Blog Archive

Monday, April 1, 2024

রামকৃষ্ণ মিশন ও রাজনীতি

আজ সকালে নিউজফিডে হঠাৎই একটা ভিডিও ভেসে উঠলো - বেলুড় মঠে মা গঙ্গায় সদ্য ব্রহ্মলীন পরম পূজনীয় প্রেসিডেন্ট মহারাজের পূত অস্থি বিসর্জনের ভিডিও। মহারাজের যিনি সেবক মহারাজ ছিলেন, সর্বক্ষণ মহারাজের সঙ্গে থাকতেন, তাঁকে আগলে রাখতেন, ভিডিওটিতে তাঁকে দেখলাম। যিনি মাথায় করে অস্থিকলস নিয়ে ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে গঙ্গায় নামছিলেন, দুহাত দিয়ে তাঁকে অমনভাবেই মহারাজ ধরেছিলেন যেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট মহারাজকে ধরে নামাচ্ছেন। এই যে dedication, এই আত্মনিবেদন - এ আর কোথায় দেখতে পাবো? চোখে জল এসে গেল। তারপর দেখলাম অন্যদের সাথে সেই সেবক মহারাজও বালতি করে গঙ্গাজল ভরে এনে চিতায় ছড়িয়ে দিয়ে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম করলেন আর সমবেত হাজার হাজার মানুষ হরি ওঁ রামকৃষ্ণ ধ্বনি দিয়ে উঠলেন। ওখানে, ওই মুহূর্তে, সেই ভক্তদের আর পৃথক পরিচয় নেই, তাঁরা সবাই রামকৃষ্ণ পরিবারের সদস্য। 


এই প্রসঙ্গেই পরে একটা কথা ভাবছিলাম। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন না, স্বামীজীর নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন বলে কত না criticism face করতে হয়। কত ভালো কথা, না? ওঁরা শিব জ্ঞানে জীব সেবা করেন স্বামীজীরই দেখানো পথে, ওটাই ওঁদের নিত্যপূজা। নিজেদের হাতে গড়া ইস্কুল, কলেজ, টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয়ে অগণিত জাতির ভবিষ্যৎ তৈরি করেন, দাতব্য চিকিৎসালয় বা বড় বড় হাসপাতালের মাধ্যমে আর্তের সেবা করেন, গ্রামোন্নয়ন, স্বনির্ভর প্রকল্প, কৃষির উন্নতি ইত্যাদিতে অজস্র মানুষের আর্থিক উন্নতির সহায়ক হন, বন্যা খরা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণ এবং rihabilitation নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন, কত শাস্ত্রগ্রন্থ, ধর্মগ্রন্থ ইত্যাদি প্রকাশনা করে এবং প্রবচন প্রশিক্ষণ এবং পরিমার্জনের মাধ্যমে সমাজকে উন্নীত হতে সাহায্য করেন, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার বা বিবেকানন্দ বেদ বিদ্যালয়ের মতন ব্যতিক্রমী গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেন, আর্ট, কালচার, নৃত্য, গীত, বাদ্য, সেমিনার, sermon - কি বাদ থাকে? এছাড়া একেবারে তিথি নক্ষত্র ধরে ধরে সারাবছর বিভিন্ন মঠে নানান পূজা অর্চনা তো আছেই। এঁরা সবকিছুই করেন এবং অত্যন্ত সুচারুরূপে করেন কিন্তু রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন - কেন? 


