শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এমন দুএকটি শ্লোক আছে যেগুলি মোটামুটি সবাই জানেন, এমনকি যাঁরা জীবনেও গীতা পড়েননি, তাঁরাও অন্তত এগুলির একটা লাইন হলেও জানেন। এমনই একটি হলো দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৭নং শ্লোক,
কর্ম্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্ম্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্ম্মণি।।
অর্থাৎ, কর্ম্মেই তোমার অধিকার, কর্ম্মফলে তোমার অধিকার নেই। কর্ম্মফল যেন তোমার কর্ম্মপ্রবৃত্তির হেতু না হয়, কর্ম্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়।
আমরা যারা সংসারী জীব, আমাদের পক্ষে এ কথা মুখে বলা যত সোজা, কাজে করে দেখানো তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি কঠিন। দিনরাত অফিসের জন্য খেটে চলেছি অথচ বছরের শেষে একটা ভালো increment বা promotion আশা করবো না - এ আবার হয় নাকি? পরীক্ষার জন্য খেলাধুলো বন্ধ করে দিনরাত মুখ গুঁজে পড়ে চলেছি অথচ পরীক্ষায় ভালো ফল আশা করতে পারবো না - absurd! বিয়ে করেছি কিন্তু সুখ আশা করা যাবে না, রান্না করছি কিন্তু ভালো স্বাদ আশা করা যাবে না, ফুটবল খেলছি কিন্তু জিত আশা করা যাবে না - তাহলে আর বেগার খাটবো কেন? বাড়িতে বসে দিনরাত হরি হরি করলে যদি অন্ন বস্ত্র বাসস্থান জুটে যেত, তাহলে কেই বা আর খাটতো আর কেই বা ফলের আশা করতো? ফলে শ্রীকৃষ্ণের এই বাণী কেবলমাত্র সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের জন্য, সংসারীদের জন্য নয় - এই interpretation যদি মেনে নিতে হয় তাহলে বুঝতে হবে যে শ্রীকৃষ্ণের common sense বলে কিছু ছিল না কারণ যাঁকে তিনি এই কথাগুলি বলেছিলেন সেই অর্জুন ছিলেন ঘোর সংসারী।
এই শ্লোকের বাস্তব application কিভাবে সম্ভব, তার ব্যাখ্যা পাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নবম অধ্যায়ের ২৭নং ও ২৮নং শ্লোকে। এখানে ভগবান বলছেন,
যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।
যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্।।
শুভাশুভফলৈরেবং মোক্ষসে কর্ম্মবন্ধনৈঃ।
সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি।।
যেহেতু এই শ্লোকগুলির মধ্যে উপায় লুকিয়ে আছে, ফলে এগুলিকে একটু ভালোভাবে word by word বুঝতে হবে।
যৎ করোষি - যা কিছু করো, যৎ অশ্নাসি - যা খাও, যৎ জুহোষি - যে যজ্ঞ করো, যৎ দদাসি - যা দান করো, যৎ তপস্যসি - যে তপস্যা করো, তৎ - সেসব, মৎ অর্পণম্ - আমাতে অর্পণ, কুরুষ্ব - করো।
শুভ অশুভ ফলৈঃ এবং - এবং শুভ অশুভ সমস্ত ফল, সন্ন্যাস যোগ যুক্ত আত্মা - আমাতে সমর্পণ করে আমার সাথে যুক্ত হলে, কর্ম্মবন্ধনৈঃ - কর্মবন্ধন হতে, মোক্ষসে - মুক্ত হবে, (আর) বিমুক্তঃ - কর্মবন্ধন কেটে গেলে, মাম্ উপৈষ্যসি - আমাকে লাভ করবে।
হিন্দুধর্মের যে কোনো গভীর দর্শন সহজে বোঝার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেব ছাড়া গতি নেই। কথামৃতে ঠাকুর বলছেন,
ব্রাহ্মভক্ত— সংসারত্যাগ কি ভাল?
শ্রীরামকৃষ্ণ— সকলের পক্ষে সংসারত্যাগ নয়। যাদের ভোগান্ত হয় নাই তাদের পক্ষে সংসারত্যাগ নয়। দুআনা মদে কি মাতাল হয়?
