Tuesday, November 21, 2023

শিক্ষা, বিদ্যা ও জ্ঞান



যিনি অনেক পড়েছেন এবং জেনেছেন, বিদেশে সাধারণত তাঁকেই জ্ঞানী বলা হয়। ইংরেজ আমল থেকে বিদেশি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে আমাদের দেশেও বিদ্বজনদের জগতে বিদ্যার মানদণ্ড হিসেবে প্রাথমিকভাবে ডিগ্রিকেই ধরে নেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ যাঁর যত বেশি ডিগ্রি তিনি তত বেশি শিক্ষিত এবং যিনি যত বেশি শিক্ষিত তিনি তত বেশি জ্ঞানী। আমরা সনাতনীরা বাপু এর উল্টোটাই জেনে এসেছি। যিনি নিজেকে জানেন তিনি জ্ঞানী, বাকি সব অজ্ঞানী, তা তাঁদের প্রথাগত বা পুঁথিগত বিদ্যা যতই থাক না কেন। আমাদের বোধে বিদ্যা আর জ্ঞান এক নয়। বস্তুত, সংস্কৃতে বিদ্যার মূলে হল 'বিদ্' ধাতু, যার অর্থ 'বিবেচনা করা'। যেখানে বিবেচনা করে গ্রহণ বা বর্জন করার সুযোগ নেই, সে আর যাই হোক, বিদ্যা নয়।

মূলত জ্ঞানমার্গ বলতে সনাতন সংস্কৃতিতে যা আমরা বুঝি তা শাস্ত্রীয় সূত্রগুলিকে চুলচেরা বিচার ও বিশ্লেষণ করে আত্মজ্ঞান অর্জন করার ছয়টি মার্গ বা ছয়টি দর্শনের অধ্যয়নকে নির্দেশ করে - ন্যায়, যোগ, বৈশেষিক, সাংখ্য, পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা। যেমন আজকাল ডাক্তাররা theory of elimination মেনে একগাদা টেস্ট লিখে দেন না, অনেকটা সেরকম। হয়তো সর্দি কাশি জ্বর হয়েছে, চেস্ট এক্সরে লিখে দিলেন, তারপর রিপোর্ট দেখে নিশ্চিন্ত হলেন যে যাক বাবা, নিউমোনিয়া হয়নি। অর্থাৎ যাবৎ কিছু আছে সবকিছু ভালো করে দেখে নাও, বুঝে নাও, তারপর একে একে 'এটা নয়' 'এটা নয়' করতে করতে একেবারে মূল জায়গায় পৌঁছে যাও। তারপর হলো theory of affirmation - clinically যে ব্যামো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে কেবল সেটারই পরীক্ষা করে রেসাল্ট দেখে নিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া যে 'আমিই সেই' - ঠাকুর একে বলতেন 'বিজ্ঞান'। 

আসলে বিদেশি জাগতিক জ্ঞান আরোহণের প্রয়াসকে সনাতনী অখন্ড বা অদ্বৈতজ্ঞানের অন্বেষণের দিকে ঘোরানোর জন্য গোটাকতক ব্যক্তিগত গুণের প্রয়োজন হয় যেমন বিবেক, শমদমাদি (আত্মশাসন), উপরতি (নিবৃত্তি), তিতিক্ষা (ধৈর্য্যশীলতা), সমাধি (মনের একীকরণ), শ্রদ্ধা, বিরাগ (ঔদাসীন্য) ও মুমুক্ষুত্ব (মোক্ষলাভের ইচ্ছা)। আর এই অন্বেষণের তিনটি stage আছে - প্রথমে শ্রবণ (শোনা বা পড়া), তারপর মনন (যুক্তি-বুদ্ধিদ্বারা বিশ্লেষণ) ও শেষে নিদিধ্যাসন (নিরন্তর ধ্যান)। এটা অনেকটা কোনো যুগান্তকারী বিজ্ঞানীর দীর্ঘদিনের intense গবেষণার মতো - খোঁজ খোঁজ খোঁজ, এটা নিয়ে পরীক্ষা, ওটা নিয়ে পরীক্ষা, বছরের পর বছর ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে শেষে হটাৎ একদিন কাঙ্খিত বস্তুটিকে আবিষ্কার - ইউরেকা! তবে আত্মোপলব্ধি সকলের জন্য নয়, ফলে সেখানে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে ঠাকুরের lesson plan মেনে চললেই হবে। 

শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষাদান পদ্ধতির দুটি বিশেষত্ব হলো অধিকারীভেদ এবং রুচিভেদ। "কি জানো রুচিভেদ, আর যার যা পেটে সয়। তিনি নানা ধর্ম নানা মত করেছেন, আর যার যা পেটে সয়। তিনি নানা ধর্ম নানা মত করেছেন অধিকারী বিশেষের জন্য। সকলে ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী নয়। তাই আবার তিনি সাকার পূজার ব্যবস্থা করেছেন। মা ছেলেদের জন্য বাড়িতে মাছ এনেছে। সেই মাছ ঝোল, অম্বল, ভাজা আবার পোলাও করলেন। সকলের পেটে কিন্তু পোলাও সয় না। তাই কারও কারও জন্য মাছের ঝোল করেছেন তারা পেট রোগা। আবার কারও সাধ অম্বল খায়, বা মাছ ভাজা খায়। প্রকৃতি আলাদা - আবার অধিকারীভেদ।" (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ৩য় খণ্ড, ৯ম অধ্যায়, ৫ম পরিচ্ছেদ)

ফিরে যাওয়া যাক বিদেশি education বা শিক্ষার বিষয়ে, যাকে বিদেশিরা বিদ্যা বলেই মনে করেন। এনক্লাইকোপেডিয়া ব্রিটানিকায় educationকে সংজ্ঞায়িত করে বলা হচ্ছে, 'Education: discipline that is concerned with methods of teaching and learning in schools or school-like environments as opposed to various nonformal and informal means of socialization. Education can be thought of as the transmission of the values and accumulated knowledge of a society.' এর ঠিক বিপরীতমেরুতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয় (পল্লীপ্রকৃতি, পল্লীর উন্নতি)। বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হলো social being তৈরি করা আর সনাতনী বিদ্যাভাসের উদ্দেশ্য হলো জিজ্ঞাসু তৈরি করা - আমি আসলে কে, কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাবো ইত্যাদি, দুটোর approach-এ বিস্তর ফারাক।

আধুনিক মনীষীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা নিয়ে যত ফলিত প্রয়োগ করেছেন, সেই অভিজ্ঞতার বলে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার অসারতাকে বুঝে কবি তাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বলছেন, 'যে-কাঁচাবয়সে মন অজ্ঞাতসারে আপনার খাদ্য শোষণ করিতে পারে, তখনই সে জ্ঞান ও ভাবকে আপনার রক্তমাংসের সহিত পূর্ণভাবে মিশাইয়া নিজেকে সজীব সবল সক্ষম করিয়া তোলে। সেই সময়টাই আমাদের মাঠে মারা যায়। সে-মাঠ শস্যশূন্য অনুর্বর নীরস মাঠ। সেই মাঠে আমাদের বুদ্ধি ও স্বাস্থ্য কত যে মরিয়াছে তাহার হিসাব কে রাখে' (প্রবন্ধ 'শিক্ষা-সংস্কার')। রোগশয্যায় শুয়ে ঠাকুর বলেছিলেন, "নরেন শিক্ষে দিবে। যখন ঘরে বাইরে হাঁক দিবে"। ঈশ্বরে অবিশ্বাসী নরেন্দ্রনাথ বহুদিন শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে অতিবাহিত করার পরে উপলব্ধি করেছিলেন যে ঈশ্বর তাঁর নিজের মধ্যেই অবস্থান করছেন। 

স্বামীজী সেই পরমজ্ঞানের শিক্ষাই জগৎকে দিয়েছিলেন বটে, যা আসলে সনাতন ভারতের চিরন্তন শিক্ষা। সিংহবিক্রমে একেবারে বিশ্ববাসীর ঘাড় ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "মানুষ পাপী নয়, মানুষ দেবতা", বলেছিলেন, "প্রত্যেকের মধ্যে অন্তর্নিহিত দেবত্ব রয়েছে ও তাকে প্রকাশ করাই জীবনের লক্ষ্য", "সমস্ত শক্তি তোমার মধ্যেই আছে, তুমি যা চাইবে তাই করতে পারবে", "যে নিজেকে বিশ্বাস করে না সেই নাস্তিক", বলেছিলেন, "ওঠো, জাগো এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে থেমো না"। আমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে একেই প্রকৃত শিক্ষা বলে। যে উপনিষদীয় শিক্ষা আমরা স্কুলে পাইনি, আমি চাই এখনকার ও ভবিষ্যতের প্রজন্ম সেই শিক্ষা পাক। অন্তত ভারতের বিদ্যালয়গুলিতে ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান গণিত কম্পিউটার ইত্যাদির সাথে সাথে এটাও পড়ানো হোক যে every man is potentially Divine - নইলে social being তৈরি হলেও, eternal being হিসেবে তার মানসিক উত্তরণ ঘটবে কি করে?

No comments:

Post a Comment