মানুষ বলতেই পারেন যে রাজনীতিও তো জীবসেবার একটি মাধ্যম, গোরক্ষনাথ মঠের মোহন্তবাবাজীরা তো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত, তাহলে রামকৃষ্ণ মিশন নয় কেন? ওটা ওঁদের tradition, এটা মিশনের। মিশনের জীবসেবা করার যে যে পন্থার কথা আগে বললাম, তাতে স্বার্থ, কালোটাকা আর ময়লা-মনের মানুষদের কোনো স্থান নেই। এই সেবায় মন শুদ্ধ থাকে, সেবককে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়না। সন্ন্যাসী হবেন নিষ্কলঙ্ক, বেদাগ, একেবারে তরোয়ালের ফলার মতন মসৃন। স্বামীজী ছিলেন ক্রান্তদর্ষি, উনি জানতেন রাজনীতি কোন দিকে যেতে চলেছে, ফলে আগে থাকতেই নিজের হাতে গড়া সঙ্ঘকে লক্ষণরেখা টেনে protect করে গেছেন। তাই তো যখন রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা ব্রহ্মলীন হন তখন দল মত নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যেন তাঁদের স্বজন হারান, কোনো ism বা সংকীর্ণ পরিচয় সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। Universal Truth needs no boundaries.

Sunday, March 24, 2024

দোলযাত্রা ১৪৩০

আজ ১১ই চৈত্র ১৪৩০, শ্রীচৈতন্য পূর্ণিমা, বসন্তকাল, শুভ দোলোৎসব। প্রেম নামক যে ঈশ্বরীয় অনুভূতিটি সৃষ্টিকর্তা আমাদের সকলকে দিয়েছেন, তাঁর যে প্রেম দিয়ে তৈরি সহস্রদলপদ্মরূপী আসনে তিনি স্বয়ং আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে বিরাজমান, সেই নিত্য সত্য অনন্ত আনন্দময়ের আত্মপ্রেমের প্রকাশরূপে এই যে গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ড প্রতীয়মান, আজকের এই পবিত্র দিনটি সর্বতোরূপে সেই অদ্বৈতবোধকে উজ্জাপন করার দিন। বাইরে তাকিয়ে দেখুন - পলাশের শাখায় শাখায় যেন প্রেমের আগুন লেগেছে, কৃষ্ণচূড়া, কণকচাঁপা থেকে নিয়ে গাব, গামারি, মণিমালা পর্য্যন্ত প্রতিটি গাছ যেন বসন্তের প্রেমের ঔজ্জ্বল্যে একেবারে ফেটে পড়ছে। আর প্রকৃতির এই বাঁধভাঙা উচ্ছাসের মাধ্যমে যে অনন্তপ্রেমের বাণী তিনি দিচ্ছেন, তাকেই অনুসরণ মানুষ করে একে অপরকে রঙে রঙে রাঙিয়ে তুলে তাঁরই সৃষ্টির মধ্যে তাঁকে অনুভব করে তাঁর সাথে একাত্ম বোধ করতে চেষ্টা করছে, এ ঈশ্বরের লীলা বৈ আর কিই বা? বৃন্দাবনে শ্রীরাধা এবং শ্রীকৃষ্ণ একে অপরের গায়ে আবির ছুঁড়ে দোলযাত্রার সূচনা করেছিলেন। আসলে শ্রীরাধা আর শ্রীকৃষ্ণ এক এবং অদ্বিতীয় কারণ প্রেম দ্বৈতস্বত্তাকে অদ্বৈত করে তোলে, সেটাই তার প্রকৃতি। রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি আসলে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, অবিচ্ছেদ্য, অবর্ণনীয়, সগুন আর নির্গুণ ব্রহ্মের, পুরুষ ও প্রকৃতির, নিত্য ও অনিত্যের একত্রিত বাহ্যিক প্রতিফলন। এ এক অনন্ত প্রেম, যা বুঝতে গেলে প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে হবে। ফুটে ওঠা বেলকুঁড়ির সাথে বাতাসের যে প্রেম, সেটার চরিত্র কি? বসন্তের বার্তা বহন করে আনা বেলকুঁড়ি ফোটে, বাতাসে তার মিষ্টি গন্ধ মিশে যায়, বাতাস সেই সুগন্ধ বয়ে নিয়ে যায় বহু দূরে যেখানে আমি আপনি ছোট্ট বেলগাছটিকে চোখে দেখতে না পেলেও তার মিষ্টি আঘ্রানে পুলকিত হৈ, একইসাথে তার অস্তিত্বকে এবং বসন্তের আগমনকেও অনুভব করতে পারি। এই হলো প্রেমের সত্যিকারের চরিত্র - যা মেলায়, বা সসীমের মধ্যেও অসীমের বার্তা বহন করে আনে। আজ দোল, রঙের উৎসব, জীবনের উৎসব। জীবন মানেই প্রেম কারণ আমাদের প্রত্যেকের উৎস ওটাই। তাই আজ প্রেমের উৎসব, হয়তো সেই কারণেই প্রেমের জীবন্ত প্রতিমূর্তি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পূণ্য আবির্ভাব তিথিও বটে। তাঁর শ্রীচরণে প্রার্থনা করি,

রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, 

আমার সকল কর্মে লাগে,

সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, 

গভীর রাতের জাগায় লাগে॥

যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে,

রক্তে তোমার চরণ-দোলা লাগিয়ে দিয়ে।

আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে,

পাষাণগুহার কক্ষে নিঝর-ধারা জাগে,

মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে,

বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে,

তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও 

যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে,

কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে॥


আপনারা সকলে শুভ দোলযাত্রা উপলক্ষে আমার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানবেন। হরিবোল।

Friday, March 8, 2024

শিবমন্ত্র

ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারুণাত্রায় হেতবে। 

নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গত্বিং পরমেশ্বরম॥


এখানে কি বলা হচ্ছে? না, হে পরমেশ্বর শিব, আমি আমার আত্মাকে তোমার পায়ে নিবেদন করছি, তুমি তার গতি করো। এখন, শিব নিজে যেমন তেমনই তো গতি করবেন, উনি তো আর আমায় রাক্ষস বানিয়ে দেবেন না। তা, শিব কেমন? প্রথম লাইনে বলা হচ্ছে যে আমি সেই শিবকে প্রণাম করি যিনি শান্ত আর তিন কারণের হেতু। কি কি কারণ? সৃষ্টি, স্থিতি আর প্রলয়। শিবের স্তুতিতে আর একটি মন্ত্রে আছে, 'তস্মৈ নমঃ পরমকারণ কারণায়' অর্থাৎ হে কারণের পরম কারণ, তোমায় প্রণাম করি - মানে, এই যে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়যুক্ত বিশ্বব্রহ্মান্ড তৈরি হয়েছে, এও তোমারই ইচ্ছায়, অর্থাৎ তুমিই শক্তি, তুমিই ব্রহ্ম।


এই মন্ত্রের অলৌকিক দ্যোতনা বাদ দিলে, প্রাত্যহিক যাপনে শিবভক্তদের লৌকিক ব্যবহার কেমন হবে, তার নির্দেশও এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে। প্রথম কথা, আমায় বুঝতে হবে যে আমি আত্মা, এই শরীর-মন মাত্র নই। দুই, আমি শিবত্ব অর্থাৎ শিব-অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কারণ যাঁকে চিনি না, জানি না তাঁর কাছে তো আর নিজেকে নিবেদন করতে যাবো না। তিন, তিনি আমার কি গতি করবেন সে সম্পর্কেও আমার সম্যক ধারণা আছে কারণ সমস্ত জাগতিক বন্ধন থেকে তিনি আমায় মুক্ত করে দেবেন, সেটা মেনে নিয়ে এবং কামনা করেই আমি এই পথে হাঁটছি। চার, আমার যে কামনা তা পবিত্র, তা লোভ নয় কারণ আমার লক্ষ্য শিবত্ব প্রাপ্তি। 


