'আমি' আর 'তুমি' দুজন দুটি আলাদা entity হলেও আমার আর তোমার মধ্যে common factor হচ্ছে আমাদের সম্পর্ক। আমি আর তুমিরা জন্মাবো, কিছুদিন হট্টগোল করবো, তারপর একদিন মরে যাবো। সম্পর্কের মূল ভিত্তি কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে যাবে। আজ আমাদের দুজনের মধ্যেকার যে সম্পর্ক, অন্য কোনো সময়ে অন্য কোনো জায়গায় অন্য কোনো দুই ব্যক্তির মধ্যে অবশ্যই সেই একই সম্পর্ক তৈরি হবে, ফলে ব্যক্তি নশ্বর হলেও সম্পর্ক অবিনশ্বর। ছোটবেলায় গণিত শেখানোর সময় প্রথম শিখতে হয় যোগ। এক আর এক মিলে দুই হবে, আর এই মেলার চিহ্ন হচ্ছে যোগ - সবচেয়ে প্রথম এটাই শেখানো হয়। এবার দুইয়ে দুইয়ে চারই হোক বা ছয়শ আর আটশ মিলে চোদ্দশ, যোগ মানেই দুটি ভিন্ন identity মিলে এক হয়ে যাওয়া - দ্বৈত নয়, অদ্বৈত। দুটো হাত, দুটো আলাদা identity, একটা বাম আর অন্যটা ডান, একটা অন্যটার চেয়ে একটু বেশি শক্তিশালী, যেই যোগ হলো অমনি একটাই নমস্কার। একদম ছোটবেলায় বাবা-মা যখন হাতজোড় করতে শেখান, সেইদিন থেকে তাঁদের অজান্তেই আমাদের অদ্বৈতের পথচলা শুরু হয়ে যায়।
মাত্র দিনকয়েকের একটি শিশু, কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না, কোনো অসুবিধে হলে কেবল কাঁদে আর বাকি সময় ঘুমায়, সেও কিন্তু নিজের মায়ের গায়ের গন্ধটি চেনে। সেও জানে যে ঐ হচ্ছে আমার গ্রাহ্য আর আমি হলাম গ্রাহক। মায়ের সঙ্গে তার শুধু নেওয়ার সম্পর্ক - খাদ্য, স্নেহ, বাৎসল্য, পরিচর্যা, প্রতিপালন, নিরাপত্তা, সবকিছু। এ দেওয়া-নেওয়ার নয় কিন্তু, শুধুই নেওয়ার। তাহলে মায়ের কি এখানে কিছুই পাওয়ার নেই? আছে - সন্তানসুখ আর নিজের প্রাণসংশয়ের ঝুঁকি নিয়েও অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আনন্দ, যা একেবারেই non transactional. পেটের ভেতর থাকার সময় যে নাড়িটা দুজনকে জুড়ে রেখেছিল, জন্ম দেবার পরেও কিন্তু অদৃশ্যভাবে সেটা অক্ষুণ্ন থাকে আর ওটাই হলো মাতৃযোগ। এই সম্পর্কের একটা অতি বিশিষ্ট দিক আছে, কৃপা। কৃপা মানে অহেতুকি স্বার্থশূন্য অনুগ্রহ। কোনো অদৈবী মানুষ অন্য কোনো মানুষকে কৃপা করতেই পারেননা, কারণ একমাত্র দেবশরীর ছাড়া বাকি সকলের স্বার্থবোধ থাকবেই। মা কিন্ত তাঁর সদ্যজাত সন্তানকে কৃপাই করেন। যাঁরা মাতৃকৃপার তাৎপর্য বুঝতে পারবেন তাঁরা মায়ের মধ্যে ঈশ্বরের রূপও দেখতে পাবেন। ওই মুহূর্তে মা আর মহাশক্তি ভিন্ন থাকেন না, তাঁরা এক, অদ্বৈত।
