Friday, June 24, 2022

কর্মযোগ

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এমন দুএকটি শ্লোক আছে যেগুলি মোটামুটি সবাই জানেন, এমনকি যাঁরা জীবনেও গীতা পড়েননি, তাঁরাও অন্তত এগুলির একটা লাইন হলেও জানেন। এমনই একটি হলো দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৭নং শ্লোক,
কর্ম্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্ম্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্ম্মণি।।
অর্থাৎ, কর্ম্মেই তোমার অধিকার, কর্ম্মফলে তোমার অধিকার নেই। কর্ম্মফল যেন তোমার কর্ম্মপ্রবৃত্তির হেতু না হয়, কর্ম্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়।

আমরা যারা সংসারী জীব, আমাদের পক্ষে এ কথা মুখে বলা যত সোজা, কাজে করে দেখানো তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি কঠিন। দিনরাত অফিসের জন্য খেটে চলেছি অথচ বছরের শেষে একটা ভালো increment বা promotion আশা করবো না - এ আবার হয় নাকি? পরীক্ষার জন্য খেলাধুলো বন্ধ করে দিনরাত মুখ গুঁজে পড়ে চলেছি অথচ পরীক্ষায় ভালো ফল আশা করতে পারবো না - absurd! বিয়ে করেছি কিন্তু সুখ আশা করা যাবে না, রান্না করছি কিন্তু ভালো স্বাদ আশা করা যাবে না, ফুটবল খেলছি কিন্তু জিত আশা করা যাবে না - তাহলে আর বেগার খাটবো কেন? বাড়িতে বসে দিনরাত হরি হরি করলে যদি অন্ন বস্ত্র বাসস্থান জুটে যেত, তাহলে কেই বা আর খাটতো আর কেই বা ফলের আশা করতো? ফলে শ্রীকৃষ্ণের এই বাণী কেবলমাত্র সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের জন্য, সংসারীদের জন্য নয় - এই interpretation যদি মেনে নিতে হয় তাহলে বুঝতে হবে যে শ্রীকৃষ্ণের common sense বলে কিছু ছিল না কারণ যাঁকে তিনি এই কথাগুলি বলেছিলেন সেই অর্জুন ছিলেন ঘোর সংসারী।

এই শ্লোকের বাস্তব application কিভাবে সম্ভব, তার ব্যাখ্যা পাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নবম অধ্যায়ের ২৭নং ও ২৮নং শ্লোকে। এখানে ভগবান বলছেন,
যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।
যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্।।
শুভাশুভফলৈরেবং মোক্ষসে কর্ম্মবন্ধনৈঃ।
সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি।।
যেহেতু এই শ্লোকগুলির মধ্যে উপায় লুকিয়ে আছে, ফলে এগুলিকে একটু ভালোভাবে word by word বুঝতে হবে।
যৎ করোষি - যা কিছু করো, যৎ অশ্নাসি - যা খাও, যৎ জুহোষি - যে যজ্ঞ করো, যৎ দদাসি - যা দান করো, যৎ তপস্যসি - যে তপস্যা করো, তৎ - সেসব, মৎ অর্পণম্ - আমাতে অর্পণ, কুরুষ্ব - করো। 
শুভ অশুভ ফলৈঃ এবং - এবং শুভ অশুভ সমস্ত ফল, সন্ন্যাস যোগ যুক্ত আত্মা - আমাতে সমর্পণ করে আমার সাথে যুক্ত হলে, কর্ম্মবন্ধনৈঃ - কর্মবন্ধন হতে, মোক্ষসে - মুক্ত হবে, (আর) বিমুক্তঃ - কর্মবন্ধন কেটে গেলে, মাম্ উপৈষ্যসি - আমাকে লাভ করবে।

হিন্দুধর্মের যে কোনো গভীর দর্শন সহজে বোঝার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেব ছাড়া গতি নেই। কথামৃতে ঠাকুর বলছেন,
ব্রাহ্মভক্ত— সংসারত্যাগ কি ভাল?
শ্রীরামকৃষ্ণ— সকলের পক্ষে সংসারত্যাগ নয়। যাদের ভোগান্ত হয় নাই তাদের পক্ষে সংসারত্যাগ নয়। দুআনা মদে কি মাতাল হয়?
ব্রাহ্মভক্ত— তারা তবে সংসার করবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ— হাঁ, তারা নিষ্কামকর্ম করবার চেষ্টা করবে। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙবে। বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কর্ম করে, কিন্তু দেশে মন পড়ে থাকে; এরই নাম নিষ্কামকর্ম। এরই নাম মনে ত্যাগ। তোমরা মনে ত্যাগ করবে। সন্ন্যাসী বাহিরের ত্যাগ আবার মনে ত্যাগ দুইই করবে।

কিন্তু করবো কিভাবে? নিষ্কাম বললেই তো আর নিষ্কাম হয়ে যাওয়া যায় না, তাহলে উপায়টা কি? তারও রাস্তা বাতলে দিচ্ছেন,
“নির্লিপ্ত হয়ে সংসার করা কঠিন। প্রতাপ বলেছিল, মহাশয়, আমাদের জনক রাজার মত। জনক নির্লিপ্ত হয়ে সংসার করেছিলেন, আমরাও তাই করব। আমি বললুম, মনে করলেই কি জনক রাজা হওয়া যায়! জনক রাজা কত তপস্যা করে জ্ঞানলাভ করেছিলেন, হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হয়ে অনেক বৎসর ঘোরতর তপস্যা করে তবে সংসারে ফিরে গিছলেন।

“তবে সংসারীর কি উপায় নাই?— হাঁ অবশ্য আছে। দিন কতক নির্জনে সাধন করতে হয়। তবে ভক্তিলাভ হয়, জ্ঞানলাভ হয়; তারপর গিয়ে সংসার কর, দোষ নাই। যখন নির্জনে সাধন করবে, সংসার থেকে একেবারে তফাতে যাবে। তখন যেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, মাতা, পিতা, ভাই, ভগিনী, আত্মীয়-কুটুম্ব কেহ কাছে না থাকে। নির্জনে সাধনের সময় ভাববে, আমার কেউ নাই; ঈশ্বরই আমার সর্বস্ব। আর কেঁদে কেঁদে তাঁর কাছে জ্ঞান-ভক্তির জন্য প্রার্থনা করবে।

“যদি বল কতদিন সংসার ছেড়ে নির্জনে থাকবো? তা একদিন যদি এইরকম করে থাক, সেও ভাল; তিনদিন থাকলে আরও ভাল; বা বারোদিন, একমাস, তিনমাস, একবৎসর — যে যেমন পারে। জ্ঞান-ভক্তিলাভ করে সংসার করলে আর বেশি ভয় নাই।

“মনটি দুধের মতো। সেই মনকে যদি সংসার-জলে রাখ, তাহলে দুধেজলে মিশে যাবে। তাই দুধকে নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। যখন নির্জনে সাধন করে মনরূপ দুধ থেকে জ্ঞান-ভক্তিরূপ মাখন তোলা হল, তখন সেই মাখন অনায়াসে সংসার-জলে রাখা যায়। সে মাখন কখনও সংসার-জলের সঙ্গে মিশে যাবে না — সংসার-জলের উপর নির্লিপ্ত হয়ে ভাসবে।”

পরম পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী মহারাজ তাঁর বিখ্যাত 'Universal message of the Bhagavad Gita' বইয়ের প্রথম খণ্ডে লিখছেন, The Western mystic and Eastern sage find a strong effect of endorsement in modern science and the everyday teaching of practical morality; both teach that self must be subordinated, that self is a method and not an end. Ego has a 'strategic value in evolution. It is provisional delusion', don't treat it as a final stage. You have to discover it's higher dimensions. That is the work the Upanishads did ages ago.... In the whole cosmos you don't find the ego. In the whole animal kingdom you don't find the ego, only in man you find it. In our ignorance we are basing our work on this provisional delusion of the ego. What a powerful 'I' the ego is in the waking state; and when we go to sleep there is no ego; it dies and later comes to an awareness of itself. Sri Ramkrishna says in one of his beautiful sayings: even the most powerful person, when he or she sleeps, if a child spits on his or her face, there will be no protest.... You can go beyond and penetrate to the root of this ego. That is the infinite Self. That Atman is one with all.... even in families, a man or woman works for whom? For wife, husband or children, for their welfare, not for one's own.... The self that is contained in the organic system is only a 'convenient provisional delusion'. When you set it aside, you begin to expand your concept of self. You feel spiritual oneness with others. So, whatever work I do, the fruits of it are not for me alone; it will go to all. And a state will come, when there will be nothing of 'I' left; everything will be 'we'. We loose ourselves in the Universal.

সবই তো বুঝলাম কিন্তু কাজের চাপ, boss এর তাড়া, office politics সামলে কাজের মধ্যে আবার spiritual oneness আনি কি করে? কাজ মানে তো দায়িত্ব, timeline, goal, reward বা reprimand - এর মধ্যে আবার 'যৎ করোষি মদর্পণম্' হবে কিভাবে? পরম পূজ্যপাদ বড় মহারাজ শ্রীমৎ স্বামী লোকেশ্বরানন্দজী তাঁর এক দারুন মনোগ্রাহী বক্তৃতায় খুব প্রাঞ্জল করে এই বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
"তাঁরা (রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা) ঈশ্বরলাভের জন্য ঘর-সংসার ছেড়েছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ টাইপ করছেন, কেউ স্কুলে পড়াচ্ছেন, কেউ বাগানে কাজ করছেন, কেউ হাসপাতালে ওষুধ দিচ্ছেন, আরও কত সব করছেন। তাহলে সাধারণ গৃহস্থের সঙ্গে তাঁদের তফাৎটা কি হল? তফাৎটা হল এইখানে যে, তাঁরা এইসব কাজ করছেন ঈশ্বরের উদ্দেশে। কাজ করছেন না - তাঁরা ঈশ্বরের আরাধনা করছেন। এই প্রসঙ্গে আমাদের মঠের একটা মজার গল্প বলি।
আমাদেরই একজন সাধু। গত হয়েছেন। খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। এম.এসসি-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। বাবা ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট - বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে আই. সি. এস. হবে কিন্তু ছেলে রামকৃষ্ণ মিশনের সাধু হয়ে গেলেন। বাবা মিশনের বিরুদ্ধে কোর্টে নালিশ করলেন। কিন্তু ছেলে কোর্টে গিয়ে বললেন - আমি সাবালক, আমি স্বেচ্ছায় সাধু হয়েছি। বাবা হেরে গেলেন। খুব অপমানিত বোধ করলেন তিনি। সঙ্গে রিভলভার নিয়ে একদিন মঠে গেছেন - প্রথমে ছেলেকে আসতে বলবেন, যদি না আসে তাহলে গুলি করে মারবেন। ছেলের কাছে গিয়ে দেখেন যে ছেলে বসে বসে কুমড়ো কাটছে। তিনি বলছেন, আমি হাসব না কাঁদব, আমি ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট আর আমার ছেলে, যাকে ভেবেছিলাম আই.সি.এস হবে সে কিনা এখানে এসে কুমড়ো কাটছে? ছেলেকে বললেন, যদি কুমড়ো কাটার জন্যই সাধু হয়ে থাকিস তাহলে বাড়ি ফিরে চল, গাড়ি গাড়ি কুমড়ো কিনে দেব। ছেলে বাবাকে প্রণাম করে বললেন, বাবা, আমি কুমড়ো কাটছি না. ঠাকুরের পুজো করছি। এই ভাব - সব তাঁর পুজো।

"আমি যখন প্রথম রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে যোগ দিয়েছি সেইসময়কার একটা ঘটনা বলি। দেওঘরে আমাদের যে স্কুল ছিল সেখানে তখন পড়াতাম। একবার কয়েকদিনের জন্য মঠে এসেছি।

"একদিন আমাদের এক বৃদ্ধ স্বামীজী আমাকে ডেকে বললেন: এই চিঠিগুলো ডাকে যাবে, এগুলোতে স্ট্যাম্প লাগিয়ে দাও। এক গাদা চিঠি - আমি তাড়াহুড়ো করে টেরা-বাঁকা করে স্ট্যাম্প লাগিয়ে কাজ শেষ করেছি। তারপর সেই স্বামীজীর টেবিলে গিয়ে রেখে দিয়ে এসেছি।

"কিছুক্ষণ পরেই তাঁর কাছ থেকে আবার ডাক। আমি তো ভাবছি: সেরেছে, আবার স্ট্যাম্প লাগাতে হবে নাকি? গিয়ে দেখি, সেই স্বামীজী প্রতিটা স্ট্যাম্প জল দিয়ে খুলছেন আর সোজা করে লাগাচ্ছেন। আমি যেতেই বললেন: এই তোমার কাজের ছিরি! স্কুলে ছাত্রদের এরকম শিক্ষাই দাও বুঝি ! —মারাত্মক কথা! আমি খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম, বললাম, দিন, আমি আবার লাগাচ্ছি। তিনি বললেন: না, তোমার দৌড় খুব বুঝেছি! তোমাকে এ আর করতে হবে না। আসলে তিনি তো কাজটাকে শুধু ‘স্ট্যাম্প লাগানো’ মনে করছেন না - স্ট্যাম্প তো যেমন করেই লাগাই না কেন, চিঠি ঠিক চলে যাবে। তিনি মনে করছেন: এ হচ্ছে পূজা, শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা। তাই এত যত্ন, এত সতর্কতা।"

'তব কথামৃতম্' বইতে পূজনীয় বড় মহারাজ ওই রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদের টাইপ করা বা স্কুলে পড়ানোর প্রসঙ্গটিই টেনে এনে একজায়গায় বলছেন, "স্বামীজী এটাকেই বলেছেন work is worship ...সংসারে যাঁরা আছেন তাঁরা যদি এই ভাবটা রাখতে পারেন যে, সংসারের সব কাজের মধ্য দিয়ে আমি ঈশ্বরের সেবা করছি, তাহলে কাজটা আর কাজ থাকে না, উপাসনা হয়ে যায়। ...সংসারের চেহারাটাই তখন বদলে যায়, আনন্দের জায়গা হয়ে যায় সংসারটা।" সবকিছুর শেষে, জীবনে আনন্দই তো খুঁজছি আমরা, তাই না? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তারই হদিস দিচ্ছেন - কি করে আমরা আমাদের দৈনন্দিন যাপনটিকে একটি আনন্দময় উপাসনায় রূপান্তরিত করার মধ্যে দিয়ে একইসাথে একটা sense of fulfillment লাভ করতে পারি আবার আত্মপলব্ধিও করতে পারি।

