Thursday, July 7, 2022

মা কালী

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি রামপ্রসাদী গান খুব গাইতেন, 
কে জানে কালী কেমন, ষড় দর্শনে না পায় দরশন।
আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন,
সে যে ঘটে ঘটে বিরাজ করে ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।
কালীর উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা বুঝ কেমন,
যেমন শিব বুঝেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন।
মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন,
কালী পদ্মবনে হংস-সনে, হংসীরূপে করে রমণ।
প্রসাদ ভাষে, লোকে হাসে, সন্তরণে সিন্ধু-তরণ,
আমার মন বুঝেছে, প্রাণ বুঝে না; ধরবে শশী হয়ে বামন।

সত্যিই তো, কে জানে কালী কেমন? নানা তন্ত্রে মায়ের নানারূপের বর্ণনা থাকলেও, আমরা বাঙালিরা মায়ের দক্ষিণাকালিকা রূপটিকেই বেশি পছন্দ করি। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে নবদ্বীপের বিশিষ্ট তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ এই কালীমূর্তির প্রচলন করেছিলেন। মহাকাল সংহিতা অনুসারে আদ্যাকালীই দক্ষিণাকালী। জনশ্রুতি যে দক্ষিণদিকে যমের অবস্থান, কালী নামে ভীত হয়ে সে ছুটে পালায়, এজন্যেই ত্রিজগতে কালিকাদেবী ‘দক্ষিণা’ নামে পরিচিতা। তবে আসল কারন আলাদা। ঋগবেদে আছে 'তমঃ আসীত্তমসা গূঢ়মগ্রে' মানে অগ্রে অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে ছিল তমঃ। সেই তমসায় সমস্তই আচ্ছন্ন ছিল (ঋকবেদ ১০/১২৯/৩)। আবার মৈত্রায়ণী-উপনিষদেও বলা হয়েছে 'তমো বা ইদমেকমাস', অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র তমঃ ছিল (মৈ-উপঃ, ৪র্থ প্রপাঠক)। এই আদি তমঃই কালী, তাই মা কালো। 

মহানির্বাণতন্ত্রে (১৩/৫-৬) বলা হয়েছে,
স্বেতপীতাদিকো বর্ণে যথা কৃষ্ণে বিলীয়তে।
প্রবিশন্তি তথা কাল্যাং সর্বভূতানি শৈলজে।।
অতস্তস্যাঃ কালশক্তের্নিগুণায়া নিরাকৃতেঃ।
হিতায়াঃ প্রাপ্তযোগানাং বর্ণঃ কৃষ্ণো নিরূপিতঃ।।
অর্থাৎ, শ্বেত পীতাদি বর্ণ যেমন কৃষ্ণ বর্ণে বিলীন হয়ে যায় তেমনি সর্বভূত কালীর মধ্যে বিলীন হয়। এইজন্য যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাঁরা নির্গুণা নিরাকারা কল্যাণময়ী কালশক্তির কৃষ্ণবর্ণ নিরূপণ করেছেন। “পরাশক্তি অরূপা সুতরাং বর্ণহীন। যেখানে সর্ববর্ণের অভাব তাহাই নিবিড় কৃষ্ণাবর্ণ, একথা বিজ্ঞানসম্মত। বিজ্ঞান আরও বলে যে-জ্যোতিঃ আমাদের চক্ষু ধারনা করিতে পারে না, তাহাই নিবিড় কৃষ্ণবর্ণ দেখায়। তাই মহাজ্যোতিঃ কালী কৃষ্ণাবর্ণা। কিন্তু জ্ঞাননেত্রে মহাজ্যোতিঃ রূপে দৃশ্য হন।”

