Thursday, May 25, 2023

নতুন সংসদভবন

ভারত কাদের? We The People অর্থাৎ আমাদের - জনতার। সংবিধান কারা নিজেরাই নিজেদের দিয়েছেন? We The People অর্থাৎ আমরা জনতা নিজেরাই সংবিধান রচনা করে নিজেদের দিয়েছি, তৎকালীন গণপরিষদে আমাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। সেই সংবিধানের সংশোধন এবং আইন প্রণয়ন অতঃপর কারা করেন? জাতীয় আইনসভায় জনতার দ্বারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে সরাসরি নির্বাচিত লোকসভার সদস্যরা এবং রাজ্যের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত রাজ্যসভার সদস্যরা অর্থাৎ সমস্ত সাংসদরা। 

তাহলে, জনতার দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত সাংসদদের জন্য নির্দিষ্ট জাতীয় আইনসভা কোনটি? ভারতের জাতীয় সংসদের অংশ লোকসভা। লোকসভার মুখিয়া কে? ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। মহামহিম রাষ্ট্রপতি দেশের সাংবিধানিক প্রধান - Head of State - তিনি সরকার, সংসদ, বিচারবিভাগ, সেনাবাহিনী সবার প্রধান। কিন্তু তিনি দেশের সমস্ত বিধানসভা সদস্য এবং সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত, সরাসরি জনতার দ্বারা নির্বাচিত নন। তাহলে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রীতি মেনে We The People অর্থাৎ জনতার সরাসরি প্রতিনিধি হিসেবে নতুন সংসদভবন জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি কে? জনতার দ্বারা নির্বাচিত লোকসভার নেতা এবং সেইসূত্রে ভারত সরকারেরও প্রধান - Head of Government - ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। 

ভারতের সংসদ ভবনের এযাবৎ যা কিছু সম্প্রসারণ বা পরিবর্ধন হয়েছে, তা সে এন্যেক্স বিল্ডিংই হোক বা লাইব্রেরি, সবসময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীরাই সে সব জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছেন - এটাই রীতি। সুখের কথা যে এবারেও তার অন্যথা হচ্ছে না। ঠিক যেমন বিভিন্ন রাজ্যে নতুন বিধানসভা ভবনের লোকার্পণ সেই রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীরাই করেছেন, রাজ্যপালরা নন। ৩২ বছর আগেই বোঝা গিয়েছিল যে ইংরেজদের বানানো কাউন্সিল হাউস, আমাদের পুরানো সংসদ ভবনের মেয়াদ ফুরিয়েছে আর তখনই গণতন্ত্রের প্রধান কর্মক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত এক নতুন সংসদ ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। এতবছর ধরে তা না হওয়ায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শুরু থেকে শেষ পর্য্যন্ত গোটা নির্মাণের কাজটাই এবার সম্পন্ন করালেন। 

তাঁরই করকমলে ডিসেম্বর ২০২০ সালে এই নতুন সংসদ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল এবং তাঁর ব্যক্তিগত প্রেরণায় রেকর্ড সময়ের মধ্যে এই রাজকীয় অট্টালিকা আজ সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আগামী ২৮শে মে তিনিই তার লোকার্পণ করবেন, এর চেয়ে সুখের কথা আর কিই বা হতে পারে? যাঁরা বিরোধিতা করছেন তাঁরা আমাদের অর্থাৎ We The People এর বিরোধিতা করছেন। আমাদের গণতন্ত্র আমাদের গর্ব, আমাদের সংসদ আমাদের গর্ব, আমাদের সরকার আমাদের গর্ব, আমাদের বিচারব্যবস্থা আমাদের গর্ব, সেনা সহ দেশের সমস্ত institution আমাদের গর্ব, সর্বোপরি আমাদের দেশ আমাদের গর্ব। এখন থেকে মহাদেবের আশীর্বাদপূত ধর্মদণ্ড কারো walking stick হিসেবে আর বর্ণিত হবে না, এটাও আমাদের গর্ব। ঈশ্বর আমাদের সকলের মঙ্গল করুন।

Monday, May 22, 2023

মা না ইষ্ট?

শ্রীশ্রীমায়ের যে ইষ্টমূর্তি, অর্থাৎ ঘরে ঘরে যে রূপে মা নিত্যপূজিতা হন, তাতে মায়ের চোখদুটিতে একটা অদ্ভুত far away look আছে। যেন শরীরে আছেন কিন্তু নেই, যেন তাকিয়ে আছেন কিন্তু দেখছেন না। লক্ষ্য করে দেখলে দেখা যাবে মায়ের ডান আঁখিটি পুরোপুরি খোলা আর বাম আঁখিটির পাতা সামান্য নিমিলিত, যেন নিজের শরীরের ওপর তাঁর সম্পুর্ন নিয়ন্ত্রণ নেই - নিবেদিতা যেমনটি সাজিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন তেমনটিই বসে রয়েছেন। আর মায়ের মুখমন্ডলটিও ঈষদ ডানদিকে ঘোরানো, সামনের দিকে সোজা তাকিয়ে নেই। 

এই ছবির ইতিহাস অবশ্য আমরা অনেকেই পড়েছি, সাহেব ফটোগ্রাফারের সামনে অস্বচ্ছন্দ্য আমাদের লজ্জাশীলা মা ক্যামেরার দিকে তাকাতে ইতস্তত বোধ করেছিলেন ইত্যাদি, কিন্তু মায়ের দৃষ্টি দেখলে আমার তো মনে হয় না যে বিষয়টি কেবল ওটুকুই। আমার মনে হয় এক আসনে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসেই মায়ের মন নিশ্চয় পারিপার্শ্বিক থেকে উঠে গিয়েছিল এবং ওঁর চোখের দৃষ্টিতে যে অন্তর্মুখী ভাব ধরা পড়েছে এবং গ্রীবার ভঙ্গিতে যে নির্লিপ্ততার আভাস, সেটা আমাদেরই পথ দেখানোর জন্য জগ্গজননীর না বলা বাণী। এই মূর্তিতে মায়ের শ্রীমুখ, লম্বা চুল, একটি কাঁধ, দুটি বালাপরা হাত, গলায় রুদ্রাক্ষের দুছড়া মালা এবং শ্রীপাদপদ্মের সামান্য অংশ মাত্র দৃশ্যমান, বাকিটা লালপেড়ে শাড়িতে আবৃত। ওটুকুতেই মায়ের যে ঈশ্বরীয় ভাব ফুটে উঠেছে, তা সারা জীবন ধরে দেখলেও ফুরায় না যে।