Saturday, June 18, 2022

গীতা আর কথামৃত এক

বহুদিন আগে একজন মহাত্মা আমায় বলেছিলেন যে রোজ একটু করে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত পড়লেই হবে, আর কোনোকিছুই পড়ার প্রয়োজন নেই। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম গীতা পড়ারও প্রয়োজন নেই? উনি উত্তর দিয়েছিলেন যা কিছু গীতায় আছে তা সবই কথামৃতে আছে, এটাই এ যুগের ব্রহ্মসূত্র, গীতা, উপনিষদ সবকিছু। সেদিন বুঝিনি, আজ মধ্যবয়সে এসে অনেককিছু পড়ার পর হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি উনি কেন সেদিন ও কথা বলেছিলেন। আজ উনি শরীরে নেই, কিন্তু সেসময় আমার বোঝার মতো maturity ছিল না যে অবশ্যই সমস্ত ধর্মগ্রন্থ পড়ে তবেই সবার শেষে উনি ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়েছিলেন এবং ওনার কথা follow করলে আখেরে লাভ বৈ ক্ষতি হতো না। দুএকটি মাত্র উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে ভগবান দ্বাপরে যা বলেছিলেন কলিতেও তাই বলেছেন, কেবল বলার ভঙ্গিটা এ যুগের উপযোগী করে দিয়েছেন যাতে মানুষ সহজে তার কর্তব্য-অকর্তব্য বুঝতে পারেন। দুটো আলাদা যুগে কথিত নির্দেশ এতটাই similar যে চমকে উঠতে হয়, আর তারপর সত্যিটা ধীরে ধীরে sink in করে।

১) গীতা, ৯ম অধ্যায়, ৭নং ও ৮নং শ্লোক:
সর্বভূতানি কৌন্তেয় প্রকৃতিং যান্তি মামিকাম্। 
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্।।
প্রকৃতিং স্বামবষ্টভ্য বিসৃজানি পুনঃ পুনঃ। 
ভূতগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ।।
অর্থাৎ,
At the end of one kalp, all living beings merge into My primordial material energy. At the beginning of the next creation, O son of Kunti, I manifest them again. Presiding over My material energy, I generate these myriad forms again and again, in accordance with the force of their natures.

কথামৃত, ৪র্থ পরিচ্ছদ, ২৭শে অক্টোবর ১৮৮২:
"..ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ, এককে মানলেই আর-একটিকে মানতে হয়। যেমন অগ্নি আর তার দাহিকাশক্তি; — অগ্নি মানলেই দাহিকাশক্তি মানতে হয়, দাহিকাশক্তি ছাড়া অগ্নি ভাবা যায় না; আবার অগ্নিকে বাদ দিয়ে দাহিকাশক্তি ভাবা যায় না। সূর্যকে বাদ দিয়ে সূর্যের রশ্মি ভাবা যায় না; সূর্যের রশ্মিকে ছেড়ে সূর্যকে ভাবা যায় না।

"দুধ কেমন? না, ধোবো ধোবো। দুধকে ছেড়ে দুধের ধবলত্ব ভাবা যায় না। আবার দুধের ধবলত্ব ছেড়ে দুধকে ভাবা যায় না।
"তাই ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে, শক্তিকে ছেড়ে ব্রহ্মকে ভাবা যায় না। নিত্যকে ছেড়ে লীলা, লীলাকে ছেড়ে নিত্য ভাবা যায় না!
"আদ্যাশক্তি লীলাময়ী; সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী! একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয় — সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কোন কাজ করছেন না — এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ।

"তিনি নানাভাবে লীলা করছেন। তিনিই মহাকালী, নিত্যকালী, শ্মশানকালী, রক্ষাকালী, শ্যামাকালী। মহাকালী, নিত্যকালীর কথা তন্ত্রে আছে। যখন সৃষ্টি হয় নাই; চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, পৃথিবী ছিল না; নিবিড় আঁধার; তখন কেবল মা নিরাকারা মহাকালী — মহাকালের সঙ্গে বিরাজ করছিলেন।...
"যখন জগৎ নাশ হয়, মহাপ্রলয় হয়, তখন মা সৃষ্টির বীজ সকল কুড়িয়ে রাখেন। গিন্নীর কছে যেমন একটা ন্যাতা-ক্যাতার হাঁড়ি থাকে, আর সেই হাঁড়িতে গিন্নী পাঁচরকম জিনিস তুলে রাখে। (কেশবের ও সকলের হাস্য)...

কেশব (সহাস্যে) — কালী কতভাবে লীলা করছেন, সেই কথাগুলি একবার বলুন।
(সহাস্যে) — “হ্যাঁ গো! গিন্নীদের ওইরকম একটা হাঁড়ি থাকে। ভিতরে সমুদ্রের ফেনা, নীল বড়ি, ছোট-ছোট পুঁটলি বাঁধা শশাবিচি, কুমড়াবিচি, লাউবিচি — এই সব রাখে, দরকার হলে বার করে। মা ব্রহ্মময়ী সৃষ্টি-নাশের পর ওইরকম সব বীজ কুড়িয়ে রাখেন। সৃষ্টির পর আদ্যাশক্তি জগতের ভিতরেই থাকেন! জগৎপ্রসব করেন, আবার জগতের মধ্যে থাকেন। বেদে আছে ‘ঊর্ণনাভির’ কথা; মাকড়সা আর তার জাল। মাকড়সা ভিতর থেকে জাল বার করে, আবার নিজে সেই জালের উপর থাকে। ঈশ্বর জগতের আধার আধেয় দুই।

২) গীতা, ১৮তম অধ্যায়, ৬৬নং শ্লোক:
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। 
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।
অর্থাৎ,
Abandon all varieties of dharmas and simply surrender unto Me alone. I shall liberate you from all sinful reactions; do not fear.
শ্রীমৎ শঙ্করাচাৰ্য্য এই শ্লোকটির ১১৩ টি শ্লোকে ভাষ্য করেছেন। তার মধ্যে প্রথমটিতে আচার্য্য বলছেন, 'সর্বধর্মান্’ সর্বে চ তে ধর্মাঃ চ সর্বধর্মাঃ তান্ / ধর্ম শব্দেন অত্র অধর্মঃ অপি গৃহ্যতে নৈষ্কর্ম্যস্য বিবক্ষিতত্বাৎ', অর্থাৎ যত প্রকার ধর্ম আছে সেই সমস্তই এখানে included। নৈষ্কর্ম্য (কর্মভাব) 'বিবক্ষিত' অর্থাৎ নির্ণয় করতে হবে বলে 'ধর্ম' শব্দের দ্বারা এখানে অধর্মকেও বোঝানো হচ্ছে। আর ভাষ্যের দশ নম্বর শ্লোকে আচার্য্য বলছেন, 'আত্মজ্ঞানস্য তু কেবলস্য নি:শ্ৰেয়সহেতুত্বং ভেদপ্রত্যয় নিবৰ্তকত্বেন কৈবল্যফলাবসানত্বাৎ' অর্থাৎ কেবল আত্মজ্ঞানেই দ্বৈতভাব নাশ হয় আর মুক্তিরূপ ফলবাসনা সিদ্ধ হয়।

কথামৃত, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ, ২৭শে অক্টোবর ১৮৮২:
"ঈশ্বরের নামে এমন বিশ্বাস হওয়া চাই — কি, আমি তাঁর নাম করেছি, আমার এখনও পাপ থাকবে! আমার আবার পাপ কি?’ কৃষ্ণকিশোর পরম হিন্দু, সদাচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ, সে বৃন্দাবনে গিছল। একদিন ভ্রমণ করতে করতে তার জলতৃষ্ণা পেয়েছিল। একটা কুয়ার কাছে গিয়ে দেখলে, একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে বললে, ওরে তুই একঘটি জল আমায় দিতে পারিস? তুই কি জাত? সে বললে, ঠাকুর মহাশয়, আমি হীন জাত — মুচি। কৃষ্ণকিশোর বললে, তুই বল, শিব। নে, এখন জল তুলে দে।

"ভগবানের নাম করলে মানুষের দেহ-মন সব শুদ্ধ হয়ে যায়।
"কেবল ‘পাপ’ আর ‘নরক’ এই সব কথা কেন? একবার বল যে, অন্যায় কর্ম যা করেছি আর করব না। আর তাঁর নামে বিশ্বাস কর।”

ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া নামমাহাত্ম্য গাইতেছেন:
"আমি দুর্গা দুর্গা বলে মা যদি মরি ৷
আখেরে এ-দীনে, না তারো কেমনে, জানা যাবে গো শঙ্করী ৷৷
"আমি মার কাছে কেবল ভক্তি চেয়েছিলাম। ফুল হাতে করে মার পাদপদ্মে দিয়েছিলাম; বলেছিলাম, ‘মা, এই নাও তোমার পাপ, এই নাও তোমার পুণ্য, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার জ্ঞান, এই নাও তোমার অজ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার শুচি, এই নাও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার ধর্ম, এই নাও তোমার অধর্ম, এই নাও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও’।"

কথামৃত, প্রথম পরিচ্ছদ, ২৬শে নভেম্বর ১৮৮৩:
"...এইরকম আছে যে, সত্য কথাই কলির তপস্যা। সত্যকে আঁট করে ধরে থাকলে ভগবানলাভ হয়। সত্যে আঁট না থাকলে ক্রমে ক্রমে সব নষ্ট হয়। আমি এই ভেবে যদিও কখন বলে ফেলি যে বাহ্যে যাব, যদি বাহ্যে নাও পায় তবুও একবার গাড়ুটা সঙ্গে করে ঝাউতলার দিকে যাই। ভয় এই — পাছে সত্যের আঁট যায়। আমার এই অবস্থার পর মাকে ফুল হাতে করে বলেছিলাম, ‘মা! এই নাও তোমার জ্ঞান, এই নাও তোমার অজ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার শুচি, এই নাও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার ভাল, এই নাও তোমার মন্দ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার পুণ্য, এই নাও তোমার পাপ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।’ যখন এই সব বলেছিলুম, তখন এ-কথা বলিতে পারি নাই, ‘মা! এই নাও তোমার সত্য, এই নাও তোমার অসত্য।’ সব মাকে দিতে পারলুম, ‘সত্য’ মাকে দিতে পারলুম না।"

কথামৃত, দ্বাদশ পরিচ্ছদ, ২৮শে নভেম্বর ১৮৮৩:
"যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা (Phenomenal world)। যাঁরই লীলা তাঁরই নিত্য (Absolute)। যিনি ঈশ্বর বলে গোচর হন, তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন। যে জেনেছে সে দেখে যে তিনিই সব হয়েছেন — বাপ, মা, ছেলে প্রতিবেশী, জীবজন্তু, ভাল-মন্দ, শুচি, অশুচি সমস্ত।"

প্রতিবেশী — তবে পাপ পূণ্য নাই?

শ্রীরামকৃষ্ণ — আছে, আবার নাই। তিনি যদি অহংতত্ত্ব, (Ego) রেখে দেন, তাহলে ভেদবুদ্ধিও রেখে দেন। তিনি দু-একজনেতে অহংকার একেবারে পুঁছে ফেলেন — তারা পাপ-পুণ্য ভাল-মন্দের পার হয়ে যায়। ঈশ্বরদর্শন যতক্ষণ না হয় ততক্ষণ ভেদবুদ্ধি ভাল-মন্দ জ্ঞান থাকবেই থাকবে। তুমি মূখে বলতে পার, আমার পাপ-পুণ্য সমান হয়ে গেছে; তিনি যেমন করাচ্ছেন, তেমনি করছি। কিন্তু অন্তরে জান যে, ও-সব কথা মাত্র; মন্দ কাজটি করলেই মন ধুকধুক করবে। ঈশ্বরদর্শনের পরও তাঁর যদি ইচ্ছা হয়, তিনি “দাস আমি” রেখে দেন। সে অবস্থায় ভক্ত বলে — আমি দাস, তুমি প্রভু। সে ভক্তের ঈশ্বরীয় কথা, ঈশ্বরীয় কাজ ভাল লাগে; ঈশ্বরবিমুখ লোককে ভাল লাগে না; ইশ্বর ছাড়া কাজ ভাল লাগে না। তবেই হল, এরূপ ভক্তেতেও তিনি ভেদবুদ্ধি রাখেন।

প্রতিবেশী — মহাশয় বলছেন, ঈশ্বরকে জেনে সংসার কর। তাঁকে কি জানা যায়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে ইন্দ্রিয় দ্বারা বা এ-মনের দ্বারা জানা যায় না। যে-মনে বিষয়বাসনা নাই সেই শুদ্ধমনের দ্বারা তাঁকে জানা যায়।

প্রতিবেশী — ঈশ্বরকে কে জানতে পারে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ঠিক কে জানবে? আমাদের যতটুকু দরকার, ততটুকু হলেই হল। আমার এক পাতকুয়া জলের কি দরকার? একঘটি হলেই খুব হল। চিনির পাহারের কাছে একটা পিঁপড়ে গিছল। তার সব পাহাড়টার কি দরকার? একটা-দুটো দানা হলেই হেউ-ঢেউ হয়।

প্রতিবেশী — আমাদের যে বিকার, একঘটি জলে হয় কি? ইচ্ছা করে ঈশ্বকে সব বুঝে ফেলি!

শ্রীরামকৃষ্ণ — তা বটে। কিন্তু বিকারের ঔষধও আছে।

প্রতিবেশী — মহাশয়, কি ঔষধ?

শ্রীরামকৃষ্ণ — সাধুসঙ্গ, তাঁর নামগুণগান, তাঁকে সর্বদা প্রার্থনা। আমি বলেছিলাম, মা, আমি জ্ঞান চাই না; এই নাও তোমার জ্ঞান, এই নাও তোমার অজ্ঞান, — মা আমায় তোমার পাদপদ্মে কেবল শুদ্ধাভক্তি দাও। আর আমি কিছুই চাই নাই।

"যেমন রোগ, তার তেমনি ঔষধ। গীতায় তিনি বলেছেন, ‘হে অর্জুন, তুমি আমার শরণ লও, তোমাকে সবরকম পাপ থেকে আমি মুক্ত করব।’ তাঁর শরণাগত হও, তিনি সদ্বুদ্ধি দেবেন। তিনি সব ভার লবেন। তখন সবরকম বিকার দূরে যাবে। এ-বুদ্ধি দিয়ে কি তাঁকে বুঝা যায়? একসের ঘটিতে কি চারসের দূধ ধরে? আর তিনি না বুঝালে কি বুঝা যায়? তাই বলছি — তাঁর শরণাগত হও — তাঁর যা ইচ্ছা তিনি করুন। তিনি ইচ্ছাময়। মানুষের কি শক্তি আছে?"