যা ক্ষণস্থায়ী, non permanent, তার ওপর জোর দিয়ে কি লাভ? যতক্ষণ আমরা transactional relationship এর ওপর focus করে জীবনযাপন করি ততক্ষণই তুমি আর আমি। তুমি এই দিলে আর আমি এই দিলাম বা আমি এই দেবো আর বিনিময়ে তোমার কাছ থেকে এই আশা করি। এখানে সম্পর্কটি মুখ্য নয়, নিমিত্ত মাত্র, মুখ্য হলাম আমি আর তুমি। তা সে প্রেমিক প্রেমিকাই হন বা স্বামী স্ত্রী, বন্ধু বান্ধবই হন বা ভাই বোন, যাঁরা প্রত্যেকেই প্রতিমুহূর্তে একপা একপা করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন অথচ নিজেদের দেহবোধ-সর্বস্ব অস্তিত্বের প্রেমে নিজেরাই মশগুল, মনে মনে তাঁদের প্রতিদিনের এই জাগতিক দর কষাকষি বস্তুত তাঁদের আত্মপ্রবঞ্চনা। সম্পর্কের এই ধরণের অবমূল্যায়ন আপাতভাবে আলাদা আলাদা স্বত্তাকে কোনোদিনই এক করতে পারেনা। এটার যোগফল চিরকাল শূন্যই থাকে কারণ এ এক অন্তঃসারশূন্যের সাথে আর এক অন্তঃসারশূন্যের নিরর্থক যোগ।
যে মুহূর্তে নজরটা অনিত্যের ওপর থেকে নিত্যের ওপর shift করে যায়, অমনি আমি তুমির বদলে প্রত্যেক সম্পর্কের মধ্যে যে ঐশ্বরিক গুন আছে যেমন দয়া, ক্ষমা, প্রেম, বাৎসল্য, করুণা, অনুকম্পা ইত্যাদি, সেই বিষয়গুলিই মুখ্য হয়ে ওঠে এবং একবার মনে মনে এই paradigm shift হয়ে গেলে, ভোগের সংসার আপনেআপই যোগের সংসার হয়ে ওঠে। তখন আর পাওয়ার আশা নয়, শুধুই মর্য্যাদারক্ষা। অঙ্কে গুণ মানে বহুবার যোগ। আর ঐশ্বরিক গুণ হলো সেইসব গুণ যা ব্যবহারিক জীবনে বহুভাবে প্রকাশিত হয়ে আমাদের ভেতরে অধিষ্ঠিত জাগ্রত ঈশ্বরের অস্তিত্বের বাহ্যিক প্রতিফলন ঘটায়। যে মুহূর্তে আমি নিঃস্বার্থ হলাম, যে মুহূর্তে বিনিময়ে কোনো কিছু পাওয়ার আশা ছাড়াই আমি সম্পর্কের মান রাখতে উদ্যত হলাম, অমনি আমার 'মা ফলেষু কদাচন' হয়ে গেল। সেই মুহূর্তে ওই সম্পর্ককে ধরে আমি আমার অন্তরাত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করলাম, তাঁর গুণের সাথে সম্পৃক্ত হলাম, বহির্মুখী থেকে অন্তর্মুখী হলাম, বহু থেকে এক হলাম।
আদর্শ সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ আমরা শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও শ্রীশ্রীমায়ের জীবনে বহুবার দেখতে পাই, যার মধ্যে মাত্র চারটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ্য। প্রথমটি মায়ের দক্ষিণেশ্বরে আসার পথে তেলোভেলোর মাঠের ঘটনা। অন্ধকার বিপদসঙ্কুল পথে সদ্যযুবতী মা একা হেঁটে চলেছেন, হঠাৎ এক ভয়ঙ্করমূর্তি ডাকাত তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললে, "কে তুমি"? প্রচণ্ড সাহসিনী মা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, "আমি তোমার মেয়ে সারদা"। এর পরের কাহিনি সবার জানা। দুটি অপরিচিত ব্যক্তি এক মুহূর্তের মধ্যে এমন এক পবিত্র আপত্যের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন যে তাঁদের নিজেদের ব্যক্তিত্বের চেয়েও সেই সম্পর্কের শুদ্ধতা অনেক বড় হয়ে উঠলো। দ্বিতীয় উদাহরণ ঠাকুরের মাতৃবিয়োগের ঠিক পরের ঘটনা। মা চন্দ্রামণি দেবীর মৃত্যুসংবাদে ঠাকুর হাউহাউ করে কাঁদছেন, ভাগ্নে