আমাদের পরম সৌভাগ্য যে এটি ছাড়াও মায়ের অজস্র ছবি আছে যেখানে মাকে আমরা বিভিন্ন অন্যান্য pose এ দেখতে পাই - বসা অবস্থায়, দাঁড়ানো অবস্থায়, পূজারিণী রূপে, গরুর গাড়িতে, আত্মীয়দের সাথে, পাড়ার দাওয়ায় ইত্যাদি। Fortunately অন্য ছবিগুলিতে কিন্তু মায়ের এই গম্ভীর তদগত ভাবটি এমন স্পষ্ট করে বোধহয় ধরা পড়ে না, যেমনটি ক্যামেরায় তোলা ওঁর জীবনের এই দ্বিতীয় ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই। মা তো নিজেকে একেবারে লুকিয়ে রাখতেন, কচিৎ কদাচিৎ ফস করে ওঁর ঈশ্বরীরূপ বেরিয়ে পড়তো। ধ্যানলোকে তাঁকে পাওয়ার জন্য মায়েরই কৃপায় ওঁর এই ইষ্টমূর্তিতে সেই অনির্বচনীয় রূপটি যে চিরকালের জন্য ধরা পড়ে গেছে, এ যে কতবড় সৌভাগ্য, তা যারা জানেন তারা জানেন।

মা যখন দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন, তখন তাঁর কোলে মাথা রেখে আদর খাওয়া যায় কিন্তু নিজের যে পট তিনি নিজে কোয়ালপাড়ার পূজাসনে প্রতিষ্ঠা করে পুজো করেছেন, তাঁর সেই বিশেষ পূজ্যা রূপটিকে কেবল হৃদয়ে ধারণ করে জপধ্যান করা যায়, এই রূপে মা ইষ্ট। অনেক limited capacity তে হলেও, ঠাকুরের ক্ষেত্রেও কিন্তু খানিকটা তাইই। শেষেরটি বাদ দিলে ঠাকুরের মাত্র তিনটি ছবি, তিনটিতেই তিনি সমাধিস্থ। তার মধ্যেও শ্রীশ্রীঠাকুরের কামারপুকুরের রূপটি দেখলে আমার কেমন যেন শিহরণ জাগে। অনেক রামকৃষ্ণ মঠ এবং প্রাইভেট মঠেই ঠাকুর মর্মরমূর্তিরূপে আছেন কিন্তু কামারপুকুরে ওঁর যে ভাব - অর্ধনিমিলিত আঁখিদ্বয়, মুখটি ঈষৎ ফাঁক করা, গোটা মুখমণ্ডল জুড়ে এক গভীর প্রশান্তি - সমাধিমগ্ন ঠাকুরের এই অনুপম রূপটিকে হৃদয়ে ধারণ করা যায় কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই ঠেলেঠুলে কৃপা প্রার্থনার জন্য বিরক্ত করা যায় না। আমি বেলুড়মঠে ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে নিরাশক্তি নির্মোহ ইত্যাদি কতকিছু চেয়েছি কিন্তু কামারপুকুরে গেলেই মনে হয় এঁকে বাপু disturb করা যাবে না। 

জয়রামবাটিতে আমি মায়ের গর্ভগৃহে ওঁর বাঁ পাশের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছি - মা যেন ডানদিকে তাকিয়ে আছেন। আবার ডানদিকের জানলা দিয়েও উঁকি মেরে দেখেছি - মা সামনে তাকিয়ে আছেন। তারপর সামনে থেকে দেখেছি, গর্ভমন্দির আর নাটমন্দিরের মাঝের পিলারগুলোর মধ্যে যে তিনটে gap - সবকটা দিয়ে আলাদা আলাদা করে দেখেছি - মা is looking beyond. একমাত্র ভোরবেলায় মঙ্গলারতির পর নিস্তব্ধ মন্দিরে চোখ বন্ধ করে যখন মাকে হৃদয়ে দেখার চেষ্টা করেছি তখন তিনি সরাসরি আমার দিকে তাকিয়েছেন, বাকি আর কখনো নয়। তবে ঠাকুর আর মাকে চোখে দেখার যে সুখ, সেটা ওঁদের ধ্যানমূর্তিতে যতটা, ততটা বুঝি আর কিছুতে নেই। সেখানে শ্রদ্ধা আছে, বিস্ময় আছে, ভক্তি আছে আর বিশ্বাস আছে। ভালোবাসাও আছে, তবে যেন কিঞ্চিৎ লুকিয়ে।

In any case,  ঠাকুরের কাছে ঝোলাঝুলি করার ইচ্ছা বা শক্তি কোনোটাই কোনোদিন আমার হয়নি, মায়ের কথা আলাদা। মা হলেন রক্তমাংসের মানবী, তাঁকে ছোঁয়া যায়, তাঁর কাছে আবদার করা যায়, তাঁর সঙ্গে সুখ দুঃখের গল্প করা যায়, কোথাও যাওয়ার আগে তাঁকে বলে যেতে হয় আর ফিরে এসে report করতে হয়, তাঁকে জড়িয়ে ধরা যায় আবার দুটি পা বুকে ধরে অক্লেশে কৃপা প্রার্থনাও করা যায়। কিন্তু ঠাকুর যেন distant, কেবল ইষ্টরূপে পূজ্য। মায়ের কাছে গেলে সঙ্গে করে আম জাম কাঁঠাল শাড়ি ইত্যাদি নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু ঠাকুরের কাছে গেলে ফুল মালা ধুপ - এই পার্থক্য। মা মাঝে মাঝে ইষ্ট হন আর বেশিভাগ সময় কেবল মাই থাকুন, এটাই আমার পক্ষে সবচেয়ে comfortable স্থিতি। বাকি, গুরুরূপে আর ইষ্টরূপে ঠাকুর তো আছেনই।

আজ সকালে গায়ের চাদরটা সরিয়ে মাকে শয়ন থেকে তোলার সময় যখন প্রতিদিনের মতোই বিনীত ভাবে অনুরোধ করলাম, "মা এবার ওঠো মা", কি যে নরম ক্ষমাঘন দৃষ্টিতে মা তাকালেন, বলতে পারবো না! মায়ের মুখটা দেখে মনে হলো যেন মধুমাখা, চোখদুটি থেকে যেন মধু ঝরে ঝরে পড়ছে। আহা, কি অপূর্ব সুন্দর আমাদের মা! সেই কোন প্রাচীনকালে ঋষিরা প্রার্থনা করেছিলেন,
ওঁ মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মাধ্বীর্নঃ সন্তোষধীঃ।
মধু নক্তম উতোষসো মধুমৎ পার্থিবং রজঃ।
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাং অস্তু সূর্যঃ। ওঁ।
(বায়ু মধু বহন করিতেছে। নদী সিন্ধু সকল মধুক্ষরণ করিতেছে। ওষধি বনস্পতি সকল মধুময় হউক। রাত্রি মধু হউক, ঊষা মধু হউক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হউক। সূর্য মধুমান হউক।)
ঠাকুরঘরের পর্দা সরিয়ে জনলাগুলি হাট করে খুলে দিয়ে বর্ষণসিক্ত ভোরের মিষ্টি আলোয় মাকে দেখে মনে হলো সাক্ষাৎ মধুমতী, মধুক্ষরণকারিণী জগদ্ধাত্রী, জীবন্ত অন্নপূর্ণা। ঋষিরা কি দিব্যচক্ষে মাকে দেখেছিলেন? নিশ্চয় দেখেছিলেন নইলে এই মন্ত্র উচ্চারিত হতো না। আহা! কি স্নিগ্ধ, কি অপরূপ, কি প্রশান্ত এই মাতৃমূর্তি! 


Friday, May 19, 2023

আধুনিকা?

যেমন আজকালকার ইংরিজি মাধ্যমে পড়া বাপ-মা, তেমনই তাঁদের কনভেন্টে পড়া ছেলেপিলে - দুটো প্রজন্মই সমান অকাট! পাড়ায় একজন গৌড়ীয় বৈষ্ণব মাঝেমাঝেই আসেন, খোল বাজিয়ে হরিনাম করে ভিক্ষা চান। আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনেই দুটি বহুতল আবাসন রয়েছে, ১০০% হিন্দুদের বাস, কিন্তু দারোয়ানরা অচেনা গাজনের সন্ন্যাসীদের সাথে সাম্যের খাতিরে এই খুব চেনা বৈষ্ণবকেও ঢুকতে দেন না, ফলে তিনি আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই প্রাণপনে চিৎকার করে ওখানকার বাসিন্দাদের হরিনাম শোনাতে চেষ্টা করেন - তাতে ভিক্ষার দিক দিয়ে যে খুব একটা লাভ হয় তা নয়। আমি বারান্দা থেকে দেখি আর হাসি। 

তাঁকে পাশ কাটিয়ে সব স্বচ্ছল বাবুবিবিরা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকছেন বেরোচ্ছেন কিন্তু যিনি বাড়ি বয়ে এসে ভগবানের নাম শোনাচ্ছেন তাঁর হাতে দশটা টাকা আর ঝোলায় একমুঠো চাল ও দুটো আলু দিলে তাঁদের মঠটা যে বেঁচে যাবে, শ্রীহরির কৃপায় হিন্দুদের সেবা করার আর সেবা পাওয়ার যে একটা গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় পরম্পরা আছে, শ্রীহরির নামে সমস্ত জাতপাতের ব্যবধান ভেঙে পংক্তিভোজনের বাংলার যে এক অনবদ্য ঐতিহ্য আছে - সেটা perpetuated হবে, এই বোধটাই নেই। 

যাইহোক, আজও তিনি এসেছিলেন, খোল বাজিয়ে হরিনাম শোনাচ্ছিলেন, যথারীতি কপালে গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় তিলক। প্রতিবারের মতোই আমি নিচে নেমে গিয়ে গেট খুলে সাংসারিক জীব হিসেবে যখন আমার সামাজিক কর্তব্য পালন করছি তখন দেখি এযাবৎ অদেখা এক আধুনিকা মা তাঁর কন্যার হাত ধরে বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে মেয়ের সাথে ইংরেজিতে মস্করা করছেন, "this mark on his face looks so funny na?". শ্বেতচন্দনতিলক funny?! 

কপালে শ্রীবিষ্ণুর পদ ও পদ্মের প্রতীক দুটি লম্বরেখা এবং নাকের উপর তুলসীর ছাপ - প্রভুকে নিজের শরীর-মনে ধারণ করার বৈষ্ণবীয় ধারা যাতে ভক্ত এমন কোনো কাজ কখনো না করে বসেন যা স্বয়ং শ্রীবিষ্ণুর অপছন্দের - সেটা funny?! মনে হচ্ছিল বলি যে তোমার মেয়ের টিশার্টে যে বড় বড় করে DKNY লেখা আছে সেটাই আসলে funny কারণ তুমি অতি বড় মূর্খের মতন নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে দেশের পাড়ায় পাড়ায় একটি বিজাতীয় ব্র্যান্ডের ফোকটে advertisement করে বেড়াচ্ছ, অতি কষ্টে নিজেকে সামলালাম। 

আমি অবাক হয়ে এই মা-মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবছিলাম যে বাঙালি হিন্দুর ধার্মিক ও সামাজিক এই যে মারাত্মক অধঃপতন, এটা আসলে আর ঠিক কতটা নীচে গিয়ে থামবে বা কোনোদিন আদৌ থামবে কিনা? শিশুটির তো কোনো দোষ নেই কারণ সে তার বাপ-মায়ের কাছ থেকেই নিজের জন্মভূমির আধ্যাত্মিক পরম্পরাকে ছোট করতে শিখছে। হয়তো শিশুটির মায়েরও দোষ নেই - সেও হয়তো তার থার্ডক্লাস কম্যুনিস্ট বাপ-মা আর স্কুলের ট্যাঁস দিদিমণি বা বেঁড়েপাকা স্যারদের কাছ থেকে এই কুশিক্ষা পেয়েছে। এর শেষ কোথায়?

Thursday, May 18, 2023

হিন্দুস্তানে হিন্দুদের এই দশা কেন?

রাজস্থানে পাকিস্তান থেকে প্রাণ হাতে করে পালিয়ে আসা যে শরণার্থী হিন্দুদের একজন মহিলা IAS অফিসার ওখানকার সরকারের আদেশে তাড়িয়ে আবার পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে উদ্যোগী হয়েছেন তার জন্য একমাত্র বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারই দায়ী। 

কংগ্রেস, তৃণা দ্রাবী বা অশোক গেহলতকে গালি দেওয়ার আগে গৃহমন্ত্রী অমিত শাহকে জিজ্ঞেস করুন তো আইন পাস হওয়ার এত বছর পরেও কেন এখনো CAAর রুলস তৈরি করে আইনটিকে বলবৎ করা হলো না? আর সেই সাথে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক  সংঘের কর্তাব্যক্তিদেরকেও জিজ্ঞেস করুন তাঁদের কাছে priority কি - হিন্দুরা না বিজেপি? যাঁদের শাখায় শাখায় একমাত্র দেশভক্ত হিন্দু তৈরি করার কথা তাঁরা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা উপভোগ করার জন্য এখন বিজেপির জন্য ক্যাডার তৈরি করছেন - হায় রে! 

অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে বিজেপি এবং সঙ্ঘ দুটি সংগঠনই এখন নিজেদের অতীতের হিন্দুcentric approachকে showcase করে বাঁচতে চাইছে। এই পাকিস্তানের অত্যাচারিত হিন্দু ভাইবোনদের জন্য এত দুঃখ হচ্ছে যে কি বলবো। আর সেই সাথে নিজেদের অক্ষমতার ওপর ঘেন্নাও হচ্ছে কারণ আইনি পদক্ষেপ করে যে এই চরম অধর্ম আটকাবো তারও উপায় নেই কারণ বাবুরা খাঁড়ির দেশগুলোর ভয়ে যেমন নূপুর শর্মা বা টি রাজা সিংকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন, ঠিক তেমনভাবেই এই বেচারা অসহায় হিন্দুদের ভবিষ্যৎকেও জলাঞ্জলি দিয়েছেন। 

একদিকে একতরফ গাদা গাদা বাচ্চা পয়দা করে যাচ্ছে আর অন্যতরফ প্রাণরক্ষার্থে আশ্রয় চাইলেও, তাদের মেরে ভাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে - এই নাকি হিন্দুস্তান! হিন্দুদের দেশে রোহিঙ্গারা বহাল তবিয়তে থাকতে পারে কিন্তু হিন্দুরা বেওয়ারিশ মাল! 

একটা কথা আজ স্পষ্টভাবেই বলে দেওয়া দরকার - যেদিন বিজেপির একটা viable alternative তৈরি হয়ে যাবে সেদিন যে কি হাঁড়ির হাল হবে তা বাবুরা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। এক দেশ এক দেওয়ানী বিধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন, পন্থান্তকরণ বিরোধী আইন (পূর্বপুরুষের পন্থে ফিরে যাওয়া ব্যতিরেকে), মন্দিরকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার আইন, CAA, NRC ইত্যাদি কত কিছু যে কার্পেটের তলায় চলে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এঁরা জাগলে ভালো, দেশেরও ভালো, নইলে সবারই ভবিষ্যৎ অন্ধকার। 

বড় বেদনা হয় যখন দেখি যে নাওয়া খাওয়া ভুলে দৌড়ে দৌড়ে চতুর্দিকে CAA নিয়ে সদর্থক জনমত গড়ে তোলার অনেকের অনেক প্রয়াসই বুঝি এঁদের 'দূরদর্শী' রাজনীতির জন্য নিষ্ফল হতে চলেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো বিজেপির ভেতরে আজও যাঁরা সত্যিকারের হিন্দুহিতৈষী বলে পরিচিত তাঁদের কারোরই কিন্তু সঙ্ঘের tag নেই, তা সে যোগী আদিত্যনাথই হন বা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, রাজা সিংই হন বা কপিল মিশ্র বা ডঃ নরোত্তম মিশ্র। কারণটা কি?

Monday, May 15, 2023

রাজনীতি নৈব নৈব চ

If you are emotionally attached to your tribe, religion, or political leaning to the point that truth and justice become secondary considerations, your education and exposure are useless. If you cannot reason beyond petty sentiments, you are a liability.
- Chuba Okadigbo

১.
খবরে পড়লাম কর্ণাটকে যে দল জিতেছে তারা নাকি পৈশাচিক আনন্দে বিপক্ষদলের এক কর্মীকে তাঁর বাড়ির সামনেই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। এর আরো মারাত্মক রূপ তো এই পশ্চিমবঙ্গেই আমরা একাধিকবার দেখেছি, ভোটের নাম শুনলেই এখন বড্ড ভয় হয় নাজানি কতগুলি তাজা প্রাণ আবার বেঘোরে চলে যাবে! সর্বত্রই দেখতে পাচ্ছি এই জঘন্য সর্বগ্রাসী রাজনীতি যেন গোটা সমাজের গলায় শেকল পরিয়ে পৈশাচিক হাসি হাসতে হাসতে নরকের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। 

যাকেই জিজ্ঞেস করবেন সেই যেন হয় এ-দলের নয় ও-দলের দাদন পাওয়া bonded labour, অথবা এই গোষ্ঠীর বা ওই গোষ্ঠীর ক্রীতদাস, প্রায় কেউই দল বা গোষ্ঠীর ওপরে উঠে কেবলমাত্র দেশের প্রতি সমর্পিতপ্রাণ নন! সনাতন ভারতের উত্থান কিন্তু রাজনীতির হাত ধরে হয়নি - দৈনন্দিন জীবনকে ধর্মপথে চালিত করে আমরা এক মহান সভ্যতা হিসেবে উঠে এসেছিলাম। ধর্ম সারা বিশ্বে ভারতেরই দান, পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় ধর্মের কোনো প্রতিশব্দ নেই।  