শিবত্ব কি? শিবকে বর্ণনা করা হচ্ছে  'সত্যম-শিবম-সুন্দরম' বলে। শিব হচ্ছেন শাশ্বত, তাই একমাত্র চিরসত্য। শিব হচ্ছেন চিরপবিত্র, তাই একমাত্র চিরসুন্দর। এটা আসলে জৈব জীবন থেকে অনন্ত জীবনে উত্তরণের একটি ফর্মুলা। জীবাত্মা প্রথমে প্রবৃত্তির অস্থিরতাকে অতিক্রম করে শান্ত হবে। তারপর ক্রমশই সে নিজের মধ্যে পরমাত্মারূপী সেই অনন্ত অজর অমর চিরসত্যকে উপলব্ধি করে পবিত্রতার প্রতিরূপ হয়ে প্রতিভাত হবে। শিবলিঙ্গ অর্থাৎ শিবের প্রতিরূপের মাথায় জল দেওয়া হয়। জলই জীবন। শিবের মাথায় যখন অর্ঘ্য হিসেবে জল নিবেদন করা হয় তখন আসলে নিজেকেই নিবেদন করা হয় এবং উপরোক্ত মন্ত্রটি বলা হয়। আশাকরি এবার থেকে জল ঢালার এবং এই বিখ্যাত মন্ত্রটি উচ্চারণ করার সময় সচেতনভাবেই তা করা যাবে।

Saturday, February 24, 2024

লাটু মহারাজ

 কাশীর রামকৃষ্ণ মিশনের দোতলায় লাটু মহারাজের ঘরে তাঁর এই তৈলচিত্রটি আছে, আর তার ঠিক উল্টোদিকে তাঁর খাটের পাশের দেওয়ালে আছে মা কালীর এই দিব্য ছবিটি। আসলে মহারাজ মঠে খুব কমই থেকেছেন, উনি মাঠে ঘাটেই থাকতেন বেশি আর শেষে কয়েকবছর ছিলেন বাঙালিটোলায় একটি বাড়িতে, ওনার শরীর যাওয়ার পর ওখান থেকেই ওনার ব্যবহৃত জিনিষপত্তর মঠের এই ঘরে এনে রাখা হয়। আমি ভেজানো দরজা ঠেলে ঐ ঘরে যখন ঢুকেছিলাম, ওই বিশেষ গন্ধটা নাকে আসতেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল - সেই গন্ধটা যা একমাত্র প্রাচীন সাধুদের ঘরে পাওয়া যায়। লাটু মহারাজের মধ্যে ঠাকুর ছাড়া আর কিছু নেই - নিরক্ষর ছিলেন, ফলে শুনেছেন প্রচুর কিন্তু নিয়েছেন সেটুকুই যেটুকু ঠাকুরের কাছে যা শিখেছেন তার নিরিখে ওনার মান্য বলে মনে হয়েছে। 


যদিও বলাটা হয়তো politically incorrect হবে, ব্যক্তিগতভাবে আমার লাটু মহারাজকে ঠাকুরেরই extension বলে মনে হয়, যদিও তাঁর সব পার্ষদরাই তাঁর নিজের হাতে গড়া। আমি শ্রীশ্রীলাটুমহারাজের বিশাল বড় fan - এই সিদ্ধপুরুষের মুখের প্রতিটি কথা আমার কাছে সাক্ষাৎ দৈববাণী। আর এই যে মিশনের কর্মকান্ড থেকে তাঁর কন্সিয়াসলি দূরে থাকা এবং ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে সাধনায় ডুবে থাকা, এটাও কিন্তু ঠাকুরের ইচ্ছাতেই হয়েছে, কারণ লাটু মহারাজের সাথে ঠাকুরের সম্পর্কটা ছিল সর্বাঙ্গীন - শিক্ষক-ছাত্র, গুরু-শিষ্য, ইষ্ট-ভক্ত, প্রভু-ভৃত্য, সেবিত-সেবক, সবরকমের। তাঁর জন্মতিথি অজ্ঞাত, তাই আজকের এই মাঘী পূর্ণিমাকেই তাঁর জন্মতিথি বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। মহারাজের দিব্য শ্রীচরণে আমার ভূমিষ্ট প্রণাম জানাই।


