনো জাতের নামে বজ্জাতি শুরু হয়নি। 

তার আগের কথা, অর্থাৎ নালন্দা আর তক্ষশীলার মতো বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা তো নাহয় ছেড়েই দিলাম, যার মাধ্যমে আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা বহু দেশকে জীবনের রাস্তা দেখাতো, গ্রামেই দেশজ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এক ধর্ম আধারিত সুখী জীবনযাপনের সমস্ত ব্যবস্থা মজুত ছিল। মাত্র কয়েক শ বছর আগেও ভারতে কেউ বেরোজগার ছিলেন না, কোনোদিন কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি আর আজকের ভাষায় যাকে আমরা বিদেশিমুদ্রা অর্জন বলি, তাতেও পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি এলেম আমাদেরই ছিল। 

আজ, এত ইংরিজি শিক্ষা, শিল্পায়ন, উন্নত জীবনধারা ইত্যাদির পর সেদিনের চেয়ে দশগুন বেশি জনসংখ্যার জন্য সারা দেশে মোট ইস্কুলের সংখ্যা কত? না পনেরো লক্ষ নয় হাজার - গ্রামের দিকে ১২.৫ লক্ষ আর শহরের দিকে ২.৫ লক্ষ। এখন, আধুনিক বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত, অতীতের 'native backwardness'কে ঝেড়ে ফেলে পাশ্চাত্যের 'enlightened forwardness'কে আঁকড়ে ধরে 'উন্নত' হয়ে ওঠা দেশে ২৫% মানুষ নিরক্ষর, ৮% মানুষ সম্পূর্ণ বেকার (underemployed কত ঈশ্বরই জানেন) আর সরকার বিনা পয়সায় রেশন না দিলে ১২.৫% মানুষ না খেতে পেয়ে মরে যাবেন। 

তাহলে মাত্র কয়েক শ বছর আগেকার আত্মনির্ভর ভারত কোথায় হারিয়ে গেল? দুর্ভাগ্যবশত বিদেশি ঔপনিবেশিক শক্তি এবং মার্ক্সবাদী মিথ্যুকদের fake propagandaর আড়ালে তাকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল, যাকে জাতীয়তাবাদীরা আবার ধুলোটুলো ঝেড়ে নতুন করে সামনে নিয়ে আসছেন। আবার নতুন করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন ভারতে পর্যটক বা ছাত্র হয়ে আসা বিদেশিদের লেখাপত্তর প্রকাশিত হচ্ছে, OECD দেশগুলির সহায়তায় Prof. Angus Maddison-এর মতন বিদেশি রিসার্চারদের গবেষণার ভিত্তিতেই ডঃ শশী থারুর বা ডঃ জয়শঙ্করের মতন ভারতীয় বোদ্ধারা অক্সফোর্ড কেমব্রিজ বা হার্ভার্ডে গিয়ে সত্যিটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরছেন and the world is taking note of it. 

প্রাক ঔপনিবেশিক ভারত মানেই যেন অশিক্ষিত, না খেতে পাওয়া, পন্থান্ধ, কুসংস্কারগ্রস্ত, জাত-পাত দীর্ন, নোংরা regressive একটা দেশ, যাকে সাদা চামড়ারা এসে মানুষ করার অনেক চেষ্টা করেও হতোদ্যম হয়ে শেষে খ্যামা দিয়েছে - এমনই একটা গল্প প্রচার করা হয়েছে এতদিন, মার্ক্সীয় ভারতধারণা যার থেকে আলাদা কিছু নয়। ভুল, সম্পুর্ন ভুল। কোটি কোটি বছর ধরে দৈহিক বিবর্তনের পর মানব এসেছে। আর যেদিন থেকে পৃথিবীতে মানব এসেছে সেইদিন থেকে বিবর্তনের ধারাটি বৌদ্ধিক হয়ে গেছে। প্রস্তর যুগ থেকে নিয়ে আজকের যুগ পর্য্যন্ত গোটা মানবসভ্যতার বৌদ্ধিক বিকাশে যদি সবচেয়ে বেশি কারো contribution থেকে থাকে তাহলে সেটি এই ভারতীয় সভ্যতার, যাদের সম্পদ লুট করার জন্য ইচ্ছে করে সেই জাতিকেই যারপরনাই vilify করা হয়েছে। 

মহাদেবের কৃপায় এতবছর পর সঠিক দিশা পেয়ে ভারত যে এখন আবার নতুন করে জাগছে, আত্মানুসন্ধান করছে, এতে গোটা বিশ্বেরই কল্যাণ হবে কারণ ভারত আবার মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রচুর value add করতে শুরু করবে, যেমনটি সে ঘুমিয়ে পড়ার আগে বহু হাজার হাজার বছর ধরে করে এসেছে। আমার খুব বড় একটা regret যে মোদিজির সরকারের আট-নয় বছর হয়ে গেল, এখনো আমাদের বাচ্চাদের সেই পুরনো ম্যাকলের মিথ্যাই পড়ানো হচ্ছে, নতুন শিক্ষানীতি অত্যন্ত শ্লথ গতিতে লাগু হচ্ছে। সেদিন বিক্রম সম্পথের অভিমত শুনছিলাম, ওনারও একই বক্তব্য। শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনটি সরকারের অনেক আগে এবং অনেক দ্রুত সেরে ফেলা উচিত ছিল।

Thursday, December 29, 2022

শরণাগতি


দুদিকে যেন দুটো সমান্তরাল জগৎ - বাইরে আর ভেতরে, শরীরে আর মনে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আর বোধগ্রাহ্য অবস্থার। দুদিকেই জীবনধারণ, তবে আপাতদৃষ্টিতে দুরকমের মনে হলেও, আসলে হয়তো নিরবিচ্ছিন্ন। সামনে যা দেখছি, শুনছি, চাখছি, অনুভব করছি তা তো সত্যি বটেই, সেসবের জন্য ভেতরে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, সেটাও তো একইরকমের সত্যি, অস্বীকার করার উপায় নেই। 

বাড়ির বাইরে দুটো লোক তারস্বরে চিৎকার করে ঝগড়া করছে, ইচ্ছে না থাকলেও তাদের বৃত্তান্ত শুনতে হচ্ছে, যা পড়ছি তাতে মনোনিবেশ করায় ব্যাঘাত ঘটছে, বিরক্ত হচ্ছি, মনে হচ্ছে বাইরে গিয়ে বলি বাবারা, একটু অন্যত্র গিয়ে চেঁচান - সবটাই তো সত্যিকারের experience। আমি তো চাইলেও আর নিজেকে পারিপার্শ্বিক থেকে সম্পূর্ণভাবে insulate করে ফেলতে পারছি না, যে কোনো কিছুই আর মনকে effect করে না, তাই সবটাই আমার নিজস্ব সত্যিকারের অনুভূতি। ঝগড়া হচ্ছে বাড়ির বাইরে, ঝগড়া করছে অন্য কেউ আর প্রভাবিত হচ্ছি আমি - যার সঙ্গে সেই ব্যক্তিদ্বয় বা ঘটনার কোনো সম্পর্কই নেই - এটাকে মিথ্যা বলে এড়িয়ে যাই কিভাবে?

আবার, মন্দিরে গেছি, চোখের সামনে চাঁদোয়ার তলায় ফুলমালাশোভিত ঠাকুরকে দেখতে পাচ্ছি, প্রণাম করছি, তাঁর সামনে বসে আছি যাতে তাঁর নজর পড়ে আমার ওপর, চোখ বন্ধ করে তাঁর কথা চিন্তা করছি, একসময় নিজের ওপর তাঁর দৃষ্টি যেন feel করতে পারছি, এক গভীর প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে আমার মন - এটা যেমন সত্যি তেমনি ধ্যানে বসে আমি নিজের শরীরের বাইরে থেকে নিজেরই বুকের মধ্যে সেই ঠাকুরকে পদ্মাসনে বসা দেখছি - ভেতর বাইরে সব একাকার হয়ে যাচ্ছে - এও তো সত্যিকারের অনুভব। তবে এই দুটি ঘটনার মধ্যে একটা মূল পার্থক্য আছে - ঝগড়া আমার মনকে কষ্ট দিচ্ছে আর ঠাকুরের দর্শন বা ধ্যান আমায় আনন্দ দিচ্ছে। আর সাথে সাথে কোন অভিজ্ঞতাটি আমি চাইছি আর কোনটি চাইছি না, অর্থাৎ আমার বাইরের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে ভেতরে যে reaction তৈরি হয় সেটার acceptance ও rejection যেন মনের মধ্যে একটা অদৃশ্য ফিল্টারে ছেঁকে একেবারে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 

এর আর একটা দিক আছে। ইন্দ্রিয় দিয়ে যা কিছু আমরা শুষে নিচ্ছি, তা আদৌ প্রয়োজনীয় কিনা, হলেও কতটা, সেই প্রশ্ন মনকে বারেবারে নাড়া দেয়। কত rubbish ঢুকে মনকে clog করে দিচ্ছে, ভাবলে আশ্চর্য্য হতে হয় বৈকি। বাইরে ঝগড়া হচ্ছে দেখছি, শুনছি কিন্তু মনের ভেতরে গ্রহণ করেছি না - এই অবস্থায় পৌঁছনোর তীব্র ইচ্ছা তখন তৈরি হয়। অর্থাৎ যেটা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় সেটা আমি ইচ্ছা করলেই বাইরের দরজায় আটকে দিতে পারি আর যেটা প্রয়োজনীয়, কেবল সেটুকুকেই ভেতরে ঢুকতে দিতে পারি, এই ক্ষমতা যাতে তৈরি হয়, সেই দিকে নজর ঘুরে যায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যেখানে যা ঘটেছে সবই সত্যি, কিন্তু সব সত্যিতে তো আর আমার কাজ নেই, আমি শুধু সেটুকুই নেবো যেটুকু আমার কাজে লাগবে। 

এইখানে আবার তৃতীয় প্রশ্নটি জাগে - হ্যাঁগা, সেই কাজটি কি? সেটা নির্ভর করে আমি এই জীবনটাকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চাই, তার ওপর। মাষ্টারমশাই সংসারী ছিলেন তাই ঠাকুর মাস্টারমশাইকে সংসারে থেকে তিনটি কাজ করতে বলেছিলেন - সাধুসঙ্গ, নির্জনবাস আর বিচার। সাধুসঙ্গ মানে সাধুর সঙ্গে সুখদুঃখের গুলতানি করা নয়, সাধুর ভাব গ্রহণ করা। নির্জনবাস মানে me time, সেটা হিমালয়ের বনে গিয়েও হতে পারে অথবা ঘরের কোণে - আসল নির্জনতা তো মনে। আর বিচার মানে হলো সৎ আর অসৎ-এর মধ্যে কি সৎ বুঝে নিয়ে তার ওপর বিশ্বাস অর্থাৎ ইষ্টের ওপর সম্পুর্ন নির্ভরতা - আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী, এই ভাবকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে হৃদয়ঙ্গম করা। এখন, আমি যদি আমার জীবনটাকে ঠাকুরের দেখানো পথে চালিত করতে চাই তাহলে আমার জীবনে প্রয়োজন একরকম হবে আর যদি রাস্তায় বেরিয়ে ঝগড়া শুনতে চাই এবং ফোড়ন কেটে তাতে আরো ইন্ধন জোগাতে চাই, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যরকম হবে। প্রয়োজন যেহেতু আমার, কাজও যেহেতু আমি করবো, ফলে দায়ও আমার।

এর একটা চতুর্থ dimension ও আছে - আমি চাইলেই যে course control করতে পারবো, তার স্থিরতা কি? হ্যাঁ, এইটা একটা মস্ত বড় সমস্যা বটে। আমার ক্ষেত্রে যেমন, কত চাইছি বৈষয়িক বিষয় একেবারে ঝেড়ে ফেলে ঝামেলামুক্ত হতে কিন্তু হচ্ছি কই? কারণ আগের আগের জন্মে যেসব জট পাকিয়ে রেখে এসেছি সেসব তো আমাকেই খুলতে হবে, তাই না? একে বলে প্রারব্ধ। এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হলো মায়ের কৃপা - ক্রমাগত প্রার্থনা আর পীড়াপীড়িতে বিরক্ত হয়ে মা যদি একবার ছুট দিয়ে দেন, ব্যাস, কেল্লা ফতে। তবে এ এক মারাত্মক আবদার কিন্তু, বহুজন্মের তপস্যার ফলে কেউ কেউ সন্ন্যাসী হন, আর তাঁদের মধ্যেও এমন blissful state of existence মাত্র কয়েকজনের কপালেই জোটে। এমন বেয়াড়া আবদার বাপের কাছে করলে লাঠিপেটা খেতে হতে পারে। সেই জন্যই তো মায়ের কাছে যত বাজে আবদার - সাধনভজন কিছু নেই তবু ওই শান্ত অবস্থা চাই! 

এইবার ভেতর আর বাইরের মূল বিষয়। একবার স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে পায়েস খেতে দেওয়া হয়েছে, তাতে মহারাজ একটি চুল দেখতে পেয়ে খুব রেগে গেছেন। যেই জানতে পেরেছেন যে তাঁরই শিষ্য সুয্যি মহারাজ অর্থাৎ স্বামী নির্বাণানন্দজী সেটি রেঁধেছেন, রাগের চোটে রান্নাঘরে গিয়ে তাঁকে খুব করে মারছেন আর তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই মার খাচ্ছেন। স্বামী প্রেমানন্দজী গোলযোগ শুনে দেখতে এসে সুয্যি মহারাজকে বলছেন, "ওরে সুয্যি দাঁড়িয়ে আছিস কেন, পালা পালা"। সুয্যি মহারাজ যে উত্তরটি দিয়েছিলেন, সেটি এই ক্ষেত্রে শেষ কথা - "যেখান থেকে পালাবার ছিল পালিয়েই তো এসেছি, আর কোথায় পালাবো?"। ব্যাস, এই একটা কথাতেই জীবনের direction কি হওয়া উচিত তা যেন একেবারে জলের মতন স্বচ্ছ হয়ে যায়।

ভেবে দেখলে মায়ের কাছে যে কৃপা চাইছি সেটি আসলে শরণাগতি। সাধুর ভাব কি? শরণাগত, যাতে বাকি দুনিয়াদারী সব অপ্রাসঙ্গিক। নির্জন মন কেমন? শরণাগত, যেখানে দুনিয়াদারী ঢুকতে পারেনা। আর বিশ্বাস? সেও শরণাগতি - সব ছেড়ে তোমার আশ্রয়ে এসেছি, তুমি যেমন রাখবে তেমন থাকবো, যেখানে রাখবে সেখানে থাকবো আর আমি তোমায় ভুলে গেলেও তুমি আমায় ভুলো না। রাজা মহারাজ কেন শিষ্যকে মেরেছিলেন? গুরু বা ইষ্টকে কোনো কিছু নিবেদন করার আগে নিজেকে যেভাবে মন প্রাণ দিয়ে প্রস্তুত করতে হয়, সুয্যি মহারাজ সেদিন সেটি ভুলে গিয়েছিলেন। গুরু কিন্তু তাঁকে ভোলেননি। ভক্তের ওপর নিজের অধিকার তাই জোর করে কায়েম করেছিলেন। নিজের শরীর যাওয়ার ঠিক আগে রাজা মহারাজ তাঁর এই শিষ্যকে আশীর্বাদ করেছিলেন এই জীবনেই তাঁর ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হবে। পরবর্তীকালে গুরুর কৃপায় পরম পূজনীয় শ্রীমৎ স্বামী নির্বাণানন্দজী মহারাজের সত্যিসত্যিই তাই হয়েছিল।

Sunday, December 18, 2022

মন বিষানোর খেলা

সৌরভ গাঙ্গুলির কিশোরী কন্যার নাম করে ইনস্টাগ্রামে দেওয়া খুসওয়ান্ত সিংয়ের একটি উদ্ধৃতি হটাৎ করেই খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে সৌরভ টুইট করেছেন যে ওটি ওঁর কন্যার নয়, তার এখনো এসব বিষয় বোঝার মতন বয়স হয়নি এবং তাকে বিতর্কের বাইরে রাখাই উচিত। কন্যার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে উনি পিতার উপযুক্ত কর্তব্য করেছেন, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু বিতর্কের পেছনে এতটাই নোংরা এক অবক্ষয়ি রাজনীতি আছে, যে সর্বস্তরের অভিভাবকের পক্ষে সেটির উদ্দেশ্য এড়ানো সম্ভব নয়।

খুসওয়ান্তের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতি বিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। উনি চিরকাল ওঁর বিভিন্ন লেখায় এবং ২০০৩এর এই উদ্ধৃত বইতেও, ওনার কল্পনায় যা সঙ্ঘের দৃষ্টিতে এক আদর্শ ভারতের চিত্র হওয়া উচিত, সেই সম্পর্কে পাঠককে ভয় দেখিয়ে এসেছেন। ভারতের পূর্বগরিমার প্রতি সঙ্ঘের শ্রদ্ধা ও সাংস্কৃতিক রাষ্ট্র্ববাদের প্রতি বিশ্বাসকে ওনার মনে হতো পশ্চাদগামী। যেমন উনি কল্পনা করতেন যে দেশে সঙ্ঘের প্রভাব বিস্তৃত হলে এলোপ্যাথিক ডাক্তারের বদলে হয়তো মানুষ বৈদ্য দেখাতে বাধ্য হবেন ইত্যাদি, যেটি সানার নাম করে দেওয়া উদ্ধৃতির মধ্যেও আছে। ভদ্রলোক ২০১৪ মার্চ মাসে মারা যান, ফলে প্রথমবার বিজেপির বিপুল জয় এবং ২০১৯শে দ্বিতীয়বার বিপুলতর জয় উনি দেখে যেতে পারেননি। একজন সঙ্ঘপ্রচারক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যে ওঁর ভারতবর্ষ সারা বিশ্বের মধ্যে এলোপ্যাথিক ওষুধ রপ্তানিতে আজ অন্যতম প্রধান শক্তি, সেটাও ভদ্রলোক দেখে যেতে পারেননি। 

যাইহোক, প্রশ্নটা খুসওয়ান্ত সিংকে নিয়ে নয়, প্রশ্নটা হলো এক মারাত্মক মানসিকতাকে নিয়ে, যা সুপরিকল্পিতভাবে কোনো কিশোর-কিশোরীর অপরিণত নিষ্পাপ মনে বৈচারিক চেতনা গড়ে ওঠার আগেই তাকে বিষিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। যেহেতু সানার নাম করে পোস্ট করা হয়েছে, তাই উদাহরণস্বরূপ ওর বয়সীদের প্রতিনিধি হিসেবে ওর নাম করেই বলছি যে আমি নিশ্চিত সানা গাঙ্গুলি সঙ্ঘের দীর্ঘ ৯৪ বছর ধরে মানুষ গড়ার ইতিহাস জানে না, জানে না অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে যুক্তফ্রন্ট হয়ে বামফ্রন্টের মেকি বামপন্থার ইতিহাস, জানে না idea of India আর idea of Bharat-এর মধ্যে মূল বৈচারিক পার্থক্য কোথায়। এই বয়সে, এবং যে বিত্তশালী পরিবেশে ও বড় হচ্ছে, তাতে ওর এতসব জানার কথাও নয়। তাহলে হটাৎ কেন ওর নামে এই পোস্টটা দেওয়া হলো? কারণ একজন বিখ্যাত কিশোরীর নাম ভাঙিয়ে catch them young নামক রাজনৈতিক কালসর্প অবচেতনের লোহার বর্ম ভেদ করে যথাস্থানে পৌঁছবার ফন্দি এঁটেছে। যে মন দেশের পক্ষে ভালো মন্দ বিচার করার মতন পরিণতই নয়, তাতে রং লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা তাকে সারা জীবনের মতন অযৌক্তিক করে দেবে, তার নাকের ওপর রঙিন চশমাটা একদম চিরস্থায়ী করে দেবে। 

আপাতদৃষ্টিতে অপরিণত মন বিষানোর কাজটা হয়তো সোজা কিন্তু এর ফল বড় মারাত্মক। সেই কারণেই আজ যখন সারা দেশে ডানপন্থার জয়জয়কার, যে বাঙালির হাত ধরে আধুনিক ভারতে এই মতবাদের হাতেখড়ি, জাতীয়স্তরে তার নীতি নির্ধারণের জায়গায় আজ আর সেই বাঙালির অস্তিত্বই নেই। কারণ বাঙালির প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ডানপন্থীদের সম্পর্কে ঠিক সেই ভুল কথাগুলোই বোঝানো হয়েছে যা খুসওয়ান্ত সিং লিখেছেন। সানা গাঙ্গুলি একটি বাচ্চা মেয়ে হলেও, বিখ্যাত ব্যক্তির সন্তান বলেই এত হৈচৈ হচ্ছে। নাহলে কোনো অনামা বাচ্চা নিজের খেয়ালে কোথায় কি লিখলো না লিখলো বা বললো না বললো, তা নিয়ে কেউ মাথাই ঘামাত না। 

সব কিশোর-কিশোরী কিন্তু সানার মতন বিখ্যাত নয়। তারা নিজেদের মধ্যে কি আলোচনা করছে তা হয়তো তাদের অভিভাবকরাও খেয়াল করেছেন না। নীরবে সারা দেশ জুড়ে ভবিষ্যতের বিদ্বেষের রাজনীতির বীজ বোনা হয়ে চলেছে, অথচ আমরা বাবা-মায়েরা হয়তো জানতেই পারছি না। আমাদের সন্তান যেন সুস্থ চেতনার অধিকারী হয়, তারা বড় হয়ে যেন নিরপেক্ষভাবে যে কোনো বিষয়কে স্বচ্ছ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে নিজের হিতে, সমাজের হিতে সঠিক নির্ণয় নিতে পারে, অভিভাবক হিসেবে সেটাই তো আমরা চাই। এটা প্রত্যেক শিশুর অধিকারও বটে। 

আজ হটাৎ যখন যাদবপুরে আজাদীর স্লোগান শুনি তখন আমাদের মধ্যে অনেকেরই মনে হয় এরা কোন বিকৃত শিক্ষাব্যবস্থার শিকার? এদের দুর্বিনীত অভব্য অছাত্রসুলভ আচরণ অভিভাবকদের অনেককেই বিস্মিত করে। এগুলো কিন্তু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নিজেদের সন্তানের প্রতি আমাদের আরো বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। ওদের ওপর কোনো কিছুই চাপিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। চারদিকে বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা আর নিয়মিতভাবে জল আর সার দেওয়া, এটুকুই তো যথেষ্ট। বাকি মহীরুহ তার ব্যাপ্তিকে নিজের বীজের মধ্যেই লুকিয়ে নিয়ে এসেছে, সে ঠিক তার মতন করে বেড়ে উঠে একদিন সবাইকে ফুল দেবে, ফল দেবে, প্রয়োজনে ছায়াও দেবে।