এখন আবার যদি বিশ্বমানচিত্রে ভারতকে নিজের পুরানো জায়গা ফিরে পেতে হয় তাহলে প্রথমেই সমাজকে প্রাত্যহিক জীবন থেকে এই অধার্মিক নিচ রাজনীতিকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। সমাজসেবার হাতিয়ার, জনকল্যাণের অস্ত্র ইত্যাদি মিথ্যে কথাগুলোয় বিশ্বাস না করে প্রথমেই স্বীকার করে নিন যে রাজনীতি এখন শুধুমাত্র একটা remunarative পেশা, এবং অত্যন্ত সিরিয়াস cut throat একটা পেশা, ফলে আর পাঁচটা পেশার মতোই এখানেও সিরিয়াস পেশাদাররাই সমাদৃত হন। 

আরে আপনার পাড়া প্রতিবেশী, আপনার আত্মীয় স্বজন, আপনার বন্ধু বান্ধবরা কি পেশাদার রাজনীতিবিদ নাকি আপনার আপনজন, আপনার নিজের সমাজ? আর আপনি নিজে কি পেশাদার রাজনীতিবিদ যে অজানা অচেনা কিছু চরম স্বার্থপর চরম আগ্রাসী চরম পরিহার্য প্রাণীর স্বার্থসিদ্ধির জন্য আপনজনদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক মারকাট করে মরবেন? নিজের মেয়ের বিয়েতে ভিন্নমতধারী প্রতিবেশীকে বাদ দিয়ে অন্য এলাকার দলের লোকেদের ডাকছেন - আপনি কি পাগল? যেদিন মাঝরাতে বুকে ব্যাথা উঠবে সেই মুহূর্তে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কি প্রতিবেশীকে পাশে পাবেন না দলকে? 

যদি জীবনে শান্তি পেতে চান প্রথমেই এই অধার্মিক পাকচক্র থেকে ছিটকে বেরোন আর যাঁর যে ধর্মাধিকারীদের ভালো লাগে তাঁদের কাছে গিয়ে ধর্ম আধারিত জীবনের পথনির্দেশ নিন অথবা আমাদের প্রাচীন দর্শন পড়ুন। জীবনে ধর্ম অর্থাৎ মর্য্যাদাজ্ঞান ও কর্তব্যবোধকে খুঁটি করে একজন যথার্থ সামাজিক প্রাণী হিসেবে নিজের দেশ, জাতি কুল এবং মানের খেয়াল রাখুন - দেখবেন আপনি ধর্মকে রক্ষা করলে ধর্মই আপনাকে রক্ষা করবে। 

সমাজের প্রতি যদি সত্যি সত্যিই আপনার মধ্যে নিরহংকার সেবাভাব জন্মায় তাহলে ঈশ্বর ঠিকই তা অভিব্যক্তির রাস্তা প্রশস্ত করে দেবেন, আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। তবে এই করতে গিয়ে যদি ভুলক্রমেও রাজনীতির খপ্পরে পড়েন, হয় exploited হবেন, নয় heart burn হবে, নয় ব্যক্তিস্বার্থসর্বস্ব ক্ষমতালোভীদের ক্রীতদাস হয়ে থাকবেন এবং ধীরে ধীরে তাদেরই মতো হয়ে যাবেন, যার কোনোটাই বোধহয় কাম্য নয়। রাজনেতাদের নিজেদের মধ্যে কিন্তু ব্যক্তিগত শিষ্ঠাচারের অভাব নেই, কেবল পা-চাটাদের মধ্যেই যত বিভেদ। ভেবে দেখবেন।

২.
গতকাল আমি লিখেছিলাম যে নিজের মাথাটা উঁচু রাখুন, পেশাদার রাজনীতিবিদ না হলে খামোখা কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে মাথাটা বিকিয়ে দেবেন না। তারপর থেকে ইনবক্সে এত ম্যাসেজ এসেছে যে বলার কথা নয়। তাই মনে হলো individually সবাইকে উত্তর দিয়ে সময় নষ্ট না করে এখানেই আবার একবার লিখে দিই। আমি নিজে ভুল করেছিলাম, ঠেকে শিখেছি, তাই আপনাদের ওই রাস্তায় হাঁটতে বারণ করছি। 

আমি কিন্তু একবারও বলিনি যে নিজেদের রাজনৈতিক সচেতনতা বিসর্জন দিন অথবা দেশের ব্যাপারে চোখ কান বন্ধ করে রাখুন। দেশ হলেন মা, মাকে পরম শ্রদ্ধায় এমন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে থাকুন যাতে তিনি সবসময় ভালো থাকেন, শান্তিতে থাকেন, আরামে থাকেন, আনন্দে থাকেন। দেশের বিরুদ্ধাচরণ দেখলে অবশ্যই গর্জে উঠুন, সারা সমাজকে একাট্টা করে প্রতিরোধ করুন। 

সমাজ মানে আপনজন, তাতে বিভিন্ন মতাবলম্বী থাকতেই পারেন - আপনার বাড়িতে কি মতভেদ নেই? সবার সাথে সবার কি সবসময় মতের মিল হয়? আমি খালি এটুকুই বলছি যে সমাজের সাথে ওঠাবসার ক্ষেত্রে নিজের বুদ্ধি, নিজের বিবেক আর নিজের ধর্মবোধকে ব্যবহার করুন, কোনো দলের চশমা পরে সমাজকে দয়া করে দেখবেন না, নিজেকে দলদাস করে ফেলবেন না। 

এর মানে এও নয় যে আপনার বিশেষ কোনো মত বা নেতার প্রতি preference থাকবে না, থাকতেই পারে। কিন্তু তাই বলে কোনো অবস্থাতেই নিজের independent thinking কে compromised হতে দেওয়া চলবে না - যদি মনে হয় পছন্দের দল বা নেতা ভুল করছেন, খোলাখুলি criticise করুন। তাঁরা আপনার ভোটটা নেবেন কিন্তু critisism নেবেন না, এ হয় নাকি? সবসময় মনে রাখবেন আপনি একজন আম জনতা, কোনো পেশাদার রাজনীতিবিদ নন, ফলে কোনো দলীয় লাইন মেনে চলার, অন্ধের মতন দলীয় লাইন আওড়িয়ে সাদাকে কালো আর কালোকে সাদা বলার কোনো দায়বদ্ধতা আপনার নেই।