কালের কোলে সবকিছুই একদিন লয় হয়। কাল সৃষ্টির শুরু থেকে সমস্তই ‘কলন’ অর্থাৎ গ্রাস বা কালগ্রস্ত করছেন, তাই তাঁকে জগৎ-সংহারক ‘মহাকাল’ বলা হয়। সেই মহাকালকেও যিনি গ্রাস করেন বা নিজের মধ্যে বিলীন করে নেন, তিনিই কালী। কালী শব্দটি উচ্চারণ করলে ‘কাল-ঈ’ বোঝায়। ঈ অর্থাৎ ঈশ্বরী। অনাদি ও অনন্ত মহাকাল অর্থাৎ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানরূপী কালকে লয়-লীলার মধ্যেও যিনি সতত ‘ঈ’ অর্থাৎ ‘ঈক্ষণ’ অথবা দর্শন করছেন, তিনিই কাল-ঈ = কালী। 

মহাকালের অন্তর্গত খন্ডকালের মধ্যে সংসারের নিত্য সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় কার্য্য যা অহরহঃ অবিরত ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাও তিনি ‘ঈ’ বা ঈক্ষণ করছেন। আবার সেই অনাদি কাল থেকেই কাল-সংহারিণী কালীর করালবদনের মধ্যে নিত্য কত কি যে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, সে সবও তিনি সতত ‘ঈ’ বা ঈক্ষণ অথবা দর্শন করছেন, তাই তিনি ‘কালী’। শ্রীশ্রীচন্ডীতে মাকে 'সর্বভূতেষু চেতনেত্যাবিধীয়তে' বলা হচ্ছে, অর্থাৎ সকল প্রাণীতে যিনি চেতনা বলে অভিহিত হন। কালী হলেন স্বগুন ব্রহ্ম, মহাশক্তি, মহামায়া। যা ছিল, যা আছে এবং যা থাকবে, ভূত বর্তমান ভবিষ্যৎ আদি অনন্ত সব মায়ের মধ্যেই আছে।

কালী বা মহাকালী দক্ষিনা আদি অষ্ট কালীরূপে সাধকের ধ্যেয়। যেরূপেই তিনি ধ্যেয় হন না কেন, কালী হলেন আদি, অনন্ত, অক্ষয়, 'বাক্যমনাতীত মনোবচনৈকাধার'। তিনি ত্রিগুণময়ী। তাই মহানির্বাণতন্ত্রে সদাশিব দেবীকে বলেছেন,
সৃষ্টেরাদৌ ত্বমেকাসীৎ তমোরূপমগোচরম।
পুনঃ স্বরূপনাসাদ্য তমোরূপং নিরাকৃতিঃ।।
বাচাতীতং মনোহগম্যং ত্বমেকৈবাবশিষ্যসে।
সৃষ্টির পূর্বে বাক্য ও মনের অতীত তমোরূপে তুমি একা বিরাজমানা ছিলে। (প্রলয়ের পর) তুমিই আবার তোমার নিরাকার, বাক্যের অতীত ও মনের অগম্য তমোরূপ স্বরূপ প্রাপ্ত হও এবং তখন অদ্বিতীয়া তুমিই কেবল অবশিষ্ট থাকো।

দক্ষিণাকালী সম্পর্কে তন্ত্রতত্ত্বের আলোচনা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। শিবচন্দ্র লিখেছেন, "পুরুষের নাম দক্ষিন (দক্ষিনাঙ্গস্বরূপ বলে) এবং শক্তির নাম বামা (বামাঙ্গস্বরূপ বলে)। যতদিন এই বাম আর দক্ষিন, স্ত্রী ও পুরুষ সমবলে অবস্থিত, ততদিন সংসার বন্ধন। সাধনার প্রখর প্রভাবে বামাশক্তি জাগরিতা হলে তিনি দক্ষিনশক্তি পুরুষকে জয় করে তদুপরি স্বয়ং দক্ষিণানন্দে নিমগ্না হয়েন অর্থাৎ কি বাম, কি দক্ষিন উভয় অংশই যখন তাঁর প্রভাবে পূর্ণ হয়ে যায়, তখন সেই কেবলানন্দরূপিণী জীবের মহামোক্ষ প্রদান করেন। তাই ত্রৈলোক্য-মোক্ষদা মায়ের নাম দক্ষিণাকালী"।