ব্রাহ্মভক্ত— তারা তবে সংসার করবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ— হাঁ, তারা নিষ্কামকর্ম করবার চেষ্টা করবে। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙবে। বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কর্ম করে, কিন্তু দেশে মন পড়ে থাকে; এরই নাম নিষ্কামকর্ম। এরই নাম মনে ত্যাগ। তোমরা মনে ত্যাগ করবে। সন্ন্যাসী বাহিরের ত্যাগ আবার মনে ত্যাগ দুইই করবে।
কিন্তু করবো কিভাবে? নিষ্কাম বললেই তো আর নিষ্কাম হয়ে যাওয়া যায় না, তাহলে উপায়টা কি? তারও রাস্তা বাতলে দিচ্ছেন,
“নির্লিপ্ত হয়ে সংসার করা কঠিন। প্রতাপ বলেছিল, মহাশয়, আমাদের জনক রাজার মত। জনক নির্লিপ্ত হয়ে সংসার করেছিলেন, আমরাও তাই করব। আমি বললুম, মনে করলেই কি জনক রাজা হওয়া যায়! জনক রাজা কত তপস্যা করে জ্ঞানলাভ করেছিলেন, হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হয়ে অনেক বৎসর ঘোরতর তপস্যা করে তবে সংসারে ফিরে গিছলেন।
“তবে সংসারীর কি উপায় নাই?— হাঁ অবশ্য আছে। দিন কতক নির্জনে সাধন করতে হয়। তবে ভক্তিলাভ হয়, জ্ঞানলাভ হয়; তারপর গিয়ে সংসার কর, দোষ নাই। যখন নির্জনে সাধন করবে, সংসার থেকে একেবারে তফাতে যাবে। তখন যেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, মাতা, পিতা, ভাই, ভগিনী, আত্মীয়-কুটুম্ব কেহ কাছে না থাকে। নির্জনে সাধনের সময় ভাববে, আমার কেউ নাই; ঈশ্বরই আমার সর্বস্ব। আর কেঁদে কেঁদে তাঁর কাছে জ্ঞান-ভক্তির জন্য প্রার্থনা করবে।
“যদি বল কতদিন সংসার ছেড়ে নির্জনে থাকবো? তা একদিন যদি এইরকম করে থাক, সেও ভাল; তিনদিন থাকলে আরও ভাল; বা বারোদিন, একমাস, তিনমাস, একবৎসর — যে যেমন পারে। জ্ঞান-ভক্তিলাভ করে সংসার করলে আর বেশি ভয় নাই।
“মনটি দুধের মতো। সেই মনকে যদি সংসার-জলে রাখ, তাহলে দুধেজলে মিশে যাবে। তাই দুধকে নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। যখন নির্জনে সাধন করে মনরূপ দুধ থেকে জ্ঞান-ভক্তিরূপ মাখন তোলা হল, তখন সেই মাখন অনায়াসে সংসার-জলে রাখা যায়। সে মাখন কখনও সংসার-জলের সঙ্গে মিশে যাবে না — সংসার-জলের উপর নির্লিপ্ত হয়ে ভাসবে।”
পরম পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী মহারাজ তাঁর বিখ্যাত 'Universal message of the Bhagavad Gita' বইয়ের প্রথম খণ্ডে লিখছেন, The Western mystic and Eastern sage find a strong effect of endorsement in modern science and the everyday teaching of practical morality; both teach that self must be subordinated, that self is a method and not an end. Ego has a 'strategic value in evolution. It is provisional delusion', don't treat it as a final stage. You have to discover it's higher dimensions. That is the work the Upanishads did ages ago.... In the whole cosmos you don't find the ego. In the whole animal kingdom you don't find the ego, only in man you find it. In our ignorance we are basing our work on this provisional delusion of the ego. What a powerful 'I' the ego is in the waking state; and when we go to sleep there is no ego; it dies and later comes to an awareness of itself. Sri Ramkrishna says in one of his beautiful sayings: even the most powerful person, when he or she sleeps, if a child spits on his or her face, there will be no protest.... You can go beyond and penetrate to the root of this ego. That is the infinite Self. That Atman is one with all.... even in families, a man or woman works for whom? For wife, husband or children, for their welfare, not for one's own.... The self that is contained in the organic system is only a 'convenient provisional delusion'. When you set it aside, you begin to expand your concept of self. You feel spiritual oneness with others. So, whatever work I do, the fruits of it are not for me alone; it will go to all. And a state will come, when there will be nothing of 'I' left; everything will be 'we'. We loose ourselves in the Universal.