Friday, June 17, 2022

বদল


আমি যেমন আশেপাশের মানুষজনকে observe করি, তেমনি যত বয়স বাড়ছে তত আমার নিজের ভেতরে কেমন কেমন পরিবর্তন হচ্ছে সেটাও আমি আজকাল খুব keenly observe করি। আগে যেমন হুট বলতেই সবকিছুতে involved হয়ে যেতাম, এখন কখনো কখনো আসেপাশের কথাবার্তা বা ঘটনার প্রভাব মনের ওপর পড়ে বটে, কিন্তু অনেকসময়ই একেবারে পড়ে না। হয়তো কখনো পরিণত কারো শিশুসুলভ আচরণ দেখে তাৎক্ষণিক রাগ হলো, আবার কখনো হাসি পেলো, কখনো বা আবার মনে কোনো দাগই কাটলো না - সবটাই নির্ভর করে ঠিক সেই সময় মানসিকভাবে আমার পারিপার্শ্বিকের সাথে আমি কতটা attached বা detached আছি, তার ওপর। তবে ভালো মন্দ যাই হোক না কেন, খুব বেশিক্ষন আশেপাশের ঘটনা এখন আর মনেও থাকে না। 

লক্ষ্য করে দেখছি increasingly অনেকসময়ই মনের ওপর বাইরের জগতে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার এখন আর কোনো প্রভাব পড়ে না অথবা কম সময়ের জন্য প্রভাবিত হয়ে পড়ি আবার চট করে তার থেকে বেরিয়েও আসি। এও দেখছি যে এর বেশিরভাগটাই এখন নিজের involved হওয়ার ইচ্ছা বা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। আর একটা পরিবর্তন হয়েছে - এখন আর একেবারেই আগের মতন strong মান অপমান বোধ নেই, বরং অনেকসময়ই কেউ দুর্ব্যবহার করলে আপনেআপই তার জায়গা থেকে তার অশান্তির কারণটা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করি আর তার প্রতি genuine compassion অনুভব করি। 

আরো একটা ব্যাপার হলো ইচ্ছেমত হট্টগোল থেকে শান্তিতে switch on বা switch off করতে পারা। যতক্ষণ হাটের মাঝে থাকি ততক্ষণ সবকিছুর সাথে জড়িয়ে থাকি আর যেই সেসব কচাকচি আর ভালো লাগে না, একা আমার চিলেকোঠার ঘরে উঠে যাই। যেই ওই familiar surroundings এ পৌঁছে গেলাম অমনি চঞ্চল মনটাকে স্থির করে নিয়ে নিজেকে বাইরের ঝামেলা থেকে মানসিকভাবে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিতে আমি শিখে গেছি। এটাকেই surroundings syndrome বলে কিনা জানিনা তবে আমার ক্ষেত্রে এটাকে distortions in perception of time, space, shape, distance ইত্যাদি বা episodes of depersonalization - derealization disorder না বলে heightened awareness and clarity about selfsatisfaction বলাই বোধহয় বেশি উপযোগী।

এছাড়া কি শুনছি বা পড়ছি তার ওপরেও নির্ভর করে সাময়িকভাবে মনের অবস্থানগত পরিবর্তন হয় - যদি শাস্ত্র পড়ি বা আধ্যাত্মিক কোনো লেখা পড়ি বা ইউটিউবে সৎসঙ্গ শুনি, তখন মনকে ঘিরে একরকমের একটা শান্ত স্নিগ্ধ আবরণ গড়ে ওঠে, যে খোলসটি থেকে আর চট করে বেরোতে ইচ্ছে করে না। তখন ফোন বাজলে অস্বস্তি হয়, কেউ ডাকলে avoid করার চেষ্টা করি। আবার যখন অন্য কিছু পড়ি বা গান শুনি বা কোনো শারীরিক কাজ করি বা গল্পসল্প করি, তখন বাইরের sights and sounds খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয় আর তাতে যথোপযুক্তভাবে react করতেও কোনো অসুবিধা হয়না। তবে তারও রকমফের আছে। আমি যেহেতু একবেলা খাই, রাতে আমার সামনে বসে কেউ কোপ্তা কালিয়া মন্ডা মিঠাই খেলেও আমার কিছু যায় আসে না - যা সকালে খুবই রুচিকর তাইই রাতে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।

যখন আমি পরিচিতদের অনেকেরই মানসিকভাবে একই জায়গায় আটকে থেকে যাওয়া বা আরো বেশি জড়িয়ে পড়ার পটভূমিকায় নিজের ক্রমবর্ধমান গা-ছাড়া ভাব আর নিরুৎসাহের অবস্থাটাকে একটা third person angle থেকে দেখি, বেশ অদ্ভুত লাগে। অন্যরকম বিষয়ের উদাহরণ হলেও, ধরুন আমি মাঝেমাঝে খুব উৎসাহ নিয়ে food vlog দেখি - কে কিরকম নতুন নতুন জিনিষ খাচ্ছেন, কোন নতুন নতুন রান্না হচ্ছে, কি কি নতুন resturant হলো ইত্যাদি দেখতে বেশ লাগে কিন্তু সেগুলোয় যেতে বা নতুন কিছু খেতে, নিজের ভেতর থেকে আজকাল আর তেমন উৎসাহই পাইনা, অথচ এই আমিই এককালে বিরাট বড় foodie ছিলাম। আমি কতটা বদলে গেছি ভাবলে আমার নিজেরই মাঝেমাঝে অবাক লাগে। হয়তো আরো বদলাবো, সে কথা সময়ই বলবে।

যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি

বৈষ্ণবদের বিশেষ প্রিয় ভক্তিগ্রন্থ পাণ্ডবগীতায় একজায়গায় দুর্যোধন বলছেন,
জানামি ধর্ম্মং ন চ মে প্রবৃত্তি-
জানাম্যধর্ম্মং ন চ মে নিবৃত্তিঃ।
ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন
যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি॥ ৬০
যন্ত্রস্য গুণদোষৌ ন ক্ষম্যতাং মধুসূদন।
অহং যন্ত্রো ভবান্‌ যন্ত্রী মম দোষো ন বিদ্যতে॥ ৬১
অর্থাৎ,
ধর্ম্মজ্ঞান আছে, কিন্তু মন নাহি যায়,
অধর্ম্ম বিদিত মম বিরাম কোথায়?
অতএব হৃষীকেশ, হয়ে হৃদিস্থিত
করি তাহা, যাহে তুমি কর নিয়োজিত। ৬০
আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী, কিবা দোষ তবে?
যন্ত্রের এ দোষগুণ ক্ষমহ মাধবে। ৬১
(পদ্যানুবাদ শ্রীশশিভূষণ পুরকায়স্থ)

এর কিয়দংশ উদ্ধৃত করে গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ মূল ভগবৎগীতার ২/৪৭ নং শ্লোকে 'কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন' ইত্যাদি সম্পর্কিত কর্মযোগের তিনটি লক্ষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলছেন, '(হিন্দুসাধক) নিজেকে যন্ত্রস্বরূপ মনে করিয়া সেই যন্ত্রীর উপরই আত্মসমর্পণ করেন। রাজসিক কর্মীর কর্মজীবনের মূলমন্ত্র "অহং"-প্রতিষ্ঠা, সাত্ত্বিক হিন্দুর কর্মজীবনের প্রথম ও শেষকথা "অহং"-ত্যাগ। তাই হিন্দু প্রত্যহ শয্যা হইতে উঠিয়া কর্মারম্ভের পূর্বে বলিয়া থাকেন -- "ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদিস্থিতেন যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি"।'

এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথেরও একটি অসাধারণ ব্যাখ্যা আছে শান্তিনিকেতনে তাঁর 'শক্ত ও সহজ' প্রবন্ধে। মহাকবি ঋষি লিখছেন,

'সাধনার দুই অঙ্গ আছে। একটি ধরে রাখা, আর একটি ছেড়ে দেওয়া। এক জায়গায় শক্ত হওয়া, আর এক জায়গায় সহজ হওয়া।

জাহাজ যে চলে তার দুটি অঙ্গ আছে। একটি হচ্ছে হাল, আর একটি হচ্ছে পাল। হাল খুব শক্ত করেই ধরে রাখতে হবে। ধ্রুবতারার দিকে লক্ষ স্থির রেখে সিধে পথ ধরে চলা চাই। এর জন্যে দিক জানা দরকার, নক্ষত্রপরিচয় হওয়া চাই, কোন্‌খানে বিপদ কোন্‌খানে সুযোগ সে-সমস্ত সর্বদা মন দিয়ে বুঝে না চললে চলবে না। এর জন্যে অহরহ সচেষ্টা সতর্কতা এবং দৃঢ়তার প্রয়োজন। এর জন্যে জ্ঞান এবং শক্তি চাই।

আর একটি কাজ হচ্ছে অনুকূল হাওয়ার কাছে জাহাজকে সমর্পণ করা। জাহাজের যত পাল আছে সমস্তকে এমন করে ছড়িয়ে ধরা যে বাতাসের সুযোগ হতে সে যেন লেশমাত্র বঞ্চিত না হয়।

আধ্যাত্মিক সাধনাতেও তেমনি। যেমন একদিকে নিজের জ্ঞানকে বিশুদ্ধ এবং শক্তিকে সচেষ্ট রাখতে হবে, তেমনি আর-এক দিকে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করে দিতে হবে। তাঁর মধ্যে একেবারে সহজ হয়ে যেতে হবে।

নিজেকে নিয়মের পথে দৃঢ় করে ধরে রাখবার সাধনা অনেক জায়গায় দেখা যায়, কিন্তু নিজেকে তাঁর হাতে সমর্পণ করে দেবার সাধনা অল্পই দেখতে পাই। এখানেও মানুষের যে একটা কৃপণতা আছে। সে নিজেকে নিজের হাতে রাখতে চায় ছাড়তে চায় না। একটা কোনো কঠোর ব্রতে সে প্রতিদিন নিজের শক্তির পরিচয় পায়। প্রতিদিন একটা হিসাব পেতে থাকে যে, নিয়ম দৃঢ় রেখে এতখানি চলা হল। এতেই তার একটা বিশেষ অভিমানের আনন্দ আছে।

নিজের জীবনকে ঈশ্বররের কাছে নিবেদন করে দেবার এ মানে নয় যে, আমি যা করছি সমস্তই তিনি করছে এইটি কল্পনা করা। করছি কাজ আমি, অথচ নিচ্ছি তাঁর নাম, এবং দায়িক করছি তাঁকে-- এমন দুর্বিপাক না যেন ঘটে।

ঈশ্বরের হাওয়ার কাছে জীবনটাকে একেবারে ঠিক করে ধরে রাখতে হবে। সেটিকে সম্পূর্ণ মানতে হবে। কাত হয়ে সেটিকে পাশ কাটিয়ে চললে হবে না। তাঁর আহ্বান তাঁর প্রেরণাকে পুরাপুরি গ্রহণ করবার মুখে জীবন প্রতিমুহূর্তে যেন আপনাকে প্রসারিত করে রাখে। "কী ইচ্ছা, প্রভু, কী আদেশ" এই প্রশ্নটিকে জাগ্রত করে রেখে সে যেন সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকে। যা শ্রেয় তা যেন সহজেই তাকে চালায় এবং শেষ পর্যন্তই তাকে নিয়ে যায়।

জানামি ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তিঃ
জানাম্যধর্মং ন চ মে নিবৃত্তিঃ
ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদিস্থিতেন
যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি।

এ শ্লোকের মানে এমন নয় যে, আমি ধর্মেই থাকি আর অধর্মেই থাকি তুমি আমাকে যেমন চালাচ্ছ আমি তেমনি চলছি। এর ভাব এই যে, আমার প্রবৃত্তির উপরেই যদি আমি ভার দিই তবে সে আমাকে ধর্মের দিকে নিয়ে যায় না, অধর্ম থেকে নিরস্ত করে না ; তাই হে প্রভু, স্থির করেছি তোমাকেই আমি হৃদয়ে রাখব এবং তুমি আমাকে যেদিকে চালাবে সেই দিকে চলব। স্বার্থ আমাকে যেদিকে চালাতে চায় সেদিকে চলব না, অহংকার আমাকে যে পথ থেকে নিবৃত্ত করতে চায় আমি সে পথ থেকে নিবৃত্ত হব না।

অতএব তাঁকে হৃদয়ের মধ্যে স্থাপিত করে তাঁর হাতে নিজের ভার সমর্পণ করা, প্রত্যহ আমাদের ইচ্ছাশক্তির এই একটিমাত্র সাধনা হোক।

এইটি করতে গেলে গোড়াতেই অহংকারকে তার চূড়ার উপর থেকে একেবারে নামিয়ে আনতে হবে। পৃথিবীর সকলের সঙ্গে সমান হও, সকলের পিছনে এসে দাঁড়াও, সকলের নীচে গিয়ে বোসো, তাতো কোনো ক্ষতি নেই। তোমার দীনতা ঈশ্বরের প্রসাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক, তোমার নম্রতা সুমধুর অমৃতফলভারে সার্থক হউক। সর্বদা লড়াই করে নিজের জন্যে ওই একটুখানি স্বতন্ত্র জায়গা বাঁচিয়ে রাখবার কী দরকার, তার কী মূল্য? জগতের সকলের সমান হয়ে বসতে লজ্জা ক'রো না_ সেইখানেই তিনি বসে আছেন। যেখানে সকলের চেয়ে উঁচু হয়ে থাকবার জন্যে তুমি একলা বসে আছ সেখানে তাঁর স্থান অতি সংকীর্ণ।

যতদিন তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ না করবে ততদিন তোমার হার-জিত তোমার সুখদুঃখ ঢেউয়ের মতো কেবলই টলাবে, কেবলই ঘোরাবে। প্রত্যেকটার পুরো আঘাত তোমাকে নিজে হবে। যখন তোমার পালে তাঁর হাওয়া লাগবে তখন তরঙ্গ সমানই থাকবে, কিন্তু তুমি হু হু করে চলে যাবে। তখন সেই তরঙ্গ আনন্দের তরঙ্গ। তখন প্রত্যেক তরঙ্গটি কেবল তোমাকে নমস্কার করতে থাকবে এবং এই কথাটিরই প্রমাণ দেবে যে, তুমি তাঁকে আত্মসমর্পণ করেছ।

তাই বলছিলুম জীবনযাত্রার সাধনায় নিজের শক্তির চর্চা যতই করি, ঈশ্বরের চিরপ্রবাহিত অনুকূল দক্ষিণ বায়ুর কাছে সমস্ত পালগুলি একেবারেই পূর্ণভাবে ছড়িয়ে দেবার কথাটা না ভুলি যেন।'

এ ব্যাপারে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব কি বলছেন সেটি না শুনলে এই শ্লোকের ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের সপ্তম পরিচ্ছেদ থেকে ২৭শে ডিসেম্বর ১৮৮৩র এই কথোপকথন শুনে নেওয়া যাক :

কেশব (কীর্তনীয়া) — তা তিনিই ‘করণ’, ‘কারণ’। দুর্যোধন বলেছিলেন, “ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদিস্থিতেন যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি।”

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — হাঁ, তিনিই সব করাচ্ছেন বটে; তিনিই কর্তা, মানুষ যন্ত্রের স্বরূপ।

“আবার এও ঠিক যে কর্মফল আছেই আছে। লঙ্কামরিচ খেলেই পেট জ্বালা করবে; তিনিই বলে দিয়েছেন যে, খেলে পেট জ্বালা করবে। পাপ করলেই তার ফলটি পেতে হবে।

“যে ব্যক্তি সিদ্ধিলাভ করেছে, যে ঈশ্বরদর্শন করেছে, সে কিন্তু পাপ করতে পারে না। সাধা-লোকের বেতালে পা পড়ে না। যার সাধা গলা, তার সুরেতে সা, রে, গা, মা’-ই এসে পড়ে।”...