স্বাধীনভাবে বাঁচুন, স্বাধীনভাবে চিন্তা করুন আর সমাজকে নিজের সমাজ হিসেবেই দেখুন, বিভিন্ন fragmented competing entityর সমষ্টি হিসেবে নয়। আর একটা কথা। নিজের উত্তরাধিকার, তা সে পরিবার হোক, কুল হোক, পন্থ হোক, ধর্মবোধ হোক, সমাজচেতনা হোক, সভ্যতা হোক বা অন্য কোনো ঐতিহ্য, জানবেন সেটা একমাত্র আপনারই বাপের সম্পত্তি, অন্য কারো নয়। কোনো দল বা নেতা যদি সেই উত্তরাধিকারের একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেকে project করেন, জানবেন কেবলমাত্র ভোট পাওয়ার জন্য ঢং করছেন। আপনার নিজের বিশ্বাস নিজের অন্তরেই সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত, তার জন্য কোনো দরোয়ানের দরকারই নেই। 

শাসক সবরকমভাবে নিরপেক্ষ হবে, উন্নয়নের facilitator হবে, অর্থনীতিকে strong footing-এ রাখবে, আইনের শাসন বলবৎ রাখবে, দেশকে সামরিকভাবে সুরক্ষিত রাখবে, বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি বাড়াবে, নতুন নতুন innovation আর entrepreneurship-কে encourage করবে, কৃষিকে বিষমুক্ত করবে এবং খাদ্যসুরক্ষা ensure করবে, স্বাস্থ্য শিক্ষা বাসস্থান ইত্যাদি basic needs পূরণ করবে - ব্যাস এটুকুই তার utility, তার বেশি কিছু নয় আর তার জন্য সে আপনার করের টাকায় মাইনে ও বিস্তর perks পায়। বাকি যা করার সমাজ করবে, আপনি আমি করবো। তাই সমাজকে জুড়ে রাখুন, নিজেদের জীবন থেকে দৈনন্দিন রাজনৈতিক কচকচানিকে একেবারেই বাদ দিয়ে দিন, দেখবেন ধর্মপথে চলতে শেখার সময়ও পাবেন, জীবনে শান্তিও পাবেন।

Saturday, May 13, 2023

মাতৃদিবস

মানুষে মানুষে মতভেদ থাকতে পারে, মানুষের নিজস্ব বোধ-বুদ্ধিপ্রসূত নানান বিকল্পের মধ্যেও দ্বন্ধ থাকতে পারে কিন্তু অন্তরাত্মার সাথে কেবল একটা মায়ার পর্দার আড়াল ছাড়া আর কিছুই থাকে না। মা সেই পর্দার ঠিক পেছনেই সদাসর্বদা বিরাজ করেন। যতক্ষণ তিনি মানবী ততক্ষণ একরকম আর যখন তিনি দেবী তখন অন্যরকম। গর্ভধারিণী মা যেমন তাঁর নিঃস্বার্থ আপত্যস্নেহের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধের জন্ম দেন ঠিক তেমন করেই জগ্গজননী মহামায়া স্বয়ং শ্রীশ্রীমায়ের মানবীয় রূপ ধারণ করে ধ্যানে হৃদয়াসনে বিরাজমানা হয়ে তাঁর অহেতুকি কৃপার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে সুপ্ত ঈশ্বরত্ববোধের জন্ম দেন। আমরা জন্মদাত্রীর হাত ধরে জাগতকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে শিখে প্রথমে মানুষ হৈ আর তারপর মানুষ থেকে দৈবত্বে উত্তীরণের আধ্যাত্মিক যাত্রাপথে ইষ্টরূপী স্বয়ং জগজ্জননীর বিশেষ কৃপাদৃষ্টিকে অবলম্বন করে অগ্রসর হৈ। ঈশ্বরী বারেবারে মানুষের রূপ ধরেন যাতে তাঁকে দেখে মানুষও ঈশ্বর হয়ে উঠতে পারে, এর চেয়ে বড় দৈবকৃপা আর কিই বা হতে পারে? মা শব্দটি ছোট কিন্তু এত শক্তিশালী মহামন্ত্র বুঝি আর কিছুই নেই। ওঁকার আর মা এক। মা-ই ওঁ, ওঁ-ই মা। 
মাতৃদেব ওম তৎ সৎ। 
জননীং সারদাং দেবীং রামকৃষ্ণং জগদগুরুম।
পাদপদ্মে তয়ো শ্রিত্বা প্রণমামি মুহুমুহুঃ।।

