আমাদের দেশ এই সময়ে মহাশক্তি হিসেবে উত্থিত হত্তয়ার মহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে আর এই বিষয়টি এখনকার মহাশক্তিদের ভালো লাগার কথা নয়। বড়জোর আর পনেরো বছর, তারপরে ভারতবর্ষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশীদারি ছাড়া সারা বিশ্বজুড়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটা বা ঘটানো আর সম্ভব হবে না। এমতবস্থায় ভারত কি বলছে, কেমনভাবে বলছে, কি করছে আর কেমনভাবে করছে, অথবা কি বলছে না বা কি করছে না, সমস্ত কিছুই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন স্তরে প্রতিনিয়ত অতসকাঁচের তলায় ফেলে দেখা হচ্ছে কারণ ভবিষ্যতের আঁচ ইতিমধ্যে সবাই পেয়েই গেছেন। এই মুহূর্তে আমরা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র, পিপিপি অনুযায়ী বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এবং নমিনাল জিডিপি অনুযায়ী পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি, সামরিক শক্তিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সেনার অধিকারী আর সংস্কৃতির দিক দিয়ে পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবন্ত সভ্যতা। গত আট বছর দেশ যেভাবে প্রগতি করেছে, আগামী আট বছরে যদি সেই ধারা বজায় থাকে, এই দশকের শেষে আমাদের এতদিনকারপরিচিত ভারতবর্ষ দেখতে শুনতে একদম অন্যরকম হয়ে যাবে।
আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশের এই যে এত দ্রুত এগিয়ে যাওয়া, এ দৌড়ের মধ্যে নানারকমের টানাপোড়েন থাকবে না তা কি কখনো হয় নাকি? স্বাভাবিকভাবেই বিরুদ্ধ মত থাকবে, বিরোধাভাস থাকবে, বিরোধিতাও থাকবে, আবার সহমত থাকবে, সহযোগিতা থাকবে, সম্পৃক্ততাও থাকবে। এই বৈচিত্রময় দেশীয় সমাজের যে মূল চরিত্র, 'বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান', সেটা সর্বোপরি রেখেও আমরা কিন্তু বিশ্বকে নানা ভাষা, নানা বর্ণ, নানা পন্থ ছাপিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে একটা বহু-অংশে সমন্বিত বার্তা দিয়ে আসছি, আর তা হলো শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের। রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে সরকারের গান্ধী ভজনা ওই ন্যারেটিভেরই একটা অংশ। সত্যাসত্য যাই হোক না কেন, বিশ্বজুড়ে অহিংসার পূজারী হিসেবে গান্ধীর একটা ব্যতিক্রমী সদর্থক ভাবমূর্তি আছে আর সমস্ত দেশনেতাই সেটা কাজে লাগিয়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। না করাটাই বরং বেকুফি।
যত দিন যাচ্ছে, দেশে গণতন্ত্র তত সুদৃঢ় হচ্ছে অর্থাৎ উচ্চশিক্ষিত এবং বড়লোকদের হাত থেকে অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত এবং গরিবদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হচ্ছে। আমাদের দেশে যেহেতু ম্যাকলের অভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাই এতদিন বলবৎ ছিল, ফলে যাঁরা উচ্চশিক্ষিত, তাঁদের মধ্যে সনাতন ভারতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে স্বীকার করে নেওয়ার প্রবণতাই বেশি ছিল। গ্রামীন অবিত্তশালী ভারতে পারম্পরিক রীতিনীতি, পৌরাণিক উপদেশ, রামায়ণ মহাভারতের আখ্যান, ভক্তি-বিশ্বাস, সনাতন ধর্মবোধ ইত্যাদির প্রভাব থাকলেও শহরগুলোতে যেন এর একেবারে বিপরীতধর্মী পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত বৌদ্ধিকস্তরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মূলতঃ শহরভিত্তিক হওয়ার ফলে এই তথাকথিত সংখ্যালঘু শ্রেণীর দ্বারা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া মেকি সেক্যুলারিজম সারা দেশের আমজনতা এতদিন মেনে চলতে বাধ্য হতেন, যদিও তাঁরা সংখ্যায় অভিজাতদের চেয়ে চিরকালই অনেক অনেক বেশি।