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার কি ভাব? সোঽহম্‌ না সেব্য-সেবক?

“সংসারীর পক্ষে সেব্য-সেবকভাব খুব ভাল। সব করা যাচ্ছে, সে অবস্থায় ‘আমিই সেই’ এ-ভাব কেমন করে আসে। যে বলে আমিই সেই, তার পক্ষে জগৎ স্বপ্নবৎ, তার নিজের দেহ-মনও স্বপ্নবৎ, তার আমিটা পর্যন্ত স্বপ্নবৎ, কাজে কাজেই সংসারের কাজ সে করতে পারে না। তাই সেবকভাব, দাসভাব খুব ভাল।

“হনুমানের দাসভাব ছিল। রামকে হনুমান বলেছিলেন, ‘রাম, কখন ভাবি তুমি পূর্ণ, আমি অংশ; তুমি প্রভু, আমি দাস; আর যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি তুমিই আমি, আমিই তুমি।’

“তত্ত্বজ্ঞানের সময় সোঽহম্‌ হতে পারে, কিন্তু সে দূরের কথা।”

শ্রীশ — আজ্ঞে হাঁ, দাসভাবে মানুষ নিশ্চিন্ত। প্রভুর উপর সকলই নির্ভর। কুকুর ভারী প্রভুভক্ত, তাই প্রভুর উপর নির্ভর করে নিশ্চিন্ত।

Monday, June 13, 2022

পুরুষকার

আমার বাবা ঘোর শাক্ত ছিলেন। ছোটবেলায় মঠে বা মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বাবা প্রার্থনা করতে শেখাতেন, বলতেন "বলো মা জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও, প্রেম দাও, বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও"। ঠাকুরঘরেও রোজ সকালে স্নানের পর দেবদেবীদের প্রণাম করে ওটাই বলতে হতো, সাথে আদ্যাস্তোত্ৰটি মুখস্ত বলতে হতো। একটি শব্দেরও মানে বুঝতাম না, না তো প্রার্থনার, না সংস্কৃতে লেখা স্তোত্রের, কিন্তু নিয়ম করে প্রতিদিন বলে যেতে হতো। একদিন মানে জিজ্ঞেস করায় বাবা বলেছিলেন এগুলো হচ্ছে মনের খিদে মেটানোর জন্য ভাত ডাল তরকারি মাছ ও দইয়ের মতন আর এগুলো একমাত্র মা কালীই দিতে পারেন। তাই রোজ যেমন শরীরের খিদে পেলে মাকে 'মা ভাত দাও' বলি, তেমনি মানুষ হতে গেলে রোজই মা কালীর কাছেও এইসব খাবার চেয়ে নিতে হয়। আর বলেছিলেন স্তোত্র হলো যাঁর কাছে চাইছি, তাঁকে বন্দনা করে মানুষ করার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা; পরে বড় হলে একদিন ঠিকই বুঝতে পারবো সত্যি সত্যিই কতটা মানুষ হতে পারলাম। মনে আছে সেদিন বেশ অবাক হয়েছিলাম। আমি তো মানুষই! লিও, অর্থাৎ আমাদের পোষ্য এলসেশিয়ানের মতন কুকুর তো নই, তাহলে আবার আলাদা করে কি মানুষ হবো রে বাবা? আজ মধ্য বয়সে এসে হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি বাবা সেদিন আসলে কি বলেছিলেন। বড় হলাম বটে, সত্যিকারের মানুষ আর হতে পারলাম কৈ?

বাবা আমার ছেলেবেলাতেই সাধনোচিত ধামে পাড়ি দিলেন, আমার অবিভাবকত্বেরও হাতবদল হলো। বাড়িতে মা বলতে লাগলেন, "রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা কর যাতে ভালোভাবে পড়াশুনা করে শিগগির শিগগির মানুষ হতে পারিস" আর স্কুলে মাষ্টারমশাইরা বলতে লাগলেন, "আরো মন দিয়ে পড়, ভালো রেজাল্ট কর, ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারবি না আর ভালো চাকরিও পাবি না, তখন জীবন দুর্বিষহ হয়ে যাবে"। যত চাপ বাড়তে লাগলো তত বাবার শেখানো প্রার্থনা ভুলে গিয়ে প্রার্থনায় 'ভালো রেজাল্ট দাও' দিয়ে শুরু করে পরে 'অমুকের মতো পেন দাও', 'তমুকের মতো জামা দাও'তে গিয়ে ঠেকলো। স্পষ্ট মনে আছে এক সরস্বতী পূজায় শুধু জ্ঞান চেয়েই থেমে গেলাম, ভক্তি প্রেম বিবেক বৈরাগ্য সব কেমন করে যেন নিজে থেকেই বাদ চলে গেল। ধীরে ধীরে একসময় আদ্যাস্তোত্ৰটিও ভুলে গেলাম। কখনো কখনো মনে পড়লে 'শৃণু বৎস প্রবক্ষ্যামি আদ্যাস্তোত্রং মহাফলম্/ যঃ পঠেৎ সততং ভক্ত্যা স এব বিষ্ণুবল্লভঃ' অবধি গিয়েই আটকে যেতাম। আমার যখন ১৪-১৫ বছর বয়স, তখন আমার মানসে মানুষ হওয়ার সংজ্ঞা হলো আমারই এক নিকট আত্মীয়ের মতো অঢেল পয়সা কামানো আর যথেচ্ছ খরচ করার ক্ষমতা অর্জন করা। 

তারপর জীবন যেদিকে নিয়ে গেল, ভেসে গেলাম। দীর্ঘদিন চাকরি, দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, সংসার, সন্তান, কর্পোরেট ল্যাডার বেয়ে শীর্ষে ওঠা, তারপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করা, সাথেসাথে সমাজে একটুআধটু নাম কামানোর চেষ্টা, ইতিমধ্যে ছেলেরা উপার্জনক্ষম হয়ে যাওয়া আর আমার active involvement ছাড়াই রোজকার ডাল ভাতের একটা হিল্লে হওয়ার পর অবশেষে সব হ্যাপা জলাঞ্জলি দিয়ে ভাবতে বসা যে সত্যিই কি মানুষ হলাম? ভাবতে গিয়ে দেখলাম যে 'পরের জাগা পরের জমিন, ঘর বানাইয়া আমি রৈ / আমি তো সেই ঘরের মালিক নৈ'! তাহলে হলোটা কি? মাঝখানে গুচ্ছের সময় অপব্যয় করে আবার সেই বাবার শিক্ষায় ফিরে আসা - মনের খাবার যোগাড় করো, ওটাই আসল। মনটা থাকবে, বাকি আর কিছুই থাকবে না। বাবার অসময়ে চলে যাওয়ায় আমার আসলে কতটা ক্ষতি হয়েছিল সেটা আমি এই বয়সে এসে যতটা গভীরভাবে বুঝতে পারলাম, ততটা এযাবৎ বুঝিনি। তবে একটাই রক্ষা ছিল - সেটা আমার মন্ত্রদীক্ষা, গুরুদেবের দেওয়া বীজমন্ত্র এবং তাঁর আশীর্বাদ। ওটা ছাড়া হয়তো এখনো স্যুট টাই পরে পাঁচতারা হোটেলে একগাদা সাহেবসুবোর সাথে রোজ সিঙ্গেল মল্টে চুমুক দিতে দিতে আর কৃত্তিম হাসিঠাট্টায় মশগুল হয়ে ব্যবসায়িক লেনদেন করতে করতে ভাবতাম, this is it, I have arrived.

আগের সবকিছু বাদ দিয়ে আবার নতুন করে সনাতন সংবাদ পড়ছি। শাস্ত্র পড়ছি, সৎসঙ্গ করছি, মনটাকে বসে আনার চেষ্টা করছি। এ এক অন্য জগৎ - দুনিয়াদারি থেকে সরে গিয়ে সত্যিকারের মানুষদের জগৎ, এর স্বাদ গন্ধ বর্ণ সব একেবারে আলাদা। নিজের চেষ্টায় অল্প অল্প সংস্কৃত শেখার চেষ্টা করেছি, ফলে এতদিনে আদ্যাস্তোত্রের মানে বুঝতে পেরেছি এবং কেন বাবা রোজ পাঠ করতে বলতেন, সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে। মনের মধ্যে 'কি করছি?' প্রশ্নটি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মা যে দ্রুততার সঙ্গে বাইরের কাজ ও ভোগবাসনা কমিয়ে দিলেন, সেটা তো নিজেই অনুভব করলাম আর সেই সাথে সাথে দৈবনির্ভরতাও বেড়ে গেল বহুগুণ। এর কোনোকিছুই যে জোর করে করতে হয়েছে, তা তো নয় - যা হয়েছে সব আপনেআপই হয়েছে। কেন যে হটাৎ করে জীবনের focus-টা একদম ১৮০° ঘুরে গেল, স্বামী শিষ্য সংবাদ পড়তে পড়তে একজায়গায় তার উত্তর পেলাম। গুরুকৃপা হলে পুরুষকার জাগে, তারপর it is just a matter of time আর গুরু এবং ইষ্ট এক। আমার অসীম সৌভাগ্য যে সদগুরুর কৃপা পেয়েছিলাম, ফলে শরীরে না থেকেও তিনিই ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছেন। ওখানেই দেখলাম গুরু স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে কিভাবে inspire করছেন, "কি জানিস বাবা, সংসার সবই দুনিয়াদারি! ঠিক সৎসাহসী ও জ্ঞানী কি এ-সব দুনিয়াদারিতে ভোলে রে বাপ! জগৎ যা ইচ্ছে বলুক, আমার কর্তব্য কার্য করে চলে যাব—এই জানবি বীরের কাজ। নতুবা এ কি বলছে, ও কি লিখছে, ও-সব নিয়ে দিনরাত থাকলে জগতে কোন মহৎ কাজ করা যায় না। 

এই শ্লোকটা জানিস না?—
নিন্দন্তু নীতিনিপুণা যদি বা স্তুবন্তু
লক্ষ্মীঃ সমাবিশতু গচ্ছতু বা যথেষ্টম্।
অদ্যৈব মরণমস্তু শতাব্দান্তরে বা
ন্যায্যাৎ পথঃ প্রবিচলন্তি পদং ন ধীরাঃ॥
লোকে তোর স্তুতিই করুক বা নিন্দাই করুক, তোর প্রতি লক্ষ্মীর কৃপা হোক বা না হোক, আজ বা শতবর্ষ পরে তোর দেহপাত হোক, ন্যায়পথ থেকে যেন ভ্রষ্ট হসনি। কত ঝড় তুফান এড়িয়ে গেলে তবে শান্তির রাজ্যে পৌঁছান যায়। যে যত বড় হয়েছে, তার উপর তত কঠিন পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষার কষ্টিপাথরে তার জীবন ঘষে মেজে দেখে তবে তাকে জগৎ বড় বলে স্বীকার করেছে। যারা ভীরু কাপুরুষ, তারাই সমুদ্রের তরঙ্গ দেখে তীরে নৌকা ডোবায়। মহাবীর কি কিছুতে দৃকপাত করে রে? যা হবার হোক গে, আমার ইষ্টলাভ আগে করবই করব—এই হচ্ছে পুরুষকার। এ পুরুষকার না থাকলে শত দৈবও তোর জড়ত্ব দূর করতে পারে না।

শিষ্য॥ তবে দৈবে নির্ভরতা কি দুর্বলতার চিহ্ন?