হৃদয় শ্লেষের স্বরে বললেন, "আপনি না সন্ন্যাসী, এত বিচলিত হওয়া কি আপনাকে সাজে?" রেগে উঠে ঠাকুর বললেন, "হৃদে, তুই চুপ কর। সন্ন্যাসী হয়েছি বলে তো আর হৃদয়হীন পশু হয়ে যাইনি।" এ হলো যখন অবতারপুরুষ স্বয়ং ব্রহ্মজ্ঞানী সন্ন্যাসীরূপে আত্মবোধকে ছাপিয়ে জন্মদাত্রী মায়ের সাথে সন্তানের পবিত্র সম্পর্কের বিশুদ্ধ রূপকে অধিক মর্য্যাদা দিচ্ছেন।
তৃতীয় ঘটনা দক্ষিণেশ্বরের। ঠাকুরকে রাতের বেলায় খাবার মা নিজের হাতেই দিতেন। এক দিন জনৈক স্বভাবচরিত্রে দুষ্ট মহিলা ঠাকুরের পবিত্র সংস্পর্শে আসার বাসনায় মাকে বললেন, "মা, দিন, আজ আমি ঠাকুরকে খাবার থালাটা পৌঁছে দিয়ে আসি।" মা সবই জানতেন তবু সেই মহিলার হাতেই হাসিমুখে ঠাকুরের খাবার থালাটা তুলে দিলেন। এই ঘটনায় ঠাকুর সামান্য অসন্তুষ্ট হন। পরে তিনি মাকে বলেন, "জান, ওই মেয়েটার স্বভাব চরিত্রে দোষ আছে। ওর হাতে আমাকে খেতে দিলে?" এ কথা শুনে মা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, "তোমার খাবার আমি নিজেই নিয়ে আসব, কিন্তু আমায় মা বলে চাইলে আমি থাকতে পারব না।" মা হবেন দেবীর মতো, বাৎসল্যরসে টইটুম্বুর, প্রেমময়ী ক্ষমাদাত্রী সর্বংসহা, তবেই না তিনি পাতানো মা নন, সত্যিকারের মা। সন্তানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সর্বদা স্বার্থবোধশূন্য, তাই সন্তানকে অদেয় তাঁর কিছুই নেই। এখানে সন্তান বড় নয়, মাতৃভাবই আসল। আর এটা মা তাঁর সমস্ত সন্তানদের সাথেই করতেন, কেউ বাদ পড়তো না।
চতুর্থ ও শেষ ঘটনাটি এক ফলহারিণী পূজার রাতের। সেইদিন ঠাকুর তাঁর নিজের স্ত্রীকে জগজ্জননী রূপে আরাধনা করেছিলেন। এর অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব, যদিও পূজ্যপাদ চেতনানন্দজী মহারাজ খানিকটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। সারা জীবন ঠাকুর ঈশ্বরকে মাতৃরূপে আরাধনা করে এসেছেন। সেই মাতৃরূপিণী শক্তিকে তিনি শ্রীশ্রীমাতে আরোপিত করলেন, তারপর তাঁর পদপ্রান্তে নিজের সব সাধনা উৎসর্গ করে দিলেন। ঠাকুরের এই ষোড়শী পূজা অধ্যাত্মজগতে এক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মহারাজ বলছেন, কোনও কোনও অবতার বিবাহ করেছেন, যেমন - রামচন্দ্র, রামকৃষ্ণ। কোনও কোনও অবতার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছেন, যেমন - বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য। শ্রীরামকৃষ্ণ স্ত্রীকে পরিত্যাগ তো করলেনই না, উল্টে তাঁকে শক্তি রূপে আরাধনা করলেন। এ এক বিরল, ব্যতিক্রমী ঘটনা। আর এখানেই ব্যক্তি ছেড়ে সম্পর্কের ওপর মনোনিবেশের মাহাত্ম - যে সম্পর্ককে ভিত্তি করে অনিত্যকে অতিক্রম করে নিত্যের সাথে যোগের যাত্রা শুরু করা বা করানো সম্ভবপর হয়।
No comments:
Post a Comment