|| অ দ্ভু ত আ ন ন্দ ||


লাটু মহারাজ একদিন বলিয়াছিলেন — "সংস্কার যাওয়া খুব কঠিন—ভগবানের কৃপা ভিন্ন যায় না। অনেক বড় লোকের ছেলে, কোনও অভাব নেই, তবুও চুরি করে। পূর্ব জন্মের সংস্কার। সেই জন্যই তো জন্মান্তর মানতে হয়। শাস্ত্রে বলেছে — জন্মগ্রহণ করে ভালো কাজ করলে মঙ্গল হয়। 

ভাইয়ে ভাইয়ে মিল থাকা খুব দরকার। সকলে সমান রোজগার করতে পারে না। হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না।"


যে বেশী রোজগার করিতে অক্ষম, তাহাকে বলিতেন, "এ সংসার ক'দিনের জন্য। বেশী ভাবিস না, কোনও রকমে সংসার চলে গেলেই হল।"


শ্রীশ্রীমা বলিয়াছিলেন "লাটু কি কম গা? সে সময় লাটু আমার কত কাজ করত। অন্য ছেলেরা আমার সামনে আসতে পারত না।"


একবার এক জনৈক ভক্তকে শ্রীশ্রীমা মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিয়া বলিয়াছিলেন "লাটুর সেবা করলে তোমার কল্যাণ হবে।"

(মূলগ্রন্থ : অদ্ভুতানন্দ প্রসঙ্গ, সংকলক : স্বামী সিদ্ধানন্দ, পৃ.: ১২৫-১২৬)


স্বামী গৌরীশানন্দ — শরৎ মহারাজ একবার লাটু মহারাজকে দেখতে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। তাতে ভূমানন্দ স্বামীর মনে হলো— ইনি গুরুভ্রাতা, কত বিদ্বান, পণ্ডিত! ইনি লাটু মহারাজকে প্রণাম করলেন কেন? কথাটা আলোচিত হতে লাগল। অবশেষে শরৎ মহারাজকে প্রশ্ন করা হলো। শরৎ মহারাজ বললেন, "লাটু কত আগে ঠাকুরের কাছে গিয়েছে। ঠাকুরের সমাধি, ভাবের সময় কত দেখেছে, শুনেছে—তাঁকে নানা নাম শুনিয়ে সমাধি ভাঙিয়েছে। আমাদের এখন যে-অবস্থা লাটু বহু দিন আগে তা লাভ করেছে। ও আমাদের চেয়ে ঢের বড়। গুরুতুল্য পূজার পাত্র।"

(লাটু মহারাজের স্মৃতি,  মূলগ্রন্থ : প্রাচীন সাধুদের কথা (দ্বিতীয় খণ্ড) সম্পাদক : স্বামী চেতনানন্দ, পৃ.: ১০-১১)

Friday, February 16, 2024

বাংলায় দেবী সরস্বতীর আবাহন মন্ত্র

 মধুর মধুর ধ্বনি বাজে

হৃদয়কমলবনমাঝে॥


নিভৃতবাসিনী বীণাপাণি   অমৃতমুরতিমতী বাণী

হিরণকিরণ ছবিখানি-- পরানের কোথা সে বিরাজে॥


মধুঋতু জাগে দিবানিশি   পিককুহরিত দিশি দিশি।

মানসমধুপ পদতলে   মুরছি পড়িছে পরিমলে।


এসো দেবী, এসো এ আলোকে,   একবার তোরে হেরি চোখে--

গোপনে থেকো না মনোলোকে   ছায়াময় মায়াময় সাজে॥


অর্থ : 

হৃদয় নামক পদ্মবনে তিনি বিচরণ করছেন, তাঁর নূপুরধ্বনির মধুর সুর মনের মধ্যে শোনা যাচ্ছে।


