"সহসা দারুণ দুখতাপে
সকল ভুবন যবে কাঁপে,
সকল পথের ঘোচে চিহ্ন
সকল বাঁধন যবে ছিন্ন,
মৃত্যু-আঘাত লাগে প্রাণে -
তোমার পরশ আসে কখন কে জানে॥"
আমরা দীর্ঘ দুঃখপথের সহযাত্রী ছিলাম, আমি আর আমার মা। সে দুঃখের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত সাহচর্যসুখ ছিল তার অর্ধেকটা বারোদিন আগে দাহ করা হলো। আর সেই সাথে স্মৃতি হয়ে গেল নিজের সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা গত শতাব্দীর একটি সেতার বাজানো গাড়ি চালানো লায়ন্স ক্লাবের মধ্যমনি আধুনিকার সর্বংসহা জননী হয়ে ওঠার বিবর্তনের ইতিহাস।
মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল অবস্থা থেকে হটাৎ একসময় খুব কঠিন আর্থিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে মায়ের মাতৃত্ব আর আমার পুত্রত্ব বোধহয় একই সাথে একটু অন্যভাবে পুনর্বিকশিত হয়েছিল। বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর ফ্যামিলি পেনশন পেতে মাত্রাতিরিক্ত দেরি হওয়ার কারণে অত্যন্ত সীমিত সাধ্যের মধ্যে সেইসময় মা আমায় গড়ে তুলতে শিখছিলেন, বোধহয় খানিক নিজেকেও।
আমরা দুটি প্রাণী মাসের শেষে অনেকদিনই একটি সেদ্ধ ডিমকে সুতো দিয়ে দুভাগ করে খেয়েছি বা দুটুকরো মাছ নিয়ে একে অপরকে অপেক্ষাকৃত বড় অংশটি খেতে জোরাজুরি করেছি কারণ একে অপরকে বাদ দিয়ে নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব তখন অকল্পনীয় ছিল। বহুবছর মা আর আমি একে অন্যের অবলম্বন এবং সম্বল দুইই ছিলাম, বহু ক্লেশ-কঠিন মুহূর্ত আমরা দাঁতে দাঁত চেপে একসাথে যুঝেছি, যেগুলোর নানা ইতিবৃত্ত কেবলমাত্র আমাদের দুজনের গোপন দুঃখভোগ এবং শিক্ষাও বটে।
মা কিন্তু শত সঙ্কটেও কোনোদিন মাথা নোয়াননি, বরং ধারালো আঘাতের মোকাবিলা করেছেন ঢালের মতন, সে আমার জীবনসংশয়ের সময়ও। আমি স্বাবলম্বী না হওয়া পর্য্যন্ত মা আমায় বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, চুপিসারে আমার ভাগের দুঃখটুকুও নিজে আত্মসাৎ করে তবে স্বস্তি পেতেন। ওঁর আত্মত্যাগেরই ফসল আমার আজকের ব্যক্তিত্ব।
তারপর ক্রমে কালের নিয়মে দিন বদলালো, আমরা মা-বেটাও আমাদের মতন করে বদলে গেলাম। আমি আমার মতন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলাম, মা মায়ের মতন করে ডাল পালা বিস্তার করলেন, বেশিরভাগ সময়ই দুজনে দুই শহরে অথবা একজন দেশে এবং অন্যজন বিদেশে। স্বাভাবিকভাবেই ইতিমধ্যে আসলের চেয়ে সুদ বেশি সুখের হয়েছে, নাতিরা এসেছেন। তারপর একসময় আমার প্রবাস শেষ করে ঘরে ফেরা, তা সেও আজ প্রায় বছর বারো হল।
অবশ্য তার বহুদিন আগেই আমাদের ভাগাভাগি করে ডিম খাওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়েছে আর ভূমি এবং ভূমিকার পরিবর্তনের সাথে সাথে ধীরে ধীরে পাল্টে গেছে প্রাত্যহিক যাপনও। কিন্তু এমন এক জরিপহীন বিচরণক্ষেত্র শেষ দিন পর্য্যন্ত অক্ষত ছিল যেখানে একমাত্র আমি আর মা ছাড়া তৃতীয়পক্ষের প্রবেশ নিষেধ, তা সে বাহ্যিক আয়োজন যাই হোক না কেন।
আগামী পয়লা জুন মা নব্বইয়ের হতেন, তার আগেই থেমে গেলেন। ওঁর মর্তভূমির ভ্রমণ সারা হয়ে অনন্তপথে যাত্রা শুরু হলো গত ১৫ই বৈশাখ, ১৪২৬, গভীর রাতে। আমার মা জীবনে সুখ যেমন দেখেছেন তেমন যন্ত্রনাও, স্বাচ্ছন্দ্য যেমন, তেমনিই দারিদ্র্যও। ওঁর জীবন এক পরিপূর্ণ জীবন, পাওয়া, হারানো, ফিরে পাওয়া, ত্যাগ, স্বার্থশূন্যতা, ঠিক, ভুল, শান্তি, অশান্তি সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত জাগতিক সম্পূর্ণতা। আগামীকাল ওঁর আধ্যশ্রাদ্ধ। অবশেষে কর্কটপীড়িত শরীরটি যন্ত্রনামুক্ত হয়েছে, এবার মায়ার চক্রব্যূহ ভেদ করে জননীর আত্মাও অপার শান্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুন, জগতবল্লভের চরণে এইটুকুই নিবেদন।
"যা হবার তাই হোক ,
ঘুচে যাক সর্ব শোক ,
সর্ব মরীচিকা ।
নিবে যাক চিরদিন
পরিশ্রান্ত পরিক্ষীণ
মর্তজন্মশিখা ।
সব তর্ক হোক শেষ ,
সব রাগ সব দ্বেষ ,
সকল বালাই ।
বলো শান্তি , বলো শান্তি ,
দেহ-সাথে সব ক্লান্তি
পুড়ে হোক ছাই ।"
No comments:
Post a Comment