আমি শরীর নামক একটা জামা পরে আছি যার বাহ্যিক রূপটি পুরুষের। এটা স্ত্রীরও হতে পারতো, কুকুর বেড়াল কীট পতঙ্গ গাছ উদ্ভিদ যা কিছুরই হতে পারতো যেমন একই কাপড়ের থান থেকে হাফ শার্ট ফুল শার্ট পাঞ্জাবি ফতুয়া যা ইচ্ছে বানানো যেতে পারে। আর আমার এই পুরুষ শরীরটির সাথে কয়েকটি attributes জুড়ে আছে - যে পরিবারে ও দেশে আমার জন্ম, তাদের কিছু বিশেষত্ব জুড়ে আছে, এই শরীরকে কেন্দ্র করে যে সম্পর্কের বলয় তৈরি হয়েছে, তার টান জুড়ে আছে, শিক্ষকদের ও গুরুর মার্গদর্শন ও আশীর্বাদ জুড়ে আছে এবং যাপন করতে করতে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, তার প্রভাব জুড়ে আছে।
সেই সাথে ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, কর্মফল, অহঙ্কার ইত্যাদি নানারকমের ব্যাপার তো আছেই, যারা জামার বোতাম খুলতে চাইলেই প্রলয় নাচন নাচতে শুরু করে দেয়। সব মিলিয়ে এই শরীরকে কেন্দ্র করে অর্থাৎ বাইরের জামাটাকে ঘিরে আমার একটা পরিচয় তৈরি হয়েছে যার ভিত্তিতে লোকে আমায় অমুক বলে চেনে। ওটা অনেকটা ওইরকমই - জিন্স আর টি-শার্ট পরে রাস্তায় বেরোলে মডার্ন আর ধুতি পাঞ্জাবি পরে বোরোলে সেকেলে - judging a book by it's cover আরকি। সেই জামাটা কিন্তু আমি নই।
আসলে এই শরীরের কাজ খুবই নির্দিষ্ট এবং সীমিত, আমরা বোধহয় তাকে অতিরিক্ত বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। উদাহরণস্বরূপ খাবার। আপনি করোলা সেদ্ধই খান বা জনাইএর মনোহরা - পরদিন সকালে দুটোরই পরিণতি কিন্তু এক। ওদিকে আপনি লাখ টাকা পাউন্ডের দামি দার্জিলিং চাইই খান বা গুমটির দশ টাকার কাটিং চা, কয়েকঘন্টা পর সেই তো বর্জ্যপদার্থ হিসেবে বেরিয়েই যায়। শরীরও সেইরকম - টাটা বিড়লা যেই হও না কেন, শেষে পঞ্চভূতে বিলীন। এখানেই বিপত্তি - যা ক্ষণস্থায়ী তার জন্য মারামারি আর যা চিরকালীন তার পাত্তা নেই। নাম-রূপে ফেঁসে আছি, স্বরূপের আর জানি কি?
প্রকৃতির নিয়মেই এই শরীরজাত যে সন্তান, তাদের প্রতি যে attachment, সেও এক বিড়ম্বনা। সন্তান সুখে থাকলে আমি সুখী, সন্তান দুঃখে থাকলে আমি দুখী, আর সন্তান সমস্যায় পড়লে আমি দুর্ভাবনায় একশেষ - অথচ আমার এই শরীর না থাকলে তাদের বর্তমান বাহ্যিক রূপের কোনো অস্তিত্বই থাকতো না। তাদের এবং আমার প্রারব্ধই আমার এই শরীরের সাথে তাদের জুড়ে দিয়েছে, প্রারব্ধ অন্যরকম হলে তারা অন্যশরীর পেত। অথচ যবে এই শরীরগুলো থাকবে না, তখনও বাপ-ছেলের সম্পর্ক থাকবে কারণ মাঝখানে সামাজিক স্বীকৃতি নামক একটি অশরীরী বস্তু দাঁড়িয়ে আছে - কি অদ্ভুত না?
যত নিজেকে নিজেরই বাহ্যিক রূপের খপ্পর থেকে উদ্ধার করে অন্তরে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছি, তত দেখছি মায়া তার সর্বশক্তি দিয়ে resistance গড়ে তুলছেন - কেমন কেমন করে জানি এই শরীর এবং তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলিকে দিয়ে মনকে মাঝেমাঝেই ভয়ঙ্কর বিক্ষিপ্ত করে তুলছেন। আর এই টানাপোড়েনে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ছে ওই শরীরের ওপরেই, মজাটা এখানে। অনেকদিন হয়ে গেল এই খেলা চলছে, আমি এখনো দশ গোল খেয়ে পিছিয়ে আছি, কিন্তু খেলা ছেড়ে মোটেও পালাচ্ছি না।
রবীন্দ্রনাথ 'মায়ার খেলা' গীতিনাট্যে মায়াকুমারীগণকে দিয়ে বলিয়েছিলেন না, ওটাই আসল কথা:
"মনের মতো কারে খুঁজে মর,
সে কি আছে ভুবনে,
সে তো রয়েছে মনে।
ওগো, মনের মতো সেই তো হবে,
তুমি শুভক্ষণে যাহার পানে চাও।"
চাতক পাখির মতন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছি সেই শুভক্ষণের প্রতীক্ষায় যেদিন জননী কৃপা করে মনের গোপন দরজাটা খুলে দেবেন। সেদিন হয়তো আয়নার সামনে দাঁড়ালেও এই জামাটা আর তেমনভাবে চোখে পড়বে না।
No comments:
Post a Comment