তিনি বীণাপাণি, সারদা, সরস্বতী - তিনি নিভৃতবসিনী, গোপনচারিণী, কারণ বিদ্যা আত্মস্থ করতে হয়, আত্মসাৎ করতে হয়, বিদ্যা জাহির করার বিষয় নয়। তাঁর বাণী সাক্ষাৎ অমৃত যা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে সে আত্মবোধ জাগরিত করে মরণের পারে নিয়ে যায়, মোক্ষপ্রদান করে। 'হিরণকিরণছবি', অর্থাৎ, তিনি সোনার মত উজ্জ্বল প্রভাযুক্ত। তা মা সরস্বতী কোথায় বিরাজ করেন? ঘুরেফিরে সেই শুরুর কথা - হৃদয়কমলবনে, হৃদয়কে আলোকিত করে থাকেন। 


আমার হৃদয়ে যেহেতু স্বয়ং পরমজ্ঞানদাত্রী বিরাজ করেন, ফলে আমার অন্তরে চিরবসন্ত আর সেখানে ডালে ডালে বসন্তের অগ্রদূত কোকিল ডাকে। অন্তরে চিরবসন্ত অর্থাৎ মন নিত্য সৃজনশীল, নিত্য ক্রিয়াশীল, নিত্য চিন্তাশীল - সেখানে ক্রমাগত শ্রবণ মনন আর নিদিধ্যাসন ঘটে চলেছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, 'if the cuckoo sings, can spring be far behind?' বসন্তে কোকিলের ডাকের সাথেই শুরু হয় নতুন পাতার উদ্গম, নতুন প্রাণের সঞ্চার - নতুন সৃজনের আভাস পাওয়া যায় - নতুন আশা, নতুন আকাঙ্খা, নবযৌবন। আধাত্মপথের পথিকের ক্ষেত্রে এর অর্থ নতুন উদ্যম, নতুন করে কাজে লেগে পড়া, যাতে মায়ের কৃপায় এই শরীরেই মনুষ্যজন্মের আসল উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব হয়।


'মানসমধুপ', অর্থাৎ আমার মনরূপী ভ্রমর, এই হৃদকাননের পরিমলে অর্থাৎ পুষ্পসৌরভে কমলাসনা দেবীর পদতলে মুর্চ্ছিত হয়ে আছে। এ মূর্ছার অর্থ কি? পার্থিব চাওয়া-পাওয়া, লোভ-লালসা ইত্যাদির চাহিদা লোপ পাওয়া, সেই অর্থে সংজ্ঞাহীন হওয়া, আর চেতনের সৌরভে সুরভিত হওয়া। 


দেবী অন্তরালবাসিনী। মনের গহনে লুকিয়ে রয়েছেন। আসলে, আমার মনের মধ্যে 'আমি' সম্পর্কে যে প্ৰশ্ন জাগরিত হয়েছে, যা ধীরে ধীরে আমায় আধ্যাত্মপথের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নের অন্তরেই সারদার বাস। সেই মুর্তিমতী জ্ঞানকে এই বিশেষ দিনে শুভ্রা, হংসবাহিনী মূর্তিতে চোখের সামনে প্রকাশিত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তিনি বলছেন, "এস দেবী এস, এ আলোকে, একবার তোরে হেরি চোখে"। এখানে তাঁর নিরাকারকে সাকারে দেখার তীব্র ইচ্ছাই প্রকাশিত হচ্ছে।

Wednesday, February 14, 2024

নিজধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ

 একজন অতি সজ্জন বন্ধুকে দেখলাম বসন্ত পঞ্চমীর দিন একটি কবরে হলুদ গাঁদার চাদর চড়ানো হচ্ছে দেখে 'এটাই আমার ভারত' বলে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন। আমি তাঁর ভাবনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু যাঁর কবর, তৎকালীন ভারতের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর নাস্তিবাচক ভূমিকা কি ছিল বা বহুত্ববাদ সম্পর্কেই বা তাঁর অবস্থান কি ছিল, সেটা জানলে বোধহয় ওঁর উচ্ছাসটি কিছু কম হতো। যাঁরা ছোটবেলা থেকে 'আল্লা কে বন্দে' বা 'Son of God' শুনে শুনে বড় হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে 'अहम् ब्रह्मास्मि' - আমিই ব্রহ্ম - এই মহাবাক্যের প্রকৃত দ্যোতনা উপলব্ধি করাটা খুবই কঠিন, আমি তাঁদের দোষ দিই না। 