এই এলিটদের টাকা বেশি, ফলে সমাজে তাঁদের খবরদারিও চলতো বেশি। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে এঁরাই এতদিন ভারতের রাজনীতি চালিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে সময়ের সাথে সাথে সামাজিক সশক্তিকরণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সেই কাঠামোটা ভেঙে গিয়ে সার্বজনীন হয়ে পড়েছে আর তাই দেশজুড়ে এখন এত বেশি সনাতন সংস্কৃতি আর ধর্মবোধের উন্মেষ দেখা যাচ্ছে। বিদেশি মানসিকতার শিকার কারো কারো হয়তো মনে হতে পারে এটা majoritarianism, কিন্তু আদপেই তা নয় - এটা সংখ্যাগরিষ্ঠের কন্ঠস্বর, যা এতদিন জোর করে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অতি উচ্চবংশজাত বা গরিবঘরের হলেও আইভি লীগ এবং অক্সফোর্ডের স্নাতকোত্তর থেকে নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী রেল স্টেশনের চাওয়ালার ছেলে, মা লোকের বাড়িতে সহায়িকার কাজ করতেন, প্রান্তিক এবং অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষ, অনেক বেশি বয়সে স্নাতক হয়েছেন, আর এটা আমাদের গণতন্ত্রের গৌরব যে তিনি ওই জায়গা থেকে উঠে এসে আজ এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছেন - এই বোধটি কিন্তু জনগণের একটা মস্ত বড় মানসিক ক্রান্তির পরিচায়ক। আর এই প্রধানমন্ত্রী আবার মুখে গান্ধীর নাম জপতে জপতে রাজপথে সুভাষচন্দ্রের মূর্তি বসিয়ে দেন আর টাকায় গান্ধীর সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথ আর এপিজে আব্দুল কালামের ছবি ছাপার ব্যবস্থাও করে ফেলেন, যা কিছু বছর আগে অবধি ভাবাই যেত না।
ভারতীয় সমাজের একটা সুবিধা হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে সে তর্ক আর বিতর্ক করে এসেছে কিন্তু মতের অমিল হলে কাউকে মারতে যায়নি। সংবাদ আর বিবাদ আমাদের সভ্যতার উত্তরাধিকার আর ভাবের এই সুস্থ আদানপ্রদানের ফলেই জাতি হিসেবে সমৃদ্ধ ও উন্নত হতে হতে মাত্র আটশ বছর আগে পর্য্যন্ত ধর্মবোধের নিরিখে আমরা বিবর্তনের শিখরে ছিলাম। এমনকি আমরা যুদ্ধও করতাম মানবিক নিয়ম মেনে, ছলচাতুরী করে যুদ্ধজয় সমাজে ঘৃণিত অপরাধ বলেই গণ্য হতো। দুর্ভাগ্যবশত ঘরশত্রু জয়চাঁদদের জন্য একসময় আমরা বিদেশি আক্রমণকারীদের কাছে হেরে যাই বটে কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই ধর্মবোধ অন্তঃসলীলা ফল্গুধারার মতো সমাজের মধ্যে ঠিকই বয়ে চলেছিল, কোনো আঘাত বা আক্রমণই তাকে শেষ করতে পারেনি। এই ধর্মবোধকেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন 'ভারতের অন্তরাত্মা'। এটা এতদিন সুপ্ত ছিল, এখন আম ভারতের হাত ধরে ভারতীয়ত্বের পুনরুত্থানের সাথে সাথে তা আবার জেগে উঠছে।
