বহুদিন আগে একজন মহাত্মা আমায় বলেছিলেন যে রোজ একটু করে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত পড়লেই হবে, আর কোনোকিছুই পড়ার প্রয়োজন নেই। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম গীতা পড়ারও প্রয়োজন নেই? উনি উত্তর দিয়েছিলেন যা কিছু গীতায় আছে তা সবই কথামৃতে আছে, এটাই এ যুগের ব্রহ্মসূত্র, গীতা, উপনিষদ সবকিছু। সেদিন বুঝিনি, আজ মধ্যবয়সে এসে অনেককিছু পড়ার পর হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি উনি কেন সেদিন ও কথা বলেছিলেন। আজ উনি শরীরে নেই, কিন্তু সেসময় আমার বোঝার মতো maturity ছিল না যে অবশ্যই সমস্ত ধর্মগ্রন্থ পড়ে তবেই সবার শেষে উনি ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়েছিলেন এবং ওনার কথা follow করলে আখেরে লাভ বৈ ক্ষতি হতো না। দুএকটি মাত্র উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে ভগবান দ্বাপরে যা বলেছিলেন কলিতেও তাই বলেছেন, কেবল বলার ভঙ্গিটা এ যুগের উপযোগী করে দিয়েছেন যাতে মানুষ সহজে তার কর্তব্য-অকর্তব্য বুঝতে পারেন। দুটো আলাদা যুগে কথিত নির্দেশ এতটাই similar যে চমকে উঠতে হয়, আর তারপর সত্যিটা ধীরে ধীরে sink in করে।
১) গীতা, ৯ম অধ্যায়, ৭নং ও ৮নং শ্লোক:
সর্বভূতানি কৌন্তেয় প্রকৃতিং যান্তি মামিকাম্।
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্।।
প্রকৃতিং স্বামবষ্টভ্য বিসৃজানি পুনঃ পুনঃ।
ভূতগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ।।
অর্থাৎ,
At the end of one kalp, all living beings merge into My primordial material energy. At the beginning of the next creation, O son of Kunti, I manifest them again. Presiding over My material energy, I generate these myriad forms again and again, in accordance with the force of their natures.
কথামৃত, ৪র্থ পরিচ্ছদ, ২৭শে অক্টোবর ১৮৮২:
"..ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ, এককে মানলেই আর-একটিকে মানতে হয়। যেমন অগ্নি আর তার দাহিকাশক্তি; — অগ্নি মানলেই দাহিকাশক্তি মানতে হয়, দাহিকাশক্তি ছাড়া অগ্নি ভাবা যায় না; আবার অগ্নিকে বাদ দিয়ে দাহিকাশক্তি ভাবা যায় না। সূর্যকে বাদ দিয়ে সূর্যের রশ্মি ভাবা যায় না; সূর্যের রশ্মিকে ছেড়ে সূর্যকে ভাবা যায় না।
"দুধ কেমন? না, ধোবো ধোবো। দুধকে ছেড়ে দুধের ধবলত্ব ভাবা যায় না। আবার দুধের ধবলত্ব ছেড়ে দুধকে ভাবা যায় না।
"তাই ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে, শক্তিকে ছেড়ে ব্রহ্মকে ভাবা যায় না। নিত্যকে ছেড়ে লীলা, লীলাকে ছেড়ে নিত্য ভাবা যায় না!
"আদ্যাশক্তি লীলাময়ী; সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী! একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয় — সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কোন কাজ করছেন না — এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ।
"তিনি নানাভাবে লীলা করছেন। তিনিই মহাকালী, নিত্যকালী, শ্মশানকালী, রক্ষাকালী, শ্যামাকালী। মহাকালী, নিত্যকালীর কথা তন্ত্রে আছে। যখন সৃষ্টি হয় নাই; চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, পৃথিবী ছিল না; নিবিড় আঁধার; তখন কেবল মা নিরাকারা মহাকালী — মহাকালের সঙ্গে বিরাজ করছিলেন।...
"যখন জগৎ নাশ হয়, মহাপ্রলয় হয়, তখন মা সৃষ্টির বীজ সকল কুড়িয়ে রাখেন। গিন্নীর কছে যেমন একটা ন্যাতা-ক্যাতার হাঁড়ি থাকে, আর সেই হাঁড়িতে গিন্নী পাঁচরকম জিনিস তুলে রাখে। (কেশবের ও সকলের হাস্য)...
