Monday, May 22, 2023

মা না ইষ্ট?

শ্রীশ্রীমায়ের যে ইষ্টমূর্তি, অর্থাৎ ঘরে ঘরে যে রূপে মা নিত্যপূজিতা হন, তাতে মায়ের চোখদুটিতে একটা অদ্ভুত far away look আছে। যেন শরীরে আছেন কিন্তু নেই, যেন তাকিয়ে আছেন কিন্তু দেখছেন না। লক্ষ্য করে দেখলে দেখা যাবে মায়ের ডান আঁখিটি পুরোপুরি খোলা আর বাম আঁখিটির পাতা সামান্য নিমিলিত, যেন নিজের শরীরের ওপর তাঁর সম্পুর্ন নিয়ন্ত্রণ নেই - নিবেদিতা যেমনটি সাজিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন তেমনটিই বসে রয়েছেন। আর মায়ের মুখমন্ডলটিও ঈষদ ডানদিকে ঘোরানো, সামনের দিকে সোজা তাকিয়ে নেই। 

এই ছবির ইতিহাস অবশ্য আমরা অনেকেই পড়েছি, সাহেব ফটোগ্রাফারের সামনে অস্বচ্ছন্দ্য আমাদের লজ্জাশীলা মা ক্যামেরার দিকে তাকাতে ইতস্তত বোধ করেছিলেন ইত্যাদি, কিন্তু মায়ের দৃষ্টি দেখলে আমার তো মনে হয় না যে বিষয়টি কেবল ওটুকুই। আমার মনে হয় এক আসনে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসেই মায়ের মন নিশ্চয় পারিপার্শ্বিক থেকে উঠে গিয়েছিল এবং ওঁর চোখের দৃষ্টিতে যে অন্তর্মুখী ভাব ধরা পড়েছে এবং গ্রীবার ভঙ্গিতে যে নির্লিপ্ততার আভাস, সেটা আমাদেরই পথ দেখানোর জন্য জগ্গজননীর না বলা বাণী। এই মূর্তিতে মায়ের শ্রীমুখ, লম্বা চুল, একটি কাঁধ, দুটি বালাপরা হাত, গলায় রুদ্রাক্ষের দুছড়া মালা এবং শ্রীপাদপদ্মের সামান্য অংশ মাত্র দৃশ্যমান, বাকিটা লালপেড়ে শাড়িতে আবৃত। ওটুকুতেই মায়ের যে ঈশ্বরীয় ভাব ফুটে উঠেছে, তা সারা জীবন ধরে দেখলেও ফুরায় না যে।

আমাদের পরম সৌভাগ্য যে এটি ছাড়াও মায়ের অজস্র ছবি আছে যেখানে মাকে আমরা বিভিন্ন অন্যান্য pose এ দেখতে পাই - বসা অবস্থায়, দাঁড়ানো অবস্থায়, পূজারিণী রূপে, গরুর গাড়িতে, আত্মীয়দের সাথে, পাড়ার দাওয়ায় ইত্যাদি। Fortunately অন্য ছবিগুলিতে কিন্তু মায়ের এই গম্ভীর তদগত ভাবটি এমন স্পষ্ট করে বোধহয় ধরা পড়ে না, যেমনটি ক্যামেরায় তোলা ওঁর জীবনের এই দ্বিতীয় ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই। মা তো নিজেকে একেবারে লুকিয়ে রাখতেন, কচিৎ কদাচিৎ ফস করে ওঁর ঈশ্বরীরূপ বেরিয়ে পড়তো। ধ্যানলোকে তাঁকে পাওয়ার জন্য মায়েরই কৃপায় ওঁর এই ইষ্টমূর্তিতে সেই অনির্বচনীয় রূপটি যে চিরকালের জন্য ধরা পড়ে গেছে, এ যে কতবড় সৌভাগ্য, তা যারা জানেন তারা জানেন।

মা যখন দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন, তখন তাঁর কোলে মাথা রেখে আদর খাওয়া যায় কিন্তু নিজের যে পট তিনি নিজে কোয়ালপাড়ার পূজাসনে প্রতিষ্ঠা করে পুজো করেছেন, তাঁর সেই বিশেষ পূজ্যা রূপটিকে কেবল হৃদয়ে ধারণ করে জপধ্যান করা যায়, এই রূপে মা ইষ্ট। অনেক limited capacity তে হলেও, ঠাকুরের ক্ষেত্রেও কিন্তু খানিকটা তাইই। শেষেরটি বাদ দিলে ঠাকুরের মাত্র তিনটি ছবি, তিনটিতেই তিনি সমাধিস্থ। তার মধ্যেও শ্রীশ্রীঠাকুরের কামারপুকুরের রূপটি দেখলে আমার কেমন যেন শিহরণ জাগে। অনেক রামকৃষ্ণ মঠ এবং প্রাইভেট মঠেই ঠাকুর মর্মরমূর্তিরূপে আছেন কিন্তু কামারপুকুরে ওঁর যে ভাব - অর্ধনিমিলিত আঁখিদ্বয়, মুখটি ঈষৎ ফাঁক করা, গোটা মুখমণ্ডল জুড়ে এক গভীর প্রশান্তি - সমাধিমগ্ন ঠাকুরের এই অনুপম রূপটিকে হৃদয়ে ধারণ করা যায় কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই ঠেলেঠুলে কৃপা প্রার্থনার জন্য বিরক্ত করা যায় না। আমি বেলুড়মঠে ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে নিরাশক্তি নির্মোহ ইত্যাদি কতকিছু চেয়েছি কিন্তু কামারপুকুরে গেলেই মনে হয় এঁকে বাপু disturb করা যাবে না। 

