আজ শুভ নাগপঞ্চমী, কথামৃতকার পূজ্যপাদ শ্রীমর জন্মতিথি। শ্রীম শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এমন এক অনন্য শিষ্য যাঁর লেখনীর মধ্যে দিয়ে ঠাকুর আজও আমাদের সঙ্গে কথা কন আর ভবিষ্যতেও বিভিন্ন দেশ-জাতি জুড়ে সেই কথোপকথন চলতেই থাকবে। ঠাকুরের অন্য সন্ন্যাসী ও গৃহী পার্ষদরাও ঠাকুরের কথা বলেছেন, কেউ কেউ লিখেওছেন, কিন্তু শ্রীমলিখিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত তার অনন্যতায় ব্যতিক্রমী হয়েই রয়েছে।
শ্রীমর একটি বিশেষত্ব হলো কথামৃতে স্থান কাল পাত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, যার ফলে পড়তে পড়তে আমাদের মনের মধ্যে একেবারে সেই দিনটির, সেই বিশেষ মুহূর্তটির যেন স্পষ্ট একটা ছবি তৈরি যায় - আমরা যেন ঠাকুরকে চলতে ফিরতে দেখি, তাঁর গরম লাগছে না ঠান্ডা লাগছে, তাঁর আশেপাশে কারা কারা আছেন, তিনি কি খাচ্ছেন, কি পরছেন, কখন সমাধিস্থ হচ্ছেন, সমাধি ভাঙছে - সবকিছু যেন আমাদের উপস্থিতিতে চোখের সামনেই ঘটছে বলে মনে হয়। সেই জন্যই ঠাকুরকে কৃত্তিম বা দূরের বলে বোধ হয়না, আর তাঁর দেখানো পথও সাধনযোগ্য বলেই মনে হয়।
এযাবৎ যত অবতার পুরুষ এসেছেন, প্রত্যেকের বাণীই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে কেউ না কেউ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে একজন রক্ত মাংসের শরীরধারীরূপে শ্রীম যেমনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন, এমনটা এর আগে আর কোনোকালে হয়নি। ঠাকুর হাসছেন গাইছেন খাচ্ছেন স্নান করছেন, বার্নিশকরা জুতো পরছেন, মোলস্কিনের র্যাপার গায়ে দিচ্ছেন, পড়ে গিয়ে তাঁর হাত ভেঙে যাচ্ছে, ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছেন, শিষ্যদের শাসন করছেন, শিক্ষা দিচ্ছেন, রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কচুরি খাচ্ছেন, থিয়েটার দেখছেন, সার্কাস দেখছেন, একদিকে শিশুর সারল্য আর অন্যদিকে সাক্ষাৎ অবতারবরিষ্ঠায় - জীবন্ত প্রাণবন্ত প্রত্যয়ী রসিক একজন দেবমানুষ, শ্রীম না থাকলে এই ব্যক্তিগত শ্রীরামকৃষ্ণকে হয়তো আমারা এমনভাবে পেতামই না।
এই যে ধ্যানালোকে আমরা বিভিন্নভাবে ঠাকুরকে দেখি, তার অধিকাংশ দৃশ্যকল্পেরই রচয়িতা শ্রীম। উনি প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের পাঁচটি খন্ড লিখেছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন, গোটাটার সময়কাল ১৯০২-৩২, যার প্রথম চারটি খন্ড আট বছরের মধ্যে প্রকাশিত হয় আর শেষেরটি ২২ বছর পর। ডায়েরিতে সাংকেতিক এন্ট্রি দেখে দেখে গুরুর সাথে প্রতিটিদিনের সাক্ষাৎকার যদি বহুবছর পরেও অত বিশদে এবং নির্ভুলভাবে শ্রীম অনুধ্যান না করতে পারতেন, তাহলে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনে, বিশেষতঃ গৃহস্থদের ক্ষেত্রে, ভক্তিমার্গের অপেক্ষাকৃত সহজ পথ এত প্রশস্ত হতো না। কথামৃতে ব্যবহৃত 'ভক্তি' শব্দের মোট সংখ্যা ৪০৯৪ আর ভক্তি-শব্দ বিযুক্ত পৃষ্ঠার সংখ্যা ১৩১।
শ্রীম নিজে লিখছেন, 'ঠাকুরের ভক্তির কথা যত ভাবিতেছি ততই অবাক হইতেছি। কেশব সেন হরিনাম করেন, অমনি তাঁকে দেখতে ছুটছেন, অমনি কেশব আপনার লোক হলেন। তখন কাপ্তেনের কথা আর শুনলেন না। তিনি বিলাতে গিয়েছিলেন, সাহেবের সঙ্গে খেয়েছেন, কন্যাকে ভিন্ন জাতিতে বিবাহ দিয়েছেন - এসব কথা ভেসে গেল। কুলটি খাই, কাঁটায় আমার কি কাজ? ভক্তিসূত্রে সকারবাদী, নিরাকারবাদী, এক হয়; হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান এক হয়; চারি বর্ণ এক হয়। ভক্তিরই জয়। ধন্য শ্রীরামকৃষ্ণ! তোমারই জয়!'।
ইংরিজি ১৮৮১-৮৬ সালের মধ্যে মোট ১৯৬ দিনের বিবরণ আছে কথামৃতে, যা শ্রীশ্রীমা স্বয়ং কেবল নিয়মিত শুনতে ভালোবাসতেনই না, অন্যদেরও পড়তে উৎসাহ দিতেন। মা বলেছিলেন, "মাষ্টার কি সুন্দরভাবে সব মনে করে লিখেছে! শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ সামনে সব কথা হচ্ছে। কি বর্ণনা! আর এসব কথা যেন হৃদয়ে গেঁথে থাকে। এই সমস্ত পড়ে-শুনেই তো আজকাল এত লোক তাঁর দিকে ঝুঁকছে। শান্তি পাচ্ছে। এসব অমোঘ কথা।..." এটাই আধ্যাত্মিক পথের যাত্রীদের কাছে শ্রীমর আসল দান। ঠাকুর শ্রীমকে বলেছিলেন, "তোমাকে গৌরাঙ্গর দলে দেখেছিলাম"। তাই ঠাকুরের সেই কল্পতরু অবস্থার আশীর্বাদ 'তোমাদের চৈতন্য হোক', শ্রীমর লেখনীর মাধ্যমেই বুঝি আমাদের সকলের ওপর সতত বর্ষিত হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment