Saturday, November 25, 2023

বৃক্ষেই প্রত্যক্ষ

বৃক্ষেই প্রত্যক্ষ

নর্মদার তীরে অখন্ড নিরাহার অবস্থায় দাদাগুরু নামক এক যোগী মহাত্মা আছেন, ইউটিউবে ওঁর একটি অনবদ্য বাণী শুনলাম, "बृक्ष ही प्रत्यक्ष है", অর্থাৎ বৃক্ষই (তাঁর) প্রত্যক্ষ রূপ। যখন থেকে শুনেছি তখন থেকে মনের মধ্যে ক্রমাগত বাক্যটি ঘুরে চলেছে আর যত ভাবছি তত ধীরে ধীরে এর গুঢ়ার্থ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। কত রকমের angle যে এই ছোট্ট কথাটার মধ্যে আছে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। এ যেন সেই উপনিষদীয় মহাবাক্যের মতো - codified - যত ছাড়াবে তত ভেতরের শাঁস বেরোবে। ওই মধ্যপ্রদেশেই একজন স্বামী চিদানন্দ মহারাজ আছেন, উনি আবার বৃক্ষকেই প্রত্যক্ষ শিব বলেন (वृक्ष ही प्रत्यक्ष शिव हैं, जो कार्बन डाइऑक्साइड रूपी विष को ग्रहण कर हमें अमृत रूपी ऑक्सीजन दान देते हैं) কারণ বৃক্ষ কার্বনডাইঅক্সাইডরূপী বিষ নিজে গ্রহণ করে আমাদের অক্সিজেনরূপী প্রাণবায়ু প্রদান করে। 

আমার মনে পড়ছে আসানসোলে বাবার সরকারি বাংলোর গেটে ঢোকার মুখে বাঁ ধারে একটা অর্জুন গাছ ছিল। অর্জুন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ঋজু শব্দ থেকে। ঋজু মানে একদিকে যেমন সোজা, straight, আবার অন্যদিকে সরল। কারো সরল স্বভাব মানে কিন্তু তাঁর সংস্কার অতি উচ্চমানের, এ এক দারুন strength। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের অর্জুনকে বলছেন দেহাভিমান জয় করতে হলে শরীর, মন ও বাণী সরল হতে হবে, প্যাঁচঘোঁচ থাকলে চলবে না বাপু। আমাদের সেই অর্জুন গাছটি ছিল সরলতার প্রতিমূর্তি - কেউ তার বাকল ছিঁড়ে নিয়ে যেত বেটে খোশ পাঁচড়ায় লাগাবে বলে, কেউ তার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যেত ফুটিয়ে কত্থটি আমাশয়ের ওষুধ হিসেবে খাবে বলে, পারলে কেউ তার কান্ডটাও হয়তো কেটে নিয়ে যেত গরুর গাড়ির চাকা বানাবে বলে, ভাগ্যক্রমে আমরা থাকাকালীন সেটা আর সম্ভব হয়নি। কাউকে কোনোদিন ওর গোড়ায় জল বা সার কিছুই দিতে দেখিনি - ও গাছ কেবল দিত, নিত না কিছুই। 

আসলে আমাদের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে বৃক্ষ বারবার ফিরে এসেছে ত্যাগের প্রতীক হয়ে। পুরাণে যে কল্পতরুর কথা বলা আছে, সেই বৃক্ষের কাছে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। তাই যেদিন কাশীপুর বাগানবাড়িতে একটি বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেব ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরুরূপে ধরা দিয়ে বলেছিলেন, "আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হোক", সেইদিনটি কল্পতরু দিবস হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় হলো ঠাকুরের শরীর চলে গেছে কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে সেই বৃক্ষটি কিন্তু আজও রয়ে গেছে - মানুষ ওখানে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে। একইভাবে রয়ে গেছে কামারপুকুরে ঠাকুরের নিজের হাতে পোঁতা আমের আ‌ঁটির গাছ, ঠাকুরের স্মৃতি হিসেবে যার একটি পাতা আমাদের বাড়িতেও সংরক্ষিত আছে। এই বৃক্ষগুলিকে দেখলে ঠাকুরের কথা মনে পড়ে - ওরা যেন ঠাকুরেরই extension, তাঁরই লীলাসঙ্গী।

একই কথা বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বুদ্ধদেবের সময়কার সেই অশ্বথ গাছটি আর বেঁচে নেই, কিন্তু বুদ্ধদেবের সেই লীলাসঙ্গীর সন্তান সন্ততিরা ছড়িয়ে রয়েছে সারা বিশ্বজুড়ে। সাধনকালে বোধিবৃক্ষ বুদ্ধদেবকে ছায়া প্রদান করেছিল বলে পরে তিনি ওই বোধিবৃক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। এখনও ভক্তদের মনে বুদ্ধদেবের স্মৃতিকে নতুন করে জাগরিত করতে প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে বোধিবৃক্ষের উপস্থিতি একান্তই আবশ্যক। এমনকি সম্রাট অশোক তার পুত্র মহেন্দ্র ও তার কন্যা সংঘমিত্রাকে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে সিংহলে পাঠানোর সময় ওই বোধিবৃক্ষের চারাই সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। এখনো শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধরা পবিত্র বোধিবৃক্ষের শাখাতেই পরলোকগত জ্ঞাতিবর্গের উদ্দেশে শ্বেতবর্ণের কাপড়ের তৈরি স্তম্ভক আকৃতির অর্ঘ টাঙিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।

দেখছি শান্তিনিকেতনে দশম সাম্বৎসরিক ব্রহ্মোৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তৃতায় সবটা কেমন সুন্দরভাবে মিলিয়ে দিচ্ছেন। আচার্য্য বলছেন, "বৃক্ষে যে ফল থাকে সে ফল হইতে রস আকর্ষণ করিয়া পরিপক্ব হইয়া উঠে। যতই সে পরিপক্ব হইতে থাকে ততই বৃক্ষের সহিত তাহার বৃন্তবন্ধন শিথিল হইয়া আসে, অবশেষে তাহার অভ্যন্তরস্থ বীজ সুপরিণত হইয়া উঠিলে বৃক্ষ হইতে সে সহজেই বিচ্ছিন্ন হইয়া বীজকে সার্থক করিয়া তোলে। আমরাও সংসারবৃক্ষ হইতে সেইরূপ বিচিত্র রস আকর্ষণ করি-- মনে হইতে পারে তাহাতে সংসারের সহিত আমাদের সম্বন্ধ ক্রমেই দৃঢ় হইবে-- কিন্তু তাহা নহে, আত্মার যথার্থ পরিণতি হইলে বন্ধন আপনি শিথিল হইয়া আসে। ফলের সহিত আমাদের প্রভেদ এই যে, আত্মা সচেতন; রস নির্ব্বাচন ও আকর্ষণ বহুল পরিমাণে আমাদের স্বায়ত্ত। 

"আত্মার পরিণতির প্রতি লক্ষ করিয়া বিচারপূর্ব্বক সংসার হইতে রস গ্রহণ ও বর্জ্জন করিতে পারিলেই সংসারের উদ্দেশ্য সফল হয় এবং সেই সঙ্গে আত্মার সফলতা সম্পন্ন হইলে সংসারের কল্যাণবন্ধন সহজেই শিথিল হইয়া আসে। অতএব ঈশ্বরের দ্বারা সমস্ত আচ্ছন্ন জানিয়া সংসারকে তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা, তাঁহার দত্ত সুখসমৃদ্ধির দ্বারা ভোগ করিবে-- সংসারকে শেষ পরিণাম বলিয়া ভোগ করিতে চেষ্টা করিবে না। অপর পক্ষে সংসারের বৃন্তবন্ধন বলপূর্ব্বক বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহার মঙ্গলরস হইতে আত্মাকে বঞ্চিত করিবে না । ঈশ্বর এই সংসারবৃক্ষের সহস্র তন্তুর মধ্য দিয়া আমাদের আত্মার কল্যাণরস প্রেরণ করেন; এই জীবধারয়িতা বিপুল বনস্পতি হইতে দম্ভভরে পৃথক্‌ হইয়া নিজের রস নিজে যোগাইবার ক্ষমতা নাই।"

বিভিন্ন আধ্যাত্মিক আলোচনায় 'দেহবৃক্ষ' শব্দটিরও একটি বিশেষ মাহাত্ম আছে, অর্থাৎ দেহকে বৃক্ষের সাথে তুলনা করে একটা বৌদ্ধিক allegory টানা হয় - বৃক্ষের ক্ষেত্রে যেমন জাইলেমের মাধ্যমে জল ও খনিজ পোষণ মাটির নিচ থেকে ওপরে পাতা অবধি ওঠে, তেমনি দেহের মূলাধারে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা কুলকুন্ডলিনী যোগক্রিয়ার মাধ্যমে ব্রহ্মতালুতে অর্থাৎ সহস্ররারে গিয়ে পৌঁছয়। অন্যভাবেও, মানবদেহকে নানা মতাবলম্বীরা নানাভাবে বৃক্ষের সাথে তুলনা করেছেন - সেই গোবিন্দ দাসের কড়চায় আছে না,
এই বিশ্ব ঢাকিয়াছে পাপ অন্ধকারে ।
হরি ভিন্ন কিছু সত্য নাহিক সংসারে ।।
পাখি দুটি দেহবৃক্ষ যেদিন ছাড়িবে ।
সেদিন জড় দেহ পড়িয়া রহিবে ।।

তখন শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে আছেন, সেদিন শুক্রবার বেলা ৫টা, চৈত্র শুক্লা পঞ্চমী। ৯ই এপ্রিল, ১৮৮৬। ঠাকুর বলছেন,
"হৃষীকেশের সাধু এসেছিল। সে (আমাকে) বললে, কি আশ্চর্য! তোমাতে পাঁচপ্রকার সমাধি দেখলাম!
"কখন কপিবৎ — দেহবৃক্ষে বানরের ন্যায় মহাবায়ু যেন এ-ডাল থেকে ও-ডালে একেবারে লাফ দিয়ে উঠে, আর সমাধি হয়।
"কখন মীনবৎ — মাছ যেমন জলের ভিতরে সড়াৎ সড়াৎ করে যায় আর সুখে বেড়ায়, তেমনি মহাবায়ু দেহের ভিতর চলতে থাকে আর সমাধি হয়।
"কখন বা পক্ষীবৎ — দেহবৃক্ষে পাখির ন্যায় কখনও এডালে কখনও ও-ডালে।
"কখন পিপীলিকাবৎ — মহাবায়ু পিঁপড়ের মতো একটু একটু করে ভিতরে উঠতে থাকে, তারপর সহস্রারে বায়ু উঠলে সমাধি হয়। 
"কখন বা তির্যক্‌বৎ — অর্থাৎ মাহবায়ুর গতি সর্পের ন্যায় আঁকা-ব্যাঁকা; তারপর সহস্রারে গিয়ে সমাধি।”

শেষ করছি আমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে প্রত্যক্ষ ব্রহ্মরূপী বৃক্ষের কি স্থান, প্রাচীন text থেকে তার উদাহরণ দিয়ে। নিশ্চয় জানা আছে যে অত্যন্ত প্রয়োজনে কোনো জীবিত বৃক্ষকে কাটার আগে তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে তার প্রাণ বিসর্জনের রীতি এখনো এ দেশে প্রচলিত আছে। তিনটি মাত্র উদ্ধৃতি দেবো, আমাদের সভ্যতার অন্তরাত্মাকে বোঝার জন্য তাই যথেষ্ট:
১. যদি কোন দরিদ্র ব্যক্তি একটিমাত্র গাছও রোপণ করেন তবে তিনি ব্রহ্মসদনে যাবার অধিকার অর্জন করেন এবং তার তৃতীয় পুরুষ পর্যন্ত সেই ফল ভোগ করে। (ব্রহ্মনারদীয় পুরাণ, ১৩/৫২)
২. উদ্ভিদাদি রোপণ ও পরিচর্যা করলে ভূমিদান ও গোদানের সমতুল্য পুণ্য অর্জিত হয়। (বরাহপুরাণ, ১৭২/৩৫)
৩. যদি কেউ স্বীয় রন্ধনের উদ্দেশ্যে জ্বালানির জন্য অপরিপক্ক বৃক্ষ ভূপাতিত করে তবে তাকে চরম পতিত বলে গণ্য করা হবে। (মনুস্মৃতি, ১১/৬৬)

Wednesday, November 22, 2023

অন্তরতর



রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে ও কবিতায় একাধিকবার 'অন্তরতর' শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যেমন 'অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে, নির্মল করো উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে' অথবা 'কে গো অন্তরতর সে, আমার চেতনা আমার বেদনা তারি সুগভীর পরশে' ইত্যাদি। লক্ষ্য করে দেখেছি যখনই রবীন্দ্রনাথ এই শব্দটি ব্যবহার করে গান বেঁধেছেন, অধিকাংশ সময়ই হয় ইমন নয় ঝিঁঝোটী নয় ভৈরবী রাগের ওপর নির্ভর করেছেন অর্থাৎ যথাক্রমে রাত্রির প্রথম প্রহর, দ্বিতীয় প্রহর ও দিনের প্রথম প্রহরের রাগ, সবকটিই ধ্যানের পক্ষে একেবারে আদর্শ সময়। এখন প্রশ্ন হলো অন্তর মানেই তো ভিতর, তাহলে বিশেষ করে 'অন্তরতর' (যার অর্থও ভিতর) শব্দটি ব্যবহার করার প্রয়োজন কি এবং যদি innermost বলতে হতো তাহলে অন্তরতম কেন ব্যবহৃত হলো না? 

আসলে বিশেষণ হিসেবে অন্তরের অর্থ 'অপর' হলেও, বিশেষ্য হিসেবে অন্তর মানে কিন্তু 'মন' বা 'হৃদয়'। ওদিকে আবার হরিচরণ বন্ধ্যোপাধ্যায় বলছেন বাংলা অন্তরের মূলে হলো সংস্কৃত ‘অনন্তর’, অব্যয় পদ, যার অর্থ 'তাহার পর' বা 'অতঃপর'। ন + ব্যয় = অব্যয় - যার পরিবর্তন বা ব্যয় হয় না, অর্থাৎ যা অপরিবর্তনীয় তাই অব্যয়, এই পদটির বিশেষত্বও এখানে বিবেচ্য। আমার ধারণা এখানে রবীন্দ্রনাথ অন্তর বলতে প্রচলিত অর্থে 'মন'কে এবং অন্তরতর বলতে 'মনের পারে' অর্থাৎ মনের দ্রষ্টাকে বুঝিয়েছেন। মনের যিনি দ্রষ্টা, যিনি তুরীয়, যাঁর বিনাশ নেই, বিন্যাসও নেই, যিনি অপরিবর্তনীয়, তিনিই রবীন্দ্রনাথের অব্যয় পদধর্মী 'অন্তরতর'। 

অন্যদিকে, বাংলা ভাষায় 'অন্তরতম' শব্দটি সাধারণত 'প্রিয়তম' বা 'ঘনিষ্টতম' অর্থে ব্যবহার করা হয়, অর্থাৎ এই শব্দটির মূলে একটা দ্বৈতভাব আছে - আমার প্রিয়তম, অর্থাৎ আমি আর আমার প্রিয়তম দুটি ভিন্ন স্বত্তা। এক্ষেত্রে মনেরও একটা বড় ভূমিকা আছে - মন যাকে সবচেয়ে বেশি প্রিয় মনে করে, তিনিই অন্তরতম। অন্তরতর কিন্তু মনের পারে - তিনি স্থির, নিশ্চল, তিনি খালি মনের গতিবিধি লক্ষ্য করে চলেছেন কিন্তু লিপ্ত হচ্ছেন না। তিনি আত্মা, অবিনশ্বর। তিনি একম্ সৎ, বিপ্রঃ বহুধা বদন্তি, যা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক ব্রাহ্ম মতাবলম্বী রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের সাথেও সম্পূর্ণরূপে সম্পৃক্ত। 

শাস্ত্রের সাথে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে অদ্বৈত বেদান্তের আকর গ্রন্থ দৃগ্-দৃশ্য-বিবেকে ভারতীতীর্থস্বামী প্রথম শ্লোকে এঁর সম্পর্কেই বলেছেন, 
रूपं दृश्यं लोचनं दृक् तद्दृश्यं दृक्तु मानसम् । 
दृश्या धीवृत्तयः साक्षी दृगेव न तु दृश्यते ॥ १॥ 
দেখছে যে চোখ , হচ্ছে সে 'দৃক', যা দেখি তাই 'দৃশ্য',
আবার চোখ কে দেখে মন যখন - চক্ষু সেথায় দৃশ্য ।
আবার মন আর মনের ভাবনাগুলি 'আত্মা' তাদের দেখে,
সে আত্মা দৃশ্য তো নয় - 'দৃক্' কহি মোরা যাকে ।।
রবীন্দ্রনাথ তো বোধি, বোধের উচ্চতম শিখরে তাঁর অবস্থান। তাঁর কাছে আত্মা আর পরমাত্মা এক এবং অবিচ্ছেদ্য। তাই কবি যখন অন্তরাত্মার কাছে প্রার্থনায় নত, তখন তিনি অবলীলায় গেয়ে ওঠেন,
"হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর,
এ জীবনে যা-কিছু সুন্দর
সকলি আজ বেজে উঠুক সুরে
প্রভু, তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে।"

এমন কথা এত সহজে কি আর সবাই বলতে পারেন? আমরা কজনই বা আর অন্তর পেরিয়ে অন্তরতরকে প্রাত্যহিক যাপনে অনুভব করতে পারি? যদি পারতাম তাহলে আমাদের আত্মকথনও হয়তো এমনতর হতো:
"সোনালি রুপালি সবুজে সুনীলে      
সে এমন মায়া কেমনে গাঁথিলে--
তারি সে আড়ালে চরণ বাড়ালে, ডুবালে সে সুধাসরসে।
কত দিন আসে কত যুগ যায়,      
গোপনে গোপনে পরান ভুলায়,
নানা পরিচয়ে নানা নাম ল'য়ে নিতি নিতি রস বরষে॥"

আত্মপ্রত্যয় নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপলব্ধি বর্ণনা করে লিখছেন, 'আমরা সামজকে যে এক বলে জানি সেই জানবার ভিত্তি হচ্ছে আমাদের আত্মা-- মানবকে এক বলে জানি, সেই জানার ভিত্তি হচ্ছে এই আত্মা-- বিশ্বকে যে এক বলে জানি তারও ভিত্তি হচ্ছে এই আত্মা এবং পরমাত্মাকে যে অদ্বৈতম্‌ বলে জানি তারও ভিত্তি হচ্ছে এই আত্মা। এইজন্যই উপনিষৎ বলেন, সাধক-- আত্মন্যেবাত্মানং পশ্যতি-- আত্মাতেই পরমাত্মাকে দেখেন। কারণ, আত্মাতে যে ঐক্য আছে সেই ঐক্যই পরম ঐক্যকে খোঁজে এবং পরম ঐক্যকে পায়। যে জ্ঞান তার নিজের ঐক্যকে আশ্রয় করে আত্মজ্ঞান হয়ে আছে সেই জ্ঞানই পরমাত্মার পরম জ্ঞানের মধ্যে চরম আশ্রয় পায়। 

'এইজন্যই পরমাত্মাকে "একাত্মপ্রত্যয়সারং" বলা হয়েছে। অর্থাৎ নিজের প্রতি আত্মার যে একটি সহজ প্রত্যয় আছে সেই প্রত্যয়েরই সার হচ্ছেন তিনি। আমাদের আত্মা যে স্বভাবতই নিজেকে এক বলে জানে, সেই এক জানারই সার হচ্ছে পরম এককে জানা। তেমনি আমাদের যে একটি আত্মপ্রেম আছে, আত্মাতে আত্মার আনন্দ, এই আনন্দই হচ্ছে মানবাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি, বিশ্বাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি, পরমাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি। অর্থাৎ এই আত্মপ্রেমেরই পরিপূর্ণতম সত্যতম বিকাশ হচ্ছে পরমাত্মার প্রতি প্রেম-- সেই ভূমানন্দেই আত্মার আনন্দের পরিণতি। আমাদের আত্মপ্রেমের চরম সেই পরমাত্মায় আনন্দ। তদেতৎ প্রেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োহন্যস্মাৎ সর্বস্মাৎ অন্তরতর যদয়মাত্মা।'

এটা পড়ার পর মনে হয়েছে যে আমি যেভাবে রবীন্দ্রনাথের দ্বারা অন্তরতর শব্দটির ব্যবহারকে বুঝেছি, সেটা বোধহয় ঠিকই আছে। এ বিষয়ে অন্য রবীন্দ্রানুরাগীদের মধ্যে যদি কেউ ভিন্ন মত পোষণ করেন, দয়া করে জানাবেন - সমৃদ্ধ হবো। সত্যি কথা বলতে কি, ওনাকে বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের জন্য একটাই কথা প্রযোজ্য:
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না। 
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা ॥

Tuesday, November 21, 2023

শিক্ষা, বিদ্যা ও জ্ঞান



যিনি অনেক পড়েছেন এবং জেনেছেন, বিদেশে সাধারণত তাঁকেই জ্ঞানী বলা হয়। ইংরেজ আমল থেকে বিদেশি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে আমাদের দেশেও বিদ্বজনদের জগতে বিদ্যার মানদণ্ড হিসেবে প্রাথমিকভাবে ডিগ্রিকেই ধরে নেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ যাঁর যত বেশি ডিগ্রি তিনি তত বেশি শিক্ষিত এবং যিনি যত বেশি শিক্ষিত তিনি তত বেশি জ্ঞানী। আমরা সনাতনীরা বাপু এর উল্টোটাই জেনে এসেছি। যিনি নিজেকে জানেন তিনি জ্ঞানী, বাকি সব অজ্ঞানী, তা তাঁদের প্রথাগত বা পুঁথিগত বিদ্যা যতই থাক না কেন। আমাদের বোধে বিদ্যা আর জ্ঞান এক নয়। বস্তুত, সংস্কৃতে বিদ্যার মূলে হল 'বিদ্' ধাতু, যার অর্থ 'বিবেচনা করা'। যেখানে বিবেচনা করে গ্রহণ বা বর্জন করার সুযোগ নেই, সে আর যাই হোক, বিদ্যা নয়।

মূলত জ্ঞানমার্গ বলতে সনাতন সংস্কৃতিতে যা আমরা বুঝি তা শাস্ত্রীয় সূত্রগুলিকে চুলচেরা বিচার ও বিশ্লেষণ করে আত্মজ্ঞান অর্জন করার ছয়টি মার্গ বা ছয়টি দর্শনের অধ্যয়নকে নির্দেশ করে - ন্যায়, যোগ, বৈশেষিক, সাংখ্য, পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা। যেমন আজকাল ডাক্তাররা theory of elimination মেনে একগাদা টেস্ট লিখে দেন না, অনেকটা সেরকম। হয়তো সর্দি কাশি জ্বর হয়েছে, চেস্ট এক্সরে লিখে দিলেন, তারপর রিপোর্ট দেখে নিশ্চিন্ত হলেন যে যাক বাবা, নিউমোনিয়া হয়নি। অর্থাৎ যাবৎ কিছু আছে সবকিছু ভালো করে দেখে নাও, বুঝে নাও, তারপর একে একে 'এটা নয়' 'এটা নয়' করতে করতে একেবারে মূল জায়গায় পৌঁছে যাও। তারপর হলো theory of affirmation - clinically যে ব্যামো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে কেবল সেটারই পরীক্ষা করে রেসাল্ট দেখে নিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া যে 'আমিই সেই' - ঠাকুর একে বলতেন 'বিজ্ঞান'। 

আসলে বিদেশি জাগতিক জ্ঞান আরোহণের প্রয়াসকে সনাতনী অখন্ড বা অদ্বৈতজ্ঞানের অন্বেষণের দিকে ঘোরানোর জন্য গোটাকতক ব্যক্তিগত গুণের প্রয়োজন হয় যেমন বিবেক, শমদমাদি (আত্মশাসন), উপরতি (নিবৃত্তি), তিতিক্ষা (ধৈর্য্যশীলতা), সমাধি (মনের একীকরণ), শ্রদ্ধা, বিরাগ (ঔদাসীন্য) ও মুমুক্ষুত্ব (মোক্ষলাভের ইচ্ছা)। আর এই অন্বেষণের তিনটি stage আছে - প্রথমে শ্রবণ (শোনা বা পড়া), তারপর মনন (যুক্তি-বুদ্ধিদ্বারা বিশ্লেষণ) ও শেষে নিদিধ্যাসন (নিরন্তর ধ্যান)। এটা অনেকটা কোনো যুগান্তকারী বিজ্ঞানীর দীর্ঘদিনের intense গবেষণার মতো - খোঁজ খোঁজ খোঁজ, এটা নিয়ে পরীক্ষা, ওটা নিয়ে পরীক্ষা, বছরের পর বছর ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে শেষে হটাৎ একদিন কাঙ্খিত বস্তুটিকে আবিষ্কার - ইউরেকা! তবে আত্মোপলব্ধি সকলের জন্য নয়, ফলে সেখানে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে ঠাকুরের lesson plan মেনে চললেই হবে। 

শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষাদান পদ্ধতির দুটি বিশেষত্ব হলো অধিকারীভেদ এবং রুচিভেদ। "কি জানো রুচিভেদ, আর যার যা পেটে সয়। তিনি নানা ধর্ম নানা মত করেছেন, আর যার যা পেটে সয়। তিনি নানা ধর্ম নানা মত করেছেন অধিকারী বিশেষের জন্য। সকলে ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী নয়। তাই আবার তিনি সাকার পূজার ব্যবস্থা করেছেন। মা ছেলেদের জন্য বাড়িতে মাছ এনেছে। সেই মাছ ঝোল, অম্বল, ভাজা আবার পোলাও করলেন। সকলের পেটে কিন্তু পোলাও সয় না। তাই কারও কারও জন্য মাছের ঝোল করেছেন তারা পেট রোগা। আবার কারও সাধ অম্বল খায়, বা মাছ ভাজা খায়। প্রকৃতি আলাদা - আবার অধিকারীভেদ।" (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ৩য় খণ্ড, ৯ম অধ্যায়, ৫ম পরিচ্ছেদ)

ফিরে যাওয়া যাক বিদেশি education বা শিক্ষার বিষয়ে, যাকে বিদেশিরা বিদ্যা বলেই মনে করেন। এনক্লাইকোপেডিয়া ব্রিটানিকায় educationকে সংজ্ঞায়িত করে বলা হচ্ছে, 'Education: discipline that is concerned with methods of teaching and learning in schools or school-like environments as opposed to various nonformal and informal means of socialization. Education can be thought of as the transmission of the values and accumulated knowledge of a society.' এর ঠিক বিপরীতমেরুতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয় (পল্লীপ্রকৃতি, পল্লীর উন্নতি)। বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হলো social being তৈরি করা আর সনাতনী বিদ্যাভাসের উদ্দেশ্য হলো জিজ্ঞাসু তৈরি করা - আমি আসলে কে, কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাবো ইত্যাদি, দুটোর approach-এ বিস্তর ফারাক।

আধুনিক মনীষীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা নিয়ে যত ফলিত প্রয়োগ করেছেন, সেই অভিজ্ঞতার বলে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার অসারতাকে বুঝে কবি তাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বলছেন, 'যে-কাঁচাবয়সে মন অজ্ঞাতসারে আপনার খাদ্য শোষণ করিতে পারে, তখনই সে জ্ঞান ও ভাবকে আপনার রক্তমাংসের সহিত পূর্ণভাবে মিশাইয়া নিজেকে সজীব সবল সক্ষম করিয়া তোলে। সেই সময়টাই আমাদের মাঠে মারা যায়। সে-মাঠ শস্যশূন্য অনুর্বর নীরস মাঠ। সেই মাঠে আমাদের বুদ্ধি ও স্বাস্থ্য কত যে মরিয়াছে তাহার হিসাব কে রাখে' (প্রবন্ধ 'শিক্ষা-সংস্কার')। রোগশয্যায় শুয়ে ঠাকুর বলেছিলেন, "নরেন শিক্ষে দিবে। যখন ঘরে বাইরে হাঁক দিবে"। ঈশ্বরে অবিশ্বাসী নরেন্দ্রনাথ বহুদিন শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে অতিবাহিত করার পরে উপলব্ধি করেছিলেন যে ঈশ্বর তাঁর নিজের মধ্যেই অবস্থান করছেন। 

স্বামীজী সেই পরমজ্ঞানের শিক্ষাই জগৎকে দিয়েছিলেন বটে, যা আসলে সনাতন ভারতের চিরন্তন শিক্ষা। সিংহবিক্রমে একেবারে বিশ্ববাসীর ঘাড় ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "মানুষ পাপী নয়, মানুষ দেবতা", বলেছিলেন, "প্রত্যেকের মধ্যে অন্তর্নিহিত দেবত্ব রয়েছে ও তাকে প্রকাশ করাই জীবনের লক্ষ্য", "সমস্ত শক্তি তোমার মধ্যেই আছে, তুমি যা চাইবে তাই করতে পারবে", "যে নিজেকে বিশ্বাস করে না সেই নাস্তিক", বলেছিলেন, "ওঠো, জাগো এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে থেমো না"। আমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে একেই প্রকৃত শিক্ষা বলে। যে উপনিষদীয় শিক্ষা আমরা স্কুলে পাইনি, আমি চাই এখনকার ও ভবিষ্যতের প্রজন্ম সেই শিক্ষা পাক। অন্তত ভারতের বিদ্যালয়গুলিতে ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান গণিত কম্পিউটার ইত্যাদির সাথে সাথে এটাও পড়ানো হোক যে every man is potentially Divine - নইলে social being তৈরি হলেও, eternal being হিসেবে তার মানসিক উত্তরণ ঘটবে কি করে?

Wednesday, November 15, 2023

প্রারব্ধ

গতকাল ইউটিউবে দেখলাম বৃন্দাবনে শ্রীরাধা কেলিকুঞ্জে বাবা প্রেমানন্দ মহারাজের কাছে এক মা তাঁর ক্যান্সার রোগগ্রস্ত শিশুকে নিয়ে এসেছেন। বাবা অনেকভাবে সেই দুঃখিনী মাকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলেন এবং শেষে ভেবে দেখতে বললেন যে এ তো শিশু, এর তো কোনো কর্মফল জমা হয়নি, তাহলে একে কেন এত ভুগতে হচ্ছে? তারপর নিজেই এর উত্তর দিলেন, "इसकी शरीर नवीन है पर ईसके अंदर जो प्राणी है वे प्राचीन है, ये व प्राणी का प्रारब्ध है" - এর শরীর নবীন কিন্তু এর ভেতরে যে প্রাণী আছে সে প্রাচীন, এটা সেই প্রাণীটির প্রারব্ধ। আরো বললেন, যে কোনো কাজ করার আগে ভেবে দেখতে হয় ধর্মত ঠিক পথে আছি কিনা নাহলে ধর্মভ্রষ্ট হওয়ার ফল কোনো এক শরীরকে তো ভুগতেই হবে। আসলে রোজই চোখের সামনে এই সত্যটি ঘটতে দেখি কিন্তু হয়তো তার মর্মকে উপলব্ধি করতে পারিনা। কত রাস্তার কুকুরকে দেখি খেতে পায়না, পা খোঁড়া, গায়ে ঘা, লোকের লাথি ঝাঁটা খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে, আবার কোনো কোনো কুকুরকে দেখি গাড়ি চড়ে গড়ের মাঠে হওয়া খেতে যাচ্ছে, সকাল সন্ধ্যে আদর খাচ্ছে, নিয়মিত স্নান করিয়ে সুগন্ধ মাখিয়ে গ্রূমিং করা হচ্ছে, এসিতে ঘুমাচ্ছে - দেখি কিন্তু কারই বা মনে হয় যে কুকুরের তো আর মানুষের মতন পাপ করার ক্ষমতা নেই, তাহলে ওদের মধ্যে এই বৈষম্য কেন?
Now, verily, a man consists of will. As he wills in this world, so does he become when he has departed hence. Let him [with this knowledge in mind] form his will. (3.14.1 Chandogya Upanishad)

Sunday, November 12, 2023

আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ

সংস্কৃতে 'মন্ত্র' শব্দের অর্থ হলো 'আহ্বান করা'। আমরা পূজার সময় মন্ত্র পড়ি, অর্থাৎ দেবতাকে আহ্বান করি। এই মন্ত্র শব্দে যখন আলাদা আলাদা উপসর্গ অর্থাৎ prefix লাগে যেমন 'আ' অথবা 'নি', তখন দুটি আলাদা শব্দ তৈরি হয় - আমন্ত্রণ এবং নিমন্ত্রণ, যাদের আমরা সমার্থক বলেই মনে করি। আসলে কিন্তু তা নয়। 'আ' হচ্ছে আকর্ষণসূচক - to attract - কর্ষণ মানে টানা আর আকর্ষণ মানে নিজের দিকে টানা। তাহলে আমন্ত্রণ মানে হোলো কাউকে নিজের বাড়িতে অথবা নিজস্ব কোনো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আহ্বান করা। ওদিকে 'নি' মানে 'খুব বড়' যেমন নিকুঞ্জ মানে খুব বড় লতাগৃহ। তাহলে নিমন্ত্রণ মানে হলো খুব জমকালো কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে কাউকে আহ্বান করা, যেমন বিয়েতে নিমন্ত্রণ বা নেমন্তন্ন করা হয় কারণ বেশ জমজমাট ব্যাপার, দুটি প্রাণের মিলন, প্রচুর লোকজন, খাওয়া দাওয়া, হুল্লোড়,  হৈহৈ ব্যাপার একেবারে। এই দুটি শব্দই যেহেতু সরাসরি সংস্কৃত থেকে এসেছে, অর্থাৎ তৎসম শব্দ, তাই এদের ব্যবহার সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী সঠিক হওয়াই শ্রেয়। এক জায়গা থেকে একটি 'আমন্ত্রণ পত্র' এসেছে। পড়েই মনে হলো উদ্যোক্তাদের ডেকে বলি এটা সর্বজনীন সামাজিক অনুষ্ঠান, এক্ষেত্রে 'নিমন্ত্রণ পত্র' হবে। তারপর ভাবলাম, থাক। বাঙালি সবই তো ভুলে গেছে, ভাষাটাই বা আর বাকি থাকে কেন।

Friday, November 10, 2023

শরীরের পারে

আমি শরীর নামক একটা জামা পরে আছি যার বাহ্যিক রূপটি পুরুষের। এটা স্ত্রীরও হতে পারতো, কুকুর বেড়াল কীট পতঙ্গ গাছ উদ্ভিদ যা কিছুরই হতে পারতো যেমন একই কাপড়ের থান থেকে হাফ শার্ট ফুল শার্ট পাঞ্জাবি ফতুয়া যা ইচ্ছে বানানো যেতে পারে। আর আমার এই পুরুষ শরীরটির সাথে কয়েকটি attributes জুড়ে আছে - যে পরিবারে ও দেশে আমার জন্ম, তাদের কিছু বিশেষত্ব জুড়ে আছে, এই শরীরকে কেন্দ্র করে যে সম্পর্কের বলয় তৈরি হয়েছে, তার টান জুড়ে আছে, শিক্ষকদের ও গুরুর মার্গদর্শন ও আশীর্বাদ জুড়ে আছে এবং যাপন করতে করতে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, তার প্রভাব জুড়ে আছে। 

সেই সাথে ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, কর্মফল, অহঙ্কার ইত্যাদি নানারকমের ব্যাপার তো আছেই, যারা জামার বোতাম খুলতে চাইলেই প্রলয় নাচন নাচতে শুরু করে দেয়। সব মিলিয়ে এই শরীরকে কেন্দ্র করে অর্থাৎ বাইরের জামাটাকে ঘিরে আমার একটা পরিচয় তৈরি হয়েছে যার ভিত্তিতে লোকে আমায় অমুক বলে চেনে। ওটা অনেকটা ওইরকমই - জিন্স আর টি-শার্ট পরে রাস্তায় বেরোলে মডার্ন আর ধুতি পাঞ্জাবি পরে বোরোলে সেকেলে - judging a book by it's cover আরকি। সেই জামাটা কিন্তু আমি নই।

আসলে এই শরীরের কাজ খুবই নির্দিষ্ট এবং সীমিত, আমরা বোধহয় তাকে অতিরিক্ত বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। উদাহরণস্বরূপ খাবার। আপনি করোলা সেদ্ধই খান বা জনাইএর মনোহরা - পরদিন সকালে দুটোরই পরিণতি কিন্তু এক। ওদিকে আপনি লাখ টাকা পাউন্ডের দামি দার্জিলিং চাইই খান বা গুমটির দশ টাকার কাটিং চা, কয়েকঘন্টা পর সেই তো বর্জ্যপদার্থ হিসেবে বেরিয়েই যায়। শরীরও সেইরকম - টাটা বিড়লা যেই হও না কেন, শেষে পঞ্চভূতে বিলীন। এখানেই বিপত্তি - যা ক্ষণস্থায়ী তার জন্য মারামারি আর যা চিরকালীন তার পাত্তা নেই। নাম-রূপে ফেঁসে আছি, স্বরূপের আর জানি কি? 

প্রকৃতির নিয়মেই এই শরীরজাত যে সন্তান, তাদের প্রতি যে attachment, সেও এক বিড়ম্বনা। সন্তান সুখে থাকলে আমি সুখী, সন্তান দুঃখে থাকলে আমি দুখী, আর সন্তান সমস্যায় পড়লে আমি দুর্ভাবনায় একশেষ - অথচ আমার এই শরীর না থাকলে তাদের বর্তমান বাহ্যিক রূপের কোনো অস্তিত্বই থাকতো না। তাদের এবং আমার প্রারব্ধই আমার এই শরীরের সাথে তাদের জুড়ে দিয়েছে, প্রারব্ধ অন্যরকম হলে তারা অন্যশরীর পেত। অথচ যবে এই শরীরগুলো থাকবে না, তখনও বাপ-ছেলের সম্পর্ক থাকবে কারণ মাঝখানে সামাজিক স্বীকৃতি নামক একটি অশরীরী বস্তু দাঁড়িয়ে আছে - কি অদ্ভুত না? 

যত নিজেকে নিজেরই বাহ্যিক রূপের খপ্পর থেকে উদ্ধার করে অন্তরে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছি, তত দেখছি মায়া তার সর্বশক্তি দিয়ে resistance গড়ে তুলছেন - কেমন কেমন করে জানি এই শরীর এবং তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলিকে দিয়ে মনকে মাঝেমাঝেই ভয়ঙ্কর বিক্ষিপ্ত করে তুলছেন। আর এই টানাপোড়েনে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ছে ওই শরীরের ওপরেই, মজাটা এখানে। অনেকদিন হয়ে গেল এই খেলা চলছে, আমি এখনো দশ গোল খেয়ে পিছিয়ে আছি, কিন্তু খেলা ছেড়ে মোটেও পালাচ্ছি না। 

রবীন্দ্রনাথ 'মায়ার খেলা' গীতিনাট্যে মায়াকুমারীগণকে দিয়ে বলিয়েছিলেন না, ওটাই আসল কথা:
"মনের মতো কারে খুঁজে মর,
সে কি আছে ভুবনে,
সে তো রয়েছে মনে।
ওগো, মনের মতো সেই তো হবে,
তুমি শুভক্ষণে যাহার পানে চাও।"
চাতক পাখির মতন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছি সেই শুভক্ষণের প্রতীক্ষায় যেদিন জননী কৃপা করে মনের গোপন দরজাটা খুলে দেবেন। সেদিন হয়তো আয়নার সামনে দাঁড়ালেও এই জামাটা আর তেমনভাবে চোখে পড়বে না।

Thursday, November 2, 2023

সনাতনের ভবিষ্যত

একদিকে আব্রাহামীয় বা কম্যুনিস্টদের 'একটাই জীবন - খাও পিও ঔর মৌজ করো', যাকে one life consumption model বলে আর অন্যদিকে ভারতের সেই সনাতন ঋষিবাক্য 'শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা' - বিশ্ববাসী, তুমি অমৃতের পুত্র, তুমি মৃত্যুহীন - বহু শতাব্দী জুড়ে বৌদ্ধিকস্তরে এই দুই বিপরীতমেরুর দ্বন্ধ চলছে তো চলছেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যখন এক জীবনে বিশ্বাসী অসনাতনীরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যেকার একাংশের মতের প্রভুত্ব অন্যদের ওপর কায়েম করতে চায়, তখন এই দ্বন্ধ চরম সংঘাতে পর্য্যবসিত হয় এবং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কিছুসময়ের জন্য তা আবার ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে এবং ব্যাপক লোকক্ষয়ের কারণ হবে। সবের মূলে কিন্তু জীবনে চলার পথে শুভ আর অশুভের মধ্যে থেকে অনেক সংখ্যক মানুষের অশুভকে বরণ করে নেওয়া। বেশিদূর যেতে হবে না, এই তো সেদিন ১৯৬৬-৭৬ চিনে cultural revolution হলো, ঈশ্বরই জানেন আসলে কত মানুষ সেই পাগলামোতে প্রাণ খোয়ালেন। 

ঠিক তার আগেই ১৯৬২তে চিন কেন ভারত আক্রমণ করেছিল জানেন? রকমারি থিওরি শোনা যায় বটে কিন্তু আসল কারণ হলো তার আগের ২০০০ বছর ধরে চিনারা ভারতীয় আধ্যাত্মিক জ্ঞানতন্ত্র এবং মন্দির বাস্তুতন্ত্রের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত ছিলেন যে মাও জে দংকে সেই মানসিক অবকাঠামো ভাঙতে হলে আগে ভারতকে চিনবাসীর চোখে হেয় প্রতিপন্ন করতে হতো - তিনি ঠিক সেটাই করেছিলেন। চিনারা মানসিকভাবে এমনই যে ও দেশে যদি রাস্তায় কেউ কাউকে bully করে, যে bully হয় লোকে উল্টে তাকেই ঘিরে ধরে দুয়ো দেয়, কমজোরের প্রতি সহানুভূতি চিনাদের রক্তে নেই, ওঁরা শক্তের ভক্ত। আর এই গাজোয়ারী মানসিকতাকেই মাও চার বছর পরে কম্যুনিজম কায়েম করার কাজে ভরপুর লাগিয়েছিলেন। 

সেদিন পড়লাম কে যেন লিখেছেন যে এখনকার চিনারা ভারতীয়দের নাকি হীনদৃষ্টিতে দেখেন কারণ ১০০০ বছর ধরে আমরা নিজেরাই নিজেদের জাতভাইদের পরের গোলামী মেনে নিতে বাধ্য করেছি। কতজনই বা ইংরেজ থাকতো ভারতবর্ষে, ভারতীয় চাকরদের দিয়েই তো তারা এত কোটি ভারতীয়দের ওপর দুশো বছর ধরে শাসন চালিয়ে গেল। মুঘল আমলেও তাই। ব্যাপারটা পড়ে আমার মনে হলো কেউ কি চিনাদের জিজ্ঞেস করবেন যে এই যে cultural revolutionএর নামে কোটি কোটি চিনার গলা কেটে নামিয়ে দেওয়া হলো - কে কাটলো রে ভাই? নিজেরাই নিজেদের কাটলেন তো, তাহলে আবার এত বড় বড় কথা কিসের? আসলে বিষয়টা তা নয়, একটা জীবনদর্শনকে শেষ করে দিতে গেলে তার মূলে আঘাত করতে হয়। ফলে মাওয়ের প্রোপাগান্ডা মেশিনারি পুরোদমে সক্রিয় ছিল ভারত, ভারতীয়তা, ভারতীয় সভ্যতা, ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় ধর্মবোধ এবং ভারতীয় দর্শনকে চিনাদের মাথা থেকে মুছে ফেলতে, এবং তার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায়টাই তারা বেছে নিয়েছিল, যা আজও সমানভাবে সক্রিয়। ভারত অর্থাৎ সনাতন ধর্মবোধযুক্ত একমাত্র জীবিত প্রাচীন সভ্যতা।

এই যে one life থিওরি, এরই একটা অব্যর্থ পরিণতি হলো radicalisation বা অতিবাদ-মনস্কতার বৃদ্ধি। মানুষের সামনে যদি কোনো বৃহত্তর লক্ষ্য না থাকে, যদি কর্মফল ভোগ করা এবং কর্মফল ত্যাগ করে মোক্ষপ্রাপ্তিই উদ্দেশ্য এবং নিজের যাপনের মাধ্যমে তা সাধিত করার উপায় না থাকে তাহলে তাৎক্ষণিক সুখ ছাড়া তার আর জীবনে চাওয়ার কিই বা থাকতে পারে? আজকের হামাস বা দায়েশ বা হিজবুল্লারা যতটা অতিবাদী, পল পট বা মাও বা স্ট্যালিনের cultও ঠিক ততটাই অতিবাদী - ফারাক কেবল ফলিত প্রয়োগে। যে কোনো অতিবাদের পেছনে আবার একটাই মূল factor - অতিলোভ। বৌদ্ধিকতার আড়ে বিশ্বের ইতিহাসে এই লোভে লোভে ঠোকাঠুকি যত হয়েছে, সত্যিকারের বৈচারিক বিবাদ তার ধারে কাছেও হয়নি। আর লোভ মানেই গা জোয়ারী, যা স্বাভাবিক উপায়ে পাওয়ার উপায় নাই তাকে জোর করে কেড়ে নিতে হবে, তা সে আনুগত্য হোক বা অনুগ্রহ। 

একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখবেন যে consumerism এর মূলে হলো want আর profit - একদলের রাস্তা হলো মানুষের মনে একটা চাহিদা তৈরি করো, সেই চাহিদা পূরণ করার একটা তন্ত্র বানাও, খুব মাল বেচো আর মুনাফা কামাও আর অন্যদলের রাস্তা হলো যা আছে তার চেয়ে অন্যরকম কিছু চাই, নতুন কিছু চাই যা আমায় নতুন করে সুখ দেবে আর যা পাওয়ার জন্য আমি নিজেকে বিকিয়ে দিতেও রাজি আছি। এবার সেই want যদি সেকালে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার উৎস হয়ে ওঠা হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো চার্চ আর গ্যালিলিওর গৃহবন্ধি হওয়া, যদি আজকের সময়ের narcotics বা অবৈধ অস্ত্র হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো জিহাদের নামে ইসলামিস্ট সন্ত্রাসবাদ, যদি দেশের মানুষের সম্মিলিত সম্পদকে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের ভোগযোগ্য সম্পদে পরিণত করতে হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো কম্যুনিস্ট শাসনব্যবস্থা, যদি সারা বিশ্বকে নিঃস্ব করে নিজেদের দেশকে ধনবান করতে হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো ছদ্মসাম্রাজ্যবাদ আর যদি বিশ্বের বৃহৎ ধনীদের পকেট আরো ভরতে হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো যুদ্ধ আর মহামারি - আখেরে তো এই। 

হামাস, হুতি, হিজবুল্লাহ আর ইরানি শিয়া জঙ্গিরা সব একসাথে ইজরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে দেখে আমরা কেউ কি একটুও আশ্চর্য্য হচ্ছি? এটাই তো হওয়ার ছিল কারণ অসনাতনীদের জমি দখলের লড়াই চিরকাল নিজেদের পন্থীয় অথবা মতবাদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে সামনে রেখেই করা হয়ে এসেছে। আসলে পন্থসহ যে জীবনদর্শনের ভিত্তিটাই transactional, সেখানে মানুষে মানুষে সম্পৰ্কটাও তো তাইই। সনাতনীদের বৈদিক বিবাহপদ্ধতি বিচ্ছেদবিহীন আর আব্রাহামীয়দের বিবাহ নিকাহনামা নামক চুক্তিভিত্তিক - কেন? সনাতনীর সন্তান জন্মসূত্রেই সনাতনী আর আব্রাহামীয়দের সন্তানকে baptise করে পন্থগ্রহণ করাতে হয় - কেন? সনাতনী মৃত্যুর পর শরীরকে পঞ্চভূতে বিলীন করে দেয় আর অসনাতনী শেষ বিচারের অপেক্ষায় কফিনে শুয়ে থাকে - কেন?

সনাতনী আর অসনাতনীদের মধ্যে এই যে সম্পুর্ন দুই বিপরীতমুখী জীবনদর্শন, এরই ফলে সনাতনী কারো ওপর কোনোদিন কোনোকিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়না - সে জানে যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তা সাময়িক আর যা কিছুই সাময়িক তাই অনিত্য, ফলে মূলত অসত্য। আর যা সত্য, যা সনাতন, তা জাগতিক লেনদেনে নেই, তার খোঁজ আছে অদ্বৈত বেদান্তে। এই জন্যই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে বিশ্বের অগ্রণী শক্তি হওয়া সত্ত্বেও ভারত কোনোদিন কাউকে আক্রমণ করেনি, উল্টে বিশ্বের সমস্ত আক্রান্তাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। নিঃস্বার্থভাবে ভারত জ্ঞান বিতরণ করেছে, বিনিময়ে কোনো কিছুই সে চায়নি। বিশ্বজুড়ে এত সভ্যতার উদয় হয়েছে, কিন্তু একমাত্র ভারতীয় সভ্যতা ছাড়া তারা সব আজ অস্তমিত, অলক্ষ্যে কোনো তো একটা কারণ আছে, তাই না? 

একবার চোখ মেলে চেয়ে দেখুন ভারতের ভেতরে ও বাইরে ইদানিং কি ঘটছে, বুঝতে পারবেন। দেখবেন অযোধ্যায় যখন শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির দ্রুত প্রাণপ্রতিষ্ঠার শুভক্ষণের দিকে এগোচ্ছে, সুদূর চিনের গ্রামেগঞ্জে সদ্য রোজগার হারানো সাধারণ মানুষ এতবছর পর আবার বন্ধ হয়ে যাওয়া গ্রাম্য মন্দিরগুলি খুলছেন, তাঁরা ওই মন্দির ecosystemটি ফিরে পেতে আগ্রহী। মন্দির মানে ধ্যান, মানসিক শান্তি, মন্দির মানে দান দক্ষিণা, মন্দির মানে লঙ্গর, মন্দির মানে স্থানীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের রোজগার, মন্দির মানে সামাজিক ধর্মচেতনার উৎস, মন্দির গরিবের আশ্রয়স্থল। খোদ আরবের বুকে এখন বিশালাকায় মন্দির নির্মাণ হচ্ছে, আমেরিকায় হচ্ছে, আফ্রিকা জুড়ে হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে না? এমনকি পাক অধিকৃত কাশ্মীরের তথাকথিত সংসদে resolution নেওয়া হচ্ছে যে মা সরদার বিধ্বস্ত প্রাচীন পূজাস্থল ভক্তদের জন্য আবার খুলে দেওয়া হোক। বিশ্বজুড়ে যত দ্বন্দ্ব বাড়ছে, সংঘাত বাড়ছে, তত বেশি করে হটাৎ মন্দির তৈরি হওয়া বা সংস্কার হওয়াও বেড়ে গেছে, এটা কি লক্ষ্য করেছেন? কেন? 

কারণ ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে পারছেন যে one life consumption model পুরোপুরি ফেল করে গেছে, ক্যাপিটালিসম এবং কম্যুনিসম দুটোই অসাড় প্রমাণিত হয়েছে, এবার পন্থীয় অতিবাদেরও শেষ হওয়ার পালা। এই যে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এর অন্তে অতিবাদীরা নিজেরাই অতিবাদ শেষ করবে, যে প্রক্রিয়াটিকে de-radicalisation বলে। তারপর? শ্রীকৃষ্ণ নিশ্চয় আজকের অর্জুনকে আবার মনে করিয়ে দেবেন, "তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ" - হে কুন্তীপুত্র, যুদ্ধের জন্য কৃতসংকল্প হও, তোমায় নগ্ন ভোগস্পৃহার সাথে নির্ণায়ক লড়াই লড়তে হবে। বিশ্ব যাতে লোভ ঈর্ষা আর ভোগবাদের তাড়না ত্যাগ করে সকলে মিলেমিশে বাঁচার আনন্দ উপভোগ করতে পারে, সেই পথ তুমি দেখাবে। আর কি?  আর বোঝাবে, "কেউ পর নয় মা, জগৎ তোমার। যদি শান্তি চাও মা, কারও দোষ দেখোনা। দোষ দেখবে নিজের।"