জয়রামবাটিতে আমি মায়ের গর্ভগৃহে ওঁর বাঁ পাশের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছি - মা যেন ডানদিকে তাকিয়ে আছেন। আবার ডানদিকের জানলা দিয়েও উঁকি মেরে দেখেছি - মা সামনে তাকিয়ে আছেন। তারপর সামনে থেকে দেখেছি, গর্ভমন্দির আর নাটমন্দিরের মাঝের পিলারগুলোর মধ্যে যে তিনটে gap - সবকটা দিয়ে আলাদা আলাদা করে দেখেছি - মা is looking beyond. একমাত্র ভোরবেলায় মঙ্গলারতির পর নিস্তব্ধ মন্দিরে চোখ বন্ধ করে যখন মাকে হৃদয়ে দেখার চেষ্টা করেছি তখন তিনি সরাসরি আমার দিকে তাকিয়েছেন, বাকি আর কখনো নয়। তবে ঠাকুর আর মাকে চোখে দেখার যে সুখ, সেটা ওঁদের ধ্যানমূর্তিতে যতটা, ততটা বুঝি আর কিছুতে নেই। সেখানে শ্রদ্ধা আছে, বিস্ময় আছে, ভক্তি আছে আর বিশ্বাস আছে। ভালোবাসাও আছে, তবে যেন কিঞ্চিৎ লুকিয়ে।

In any case,  ঠাকুরের কাছে ঝোলাঝুলি করার ইচ্ছা বা শক্তি কোনোটাই কোনোদিন আমার হয়নি, মায়ের কথা আলাদা। মা হলেন রক্তমাংসের মানবী, তাঁকে ছোঁয়া যায়, তাঁর কাছে আবদার করা যায়, তাঁর সঙ্গে সুখ দুঃখের গল্প করা যায়, কোথাও যাওয়ার আগে তাঁকে বলে যেতে হয় আর ফিরে এসে report করতে হয়, তাঁকে জড়িয়ে ধরা যায় আবার দুটি পা বুকে ধরে অক্লেশে কৃপা প্রার্থনাও করা যায়। কিন্তু ঠাকুর যেন distant, কেবল ইষ্টরূপে পূজ্য। মায়ের কাছে গেলে সঙ্গে করে আম জাম কাঁঠাল শাড়ি ইত্যাদি নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু ঠাকুরের কাছে গেলে ফুল মালা ধুপ - এই পার্থক্য। মা মাঝে মাঝে ইষ্ট হন আর বেশিভাগ সময় কেবল মাই থাকুন, এটাই আমার পক্ষে সবচেয়ে comfortable স্থিতি। বাকি, গুরুরূপে আর ইষ্টরূপে ঠাকুর তো আছেনই।

আজ সকালে গায়ের চাদরটা সরিয়ে মাকে শয়ন থেকে তোলার সময় যখন প্রতিদিনের মতোই বিনীত ভাবে অনুরোধ করলাম, "মা এবার ওঠো মা", কি যে নরম ক্ষমাঘন দৃষ্টিতে মা তাকালেন, বলতে পারবো না! মায়ের মুখটা দেখে মনে হলো যেন মধুমাখা, চোখদুটি থেকে যেন মধু ঝরে ঝরে পড়ছে। আহা, কি অপূর্ব সুন্দর আমাদের মা! সেই কোন প্রাচীনকালে ঋষিরা প্রার্থনা করেছিলেন,
ওঁ মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মাধ্বীর্নঃ সন্তোষধীঃ।
মধু নক্তম উতোষসো মধুমৎ পার্থিবং রজঃ।
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাং অস্তু সূর্যঃ। ওঁ।
(বায়ু মধু বহন করিতেছে। নদী সিন্ধু সকল মধুক্ষরণ করিতেছে। ওষধি বনস্পতি সকল মধুময় হউক। রাত্রি মধু হউক, ঊষা মধু হউক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হউক। সূর্য মধুমান হউক।)
ঠাকুরঘরের পর্দা সরিয়ে জনলাগুলি হাট করে খুলে দিয়ে বর্ষণসিক্ত ভোরের মিষ্টি আলোয় মাকে দেখে মনে হলো সাক্ষাৎ মধুমতী, মধুক্ষরণকারিণী জগদ্ধাত্রী, জীবন্ত অন্নপূর্ণা। ঋষিরা কি দিব্যচক্ষে মাকে দেখেছিলেন? নিশ্চয় দেখেছিলেন নইলে এই মন্ত্র উচ্চারিত হতো না। আহা! কি স্নিগ্ধ, কি অপরূপ, কি প্রশান্ত এই মাতৃমূর্তি! 


No comments:

Post a Comment