স্বাধীনতাত্তরকালে দেশের রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, পন্থীয় সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন ও নাগরিক সমাজ যে ভাবে ভাবতে বা পথ চলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, এখন সামগ্রিকভাবে দেশে ভারতীয় সভ্যতার মূলে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্খা দেখা দেওয়ায় তাঁরা নতুন করে রাস্তা খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অচলায়তন ভেঙে পড়াকে কেউ কেউ অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি হিসেবে দেখলেও, আসলে এটা একটি বিজিত জাতির নিজেকে স্বাধীনভাবে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার প্ৰচেষ্টা। এতদিন সব যেন কেমন জট পাকিয়ে গিয়েছিল, এক একটা করে দড়ি টেনে টেনে সমাজ এখন সেই জট খোলার চেষ্টা করছে। পন্থীয় সংগঠন আর সামাজিক সংগঠন কি একই সীমিত ভাষায় কথা বলবে, বা সামাজিক সংগঠনের বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থাকা উচিত না অনুচিত অথবা রাজনৈতিক সংগঠন কেবল বিশেষ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবে নাকি রাজধর্মের নিরিখে ধর্মত যা সঠিক, সেই রাস্তায় চলবে আর আধুনিক জীবনশৈলীতে সনাতন ধর্মসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তিকরণে ধর্মীয় সংগঠনের ভূমিকাই বা কি হবে - নতুন করে সকলের কর্তব্য অকর্তব্য আর সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন শুরু হয়ে গেছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। সময়টা অস্থির, ভুলভ্রান্তি হওয়াও স্বাভাবিক। তবে এই মন্থনের মধ্যে থেকেই যে নতুন করে সনাতন ভারতের অন্তরাত্মার পুনরুদ্ধার হবে, সেই বিষয়ে কিন্তু কোনো দ্বিমত নেই।
আগামী দেড়দশকের কালখন্ডটি বিশ্বজুড়ে ভারতবর্ষের গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়ানোর পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো মন্থনের সময় কিছু প্রতিরোধ হবেই, অমৃত পেতে গেলেও আগে গরলই উঠে আসে। সেই সমস্ত শ্রেণী যাঁরা এতদিন সমাজকে নির্দেশ দিতেন, তাঁরা নির্দেশিত হতে পছন্দ করবেন না, তা বলাই বাহুল্য। আর যাঁরা বিশেষ অধিকার ভোগ করে এসেছেন, তাঁরা যে সর্বশক্তি দিয়ে সেগুলি রক্ষা করার চেষ্টা করবেন এবং প্রয়োজনে বিধ্বংসী হয়ে উঠবেন, সেটাও অপ্রত্যাশিত নয়। এটা অধৈর্য্য হয়ে ওঠার সঠিক সময় নয়, এই সময়টিতে ধৈর্য্য ধরে মুখ বন্ধ রেখে চুপচাপ কাজ করে যাওয়াটা ভীষণ জরুরি। যা বললে বিবাদ আরো বাড়বে, সেটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলার দরকারটা কি? বললে কি কাজ হয়ে যাবে নাকি আসলে করলে তবেই হবে? বৃহত্তর সমাজ যখন তাঁদের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে ফেলেছেন, তখন এতবড় শক্তিকে দাবিয়ে দিতে পারবে, এমন ক্ষমতা বিশ্বের কারো নেই। নিজেদের ওপর কি আমাদের এতটুকুও ভরসা থাকবে না যে দুর্বলের প্ররোচনায় প্রভাবিত না হয়ে সবলের যৌথ নম্রতায় আমরা নির্বিবাদে আমাদের অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারবো? তবে অভীষ্ট কি সেই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে তবেই কিন্তু বিবাদকে প্রথমে সংবাদ আর তারপর স্বীকৃতিতে বদলে ফেলানো যায়। মনে রাখা দরকার যে ইতিহাস থেকে যেমন প্রবৃত্তি তৈরি হয় তেমনি প্রবৃত্তিরও একটি ইতিহাস থাকে এবং প্রবৃত্তি, প্রকৃতি ও পরম্পরা এক জিনিস নয়।
No comments:
Post a Comment