Tuesday, December 13, 2022

একটু ঘুরে আসি

বয়সের সাথে সাথে মানুষের মন বোধহয় আরো বেশি নরম হয়ে পড়ে, আরো বেশি সংবেদনশীল, আরো আবেগপ্রবণ, মানসিকভাবে অনেক বেশি vulnerable - অন্ততঃ নিজের ক্ষেত্রে আমি সেটাই লক্ষ্য করছি। অজস্র শোক পেয়েছি জীবনে, অনেক আঘাত, তবে সে সবে খুব যে একটা প্রভাবিত হয়েছি এতকাল, তেমনটা কিন্তু নয়। হয়তো ছোটবেলা থেকেই দুঃখকষ্ট সয়ে সয়ে সহ্যশক্তি অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিল, যে কোনো অবস্থাতেই একা লড়াই করার মানসিকতা, ঘুরে দাঁড়াবার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ইত্যাদির ফলে কম বয়সে আঘাত কাটিয়ে ওঠাও সহজতর ছিল। এতদিন অতি নিকটজনের বিচ্ছেদও আমায় এতটা দিশাহারা করে দিতে পারেনি, চট করে সামলে উঠেছি। এবার আর যেন পেরে উঠছি না। কত চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই শোকের বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছি না। ঘুরে ফিরে বারেবারে বুকের ফাঁকা জায়গাটায় এক একটা ঢেউ ধাক্কা মারছে আর ভেতরটা পুরো হায় হায় করে উঠছে। একজন শ্রদ্ধেয় মহারাজ কথামৃতকার শ্রীমকে quote করে গতকাল তাঁর পোস্টে লিখেছিলেন 'ত্যাগের পথে বিঘ্ন, স্নেহ। স্নেহতেই সংসার চলছে। সংসারই স্নেহ। এইটি ঈশ্বরের চাতুরী। এ দিয়ে তিনি জগৎকে বেঁধে রেখেছেন।' পড়ার পর থেকে আমি ভাবছিলাম যে এ একেবারে সত্যি কথা, এ কথায় তো কোনো ভুল নেই। খালি মুশকিল হলো, যখন কিছুই পড়িনি, মায়া কি জানতাম না, তখন মন অনেক শক্ত এবং নির্দয় ছিল আর এখন যখন কিছু কিছু পড়া হয়েছে, অহংকার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, তখন মনটা যেন মাখা সন্দেশের মতন নরম তুলতুলে হয়ে গেছে যাতে স্নেহের অন্ত নেই - এবার কি করি? এখন কারো কষ্ট দেখলে বা কষ্টের কথা শুনলে ঝপ করে চোখে জল এসে যায়, কাউকে কোনো দুস্থের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে দেখলে চোখ ভিজে যায়, এমনকি রেডিওতে দুঃখের গল্প শুনলেও কান্না পায়, কিসের মায়া আর কিসের কি? যাইহোক, আমার আর এই বাড়িভর্তি স্মৃতির আবহাওয়ার মধ্যে থাকতে ভালো লাগছে না তাই আগামীকাল আমি আর গিন্নি দিন কয়েকের জন্য পালাচ্ছি। গতকাল শেষকৃত্য করতে নিয়ে যাওয়ার আগে লাড্ডুকে একটা সেন্ট মাখিয়ে দিয়েছিলাম। আজ সকালে ওই ঘরের দরজাটা খুলতেই সেই সেন্টের গন্ধটা ধক করে নাকে এসে লাগলো। আসলে ওই গন্ধটা থেকে পালাচ্ছি। পালাচ্ছি সকাল আর বিকেলের চায়ের সাথে বিস্কুটের প্যাকেটের প্রথম চারটে বিস্কুট থেকেও, যেগুলোকে আমরা বলতাম লাড্ডুট্যাক্স। পালাচ্ছি নিজেদের থেকে, নিজেদের যন্ত্রণাদায়ক familiar living space থেকে আর নিজেদের এতদিনের অভ্যেস থেকে - যে অভ্যেসের বশে এখনো ভুল করে বেশি ভাত ফুটিয়ে ফেলা হচ্ছে বা ভুল করে ওর জলের পাত্র ভরে দেওয়া হচ্ছে। অনেকগুলো নাম ছিল ছেলেটার - গুবলেট, পায়ে-পায়ে, লাড্ডুলিং, লেডো, গাবলু, আর ও সবেতেই বাঁই বাঁই করে লেজ নাড়িয়ে সারা দিতো। আমি লবির সোফাটায় বসে বই পড়ছি, ও পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে আর ওর দোদুল্যমান লেজটা সোফার গায়ে লেগে লেগে ক্রমাগত ফট ফট করে আওয়াজ করছে - পালাচ্ছি সেই আওয়াজ থেকেও।

Wednesday, November 16, 2022

আমিই সেই

ঈশা বাস্যমিদৃং সর্বং যত্‍কঞ্চ জগত্যাং জগত্‍ ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনমৃ ।।
(ঈশ উপনিষদের প্রথম শ্লোক)
এখানে তিনটি জিনিষ বলা হচ্ছে:
১/ অখিল ব্রহ্মান্ডে জড় বা চেতন সব কিছুতেই ঈশ্বর ব্যাপ্ত ।
২/ অহং ত্যাগ করে ভোগ কর ।
৩/ লোভ কর না ।
ঠাকুর বলতেন 'জগৎ চৈতন্যময়'। অর্থাৎ ব্রহ্ম সত্য, জগৎও সত্য। মায়া নয়, লীলা। ঠাকুরের ভাষায় 'লীলাপোষ্টাই'। ঠাকুরের 'জ্ঞান-বিজ্ঞান' দর্শন শঙ্করের মায়াবাদকে ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। আমার মধ্যে যদি ঈশ্বর স্বয়ং অবস্থান করেন তাহলে আমি বাস্তব তো বটেই, নিছক স্বপ্ন হৈ কিভাবে? এটা ইশ উপনিষদেরই কথা। গুরুর কথা ধরেই স্বামীজী তাঁর দ্বিতীয় Practical Vedanta বক্তৃতায় বলছেন, 'And this is the real, practical side of Vedanta. It does not destroy the world, but it explains it; it does not destroy the person, but explains him; it does not destroy the individuality, but explains it by showing the real individuality. It does not show that the world is vain and does not exist, but it says, "Understand what this world is, so that it may not hurt you.".... The theme of the Vedanta is to see the Lord in everything, to see things in their real nature, not as they appear to be.' (CW 2:312)

Saturday, October 1, 2022

বাঙালি শৃঙ্খলামুক্ত হোক

পশ্চিমবঙ্গে যদি কোনোদিন সত্যিকারের বুকের পাটাওয়ালা সরকার ক্ষমতায় আসেন তাহলে অরবিন্দ ঘোষ, রাসবিহারী বসু, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, যতীন্দ্রনাথ দাস, সূর্য সেন, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, বটুকেস্বর দত্ত, প্রফুল্লচন্দ্র চাকী, ক্ষুদিরাম বসু, বিনয় কুমার বসু, গণেশ ঘোষ, মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, লীলা রায়, শোভারানী, কল্যাণী দাস (ভট্টাচার্য্য) প্রমুখ অসংখ্য বীরশ্রেষ্ঠ বিপ্লবীদের স্মৃতি মাথায় করে রাখবেন। এঁদের বিষয়ে বাঙালিকে বিশদে পড়ানো হবে, এঁদের জন্মস্থান তীর্থক্ষেত্ররূপে চিহ্নিত হবে, এঁদের দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রবোধকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সবরকম প্রয়াস হবে। 

চরখা কেটে এ দেশ স্বাধীন হয়নি। এই বীর বিপ্লবীদের অপরিসীম আত্মত্যাগ না থাকলে এবং রাসবিহারী বসু ও বিনায়ক দামোদর সভারকারের অনুপ্রেরণায় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ পরাধীন ভারতকে আক্রমণ না করলে ও ফলস্বরূপ ইংরেজ অধীনস্ত ভারতীয় নৌবাহিনীতে বিদ্রোহ না হলে, ভারত হয়তো ১৯৪৭এ স্বাধীন হতো না। 

অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে গান্ধীজির একটা ভূমিকা আছে কিন্তু সেটা যত বড় করে দেখানো হয়, আসলে তার ধারেকাছেও না। ভারতের স্বাধীনতার জন্য যদি কোনো একটি ভারতীয় জাতির সর্বোচ্চ অবদান থেকে থাকে, তাহলে সেটা হিন্দু বাঙালির, সেলুলার এবং অন্যান্য জেল যার সাক্ষ্য আজও বহন করে চলেছে। এই রাষ্ট্রবোধের ইতিহাস, বস্তুতঃ হিন্দু বাঙালির বীরত্বগাথা, তার গৌরবময় জাতিস্বত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। হিন্দু বাঙালি বিপ্লবীদের অবদান ছোট করে দেখানো আসলে একটা গভীর ষড়যন্ত্রের ফল কারণ শৌর্যে, বীর্যে, বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, অনুভবে, অনুরাগে, শিল্পে, সাহিত্যে, উদ্ভাবনীশক্তিতে, সৃজনশীলতায় - সবকিছুতে যে জাতি সারা দেশের মধ্যে প্রমুখতম ছিল, তাকে তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন না করতে পারলে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত না যে। কংগ্রেসের সক্রিয় সহযোগিতায় দোসর বামপন্থীরা পাঁচ দশক ধরে ঠিক সেই চেষ্টাটাই করে গেছে। 

বাবর যেমন ভারতীয় ভাবধারাকে ছোট করার জন্য রামজন্মভূমির মন্দির ভাঙিয়েছিল, ঠিক তেমনই কংগ্রেসি সিস্টেম সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালিকে হেয় করে কৃত্রিমভাবে অন্যদের বড় করে দেখাবার চেষ্টা করে গেছে। সবুজ বিপ্লব গমে হয়েছে কিন্তু ধানে হয়নি, স্যার বীরেন মুখার্জির ইস্কো জাতীয়করণ হয়েছে কিন্তু টাটাদের টিস্কো হয়নি, এককালে নর্থ ও সাউথ ব্লক কাঁপানো বাঙালি সিভিল সারভেন্টের সংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে, বাঙালির ভবিষ্যৎ লাটে ওঠানোর জন্য নকশাল আন্দোলন এখানেই শুরু করা হয়েছে। এগুলো অতীত। অবশেষে দেশে নতুন করে হিন্দুত্বের জোয়ার এসেছে, তাই আমাদের দেশকে আক্রমণকারী বর্বর বাবরের সেনাপতির দ্বারা ভেঙে দেওয়া শ্রীরামজন্মভূমিমন্দির আবার নতুন করে তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে সময় এসেছে হিন্দু বাঙালি জাতিস্বত্তাকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার। সময় এসেছে হিন্দুবিরোধী ইকোসিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ জানাবার। আর সময় এসেছে আবার হিন্দু বাঙালিকে ভারতের সম্মিলিত তেজপুঞ্জের চালিকাশক্তি করে তোলার। আমাদের মননে আজও অতীতের ভারতগৌরব অতীশ দীপঙ্কর যেমন বেঁচে আছেন, তেমনই বেঁচে আছেন আধুনিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পিতামহ ভীষ্ম ঋষি রাজনারণ বসু। একবার শৃঙ্খলমুক্ত হতে পারলে আমাদের আটকানো মুশকিল আছে।

Monday, September 19, 2022

রানী ও আমরা

আজ ব্রিটেনের প্রয়াত রানীর রাষ্ট্রীয় অন্তেষ্টিতে চার্চে যে সব ভাষণ হলো তাতে তাঁকে এক বিশেষ ধারার খ্রিষ্ট পন্থাবলম্বীদের রক্ষাকর্ত্রী এবং একজন পরম খ্রিষ্টান বলে বারেবারে সম্বোধিত করা হলো। দিন দশেক আগে যখন রাজা তৃতীয় চার্লস দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তখন গোটা প্রিভি কাউন্সিলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনিও নিজেকে defender of the faith বলেই অবিহিত করেছিলেন এবং স্কটল্যান্ডের চার্চের রক্ষক হিসেবেও শপথ নিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য faiths নয় কিন্তু, faith এবং সেই faith অবশ্যই খ্রিষ্টান পন্থের একটি ধারাবিশেষ, যাকে protestant বলে। 

অর্থাৎ ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি অন্যান্য এমন কিছু দেশেরও রাষ্ট্রপ্রধান যেখানকার মূল জনজাতিরা খ্রিষ্ট পন্থাবলম্বী নন, তিনি সমস্ত পন্থ তো দূর, খ্রিষ্টানদেরই অন্য ধারাগুলির রক্ষক নন। এত কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে রাজা এবং তাঁর দৌলতে রাষ্ট্রের একটি বিশিষ্ট পন্থীয় ধারা থাকা স্বত্তেও ব্রিটেনকে কি কেউ theocratic রাষ্ট্র বলে? বলে না তার কারণ রাষ্ট্রশক্তি বিভিন্ন পন্থাবলম্বীদের মধ্যে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করে না, দুর্ভাগ্যজনকভাবে যা অনেক ইসলামিক দেশেই সরকারিভাবে করা হয়ে থাকে। 

এখন প্রশ্ন হলো যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান স্বয়ং নিজেকে একটি মাত্র পন্থের রক্ষাকর্তা হিসেবে সরকারিভাবে শপথ নেওয়া স্বত্তেও রাষ্ট্র পন্থনিরপেক্ষ থাকতে পারে, সেখানে ভারতবর্ষের বেলায় শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ইত্যাদি পন্থাচারের প্রাধান্যকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র প্রাচীনকাল থেকে প্রবাহমান ধর্মবোধ এবং একীভূত সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে কেন? প্রবঞ্চনার মাধ্যমে সংবিধানে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া socialist আর secular শব্দগুলির জেরে এখন কি আমরা খুব ভালো আছি? ওগুলোর মধ্যে কি আমাদের existential ethos আছে?

এই যে এত মারামারি কাটাকাটি - সেসব কিসের জন্য? মতবাদ-অসহিষ্ণুতার জন্য, যা ভারতীয় সংস্কৃতিতে কস্মিনকালে ছিল না, পুরোটাই বিজাতীয় পন্থের সাথে সাথে আমদানিকৃত। অর্থাৎ, অন্য অপসংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যত আমরা আমাদের সহিষ্ণু, সংস্কারমুক্ত, সদাচারী জীবনবোধ থেকে সরে গেছি, তত আমাদের অনেকের মধ্যে অন্যের মতকে সন্মান দেওয়ার প্রবণতা কমেছে এবং সেই সাথে নিজের মতকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। 

পন্থ যার যার কিন্তু ধর্ম সবার। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজে থাকতে গেলে এবং সততার সাথে নিজের নিজের কর্তব্য নির্বাহ করতে গেলে গোটা সমাজে ভালো-মন্দের মাপদন্ড একটাই হওয়া উচিত - আমাদের পূর্বপুরুষ হাজার হাজার বছর ধরে মাজাঘষা করতে করতে যার একেবারে একটা perfect model তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন, যাকে আমরা হিন্দুধর্মবোধ বা হিন্দুত্ব বলি। ভারতকে আবার অর্থ কাম এবং মোক্ষলাভের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে গেলে ফের সেটাই করতে হবে যেটি আমাদের পূর্বপুরুষ অনুসরণ করে হাতে হাতে সুফল পেয়েছিলেন - ধর্মীয় হতে হবে। পন্থীয় নয় কিন্তু, ধর্মীয়। আর তার জন্য প্রথমে আমাদের হিন্দুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার কারণ অন্য কোনো সভ্যতায় 'ধর্ম' বলে কোনো বস্তু নেই, আছে কেবল পন্থ বা religion। 

আমাদের রাষ্ট্র যদি সত্যি সত্যিই পন্থনিরপেক্ষ হতে চায়, তাহলে তাকে সত্যিকারের ধর্মনিষ্ঠ হতেই হবে। আর সত্যিকারের ধর্মনিষ্ঠ হতে গেলে মনে প্রাণে সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দু হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায়ই নেই, কারণ অন্য কোনো সংস্কৃতিতে ধর্মের কোনো প্রতিশব্দই নেই যে। সারা বিশ্বজুড়ে মানুষ আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে protestant মতানুসারে পালিত একজন protestant নারীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখছেন, কারণ সেটাই সমীচীন। যদি নিজেদের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার কারণে বিভিন্ন মতানুসারে রানীর একটা খিচুড়ি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হতো, সেটা বরং ভড়ং হতো। আমরা গত ৭৫ বছর ধরে এই মিথ্যে ভড়ংটাই করে আসছি, আর না। আমাদেরও শিকড়ে ফেরার সময় হয়ে গেছে। আমাদের রাষ্ট্রের জন্য হিন্দুত্ব ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানক নেই। জয় মা ভারতী, জয় হিন্দুরাষ্ট্র।

Tuesday, September 6, 2022

দেবী দুর্গা

দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবী ভাগবত - এইসব পুরাণ ও উপ-পুরাণে দেবী মাহাত্ম্য আলোচনা করা হয়েছে। তাতে মা দুর্গার নামের বর্ণনা এইভাবে করা হয়েছে:
দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।

অর্থাৎ, "দ" অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, "গ" অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
(পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৪)

এই দশপ্রহরণধারিনি দুর্গা রূপে ভগবতী দেবী পার্বতী দুর্গমনাশিনী। তিনি মহাযোগিনী। বন্ধুবর শ্রী সৈকত বসু মহাশয় দেবীসূক্তের এক অসামান্য যৌগিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তাঁর এক লেখায়: 'মহিষ বেশী অসুর মদগর্ব বা অহঙ্কার-এর প্রতীক। দেবীর মূল অস্ত্র ত্রিশুূল ইড়া পিঙ্গলার সুষুম্নার প্রতীক । এই ত্রিশুল মহিষাসুর এর হৃদয় বিদীর্ণ করছেন।  মানে অনাহত চক্র জয়ের প্রতীক।  মনিপুর চক্রের তত্ব জল। তাই দুর্গা জল হতে উদ্ভূতা। 

দুর্গা শরীর নামক দুর্গে স্থিত তাই তিনি দুর্গা।  তিনি ভ্রুযুগলের মধ্যে স্থিত তাই তিনি গুহাবাসীনিম।  তিনি বিন্দুতেও স্থিত তাই তিনি বিন্দুবাসীনিম। প্রথম কুম্ভক পদ্মনাভিতে এবং পূজক পুস্পাঞ্জলি দেবেন  তার নাভিপদ্মে।  দ্বিতীয় কুম্ভক অনাহতে এবং পূজক পুস্পাঞ্জলি দেবেন অনাহত চক্রে এবং শেষ পুস্পাঞ্জলি মস্তকে অথবা ব্রহ্মরন্ধ্রে।  এবার তিনি দেবীকে আবাহন করবেন ঘট পূর্ণ জলে।  দেবীর তত্ব জল। ঘটের ওপর শীর্ষযুক্ত ডাব।  ডাব জরায়ুর প্রতীক। দেবী জগৎ প্রসবিনী।'  

প্রচলিত দুর্গা বানানটি আমাদের বাড়িতে ব্যবহৃত হয়না যদিও দুর্গা = দুর্গ + স্ত্রী, 'দুঃখে প্রাপ্যা'; দেবীবিশেষ। আমরা বিজয়ার দিন গোটা পরিবার একশআটবার 'শ্রী শ্রী দূর্গা সহায়' লিখি কারণ আমাদের পূর্বপুরুষরা ওই বানানই নির্দিষ্ট করে গেছেন। তার কারণ দূর শব্দটি হলো বিশেষণ {দূর্ + √ই + র (রক্)} যার অর্থ মনোবাক্যের অতীত আর 'গা' হলো বিশেষ্য, গাত্র, দেহ, শরীর। অর্থাৎ যিনি অব্যক্ত, তিনি যখন শরীর ধারণ করে মর্তে আগমন করেন, তিনিই দূর্গা।

আবার অন্যদিকে শ্রীবিষ্ণুর যে অবতার অকাল বোধন করে এই আশ্বিনমাসের দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন, আদি শঙ্করাচার্য্যের টীকা অনুসারে (রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী তপস্যানন্দের অনুবাদ) "রাম" শব্দের অর্থ হলো যোগীরা যাঁর সঙ্গে রমণ (ধ্যান) করে আনন্দ পান, সেই পরব্রহ্ম বা সেই বিষ্ণু, যিনি দশরথের পুত্ররূপে অবতার গ্রহণ করেছিলেন। আবার সন্ত কবিরদাস তাঁর দোহায় চার রকমের রামের কথা বলেছেন "এক রাম দশরথ কা বেটা, এক রাম ঘট ঘট মে বৈঠা; এক রাম কা সফল পাসারা, এক রাম হ্যায় সবসে ন্যায়ারা।"

মানে একজন রাম যিনি দশরথ পুত্র অর্থাৎ রাজা, যাঁকে আমরা "মর্যাদা পুরুষোত্তম" বলি, অর্থাৎ, "শ্রেষ্ঠ পুরুষ" বা "আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিপতি" বা "গুণাধীশ"। দ্বিতীয় রাম যিনি প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আছেন অর্থাৎ সাক্ষাৎ ঈশ্বর। তৃতীয় রাম যিনি সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডময় প্রসারিত অর্থাৎ স্রষ্টা। আর চতুর্থ রাম যিনি সবচেয়ে অপূর্ব এবং আশ্চর্যময় অর্থাৎ যিনি সমস্ত কল্পনার অতীত সাক্ষাৎ পরব্রহ্ম।

রামবতারে লক্ষ্মীদেবীই সীতাদেবী। মা লক্ষ্মীর অপর নাম শ্রী। শ্রীবিষ্ণু, শ্রীরাম আর সীতারাম বা সিয়ারাম তাই একই। অর্থাৎ যুগলে লক্ষ্মী আর বিষ্ণু। বিভিন্ন শব্দবন্ধে ওঁদের জয়ধ্বনিও ওই একই যুগলের জয়ধ্বনি, কোনো পার্থক্য নেই। যাহা জয় শ্রীরাম তাহাই জয় সিয়ারাম। মূলত মা দুর্গা এবং শ্রীরাম একই আদিশক্তির ভিন্ন প্রকাশ, যিনি যে ভাবে দেখতে চান, দেখতে পারেন। এসব নিয়ে বৈষ্ণব এবং রামায়িতদের সাথে অযথা অনবগত বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।

পরম বৈষ্ণব শ্রীজীব গোস্বামী ভাগবতের ব্যাখ্যায় বলেছেন - যঃ কৃষ্ণ সৈব দুর্গা স্যাৎ যা দুর্গা কৃষ্ণ এব সঃ (শ্রী জীব গোস্বামী , ব্রহ্ম সংহিতা -টীকা -ধৃত গৌতমীয় কল্পবচন) অর্থাৎ যিনি কৃষ্ণ, তিনিই দুর্গা; যিনি দুর্গা, তিনিই কৃষ্ণ; ওনারা অভিন্ন। শক্তিমান ও শক্তি যেমন অভিন্ন, সেই ভাবেই, কৃষ্ণ ও দুর্গা এক ও অভিন্ন। তিনি আরও বলেছেন, অতঃ স্বয়মেব শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ শক্তিরুপেন দুর্গানাম অর্থাৎ শক্তিরূপিণী দুর্গার নামই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ। স্বয়ং নিত্যানন্দ প্রভুর বাড়িতে আজও জাঁকজমক করে দুর্গা পুজা হয়। 

স্বয়ং মহাপ্রভু মা দুর্গার রুপ ধরে ভক্তদের দর্শন দিয়েছেন (চৈতন্য ভাগবত, ১৮ অধ্যায়)। তাহলে বৈষ্ণবে আর শাক্তে প্রভেদ কোথায়? বৈষ্ণবদের সবথেকে প্রধান শাস্ত্র ভাগবত পুরাণে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর যোগমায়া শক্তি দুর্গাকে বলছেন, তুমি পৃথিবীতে নানা নামে পূজিত হবে এবং ভক্তগণ নানা পূজা সামগ্রীর দ্বারা তোমার আরাধনা করবে (ভাগবত, ১০/২/ ১০-১২)। মহাভারতের যুদ্ধের পূর্বে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দুর্গা স্তব করতে আদেশ করেন (মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ২৩/ ৪-১৬)। স্বয়ং শ্রীহরি শ্রীরামরূপে যাঁর অকালবোধন করেন, তাঁর পূজার বিষয়ে দুই ধারার মধ্যে কিসের বিভেদ?