স্বামীজী॥ শাস্ত্র নির্ভরতাকে ‘পঞ্চম পুরুষার্থ’ বলে নির্দেশ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে লোকে যেভাবে ‘দৈব দৈব’ করে, ওটা মৃত্যুর চিহ্ন, মহা-কাপুরুষতার পরিণাম, কিম্ভূতকিমাকার একটা ঈশ্বর কল্পনা করে তার ঘাড়ে নিজের দোষ-চাপানর চেষ্টামাত্র। ঠাকুরের সেই গোহত্যা-পাপের গল্প শুনেছিস তো? সেই গোহত্যা-পাপে শেষে বাগানের মালিককেই ভুগে মরতে হল। আজকাল সকলেই ‘যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি’ বলে পাপ-পুণ্য দুই-ই ঈশ্বরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। নিজে যেন পদ্মপত্রে জল! সর্বদা এ ভাবে থাকতে পারলে সে তো মুক্ত! কিন্তু ভাল-র বেলা ‘আমি’, আর মন্দের বেলা ‘তুমি’—বলিহারি তাদের দৈবে নির্ভরতা! পূর্ণ প্রেম বা জ্ঞান না হলে নির্ভরের অবস্থা হতেই পারে না। যার ঠিক ঠিক নির্ভর হয়েছে, তার ভালমন্দ-ভেদবুদ্ধি থাকে না—ঐ অবস্থার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের (শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিষ্যদের) ভেতর ইদানীং নাগ-মহাশয়।"

Sunday, June 12, 2022

সম্পর্ক

'আমি' আর 'তুমি' দুজন দুটি আলাদা entity হলেও আমার আর তোমার মধ্যে common factor হচ্ছে আমাদের সম্পর্ক। আমি আর তুমিরা জন্মাবো, কিছুদিন হট্টগোল করবো, তারপর একদিন মরে যাবো। সম্পর্কের মূল ভিত্তি কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে যাবে। আজ আমাদের দুজনের মধ্যেকার যে সম্পর্ক, অন্য কোনো সময়ে অন্য কোনো জায়গায় অন্য কোনো দুই ব্যক্তির মধ্যে অবশ্যই সেই একই সম্পর্ক তৈরি হবে, ফলে ব্যক্তি নশ্বর হলেও সম্পর্ক অবিনশ্বর। ছোটবেলায় গণিত শেখানোর সময় প্রথম শিখতে হয় যোগ। এক আর এক মিলে দুই হবে, আর এই মেলার চিহ্ন হচ্ছে যোগ - সবচেয়ে প্রথম এটাই শেখানো হয়। এবার দুইয়ে দুইয়ে চারই হোক বা ছয়শ আর আটশ মিলে চোদ্দশ, যোগ মানেই দুটি ভিন্ন identity মিলে এক হয়ে যাওয়া - দ্বৈত নয়, অদ্বৈত। দুটো হাত, দুটো আলাদা identity, একটা বাম আর অন্যটা ডান, একটা অন্যটার চেয়ে একটু বেশি শক্তিশালী, যেই যোগ হলো অমনি একটাই নমস্কার। একদম ছোটবেলায় বাবা-মা যখন হাতজোড় করতে শেখান, সেইদিন থেকে তাঁদের অজান্তেই আমাদের অদ্বৈতের পথচলা শুরু হয়ে যায়।

মাত্র দিনকয়েকের একটি শিশু, কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না, কোনো অসুবিধে হলে কেবল কাঁদে আর বাকি সময় ঘুমায়, সেও কিন্তু নিজের মায়ের গায়ের গন্ধটি চেনে। সেও জানে যে ঐ হচ্ছে আমার গ্রাহ্য আর আমি হলাম গ্রাহক। মায়ের সঙ্গে তার শুধু নেওয়ার সম্পর্ক - খাদ্য, স্নেহ, বাৎসল্য, পরিচর্যা, প্রতিপালন, নিরাপত্তা, সবকিছু। এ দেওয়া-নেওয়ার নয় কিন্তু, শুধুই নেওয়ার। তাহলে মায়ের কি এখানে কিছুই পাওয়ার নেই? আছে - সন্তানসুখ আর নিজের প্রাণসংশয়ের ঝুঁকি নিয়েও অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আনন্দ, যা একেবারেই non transactional. পেটের ভেতর থাকার সময় যে নাড়িটা দুজনকে জুড়ে রেখেছিল, জন্ম দেবার পরেও কিন্তু অদৃশ্যভাবে সেটা অক্ষুণ্ন থাকে আর ওটাই হলো মাতৃযোগ। এই সম্পর্কের একটা অতি বিশিষ্ট দিক আছে, কৃপা। কৃপা মানে অহেতুকি স্বার্থশূন্য অনুগ্রহ। কোনো অদৈবী মানুষ অন্য কোনো মানুষকে কৃপা করতেই পারেননা, কারণ একমাত্র দেবশরীর ছাড়া বাকি সকলের স্বার্থবোধ থাকবেই। মা কিন্ত তাঁর সদ্যজাত সন্তানকে কৃপাই করেন। যাঁরা মাতৃকৃপার তাৎপর্য বুঝতে পারবেন তাঁরা মায়ের মধ্যে ঈশ্বরের রূপও দেখতে পাবেন। ওই মুহূর্তে মা আর মহাশক্তি ভিন্ন থাকেন না, তাঁরা এক, অদ্বৈত। 

যা ক্ষণস্থায়ী, non permanent, তার ওপর জোর দিয়ে কি লাভ? যতক্ষণ আমরা transactional relationship এর ওপর focus করে জীবনযাপন করি ততক্ষণই তুমি আর আমি। তুমি এই দিলে আর আমি এই দিলাম বা আমি এই দেবো আর বিনিময়ে তোমার কাছ থেকে এই আশা করি। এখানে সম্পর্কটি মুখ্য নয়, নিমিত্ত মাত্র, মুখ্য হলাম আমি আর তুমি। তা সে প্রেমিক প্রেমিকাই হন বা স্বামী স্ত্রী, বন্ধু বান্ধবই হন বা ভাই বোন, যাঁরা প্রত্যেকেই প্রতিমুহূর্তে একপা একপা করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন অথচ নিজেদের দেহবোধ-সর্বস্ব অস্তিত্বের প্রেমে নিজেরাই মশগুল, মনে মনে তাঁদের প্রতিদিনের এই জাগতিক দর কষাকষি বস্তুত তাঁদের আত্মপ্রবঞ্চনা। সম্পর্কের এই ধরণের অবমূল্যায়ন আপাতভাবে আলাদা আলাদা স্বত্তাকে কোনোদিনই এক করতে পারেনা। এটার যোগফল চিরকাল শূন্যই থাকে কারণ এ এক অন্তঃসারশূন্যের সাথে আর এক অন্তঃসারশূন্যের নিরর্থক যোগ।

যে মুহূর্তে নজরটা অনিত্যের ওপর থেকে নিত্যের ওপর shift করে যায়, অমনি আমি তুমির বদলে প্রত্যেক সম্পর্কের মধ্যে যে ঐশ্বরিক গুন আছে যেমন দয়া, ক্ষমা, প্রেম, বাৎসল্য, করুণা, অনুকম্পা ইত্যাদি, সেই বিষয়গুলিই মুখ্য হয়ে ওঠে এবং একবার মনে মনে এই paradigm shift হয়ে গেলে, ভোগের সংসার আপনেআপই যোগের সংসার হয়ে ওঠে। তখন আর পাওয়ার আশা নয়, শুধুই মর্য্যাদারক্ষা। অঙ্কে গুণ মানে বহুবার যোগ। আর ঐশ্বরিক গুণ হলো সেইসব গুণ যা ব্যবহারিক জীবনে বহুভাবে প্রকাশিত হয়ে আমাদের ভেতরে অধিষ্ঠিত জাগ্রত ঈশ্বরের অস্তিত্বের বাহ্যিক প্রতিফলন ঘটায়। যে মুহূর্তে আমি নিঃস্বার্থ হলাম, যে মুহূর্তে বিনিময়ে কোনো কিছু পাওয়ার আশা ছাড়াই আমি সম্পর্কের মান রাখতে উদ্যত হলাম, অমনি আমার 'মা ফলেষু কদাচন' হয়ে গেল। সেই মুহূর্তে ওই সম্পর্ককে ধরে আমি আমার অন্তরাত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করলাম, তাঁর গুণের সাথে সম্পৃক্ত হলাম, বহির্মুখী থেকে অন্তর্মুখী হলাম, বহু থেকে এক হলাম।

আদর্শ সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ আমরা শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও শ্রীশ্রীমায়ের জীবনে বহুবার দেখতে পাই, যার মধ্যে মাত্র চারটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ্য। প্রথমটি মায়ের দক্ষিণেশ্বরে আসার পথে তেলোভেলোর মাঠের ঘটনা। অন্ধকার বিপদসঙ্কুল পথে সদ্যযুবতী মা একা হেঁটে চলেছেন, হঠাৎ এক ভয়ঙ্করমূর্তি ডাকাত তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললে, "কে তুমি"? প্রচণ্ড সাহসিনী মা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, "আমি তোমার মেয়ে সারদা"। এর পরের কাহিনি সবার জানা। দুটি অপরিচিত ব্যক্তি এক মুহূর্তের মধ্যে এমন এক পবিত্র আপত্যের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন যে তাঁদের নিজেদের ব্যক্তিত্বের চেয়েও সেই সম্পর্কের শুদ্ধতা অনেক বড় হয়ে উঠলো। দ্বিতীয় উদাহরণ ঠাকুরের মাতৃবিয়োগের ঠিক পরের ঘটনা। মা চন্দ্রামণি দেবীর মৃত্যুসংবাদে ঠাকুর হাউহাউ করে কাঁদছেন, ভাগ্নে হৃদয় শ্লেষের স্বরে বললেন, "আপনি না সন্ন্যাসী, এত বিচলিত হওয়া কি আপনাকে সাজে?" রেগে উঠে ঠাকুর বললেন, "হৃদে, তুই চুপ কর। সন্ন্যাসী হয়েছি বলে তো আর হৃদয়হীন পশু হয়ে যাইনি।" এ হলো যখন অবতারপুরুষ স্বয়ং ব্রহ্মজ্ঞানী সন্ন্যাসীরূপে আত্মবোধকে ছাপিয়ে জন্মদাত্রী মায়ের সাথে সন্তানের পবিত্র সম্পর্কের বিশুদ্ধ রূপকে অধিক মর্য্যাদা দিচ্ছেন।

তৃতীয় ঘটনা দক্ষিণেশ্বরের। ঠাকুরকে রাতের বেলায় খাবার মা নিজের হাতেই দিতেন। এক দিন জনৈক স্বভাবচরিত্রে দুষ্ট মহিলা ঠাকুরের পবিত্র সংস্পর্শে আসার বাসনায় মাকে বললেন, "মা, দিন, আজ আমি ঠাকুরকে খাবার থালাটা পৌঁছে দিয়ে আসি।" মা সবই জানতেন তবু সেই মহিলার হাতেই হাসিমুখে ঠাকুরের খাবার থালাটা তুলে দিলেন। এই ঘটনায় ঠাকুর সামান্য অসন্তুষ্ট হন। পরে তিনি মাকে বলেন, "জান, ওই মেয়েটার স্বভাব চরিত্রে দোষ আছে। ওর হাতে আমাকে খেতে দিলে?" এ কথা শুনে মা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, "তোমার খাবার আমি নিজেই নিয়ে আসব, কিন্তু আমায় মা বলে চাইলে আমি থাকতে পারব না।" মা হবেন দেবীর মতো, বাৎসল্যরসে টইটুম্বুর, প্রেমময়ী ক্ষমাদাত্রী সর্বংসহা, তবেই না তিনি পাতানো মা নন, সত্যিকারের মা। সন্তানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সর্বদা স্বার্থবোধশূন্য, তাই সন্তানকে অদেয় তাঁর কিছুই নেই। এখানে সন্তান বড় নয়, মাতৃভাবই আসল। আর এটা মা তাঁর সমস্ত সন্তানদের সাথেই করতেন, কেউ বাদ পড়তো না।

চতুর্থ ও শেষ ঘটনাটি এক ফলহারিণী পূজার রাতের। সেইদিন ঠাকুর তাঁর নিজের স্ত্রীকে জগজ্জননী রূপে আরাধনা করেছিলেন। এর অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব, যদিও পূজ্যপাদ চেতনানন্দজী মহারাজ খানিকটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। সারা জীবন ঠাকুর ঈশ্বরকে মাতৃরূপে আরাধনা করে এসেছেন। সেই মাতৃরূপিণী শক্তিকে তিনি শ্রীশ্রীমাতে আরোপিত করলেন, তারপর তাঁর পদপ্রান্তে নিজের সব সাধনা উৎসর্গ করে দিলেন। ঠাকুরের এই ষোড়শী পূজা অধ্যাত্মজগতে এক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মহারাজ বলছেন, কোনও কোনও অবতার বিবাহ করেছেন, যেমন - রামচন্দ্র, রামকৃষ্ণ। কোনও কোনও অবতার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছেন, যেমন - বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য। শ্রীরামকৃষ্ণ স্ত্রীকে পরিত্যাগ তো করলেনই না, উল্টে তাঁকে শক্তি রূপে আরাধনা করলেন। এ এক বিরল, ব্যতিক্রমী ঘটনা। আর এখানেই ব্যক্তি ছেড়ে সম্পর্কের ওপর মনোনিবেশের মাহাত্ম - যে সম্পর্ককে ভিত্তি করে অনিত্যকে অতিক্রম করে নিত্যের সাথে যোগের যাত্রা শুরু করা বা করানো সম্ভবপর হয়।

Saturday, June 11, 2022

হিন্দুসভ্যতা ও ত্যাগ

ভৌগোলিকভাবে কাছাকাছি চারটি পুরানো সভ্যতা - মেসোপটেমিয়ার, পারসিক, ভারতীয় আর চৈনিক - আজ তাদের কি দশা? মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ আধুনিক ইরাক এবং তৎসংলগ্ন দুটি দেশ আর পারস্য অর্থাৎ কমবেশি আধুনিক ইরান তলোয়ারের চোট সামলাতে না পেরে তাদের আদিম উন্নত উদার সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে মরুভূমির অনুন্নত বেদুইন সংস্কৃতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে এখনো বসে আছে। একই দুর্দশা অখন্ড ভারতের পশ্চিমপ্রান্তের অর্থাৎ গান্ধার বা আধুনিক আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান ও পাকিস্তানের এবং ভারতের পূর্বপ্রান্ত অর্থাৎ বাংলাদেশের। তারপরের ভূভাগ, যেখানে যেখানে ভারতীয় সভ্যতার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল অর্থাৎ মায়ানমার থেকে নিয়ে লাওস কাম্বোডিয়া ভিয়েতনাম থাইল্যান্ড হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্য্যন্ত অথবা সমুদ্রপারের শ্রীলঙ্কা ও মলদ্বীপে, সেখানে পূজা পদ্ধতি পাল্টে গেলেও ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়নি। আর বাকি থাকে চিন - ওঁরা যে কি চান সেটা ১৯৫০ থেকে ওঁরা খুঁজেই চলেছেন এবং ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব থেকে তিব্বতকে বের করে এনে একটা অধার্মিক ভোগবাদী যাপনের দিকে ঠেলে দেওয়ার নিষ্ফল প্রচেষ্টা ক্রমাগত চালিয়ে যাচ্ছেন। এই বিপরীত পরিস্থিতিতে একমাত্র ভারতের একটি বিরাট ভূভাগ যে এখনো নিজের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে তার কারণ তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধর্ম। এখনো পুষ্করে কাশীতে প্রয়াগরাজে ঋষিকেশে এবং অজস্র প্রাচীন ছোট বড় জনপদে আধুনিক মানুষ বাস করেন, তাঁদের পূর্বপুরুষের জীবনবোধ নিজেদের মধ্যে ধারণ করেন, আর নিজেদের সামাজিক ও ধার্মিক উত্তরাধিকারকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হস্তান্তর করতে করতে চলেন। ফলে একমাত্র এই ভারতীয় সভ্যতাই এখনো বাস্তবে চলমান, যাকে মধ্যযুগীয় মরুদস্যুরা হিন্দুসভ্যতা বলতো, এখন আমরাও বলি।