কেশব (সহাস্যে) — কালী কতভাবে লীলা করছেন, সেই কথাগুলি একবার বলুন।
(সহাস্যে) — “হ্যাঁ গো! গিন্নীদের ওইরকম একটা হাঁড়ি থাকে। ভিতরে সমুদ্রের ফেনা, নীল বড়ি, ছোট-ছোট পুঁটলি বাঁধা শশাবিচি, কুমড়াবিচি, লাউবিচি — এই সব রাখে, দরকার হলে বার করে। মা ব্রহ্মময়ী সৃষ্টি-নাশের পর ওইরকম সব বীজ কুড়িয়ে রাখেন। সৃষ্টির পর আদ্যাশক্তি জগতের ভিতরেই থাকেন! জগৎপ্রসব করেন, আবার জগতের মধ্যে থাকেন। বেদে আছে ‘ঊর্ণনাভির’ কথা; মাকড়সা আর তার জাল। মাকড়সা ভিতর থেকে জাল বার করে, আবার নিজে সেই জালের উপর থাকে। ঈশ্বর জগতের আধার আধেয় দুই।
২) গীতা, ১৮তম অধ্যায়, ৬৬নং শ্লোক:
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।
অর্থাৎ,
Abandon all varieties of dharmas and simply surrender unto Me alone. I shall liberate you from all sinful reactions; do not fear.
শ্রীমৎ শঙ্করাচাৰ্য্য এই শ্লোকটির ১১৩ টি শ্লোকে ভাষ্য করেছেন। তার মধ্যে প্রথমটিতে আচার্য্য বলছেন, 'সর্বধর্মান্’ সর্বে চ তে ধর্মাঃ চ সর্বধর্মাঃ তান্ / ধর্ম শব্দেন অত্র অধর্মঃ অপি গৃহ্যতে নৈষ্কর্ম্যস্য বিবক্ষিতত্বাৎ', অর্থাৎ যত প্রকার ধর্ম আছে সেই সমস্তই এখানে included। নৈষ্কর্ম্য (কর্মভাব) 'বিবক্ষিত' অর্থাৎ নির্ণয় করতে হবে বলে 'ধর্ম' শব্দের দ্বারা এখানে অধর্মকেও বোঝানো হচ্ছে। আর ভাষ্যের দশ নম্বর শ্লোকে আচার্য্য বলছেন, 'আত্মজ্ঞানস্য তু কেবলস্য নি:শ্ৰেয়সহেতুত্বং ভেদপ্রত্যয় নিবৰ্তকত্বেন কৈবল্যফলাবসানত্বাৎ' অর্থাৎ কেবল আত্মজ্ঞানেই দ্বৈতভাব নাশ হয় আর মুক্তিরূপ ফলবাসনা সিদ্ধ হয়।
কথামৃত, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ, ২৭শে অক্টোবর ১৮৮২:
"ঈশ্বরের নামে এমন বিশ্বাস হওয়া চাই — কি, আমি তাঁর নাম করেছি, আমার এখনও পাপ থাকবে! আমার আবার পাপ কি?’ কৃষ্ণকিশোর পরম হিন্দু, সদাচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ, সে বৃন্দাবনে গিছল। একদিন ভ্রমণ করতে করতে তার জলতৃষ্ণা পেয়েছিল। একটা কুয়ার কাছে গিয়ে দেখলে, একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে বললে, ওরে তুই একঘটি জল আমায় দিতে পারিস? তুই কি জাত? সে বললে, ঠাকুর মহাশয়, আমি হীন জাত — মুচি। কৃষ্ণকিশোর বললে, তুই বল, শিব। নে, এখন জল তুলে দে।
"ভগবানের নাম করলে মানুষের দেহ-মন সব শুদ্ধ হয়ে যায়।
"কেবল ‘পাপ’ আর ‘নরক’ এই সব কথা কেন? একবার বল যে, অন্যায় কর্ম যা করেছি আর করব না। আর তাঁর নামে বিশ্বাস কর।”
ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া নামমাহাত্ম্য গাইতেছেন:
"আমি দুর্গা দুর্গা বলে মা যদি মরি ৷
আখেরে এ-দীনে, না তারো কেমনে, জানা যাবে গো শঙ্করী ৷৷
"আমি মার কাছে কেবল ভক্তি চেয়েছিলাম। ফুল হাতে করে মার পাদপদ্মে দিয়েছিলাম; বলেছিলাম, ‘মা, এই নাও তোমার পাপ, এই নাও তোমার পুণ্য, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার জ্ঞান, এই নাও তোমার অজ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার শুচি, এই নাও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার ধর্ম, এই নাও তোমার অধর্ম, এই নাও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও’।"
কথামৃত, প্রথম পরিচ্ছদ, ২৬শে নভেম্বর ১৮৮৩:
"...এইরকম আছে যে, সত্য কথাই কলির তপস্যা। সত্যকে আঁট করে ধরে থাকলে ভগবানলাভ হয়। সত্যে আঁট না থাকলে ক্রমে ক্রমে সব নষ্ট হয়। আমি এই ভেবে যদিও কখন বলে ফেলি যে বাহ্যে যাব, যদি বাহ্যে নাও পায় তবুও একবার গাড়ুটা সঙ্গে করে ঝাউতলার দিকে যাই। ভয় এই — পাছে সত্যের আঁট যায়। আমার এই অবস্থার পর মাকে ফুল হাতে করে বলেছিলাম, ‘মা! এই নাও তোমার জ্ঞান, এই নাও তোমার অজ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার শুচি, এই নাও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার ভাল, এই নাও তোমার মন্দ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার পুণ্য, এই নাও তোমার পাপ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।’ যখন এই সব বলেছিলুম, তখন এ-কথা বলিতে পারি নাই, ‘মা! এই নাও তোমার সত্য, এই নাও তোমার অসত্য।’ সব মাকে দিতে পারলুম, ‘সত্য’ মাকে দিতে পারলুম না।"
কথামৃত, দ্বাদশ পরিচ্ছদ, ২৮শে নভেম্বর ১৮৮৩:
"যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা (Phenomenal world)। যাঁরই লীলা তাঁরই নিত্য (Absolute)। যিনি ঈশ্বর বলে গোচর হন, তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন। যে জেনেছে সে দেখে যে তিনিই সব হয়েছেন — বাপ, মা, ছেলে প্রতিবেশী, জীবজন্তু, ভাল-মন্দ, শুচি, অশুচি সমস্ত।"
প্রতিবেশী — তবে পাপ পূণ্য নাই?