ইদানিং জায়গায় জায়গায় শান্তি ও সম্প্রীতির নামে দেবীমুর্তির হাতে অস্ত্রের বদলে ফুল গুঁজে দেওয়া হচ্ছে অথবা কার্তিকের বাহন পাল্টে ঘোড়া করে দেওয়া হচ্ছে, এতটাই 'ধর্মনিরপেক্ষ' হয়ে গেছেন কেউ কেউ। অনেকেই আবার এসব দেখে না বুঝে বাহবা দিচ্ছেন, বিশেষতঃ তাঁদের জন্যই আজ দুর্গাপূজার প্রাক্কালে মাদুর্গার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

ঋকবেদে স্বয়ং দেবী নিজের স্বরূপ উদঘাটন করতে গিয়ে বলছেন,
অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিযানাম্ ।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশযন্তীং ।।.. ৩.. দেবীসুক্তম
(আমি রাষ্ট্রী, রাষ্ট্রের অধিশ্বরী, রাষ্ট্রারক্ষার্থে যে সম্পদের প্রয়োজন আমি তার বিধানকারীনী, সংসারে শান্তিলাভের জন্য যে ব্রহ্মজ্ঞান প্রয়োজন আমিই তা দান করতে পারি, আমি বহুরূপে সর্বভূতে শক্তিরূপে বিরাজ করি, দেবতাদের সব কাজই আমি সমাধা করতে পারি।)

বুদ্ধিজীবী, বৃত্তিজীবী, শৌর্যজীবী ও শ্রমজীবী, রাজ্যচালনায় এই চারটি শ্রেণী অপরিহার্য এবং মা দুর্গাকে ঘিরে তাই যথাক্রমে বুদ্ধিবৃত্তির প্রতীক বিদ্যাদেবী সরস্বতী, ব্যবসাবৃত্তির প্রতীক ধনদেবী লক্ষ্মী, ক্ষত্রিয়শৌর্য্যের প্রতীক দেবসেনাপতি কার্তিক এবং গণ বা জনশক্তির প্রতীক সিদ্ধিদাতা গণেশ। মা স্বয়ং রাষ্ট্রের অধিশ্বরী, তিনি স্বয়ং শক্তিস্বরূপিনী এবং একচালায় গোটা দুর্গা পরিবারটি হলো সম্পূর্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক। 

এক হিসেবে আমাদের দুর্গাপূজা আসলে রাষ্ট্রশক্তিস্বরূপা স্বর্গাদপি গরীয়সী জননীর পূজা, বিশ্বাস না হয় উপরোক্ত ঋকবেদের দেবীসুক্তমের তৃতীয় সুক্তটি পড়ুন যেখানে দেবী স্বয়ং নিজেকে 'অহং রাষ্ট্রী' বলে পরিচয় দিচ্ছেন। দেবী ত্রিনয়নী, তাঁর একটি নয়ন চন্দ্রস্বরুপ, একটি সূর্যস্বরুপ এবং তৃতীয়টি অগ্নিস্বরুপ, অর্থাৎ তিনি সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের প্রতীক। তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই নিয়ন্ত্রিত হয় রাষ্ট্রের ত্রিকাল। দেবী দশভূজা, কারণ দশদিশার তিনি অধিশ্বরী, যা রাষ্ট্রের ব্যাপ্তির পরিচায়ক। দশদিশা মানে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, অগ্নি, বায়ু, নৈঋত, ঊর্ধ্ব এবং অধঃ। 

তাঁর ডানদিকের পাঁচ হাতে পাঁচটি অস্ত্র এবং বামদিকের পাঁচ হাতে চারটি অস্ত্র এবং একটি ঘন্টা। দেবী যা যা ধারণ করে আছেন তার প্রত্যেকটির প্রতীকী তাৎপর্য আছে। ডানদিকের হাতের অস্ত্রগুলি হল: মা ত্রিগুনময়ী এবং ত্রিতাপহরণী তাই ত্রিশূল, অবিদ্যানাশিনী তাই খড়্গ, সংসারচক্র থেকে মুক্তিদায়িনী তাই সুদর্শন চক্র, মায়ের কৃপায় পরমব্রহ্মে লীন হওয়ার লক্ষ্য ভেদ হয় তাই বান, আর মা কামনানাসিনী তাই কুঠার বা ক্ষেত্রবিশেষে গদা। বামদিকের হাতের অস্ত্রগুলি হল: মা আশ্রিতের পরম আশ্রয় এই বোধ থাকা প্রয়োজন তাই খেটক বা বর্ম, ঈশ্বর উপলব্ধিতে গতিশক্তির প্রয়োজন তাই ধনুক, অসংযত মনকে শান্ত রাখা প্রয়োজন তাই নাগপাশ, অহংকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন তাই অঙ্কুশ আর মা শব্দব্রহ্মময়ী, নাদধ্বনির মাধ্যমেই সৃষ্টির সূচনা, তাই মায়ের হাতে ঘন্টা। 

এককথায় বলতে গেলে দেবীর ডানদিকে কার্য্য আর বামদিকে কারণ। দেবী সিংহবাহনা কারণ তামসিক পশুশক্তির অধিপতি পশুরাজ সিংহ তাঁর বশে আর মহিষাসুর কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যরূপী দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক, তাই বধ্য। গোটা কাঠামোটি পরিবেষ্টিত চালচিত্রে সবার মাথার ওপর দেবাদীদেব মহাদেব, তিনি সদাশান্তম, তিনি মঙ্গলময়তা, ঔদার্য ও স্থিরত্বের প্রতীক, অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রগুরু। তাই তো স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, "মনে রাখবে তোমরা জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত"। কে এই মা? অবশ্যই জননী জন্মভূমি।

এই সূত্রেই কার্তিকের প্রসঙ্গে বিশেষরূপে আসা প্রয়োজন কারণ কার্তিকপূজাকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালীদের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি আছে। দেব সেনাপতি কার্তিক বা মুরুগণ বা সুব্রহ্মণ্য ঠাকুরের অপর নাম হচ্ছে ষড়ানন অর্থাৎ ছয়টি মুখ যাঁর। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো মানব জীবনের ষড়রিপু- কাম (কামনা), ক্রোধ (রাগ), লোভ (লালসা), মদ(অহং), মোহ (আবেগ) এবং মাৎসর্য (ঈর্ষা)কে সংবরণ করে দেব সেনাপতি কার্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে সদাজাগ্রত ও সচেতন থাকেন, তার বাহ্যিক প্রতীকিকরণ। আর তাঁর বাহন হলেন ময়ূর কারণ প্রাণীটি অত্যন্ত কর্মঠ ও সদাচঞ্চল এবং সর্পভক্ষী। এই সর্পটি আসলে অহংবোধ, যা তিনি আগেই গ্রাস করে নেন বলে কার্তিকের পক্ষে ষড়রিপুদমন করা সহজ হয়, তিনি জীবনযুদ্ধে সর্বদা জয়ী হন। আদর্শ রাষ্ট্র আসলে একটি পুণ্য ধর্মক্ষেত্র এবং তাকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য। সেইজন্যই দেবতাদেরও একজন বীর সেনাপতির প্রয়োজন হয়।

শক্তি আরাধনা ছেলেখেলার বস্তু নয়, দুর্গাপূজাও নিছক কোনো শারদোৎসবও নয়, একদম একশ শতাংশ খাঁটি হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান। সবশেষে আবার বলি, ঋকবেদের দশম মণ্ডলের ১২৫তম সূক্তটিতে দেবী আদ্যাশক্তি ভগবতীর স্বরূপ ও মহিমা প্রকাশিত। সূক্ত শব্দের মানে সু-উক্ত, বিশেষ ভাবে যেটি বলা হয়, তাই সূক্ত। বৈদিকস্তোত্রকে সূক্ত বলা হয় আর মাতৃস্তোত্রগুলিকে ঋকবেদে দেবীসূক্ত বলে। দেবীসূক্তেই মা চণ্ডীর দৈবী মাহাত্ম্য বীজাকারে প্রচ্ছন্নভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, চাইলে গোটাটা পড়ে নিতে পারেন। তান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে ছেলেখেলা করলে তন্ত্রধারক ও তাঁর পরিবারের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

দেবী প্রসঙ্গে একসময় পূজ্যপাদ স্বামী সোমেশ্বরানন্দজী মহারাজের একটি লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, সেটি এখানে উদ্ধৃত করার প্রয়োজন বোধ করলাম:
'দুর্গা মানে যাকে জানা কঠিন। দুঃ=কঠিন। গ=যাওয়া। যেমন দুর্গে (fort) ঢোকা কঠিন। দুর্গম, যেখানে যাওয়া কঠিন। দুর্গের সাথে আ-কার যোগ করে দুর্গা। মাকে জানা বা পাওয়া খুবই কঠিন। তাই তাঁর নাম দুর্গা।

মায়ের দশ হাত। অর্থাৎ দশদিকেই তিনি রয়েছেন, সর্বত্রই তাঁর অস্তিত্ব। পাশে শিব, সাথে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। মায়ের কৃপায় সাধক সবকিছু পান। শিব বা ব্রহ্মজ্ঞান যেমন পাওয়া যায়, তেমনি লাভ করা যায় বিদ্যা, সম্পদ, শৌর্য, সিদ্ধি। চণ্ডীতে আছে, সুরথ ও সমাধি একই সাথে তপস্যা করেছিলেন। কিন্তু মায়ের বরে সুরথ ফিরে পেলেন তার রাজ্য, সমাধি লাভ করলেন ব্রহ্মজ্ঞান।

মাতৃমন্ডপে কলাগাছ? অনেকে বলেন গণেশের বউ! না। একে নবপত্রিকা বলা হয়। সাত রকম গাছ। পত্রিকা=যার পত্র (পাতা) আছে তাকে বলে পত্রিকা। কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, দাড়িম, অশোক, মান ও ধান। নবদুর্গার অন্য রূপ। এরও পুজো হয়। কেন? বলছি তা একটু পরে।

মন্ডপে মায়ের প্রতিমা মাটির। আর অষ্টমীর দিনে কুমারী পুজো। মাকে পুজো করা হচ্ছে গাছ, মাটি, মানুষ রূপে। মাটি জড়, গাছ যেন জড় ও জীবের মধ্যে (প্রাণ আছে কিন্তু সচল নয়), আর কুমারী হলো মানুষ। অর্থাৎ মাকে তিন রূপে আবাহন করা হয়। বিভিন্ন রূপে তিনিই রয়েছেন সর্বত্র।

মাতৃপ্রতিমার সামনে ঘট রাখা হয় কেন? ঐ ঘট হলো ভক্তের প্রতীক। ঘট=শরীর। ঘটের মধ্যে জল=মন (mind)। ঘটের মুখে আম পাতা= ইন্দ্রিয়। আর জলের নীচে রাখা সোনা (gold) = জীবাত্মা। অর্থাৎ সমবেত ভক্তদের প্রতীক এই ঘট। 

দেবতাদের সমবেত শক্তির ফলে মায়ের আবির্ভাব। অর্থাৎ ঐক্যই শক্তি। আজ সমাজে ভাল লোকেরা, সৎ মানুষেরা কেন নিজেদের অসহায় মনে করে? কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ নয় যেখানে অসৎ লোকেরা দলবদ্ধ। চণ্ডীর তাৎপর্য এটাই। সংঘে শক্তি কলৌ যুগে = কলিযুগে সংঘবদ্ধ হলেই শক্তি।

মায়ের হাতে অস্ত্র কেন? কারণ ভাল লোকদের হাতেই অস্ত্র থাকা দরকার। তারাই সঠিক প্রয়োগ করতে সক্ষম। অসৎ লোকের হাতে অস্ত্র সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর।

শিবের তেজে সৃষ্টি হলো মায়ের মুখ। শিব সারাক্ষণ ধ্যানস্থ। অর্থাৎ কঠিন পরিস্থিতি এলে শান্ত মনে তার মোকাবিলা করতে হয়, এই শিক্ষাই দেওয়া হচ্ছে এখানে।

বিষ্ণুর তেজে মায়ের হাত। বিষ্ণু স্থিতি বা পালনের দেবতা। এর তাৎপর্য, আমাদের কর্মের দ্বারা জগতের বা সমাজের কি কোনো উপকার হচ্ছে অথবা শুধু নিজের জন্যই কাজ করি? যদি অন্যদের উপকারের জন্য হয় তবে তা দিব্য কর্ম।

ব্রহ্মার তেজে মায়ের পা। চলতে হয় পদক্ষেপ নিতে নিতে। ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা। কিন্তু আমাদের পদক্ষেপ বা কাজ কি সৃজনশীল (creative) ? চণ্ডীর উপদেশ, গতানুগতিক কাজের উপরে উঠে সৃষ্টিশীল হও।

শিব নিজের শূল দিলেন মাকে। ত্রিশূল অর্থাৎ সত্ত্ব, রজ, তম। এই তিনের উপরে উঠতে পারলেই প্রকৃত জ্ঞান লাভ হবে। দন্ডের একমুখে ত্রিশূল, অন্যমুখে এক শূল। জগতের দুই রূপ। একদিকে ত্রিগুণের খেলা, অন্যদিকে অদ্বৈত অনুভব। মহিষাসুর ত্রিগুণে মত্ত ছিল বলে মা তাকে এক শূল দিয়ে মুক্তি দিলেন।

বিষ্ণু নিজের চক্র দিলেন মাকে। চক্র অর্থাৎ সংসারের আবর্তন। চক্র সবসময়েই ঘুরছে, পরিস্থিতি বদলাচ্ছে সর্বদা। কিন্তু চক্রের মাঝে যে ছিদ্র, ঐ কেন্দ্রে আঙ্গুল রাখলে স্থির থাকা যায়। চণ্ডীর উপদেশ, শ্রীরামকৃষ্ণের মতই, বুড়ি  ছুঁয়ে খেলা করো, বাসা পাকড়ে রঙ দেখো। অর্থাৎ ঈশ্বরকে ধরে কাজ করো।

ব্রহ্মা মালা দিলেন। এই মালা ফুলের নয়, রুদ্রাক্ষের মালা। সাধনার মালা। তাৎপর্য? মানুষের জীবন এক সাধনা। পশু জন্ম থেকেই পশু, পাখী ডিম ফুটে বাইরে বেরিয়েই পাখী। কিন্তু মানুষ জন্মের পর এক জীব মাত্র। তাকে সাধনা করতে হয় মনুষ্যত্ব লাভের জন্য। এই কথারই ইঙ্গিত চণ্ডীতে।'

Saturday, August 20, 2022

এক থেকে বহু, বহু থেকে এক


আমি যখন 'আমি' বলছি তখন একজনকেই বোঝাচ্ছি, singular number, একবচন - নিজেকে, অর্থাৎ নিজেকে আমি যা বলে মনে করি, তাকে। সেটা যদি আয়নায় দেখা আকারটি হয় তাহলে তাইই। কিন্তু সেই আমিই যখন 'তুমি' বলছি তখন কিন্তু সেটি অনেকজনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য - তুমি, তুমি এবং তুমি - plural number, বহুবচন, যদিও ব্যাকরণের হিসেবে ওটিও একবচনই বটে। 

এখন, 'আমি' যেমন specific, যতক্ষণ না পরমজ্ঞান হচ্ছে ততক্ষণ স্থান ও কাল নির্বিশেষে অপরিবর্তিত, 'তুমি' কিন্তু স্থান কাল পাত্র অনুযায়ী বদলে বদলে যেতে পারে। এক্ষুনি ঘরের ভেতরে গিন্নিকে তুমি বললাম, পরক্ষণেই রাস্তায় বেরিয়ে প্রতিবেশীকে তুমি বললাম আবার তারপর অফিসে পৌঁছে সহকর্মীকে তুমি বললাম - সবাই 'তুমি', সবাই বুঝলেন সেই বিশেষ সময় এবং সেই বিশেষ স্থানে specifically তাঁকেই সম্বোধন করছি, অর্থাৎ ডাকটা 'তোমরা'র মতন generalised নয় অথচ 'আমি'র মতন specificও নয়। 

'আমি' ধ্রুবক কিন্তু 'তুমি' পরিবর্তনশীল, যদিও ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দুটিই কিন্তু attached to a particular individual and indicative of only that person at any given time and space - বিশেষক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের নির্দিষ্ট পরিচায়ক। এর বিশেষত্ব হলো কে যিনি 'তুমি' বলে ডাকছেন তাঁর মনে যেমন সেই সময় যাঁকে ডাকছেন তাঁর identity নিয়ে কোনো ambiguity নেই, তেমনি যিনি সারা দিচ্ছেন তাঁর মনেও কিন্তু তাঁকেই যে ডাকা হচ্ছে - সে বিষয়ে কোনো ambiguity নেই। এই যে দুতরফেই given time and space এ understanding of identity থাকে, সেটাই দুটি ভিন্নস্বত্তার মধ্যে singular যোগসূত্র তৈরি করে দেয়। খুব জটিল ব্যাপার, তাইনা? 

বস্তুর ব্যাপারে সমস্যা কিন্তু আরো জটিল। 'গেলাস', 'জলের গেলাস', 'আমার জলের গেলাস' আর 'আমার নীলরঙের কাঁচের জলের গেলাস' এক হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। অন্যদিকে 'আমি' এবং 'তুমি' দুজনেই যে মানুষ সে বিষয়ে যেমন চরিত্রগত কোনো confusion নেই, বস্তুর ক্ষেত্রে কিন্তু বস্তুর বস্তুর ওপর তার চরিত্র নির্ভর করে, আবার করেও না। কাঁচের গেলাস, কাঁসার গেলাস আর রূপোর গেলাস যদিও উপাদানের নিরিখে চরিত্রগতভাবে একেবারেই এক নয়, কিন্তু উপযোগিতার দিক দিয়ে একই। কাঁচ একটি বস্তু আর গেলাস একটি আকৃতি বিশেষ - দুটির চরিত্র মিলে সহজেই যখন একটি বস্তুবিশেষ হয়ে যায় তখন তাদের পৃথক করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। 

এর মধ্যে অবশ্য নিত্য আর অনিত্যের মানকের বিষয়টিও এসে পড়ে। যদিও শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন যা কিছু নিত্য তাই সত্য আর যা কিছু অনিত্য তাই অসত্য, কেবলমাত্র বিষয়টি সহজতর করার জন্য আমরা এখানে ক্ষণস্থায়ী আর দীর্ঘস্থায়ী দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনা টানবো। উদাহরণস্বরূপ, একটা পাহাড় যেহেতু একজন মানুষের চেয়ে ঢের বেশি বছর অক্ষত থাকে, তাই বর্তমানে সেই পাহাড়ের মালিক যেটিকে 'আমার পাহাড়' বলে স্বত্ব আরোপ করেন, ভবিষ্যতে তাঁর মৃত্যুর পর নতুন মালিক একইভাবে ওই পাহাড়টিকেই আবার 'আমার পাহাড়' বলে স্বত্ব আরোপ করেন - তাতে কিন্তু পাহাড়ের চরিত্র একবিন্দু পাল্টে যায় না। অর্থাৎ 'আমি' পাল্টে গেলেও বস্তু পাল্টায় না, যদিও তার আরোপিত ও কৃত্তিম 'মালিকানা'র বর্ণনা পাল্টে যায়।

আবার এর উল্টোটাও হয়। ছাতুবাবু-লাটুবাবু কবে শরীর ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু উত্তর কলকাতায় ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ি এখনো ওই নামেই খ্যাত, যদিও তার এখনকার প্রজন্মের মালিকরা আলাদা। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়ালো? বস্তু 'আমি'র নামে পরিচিত হতে পারে কিন্তু তাতে বস্তুর কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়না - পাহাড় পাহাড়ই থাকে এবং বাড়ি বাড়িই। যত গোলযোগ কেবল 'আমি' আর 'তুমি'র মধ্যে বস্তু ঢুকে পড়লে। মজার ব্যাপার হলো বস্তুর ক্ষেত্রে সোনার আংটি থেকে সোনা নিয়ে নিলে আর আংটি অবশিষ্ঠ থাকে না, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে আমি থেকে 'আমি' নিয়ে নিলে বা তুমি থেকে 'তুমি' নিয়ে নিলে কি হয়? ওইখানেই অদ্বৈত বেদান্তের শুরু। 

এত কথার প্রয়োজন কি? প্রয়োজন এই যে সাধারণত আমি, তুমি আর বস্তু নিয়েই জগৎ সংসার আর এদের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রকৃত অর্থ বোঝবার জন্যই কখনো গৌতম বুদ্ধ বোধিবৃক্ষের তলায় তপস্যায় বসেন বা মানুষকে এর অর্থ বোঝাবার জন্য কখনো আচার্য্য শঙ্কর ঘুরে ঘুরে সারা দেশের চারটি কোনায় চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। আবার অন্যদিকে এই একই বিষয়ে অবুঝ হলে কখনো কার্ল মার্ক্সের তল্পীবাহকেরা বস্তুর অধিকার আমার না তোমার - এই প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে কয়েক কোটি মানুষকে খুন করে বসে আর চীন অবলীলায় নানান অন্যদেশকে জোর করে নিজের দেশ বলে অধিগ্রহণ করে নেয়।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, 'তুমি আর তোমার' - এইটি জ্ঞান। 'আমি আর আমার' - এইটি অজ্ঞান। হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা আর আমি অকর্তা - এইটি জ্ঞান। হে ঈশ্বর দেহ মন গৃহ পরিবার জীব জগৎ - এ সব তোমার, আমার কিছুই নয় - এইটির নাম জ্ঞান। যে অজ্ঞান সেই বলে ঈশ্বর 'সেথায় সেথায়' - অনেক দূরে। যে জ্ঞানী সে জানে ঈশ্বর 'হেথায় হেথায়' - অতি নিকটে হৃদয়মধ্যে অন্তর্যামীরূপে, আবার নিজে এক একটি রূপ ধরে রয়েছেন।