মা আদিশক্তি, আদ্যাশক্তি। উনিই জগতের মূল শক্তি। উনি মহা সরস্বতী, উনিই মহা লক্ষ্মী। উনি মহিষমর্দিনী চণ্ডী, চামুন্ডা, কৌষিকী, দুর্গা ভগবতী।উনি রুদ্রানী শিবানী আবার উনিই ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী। উনি নারায়নের শক্তি নারায়নী, শিবের শক্তি শিবানী। উনি নারসিংহী, বারাহী, কৌমারী, গন্ধেশ্বরী। উনি শ্রীরামচন্দ্রের শক্তি সীতাদেবী (আদ্যাস্তোত্রে 'রামস্য জানকী ত্বং হি রাবণধ্বংসকারিনী), উনিই শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি আবার উনিই ব্রহ্মাগ্নিস্বরূপ 'যে রাম যে কৃষ্ণ সেই এই শরীরে' শ্রীরামকৃষ্ণের দাহিকাশক্তি শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী। এই ব্রহ্মাণ্ডে তাঁর ইচ্ছা ব্যতিরেকে কোনো কিছুই হওয়ার যো নেই। ঠাকুর বলতেন, মায়ের ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না।

মায়ের মূর্তি বাইরে থেকে ভয়াবহ দেখালেও, আসলে তা এক ভক্তবৎসলা মোক্ষপ্রদায়িনী মহাশক্তির আধ্যাত্মিক প্রতীকীরূপ। শ্রীশ্রীচন্ডীর চতুর্থ অধ্যায়ের ২২নং শ্লোকে মায়ের রূপ সম্পর্কে বলা হচ্ছে,
চিত্তে কৃপা সমরনিষ্ঠুরতা চ দৃষ্টা।
ত্বয্যেব দেবী বরদে ভূবনত্রয়েহপি।।
অর্থাৎ, দেবী, কার সাথে তোমার এই পরাক্রমের তুলনা হতে পারে? শত্রুভীতিজনক এবং এত মনোরম সৌন্দর্য কোথায় আছে? বরদে, হৃদয়ে কৃপা এবং যুদ্ধে কঠোরতা ত্রিভুবনে একমাত্র তোমাতেই দেখা যায়। ওই শ্রীশ্রীচন্ডীতেই একাদশ অধ্যায়ের ৫৪-৫৫ নং শ্লোকে 'পাতানো মা নয়, সত্যিকারের মা' আশ্বাসবাণী দিচ্ছেন,
"ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি।
তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্।"
অর্থাৎ, যখনই দানবোদ্ভুত বিঘ্ন উপস্থিত হবে, তখনই আমি আবির্ভূতা হয়ে অসুরদের বিনাশ করবো।

মা ত্রিনয়না - অতীত, বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্তই সেই ত্রিগুণময়ী ত্রিকালদর্শিনী মায়ের নয়নপথে সর্বক্ষণ প্রতিভাত হয়ে রয়েছে। মায়ের একটি নয়ন চন্দ্রস্বরূপ, দ্বিতীয়টি সূর্যস্বরূপ আর তৃতীয়টি অগ্নিস্বরূপ। প্রথমটিতে মায়ের শান্তভাব, দ্বিতীয়টিতে জ্যোতি আর তৃতীয়টিতে তেজ প্রকাশ পায়। মায়ের চক্ষু রক্তবর্ণ কারণ রক্তই জীবের জীবনীশক্তিস্বরূপ, ফলে তাঁর নয়নত্রয় শক্তি-সহযোগে রক্তবিস্ফুরিত হয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে রয়েছে। মায়ের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে 'দেবীং লোলজিহ্বাং দিগম্বরীং'। মা আমাদের দিগম্বরী। এর অর্থ তিনি কোন কিছুরই বন্ধনে আবদ্ধ নন, তিনি দেশ কাল পাত্রের অতীত। এক দিকে তিনি বিশ্বমধ্যে, আবার অন্য দিকে তিনি বিশ্বব্যাপী ও বিশ্বাতীত। যাঁর স্বরূপ এমন, তাঁকে কি কোনও বাহ্যিক জাগতিক আবরণ দিয়ে ঢাকা যায়? বাসনামুক্ত হয়ে সম্পূর্ণভাবে অহং ও অবিদ্যাকে ত্যাগ করলে, তবেই মায়ের কাছে পৌঁছানো যায়।