Friday, May 12, 2023

দর্শন

ইংরিজি ফিলোসফি (philosophy) শব্দটি এসেছে গ্রিক ফিলোসোফিয়া থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ 'জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা'। কার বদান্যতায় যে ফিলোসফির তর্জামা 'দর্শন' হয়েছে জানিনা কারণ দর্শন এক গভীর বোধের বিষয়, যা বাহ্যিকতাশুন্য এবং যার সাথে প্রত্যক্ষ উপলব্ধির অঙ্গাঙ্গিযোগ নিছক জ্ঞান পিপাসার চেয়ে ঢের ঢের বেশি অর্থবহ। দর্শন মানে যা দৃশ্যমান, তাকে আসলেই in form and substance দেখা। আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের একাধিক স্তর আছে যার মধ্যে কিছু স্থূল, কিছু সূক্ষ্ম এবং কিছু অতি সূক্ষ্ম। যা বাইরে দৃশ্যমান তা স্থূল চোখ দিয়েই দেখা যায়, যাঁদের দৃষ্টিশক্তি আছে তাঁরা সবাই দেখতে পান। আবার এঁদেরই মধ্যে যাঁদের কিঞ্চিৎ সূক্ষ্ম দৃষ্টি আছে তাঁরা ওই দৃশ্যটিরই বিশেষত্ব দেখতে পান যেমন নামকরা কোনো ফটোগ্রাফার একই দৃশ্যের অনবদ্য সব ফ্রেম ক্যামেরায় ধরেন, যা সাধারণ মানুষের চোখে কিন্তু ধরা পড়ে না। আর বোধের নানা স্তর পেরিয়ে আছে অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি, যার মাধ্যমে গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধি সাক্ষাৎ দৃশ্যমান হয়ে দার্শনিকের মনের চোখে ধরা পড়ে - তাকেই প্রাচীন ভারতীয় পরম্পরায় দর্শন বলে। মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের অন্তর্দৃষ্টিতে বেদমন্ত্র দৃশ্যমান হয়েছিল, ওটা দীর্ঘ সাধনার দ্বারা অতিসূক্ষ্ম স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় হলে তবেই সম্ভব হয়। ফলতঃ দর্শন আর ফিলোসফি কখনোই এক নয়, ঠিক যেমন ধারণা আর সত্য এক নয়। একটা শাস্ত্রীয় বইয়ের ইংরিজি অনুবাদে বারবার দর্শনকে ফিলোসফি বলা হচ্ছে দেখে আর থাকতে না পেরে এতগুলো কথা বলতে বাধ্য হলাম। বেশ কিছু সংস্কৃত শব্দ আছে যা অনুবাদ অনুপযুক্ত যেমন ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি। এই শব্দগুলিকে বুঝতে গেলে এগুলি যে প্রাচীন দার্শনিক এবং সামাজিক পরম্পরার ফসল, সেই পরম্পরাকে আগে বুঝতে হবে। দুম করে একটা ইংরিজি শব্দ ধরলুম আর ধর্মকে religion আর বর্ণকে caste এর প্রতিশব্দ বলে দেগে দিলুম - হয় নাকি? এ যেন কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন!

Saturday, May 6, 2023

চার্লস ৩য়র রাজ্যাভিষেক

আজ রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেক দেখলাম। Pomp and pageantry দেখতে আমার বেশ লাগে। গোটা অনুষ্ঠানটিই ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ দ্বারা পরিচালিত এবং গোটাটাই আগাগোড়া প্রটেস্টান্ট পন্থের রীতিনীতি মেনেই হলো। মুখে অল ফেইথ বারবার বলা হলেও ওঁদের ভূমিকা ওই টুকিটাকি রাজকীয় emblem এগিয়ে দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ। এমনকি রাজার শপথবাক্যে দেখলাম রাজাকে দিয়ে ঘোষণা করানো হলো যে উনি নিজে একজন প্রটেস্টান্ট এবং অতঃপর নিজপন্থের রক্ষাকর্তা হিসেবে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন। আচ্ছা, ওরা তো সব শিক্ষিত সভ্য সাহেবশুবো, ওরা নিজেদের মত flaunt করলে আপত্তি নেই, আমাদের মতো অসভ্য কালোদের দেশের অশিক্ষিত প্রধানমন্ত্রী মাথায় চন্দন মেখে বাবা বিশ্বনাথের অভিষেক করলেই দুনিয়ার secularism খতত্রে মে আ যাতা হ্যায় - তাই না? যাক যে,  যা হলো সেটা ওদের সভ্য দেশের ব্যাপার, আমাদের ওসবে কিছু যায় আসে না। কেবল দুটো জিনিস কিন্তু বড্ড গায়ে লাগলো। চার্লসসাহেবকে ব্রিটেনের রাজার শাসনে থাকা নানান দেশ ও উপনিবেশকাল থেকে দখলে রাখা ভূমিখণ্ডের সাথে কমনওয়েলথের কর্তা হিসেবেও ভূষিত করা হলো এবং রাজমুকুট পরে যখন উনি প্রাসাদে ফেরত যাচ্ছিলেন তখন কমনওয়েলথের অন্যান্য দেশের সাথে দেখলাম ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারতের জাতীয় পতাকাও আগে আগে বহন করে নিয়ে চলেছেন - তাও আবার নত। আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে এই কমনওয়েলথ নামক ঔপনিবেশিক ভণ্ডামিটি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার, বস্তুত অনেক আগেই এই শুভকাজটি সেরে ফেলা উচিত ছিল। চার্লস বা তাঁর চোদ্দগুষ্টির কেউ কোনোদিন আমাদের রাজা বা রানী ছিলেন না, এখনো নন, ভবিষ্যতেও হবেন না। ওঁরা plain and simple গায়ের জোরে দখলদার ছিলেন, আমাদের অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা, সত্যাগ্রহীরা, আই এন এর সৈনিকরা এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র দ্বারা উদ্বুদ্ধ বিদ্রোহী ভারতীয় নৌসেনা এদের মেরে তাড়িয়ে ছেড়েছিলেন। আমি তো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস ইত্যাদি নামেরও ঘোর বিরোধী - ধরো আর ডাস্টবিনে ফেলো। আমার দেশের জিনিস দিয়ে আমারই দেশজ ভাইদের হাতে তৈরি পুরাকীর্তি একজন আক্রান্তার নষ্টামিকে কেন celebrate করবে? VTকে তো মুম্বাইকারেরা ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ টার্মিনাস করে দিয়েছেন, আমরা কলকাতাবাসী এখনো সেই colonial hangover নিয়েই বসে আছি, ওই কমনওয়েলথের মতন!

Thursday, May 4, 2023

আত্মবিস্মৃতি



পথের পাঁচালির সেই শেষের দিকের দৃশ্যটা কি কারো মনে পড়ে? হরিহর সর্বজয়া আর অপুকে নিয়ে একটা গরুর গাড়ি করে নিশ্চিন্দিপুরের বাপ ঠাকুরদার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন চিরকালের জন্য, আর তাঁদের সেই ফাঁকা ভিটায় ধীরে ধীরে একটা সাপ ঢুকছে, মনে পড়ে? 