সবই তো বুঝলাম কিন্তু কাজের চাপ, boss এর তাড়া, office politics সামলে কাজের মধ্যে আবার spiritual oneness আনি কি করে? কাজ মানে তো দায়িত্ব, timeline, goal, reward বা reprimand - এর মধ্যে আবার 'যৎ করোষি মদর্পণম্' হবে কিভাবে? পরম পূজ্যপাদ বড় মহারাজ শ্রীমৎ স্বামী লোকেশ্বরানন্দজী তাঁর এক দারুন মনোগ্রাহী বক্তৃতায় খুব প্রাঞ্জল করে এই বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
"তাঁরা (রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা) ঈশ্বরলাভের জন্য ঘর-সংসার ছেড়েছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ টাইপ করছেন, কেউ স্কুলে পড়াচ্ছেন, কেউ বাগানে কাজ করছেন, কেউ হাসপাতালে ওষুধ দিচ্ছেন, আরও কত সব করছেন। তাহলে সাধারণ গৃহস্থের সঙ্গে তাঁদের তফাৎটা কি হল? তফাৎটা হল এইখানে যে, তাঁরা এইসব কাজ করছেন ঈশ্বরের উদ্দেশে। কাজ করছেন না - তাঁরা ঈশ্বরের আরাধনা করছেন। এই প্রসঙ্গে আমাদের মঠের একটা মজার গল্প বলি।
আমাদেরই একজন সাধু। গত হয়েছেন। খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। এম.এসসি-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। বাবা ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট - বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে আই. সি. এস. হবে কিন্তু ছেলে রামকৃষ্ণ মিশনের সাধু হয়ে গেলেন। বাবা মিশনের বিরুদ্ধে কোর্টে নালিশ করলেন। কিন্তু ছেলে কোর্টে গিয়ে বললেন - আমি সাবালক, আমি স্বেচ্ছায় সাধু হয়েছি। বাবা হেরে গেলেন। খুব অপমানিত বোধ করলেন তিনি। সঙ্গে রিভলভার নিয়ে একদিন মঠে গেছেন - প্রথমে ছেলেকে আসতে বলবেন, যদি না আসে তাহলে গুলি করে মারবেন। ছেলের কাছে গিয়ে দেখেন যে ছেলে বসে বসে কুমড়ো কাটছে। তিনি বলছেন, আমি হাসব না কাঁদব, আমি ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট আর আমার ছেলে, যাকে ভেবেছিলাম আই.সি.এস হবে সে কিনা এখানে এসে কুমড়ো কাটছে? ছেলেকে বললেন, যদি কুমড়ো কাটার জন্যই সাধু হয়ে থাকিস তাহলে বাড়ি ফিরে চল, গাড়ি গাড়ি কুমড়ো কিনে দেব। ছেলে বাবাকে প্রণাম করে বললেন, বাবা, আমি কুমড়ো কাটছি না. ঠাকুরের পুজো করছি। এই ভাব - সব তাঁর পুজো।
"আমি যখন প্রথম রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে যোগ দিয়েছি সেইসময়কার একটা ঘটনা বলি। দেওঘরে আমাদের যে স্কুল ছিল সেখানে তখন পড়াতাম। একবার কয়েকদিনের জন্য মঠে এসেছি।
"একদিন আমাদের এক বৃদ্ধ স্বামীজী আমাকে ডেকে বললেন: এই চিঠিগুলো ডাকে যাবে, এগুলোতে স্ট্যাম্প লাগিয়ে দাও। এক গাদা চিঠি - আমি তাড়াহুড়ো করে টেরা-বাঁকা করে স্ট্যাম্প লাগিয়ে কাজ শেষ করেছি। তারপর সেই স্বামীজীর টেবিলে গিয়ে রেখে দিয়ে এসেছি।
"কিছুক্ষণ পরেই তাঁর কাছ থেকে আবার ডাক। আমি তো ভাবছি: সেরেছে, আবার স্ট্যাম্প লাগাতে হবে নাকি? গিয়ে দেখি, সেই স্বামীজী প্রতিটা স্ট্যাম্প জল দিয়ে খুলছেন আর সোজা করে লাগাচ্ছেন। আমি যেতেই বললেন: এই তোমার কাজের ছিরি! স্কুলে ছাত্রদের এরকম শিক্ষাই দাও বুঝি ! —মারাত্মক কথা! আমি খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম, বললাম, দিন, আমি আবার লাগাচ্ছি। তিনি বললেন: না, তোমার দৌড় খুব বুঝেছি! তোমাকে এ আর করতে হবে না। আসলে তিনি তো কাজটাকে শুধু ‘স্ট্যাম্প লাগানো’ মনে করছেন না - স্ট্যাম্প তো যেমন করেই লাগাই না কেন, চিঠি ঠিক চলে যাবে। তিনি মনে করছেন: এ হচ্ছে পূজা, শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা। তাই এত যত্ন, এত সতর্কতা।"
'তব কথামৃতম্' বইতে পূজনীয় বড় মহারাজ ওই রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদের টাইপ করা বা স্কুলে পড়ানোর প্রসঙ্গটিই টেনে এনে একজায়গায় বলছেন, "স্বামীজী এটাকেই বলেছেন work is worship ...সংসারে যাঁরা আছেন তাঁরা যদি এই ভাবটা রাখতে পারেন যে, সংসারের সব কাজের মধ্য দিয়ে আমি ঈশ্বরের সেবা করছি, তাহলে কাজটা আর কাজ থাকে না, উপাসনা হয়ে যায়। ...সংসারের চেহারাটাই তখন বদলে যায়, আনন্দের জায়গা হয়ে যায় সংসারটা।" সবকিছুর শেষে, জীবনে আনন্দই তো খুঁজছি আমরা, তাই না? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তারই হদিস দিচ্ছেন - কি করে আমরা আমাদের দৈনন্দিন যাপনটিকে একটি আনন্দময় উপাসনায় রূপান্তরিত করার মধ্যে দিয়ে একইসাথে একটা sense of fulfillment লাভ করতে পারি আবার আত্মপলব্ধিও করতে পারি।
No comments:
Post a Comment