স্বামীজী বলেছিলেন, "ভিখারির আবার ত্যাগ কি? আগে সব পাও, তারপর মায়ামুক্ত বৈদান্তিকের উদাসীনতায় সব লাথি মেরে ফেলে দাও।" বলেছিলেন, "আগে ভেতরের শক্তি জাগ্রত করে দেশের লোককে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করা, উত্তম অশন-বসন -- উত্তম ভোগ আগে করতে শিখুক, তারপর সর্বপ্রকার ভোগের বন্ধন থেকে কি করে মুক্ত হতে পারবে, তা বলে দে"। এই হলো শাশ্বত ভারতবর্ষের শিক্ষা - ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ - in that order. কাঁঠাল ভাঙার আগে হাতে তেল না মাখলে বা পাঁকাল মাছ ধরার আগে হাতে ছাই না মাখলেই বিপদ। জীবন কোন মানক অনুযায়ী চলবে? না, ধর্ম। ওটা হলো shield, স্বার্থপরতা বা লোকঠকানি কাজ করতে গেলেই মনের মধ্যে অঙ্কুশ মারবে, হাত চেপে ধরবে, নিজের ওপর ধিক্কার জন্মাবে। ঠাকুর বলেছিলেন স্বাত্ত্বিকের সংসার হবে শিবের সংসার। পন্ডিত ভীমসেন জোশির একটি বিখ্যাত ভজন আছে 'যো ভজে হরি কো সদা', ওখানে একটি স্তবক আছে - দিল কে দর্পন কো সমাহকর দূর কর অভিমান কো / খাক হো গুরু কে কদম কি তো প্রভু মিল যায়েগা। এই হলো শিবের সংসার। অহংকার থাকলেই বাসনা থাকবে, আর বাসনা থাকলেই অশান্তি থাকবে তাই শান্তি পেতে গেলে সবার আগে মনের মধ্যেকার অহংবোধ নাশ করো। 

আমি কিছু নই, সব তুমি। আমার কিছু নেই, সব তোমার। আমি খাচ্ছি না, তুমি খাচ্ছ। আমি পরছি না, তুমি পরছো। ভোগ যা কিছু হচ্ছে সে সব তোমার ইচ্ছায় হচ্ছে, আমার বলে কিছু নেই। তোমার মধ্যে আমি আছি তাই আলাদা করে 'আমি' বলে কেউ নেই। খাক মানে বিভূতি, আশীর্বাদ। যিনি মানুষের শরীর-মন-বুদ্ধি দিয়ে আত্মাবিষ্কার করতে এই জগতে পাঠিয়েছেন তিনিই সদগুরু জুটিয়ে দেবেন আর সেই গুরু শিখিয়ে দেবেন ভোগের বন্ধন থেকে কি করে মুক্ত হতে পারা যায়। একবার বাসনা মুক্ত হতে পারলেই কেল্লা ফতে - 'প্রভু মিল যায়েগা'। এই হলো ভারতের সনাতন সংস্কৃতি, ত্যাগের সংস্কৃতি, ত্যাগের মাধ্যমে যোগের সংস্কৃতি। কি ত্যাগ? 'আমি' ত্যাগ। কার সাথে যোগ? সবার সাথে কারণ 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম'। আমাদের সমসাময়িক বাকি প্রাচীন সভ্যতাগুলির এই বৈশিষ্ট্য না থাকার কারণেই তারা আজ বিধ্বস্ত। আমরা আছি কারণ আমাদের ধর্মবোধ সনাতন, শাশ্বত, শুদ্ধ। যেদিন ত্যাগ থাকবে না সেদিন হিন্দুসভ্যতাও থাকবে না। এটা বাকিরা জানেন, তাই তারা বারবার আমাদের সভ্যতার মূলে আঘাত করার চেষ্টা করেন কিন্তু অসফল হন। যতই তারা লোভ দেখিয়ে আমাদের ভোগের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চান না কেন, আমরা সে সব অভিজ্ঞতা উপভোগ করেটোরে, একসময় তার অসারতা উপলব্ধি করে ঠিক টুক করে সরে আসি। এটাই আমাদের সভ্যতার শক্তি। কত ism তো এলো গেল, উপনিষদ কিন্তু তার জায়গাতে সেই থেকেই গেল। ফলে ইহকালের সম্পদ আর পরকালের সুখ আমাদের অনেককেই খুব বেশিদিন প্রলোভিত করতে পারেনা। আবার কিছু লোককে করেও। তাদের জন্যই আজ দেশে এত সমস্যা।

ভারত পুণ্যভূমি, ধর্মভূমি। গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন আশ্রমের মাধ্যমে ঋষিরা প্রমান করে গেছেন যে সারা ভারতবর্ষ একটা বৃহৎ সাধনপিঠও বটে। আধুনিক ভারতকে পথ দেখাবার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেবের চেয়ে বড় সদগুরু তো আর কেউ নেই, তাই তাঁর কথাতেই ফিরে যেতে হয়। ঠাকুর বলছেন,
"সংসারে থাকবে না তো কোথায় যাবে? 
আমি দেখছি যেখানে থাকি, রামের অযোধ্যায় আছি। 
এই জগৎসংসার রামের অযোধ্যা। রামচন্দ্র গুরুর কাছে জ্ঞানলাভ করবার পর বললেন, আমি সংসারত্যাগ করব। দশরথ তাঁকে বুঝাবার জন্য বশিষ্ঠকে পাঠালেন। 
বশিষ্ঠ দেখলেন, রামের তীব্র বৈরাগ্য। তখন বললেন, 
“রাম, আগে আমার সঙ্গে বিচার কর, তারপর সংসারত্যাগ করো। আচ্ছা, জিজ্ঞাসা করি, সংসার কি ঈশ্বর ছাড়া? তা যদি হয় তুমি ত্যাগ কর।” রাম দেখলেন, ঈশ্বরই জীবজগৎ সব হয়েছেন। তাঁর সত্তাতে সমস্ত সত্য বলে বোধ হচ্ছে। তখন রামচন্দ্র চুপ করে রইলেন।
“সংসারে কাম, ক্রোধ এই সবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, নানা বাসনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, আসক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। 
যুদ্ধ কেল্লা থেকে হলেই সুবিধা। 
গৃহ থেকে যুদ্ধই ভাল; — খাওয়া মেলে, ধর্মপত্নী অনেকরকম সাহায্য করে। 
কলিতে অন্নগত প্রাণ — অন্নের জন্য সাত জায়গায় ঘুরার চেয়ে এক জায়গাই ভাল। 
গৃহে, কেল্লার ভিতর থেকে যেন যুদ্ধ করা।

“আর সংসারে থাকো ঝড়ের এঁটো পাত হয়ে। 
ঝড়ের এঁটো পাতাকে কখনও ঘরের ভিতরে লয়ে যায়, কখনও আঁস্তাকুড়ে। হাওয়া যেদিকে যায়, পাতাও সেইদিকে যায়। কখনও ভাল জায়গায়, কখনও মন্দ জায়গায়! 
তোমাকে এখন সংসারে ফেলেছেন, ভাল, এখন সেই স্থানেই থাকো — আবার যখন সেখান থেকে তুলে ওর চেয়ে ভাল জায়গায় লয়ে ফেলবেন, তখন যা হয় হবে।”
“সংসারে রেখেছেন তা কি করবে? সমস্ত তাঁকে সমর্পণ করো — তাঁকে আত্মসমর্পণ করো। তাহলে আর কোন গোল থাকবে না। তখন দেখবে, তিনিই সব করছেন। সবই রামের ইচ্ছা।”

রোজ রোজ অশান্তির পর

এ আঁধার কেটে যাবে,
কেটে যাবে অনভ্যাসের ভয়।
ছত্রাখান হয়ে যাবে যত রাবণের দরবার -
একবার, শুধু একবার আসুক সে সময়।

ধৈর্য্য ধরো। সহ্য করো, যতক্ষণ পারো।
আমি দেখতে পাচ্ছি বানরসেনার সাজ।
তুমিও পাবে, জমিতে কান পাতো।
দাদামা বাজছে, ওই শোনো দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজ।

মহাবীরের ল্যাজে যারা আগুন লাগায়
তারা কি চেয়েছিল স্বর্ণলঙ্কা পুড়ে হোক খাক?
জানলে নিশ্চয় দুহাত তুলে রাজাকে বলতো
জাঁহাপনা, বিরাট যতদিন ছোট হয়ে থাকে, থাক।

১১ই জুন, ২০২২
কলকাতা

Monday, June 6, 2022

বিবাদের প্রয়োজন নেই

আমাদের দেশ এই সময়ে মহাশক্তি হিসেবে উত্থিত হত্তয়ার মহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে আর এই বিষয়টি এখনকার মহাশক্তিদের ভালো লাগার কথা নয়। বড়জোর আর পনেরো বছর, তারপরে ভারতবর্ষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশীদারি ছাড়া সারা বিশ্বজুড়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটা বা ঘটানো আর সম্ভব হবে না। এমতবস্থায় ভারত কি বলছে, কেমনভাবে বলছে, কি করছে আর কেমনভাবে করছে, অথবা কি বলছে না বা কি করছে না, সমস্ত কিছুই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন স্তরে প্রতিনিয়ত অতসকাঁচের তলায় ফেলে দেখা হচ্ছে কারণ ভবিষ্যতের আঁচ ইতিমধ্যে সবাই পেয়েই গেছেন। এই মুহূর্তে আমরা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র, পিপিপি অনুযায়ী বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এবং নমিনাল জিডিপি অনুযায়ী পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি, সামরিক শক্তিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সেনার অধিকারী আর সংস্কৃতির দিক দিয়ে পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবন্ত সভ্যতা। গত আট বছর দেশ যেভাবে প্রগতি করেছে, আগামী আট বছরে যদি সেই ধারা বজায় থাকে, এই দশকের শেষে আমাদের এতদিনকারপরিচিত ভারতবর্ষ দেখতে শুনতে একদম অন্যরকম হয়ে যাবে।

আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশের এই যে এত দ্রুত এগিয়ে যাওয়া, এ দৌড়ের মধ্যে নানারকমের টানাপোড়েন থাকবে না তা কি কখনো হয় নাকি? স্বাভাবিকভাবেই বিরুদ্ধ মত থাকবে, বিরোধাভাস থাকবে, বিরোধিতাও থাকবে, আবার সহমত থাকবে, সহযোগিতা থাকবে, সম্পৃক্ততাও থাকবে। এই বৈচিত্রময় দেশীয় সমাজের যে মূল চরিত্র, 'বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান', সেটা সর্বোপরি রেখেও আমরা কিন্তু বিশ্বকে নানা ভাষা, নানা বর্ণ, নানা পন্থ ছাপিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে একটা বহু-অংশে সমন্বিত বার্তা দিয়ে আসছি, আর তা হলো শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের। রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে সরকারের গান্ধী ভজনা ওই ন্যারেটিভেরই একটা অংশ। সত্যাসত্য যাই হোক না কেন, বিশ্বজুড়ে অহিংসার পূজারী হিসেবে গান্ধীর একটা ব্যতিক্রমী সদর্থক ভাবমূর্তি আছে আর সমস্ত দেশনেতাই সেটা কাজে লাগিয়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। না করাটাই বরং বেকুফি।

যত দিন যাচ্ছে, দেশে গণতন্ত্র তত সুদৃঢ় হচ্ছে অর্থাৎ উচ্চশিক্ষিত এবং বড়লোকদের হাত থেকে অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত এবং গরিবদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হচ্ছে। আমাদের দেশে যেহেতু ম্যাকলের অভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাই এতদিন বলবৎ ছিল, ফলে যাঁরা উচ্চশিক্ষিত, তাঁদের মধ্যে সনাতন ভারতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে স্বীকার করে নেওয়ার প্রবণতাই বেশি ছিল। গ্রামীন অবিত্তশালী ভারতে পারম্পরিক রীতিনীতি, পৌরাণিক উপদেশ, রামায়ণ মহাভারতের আখ্যান, ভক্তি-বিশ্বাস, সনাতন ধর্মবোধ ইত্যাদির প্রভাব থাকলেও শহরগুলোতে যেন এর একেবারে বিপরীতধর্মী পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত বৌদ্ধিকস্তরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মূলতঃ শহরভিত্তিক হওয়ার ফলে এই তথাকথিত সংখ্যালঘু শ্রেণীর দ্বারা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া মেকি সেক্যুলারিজম সারা দেশের আমজনতা এতদিন মেনে চলতে বাধ্য হতেন, যদিও তাঁরা সংখ্যায় অভিজাতদের চেয়ে চিরকালই অনেক অনেক বেশি। 