মাযের মূর্তিতে আমরা দেখি তাঁর জিব বের করা, মা দাঁত দিয়ে জিব কামড়ে আছেন। এই ভঙ্গিমাকেই লোলজিহ্বা বলা হচ্ছে। জিবের অন্য নাম রসনা, যা সমস্ত রকমের রস ভোগ করার প্রতীক। রসনা ও উপস্থ, এই দুটি ইন্দ্রিয়জনিত ভোগ লালসার মূল যন্ত্র এবং অষ্টাঙ্গযোগ সাধনার শুরুতে এ দুটিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই যম বা সংযম ক্রিয়া অভ্যাস করতে হয়। স্থুলদেহের সংযমের কেন্দ্রবিন্দু বীর্য্য রক্ষা এবং সূক্ষ্মদেহের প্রথম স্তর বাক্য-সংযম ও পক্ষান্তরে রসনা সংযম। মন-সংযমও এরই অন্তর্গত অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম ক্রিয়া। মা নিজের জিব নিজের দাঁত দিয়ে কেটে আসলে সর্ববিধ লালসা-সংযমেরই ইঙ্গিত করছেন। অন্যভাবে দেখলে, রজোগুণ সাধারণতঃ সত্ত্বগুণের দ্বারাই বশীভূত হয়। রজো হলো লাল আর সত্ত্ব হলো সাদা। লাল জিবকে সাদা দাঁত দিয়ে কামড়ে মা সাধককে সত্ত্বগুণকে দিয়ে রজোগুণকে নিয়ন্ত্রণ করার বার্তা দিচ্ছেন, বলছেন ত্যাগের দ্বারা ভোগকে জয় করো।

মায়ের গলায় ৫০টি কাটা মুন্ডু আসলে ৫০টি সংস্কৃত বর্ণমালার প্রতীক, যার মধ্যে ১৪টি স্বরবর্ণ আর ৩৬টি ব্যঞ্জন বর্ণ। এখানে প্রতিটি বর্ণ মানে এক একটি বীজমন্ত্র। শব্দই ব্রহ্ম। তাই এখানে অক্ষররূপ বীজমন্ত্রগুলি শক্তির উৎস। দেবী স্বয়ং শব্দব্রহ্মরূপিণী। কামধেনু তন্ত্রে তাই মা নিজেই বলছেন,
"মম কণ্ঠে স্থিতং বীজং পঞ্চাশদ্ বর্ণমদ্ভুতম্"।
রামপ্রসাদ সেই শুনে গেয়েছেন,
যত শোন কর্ণপুটে সকল মায়ের মন্ত্র বটে।
কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে।
আসলে মায়ের গলার মুন্ডমালা হল জ্ঞানশক্তির প্রতীক। দেবী ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন - তিনি চেতনা দান করেন। আবদ্ধ জীবকে তিনি আলোর পথ দেখান। আর মায়ের কোমরবন্ধ হিসেবে মানুষের কাটা রক্তঝরা হাতের মাধ্যমে কর্মফলকে বোঝানো হয়েছে। তিনি ইচ্ছা করলেই কর্মফল ঘুচিয়ে দিয়ে এই জীবন-মৃত্যুর বৃত্ত থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি দিতে পারেন।