তুমি, তুমি আর তুমি - বহুরূপে সম্মুখে তুমি, তবু 'সেথায় সেথায়' করে আমরা ঈশ্বরকে অন্যত্র খুঁজে মরি। বস্তুতঃ 'আমি' আর 'তুমি' যে একই, সেই একই অদ্বৈত স্বত্তা, তোমার আর আমার মধ্যে যে পৃথক কোনো কিছু নেই, সে কথা বুঝতে বুঝতেই তো কত কত জন্ম জন্মান্তর কেটে যায়, তারপর হয়তো তাঁর কৃপা হয়। বস্তুত, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনো বহুবচন নেই, সবটা মিলিয়ে একটাই একবচন। আত্মা চেতন, সদামুক্ত তবু সে জড়ে আসক্তিবশতঃ জীবরূপে দেহবোধে আবদ্ধ থাকে, ফলে তার এক কৃত্তিম অবস্থা এবং অন্য এক কৃত্তিম অবস্থার মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে যাওয়াটা কেবল অর্থহীন বস্তুবিচারের বিষয়মাত্র। তবে বৈচারিকস্তরে সমস্ত প্রানীতে এক অবিভক্ত চিন্ময়ভাব দর্শন কল্পনা করা গেলেও মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করা এবং সেইভাবে নিজের 'আমি'কে 'তুমি'তে মিশিয়ে দেওয়াটি কিন্তু খুব খুব শক্ত কাজ এবং গুরুকৃপা ছাড়া সম্ভবই নয়।

১৮৬৮ সালে শ্রীরামকৃষ্ণদেব কাশীতে ত্রৈলঙ্গস্বামীকে দর্শন করতে গিয়েছিলেন। ঠাকুর তাঁকে বলতেন 'হাঁটা-চলা করা, কথা বলা কাশীর জ্যান্ত বিশ্বেশ্বর'। মণিকর্ণিকা ঘাটে গিয়ে ঠাকুর দেখলেন ত্রৈলঙ্গস্বামী সেখানে শুয়ে আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পদধ্বনি শুনে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন তিনি। কেউই কোনো কথা বললেন না। শুধু দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমেই সেরে নিলেন ভাবের আদানপ্রদান। তখনই ইশারায় ঠাকুর প্রশ্ন করলেন, "ঈশ্বর এক না অনেক?" স্বামীজী ইশারাতেই তাঁকে উত্তর দিলেন, "সমাধিস্থ হয়ে দেখলে এক, না হলে যতক্ষণ আমি, তুমি, জীব, জগৎ ইত্যাদির ভেদ রয়েছে ততক্ষণ অনেক।"

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের একেবারে শেষে সঞ্জয়ের কথা দিয়ে গীতা শেষ হচ্ছে। সেখানে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন,
রাজন্ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য সংবাদমিমমদ্ভুতম্। 
কেশবার্জুনয়োঃ পুণ্যং হৃষ্যামি চ মুহুর্মুহুঃ।।৭৬।।
তচ্চ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য রূপমত্যদ্ভুতং হরেঃ। 
বিষ্ময়ো মে মহান্ রাজন্ হৃষ্যামি চ পুনঃ পুনঃ।।৭৭।।
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম।।৭৮।।
অর্থাৎ
হে রাজন্! শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের এই পুণ্যজনক অদ্ভুত সংবাদ স্মরণ করতে করতে আমি বারংবার রোমাঞ্চিত হচ্ছি। ৭৬
হে রাজন্! শ্রীকৃষ্ণের সেই অত্যন্ত অদ্ভুত রূপ স্মরণ করতে করতে আমি অতিশয় বিস্ময়াভিভূত হচ্ছি এবং বারংবার হর্ষান্বিত হচ্ছি। ৭৭
যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে। সেটিই আমার অভিমত। ৭৮

সঞ্জয় কাদের মধ্যে পুণ্যজনক অদ্ভুত সংবাদ শুনে রোমাঞ্চিত? তুমি ও আমি, ঈশ্বর ও জীব, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সংবাদ - যেখানে স্রষ্টা কৃপা করে divergence ও delusionকে convergence ও truthএ পরিণত করছেন, দ্বৈতবোধ থেকে অদ্বৈতবোধে উত্তরণ ঘটাচ্ছেন, আত্মার আসক্তি সরে গিয়ে পরমাত্মার সাথে তার সাক্ষাৎকার ঘটছে। কোন অত্যন্ত অদ্ভুত রূপ স্মরণ করতে করতে সঞ্জয় অতিশয় বিস্ময়াভিভূত এবং বারংবার হর্ষান্বিত হচ্ছেন? তিনি বিশ্বরূপ দর্শন করেছেন। তিনি দেখেছেন যে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কিছুই আলাদা নয়, জড় ও চেতন অর্থাৎ বস্তু এবং জীব সব একই নির্গুণ ব্রহ্মের স্বগুণ রূপ এবং এই পরমজ্ঞানের চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু নেই। আর একদম শেষে সঞ্জয় যে 'শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি'র কথা বলছেন সেটা হলো নিষ্কাম কর্মের outcome - কর্মফলের কামনা ত্যাগ করতে পারলে যোগেশ্বরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ হয়। এর ফলে যে আত্মবোধের শক্তি উৎপন্ন হয়, তার দ্বারা মায়াকে জয় করে জীবনের আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ ব্রহ্মত্ব অর্জন করা যায়। এটাই সমাধি। এটি পুরোটাই কিন্তু একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, শোনা কথা নয়।

আর যাঁর সত্যি সত্যিই সমাধির অনুভব হয়েছে, যিনি নিজে এই পরম অবস্থাকে experience করেছেন, সেই স্বামী বিবেকানন্দ এইভাবে তাঁর অনুভূতিকে বর্ণনা করেছেন:
নাহি সূর্য নাহি জ্যোতিঃ নাহি শশাঙ্ক সুন্দর।
ভাসে ব্যোমে ছায়া-সম ছবি বিশ্ব-চরাচর॥
অস্ফুট মন আকাশে, জগত সংসার ভাসে,
ওঠে ভাসে ডুবে পুনঃ অহং-স্রোতে নিরন্তর॥
ধীরে ধীরে ছায়া-দল, মহালয়ে প্রবেশিল,
বহে মাত্র ‘আমি আমি’ - এই ধারা অনুক্ষণ॥
সে ধারাও বদ্ধ হল, শূন্যে শূন্য মিলাইল,
‘অবাঙমনসোগোচরম্’, বোঝে প্রাণ বোঝে যার॥

মানসিকভাবে এখন যে যেখানে আছি সেইখান থেকে এইখানে পৌঁছতে হবে। হয়তো আরো অনেকগুলো জন্ম লেগে যাবে, হয়তো রাস্তাটা সহজ হবে না, কিন্তু এই গোটা journeyটাতে যাতে লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারি, সেটাই আমাদের আসল প্রার্থনার বিষয়। 'আমি' নয় - 'তুমি', আবার 'তুমি' নয় - 'আমি', কোনো এক শুভক্ষণে সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যাক।

Thursday, August 18, 2022

অবতার

শ্রীকৃষ্ণ বন্দে জগৎগুরুম্!

শ্রীকৃষ্ণের জন্মের রাত ছিল সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে, যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয়। সেই রাত ছিল গভীর অন্ধকার এবং ঘোর বৃষ্টিময়। কংসের কারাগার আলো করে তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পিতা বসুদেব দেখলেন শিশুটির চারটি হাত এবং তাতে তিনি শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করে আছেন। বাসুদেব বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গলার্থে স্বয়ং নারায়ণ তাঁদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। বসুদেব করজোড়ে প্রণাম ও বন্দনার পর দেবকীও নবজাতকের কাছে প্রার্থনা করলেন এবং তখন শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন মাতা দেবকীর অষ্টম সন্তান।

এর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পর তীর্থ ভ্রমণে গয়ায় এসে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন। গদাধর বিষ্ণু তাঁকে দেখা দিয়ে তাঁর ঘরে পুত্ররূপে আসতে চাইলেন। ক্ষুদিরাম ছিলেন ঈশ্বরগতপ্রাণ। দরিদ্র তিনি, তাঁর ঘরে এলে প্রভুর কত কষ্ট হবে, তা অকপটে নিবেদন করলেন। নারায়ণ কিন্তু হেসে আবার তার ঘরেই আসতে চাইলেন। এদিকে কামারপুকুরে চন্দ্রমণি দেবীরও এক অদ্ভুত দর্শন হয়েছিল। বাড়ির কাছে যুগীদের শিব মন্দিরে গিয়েছিলেন তিনি। অকস্মা‌ৎ এক জ্যোতি শিববিগ্রহ থেকে নির্গত হয়ে প্রবেশ করেছিল তাঁর দেহে। ক্ষুদিরাম ও চন্দ্রমণি, উভয়েরই বিশ্বাস হয়েছিল ভগবান পুত্ররূপে তাঁদের কাছে আসছেন। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে ১৮ই ফেব্রুয়ারী (৬ই ফাল্গুন, শুক্লা দ্বিতীয়া তিথি) কামারপুকুরে ক্ষুদিরামের বাড়ীর ঢেঁকিশালে তাঁর তৃতীয় পুত্র গদাধরের জন্ম হয়েছিল।

শ্রীবিষ্ণু কি সত্যি সত্যিই বারেবারে সশরীরে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন? স্বমুখে শ্রীকৃষ্ণ যেমন তাঁর আত্মপরিচয় দিয়ে গিয়েছেন তেমনি একদিন দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বাবুরাম প্রভৃতি ভক্তদের সঙ্গে বসে ছিলেন, দিনটি ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ, ৭ই মার্চ, বেলা ৩টা-৪টা হবে, ভক্তেরা পদসেবা করছেন, এমন সময় শ্রীরামকৃষ্ণ একটু হেসে ভক্তদের বললেন, "এর (অর্থাৎ পদসেবার) অনেক মানে আছে।" তারপর নিজের হৃদয়ে হাত রেখে বললেন, "এর ভিতর যদি কিছু থাকে (পদসেবা করলে) অজ্ঞান অবিদ্যা একেবারে চলে যাবে।"

তারপর হঠাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ গম্ভীর হয়ে গেলেন, যেন কি গুহ্যকথা বলবেন। তারপর ভক্তদের ঠাকুর বললেন, "এখানে বাহিরের লোক কেউ নাই, তোমাদের একটা গুহ্যকথা বলছি। সেদিন দেখলাম, আমার ভিতর থেকে সচ্চিদানন্দ বাইরে এসে রূপ ধারণ করে বললে, আমিই যুগে যুগে অবতার। দেখলাম পূর্ণ আর্বিভাব, তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য।" কথামৃতকার লিখছেন, 'ভক্তেরা এই সকল কথা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন। কেহ কেহ গীতোক্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহাবাক্য স্মরণ করিতেছেন —
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্‌ ৷৷
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্‌
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ৷৷'

ঠাকুরের যখন প্রেমোন্মাদ অবস্থা, লোকে যখন ওঁকে পাগল ভাবছে, তখন ভৈরবী ব্রাহ্মণী কিন্তু ঠাকুরের পরিবর্তনগুলিকে ঠিক ঠিক চিনতে পেরেছিলেন। এগুলি যে কোন রোগ নয়, কেবল সাধকের বিশেষ অবস্থার বাহ্যিক লক্ষণ মাত্র, তা তিনি শাস্ত্রের গভীর অধ্যয়ন ও প্রতীতি থেকেই বুঝেছিলেন। ফুলের মালা পরলে বা গায়ে চন্দনের প্রলেপ দিলে যে এই যন্ত্রণার উপশম হয়, তাও তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। শ্রীমতি রাধারানী থেকে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য পর্যন্ত যোগী আচার্যদের জীবনে আধ্যাত্মিক অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে যে অনুরূপ শারীরিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল - ভক্তিগ্রন্থসমূহ ও শাস্ত্রসমূহ উদ্ধৃত করে ভৈরবী তা সোচ্চারে ঘোষণা করতে একবিন্দু দ্বিধা করেননি। 

তারপর মথুরবাবু সে কালের বিখ্যাত পন্ডিত বৈষ্ণবচরণকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে। যে প্রধান উনিশটি ভাব বা অবস্থার সম্মিলনকে ভক্তিশাস্ত্রে মহাভাব বলা হয়, যা আগে শ্রীরাধিকা ও শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনে দেখা গিয়েছিল, বৈষ্ণবচরণ সেই সবকটি লক্ষণই দেখতে পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে। পরবর্তিকালে শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে তান্ত্রিক সাধক গৌরী পন্ডিতের অহংকারও খর্ব হয়েছিল। তিনি ঠাকুরকে চিনেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বররূপে ও ঈশ্বরলাভের জন্য সংসার ত্যাগ করেছিলেন।

মহাসমাধির কয়েকদিন আগে নরেন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে তাঁর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ঠাকুর সমাধিস্থ হন। নরেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল ঠাকুরের দেহ থেকে সূক্ষ্ম তেজরশ্মি, তড়ি‌ৎকম্পনের মত তাঁর শরীরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। সমাধিভঙ্গ হলে অশ্রু বিসর্জন করে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন,"আজ যথাসর্বস্ব তোকে দিয়ে ফকির হলুম, তুই এই শক্তিতে জগতের কাজ করবি। কাজ শেষ হলে ফিরে যাবি।" ঠাকুর কি সত্যিই অবতার, এই সংশয় তখনও সম্পূর্ণ নিরসন হয়নি যুক্তিবাদী নরেন্দ্রনাথের হৃদয় থেকে। অন্তর্যামী ঠাকুর তা উপলব্ধি করে বলেছিলেন, "সত্যি সত্যি বলছি, যে রাম যে কৃষ্ণ সেই ইদানিং এই শরীরে রামকৃষ্ণ – তবে তোর বেদান্তের দিক দিয়ে নয়।"

এসবের অনেকবছর পরে স্বামীজী যখন আমেরিকায় গীতা ও নারদসূত্রাদি গ্রন্থ অবলম্বন করে ভক্তিযোগ নামক গ্রন্থ লিখছেন, তখন শ্রীরামকৃষ্ণকে স্মরণ করে তাতে তিনি বলছেন, "Higher and nobler than all ordinary ones, is another set of teachers, the Avataras of Ishvara, in the world. They can transmit spirituality with a touch, even with a mere wish. The lowest and the most degraded characters become in one second saints at their command. They are the Teachers of all teachers, the highest manifestations of God through man. We cannot see God except through them. We cannot help worshipping them; and indeed they are the only ones whom we are bound to worship."

আমেরিকাতেই 'Christ the Messenger' নামক বক্তৃতায় স্বামীজী আরো বিস্তারিতভাবে অবতারত্বের প্রসঙ্গ বুঝিয়ে বলছেন, "Thou hast seen me and not seen the Father? I and my Father are one! The kingdom of Heaven is within you! If I am pure enough I will also find in the heart of my heart, I and my Father are one. That was what Jesus of Nazareth said.

"It has been said by the same Messenger (Christ) 'None hath seen God, but they have seen the Son.' And that is true. And where to see God but in the Son? It is true that you and I, the poorest of us, the meanest even, embody that God — even reflect that God. The vibration of light is everywhere, omnipresent; but we have to strike the light of the lamp there and then we human beings see that He is Omnipresent. The Omnipresent God of the Universe cannot be seen until He is reflected by these giant lamps of the earth; the Prophets, the Man-Gods, the Incarnations, the embodiments of God .... They are all manifestations of the same Infinite God. They were all pure and unselfish; they struggled, and gave up their lives for us, poor human beings. They all and each of them bore Vicarious atonement for every one of us and also for all that are to come hereafter."

কথামৃতে একটা বেশ মজার কথোপকথন আছে, দিনটি ছিল ১৮ই অক্টোবর, ১৮৮৫। নাট্যাচার্য্য গিরিশ চন্দ্র ঘোষের সাথে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের আলোচনা হচ্ছে।
ডাক্তার - 'অবতার আবার কি! যে মানুষ হাগে মোতে তার পদানত হব! হাঁ, তবে Reflection of God's light (ঈশ্বরের জ্যোতি) মানুষে প্রকাশ হয়ে থাকে তা মানি।' উত্তরে গিরিশবাবু তাঁর বিশ্বাসের কথা বলছেন এমন সময় ঠাকুর হস্তক্ষেপ করলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ - এ-সব যা কথা হচ্ছে, এ কিছুই নয়। .... যতক্ষণ কাঁচা ঘি, ততক্ষণই কলকলানি শোনা যায়। পাকা হলে আর শব্দ থাকে না। যার যেমন মন, ঈশ্বরকে সেইরূপ দেখে। আমি দেখেছি, বড় মানুষের বাড়ির ছবি - কুইন-এর ছবি আছে। আবার ভক্তের বাড়ি - ঠাকুরদের ছবি! .... পূর্ণজ্ঞানের লক্ষণ আছে। বিচার বন্ধ হয়ে যায়। যা বললুম, কাঁচা থাকলেই ঘিয়ের কলকলানি।
ডাক্তার - পূর্ণজ্ঞান থাকে কি? সব ঈশ্বর! তবে তুমি পরমহংসগিরি করছো কেন? আর এরাই বা এসে তোমার সেবা করছে কেন? চুপ করে থাক না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) - জল স্থির থাকলেও জল, হেললে দুললেও জল, তরঙ্গ হলেও জল।

Saturday, August 13, 2022

অখন্ড ভারত

আজ ১৪ই অগাস্ট, পাকিস্তানের জন্মদিন। আজকের দিনেই আমাদের দেশমায়ের দুটি বাহু কেটে নিয়ে পাকিস্তানের দুটি প্রান্ত তৈরি হয়েছিল। আসলে আক্রান্তার বেশে ভিনদেশি দানবরা এসে আমাদেরই কয়েকজনকে ধরে বেঁধে, মাথা মুড়িয়ে, এমন দানবিক বিষ তাদের মননে ঢেলে দিয়ে গিয়েছিল যে কয়েক প্রজন্ম পরে তারা ভুলেই গেল যে তারা আসলে কারা। 

সামান্য পূজাপদ্ধতি পাল্টে গিয়ে তারা যেন হটাৎ এক ভিন্ন জাতি, ভিন্ন মানুষ হয়ে গেল। আর যত তারা রাষ্ট্রের বৃহত্তর সমাজের মূলধারা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিতে লাগলো বা সমাজও তাদের নিত্যনতুন বিজাতীয় চাহিদা মেটাতে অক্ষমতা জাহির করতে শুরু করলো, তত তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আমাদের প্রাচীন উন্নত মানবিক উদার সভ্যতা ও ধর্মসংস্কৃতির প্রভাব কমতে কমতে একসময় এমন হলো যে তারা হিতাহিত জ্ঞান খুইয়ে নিজেদের ছেড়ে আসা রক্তের সম্পর্কের সনাতনী আত্মীয়-বন্ধুদেরই পরমশত্রু বলে ভাবতে শুরু করলো। দুর্ভাগ্যবশত, সেই ভাবনা আজো বেঁচে আছে কারণ দেশভাগের ৭৫ বছর পরেও দেশের ভেতরে ও বাইরে সেই একই বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকে উস্কে দেওয়ার ষড়যন্ত্রকারী লোকের অভাব নেই। 

পাকিস্তান কোনো ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক স্বত্তা নয়, ওটি আসলে নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের ইতিহাস, বস্তুত নিজেদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধেই কিছু অবুঝ অর্বাচীনের বিদ্রোহ, যার কোনো সারবত্তা নেই। পাকিস্তান থেকে ভাষার ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের অবস্থানও তাই। যে জাতি অন্যের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতির পদতলে নিজের পূর্বপুরুষের সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দেয়, তাদের আসলে একূল ওকূল দুকূলই যায়। বেচারাদের পায়ের তলায় মাটি থাকলেও আসলে এরা সবাই ছিন্নমূল।

পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো মেকি দেশ ১০০ বছরের বেশি টেকেনি, হয়তো আগামী ২৫ বছরে আমাদের উপমহাদেশের মানচিত্রটিও অনেকটাই বদলে যাবে। কিন্তু আজকের দিনে, যেদিন প্রেমজীভাই মেঘজী ঠক্করের নাতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজের ভারতীয়ত্ব বিসর্জন দিয়ে একটি কৃত্তিম দেশের প্রথম গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন, সেদিন কি সত্যি সত্যিই তার কোনো আদর্শের ভিত্তি ছিল নাকি কেবল ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বজনবৈরিতা, সেটা আজ পাকিস্তানের ঘোর বেহাল দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখিয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক মতবাদ কোনো কৃত্তিমভাবে তৈরি করা দেশকে ধরে রাখতে পারেনা, মধ্যপ্রাচ্য দেখিয়ে দিয়েছে ভাষা এক হলেও স্থানীয় সংস্কারের ভিত্তিতে নানা দেশ তৈরি হতে পারে আর বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে পন্থীয় একতাও কোনো কৃত্তিমভাবে তৈরি করা দেশকে ধরে রাখতে পারেনা। অন্যদিকে জার্মানি দেখিয়ে দিয়েছে যে জাতির মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন থাকলে কৃত্তিমভাবে বিভাজিত দেশও একদিন আপনাআপনিই জুড়ে গিয়ে আবার এক হয়ে যায়। 

এই সংস্কৃতিই হলো মূল কথা, যে কোনো সভ্যতার ওটাই আসল অবদান। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কথা ছেড়ে দিয়ে আপাতত আমরা যদি আমাদের নিজেদের দেশে বসবাসকারী সমস্ত নাগরিককে সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতির রঙ্গে না রাঙিয়ে তুলতে পারি, তাহলে এই স্বাধীনতা অর্থহীন। আমরা স্বাধীন বলে তখনই গণ্য হবো যখন আমাদের নিজেদের সভ্যতার কথা আমরা সোচ্চারে বলতে পারবো। এই রাষ্ট্র হিন্দুরাষ্ট্র কারণ আমরা সবাই হিন্দু সভ্যতার ধারক ও বাহক - ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে এ কথা বলার মধ্যে যতদিন দ্বিধাবোধ থাকবে ততদিন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন নৈ। 