এই এলিটদের টাকা বেশি, ফলে সমাজে তাঁদের খবরদারিও চলতো বেশি। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে এঁরাই এতদিন ভারতের রাজনীতি চালিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে সময়ের সাথে সাথে সামাজিক সশক্তিকরণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সেই কাঠামোটা ভেঙে গিয়ে সার্বজনীন হয়ে পড়েছে আর তাই দেশজুড়ে এখন এত বেশি সনাতন সংস্কৃতি আর ধর্মবোধের উন্মেষ দেখা যাচ্ছে। বিদেশি মানসিকতার শিকার কারো কারো হয়তো মনে হতে পারে এটা majoritarianism, কিন্তু আদপেই তা নয় - এটা সংখ্যাগরিষ্ঠের কন্ঠস্বর, যা এতদিন জোর করে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অতি উচ্চবংশজাত বা গরিবঘরের হলেও আইভি লীগ এবং অক্সফোর্ডের স্নাতকোত্তর থেকে নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী রেল স্টেশনের চাওয়ালার ছেলে, মা লোকের বাড়িতে সহায়িকার কাজ করতেন, প্রান্তিক এবং অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষ, অনেক বেশি বয়সে স্নাতক হয়েছেন, আর এটা আমাদের গণতন্ত্রের গৌরব যে তিনি ওই জায়গা থেকে উঠে এসে আজ এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছেন - এই বোধটি কিন্তু জনগণের একটা মস্ত বড় মানসিক ক্রান্তির পরিচায়ক। আর এই প্রধানমন্ত্রী আবার মুখে গান্ধীর নাম জপতে জপতে রাজপথে সুভাষচন্দ্রের মূর্তি বসিয়ে দেন আর টাকায় গান্ধীর সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথ আর এপিজে আব্দুল কালামের ছবি ছাপার ব্যবস্থাও করে ফেলেন, যা কিছু বছর আগে অবধি ভাবাই যেত না।

ভারতীয় সমাজের একটা সুবিধা হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে সে তর্ক আর বিতর্ক করে এসেছে কিন্তু মতের অমিল হলে কাউকে মারতে যায়নি। সংবাদ আর বিবাদ আমাদের সভ্যতার উত্তরাধিকার আর ভাবের এই সুস্থ আদানপ্রদানের ফলেই জাতি হিসেবে সমৃদ্ধ ও উন্নত হতে হতে মাত্র আটশ বছর আগে পর্য্যন্ত ধর্মবোধের নিরিখে আমরা বিবর্তনের শিখরে ছিলাম। এমনকি আমরা যুদ্ধও করতাম মানবিক নিয়ম মেনে, ছলচাতুরী করে যুদ্ধজয় সমাজে ঘৃণিত অপরাধ বলেই গণ্য হতো। দুর্ভাগ্যবশত ঘরশত্রু জয়চাঁদদের জন্য একসময় আমরা বিদেশি আক্রমণকারীদের কাছে হেরে যাই বটে কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই ধর্মবোধ অন্তঃসলীলা ফল্গুধারার মতো সমাজের মধ্যে ঠিকই বয়ে চলেছিল, কোনো আঘাত বা আক্রমণই তাকে শেষ করতে পারেনি। এই ধর্মবোধকেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন 'ভারতের অন্তরাত্মা'। এটা এতদিন সুপ্ত ছিল, এখন আম ভারতের হাত ধরে ভারতীয়ত্বের পুনরুত্থানের সাথে সাথে তা আবার জেগে উঠছে।

স্বাধীনতাত্তরকালে দেশের রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, পন্থীয় সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন ও নাগরিক সমাজ যে ভাবে ভাবতে বা পথ চলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, এখন সামগ্রিকভাবে দেশে ভারতীয় সভ্যতার মূলে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্খা দেখা দেওয়ায় তাঁরা নতুন করে রাস্তা খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অচলায়তন ভেঙে পড়াকে কেউ কেউ অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি হিসেবে দেখলেও, আসলে এটা একটি বিজিত জাতির নিজেকে স্বাধীনভাবে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার প্ৰচেষ্টা। এতদিন সব যেন কেমন জট পাকিয়ে গিয়েছিল, এক একটা করে দড়ি টেনে টেনে সমাজ এখন সেই জট খোলার চেষ্টা করছে। পন্থীয় সংগঠন আর সামাজিক সংগঠন কি একই সীমিত ভাষায় কথা বলবে, বা সামাজিক সংগঠনের বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থাকা উচিত না অনুচিত অথবা রাজনৈতিক সংগঠন কেবল বিশেষ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবে নাকি রাজধর্মের নিরিখে ধর্মত যা সঠিক, সেই রাস্তায় চলবে আর আধুনিক জীবনশৈলীতে সনাতন ধর্মসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তিকরণে ধর্মীয় সংগঠনের ভূমিকাই বা কি হবে - নতুন করে সকলের কর্তব্য অকর্তব্য আর সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন শুরু হয়ে গেছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। সময়টা অস্থির, ভুলভ্রান্তি হওয়াও স্বাভাবিক। তবে এই মন্থনের মধ্যে থেকেই যে নতুন করে সনাতন ভারতের অন্তরাত্মার পুনরুদ্ধার হবে, সেই বিষয়ে কিন্তু কোনো দ্বিমত নেই।

আগামী দেড়দশকের কালখন্ডটি বিশ্বজুড়ে ভারতবর্ষের গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়ানোর পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো মন্থনের সময় কিছু প্রতিরোধ হবেই, অমৃত পেতে গেলেও আগে গরলই উঠে আসে। সেই সমস্ত শ্রেণী যাঁরা এতদিন সমাজকে নির্দেশ দিতেন, তাঁরা নির্দেশিত হতে পছন্দ করবেন না, তা বলাই বাহুল্য। আর যাঁরা বিশেষ অধিকার ভোগ করে এসেছেন, তাঁরা যে সর্বশক্তি দিয়ে সেগুলি রক্ষা করার চেষ্টা করবেন এবং প্রয়োজনে বিধ্বংসী হয়ে উঠবেন, সেটাও অপ্রত্যাশিত নয়। এটা অধৈর্য্য হয়ে ওঠার সঠিক সময় নয়, এই সময়টিতে ধৈর্য্য ধরে মুখ বন্ধ রেখে চুপচাপ কাজ করে যাওয়াটা ভীষণ জরুরি। যা বললে বিবাদ আরো বাড়বে, সেটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলার দরকারটা কি? বললে কি কাজ হয়ে যাবে নাকি আসলে করলে তবেই হবে? বৃহত্তর সমাজ যখন তাঁদের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে ফেলেছেন, তখন এতবড় শক্তিকে দাবিয়ে দিতে পারবে, এমন ক্ষমতা বিশ্বের কারো নেই। নিজেদের ওপর কি আমাদের এতটুকুও ভরসা থাকবে না যে দুর্বলের প্ররোচনায় প্রভাবিত না হয়ে সবলের যৌথ নম্রতায় আমরা নির্বিবাদে আমাদের অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারবো? তবে অভীষ্ট কি সেই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে তবেই কিন্তু বিবাদকে প্রথমে সংবাদ আর তারপর স্বীকৃতিতে বদলে ফেলানো যায়। মনে রাখা দরকার যে ইতিহাস থেকে যেমন প্রবৃত্তি তৈরি হয় তেমনি প্রবৃত্তিরও একটি ইতিহাস থাকে এবং প্রবৃত্তি, প্রকৃতি ও পরম্পরা এক জিনিস নয়।

Saturday, June 4, 2022

শান্ডিল্য

আমার গোত্র শান্ডিল্য। নারদীয় ভক্তিসূত্র পড়তে পড়তে যখন ১৮ নং সূত্রে শান্ডিল্যের নাম পেয়েছিলাম, স্বভাবতই উৎসুক্য জেগেছিল তাঁর সম্পর্কে জানার এবং তাঁর লেখা পড়ার। এমনিতেই 'শান্ডিল্য ভক্তিসূত্র' এবং সেই সম্পর্কিত স্বপ্নেস্বরের ভাষ্য পড়ার ইচ্ছা অনেকদিন ধরেই মনের মধ্যে সুপ্ত ছিল, কিন্তু ছাপার অক্ষরে ওই নামটা দেখে এবং পরম পূজনীয় স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজকৃত সূত্রটির ব্যাখ্যা পড়ে আমার পূর্বপুরুষকে যিনি আলোর পথ দেখিয়েছিলেন, তাঁর সম্পর্কে জানাটা আগে দরকার বলে মনে হয়েছিল। আর এই পরিচয় খুঁজতে গিয়েই পুরো ঘেঁটে গেছি। 

শান্ডিল্য একজন নন, একাধিক। এবং যুগে যুগে যেমন নতুন এক একজন মনু, তেমনি শান্ডিল্যও এক এক যুগে এক একজন। ত্রেতাযুগে একজন শান্ডিল্য আছেন যিনি রাজা ত্রিশঙ্কুর পুরোহিত, আবার আর একজন আছেন যিনি রাজা দিলীপের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক এবং দীক্ষাগুরু। দ্বাপরেও একজন শান্ডিল্য আছেন, যিনি যাদবদের রাজা নন্দের পুরোহিত। আবার কলিতেও শান্ডিল্য আছেন, তাও আবার একাধিক জন - কখনো তিনি শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের সাথে শাস্ত্রালাপ করছেন আবার কখনো রাজা জন্মেজয়ের ছেলে শতানীককে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করাচ্ছেন।

এখন এই নানান শান্ডিল্যদের timelineটি কি ভয়ঙ্কর গোলমেলে, বলছি শুনুন। ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা ত্রিশঙ্কু হলেন শ্রীরামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ, কুলগুরু বশিষ্ঠের শিষ্য এবং গায়ত্রীমন্ত্র সহ ঋগ্বেদের তৃতীয় মন্ডলের মন্ত্রদ্রষ্টা ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের সমসাময়িক কারণ তাঁকে দিয়ে নিজের জন্য তিনি একটি alternate স্বর্গ তৈরি করিয়েছিলেন। আর ওই বংশেরই রাজা দিলীপ হলেন রাজা দশরথের প্রপিতামহ। দিলীপের পুত্র রঘু, রঘুর পুত্র অজ ও অজের পুত্র দশরথ। এখন ত্রিশঙ্কু থেকে নিয়ে রামচন্দ্র পর্য্যন্ত কুলগুরু কিন্তু সেই বশিষ্ঠমুনি, অর্থাৎ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে তিনিও একজন ব্যক্তি নন। তারপরের মহাভারতের যুগে রাজা জন্মেজয় হলেন রাজা পরীক্ষিত ও রাণী মদ্রবতীর জ্যেষ্ঠপুত্র, অভিমন্যুর পৌত্র এবং অর্জুনের প্রপৌত্র। পরীক্ষিতের মৃত্যুর পর মন্ত্রীরা তাঁকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন, এ মহাভারতের যুদ্ধের অনেক পরের ঘটনা। এবার, জন্মেজয়ের ছেলে শতানীক, মানে মহাভারতের যুদ্ধ এবং ভীষ্মের শরশয্যা শেষ হয়ে যাবার পর তৃতীয় প্রজন্মের রাজা। এতগুলো যুগ ধরে এবং এক এক যুগে নানা প্রজন্ম ধরে একই শান্ডিল্যমুনি বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন, এটা কোনোমতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ তো গেল একটা দিক।

এবার আসি লেখালেখির দিকটায়। বৃহদাকরণ্য উপনিষদে তিনজন শান্ডিল্যের কথা আছে, ছান্দগ্য উপনিষদে আছে 'শান্ডিল্য বিদ্যা' নামক একটি অতি মূল্যবান রচনাংশ আর খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে পঞ্চরাত্র তত্বের অংশ হিসেবে আরো একজন শান্ডিল্যের ভক্তিসূত্র পাওয়া যায়, যে দর্শনের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে অগমশাস্ত্রের মূল প্রবক্তা মাধবাচার্য্য এবং রামানুজ বৈষ্ণবীয় ধারাকে popularise করেছিলেন। এই পঞ্চরাত্র তত্ব থেকেই কিন্তু অবতারবাদের উৎপত্তি। আর শান্ডিল্য সংহিতা এবং শান্ডিল্যপনিষদের লেখক যে কোন শান্ডিল্য, বলা খুব মুস্কিল। তবে এসব বড়জোর হাজার তিনেক বছর আগেকার কথা, আর ভাগবৎ রচনার কয়েক'শ বছর আগের কথা তো বটেই। তাহলে গুরু খুঁজতে গিয়ে গরু খোঁজা হয়ে গেল, তাই তো? এটুকু বেশ বুঝতে পারছি যে ভক্তিসূত্রের শান্ডিল্য আর আমার গোত্রের সূত্রধর ঋষি শান্ডিল্য এক নন। খুব সম্ভবতঃ ছান্দগ্য উপনিষদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিই হলেন সেই বিরল শিক্ষক, যিনি আমার পূর্বপুরুষকে নিজের ঋদ্ধির দ্বারা সমৃদ্ধ করেছিলেন, যে কারণে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে তাঁর নাম আজও আমারা নিজেদের কূলের পরিচয়সূচক হিসেবে বহন করে চলেছি। 

সেই ঋষি তাঁর 'শান্ডিল্য বিদ্যা'র পরপর চারটি শ্লোকে অদ্বৈত বেদান্তের সার বলেছেন,
सर्वं खल्विदं ब्रह्म तज्जलानिति शान्त उपासीत । 
अथ खलु क्रतुमयः पुरुषो यथाक्रतुरस्मिँल्लोके पुरुषो भवति तथेतः प्रेत्य भवति स क्रतुं कुर्वीत ॥ १ ॥
1. All this is Brahman. From It the universe comes forth, in It the universe merges and in It the universe breathes. Therefore a man should meditate on Brahman with a calm mind. Now, verily, a man consists of will. As he wills in this world, so does he become when he has departed hence. Let him with this knowledge in mind form his will. 
मनोमयः प्राणशरीरो भारूपः सत्यसङ्कल्प आकाशात्मा सर्वकर्मा सर्वकामः सर्वगन्धः सर्वरसः सर्वमिदमभ्यत्तोऽवाक्यनादरः ॥ २ ॥
एष म आत्मान्तर्हृदयेऽणीयान्व्रीहेर्वा यवाद्वा सर्षपाद्वा श्यामाकाद्वा श्यामाकतण्डुलाद्वैष म आत्मान्तर्हृदये ज्यायान्पृथिव्या ज्यायानन्तरिक्षाज्ज्यायान्दिवो ज्यायानेभ्यो लोकेभ्यः ॥ ३ ॥
2-3. He who consists of the mind, whose body is subtle, whose form is light, whose thoughts are true, whose nature is like the akasa, whose creation in this universe, who cherishes all righteous desires, who contains all pleasant odours, who is endowed with all tastes, who embraces all this, who never speaks and who is without longing— He is my Self within the heart, smaller than a grain of rice, smaller than a grain of barley, smaller than a mustard seed, smaller than a grain of millet; He is my Self within the heart, greater than the earth, greater than the mid—region, greater than heaven, greater than all these worlds. 
सर्वकर्मा सर्वकामः सर्वगन्धः सर्वरसः सर्वमिदमभ्यात्तोऽवाक्यनादर एष म आत्मान्तर्हृदय एतद्ब्रह्मैतमितः प्रेत्याभिसंभवितास्मीति यस्य स्यादद्धा न विचिकित्सास्तीति ह स्माह शाण्डिल्यः शाण्डिल्यः ॥ ४ ॥
4. He whose creation is this universe, who cherishes all desires, who contains all odours, who is endowed with all tastes, who embraces all this, who never speaks and who is without longing—He is my Self within the heart, He is that Brahman. When I shall have departed hence I shall certainly reach Him: one who has this faith and has no doubt will certainly attain to that Godhead. Thus said Sandilya, yea, thus he said.

