স্বর্গলোক, ভূলোক আর পাতাললোক আসলে মনেরই তিন অবস্থা, বাস্তবেও যার প্রতিফলিতরূপ দেখা যায়। স্বর্গলোক হলো সেই মানসিক অবস্থান যেখানে সৃষ্টি আর স্রষ্টা সর্বদা একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন, অর্থাৎ আধ্যাত্মলোক। যদি গুণের দিক দিয়ে দেখা হয় তাহলে এই অবস্থায় মন সত্ত্ব রজঃ তম তিনটি গুণেকেই অতিক্রম করে প্রকৃতির পারে চলে যায়।
ভুলোক হলো সেইসব জীবের বাসভূমি যারা জড় শরীরে আবদ্ধ হয়েও চেতনের খোঁজে ফেরে আর যদিও সত্ত্বগুণ সুখে আসক্তি সৃষ্টি করে এবং রজগুণ কর্মে আসক্তি সৃষ্টি করে তাদের প্রকৃত স্বরূপ ভুলিয়ে রাখে, তবুও কোনো না কোনো সময় নশ্বরতার অসারত্ব অনুভব করে সেই জীব জড়ের উর্দ্ধে উঠতে চায়।
শেষে আসে পাতাললোক যেখানে বিবেককে ঢাকা দিয়ে প্রমাদে নিমজ্জিত করে তমগুণ জীবের ওপর নিজের একাধিকার স্থাপন করে। চরম ভোগবিলাসে নিমজ্জিত, ইন্দ্রিয়তাড়িত, ধর্মবোধহীন cult নির্ভর, চরম স্বার্থপর, মতবাদ বা পদ্ধতির নামে হানাহানিতে মত্ত এমন এক ভয়ংকর যাপন যা মানুষকে অমানুষ করে তোলে।
গীতার চতুর্দশ অধ্যায় অর্থাৎ গুণত্রয়বিভাগ যোগে শ্রীভগবান এই তিনগুণ সম্পর্কে অর্জুনকে বলছেন, "হে মহাবাহো! সত্ত্ব, রজ ও তম— এই তিন গুণ প্রকৃতির দ্বারা উৎপন্ন। কিন্তু প্রকৃতির কাজ শরীরের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক মান্য করার কারণে এই গুণ অবিনাশী জীবাত্মাকে নাশবান জড় শরীরে আবদ্ধ করে দেয়। হে নিষ্পাপ অর্জুন! সেই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল (স্বচ্ছ) হওয়ার কারণে রজগুণ ও তমগুণের তুলনায় প্রকাশক ও নির্বিকার হয়। সে সাত্ত্বিক সুখ ও সাত্ত্বিক জ্ঞানের আসক্তির সাহায্যে জীবাত্মাকে বেঁধে দেয়। অর্থাৎ তাঁকে গুণাতীত হতে দেয় না।"
বলছেন, "হে কৌন্তেয়! তৃষ্ণা ও আসক্তি উৎপন্নকারী রজগুণকে তুমি রাগস্বরূপ বিবেচনা কর। এটি কর্মের আসক্তিতে জীবাত্মাকে আবদ্ধ করে। হে ভারত! তমোগুণ অজ্ঞানতা থেকে উৎপন্ন হয় এবং সম্পূর্ণ মনুষ্যকে মোহিত করে। অর্থাৎ তাঁদের মধ্যে বিবেক উৎপন্ন হতে দেয় না। সে প্রমাদ, আলস্য ও নিদ্রার দ্বারা জীবাত্মাকে শরীরে বেঁধে দেয় অর্থাৎ তাঁর লৌকিক, পরলৌকিক উন্নতি হতে দেয় না।"
আমরা যদি আমাদের চারপাশে তাকিয়ে দেখি তাহলেই এই তিনলোক স্পষ্ট দেখতে পাবো। যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হিমালয়ের কোনো নির্জন গুহায় তপস্যারত, প্রচন্ড শীত বা অন্নাভাব যাঁকে স্পর্শ করতে পারেনা, বাহ্যিক সমস্ত অনুভূতির পারে গিয়ে যিনি আত্মমগ্ন, তিনি স্বর্গলোকের বাসিন্দা।
আবার যে সন্ন্যাসী লোকালয়ে কোলাহলের মধ্যে থাকেন কিন্তু যাঁর নিজের কোনো কামনা বাসনা নেই, আর্তের কান্না যিনি সহ্য করতে পারেননা, শিবজ্ঞানে জীবসেবা করাই যাঁর জীবনের ব্রত, ঈশ্বরের সৃষ্টির মধ্যেই যিনি তাঁর দৈবীপ্রকাশকে সর্বদা অনুভব করেন এবং যাঁর কাছে কায়া আর তার ছায়া এক এবং অবিভাজ্য বলে মনে হয়, তিনিও স্বর্গলোকের বাসিন্দা। আবার গৃহী হয়েও মানুষকে ঈশ্বরের রূপ বলেই মনে করে নির্লোভি হয়ে সারাজীবন যিনি জনসেবা করে যান, যেমন বোলপুরের সদ্যপ্রয়াত 'এক টাকার ডাক্তার' ডঃ সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁরাও শরীরে থাকাকালীনই ওই স্বর্গলোকের বাসিন্দা।