তন্ত্রে বলছে কালী 'মুন্ডমালিনীং দিব্যা সতত অট্টহাস্যকারীনিম।
শবরূপী মহাদেব হৃদয়পরি সংস্থিতাম।।'
অর্থাৎ মা গলায় মুন্ডমালা পরে দিব্যজ্যোতি ছড়িয়ে সারাক্ষন অট্টহাস্য করছেন আর শবরূপী মহাদেবের হৃদয়ের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মহাদেব দেবীর পদতলে কেন বিরাজ করছেন? কারণ শিব নিষ্ক্রিয় পুরুষ আর কালী হলেন সক্রিয় প্রকৃতি। তাই তি‌নি শবরুপী শিব, মা আদিপ্রকৃতির অধীনস্থ। সাংখ্য অনুসারে পুরুষ সাক্ষীস্বরূপ আর প্রকৃতি ক্রিয়াময়ী। তাই শ‌ক্তির পদত‌লে শি‌ব। শঙ্করাচার্য্যও বলে‌ছেন, শ‌ক্তিযুক্ত না হ‌লে শিবেরও স্পন্দন ক্ষমতা নেই । তাই দেবীর পা‌য়ের তলায় নিশ্চল হ‌য়ে প‌ড়ে র‌য়ে‌ছেন শিব।‌ তন্ত্রমতে, শ‌ক্তির দু‌টি অবস্থা, নি‌ষ্ক্রিয় ও ক্রিয়‌াশীল। শ‌ক্তি যখন নি‌ষ্ক্রিয় তখন তিনি শিব। আর যখন তিনি ক্রিয়াশীল ও জাগ্রত তখন তিনি কালী। তাই কালী ও শিব দুইই নিত্যরূপে একই মূ‌র্তি‌তে প্রকা‌শিত। দ‌ক্ষিণাকালীর মূ‌র্তি‌তে দেবী শি‌বের উপর বিপরীতরতাতুরা বা র‌তি‌ক্রিয়ার বিপরীত ভ‌ঙ্গিতে উপ‌বিষ্টা, যা নির্বাসনার প্রতীক। অপরদিকে রামপ্রসাদ বলেছেন অন্য তত্ত্ব। তিনি বলেছেন,
'দৈত্য‌বেটা ভূ‌মে প‌ড়ে,
মা দা‌ড়ি‌য়ে তার উপ‌রে, 
মা‌য়ের পাদস্প‌র্শে দানব‌দেহ 
শিবরূপ হয় রণস্থ‌লে।' 
অর্থাৎ মায়ের পাদস্পর্শে দৈত্য অর্থাৎ অশিব শিবে রূপান্তরিত হয়েছেন। এও যুগলমূর্তিকে দেখার একটা উপায় বটে।

মায়ের কাছে যেতে গেলে আগে মায়ের মেজাজটা তো বুঝতে হবে, নাকি? তাঁর রূপ যেমন প্রতীকী, তাঁর পূজাপদ্ধতিও তেমনই প্রতীকী। যাঁরা বোঝেন না তাঁদের মনে নানা প্রশ্ন জাগতেই পারে, সেটা তাঁদের কর্মফল। মায়ের বাহ্যিক রূপ দেখে তাঁরা ভাবতেই পারেন যে মা যে অসুরদের বিনাশ করেন তারা কারা আর কিভাবেই বা কোনো মা তাঁর নিজের সন্তানকে বধ করেন? তাঁরা মায়ের পূজায় অর্পণ করা উপাচারগুলির গুঢ়ার্থও স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারেন না। আসলে মা বধ করেন না, সংহার করেন। তিনি সংহাররুপিনী। সংহার শব্দের অর্থ ধ্বংস নয়, সংহরন, নিজের ভিতরে প্রত্যাকর্ষণ। যেমন সমুদ্রের বুকে ঢেউ ওঠে আবার সমুদ্রেই লয় হয়। আসলে মা তাঁর সাধক-সন্তানের অন্তরের কামাদি রিপুরূপ আসুরীপ্রবৃত্তিগুলির সাথে সর্বদা সমর-রতা। মানব হলো নিষ্কাম দেবতা আর বাসনাপূর্ন দানব - উভয় অবস্থারই প্রতীক-স্বরূপ। মানবের মনের ভিতরে নিয়তই দেবাসুরের ভীষণ যুদ্ধ ঘটে চলেছে। তাই নিষ্ঠাভরে প্রার্থনা করলে মা আজও রিপুরূপদানব-দলনের জন্য আবির্ভূতা হয়ে অন্তরের অসুরনাশ করে দেবত্বকে জাগিয়ে দেন। 