Thursday, June 2, 2022

বাঙালিকে সভ্য করতেই হবে



অধিকাংশ বাঙালি যাঁদের ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, যাঁদের গুণমুগ্ধ, বেছে বেছে তাঁদেরই গালি দিতে হবে। কিছু বাঙালি নামধারীদের মাথায় গজাল মেরে ঢুকিয়ে দাও যে বাঙালি বুদ্ধিজীবী মানেই দেশের শত্রু আর তারপর তাদের বাজারে ছেড়ে দাও একধারসে সব বাঙালির পছন্দের মানুষকে হেয় করতে। তা সে আইকনিক ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির গৌতম চট্টোপাধ্যায়ই হোন বা কবিদের উত্তমকুমার শঙ্খ ঘোষ, নাথবতী অনাথবৎ-এর শাঁওলি মিত্রই হোন বা সদ্যপ্রয়াত জনপ্রিয় সাংবাদিক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এদের পেরিনিয়াল লাভ হলেন অমর্ত্য সেন, যাঁর বিরুদ্ধে যত বেশি কুকথা বলা হয়, উচ্চশিক্ষিত ও বিশ্ববন্দিত বাঙালিদের প্রতি স্বভাবত শ্রদ্ধাবান মধ্যবিত্ত মধ্যমেধার বাঙালি তত বেশি ক্ষেপে যায়। 

এখানে বঙ্কিমচন্দ্র নিয়ে সেমিনারে কিই-নোট এড্রেস কোনো বাঙালি বঙ্কিম-বিশারদকে দিয়ে মোটে দেওয়ানো যাবে না, বাইরে থেকে অবাঙালি অপ্রবুদ্ধ নেতা ধরে আনতে হবে কারণ সেখানে তাঁর ইমেজ বিল্ডিংই হলো আসল। ভাষণটা কিন্তু নির্ঘাত কোনো বেতনভুক চামচে প্রবাসী বাঙালিরই লিখে দেওয়া। কেবল এই অবধি হয়ে থেমে গেলেও হতো। কোটি কোটি বাঙালির আস্থা যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে জড়িয়ে আছে, এরা তাদেরও হেয় করতে ছাড়ে না। রামকৃষ্ণ মিশন কেন যীশুপুজো করলেন বা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ কেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানালেন - শুরু হয়ে গেল বিদ্রুপ আর কটাক্ষ। শ্রীশ্রীঅনুকূল ঠাকুর হলে তো কথাই নেই, নোংরামির একশেষ। যা যা করলে বহু বাঙালি বিরক্ত হয় সেগুলোই বেশি বেশি করে করতে হবে কারণ এটাই নাকি বাঙালির 'সাচ্চা' প্রতিনিধিত্ব! 

আসলে বাঙালি হলো এক ওপরচালাক নির্বোধ জাতি তো, সে ৫০০ টাকার জন্য মেরুদন্ড বিকিয়ে দেয়, তার মোল্লাপ্রীতি তুলনাহীন, তার কোনো জাত্যাভিমানই নেই। অর্থাৎ বাঙালি একটি সাব-ন্যাশনালিসমে আচ্ছন্ন উচ্ছন্নে যাওয়া জাত এবং তার পছন্দের মানুষগুলোও পাতে দেওয়ার যোগ্যি নয় - অথচ সেই অসভ্য বাঙালিরই সমর্থন চাই! তারপর রয়েছে বুদ্ধিমানদের বানানো বাঙালিকে জাগানোর চূড়ান্ত মাস্টারপ্ল্যান।  এমনিতে তো আর এই অধঃপতে যাওয়া জাতকে জাগানো যাবে না, ছাগলগুলো মাঝেমাঝে যত বেশি সংখ্যায় মরে, যত বেশি ঘরছাড়া হয়, যত অত্যাচারিত হয়, তত মঙ্গল। মরুক মর্কটগুলো, পাশে দাঁড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। বলির রক্ত দেখে দেখে যদি এই 'কাঙ্গালি' বাঙালিগুলোর কিছুটা হলেও টনক নড়ে! ততক্ষণ যারা মারছে তাদের খোলা ছুট।

ও হ্যাঁ, বাঙালিকে কিছুতেই বিশ্বাস করা যাবে না, কিছুতেই যাবে না, মহাবদমাইশ এই জাত। ইংরেজদের দেশে গিয়ে নতুন করে সংসদীয় গণতন্ত্র শিখে এসে এরা ওই ইংরেজদেরই পেছনেই বাঁশ দিয়েছিল। ইংরেজদের হাতে ট্রেনিং প্রাপ্ত সেনা নিয়ে ইংরেজদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল। একটু জায়গা পেয়েই স্বয়ং গান্ধীজিকে তুড়ি মেরে হারিয়ে দিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল আর সিন্ধীরা যখন ভয়ে নিজেদের ভাষা ভুলে গিয়ে চুপচাপ উর্দু হজম করছিলেন, এই ছাগল বাঙালিগুলো প্রথমে শিলচরে আর তারপর ঢাকায় নিজেদের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য জান দিয়ে হক ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল। 
এরা সেই বস্তু যারা ইংরেজের কাছে কেমিস্ট্রি পড়ে, ফর্মুলা শিখে, বোমা বানিয়ে 'জয় মা কালী' বলে ইংরেজের ওপরেই ছুঁড়তো, কি ডেঞ্জারাস জাত ভাবুন একবার! 

এদের কোনোমতে মাথায় উঠতে দেওয়া যাবেনা, এদের কেউ নেতা হয়ে গেলেই বিপদ। ক্রমাগত বলে যেতে হবে বাঙালির সব খারাপ - বাঙালি কবি খারাপ, বাঙালি নাট্যকার খারাপ, বাঙালি শিল্পী খারাপ, বাঙালি আমলা খারাপ, বাঙালি সাংবাদিক খারাপ, বাঙালির মনন এবং মানসিকতা - সব খারাপ। কবি জয় গোস্বামী হাসপাতালে ভর্তি হলে তাঁকে দেখতে যাওয়া তো দূরের কথা, ক্রমাগত গালি দিয়ে যেতে হবে। বুদ্ধবাবু এখনো বহু বাঙালির সফ্টস্পট, তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলেও একই ব্যাপার। সোনিয়া গান্ধী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে যা করেছিলেন, সেটা অবশ্যই শিক্ষণীয় নাহলে এতদিনে গান্ধী পরিবারকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে কংগ্রেস হয়তো আবার নিজস্ব শক্তি সঞ্চয় করে ফেলতো। ইংরেজের যেমন ম্যাকলে ছিল, অমন আরো একপিস চাই যিনি এসে শেখাবেন যে সভ্যতার পিঠস্থান থেকে মহামতি আর্য্যরা এসে বন্য অসভ্য বঙ্গবাসীকে সভ্যতার আলো দেখিয়েছিলেন। যেদিন ওই লেভেলের একটা বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে, সেদিনই কেল্লাফতে। চলুন সবাই মিলে খুঁজি। তার আগে প্রবাস নিবাস বৈঠক ভোজন বিশ্রাম কোনোকিছুরই যে মনমতো বিস্তার করা যাচ্ছে না।

একটা কথা না বলে শেষ করলে পাপ হবে। যে বাঙালি দেশকে স্বাধীন করানোর জন্য সবচেয়ে আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যে বাঙালি কোনোদিন নিজের প্রাণের মায়া করেনি, যে বাঙালি নিজের হিন্দু সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে সহ সর্বস্ব জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতে চলে এসেছিল, আজ সেই যুগান্তর অনুশীলনের বাঙালিকে রাষ্ট্র্ববাদ শেখানোর জন্য বাইরের মাষ্টার দরকার পড়ছে, ভাবলেই কেমন যেন শিহরণ জাগে।


Wednesday, June 1, 2022

মায়ের চলে যাওয়া

"সহসা দারুণ দুখতাপে  
সকল ভুবন যবে কাঁপে,
সকল পথের ঘোচে চিহ্ন   
সকল বাঁধন যবে ছিন্ন,
মৃত্যু-আঘাত লাগে প্রাণে -
তোমার পরশ আসে কখন কে জানে॥"

আমরা দীর্ঘ দুঃখপথের সহযাত্রী ছিলাম, আমি আর আমার মা। সে দুঃখের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত সাহচর্যসুখ ছিল তার অর্ধেকটা বারোদিন আগে দাহ করা হলো। আর সেই সাথে স্মৃতি হয়ে গেল নিজের সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা গত শতাব্দীর একটি সেতার বাজানো গাড়ি চালানো লায়ন্স ক্লাবের মধ্যমনি আধুনিকার সর্বংসহা জননী হয়ে ওঠার বিবর্তনের ইতিহাস।

মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল অবস্থা থেকে হটাৎ একসময় খুব কঠিন আর্থিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে মায়ের মাতৃত্ব আর আমার পুত্রত্ব বোধহয় একই সাথে একটু অন্যভাবে পুনর্বিকশিত হয়েছিল। বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর ফ্যামিলি পেনশন পেতে মাত্রাতিরিক্ত দেরি হওয়ার কারণে অত্যন্ত সীমিত সাধ্যের মধ্যে সেইসময় মা আমায় গড়ে তুলতে শিখছিলেন, বোধহয় খানিক নিজেকেও। 

আমরা দুটি প্রাণী মাসের শেষে অনেকদিনই একটি সেদ্ধ ডিমকে সুতো দিয়ে দুভাগ করে খেয়েছি বা দুটুকরো মাছ নিয়ে একে অপরকে অপেক্ষাকৃত বড় অংশটি খেতে জোরাজুরি করেছি কারণ একে অপরকে বাদ দিয়ে নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব তখন অকল্পনীয় ছিল। বহুবছর মা আর আমি একে অন্যের অবলম্বন এবং সম্বল দুইই ছিলাম, বহু ক্লেশ-কঠিন মুহূর্ত আমরা দাঁতে দাঁত চেপে একসাথে যুঝেছি, যেগুলোর নানা ইতিবৃত্ত কেবলমাত্র আমাদের দুজনের গোপন দুঃখভোগ এবং শিক্ষাও বটে। 

মা কিন্তু শত সঙ্কটেও কোনোদিন মাথা নোয়াননি, বরং ধারালো আঘাতের মোকাবিলা করেছেন ঢালের মতন, সে আমার জীবনসংশয়ের সময়ও। আমি স্বাবলম্বী না হওয়া পর্য্যন্ত মা আমায় বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, চুপিসারে আমার ভাগের দুঃখটুকুও নিজে আত্মসাৎ করে তবে স্বস্তি পেতেন। ওঁর আত্মত্যাগেরই ফসল আমার আজকের ব্যক্তিত্ব।

তারপর ক্রমে কালের নিয়মে দিন বদলালো, আমরা মা-বেটাও আমাদের মতন করে বদলে গেলাম। আমি আমার মতন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলাম, মা মায়ের মতন করে ডাল পালা বিস্তার করলেন, বেশিরভাগ সময়ই দুজনে দুই শহরে অথবা একজন দেশে এবং অন্যজন বিদেশে। স্বাভাবিকভাবেই ইতিমধ্যে আসলের চেয়ে সুদ বেশি সুখের হয়েছে, নাতিরা এসেছেন। তারপর একসময় আমার প্রবাস শেষ করে ঘরে ফেরা, তা সেও আজ প্রায় বছর বারো হল।

অবশ্য তার বহুদিন আগেই আমাদের ভাগাভাগি করে ডিম খাওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়েছে আর ভূমি এবং ভূমিকার পরিবর্তনের সাথে সাথে ধীরে ধীরে পাল্টে গেছে প্রাত্যহিক যাপনও। কিন্তু এমন এক জরিপহীন বিচরণক্ষেত্র শেষ দিন পর্য্যন্ত অক্ষত ছিল যেখানে একমাত্র আমি আর মা ছাড়া তৃতীয়পক্ষের প্রবেশ নিষেধ, তা সে বাহ্যিক আয়োজন যাই হোক না কেন। 

আগামী পয়লা জুন মা নব্বইয়ের হতেন, তার আগেই থেমে গেলেন। ওঁর মর্তভূমির ভ্রমণ সারা হয়ে অনন্তপথে যাত্রা শুরু হলো গত ১৫ই বৈশাখ, ১৪২৬, গভীর রাতে। আমার মা জীবনে সুখ যেমন দেখেছেন তেমন যন্ত্রনাও, স্বাচ্ছন্দ্য যেমন, তেমনিই দারিদ্র্যও। ওঁর জীবন এক পরিপূর্ণ জীবন, পাওয়া, হারানো, ফিরে পাওয়া, ত্যাগ, স্বার্থশূন্যতা, ঠিক, ভুল, শান্তি, অশান্তি সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত জাগতিক সম্পূর্ণতা। আগামীকাল ওঁর আধ্যশ্রাদ্ধ। অবশেষে কর্কটপীড়িত শরীরটি যন্ত্রনামুক্ত হয়েছে, এবার মায়ার চক্রব্যূহ ভেদ করে জননীর আত্মাও অপার শান্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুন, জগতবল্লভের চরণে এইটুকুই নিবেদন।  

"যা হবার তাই হোক ,
ঘুচে যাক সর্ব শোক ,
       সর্ব মরীচিকা ।
নিবে যাক চিরদিন
পরিশ্রান্ত পরিক্ষীণ
      মর্তজন্মশিখা ।
সব তর্ক হোক শেষ ,
সব রাগ সব দ্বেষ ,
      সকল বালাই ।
বলো শান্তি , বলো শান্তি ,
দেহ-সাথে সব ক্লান্তি
      পুড়ে হোক ছাই ।"