যেমন আজকালকার ইংরিজি মাধ্যমে পড়া বাপ-মা, তেমনই তাঁদের কনভেন্টে পড়া ছেলেপিলে - দুটো প্রজন্মই সমান অকাট! পাড়ায় একজন গৌড়ীয় বৈষ্ণব মাঝেমাঝেই আসেন, খোল বাজিয়ে হরিনাম করে ভিক্ষা চান। আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনেই দুটি বহুতল আবাসন রয়েছে, ১০০% হিন্দুদের বাস, কিন্তু দারোয়ানরা অচেনা গাজনের সন্ন্যাসীদের সাথে সাম্যের খাতিরে এই খুব চেনা বৈষ্ণবকেও ঢুকতে দেন না, ফলে তিনি আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই প্রাণপনে চিৎকার করে ওখানকার বাসিন্দাদের হরিনাম শোনাতে চেষ্টা করেন - তাতে ভিক্ষার দিক দিয়ে যে খুব একটা লাভ হয় তা নয়। আমি বারান্দা থেকে দেখি আর হাসি।
তাঁকে পাশ কাটিয়ে সব স্বচ্ছল বাবুবিবিরা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকছেন বেরোচ্ছেন কিন্তু যিনি বাড়ি বয়ে এসে ভগবানের নাম শোনাচ্ছেন তাঁর হাতে দশটা টাকা আর ঝোলায় একমুঠো চাল ও দুটো আলু দিলে তাঁদের মঠটা যে বেঁচে যাবে, শ্রীহরির কৃপায় হিন্দুদের সেবা করার আর সেবা পাওয়ার যে একটা গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় পরম্পরা আছে, শ্রীহরির নামে সমস্ত জাতপাতের ব্যবধান ভেঙে পংক্তিভোজনের বাংলার যে এক অনবদ্য ঐতিহ্য আছে - সেটা perpetuated হবে, এই বোধটাই নেই।
যাইহোক, আজও তিনি এসেছিলেন, খোল বাজিয়ে হরিনাম শোনাচ্ছিলেন, যথারীতি কপালে গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় তিলক। প্রতিবারের মতোই আমি নিচে নেমে গিয়ে গেট খুলে সাংসারিক জীব হিসেবে যখন আমার সামাজিক কর্তব্য পালন করছি তখন দেখি এযাবৎ অদেখা এক আধুনিকা মা তাঁর কন্যার হাত ধরে বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে মেয়ের সাথে ইংরেজিতে মস্করা করছেন, "this mark on his face looks so funny na?". শ্বেতচন্দনতিলক funny?!
কপালে শ্রীবিষ্ণুর পদ ও পদ্মের প্রতীক দুটি লম্বরেখা এবং নাকের উপর তুলসীর ছাপ - প্রভুকে নিজের শরীর-মনে ধারণ করার বৈষ্ণবীয় ধারা যাতে ভক্ত এমন কোনো কাজ কখনো না করে বসেন যা স্বয়ং শ্রীবিষ্ণুর অপছন্দের - সেটা funny?! মনে হচ্ছিল বলি যে তোমার মেয়ের টিশার্টে যে বড় বড় করে DKNY লেখা আছে সেটাই আসলে funny কারণ তুমি অতি বড় মূর্খের মতন নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে দেশের পাড়ায় পাড়ায় একটি বিজাতীয় ব্র্যান্ডের ফোকটে advertisement করে বেড়াচ্ছ, অতি কষ্টে নিজেকে সামলালাম।
আমি অবাক হয়ে এই মা-মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবছিলাম যে বাঙালি হিন্দুর ধার্মিক ও সামাজিক এই যে মারাত্মক অধঃপতন, এটা আসলে আর ঠিক কতটা নীচে গিয়ে থামবে বা কোনোদিন আদৌ থামবে কিনা? শিশুটির তো কোনো দোষ নেই কারণ সে তার বাপ-মায়ের কাছ থেকেই নিজের জন্মভূমির আধ্যাত্মিক পরম্পরাকে ছোট করতে শিখছে। হয়তো শিশুটির মায়েরও দোষ নেই - সেও হয়তো তার থার্ডক্লাস কম্যুনিস্ট বাপ-মা আর স্কুলের ট্যাঁস দিদিমণি বা বেঁড়েপাকা স্যারদের কাছ থেকে এই কুশিক্ষা পেয়েছে। এর শেষ কোথায়?
No comments:
Post a Comment