রোজগারের তাগিদে বাঙালির গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা বইটি প্রকাশের সময়, অর্থাৎ ১৯২৯ সালে যেমন সত্যি ছিল, চলচিত্র আকারে আবির্ভূত হওয়ার সময়, অর্থাৎ ১৯৫৫ সালেও ঠিক তেমনই সত্যি ছিল আর আজ, ২০২৩ সালেও অবিকল তেমনই সত্যি আছে। 

যে সব শহুরে বাবুদের এখনো পারিবারিক কৃষি জমি আছে এবং পূর্ব সংস্কারের কারণে নিজেদের জীবদ্দশায় মন শক্ত করে বেচতে পারছেন না, তাঁরা অন্তত একটুকু নিশ্চিত করেছেন যে তাঁদের ছেলেমেয়েরা কৃষিকে যেন অশ্রদ্ধা করতে শেখে এবং মা বসুন্ধরাকে কেবল commercial investment বলেই মানে। এই প্রজন্মটি যেদিন চোখ বুজবেন সেইদিনই ওই জমি বিক্রি হয়ে যাবে। 

মজার ব্যাপার হলো বর্তমান প্রজন্ম বুঝবেও না কি মহান উত্তরাধিকার তারা হেলায় হারালো, কারণ ছোটবেলা থেকেই তো তাদের brainwash করা হয়েছে যে কৃষক হওয়া কোনো career optionই নয়। ভেবে দেখবেন বাঙালি রিক্সাচালকরা অধিকাংশই গ্রামহীন জমিহীন বস্তিবাসী অথচ বিহারী রিক্সাচালকদের কিন্তু গাঁওদেহাত থাকে, সেখানে তাঁদের পরিবার থাকে, ক্ষেতখামারও থাকে। 

ছোট পারিবারিক ব্যবসার ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা খাটে। কতজন বাঙালি চান যে তাঁর রক্ত জল করে তিল তিল করে গড়ে তোলা ছোট্ট ব্যবসাটি, যা চিরকাল তাঁর সংসারকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে, সেটিকে তাঁর সন্তান চালাক? আমার সন্তান ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার চার্টার্ড একাউন্টেন্ট উকিল ইত্যাদি হবে - আমার মতন self-employed হবে কোন দুঃখে? আরে ছোঃ! 

সন্তান অন্যের glorified গোলাম হোক বহুত আচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই নিজের ছোট enterprise-এর মালিক যেন না হয় - হায় রে বাঙালি! এই যে কৃষিকে অবহেলা করতে শেখানো, নিজ উদ্যোগকে অবহেলার চোখে দেখতে শেখানো, মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে জীবনের মূল্যকে কেবলমাত্র টাকার বাটখারায় ওজন করতে শেখানো - colonial slave mindset-এর শিকার বাঙালি বাপ মায়েরা যে কি মারাত্মক virus সমাজের বুকে inject করেছেন, তাঁদের কোনো ধারণাই নেই। 

এবং এটি যে কেবল আজকের বাবা মায়ের generation করছেন তা নয়, গত একশ-সোয়াশ বছর ধরেই misplaced হীনমন্যতার শিকার বাঙালিরা ক্রমাগত এই কান্ডটি ঘটিয়ে চলেছেন। সুযোগ পেলে যে কোনো হরিয়ানার জাট IAS অফিসারকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করে দেখবেন, তাঁরা বলবেন তাঁদের আটা আর ডাল গ্রামের ক্ষেত থেকে আসে, কোনো তাউ বা চাচা সেই পারিবারিক ক্ষেতিবাড়ি সামলান। 

একই ব্যাপার কোনো ইউপি বা পাঞ্জাব বা বিহার অথবা উড়িষ্যার সরকারি এবং বেসরকারি উচ্চআধিকারিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদি এঁদের মধ্যে কারো গ্রামে পারিবারিক মুদিখানা থাকে বা কাঠকল বা রাইসমিল, কোনোদিন শুনবেন না সে সব তাঁরা লাটে উঠিয়ে দিয়েছেন। যত সমস্যা আমাদের আর তামিল ব্রাহ্মণদের - এঁরা যেন যতক্ষণ না মাটির সাথে নাড়ির বাঁধনটা কাটতে পারছেন, ততক্ষণ স্বস্তি পান না! 

ইদানিং, অত্যধিক রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে পিতৃপুরুষের অন্নদাত্রী কৃষিজমিকে বন্ধ্যা করে দিয়ে কিছু পাঞ্জাবি পরিবারও সব বেচেবুচে দিয়ে টরন্টো বা ব্রিসবেনের প্লেনে উঠে পড়ছেন, এঁদেরও বাঙালির ছোঁয়াচে রোগ লেগেছে। আগেও পাঞ্জাবিরা বিদেশ যেতেন পয়সা রোজগার করতে, কিন্তু সেটা পরিবার পিছু এক আধ জন। 

এখন তো সেই একশ বছর আগের হরিহরের মতন এঁরাও কৃষিসংস্কৃতি ভুলে, নিজেদের স্বনির্ভরতার মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে, সমূলে উৎপাটিত হয়ে, হিথ্রো বিমানবন্দরে ঝাড়ু দেওয়া বা নিউইয়র্কে অন্যের ট্যাক্সি চালানোকে বেশি সন্মানজনক বলে মনে করছেন। কেন সারা দেশের মধ্যে খালি বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগ হয়েছিল, তার কারণ আমি আমাদের দুজাতের মানসিকতার মধ্যেই খুঁজে পাই। 

আমরা দুই জাতই আমাদের নিজস্বতাকে জলাঞ্জলি দিতে একটুও দ্বিধাবোধ করি না, ফলে নিজেদের ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট মাত্রায় sense of pride নেই, যা অন্যান্য ভারতীয়দের আছে। তামিল ব্রাহ্মণ সন্তান সংস্কৃত মন্ত্র জানে না, এ হতেই পারে না, ফলে আমাদের মতোই চাকরিপ্রিয় হওয়া স্বত্তেও ওঁদের ভিতটা টলে যায়নি, আত্মসন্মানবোধটুকু অক্ষুন্ন আছে।

আমরা আসলে সব খুইয়েছি। যখন কোনো পাঞ্জাবিকে গুরবাণী ভুলে আকন্ঠ পান করতে দেখি বা বাঙালিকে ঘর্মাক্তকলেবরে বাসে পাদুটো জায়গামত না রাখতে পারে ঝগড়া করতে দেখি, এঁদের দুজনের মধ্যে কোনো পার্থক্য আমার নজরে আসে না। দুটোই এক। দুটোই আত্মবিস্মৃতির বিভিন্ন পর্যায়।