হয়তো আজ যে কথা কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, আর কয়েকবছর পর তা সোচ্চারে শোনা যাবে কারণ এক বৃহৎসংখ্যক জনগণের মধ্যে সার্বিকভাবে সংস্কৃতি-সচেতনতা বাড়ছে। আজকের মতো দিন হলো সংকল্প নেওয়ার দিন, যেদিন শেষবার জোর করে আমাদের দেশমাতৃকার অঙ্গহানি করা হয়েছিল। আমরা যে এক জাতি এক প্রাণ - এই কথাটা আমাদের নিজেদের দেশের মধ্যে আগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আর তার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নিয়ে রাষ্ট্রের সমস্ত নীতি এবং তন্ত্রকে একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ দিতে হবে। যেদিন আমরা সেটা করতে ফেলতে পারবো, তার সুফল এমন আকর্ষক ও কার্যকরী হবে যে আশেপাশের সব মেকি দেওয়াল এমনি এমনিই খসে পড়বে। সেদিন আর কোনো ১৪ই অগাস্টও থাকবে না, শুধুই ১৫ই।

Wednesday, August 10, 2022

নামীর ধ্যান-ধারণা

ঠাকুর তাঁর শিষ্যদের শুধু নাম করতে বলতেন না, বলতেন সেই সাথে নামীর ধ্যান-ধারণাও করতে হয়। ঠাকুরের অনেক সন্তানই তাঁর এই কথাটি বলেছেন বটে কিন্তু কিভাবে যে ঠাকুর নামীর ধ্যান-ধারণা করতে শেখাতেন, সেই বিষয়টি আর বলেননি। একবার বলরাম মন্দিরে এক ভক্ত লাটু মহারাজকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "ধ্যেয় একমাত্র ভগবান। ভগবান ছাড়া আবার কার ধ্যান-ধারণা করবে? যাঁকে ধরেই এগোও না কেন, শেষে তাঁরই কাছে গিয়ে পৌঁছবে।" 

এই উত্তরেও কিন্তু modus operandi নেই, কেবল ইঙ্গিত আছে। সত্যিই তো, আমার পছন্দের ভগবান কালী হন বা কৃষ্ণ, শিব হন বা ব্রহ্মা, তাঁর যে মূর্তিই পছন্দ করি না কেন, তাঁকে তো চাক্ষুষ দেখিনি, কেবল স্তব স্তোত্র পুরাণ পড়ে তাঁর সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করবো কি করে? ধারণা করবো গুরুকে দেখে। লাটু মহারাজ বলছেন, "গুরু - সচ্চিদানন্দ। ... আসলি গুরুর মন সবসময় তাঁতেই যুক্ত থাকে, জানবে। তাই তাঁর (ভগবান) সাথে আসলি গুরুর কোনো ভেদ থাকে না। শাস্ত্রে তাই লেখা আছে - 'গুরু ব্রহ্ম এক'।" 

যাঁদের গুরুই ইষ্ট এবং ইষ্টই গুরু, তাঁদের ক্ষেত্রে নাম ও নামীর ধ্যান-ধারণা কি ভাবে করা যায়, এটা তার একটা সূত্র বৈকি। আমাদের রামকৃষ্ণ ভাবধারায় ঠাকুরই গুরু, আবার তিনিই ইষ্ট। যেহেতু আমরা ঠাকুরের একাধিক আসল photograph দেখতে পাই, তাঁর থাকার জায়গা, তাঁর ব্যবহার করা জিনিষ্পত্তর, তাঁর হাতে পোঁতা আঁটির আমগাছ ইত্যাদি স্বচক্ষে দেখতে পাই আর কথামৃত, লীলাপ্রসঙ্গ এবং অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীদের লেখায় তাঁর মুখের ভাষা শুনতে পাই, তিনি কিভাবে থাকতেন, কি কি করতেন ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে পারি, ফলে এক্ষেত্রে নাম আর নামীকে এক জেনে তাঁর সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়না।

একই ব্যাপার শ্রীশ্রীমায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মা কালীর মূর্তি যতই দার্শনিকভাবে অজ্ঞানীর অজ্ঞানকে ধ্বংস করে ভগবৎকৃপায় জ্ঞানের আলো জ্বালানোর প্রতীকী অপার্থিবরূপ হোন না কেন, তাঁর মাতৃরূপকে ধারণা করা সাধারণ ভক্তের পক্ষে খুব একটা সহজসাধ্য নয়, সাধক হলে অন্য কথা। কিন্তু মাকে আপন মা, কল্যাণদাত্রী, মঙ্গলময়ী, মুর্তিময়ী বাৎসল্য বলে বুঝে নিতে মোটেও বেগ পেতে হয়না, ও বড় সহজ। ঠাকুরের তাও নাহয় কিছু বাছবিচার ছিল, মায়ের তো অবারিতদ্বার - একাধারে তিনি একদিকে সর্বংসহা, মমতার প্রতিমূর্তি, যেন আমাদের রক্তমাংসের মা আবার অন্যদিকে পরমজ্ঞানদাত্রী, জগ্গজননী, মহাশক্তি, জগন্মাতা, মোক্ষপ্রদায়িনী মহামায়া, সত্যিকারের মা। মা কালীকে আমরা হয়তো ভক্তি করতে পারি, দূর থেকে প্রণাম করতে পারি কিন্তু এই মায়ের কাছে আবদার করা যায়, ঘ্যান ঘ্যান করা যায়, মাকে বিরক্ত করা যায়, মায়ের আঁচল ধরে টানা যায় আর মায়ের পার্থিবরূপ মনের মধ্যে দেখা যায়, তাঁকে অকপটে সুখ-দুঃখের কথা বলা যায়, প্রাত্যহিক যাপনে তাঁর স্নেহাশীর্বাদ অনুভব করা যায়, তাঁর চরণ স্পর্শ করে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়। 

শ্রীশ্রীমায়ের অন্যান্য নানা ভক্তদের মতোই, শ্রীমতি সরযুবালা দেবীর স্মৃতিকথাতেও মায়ের মাতৃরূপটি এমনভাবে ধরা আছে, যাঁকে যে কোনো সময়ে 'মা কেমন আছো' বলে জড়িয়ে ধরা যায়। উনি লিখছেন, 'একদিন স্কুলের ছুটি হলে গৌরীমার আশ্রম হতে মায়ের শ্রীচরণদর্শন করতে গেলুম। গ্রীষ্মকাল। সেদিন একটু পরিশ্রান্তও হয়েছিলুম। দেখি, মা একঘর স্ত্রী-ভক্তের মধ্যে বসে আছেন। আমি গিয়ে প্রণাম করতেই মূখপানে চেয়ে মশারির উপর হতে তাড়াতাড়ি পাখাখানি নিয়ে আমায় বাতাস করতে লাগলেন। ব্যস্ত হয়ে বললেন, "শীগগির গায়ের জামা খুলে ফেল, গায়ে হাওয়া লাগুক।" কি অপূর্ব স্নেহ-ভালবাসা! অত লােকের মধ্যে এত আদর-যত্ন! আমার ভারি লজ্জা করতে লাগল—সবাই চেয়ে দেখছিল; মা নিতান্ত ব্যস্ত হয়েছেন দেখে জামা খুলতেই হল। আমি যত বলি, "পাখা আমাকে দিন, আমি বাতাস খাচ্ছি," ততই স্নেহভরে বলতে লাগলেন, "তা হােক, তা হােক; একটু ঠাণ্ডা হয়ে নাও!" তারপর প্রসাদ ও এক গ্লাস জল এনে খাইয়ে তবে শান্ত হলেন।'

ঠাকুরের সন্তানরাও তাঁর সম্পর্কে যে স্মৃতিচারণা করে গেছেন, সেখানে তাঁর সান্নিধ্য শ্রীশ্রীমায়ের মতন এত সহজলভ্য না হলেও, তিনিও যে অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং ভক্তবৎসল ছিলেন, তা ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে। লাটু মহারাজ সকালবেলায় প্রথমে ঠাকুরের মুখ না দেখে অন্য কোনোদিকে তাকাতেন না। একদিন ঠাকুরকে ঘরে দেখতে না পেয়ে উনি ঘরের ভেতর থেকেই চিৎকার করে ডাকছেন। ঠাকুর তাঁকে ঘরের বাইরে আসতে বললেন। পশ্চিমদিকের বারান্দায় এসে লাটু মহারাজ দেখলেন যে ঠাকুর ফুল-বাগানে কিছু খুঁজছেন। উনি জিজ্ঞেস করলেন, "ওখানে কি খুঁজছেন মশাই?" ঠাকুর - "ওরে! কাল যে চটিজোড়া (...) এনে দিলে, তার একপাটি রয়েছে, আর একপাটি বোধহয় শেয়ালে নিয়ে গেছে। দেখছি, এখানে এনেছে কিনা!" ঠাকুর জুতো খুঁজছেন শুনে লাটু মহারাজ শিউরে উঠলেন, বললেন, "চলে আসুন, মশাই! আর আপুনাকে খুঁজতে হবে না!" ঠাকুর - "তাই তো রে! নতুন জুতোজোড়াটি তোর ভোগে হলো না। কাল সবে এনে দিলে, মাত্র একবার পায়ে দিয়েছিস।" এই কথা শুনে লাটু মহারাজ উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠেছিলেন - "আপুনি চলে আসুন মশাই! এতে যে হামার অকল্যাণ হবে। আপুনাকে ওসব খুঁজতে নেই - আজ দেখছি সারা দিনটা হামার বিলকুল খারাপ যাবে।" তাঁর কথা শুনে ঠাকুর হাসতে হাসতে বললেন, "দিন কি ওতে খারাপ যায় রে? যেদিন ভগবানের নাম হয়না, সেইদিনই খারাপ যায়।"

ঠাকুর হলেন সমস্ত পুরুষ দেবতাদের জীবন্ত রূপ আর মা হলেন সমস্ত শক্তিরূপিণী দেবীদের জীবন্তরূপ, যদিও দুইই এক, সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম। যাঁর যে নাম আর যে ইষ্টমূর্তিই ভালো লাগুক না কেন, নামীর সাক্ষাৎ ধ্যান-ধারণা করতে গেলে পুরুষ আর প্রকৃতির একেবারে জীবন্ত ফলিতরূপ হলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব আর শ্রীশ্রীমা। তাই ওঁদের কোনো বিশেষ sect নেই, কোনো বিশেষ মতবাদ নেই, কোনো গোঁড়ামী নেই - যত মত তত পথ। আমরা আমাদের ইষ্টকে যেভাবেই কল্পনা করি না কেন, ঠাকুর আর মায়ের মধ্যে গুণময় থেকে গুণাতীত সবটাই আছে। আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে ভগবানকে আমরা ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে পেয়েছি আর তাঁদের নাম জপ করার সময় তাঁদের পার্থিবরূপ এবং অনন্তরূপকে একাধারে ধ্যান-ধারণা করার মতো সুযোগ করে দিয়ে আমাদের সবাইকে তাঁরা অহেতুকি কৃপা করেছেন। এটাকেই আসলে কল্পতরু বলে।

Monday, August 8, 2022

স্থিরমতি হও

আমরা যখন চাকরি করতাম তখন যে কাজের চাপ কিছু কম ছিল, তা নয়। কর্মক্ষেত্রের রাজনীতি থেকে নিয়ে দমবন্ধ করা ডেডলাইন, সহকর্মীদের সাথে টিফিন ভাগ করে নেওয়া থেকে নিয়ে তাদের সাথেই কর্পোরেটদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার তীব্র প্রতিযোগিতা এবং ব্যক্তিগত দড়ি টানাটানি, সবই ছিল। আর যেমন যেমন ওপরে ওঠা গেছে তেমন তেমন নিচুতলা থেকে ছেঁকে উঠে আসা বিশুদ্ধ থেকে বিশুদ্ধতর সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে, আরো একাকী থেকে একাকীতর হতে হয়েছে, আরো অনেক সহকর্মীদের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে অনেক বেশি চাপ নিতে হয়েছে নিজের ঘাড়ে। তবু আমরা বার্নড আউট হয়ে যাইনি। ক্বচিৎকদাচিত বিনিদ্র রাত্রি যাপন করতে হলেও, ঘুমের ওষুধ খেয়ে জোর করে ঘুমাতে হয়নি কখনো। 

আশেপাশে দেখছি আমাদেরই ঘরের এখনকার ছেলেমেয়েদের কিন্তু হাঁড়ির হাল হচ্ছে। একেবারে এন্ট্রিলেভেল ম্যানেজমেন্ট এক্সিক্যুটিভরাও দেখছি চাপের চোটে নাজেহাল। আমরা অফিসটাকে অফিসেই রেখে আসতে পারতাম, এদের অনেকের জীবনে তো দেখি কাজ আর অবসরের মধ্যে কোনো ভারসাম্যই নেই। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ঠেলায় এরা সারা দিনরাতই অফিস মাথায় করে ঘুরছে আর কর্মক্ষেত্রজনিত উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও দুশ্চিন্তায় এদের অনেকেরই এমন দুর্দশা যে এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে আজ গাদা গাদা টাকা খরচ করে মনস্তত্ববিদদের সাহায্য নিতে হচ্ছে, স্ট্রেস কমানোর জন্য ওষুধ পর্য্যন্ত খেতে হচ্ছে। 

এরপর যখন এদের বিয়ে-থা হবে, যখন জীবনে সত্যিকারের চাপ আসবে, একদিকে সাংসারিক জীবনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং অন্যদিকে কর্মজীবনে ক্রমবর্ধমান দায়িত্বের বোঝা একসাথে মাথায় চাপবে, তখন যে এদের কি দশা হবে, ভাবলেই ভয় হয়। এই জন্যই কি আজকালকার ছেলেমেয়েরা এত ঘন ঘন চাকরি পাল্টায়? আর এই কারণেই কি বিবাহবিচ্ছেদও আজকাল এত বেড়ে গেছে? হয়তো তাই, ঠিক জানিনা। বা হয়তো এরা সেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার এবং সন্তুষ্ট থাকার শিক্ষাটুকু পায়নি যা আমাদের প্রজন্ম পেয়েছিল এবং তার জন্য আমরাই দায়ী। আমরা রাঙ্গাপিসি সেজমাসী ফুলকাকা আর নমামাদের দেখে বড় হয়েছি, আমরা জানতাম আমাদের সমস্ত জ্যাটতোতো খুড়তোতো মাসতোতো আর মামাতো ভাইবোনেরা মিলে একটাই বৃহৎ পরিবার। আমাদের একা একা নিজস্ব ঘুড়ি ওড়াতে নেই, লুকিয়ে লুকিয়ে নিজস্ব কিছু খেতেও নেই, বস্তুত যা কিছু বাড়িতে আছে তাতে সকলের সমান অধিকার। এই বেড়ে ওঠাটাই আজ উঠে গেছে যে।

আসলে এখনকার শিক্ষিত চাকরিরত প্রজন্ম বাইরে বাইরে যে রেহাইয়ের খোঁজ করছে, সেটা কিন্তু বাইরে নেই, সে আছে অন্তরে। সুখ কখনোই নিজের মনের বাইরে থাকে না, অপ্রয়োজনীয় এবং অন্তহীন চাহিদাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের মনের সুখকে মনের মধ্যেই সযত্নে লালন করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়।" আর তারপর বলেছেন, "এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ,
তাই মান অভিমান,
তাই এত হায় হায়।
প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।"

কেন এত ছোট বয়সে এদের এত এংক্সাইটি, এটা নিয়ে ইদানিং অনেক ভেবেছি। আমার মনে হয়েছে যে আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি ঈশ্বর অনিৰ্ভর, ফলে আমরা যেমন মহাশক্তির ওপর ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি, এরা সবটাই নিজেদের ওপর নিয়ে নিয়ে সারারাত ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বসে থাকে। আর যত এদের মনের ওপর চাপ বাড়তে থাকে, তত এরা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়কে কম্পিউটার গেমস, পার্টি, নাইট লাইফ ইত্যাদি বাইরের উদ্দীপক বস্তুতে খরচা করে নিজেদের শারীরিক ঘড়ির বারোটা বাজিয়ে ফেলে, যার আবার নিজস্ব ভোগান্তি আছে।

এদের তৃতীয় সমস্যা হলো ধ্যানহীনতা; অর্থাৎ নিজের মনটাকে সংযত করে, একাগ্র করে, নিজের ভেতরে ডুব দেওয়ার অভ্যাসের অভাব। অবশ্য নির্দিষ্ট ইষ্ট না থাকলে ধ্যানে মনোনিবেশ করা খুবই কঠিন কিন্তু আজকাল যাকে মেডিটেশন বলে, আদপে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা, সেটাও এরা বেশিরভাগই করে না। এদের অনেকের মধ্যেই দেখেছি গভীর ধর্মবোধ আছে কিন্তু একইসাথে পন্থবিমুখতা এদের মধ্যে এমন একটা আত্মদ্রোহ সৃষ্টি করছে, যা এদেরকে পূর্বপুরুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জুড়তে দিচ্ছে না। ফলে এই যে আমাদের নিজেকে খোঁজার বিরাট এক ঐতিহ্য, এই যে ত্যাগের মাধ্যমে ভোগের প্রাচীন দর্শন, এই যে কামের পরে মোক্ষের উদ্দেশ্যে যাত্রা, এই গভীর জীবনবোধ থেকে এরা অনেকেই বঞ্চিত।

বেচারাদের প্রধান খামতি হলো রোজগারের আসল উদ্দেশ্যকে বুঝতে না পারা। আমাদের কালে ছেলেদের ২৬-২৭এর মধ্যে বিয়ে হয়ে যেত, ৩০-৩২এর মধ্যে পরিবার কমপ্লিট। আমরা যখন চাকরি করতাম তখন আমরা জানতাম যে নিজের সংসার চালানোর দায় যেহেতু নিজেকেই নিতে হবে তাই রোজগার খুবই দরকার, চাকরির মানে কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। হ্যাঁ, যেমন যেমন প্রয়োজন বাড়বে তেমন তেমন রোজগারও বাড়াতে হবে, ফলে প্রোমোশনের জন্য লড়াই অবশ্যই ছিল কিন্তু আমরা অনেকেই যাকে আদ্যপান্ত কেরিয়ারিস্ট বলে, তা ছিলাম না। আমাদের বেশিরভাগেরই ধরাবাঁধা জীবন ছিল, অফিস পরিবার আর অবসরযাপনের মধ্যে একটা ঠিকঠাক সামঞ্জস্য ছিল, আর সন্তুষ্ট হতে বেশি বেগ পেতে হতো না।

আমরা অল্পতেই বেশি সুখী ছিলাম। আমাদের কাছে মাইনের মানে ছিল বউয়ের ছোট ছোট সাধপূরণ, ছেলেদের এবং পরিবারের প্রয়োজন এবং কিছুটা অপ্রয়োজনও মেটানো, জন্মদিনে শাড়ি উপহার পেয়ে মায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখা, মাঝে মাঝে সবাইকে নিয়ে ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া, নমাসে ছমাসে একবার সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, পরিবারের দোল দুর্গোৎসব বিয়ে অন্নপ্রাসন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে সবাইকে নিয়ে ফুর্তি করা, মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডা দেওয়া আর মাঠে গিয়ে ক্রিকেট ফুটবল খেলা দেখা, ইত্যাদি। আমাদের মধ্যে যারা ক্লাবে গিয়ে সন্ধ্যে কাটাতো তাদের কথা আলাদা, কিন্তু বেশিরভাগই ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে এবং তারা বিষয়টি ঠিকঠাক বুঝতে পারলেই যথেষ্ট সুখ পেতো। 

আমাদের মতন ঘরের এখনকার ছেলেদের মানসিকতা কিন্তু একেবারে আলাদা। এরা ৩২-৩৩এর আগে বিয়েই করেনা আর এদের কাছে মাইনের মানে নতুন নতুন গ্যাজেট, দামি দামি পোষাকঅসাক, আইফোন, দামি খেলনা, আরো কত কিই। কর্মজীবনের প্রাথমিক বছরগুলোয় এদের শুধু আমি আমি আমি - আমরা কোথাও নেই। আর ঘড়ি থেকে গাড়ি, সবেতেই অহেতুক কম্পিটিশন, প্লেন ছাড়া চড়া নেই, ছুটি কাটানোর জন্য খরচের মাবাবা নেই, আমদানির উদ্দেশ্যই হলো ভোগ, আরো ভোগ, অন্তহীন ভোগ। ফলে এদের যেমন ব্যক্তিগত অর্থের চাহিদার শেষ নেই, তেমনই উচ্চাকাঙ্ক্ষারও শেষ নেই আর বেশিরভাগকেই দেখি অর্থবান হওয়ার শর্টকাট পন্থা খুঁজে চলেছে। আমরা মধ্যবয়সী মা-বাপেরা অনেকেই নিজেরাও ইংরিজি মিডিয়াম স্কুল-কলেজে ইরফান হাবিব - রোমিলা থাপারদের লেখা গালগল্প পড়েই বড় হয়েছি কিন্ত আমরা আমাদের পারম্পরিক মূল্যবোধকে কখনো অস্বীকার করতে পারিনি কারণ আমাদের দাদু ঠাকুমা, আমাদের মা বাবা কাকা মামারা অকৃপণ হাতে সেটি আমাদের মধ্যে গেঁথে দিয়েছিলেন। অথচ আমরা আমাদের সন্তানদের ম্যাকলে নির্মিত সেই বিকৃত শিক্ষাব্যবস্থাটি হস্তান্তর করেছি ঠিকই কিন্তু ওদের মনের মধ্যে গড়ে ওঠা পারিবারিক সংস্কারের চারপাশে বেড়া দিতে ভুলে গিয়েছি, যার ফল বেচারারা আজ ভোগ করছে।

সময়ের সাথে সাথে জীবনধারণের স্বাচ্ছন্দ্য অবশ্যই বেড়েছে কিন্তু জীবনবোধ বেড়েছে কি? বরং লিপ্সা বেড়েছে, স্বার্থপরতা বেড়েছে আর পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিষন্নতা। আজকাল আকছার শুনছি ৩৫-৪০ বছর বয়সে গভীর মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে যাওয়ার কাহিনী, যুবক-যুবতীদের হটাৎ ব্রেনস্ট্রোক বা হার্টএট্যাকে প্রদীপ নিবে যাওয়ার কাহিনী, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাপ সহ্য করতে না পেরে কেরিয়ারের মধ্যগগনে হাল ছেড়ে দেওয়ার কাহিনীও। দুচোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ২৩শে চাকরিতে ঢুকে ৩৩ পৌঁছতে না পৌঁছতেই কমপ্লিট কর্পোরেট বার্নআউট - তারপর বাকি বছরগুলো ভয়ানক অশান্তি, বিতৃষ্ণা আর ক্রোধের আবহে ক্ষয় হতে হতে কোনোমতে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া, এটা তো কোনো কাজের কথা নয়। তাহলে উপায় কি?

উপায় শ্রীকৃষ্ণের দেখানো পথ অনুসরণ করা। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর কর্মযোগ বক্তৃতায় ষষ্ঠ অধ্যায়, প্যারা ৮এ বলছেন, "যদি কেউ দর্শনের একটা সূত্রও না পাঠ করে, যদি সে ঈশ্বরের অস্তিত্বেই না বিশ্বাস করে, এবং যদি সারা জীবনে একবারও ঈশ্বরের আরাধনা না করে, তবু শুভ কর্মসমূহের সরলক্ষমতা তাকে সেই অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে যেখানে পরের জন্য সে তার জীবন ও অন্য সব কিছুই উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হবে । এক্ষেত্রে একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি তার আরাধনার মাধ্যমে আর একজন দার্শনিক তার জ্ঞানের জন্য যে বিন্দুতে পৌঁছবে সেও সেই বিন্দুতেই পৌঁছতে সক্ষম । সুতরাং তোমরা নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে দার্শনিক, কর্মী ও ভক্ত সকলে একই বিন্দুতে মিলিত হয়; আর সেই বিন্দুই হচ্ছে আত্মোৎসর্গীকৃত হওয়া।"

ওই বক্তৃতারই সপ্তম অধ্যায়ে স্বামীজী যা বলছেন তার নির্যাস হলো এই: 'নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু কর্মে আসক্তি ত্যাগ কর। কোন কিছুর সাথে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলো না। মনকে মুক্ত রাখো। যা কিছু দেখছো, দুঃখ কষ্ট সবই জগতের অপরিহার্য পরিবেশ মাত্র। এগুলো সবই ক্ষণস্থায়ী, এগুলো আমাদের স্বভাবগত নয়। আমাদের স্বরূপ দুঃখ ও সুখের পারে - প্রত্যক্ষ বা কল্পনার অতীত। ...আসক্তি হতেই দুঃখ আসে, কর্ম হতে নয়। যখনই আমরা কর্মের সাথে নিজেদের অভিন্ন করে ফেলি, তখনই আমরা দুঃখ বোধ করি, কিন্তু কর্মের সাথে ঐভাবে জুড়ে না হয়ে গেলে সেই দুঃখ আর অনুভব করি না।' গীতা ছাড়া গতি নেই। যেখানে জীবন গুলিয়ে যাবে, সেখানেই গীতা উদ্ধারকারীর ভূমিকা পালন করে। তাই আমি যুবক-যুবতীদের বিষাদগ্রস্ত দেখলেই গীতা পড়তে উজ্জীবিত করি। কর্মযোগে স্বামীজীর বক্তৃতার মধ্যেই মতিস্থির করার উপায় রয়েছে, "ক্রন্দন তো বন্ধনের চিহ্ন - দুর্বলতার চিহ্ন। একবিন্দু চোখের জল যেন না পড়ে। এইরূপ হবার উপায় কি? সম্পূর্ণ অনাসক্ত হও।"

Wednesday, August 3, 2022

সমদর্শন

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়-ধ্যানযোগে শ্রীকৃষ্ণ আর অর্জুনের মধ্যে একটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথোপকথন আছে। শ্রীভগবান বলছেন,
সর্বভূতস্থমাত্মনং সর্বভূতানি চাত্মনি। 
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।।
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি। 
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।
সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ।
সর্বথা বর্তমানোহপি স যোগী ময়ি বর্ততে।।
আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন। 
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ।।
অনুবাদঃ 
- প্রকৃত যোগী সর্বভূতে আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতে সব কিছু দর্শন করেন। যোগযুক্ত আত্মা সর্বত্রই আমাকে দর্শন করেন। 
- যিনি সর্বত্র আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতেই সমস্ত বস্তু দর্শন করেন, আমি কখনও তাঁর দৃষ্টির অগোচর হই না এবং তিনিও আমার দৃষ্টির অগোচর হন না। 
- যে যোগী সর্বভূতে আমাকেই স্থিত জেনে আমার ভজনা করেন, তিনি সর্ব অবস্থাতেই আমাতে অবস্থান করেন। 
- হে অর্জুন! যিনি সমস্ত জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখের অনুরূপ সমানভাবে দর্শন করেন, আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। 

অর্জুনের মতন অমন উচ্চকোটির যোগী, স্বয়ং ভগবান যাঁর সখা এবং যিনি নিজে বিশ্বরূপ দর্শন করার অধিকারী মহাধার, তিনি পর্য্যন্ত এই সমদর্শনভাবকে খুব সহজে অনুশীলনযোগ্য বলে মনে করতে পারছেন না। বলছেন,
যোহয়ং যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন। 
এতস্যাহং ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্।।
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্।
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্।।
- হে মধুসূদন! তুমি সর্বত্র সমদর্শনরূপ যে যোগ উপদেশ করলে, মনের চঞ্চল স্বভাববশত আমি তার স্থায়ী স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না। 
- হে কৃষ্ণ ! মন বড় চঞ্চল, বিক্ষেপ-উৎপাদক, জেদি এবং অত্যন্ত বলবান, তাই তাকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি৷

তখন শ্রীভগবান উত্তর দিচ্ছেন,
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।।
অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ। 
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোহবাপ্তুমুপায়তঃ।।
- হে মহাবাহো! মন যে দুর্দমনীয় ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়, ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যর দ্বারা মনকেও বশীভূত করা যায়। 
- অসংযত চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে আত্ম-উপলব্ধি দুষ্প্রাপ্য বটে কিন্তু যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ উপায় অবলম্বন করে মনকে বশ করতে চেষ্টা করেন, তিনি অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করেন। এটিই আমার অভিমত।

কুরুক্ষেত্রে এই বাক্যালাপের প্রায় আট হাজার বছর পরে, আমাদের এই বঙ্গদেশে, শ্রীকৃষ্ণেরই আর একজন অবতারের সাথে তাঁর কথামৃতকার শিষ্য মাস্টারমশাইয়ের কথোপকথনেও এই একই ভাব একদম বাস্তব হয়ে ফুটে উঠেছে। ২৭শে ডিসেম্বর ১৮৮৪, দেবী চৌধুরাণীর প্রসঙ্গ টেনে ঈশ্বর কি প্রত্যক্ষ হন, এই কথা হচ্ছে। 

শ্রীরামকৃষ্ণ — মনের প্রত্যক্ষ। সে এ-মনের নয়। সে শুদ্ধমনের। এ-মন থাকে না। বিষয়াসক্তি একটুও থাকলে হয় না। মন যখন শুদ্ধ হয়, শুদ্ধমনও বলতে পার, শুদ্ধ আত্মাও বলতে পার।

মাস্টার — মনের দ্বারা প্রত্যক্ষ যে সহজে হয় না, এ-কথা একটু পরে আছে। বলেছে প্রত্যক্ষ করতে দূরবীন চাই। ওই দূরবীনের নাম যোগ। তারপর যেমন গীতায় আছে, বলেছে, যোগ তিনরকম — জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ। এই যোগ-দূরবীন দিয়ে ঈশ্বরকে দেখা যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এ খুব ভাল কথা। গীতার কথা। ....প্রতিমায় ঈশ্বরের পূজা হয় আর জীয়ন্ত মানুষে কি হয় না? তিনিই মানুষ হয়ে লীলা করছেন।

"কি অবস্থা গেছে। হরগৌরীভাবে কতদিন ছিলুম। আবার কতদিন রাধাকৃষ্ণভাবে! কখন সীতারামের ভাবে! রাধার ভাবে কৃষ্ণ কৃষ্ণ করতুম, সীতার ভাবে রাম রাম করতুম!

"তবে লীলাই শেষ নয়। এই সব ভাবের পর বললুম, মা এ-সব বিচ্ছেদ আছে। যার বিচ্ছেদ নাই, এমন অবস্থা করে দাও। তাই কতদিন অখণ্ড সচ্চিদানন্দ এই ভাবে রইলুম। ঠাকুরদের ছবি ঘর থেকে বার করে দিলুম।

"তাঁকে সর্বভূতে দর্শন করতে লাগলুম। পূজা উঠে গেল! এই বেলগাছ! বেলপাতা তুলতে আসতুম! একদিন পাতা ছিঁড়তে গিয়ে আঁশ খানিকটা উঠে এল। দেখলাম গাছ চৈতন্যময়! মনে কষ্ট হল। দূর্বা তুলতে গিয়ে দেখি, আর-সেরকম করে তুলতে পারিনি। তখন রোখ করে তুলতে গেলুম।

"আমি লেবু কাটতে পারি না। সেদিন অনেক কষ্টে, ‘জয় কালী’ বলে তাঁর সম্মুখে বলির মতো করে তবে কাটতে পেরেছিলুম। একদিন ফুল তুলতে গিয়ে দেখিয়ে দিলে, — গাছে ফুল ফুটে আছে, যেন সম্মুখে বিরাট — পূজা হয়ে গেছে — বিরাটের মাথায় ফুলের তোড়া! আর ফুল তোলা হল না!

"তিনি মানুষ হয়েও লীলা করছেন। আমি দেখি, সাক্ষাৎ নারায়ণ। কাঠ ঘষতে ঘষতে আগুন বেরোয়, ভক্তির জোর থাকলে মানুষেতেই ঈশ্বর দর্শন হয়। তেমন টোপ হলে বড় রুই কাতলা কপ্‌ করে খায়। 

"প্রেমোন্মাদ হলে সর্বভূতে সাক্ষাৎকার হয়। গোপীরা সর্বভূতে শ্রীকৃষ্ণ দর্শন করেছিল। কৃষ্ণময় দেখেছিল। বলেছিল, আমি কৃষ্ণ! তখন উন্মাদ অবস্থা! গাছ দেখে বলে, এরা তপস্বী, শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করছে। তৃণ দেখে বলে, শ্রীকৃষ্ণকে স্পর্শ করে ওই দেখ পৃথিবীর রোমাঞ্চ হয়েছে।”

আমরা যাঁকে শ্রীশ্রীমায়ের ভান্ডারী বলে জানি সেই শরৎ মহারাজকে বালক বয়সে একদিন শ্রীরামকৃষ্ণদেব জিজ্ঞেস করেছিলেন, "কিরে, তুই কিছু চাইলি না যে?" সেদিন পরবর্তীকালের ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ শ্রীমৎ স্বামী সারদানন্দজী মহারাজ তাঁকে বলেছিলেন, "আমি যাতে সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শন করি, এরূপ করে দিন।" উত্তরে ঠাকুর বলেছিলেন, "ও যে শেষের কথা রে! তা তোর হবে।" এই গুরুবাক্য কিভাবে তাঁর জীবনে অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল তার একটি প্রমান 'প্রাচীন সাধুদের কথা' বইটিতে আছে। জনৈক ভক্ত একবার স্বামী সারদানন্দজীকে জিজ্ঞাসা করেন, "আপনি আমাদের এত ভালবাসেন কেন? দেখুন, শেষে জড়ভরতের মতো বদ্ধ না হয়ে যান।" স্বামী সারদানন্দজী কোন উত্তর দিলেন না। কয়েকদিন পর ঐ ভক্ত উদ্বোধনে এলে মহারাজ বললেন , "সেদিন বেলুড় মঠে গিয়ে ঠাকুরের সামনে প্রনাম করলাম। ঠাকুর আবির্ভুত হয়ে আমাকে বললেন ---- 'তুই সবাইকে ভালবাসিস কারন, তুই আমাকে সবার মধ্যে দেখিস।' সেদিন তুমি যে প্রশ্ন করেছিলে, এই হল তার উত্তর।" এই স্মৃতিচারণটি করে ছলছল চোখে তাঁরই শিষ্য এবং রামকৃষ্ণসঙ্ঘের দ্বাদশ সঙ্ঘগুরু শ্রীমৎ স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে গীতার সেই পূর্বোল্লেখিত শ্লোকটি বলেছিলেন, 
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি। 
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।

Saturday, July 30, 2022

আবার কুরুক্ষেত্র

স্বর্গলোক, ভূলোক আর পাতাললোক আসলে মনেরই তিন অবস্থা, বাস্তবেও যার প্রতিফলিতরূপ দেখা যায়। স্বর্গলোক হলো সেই মানসিক অবস্থান যেখানে সৃষ্টি আর স্রষ্টা সর্বদা একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন, অর্থাৎ আধ্যাত্মলোক। যদি গুণের দিক দিয়ে দেখা হয় তাহলে এই অবস্থায় মন সত্ত্ব রজঃ তম তিনটি গুণেকেই অতিক্রম করে প্রকৃতির পারে চলে যায়। 

ভুলোক হলো সেইসব জীবের বাসভূমি যারা জড় শরীরে আবদ্ধ হয়েও চেতনের খোঁজে ফেরে আর যদিও সত্ত্বগুণ সুখে আসক্তি সৃষ্টি করে এবং রজগুণ কর্মে আসক্তি সৃষ্টি করে তাদের প্রকৃত স্বরূপ ভুলিয়ে রাখে, তবুও কোনো না কোনো সময় নশ্বরতার অসারত্ব অনুভব করে সেই জীব জড়ের উর্দ্ধে উঠতে চায়। 

শেষে আসে পাতাললোক যেখানে বিবেককে ঢাকা দিয়ে প্রমাদে নিমজ্জিত করে তমগুণ জীবের ওপর নিজের একাধিকার স্থাপন করে। চরম ভোগবিলাসে নিমজ্জিত, ইন্দ্রিয়তাড়িত, ধর্মবোধহীন cult নির্ভর, চরম স্বার্থপর, মতবাদ বা পদ্ধতির নামে হানাহানিতে মত্ত এমন এক ভয়ংকর যাপন যা মানুষকে অমানুষ করে তোলে। 

গীতার চতুর্দশ অধ্যায় অর্থাৎ গুণত্রয়বিভাগ যোগে শ্রীভগবান এই তিনগুণ সম্পর্কে অর্জুনকে বলছেন, "হে মহাবাহো! সত্ত্ব, রজ ও তম— এই তিন গুণ প্রকৃতির দ্বারা উৎপন্ন। কিন্তু প্রকৃতির কাজ শরীরের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক মান্য করার কারণে এই গুণ অবিনাশী জীবাত্মাকে নাশবান জড় শরীরে আবদ্ধ করে দেয়। হে নিষ্পাপ অর্জুন! সেই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল (স্বচ্ছ) হওয়ার কারণে রজগুণ ও তমগুণের তুলনায় প্রকাশক ও নির্বিকার হয়। সে সাত্ত্বিক সুখ ও সাত্ত্বিক জ্ঞানের আসক্তির সাহায্যে জীবাত্মাকে বেঁধে দেয়। অর্থাৎ তাঁকে গুণাতীত হতে দেয় না।" 

বলছেন, "হে কৌন্তেয়! তৃষ্ণা ও আসক্তি উৎপন্নকারী রজগুণকে তুমি রাগস্বরূপ বিবেচনা কর। এটি কর্মের আসক্তিতে জীবাত্মাকে আবদ্ধ করে। হে ভারত! তমোগুণ অজ্ঞানতা থেকে উৎপন্ন হয় এবং সম্পূর্ণ মনুষ্যকে মোহিত করে। অর্থাৎ তাঁদের মধ্যে বিবেক উৎপন্ন হতে দেয় না। সে প্রমাদ, আলস্য ও নিদ্রার দ্বারা জীবাত্মাকে শরীরে বেঁধে দেয় অর্থাৎ তাঁর লৌকিক, পরলৌকিক উন্নতি হতে দেয় না।"

আমরা যদি আমাদের চারপাশে তাকিয়ে দেখি তাহলেই এই তিনলোক স্পষ্ট দেখতে পাবো। যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হিমালয়ের কোনো নির্জন গুহায় তপস্যারত, প্রচন্ড শীত বা অন্নাভাব যাঁকে স্পর্শ করতে পারেনা, বাহ্যিক সমস্ত অনুভূতির পারে গিয়ে যিনি আত্মমগ্ন, তিনি স্বর্গলোকের বাসিন্দা। 

আবার যে সন্ন্যাসী লোকালয়ে কোলাহলের মধ্যে থাকেন কিন্তু যাঁর নিজের কোনো কামনা বাসনা নেই, আর্তের কান্না যিনি সহ্য করতে পারেননা, শিবজ্ঞানে জীবসেবা করাই যাঁর জীবনের ব্রত, ঈশ্বরের সৃষ্টির মধ্যেই যিনি তাঁর দৈবীপ্রকাশকে সর্বদা অনুভব করেন এবং যাঁর কাছে কায়া আর তার ছায়া এক এবং অবিভাজ্য বলে মনে হয়, তিনিও স্বর্গলোকের বাসিন্দা। আবার গৃহী হয়েও মানুষকে ঈশ্বরের রূপ বলেই মনে করে নির্লোভি হয়ে সারাজীবন যিনি জনসেবা করে যান, যেমন বোলপুরের সদ্যপ্রয়াত 'এক টাকার ডাক্তার' ডঃ সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁরাও শরীরে থাকাকালীনই ওই স্বর্গলোকের বাসিন্দা।

ভারতে ভূলোকবাসীদের আমরা আকছারই দেখতে পাই, হয়তো সবসময় চিনতে পারিনা। সরকারি কর্মক্ষেত্রে ঘুষ-সংস্কৃতির মধ্যে বসে সারাজীবন চাকরি করেও এবং ঘুষ নেওয়াই যেখানে রীতি সেখানে ব্যতিক্রমী স্বচ্ছতা দেখিয়ে যিনি সারাজীবন সৎপথের ন্যায্য রোজগারটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন, তিনি ভুলোকের বাসিন্দা। মানুষের মধ্যে সত্ত্বগুণ যখন বৃদ্ধি পায়, তখন ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণে নিদ্রা, আলস্য, প্রমাদ ইত্যাদি মিটে গিয়ে স্বচ্ছতা আসে এবং বিবেক প্রকট হয়। এইখান থেকেই গুণের অতীত যাওয়ার পথচলা শুরু হয়।

তবে এই স্তরে পৌঁছানোর আগে আরো একটি স্তর অতিক্রম করতে হয় যেটি রজগুণের। বাড়ির একতলায় যেমন বন্যার জল ঢুকে পড়ে লোকসান করে দেয় কিন্তু দোতলা অক্ষত থাকে, ভূলোকেই রজগুণ হলো বাড়ির একতলা। লাভ করার ইচ্ছে, ভোগ করার ইচ্ছে, নতুন নতুন কাজ খোঁজা যাতে আরো অর্থ উপার্জন করা যায়, জীবনে অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তি আর অশান্তিকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনা, এসব হলো ভূলোকেরই অংশ। আর এই করতে করতেই একদিন মানুষ এর অসারতা বুঝতে পেরে সত্যিকারের শান্তির পথ খুঁজতে শুরু করে।

শেষে হলো পাতাললোক। বহুমূল্য অত্যাধুনিক প্রমোদতরণী ভেসে যাচ্ছে সাগরে, তার আয়নাখচিত নাচঘরে অর্ধনগ্ন সুন্দরী নারীরা নেচে নেচে বিত্তশালী বৈভবশালী কামুক পৃষ্ঠপোষকদের বিনোদিত করছেন, লক্ষ লক্ষ টাকার মদের ফোয়ারা ছুটছে, ওই তো পাতাললোক। অথবা মতবাদের নামে, cult-এর নামে, বিশ্বাসের নামে একজন আর একজনের গলা কাটছে, কমজোরের ওপর কতৃত্ব কায়েম করার জন্য শক্তিশালী তাদের বাসভূমি বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে অথবা কোনো একনায়ক ভিন্নমতের লোকের ওপর অকথ্য অত্যাচার করছে, এরাই তো পাতাললোকের বাসিন্দা আর এই তো পাতাললোক। যে সময় মনে তমোগুণ বাড়ে, সে সময় ইন্দ্রিয়সংযম ও কাজে স্বচ্ছতা থাকে না, কোনও সৎকাজ করার ইচ্ছা হয়না, প্রমাদ শুরু হয় এবং অন্তঃকরণ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে প্রায় গোটা পৃথিবীটাই যে পাতাললোক হয়ে উঠেছে, আশাকরি সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

সাত্ত্বিক কর্মের ফল নির্মল, রাজস কর্মের ফল দুঃখদায়ী ও তামস কর্মের ফল বিবেকহীনতা হয়। সত্ত্বগুণের কারণে জ্ঞান (বিবেক), রজগুণের কারণে লোভ ও তমগুণের কারণে প্রমাদ, মোহ ও অজ্ঞানতা উৎপন্ন হয়। মনের মধ্যে তমগুণ বৃদ্ধি পেলে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ, বৃক্ষ, লতা ইত্যাদি নীচ যোনিতে জন্মগ্রহণ করে। সৃষ্টিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে গেলে তাই তম নাশ করে মানুষের মনের অভিমুখ তার স্বরূপ অন্বেষণের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। সেইজন্যই এখন আবার দৈবশক্তি নির্মিত আবহে ধর্মযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সময় এসে গেছে।

Friday, July 29, 2022

আসন্ন মহাযুদ্ধ

কলিযুগ শেষ হচ্ছে, মরুভূমিতে বন্যা হচ্ছে আর শৈলভূমিতে দাবদাহ, আবার একটা মহাযুদ্ধ আগতপ্রায়। তাই বিশ্বজুড়ে মহাভারতকালের সমস্ত চরিত্ররাই এখন নতুন শরীরে আবারো বর্তমান এবং প্রারব্ধ অনুযায়ী পাণ্ডব ও কৌরব দুপক্ষই এখন আবার ধীরে ধীরে নিজেদের জোটসঙ্গীসংখ্যা বাড়িয়ে বাড়িয়ে নির্ণায়ক মহারণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 

যেহেতু এই মহাযুদ্ধটি আসলে ধর্মযুদ্ধ এবং এর মূল কান্ডারি স্বয়ং শ্রীভগবান নিজে, এটি শুরু হওয়ার আগেই অধর্মিকদের মধ্যে নানারকম ছোটখাটো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, যার মাত্রা একসময় এমন বেড়ে যাবে যে সেখান থেকেই কোনো এক স্ফুলিঙ্গ এবার মহাভারতে বর্ণিত বিনাশকালের মতো প্রলয়ের সূচনা করবে এবং সেই সাথে সাথে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন শান্তিময় যুগেরও সূচনা হয়ে যাবে। 

নিশ্চিত থাকুন যে যাদের মধ্যে এতটুকুও আসুরিক প্রবৃত্তি আছে, তারা কেউ রেহাই পাবে না, সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পূজাপদ্ধতি নির্বিশেষে সনাতন ধর্মের পথই একমাত্র ঈশ্বর নির্দিষ্ট পথ এবং ভৌতিক অগ্রগতি যাই হোক না কেন, জীবনচক্রে ধর্মের জয় নিশ্চিত করতেই যুগে যুগে অধর্মের বিনাশ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। 

বিশ্বজুড়ে এখন পাপের ঘড়া এতটাই পূর্ণ হয়ে গেছে যে তা খালি না করতে পারলে ধর্মপ্রাণ মানুষের জীবনরক্ষা করাই কঠিন। এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে তাঁদের মুক্তি দিতে হলে অধর্মের নাশ করা ছাড়া শ্রীভগবানের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। আগামী ২০২৫ থেকে নিয়ে দশ বছর ধরে যে শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া চলবে, তার শেষে ধর্মের জয় এবং অধর্মের পরাজয় নিশ্চিত। 

এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রই কেবল বদলে যাবেনা, পুণ্যভূমি ঋদ্ধভূমি বেদভূমি ভারতবর্ষের ঈশ্বরর্নির্দিষ্ট অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মশক্তির প্রভাব এমনভাবে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে যে ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক সীমা অতিক্রম করে সারা বিশ্বজুড়ে ভারতবর্ষ এক নতুন ঐশীপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে, যার কথা স্বামী বিবেকানন্দ এবং ঋষি অরবিন্দ বলে গেছেন। 

নিজেদের অন্তরাত্মার ডাককে দীর্ঘদিন অবহেলা করার ফলে ভারতের মধ্যে যে সমস্ত অধার্মিক শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে এবং এই দশকের মধ্যেই তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তবে অন্যান্য দেশের মতন ভারতের অভ্যন্তরীন যুদ্ধটি রক্তক্ষয়ী হবে না, সেটি হবে মূল্যবোধাশ্রয়ী, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক। এই মহাভারতে ভারতের ভূমিকা হলো সঞ্জয়ের মতন - একজন দৈব আশীর্বাদপ্রাপ্ত দ্রষ্টার। সেই দ্রষ্টা, যিনি কেবল দূরদৃষ্টিই অর্জন করেননি, অর্জুনের সাথে সাথে যাঁর বিশ্বরূপদর্শনও হয়েছিল।

Monday, July 25, 2022

কর্ম ও ফল

আজ সকাল থেকে টিভির পর্দায় দুটি ঘটনা একসাথে ভেসে উঠছিল - আমাদের প্রজাতন্ত্রের নতুন প্রথম নাগরিক হিসেবে মহামহিম রাষ্ট্রপতি শ্রীমতি দ্রৌপদী মুর্মুর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আর আকন্ঠ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রাজ্যমন্ত্রীসভার কার্যত দুনম্বর বর্তমান শিল্প এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী ও শাসকদলের মহাসচিব শ্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে হেফাজতে নিয়ে প্রবর্তন নির্দেশনালয়ের ভুবনেশ্বর যাত্রা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কখনো এটা কখনো ওটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল দুটি ক্ষেত্রেই কি অদ্ভুত সমাপতন। 

একদিকে সমস্ত ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রতিকূলতাকে জয় করে বছরের পর বছর ধরে মানুষের সেবায় নিযুক্ত থেকে রাষ্ট্রের শীর্ষপদ অলঙ্কৃত করতে চলা একজন নির্মল স্বচ্ছ সৎ বিনয়ী মাতৃস্থানীয়া ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব আর অন্যদিকে লিপ্সা লোভ লালসা আর রিপুর তাড়নায় অবদমিত একজন অভিযুক্ত কলঙ্কিত উদ্ধত জনপ্রতিনিধি, যিনি মানুষের সেবা করার কর্তব্যকে অবহেলা করে অন্যায়ভাবে তাঁদের সাথে চরম প্রতারণা করেছেন বলে অভিযোগ।

একদিকে একজন দরিদ্র প্রান্তিক মানুষ, যাঁর মতন লক্ষ লক্ষ আদিবাসী জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে এই সমাজের একেবারে নিচের পরতে কোথায় যেন প্রতিনিয়ত হারিয়ে যান, তিনি কেবলমাত্র তাঁর চরিত্রবল এবং স্থির সংকল্পের কারণে আজ সর্বজনবন্দিত। আর একজন সমাজের উচ্চশ্রেণীর উচ্চশিক্ষিত মানুষ, কেবলমাত্র নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে সর্বোপরি ভেবে যুবসমাজের সাথে এমন বেইমানি করলেন বলে অভিযোগ যে গোটা দেশ আজ তাঁর কথিত কান্ডকারখানা দেখে ছিঃ ছিঃ করছে। 

রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের প্রথম ভাষণে মহামহিম আজ বলেছেন, "আমার এই জীবনে আমি বুঝেছি মানুষের জন্য কাজ করাই হলো আসল কথা। জগন্নাথক্ষেত্রের কবি ভিমভইয়ের কবিতা থেকে একটি লাইন আমি বলছি: 'মো জীবন পাছে নারকে পডি থাউ জগৎ'। এর অর্থ, নিজের জন্য কাজ না করে জগতের জন্য কাজ করো"। এই যাঁর মানসিকতা, তাঁকে যে সারা দেশ মাথায় তুলে রাখবে, সেটাই তো স্বাভাবিক ও কাম্য। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দের জীবনদর্শনও একইরকমের ছিল। এই হলো শাশ্বত ভারতের সনাতন সংস্কৃতিতে বর্ণিত আদর্শ রাজধর্ম, যার প্রতিফলন আমরা আজ দেশের শীর্ষতম পদাধিকারীদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। এর সুপ্রভাব ক্রমশঃ সমাজের সর্বস্তরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামতে বাধ্য।

যিনি বহু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হন, প্রিয় হন, সম্মানীয় হন, যিনি সমাজে ব্যাপকরূপে প্রভাবশালী হন, তাঁর ওপর যে ঈশ্বরের বিশেষ কৃপা আছে, এটি বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। এটি বহুজন্মলব্ধ প্রারব্ধ থেকেই আসে। দেখা যায় যে কেউ সেই কৃপার সদ্ব্যবহার করেন, কেউ বা দুর্ব্যবহার। নিজের জীবনকে কেউ কিভাবে চালনা করবেন, সেটা কিন্তু একেবারেই তাঁর নিজস্ব বিষয়, যার দায় সম্পূর্ণভাবে তাঁরই। যখন রাষ্ট্রপতি শ্রীমতি দ্রৌপদী মুর্মুর মতো ঈশ্বরভক্তকে দেখি ধর্মপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশঃ আরো বেশি বেশি করে সেবাব্রতী হয়ে উঠতে, তখন কত আনন্দ হয়। আর একইসাথে, যখন ঠিক এর উল্টোটা হতে দেখি তখন সত্যিই খুব দুঃখ হয়। বহু ভাল কর্মফল জমলে পরে জীবসেবা করার সুযোগ মেলে। আগের আগের সমস্ত জন্মের সুকর্মকে নস্যাৎ করে দিয়ে সেই সুযোগকে যখন কেউ নিজের দোষে দুর্যোগে পর্যবসিত করে নিজেরই হাতে ইতরযোনি প্রাপ্তির দরজা খুলে ফেলেন, তখন বুকটা হায় হায় করে ওঠে। এতটা এগিয়ে এসে শেষে সেই কুহকিনী মায়ার গাড্ডাতেই পড়তে হলো? বড্ড করুণা হয় গো, বড্ড করুণা হয়।

Monday, July 18, 2022

শ্রীম

 আজ শুভ নাগপঞ্চমী, কথামৃতকার পূজ্যপাদ শ্রীমর জন্মতিথি। শ্রীম শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এমন এক অনন্য শিষ্য যাঁর লেখনীর মধ্যে দিয়ে ঠাকুর আজও আমাদের সঙ্গে কথা কন আর ভবিষ্যতেও বিভিন্ন দেশ-জাতি জুড়ে সেই কথোপকথন চলতেই থাকবে। ঠাকুরের অন্য সন্ন্যাসী ও গৃহী পার্ষদরাও ঠাকুরের কথা বলেছেন, কেউ কেউ লিখেওছেন, কিন্তু শ্রীমলিখিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত তার অনন্যতায় ব্যতিক্রমী হয়েই রয়েছে। 


শ্রীমর একটি বিশেষত্ব হলো কথামৃতে স্থান কাল পাত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, যার ফলে পড়তে পড়তে আমাদের মনের মধ্যে একেবারে সেই দিনটির, সেই বিশেষ মুহূর্তটির যেন স্পষ্ট একটা ছবি তৈরি যায় - আমরা যেন ঠাকুরকে চলতে ফিরতে দেখি, তাঁর গরম লাগছে না ঠান্ডা লাগছে, তাঁর আশেপাশে কারা কারা আছেন, তিনি কি খাচ্ছেন, কি পরছেন, কখন সমাধিস্থ হচ্ছেন, সমাধি ভাঙছে - সবকিছু যেন আমাদের উপস্থিতিতে চোখের সামনেই ঘটছে বলে মনে হয়। সেই জন্যই ঠাকুরকে কৃত্তিম বা দূরের বলে বোধ হয়না, আর তাঁর দেখানো পথও সাধনযোগ্য বলেই মনে হয়।


এযাবৎ যত অবতার পুরুষ এসেছেন, প্রত্যেকের বাণীই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে কেউ না কেউ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে একজন রক্ত মাংসের শরীরধারীরূপে শ্রীম যেমনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন, এমনটা এর আগে আর কোনোকালে হয়নি। ঠাকুর হাসছেন গাইছেন খাচ্ছেন স্নান করছেন, বার্নিশকরা জুতো পরছেন, মোলস্কিনের র‍্যাপার গায়ে দিচ্ছেন, পড়ে গিয়ে তাঁর হাত ভেঙে যাচ্ছে, ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছেন, শিষ্যদের শাসন করছেন, শিক্ষা দিচ্ছেন, রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কচুরি খাচ্ছেন, থিয়েটার দেখছেন, সার্কাস দেখছেন, একদিকে শিশুর সারল্য আর অন্যদিকে সাক্ষাৎ অবতারবরিষ্ঠায় - জীবন্ত প্রাণবন্ত প্রত্যয়ী রসিক একজন দেবমানুষ, শ্রীম না থাকলে এই ব্যক্তিগত শ্রীরামকৃষ্ণকে হয়তো আমারা এমনভাবে পেতামই না।


এই যে ধ্যানালোকে আমরা বিভিন্নভাবে ঠাকুরকে দেখি, তার অধিকাংশ দৃশ্যকল্পেরই রচয়িতা শ্রীম। উনি প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের পাঁচটি খন্ড লিখেছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন, গোটাটার সময়কাল ১৯০২-৩২, যার প্রথম চারটি খন্ড আট বছরের মধ্যে প্রকাশিত হয় আর শেষেরটি ২২ বছর পর। ডায়েরিতে সাংকেতিক এন্ট্রি দেখে দেখে গুরুর সাথে প্রতিটিদিনের সাক্ষাৎকার যদি বহুবছর পরেও অত বিশদে এবং নির্ভুলভাবে শ্রীম অনুধ্যান না করতে পারতেন, তাহলে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনে, বিশেষতঃ গৃহস্থদের ক্ষেত্রে, ভক্তিমার্গের অপেক্ষাকৃত সহজ পথ এত প্রশস্ত হতো না। কথামৃতে ব্যবহৃত 'ভক্তি' শব্দের মোট সংখ্যা ৪০৯৪ আর ভক্তি-শব্দ বিযুক্ত পৃষ্ঠার সংখ্যা ১৩১। 


শ্রীম নিজে লিখছেন, 'ঠাকুরের ভক্তির কথা যত ভাবিতেছি ততই অবাক হইতেছি। কেশব সেন হরিনাম করেন, অমনি তাঁকে দেখতে ছুটছেন, অমনি কেশব আপনার লোক হলেন। তখন কাপ্তেনের কথা আর শুনলেন না। তিনি বিলাতে গিয়েছিলেন, সাহেবের সঙ্গে খেয়েছেন, কন্যাকে ভিন্ন জাতিতে বিবাহ দিয়েছেন - এসব কথা ভেসে গেল। কুলটি খাই, কাঁটায় আমার কি কাজ? ভক্তিসূত্রে সকারবাদী, নিরাকারবাদী, এক হয়; হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান এক হয়; চারি বর্ণ এক হয়। ভক্তিরই জয়। ধন্য শ্রীরামকৃষ্ণ! তোমারই জয়!'। 


ইংরিজি ১৮৮১-৮৬ সালের মধ্যে মোট ১৯৬ দিনের বিবরণ আছে কথামৃতে, যা শ্রীশ্রীমা স্বয়ং কেবল নিয়মিত শুনতে ভালোবাসতেনই না, অন্যদেরও পড়তে উৎসাহ দিতেন। মা বলেছিলেন, "মাষ্টার কি সুন্দরভাবে সব মনে করে লিখেছে! শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ সামনে সব কথা হচ্ছে। কি বর্ণনা! আর এসব কথা যেন হৃদয়ে গেঁথে থাকে। এই সমস্ত পড়ে-শুনেই তো আজকাল এত লোক তাঁর দিকে ঝুঁকছে। শান্তি পাচ্ছে। এসব অমোঘ কথা।..." এটাই আধ্যাত্মিক পথের যাত্রীদের কাছে শ্রীমর আসল দান। ঠাকুর শ্রীমকে বলেছিলেন, "তোমাকে গৌরাঙ্গর দলে দেখেছিলাম"। তাই ঠাকুরের সেই কল্পতরু অবস্থার আশীর্বাদ 'তোমাদের চৈতন্য হোক', শ্রীমর লেখনীর মাধ্যমেই বুঝি আমাদের সকলের ওপর সতত বর্ষিত হচ্ছে।

Wednesday, July 13, 2022

গুরুদেব

যদিও প্রতিদিনই জপ-ধ্যানের সময় পূজ্যপাদ গুরুদেবের শ্রীমুর্তিটি স্মরণ করা হয়, তবুও গুরুপূর্ণিমার দিনে বিশেষভাবে নিজের গুরুর কথা মনে পড়বে না, এ কেমন করে হতে পারে? গুরুদেব শরীরে থাকলে আজকের দিনে তাঁকে বেলুড়ে গিয়ে প্রণাম করাটাই স্বাভাবিক হতো কিন্তু যেহেতু তিনি এখন ধ্যানলোকের বাসিন্দা, তাই ঠাকুরের মধ্যেই তাঁর প্রকাশ জেনে তাঁকে মানসপটে প্রণাম করাটাই কেবল সম্ভবপর হয়। তবে যতদিন শিষ্যরা শরীরে থাকেন ততদিন গুরুদের ছুটি নেই কারণ মন্ত্রদীক্ষা দানের মাধ্যমে যে আধ্যাত্মিক পথনির্দেশের ভার উনি নিয়েছেন, তা আর কারো পক্ষে বইবার যে যো নেই। শরীরে থাকুন আর নাই থাকুন, গুরু আজীবন শিষ্যের হাত ধরে থাকেন আর যেই সে আধ্যাত্মপথে এক পা এগোতে চায়, তিনি অমনি তাকে কোলে তুলে পাঁচ পা এগিয়ে দেন। শিষ্য যতই ভুল করুক, গুরুর চেয়ে ধৈর্যবান, গুরুর চেয়ে ক্ষমাশীল আর গুরুর চেয়ে দয়াময় আর কেউ হননা। শিষ্য যখন গুরুকে ভুলে থাকে, গুরু তখনো শিষ্যের কর্তব্যটি নীরবে নিজে করে যান আর যখন তার সম্বিৎ ফেরে, সে একফোঁটা কৃপা চাইলে গুরু তাকে একঘটি দিয়ে দেন। আমি নিজের জীবনে গুরুকৃপার এমনসব পরিচয় পেয়েছি যে এ আর শোনা কথা নয়, একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয়।

আমাদের শ্রীরামকৃষ্ণ পরম্পরায় গুরুরা অধ্যাত্মিকভাবে দারুন অভিব্যক্ত ও ক্ষমতাবান হন কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই ব্রহ্মস্বরূপ ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন্তরূপ, তাঁর প্রতিনিধি। যে শক্তি তাঁরা বিচ্ছুরণ করেন, সেটি আসলে স্বয়ং ঠাকুর ও শ্রীশ্রীময়ের দৈবীশক্তি। যে মন্ত্র তাঁরা প্রদান করেন সেটি ঠাকুর, মা, স্বামীজী বা ঠাকুরের পার্ষদদের দেওয়া সিদ্ধমন্ত্রগুলির মধ্যে একটি। আর যে সংস্কার তাঁরা বপন করেন সেটি সেই বৈদিকযুগ থেকে অবিচ্ছিন্নভাবে বহতী ঋষিলব্ধ সনাতন ধর্মের মূল সংস্কার। ফলে আমাদের গুরুকে ইষ্টের প্রতিরূপ বলে ভাবতে মোটেও অসুবিধা হয়না এবং ধ্যানে তিনি খুব সহজেই ইষ্টের মধ্যে বিলীন হয়ে যান। এই কারণে আমার গুরুদেব সঙ্ঘাধক্ষ থাকা কালে শ্রীশ্রীঠাকুর, মা, স্বামীজী ও ঠাকুরের পার্ষদ ছাড়া রামকৃষ্ণসঙ্ঘের বাকি সমস্ত গুরুদের জন্মতিথি পালনের প্রথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন কারণ শ্রীশ্রীঠাকুর ব্যতিরেকে তাঁদের কারোরই আলাদা করে কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই পরম্পরা আজও চলছে। তবু যাঁকে চোখের সামনে স্বয়ং ঠাকুরের প্রতিমূর্তি বলে দুচোখভরে দেখেছি, যাঁকে প্রণাম করে স্বয়ং ঠাকুরকে প্রণাম করার প্রসাদ লাভ করেছি, মাথার ওপর যাঁর আশীর্বাদী স্পর্শ স্বয়ং ঠাকুরের স্পর্শ বলে জেনেছি, যাঁর উপদেশ ঠাকুরের উপদেশ বলে মনে করে যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করেছি আর আজও যাঁর মূর্তিকে হৃদয়ে ধারণ করে উপাসনা শুরু করি, সেই গুরুকে ভুলি কি করে?

আমার শ্রীগুরুদেব পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজের নামের মধ্যেই বীরেশ্বর শিব ছিলেন। ওঁর পূর্বাশ্রমের নাম ছিল পাণ্ডুরঙ্গ প্রভু, সেটির ভেতরেও শ্রীবিষ্ণু ছিলেন। আর ওঁর আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে তিনি ব্রহ্মার মতোই সৃষ্টিশীল ও জ্ঞানের আকর হিসেবে সুবিদিত ছিলেন। খুব ছোটবেলায় গুরুদেব স্বয়ং স্বামীজীর স্নেহাশীর্বাদ পেয়েছিলেন, শ্রীশ্রীমা তাঁকে জয়রামবাটিতে মন্ত্রদীক্ষা দিয়ে কৃপা করেছিলেন আর তাঁর সন্ন্যাসজীবন সযত্নে গড়ে তুলেছিলেন ঠাকুরের নিজস্ব পার্ষদরা। ফলে, আমি তাঁর কাছ থেকে একেবারে নির্ভেজাল সারবস্তুটুকুই পেয়েছিলাম, নিজে তখন তার মূল্য বুঝিনি, সে অন্য কথা। তাঁর দানে কোনো কার্পণ্য ছিল না, আমিই গ্রহণের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারিনি।

গুরুদেব যেমন সুরসিক ছিলেন তেমনই বাস্তববাদী ছিলেন, সেটি তাঁর জীবনীগ্রন্থ পড়লেই বোঝা যায়। শ্রীমৎ স্বামী চেতনানন্দজী মহারাজ তাঁর 'প্রাচীন সাধুদের কথা' গ্রন্থে একজায়গায় গুরুদেবের রসবোধ সম্পর্কে লিখেছেন, '১৯৭৭ সালে জুলাই মাসে হলিউড থেকে প্রথম মঠে এলাম। প্রভু মহারাজকে প্রণাম করতেই তিনি হেসে সেবককে বললেন, “ওর মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দে। একটা চেয়ার দে।” আমি মেঝেতে তাঁর পায়ের কাছে বসে বললাম, “মহারাজ, আপনার সামনে চেয়ারে বসতে লজ্জা করে।” তখন তিনি হেসে বললেন, “তাহলে ওকে একটা টেবিল দে।” তারপর তাঁর সঙ্গে পাশ্চাত্যের কাজকর্ম সম্বন্ধে অনেক কথা হয়।' গুরুদেবের উচ্চ-নিচ বাছবিচার ছিলনা। যাঁরা ওঁকে চিনতেন তাঁরা জানতেন যে ঐ কঠোর অবয়বের মধ্যে একটা অতিকোমল মাতৃহৃদয় বাস করে, ওঁর কাছে নিঃসংকোচ হওয়া যায়। স্বামী চেতনানন্দজী লিখেছেন, 'বেলুড় মঠে থাকাকালের কতকগুলি ঘটনা মনে পড়ছে। মহারাজ তখন জেনারেল সেক্রেটারি। পুরানাে মিশন অফিসের ওপরের ঘরে আমি মহারাজের সঙ্গে কথা বলছি। এমনসময় মঠের নাপিত রামমুরত ঘরে ঢুকে মহারাজের পায়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে বলল, “প্রভু, মেরে অবগুণ চিত না ধরাে।” মহারাজ হাে-হাে করে হেসে ফেললেন। মহারাজের মাথা কামানাের দিন ছিল, কিন্তু রামমুরত তা ভুলে যায়। তাই সন্ধ্যার সময় ঐ কথা বলে ক্ষমা চাইল।'

আর, একদিকে যিনি ব্রহ্মসূত্রের শঙ্করভাষ্যের ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, তিনিই আবার এক বক্তৃতায় বলেন, "সাধারণত ত্যাগের আদর্শ এখন নেই। আমরা সন্ন্যাসীরা স্বর্গ থেকে আসিনি, এসেছি সমাজ থেকে। নৈতিক স্বাস্থ্যবান দৃঢ় চরিত্রবলসম্পন্ন সমাজই মাত্র পারে আদর্শ সন্ন্যাসী সৃষ্টি করতে। যদি আমরা সাধারণের সঙ্গে না মিশি এবং তাদের মধ্যে কাজ না করে এড়িয়ে চলি, তাহলে তারা কেমন করে নিজেদের সংশোধন করবে এবং ঠিক পথে চলবে? যদি তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি না হয়, তাহলে আমরাও বা কেমন করে সে সমাজ থেকে তেজস্বী-ত্যাগী ছেলেদের পাব? আর যদি এইরকম দুর্বল সমাজ থেকে ছেলেরা আসে সাধু হবার জন্য, তারা হবে যেমন 
— শ্রীধর স্বামী তাঁর গীতার টীকায় বলেছেন, 
‘পিশুনাঃ কলহোৎসুকাঃ’ 
— সবসময় পরের দোষান্বেষী এবং ঝগড়াটে! সুতরাং আমাদের নিজেদের স্বার্থে আমাদের কর্তব্য জনসাধারণের কাছে গিয়ে তাদের নৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করা। অধিকন্তু সাধু হিসাবে সমাজের কাছে আমাদের ঋণও রয়েছে। কেননা এতদিন আমরা সমাজের কাছে সেবা পেয়েছি। তাই জনসাধারণের অবস্থার উন্নতির চেষ্টা করে এবং উন্নততর ভিত্তির ওপর সমাজ-পুনর্গঠনে তাদের সাহায্য করে আমাদের সেই ঋণ অবশ্যই পরিশোধ করা উচিত।" (গ্রন্থসূত্র: স্বামী বীরেশ্বরানন্দ - এক দিব্য জীবন)

গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর 
গুরুরেব পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ

Thursday, July 7, 2022

মা কালী

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি রামপ্রসাদী গান খুব গাইতেন, 
কে জানে কালী কেমন, ষড় দর্শনে না পায় দরশন।
আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন,
সে যে ঘটে ঘটে বিরাজ করে ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।
কালীর উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা বুঝ কেমন,
যেমন শিব বুঝেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন।
মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন,
কালী পদ্মবনে হংস-সনে, হংসীরূপে করে রমণ।
প্রসাদ ভাষে, লোকে হাসে, সন্তরণে সিন্ধু-তরণ,
আমার মন বুঝেছে, প্রাণ বুঝে না; ধরবে শশী হয়ে বামন।

সত্যিই তো, কে জানে কালী কেমন? নানা তন্ত্রে মায়ের নানারূপের বর্ণনা থাকলেও, আমরা বাঙালিরা মায়ের দক্ষিণাকালিকা রূপটিকেই বেশি পছন্দ করি। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে নবদ্বীপের বিশিষ্ট তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ এই কালীমূর্তির প্রচলন করেছিলেন। মহাকাল সংহিতা অনুসারে আদ্যাকালীই দক্ষিণাকালী। জনশ্রুতি যে দক্ষিণদিকে যমের অবস্থান, কালী নামে ভীত হয়ে সে ছুটে পালায়, এজন্যেই ত্রিজগতে কালিকাদেবী ‘দক্ষিণা’ নামে পরিচিতা। তবে আসল কারন আলাদা। ঋগবেদে আছে 'তমঃ আসীত্তমসা গূঢ়মগ্রে' মানে অগ্রে অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে ছিল তমঃ। সেই তমসায় সমস্তই আচ্ছন্ন ছিল (ঋকবেদ ১০/১২৯/৩)। আবার মৈত্রায়ণী-উপনিষদেও বলা হয়েছে 'তমো বা ইদমেকমাস', অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র তমঃ ছিল (মৈ-উপঃ, ৪র্থ প্রপাঠক)। এই আদি তমঃই কালী, তাই মা কালো। 

মহানির্বাণতন্ত্রে (১৩/৫-৬) বলা হয়েছে,
স্বেতপীতাদিকো বর্ণে যথা কৃষ্ণে বিলীয়তে।
প্রবিশন্তি তথা কাল্যাং সর্বভূতানি শৈলজে।।
অতস্তস্যাঃ কালশক্তের্নিগুণায়া নিরাকৃতেঃ।
হিতায়াঃ প্রাপ্তযোগানাং বর্ণঃ কৃষ্ণো নিরূপিতঃ।।
অর্থাৎ, শ্বেত পীতাদি বর্ণ যেমন কৃষ্ণ বর্ণে বিলীন হয়ে যায় তেমনি সর্বভূত কালীর মধ্যে বিলীন হয়। এইজন্য যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাঁরা নির্গুণা নিরাকারা কল্যাণময়ী কালশক্তির কৃষ্ণবর্ণ নিরূপণ করেছেন। “পরাশক্তি অরূপা সুতরাং বর্ণহীন। যেখানে সর্ববর্ণের অভাব তাহাই নিবিড় কৃষ্ণাবর্ণ, একথা বিজ্ঞানসম্মত। বিজ্ঞান আরও বলে যে-জ্যোতিঃ আমাদের চক্ষু ধারনা করিতে পারে না, তাহাই নিবিড় কৃষ্ণবর্ণ দেখায়। তাই মহাজ্যোতিঃ কালী কৃষ্ণাবর্ণা। কিন্তু জ্ঞাননেত্রে মহাজ্যোতিঃ রূপে দৃশ্য হন।”

কালের কোলে সবকিছুই একদিন লয় হয়। কাল সৃষ্টির শুরু থেকে সমস্তই ‘কলন’ অর্থাৎ গ্রাস বা কালগ্রস্ত করছেন, তাই তাঁকে জগৎ-সংহারক ‘মহাকাল’ বলা হয়। সেই মহাকালকেও যিনি গ্রাস করেন বা নিজের মধ্যে বিলীন করে নেন, তিনিই কালী। কালী শব্দটি উচ্চারণ করলে ‘কাল-ঈ’ বোঝায়। ঈ অর্থাৎ ঈশ্বরী। অনাদি ও অনন্ত মহাকাল অর্থাৎ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানরূপী কালকে লয়-লীলার মধ্যেও যিনি সতত ‘ঈ’ অর্থাৎ ‘ঈক্ষণ’ অথবা দর্শন করছেন, তিনিই কাল-ঈ = কালী। 

মহাকালের অন্তর্গত খন্ডকালের মধ্যে সংসারের নিত্য সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় কার্য্য যা অহরহঃ অবিরত ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাও তিনি ‘ঈ’ বা ঈক্ষণ করছেন। আবার সেই অনাদি কাল থেকেই কাল-সংহারিণী কালীর করালবদনের মধ্যে নিত্য কত কি যে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, সে সবও তিনি সতত ‘ঈ’ বা ঈক্ষণ অথবা দর্শন করছেন, তাই তিনি ‘কালী’। শ্রীশ্রীচন্ডীতে মাকে 'সর্বভূতেষু চেতনেত্যাবিধীয়তে' বলা হচ্ছে, অর্থাৎ সকল প্রাণীতে যিনি চেতনা বলে অভিহিত হন। কালী হলেন স্বগুন ব্রহ্ম, মহাশক্তি, মহামায়া। যা ছিল, যা আছে এবং যা থাকবে, ভূত বর্তমান ভবিষ্যৎ আদি অনন্ত সব মায়ের মধ্যেই আছে।

কালী বা মহাকালী দক্ষিনা আদি অষ্ট কালীরূপে সাধকের ধ্যেয়। যেরূপেই তিনি ধ্যেয় হন না কেন, কালী হলেন আদি, অনন্ত, অক্ষয়, 'বাক্যমনাতীত মনোবচনৈকাধার'। তিনি ত্রিগুণময়ী। তাই মহানির্বাণতন্ত্রে সদাশিব দেবীকে বলেছেন,
সৃষ্টেরাদৌ ত্বমেকাসীৎ তমোরূপমগোচরম।
পুনঃ স্বরূপনাসাদ্য তমোরূপং নিরাকৃতিঃ।।
বাচাতীতং মনোহগম্যং ত্বমেকৈবাবশিষ্যসে।
সৃষ্টির পূর্বে বাক্য ও মনের অতীত তমোরূপে তুমি একা বিরাজমানা ছিলে। (প্রলয়ের পর) তুমিই আবার তোমার নিরাকার, বাক্যের অতীত ও মনের অগম্য তমোরূপ স্বরূপ প্রাপ্ত হও এবং তখন অদ্বিতীয়া তুমিই কেবল অবশিষ্ট থাকো।

দক্ষিণাকালী সম্পর্কে তন্ত্রতত্ত্বের আলোচনা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। শিবচন্দ্র লিখেছেন, "পুরুষের নাম দক্ষিন (দক্ষিনাঙ্গস্বরূপ বলে) এবং শক্তির নাম বামা (বামাঙ্গস্বরূপ বলে)। যতদিন এই বাম আর দক্ষিন, স্ত্রী ও পুরুষ সমবলে অবস্থিত, ততদিন সংসার বন্ধন। সাধনার প্রখর প্রভাবে বামাশক্তি জাগরিতা হলে তিনি দক্ষিনশক্তি পুরুষকে জয় করে তদুপরি স্বয়ং দক্ষিণানন্দে নিমগ্না হয়েন অর্থাৎ কি বাম, কি দক্ষিন উভয় অংশই যখন তাঁর প্রভাবে পূর্ণ হয়ে যায়, তখন সেই কেবলানন্দরূপিণী জীবের মহামোক্ষ প্রদান করেন। তাই ত্রৈলোক্য-মোক্ষদা মায়ের নাম দক্ষিণাকালী"।

মা আদিশক্তি, আদ্যাশক্তি। উনিই জগতের মূল শক্তি। উনি মহা সরস্বতী, উনিই মহা লক্ষ্মী। উনি মহিষমর্দিনী চণ্ডী, চামুন্ডা, কৌষিকী, দুর্গা ভগবতী।উনি রুদ্রানী শিবানী আবার উনিই ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী। উনি নারায়নের শক্তি নারায়নী, শিবের শক্তি শিবানী। উনি নারসিংহী, বারাহী, কৌমারী, গন্ধেশ্বরী। উনি শ্রীরামচন্দ্রের শক্তি সীতাদেবী (আদ্যাস্তোত্রে 'রামস্য জানকী ত্বং হি রাবণধ্বংসকারিনী), উনিই শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি আবার উনিই ব্রহ্মাগ্নিস্বরূপ 'যে রাম যে কৃষ্ণ সেই এই শরীরে' শ্রীরামকৃষ্ণের দাহিকাশক্তি শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী। এই ব্রহ্মাণ্ডে তাঁর ইচ্ছা ব্যতিরেকে কোনো কিছুই হওয়ার যো নেই। ঠাকুর বলতেন, মায়ের ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না।

মায়ের মূর্তি বাইরে থেকে ভয়াবহ দেখালেও, আসলে তা এক ভক্তবৎসলা মোক্ষপ্রদায়িনী মহাশক্তির আধ্যাত্মিক প্রতীকীরূপ। শ্রীশ্রীচন্ডীর চতুর্থ অধ্যায়ের ২২নং শ্লোকে মায়ের রূপ সম্পর্কে বলা হচ্ছে,
চিত্তে কৃপা সমরনিষ্ঠুরতা চ দৃষ্টা।
ত্বয্যেব দেবী বরদে ভূবনত্রয়েহপি।।
অর্থাৎ, দেবী, কার সাথে তোমার এই পরাক্রমের তুলনা হতে পারে? শত্রুভীতিজনক এবং এত মনোরম সৌন্দর্য কোথায় আছে? বরদে, হৃদয়ে কৃপা এবং যুদ্ধে কঠোরতা ত্রিভুবনে একমাত্র তোমাতেই দেখা যায়। ওই শ্রীশ্রীচন্ডীতেই একাদশ অধ্যায়ের ৫৪-৫৫ নং শ্লোকে 'পাতানো মা নয়, সত্যিকারের মা' আশ্বাসবাণী দিচ্ছেন,
"ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি।
তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্।"
অর্থাৎ, যখনই দানবোদ্ভুত বিঘ্ন উপস্থিত হবে, তখনই আমি আবির্ভূতা হয়ে অসুরদের বিনাশ করবো।

মা ত্রিনয়না - অতীত, বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্তই সেই ত্রিগুণময়ী ত্রিকালদর্শিনী মায়ের নয়নপথে সর্বক্ষণ প্রতিভাত হয়ে রয়েছে। মায়ের একটি নয়ন চন্দ্রস্বরূপ, দ্বিতীয়টি সূর্যস্বরূপ আর তৃতীয়টি অগ্নিস্বরূপ। প্রথমটিতে মায়ের শান্তভাব, দ্বিতীয়টিতে জ্যোতি আর তৃতীয়টিতে তেজ প্রকাশ পায়। মায়ের চক্ষু রক্তবর্ণ কারণ রক্তই জীবের জীবনীশক্তিস্বরূপ, ফলে তাঁর নয়নত্রয় শক্তি-সহযোগে রক্তবিস্ফুরিত হয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে রয়েছে। মায়ের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে 'দেবীং লোলজিহ্বাং দিগম্বরীং'। মা আমাদের দিগম্বরী। এর অর্থ তিনি কোন কিছুরই বন্ধনে আবদ্ধ নন, তিনি দেশ কাল পাত্রের অতীত। এক দিকে তিনি বিশ্বমধ্যে, আবার অন্য দিকে তিনি বিশ্বব্যাপী ও বিশ্বাতীত। যাঁর স্বরূপ এমন, তাঁকে কি কোনও বাহ্যিক জাগতিক আবরণ দিয়ে ঢাকা যায়? বাসনামুক্ত হয়ে সম্পূর্ণভাবে অহং ও অবিদ্যাকে ত্যাগ করলে, তবেই মায়ের কাছে পৌঁছানো যায়।

মাযের মূর্তিতে আমরা দেখি তাঁর জিব বের করা, মা দাঁত দিয়ে জিব কামড়ে আছেন। এই ভঙ্গিমাকেই লোলজিহ্বা বলা হচ্ছে। জিবের অন্য নাম রসনা, যা সমস্ত রকমের রস ভোগ করার প্রতীক। রসনা ও উপস্থ, এই দুটি ইন্দ্রিয়জনিত ভোগ লালসার মূল যন্ত্র এবং অষ্টাঙ্গযোগ সাধনার শুরুতে এ দুটিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই যম বা সংযম ক্রিয়া অভ্যাস করতে হয়। স্থুলদেহের সংযমের কেন্দ্রবিন্দু বীর্য্য রক্ষা এবং সূক্ষ্মদেহের প্রথম স্তর বাক্য-সংযম ও পক্ষান্তরে রসনা সংযম। মন-সংযমও এরই অন্তর্গত অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম ক্রিয়া। মা নিজের জিব নিজের দাঁত দিয়ে কেটে আসলে সর্ববিধ লালসা-সংযমেরই ইঙ্গিত করছেন। অন্যভাবে দেখলে, রজোগুণ সাধারণতঃ সত্ত্বগুণের দ্বারাই বশীভূত হয়। রজো হলো লাল আর সত্ত্ব হলো সাদা। লাল জিবকে সাদা দাঁত দিয়ে কামড়ে মা সাধককে সত্ত্বগুণকে দিয়ে রজোগুণকে নিয়ন্ত্রণ করার বার্তা দিচ্ছেন, বলছেন ত্যাগের দ্বারা ভোগকে জয় করো।

মায়ের গলায় ৫০টি কাটা মুন্ডু আসলে ৫০টি সংস্কৃত বর্ণমালার প্রতীক, যার মধ্যে ১৪টি স্বরবর্ণ আর ৩৬টি ব্যঞ্জন বর্ণ। এখানে প্রতিটি বর্ণ মানে এক একটি বীজমন্ত্র। শব্দই ব্রহ্ম। তাই এখানে অক্ষররূপ বীজমন্ত্রগুলি শক্তির উৎস। দেবী স্বয়ং শব্দব্রহ্মরূপিণী। কামধেনু তন্ত্রে তাই মা নিজেই বলছেন,
"মম কণ্ঠে স্থিতং বীজং পঞ্চাশদ্ বর্ণমদ্ভুতম্"।
রামপ্রসাদ সেই শুনে গেয়েছেন,
যত শোন কর্ণপুটে সকল মায়ের মন্ত্র বটে।
কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে।
আসলে মায়ের গলার মুন্ডমালা হল জ্ঞানশক্তির প্রতীক। দেবী ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন - তিনি চেতনা দান করেন। আবদ্ধ জীবকে তিনি আলোর পথ দেখান। আর মায়ের কোমরবন্ধ হিসেবে মানুষের কাটা রক্তঝরা হাতের মাধ্যমে কর্মফলকে বোঝানো হয়েছে। তিনি ইচ্ছা করলেই কর্মফল ঘুচিয়ে দিয়ে এই জীবন-মৃত্যুর বৃত্ত থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি দিতে পারেন।

তন্ত্রে বলছে কালী 'মুন্ডমালিনীং দিব্যা সতত অট্টহাস্যকারীনিম।
শবরূপী মহাদেব হৃদয়পরি সংস্থিতাম।।'
অর্থাৎ মা গলায় মুন্ডমালা পরে দিব্যজ্যোতি ছড়িয়ে সারাক্ষন অট্টহাস্য করছেন আর শবরূপী মহাদেবের হৃদয়ের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মহাদেব দেবীর পদতলে কেন বিরাজ করছেন? কারণ শিব নিষ্ক্রিয় পুরুষ আর কালী হলেন সক্রিয় প্রকৃতি। তাই তি‌নি শবরুপী শিব, মা আদিপ্রকৃতির অধীনস্থ। সাংখ্য অনুসারে পুরুষ সাক্ষীস্বরূপ আর প্রকৃতি ক্রিয়াময়ী। তাই শ‌ক্তির পদত‌লে শি‌ব। শঙ্করাচার্য্যও বলে‌ছেন, শ‌ক্তিযুক্ত না হ‌লে শিবেরও স্পন্দন ক্ষমতা নেই । তাই দেবীর পা‌য়ের তলায় নিশ্চল হ‌য়ে প‌ড়ে র‌য়ে‌ছেন শিব।‌ তন্ত্রমতে, শ‌ক্তির দু‌টি অবস্থা, নি‌ষ্ক্রিয় ও ক্রিয়‌াশীল। শ‌ক্তি যখন নি‌ষ্ক্রিয় তখন তিনি শিব। আর যখন তিনি ক্রিয়াশীল ও জাগ্রত তখন তিনি কালী। তাই কালী ও শিব দুইই নিত্যরূপে একই মূ‌র্তি‌তে প্রকা‌শিত। দ‌ক্ষিণাকালীর মূ‌র্তি‌তে দেবী শি‌বের উপর বিপরীতরতাতুরা বা র‌তি‌ক্রিয়ার বিপরীত ভ‌ঙ্গিতে উপ‌বিষ্টা, যা নির্বাসনার প্রতীক। অপরদিকে রামপ্রসাদ বলেছেন অন্য তত্ত্ব। তিনি বলেছেন,
'দৈত্য‌বেটা ভূ‌মে প‌ড়ে,
মা দা‌ড়ি‌য়ে তার উপ‌রে, 
মা‌য়ের পাদস্প‌র্শে দানব‌দেহ 
শিবরূপ হয় রণস্থ‌লে।' 
অর্থাৎ মায়ের পাদস্পর্শে দৈত্য অর্থাৎ অশিব শিবে রূপান্তরিত হয়েছেন। এও যুগলমূর্তিকে দেখার একটা উপায় বটে।

মায়ের কাছে যেতে গেলে আগে মায়ের মেজাজটা তো বুঝতে হবে, নাকি? তাঁর রূপ যেমন প্রতীকী, তাঁর পূজাপদ্ধতিও তেমনই প্রতীকী। যাঁরা বোঝেন না তাঁদের মনে নানা প্রশ্ন জাগতেই পারে, সেটা তাঁদের কর্মফল। মায়ের বাহ্যিক রূপ দেখে তাঁরা ভাবতেই পারেন যে মা যে অসুরদের বিনাশ করেন তারা কারা আর কিভাবেই বা কোনো মা তাঁর নিজের সন্তানকে বধ করেন? তাঁরা মায়ের পূজায় অর্পণ করা উপাচারগুলির গুঢ়ার্থও স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারেন না। আসলে মা বধ করেন না, সংহার করেন। তিনি সংহাররুপিনী। সংহার শব্দের অর্থ ধ্বংস নয়, সংহরন, নিজের ভিতরে প্রত্যাকর্ষণ। যেমন সমুদ্রের বুকে ঢেউ ওঠে আবার সমুদ্রেই লয় হয়। আসলে মা তাঁর সাধক-সন্তানের অন্তরের কামাদি রিপুরূপ আসুরীপ্রবৃত্তিগুলির সাথে সর্বদা সমর-রতা। মানব হলো নিষ্কাম দেবতা আর বাসনাপূর্ন দানব - উভয় অবস্থারই প্রতীক-স্বরূপ। মানবের মনের ভিতরে নিয়তই দেবাসুরের ভীষণ যুদ্ধ ঘটে চলেছে। তাই নিষ্ঠাভরে প্রার্থনা করলে মা আজও রিপুরূপদানব-দলনের জন্য আবির্ভূতা হয়ে অন্তরের অসুরনাশ করে দেবত্বকে জাগিয়ে দেন। 

আরে মানুষ তো কোন ছাড়, স্বয়ং ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর তাঁর কাছে মুক্তি ভিক্ষা করেন। রামপ্রসাদ গেয়েছেন,
মুক্ত কর মা মুক্তকেশী
ভবে যন্ত্রনা পাই দিবানিশি।
মায়ের মুক্তকেশ একাধারে মোহমায়ার পাশ আর তার থেকে মুক্তির প্রতীক। কালী মায়াতীতা কিন্তু স্বগুণশক্তিরূপে অনন্ত জীবকোটিকে মায়াপাশে বদ্ধ করেন। তাই একদিকে তাঁর মুক্তকেশজাল মায়াপাশের প্রতীক আবার অন্যদিকে মা কালী ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবেরও মুক্তিবিধান করেন বলে তিনি মুক্তকেশী। ক-অ-ঈশ= কেশ। ক ব্রহ্মা, অ বিষ্ণু এবং ঈশ শিব। কাজেই কেশ বলতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব বোঝায়। তাই 'কেশ'কে মুক্ত করেন বলে মা মুক্তকেশী। যোগশাস্ত্রে মুক্তকেশ বৈরাগ্যের প্রতীক। মায়ের যে চিরবৈরাগ্য। তিনি কৃপা করে জ্ঞানখড়্গের দ্বারা লৌকিক বা জাগতিক অষ্টপাশ ছিন্ন করে সাধককে মুক্ত করে দেন, যা তাঁর বাঁহাতে ধরা কাটা মুন্ডুতে প্রতিবিম্বিত।

সিস্টার নিবেদিতা তাঁর বিখ্যাত Kali the Mother বইটিতে বেবি লেগেট নামের একটি শিশুকে চিঠিতে লিখছেন (২৫শে ডিসেম্বর, ১৮৯৮),
BABY DARLING, what is the very first thing you remember? Is it not lying on mother's lap, and looking up into her eyes, and laughing?

Did you ever play hide and seek with mother? Mother's eyes shut, and baby was not. She opened them, and there was baby! Then baby's eyes shut, and where was mother? But they opened again, and--oh!

When mother's eyes were shut, where was she? There all the time. But you could not see her eyes. Yet she was there.

Baby, some people think God is just like that. A great great Mother--so great that all this big world is Her baby. God is playing with Her world, and She shuts Her eyes. Then, all our lives long, baby darling, we try to catch the Great Mother peeping. And if any of us can do that, if any of us can look into the eyes of God, just once, just for a minute,--do you know what happens? . . . That person at once knows all secrets, and he becomes strong and wise and loving, and he never, never forgets that moment.

And when you win like that, when you catch the Mother looking, something else happens. Something lovely. All Her other children come and play with you. The little birds come, and the wee lambs love you, and the wild rabbits touch your feet, and the poor children in the streets, who are cold and hungry perhaps--poor children that the Great Mother loves most of all, because they seem to have no father or mother, and perhaps no home--poor children trust you, and make a place for you with them. We are all sitting on the Mother's lap, but these sit closest of all to Her breast.

And what do we call the Mother with Her eyes shut? We call her Kali.