ভারতে ভূলোকবাসীদের আমরা আকছারই দেখতে পাই, হয়তো সবসময় চিনতে পারিনা। সরকারি কর্মক্ষেত্রে ঘুষ-সংস্কৃতির মধ্যে বসে সারাজীবন চাকরি করেও এবং ঘুষ নেওয়াই যেখানে রীতি সেখানে ব্যতিক্রমী স্বচ্ছতা দেখিয়ে যিনি সারাজীবন সৎপথের ন্যায্য রোজগারটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন, তিনি ভুলোকের বাসিন্দা। মানুষের মধ্যে সত্ত্বগুণ যখন বৃদ্ধি পায়, তখন ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণে নিদ্রা, আলস্য, প্রমাদ ইত্যাদি মিটে গিয়ে স্বচ্ছতা আসে এবং বিবেক প্রকট হয়। এইখান থেকেই গুণের অতীত যাওয়ার পথচলা শুরু হয়।
তবে এই স্তরে পৌঁছানোর আগে আরো একটি স্তর অতিক্রম করতে হয় যেটি রজগুণের। বাড়ির একতলায় যেমন বন্যার জল ঢুকে পড়ে লোকসান করে দেয় কিন্তু দোতলা অক্ষত থাকে, ভূলোকেই রজগুণ হলো বাড়ির একতলা। লাভ করার ইচ্ছে, ভোগ করার ইচ্ছে, নতুন নতুন কাজ খোঁজা যাতে আরো অর্থ উপার্জন করা যায়, জীবনে অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তি আর অশান্তিকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনা, এসব হলো ভূলোকেরই অংশ। আর এই করতে করতেই একদিন মানুষ এর অসারতা বুঝতে পেরে সত্যিকারের শান্তির পথ খুঁজতে শুরু করে।
শেষে হলো পাতাললোক। বহুমূল্য অত্যাধুনিক প্রমোদতরণী ভেসে যাচ্ছে সাগরে, তার আয়নাখচিত নাচঘরে অর্ধনগ্ন সুন্দরী নারীরা নেচে নেচে বিত্তশালী বৈভবশালী কামুক পৃষ্ঠপোষকদের বিনোদিত করছেন, লক্ষ লক্ষ টাকার মদের ফোয়ারা ছুটছে, ওই তো পাতাললোক। অথবা মতবাদের নামে, cult-এর নামে, বিশ্বাসের নামে একজন আর একজনের গলা কাটছে, কমজোরের ওপর কতৃত্ব কায়েম করার জন্য শক্তিশালী তাদের বাসভূমি বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে অথবা কোনো একনায়ক ভিন্নমতের লোকের ওপর অকথ্য অত্যাচার করছে, এরাই তো পাতাললোকের বাসিন্দা আর এই তো পাতাললোক। যে সময় মনে তমোগুণ বাড়ে, সে সময় ইন্দ্রিয়সংযম ও কাজে স্বচ্ছতা থাকে না, কোনও সৎকাজ করার ইচ্ছা হয়না, প্রমাদ শুরু হয় এবং অন্তঃকরণ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে প্রায় গোটা পৃথিবীটাই যে পাতাললোক হয়ে উঠেছে, আশাকরি সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
সাত্ত্বিক কর্মের ফল নির্মল, রাজস কর্মের ফল দুঃখদায়ী ও তামস কর্মের ফল বিবেকহীনতা হয়। সত্ত্বগুণের কারণে জ্ঞান (বিবেক), রজগুণের কারণে লোভ ও তমগুণের কারণে প্রমাদ, মোহ ও অজ্ঞানতা উৎপন্ন হয়। মনের মধ্যে তমগুণ বৃদ্ধি পেলে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ, বৃক্ষ, লতা ইত্যাদি নীচ যোনিতে জন্মগ্রহণ করে। সৃষ্টিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে গেলে তাই তম নাশ করে মানুষের মনের অভিমুখ তার স্বরূপ অন্বেষণের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। সেইজন্যই এখন আবার দৈবশক্তি নির্মিত আবহে ধর্মযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সময় এসে গেছে।
No comments:
Post a Comment