শ্রীরামকৃষ্ণ — আছে, আবার নাই। তিনি যদি অহংতত্ত্ব, (Ego) রেখে দেন, তাহলে ভেদবুদ্ধিও রেখে দেন। তিনি দু-একজনেতে অহংকার একেবারে পুঁছে ফেলেন — তারা পাপ-পুণ্য ভাল-মন্দের পার হয়ে যায়। ঈশ্বরদর্শন যতক্ষণ না হয় ততক্ষণ ভেদবুদ্ধি ভাল-মন্দ জ্ঞান থাকবেই থাকবে। তুমি মূখে বলতে পার, আমার পাপ-পুণ্য সমান হয়ে গেছে; তিনি যেমন করাচ্ছেন, তেমনি করছি। কিন্তু অন্তরে জান যে, ও-সব কথা মাত্র; মন্দ কাজটি করলেই মন ধুকধুক করবে। ঈশ্বরদর্শনের পরও তাঁর যদি ইচ্ছা হয়, তিনি “দাস আমি” রেখে দেন। সে অবস্থায় ভক্ত বলে — আমি দাস, তুমি প্রভু। সে ভক্তের ঈশ্বরীয় কথা, ঈশ্বরীয় কাজ ভাল লাগে; ঈশ্বরবিমুখ লোককে ভাল লাগে না; ইশ্বর ছাড়া কাজ ভাল লাগে না। তবেই হল, এরূপ ভক্তেতেও তিনি ভেদবুদ্ধি রাখেন।
প্রতিবেশী — মহাশয় বলছেন, ঈশ্বরকে জেনে সংসার কর। তাঁকে কি জানা যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে ইন্দ্রিয় দ্বারা বা এ-মনের দ্বারা জানা যায় না। যে-মনে বিষয়বাসনা নাই সেই শুদ্ধমনের দ্বারা তাঁকে জানা যায়।
প্রতিবেশী — ঈশ্বরকে কে জানতে পারে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঠিক কে জানবে? আমাদের যতটুকু দরকার, ততটুকু হলেই হল। আমার এক পাতকুয়া জলের কি দরকার? একঘটি হলেই খুব হল। চিনির পাহারের কাছে একটা পিঁপড়ে গিছল। তার সব পাহাড়টার কি দরকার? একটা-দুটো দানা হলেই হেউ-ঢেউ হয়।
প্রতিবেশী — আমাদের যে বিকার, একঘটি জলে হয় কি? ইচ্ছা করে ঈশ্বকে সব বুঝে ফেলি!
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা বটে। কিন্তু বিকারের ঔষধও আছে।
প্রতিবেশী — মহাশয়, কি ঔষধ?
শ্রীরামকৃষ্ণ — সাধুসঙ্গ, তাঁর নামগুণগান, তাঁকে সর্বদা প্রার্থনা। আমি বলেছিলাম, মা, আমি জ্ঞান চাই না; এই নাও তোমার জ্ঞান, এই নাও তোমার অজ্ঞান, — মা আমায় তোমার পাদপদ্মে কেবল শুদ্ধাভক্তি দাও। আর আমি কিছুই চাই নাই।
"যেমন রোগ, তার তেমনি ঔষধ। গীতায় তিনি বলেছেন, ‘হে অর্জুন, তুমি আমার শরণ লও, তোমাকে সবরকম পাপ থেকে আমি মুক্ত করব।’ তাঁর শরণাগত হও, তিনি সদ্বুদ্ধি দেবেন। তিনি সব ভার লবেন। তখন সবরকম বিকার দূরে যাবে। এ-বুদ্ধি দিয়ে কি তাঁকে বুঝা যায়? একসের ঘটিতে কি চারসের দূধ ধরে? আর তিনি না বুঝালে কি বুঝা যায়? তাই বলছি — তাঁর শরণাগত হও — তাঁর যা ইচ্ছা তিনি করুন। তিনি ইচ্ছাময়। মানুষের কি শক্তি আছে?"
No comments:
Post a Comment