আরে মানুষ তো কোন ছাড়, স্বয়ং ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর তাঁর কাছে মুক্তি ভিক্ষা করেন। রামপ্রসাদ গেয়েছেন,
মুক্ত কর মা মুক্তকেশী
ভবে যন্ত্রনা পাই দিবানিশি।
মায়ের মুক্তকেশ একাধারে মোহমায়ার পাশ আর তার থেকে মুক্তির প্রতীক। কালী মায়াতীতা কিন্তু স্বগুণশক্তিরূপে অনন্ত জীবকোটিকে মায়াপাশে বদ্ধ করেন। তাই একদিকে তাঁর মুক্তকেশজাল মায়াপাশের প্রতীক আবার অন্যদিকে মা কালী ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবেরও মুক্তিবিধান করেন বলে তিনি মুক্তকেশী। ক-অ-ঈশ= কেশ। ক ব্রহ্মা, অ বিষ্ণু এবং ঈশ শিব। কাজেই কেশ বলতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব বোঝায়। তাই 'কেশ'কে মুক্ত করেন বলে মা মুক্তকেশী। যোগশাস্ত্রে মুক্তকেশ বৈরাগ্যের প্রতীক। মায়ের যে চিরবৈরাগ্য। তিনি কৃপা করে জ্ঞানখড়্গের দ্বারা লৌকিক বা জাগতিক অষ্টপাশ ছিন্ন করে সাধককে মুক্ত করে দেন, যা তাঁর বাঁহাতে ধরা কাটা মুন্ডুতে প্রতিবিম্বিত।

সিস্টার নিবেদিতা তাঁর বিখ্যাত Kali the Mother বইটিতে বেবি লেগেট নামের একটি শিশুকে চিঠিতে লিখছেন (২৫শে ডিসেম্বর, ১৮৯৮),
BABY DARLING, what is the very first thing you remember? Is it not lying on mother's lap, and looking up into her eyes, and laughing?

Did you ever play hide and seek with mother? Mother's eyes shut, and baby was not. She opened them, and there was baby! Then baby's eyes shut, and where was mother? But they opened again, and--oh!

When mother's eyes were shut, where was she? There all the time. But you could not see her eyes. Yet she was there.

Baby, some people think God is just like that. A great great Mother--so great that all this big world is Her baby. God is playing with Her world, and She shuts Her eyes. Then, all our lives long, baby darling, we try to catch the Great Mother peeping. And if any of us can do that, if any of us can look into the eyes of God, just once, just for a minute,--do you know what happens? . . . That person at once knows all secrets, and he becomes strong and wise and loving, and he never, never forgets that moment.

And when you win like that, when you catch the Mother looking, something else happens. Something lovely. All Her other children come and play with you. The little birds come, and the wee lambs love you, and the wild rabbits touch your feet, and the poor children in the streets, who are cold and hungry perhaps--poor children that the Great Mother loves most of all, because they seem to have no father or mother, and perhaps no home--poor children trust you, and make a place for you with them. We are all sitting on the Mother's lap, but these sit closest of all to Her breast.

And what do we call the Mother with Her eyes shut? We call her Kali.

No comments:

Post a Comment