There is a huge difference between faith and seeking - a Faithful does not seek logic and a Seeker seeks nothing but logic - দুটো সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি পথ। আমি আমার নিজের যাপনের প্রত্যক্ষ অনুভূতিগুলিকে বিশ্লেষণ করতে করতে যখন বুঝতে পারব যে এই শরীর, মন, ইচ্ছা, সুখ, সমৃদ্ধি ইত্যাদি সবই ক্ষনস্থায়ী এবং একমাত্র আত্মাই চিরন্তন আর সেই আত্মা আমার এই ক্ষণস্থায়ী শরীরের মধ্যেই বাস করছেন, এর পরের শরীরেও তিনিই থাকবেন এবং তার পরেরটিতেও, তিনিই প্রকৃতপক্ষে দ্রষ্টা বাকি সবই দৃশ্য, তখন ভারতীতীর্থের দৃক-দৃশ্য-বিবেকের logic আমায় আকৃষ্ট করবে, তখন আর আমি আকাশের দিকে মুখ করে বাইরের অচেনা কোনো ঈশ্বরকে খুঁজতে যাবো না। 


উল্টোদিকে বিশ্বাস হল অন্ধ - হয় সম্পুর্ন বিশ্বাস আছে অথবা একেবারেই নেই - এর মাঝামাঝি কোনো অবস্থান সম্ভব নয়। আর বিশ্বাস যেখানে প্রবল সেখানে লজিকেরও কোনো স্থান নেই। যা লেখা আছে বা যা বলা আছে সেটাকেই ধ্রুব সত্য বলে প্রথমে মেনে নিতে হয়, তারপর জীবনকে এমন এক নির্দিষ্ট দিশায় নিয়ে যেতে হয় যেখানে যাপন বিশ্বাসকে আরো পুষ্ট করে, বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করে। এরই পিঠোপিঠি বিষয় হলো অসহিষ্ণুতা এবং অন্যের বিশ্বাসের প্রতি অবজ্ঞা ও বিদ্বেষ। আসলে যেখানে যুক্তি নেই, বিশ্লেষণ নেই, তর্ক বিতর্ক নেই, শাস্ত্রার্থ নেই, শ্রবণ মনন নিদিধ্যাসন নেই, সেখানে যাচাই বাছাই করে নিজের মনের মতন মতটিকে গ্রহণ করার যেহেতু কোনো অবকাশই নেই, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা বা স্বীকৃতি বা গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নও নেই। 


সর্বোপরি হলো ধর্মবোধ। ধর্ম মানে সেই মানবিক মূল্যবোধ যা সমাজের ভিত্তি, যা সমাজকে ধারণ করে। বিশ্বাসীদের কোনো life after life concept নেই, একটাই জীবন - one life concept এবং এটিই হলো ভোগবাদের জনক। একটাই তো জীবন, তাই যত পারো লুটেপুটে খাও, বাকিটা judgement day-র দিন বুঝে নেওয়া যাবে'খন। এই যে অন্ধবিশ্বাসীরা সারা পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করে অন্যের ধন সম্পদ কেড়ে নিয়ে, জোর করে তাদের পন্থ পরিবর্তন করিয়ে তাদের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী রাজত্ব ও শোষণ করেছে, এর পেছনে ওই ভোগবাদের ভূতই কাজ করেছে। আমরাও তো ভিনদেশে গিয়েছি, কি নিয়ে গিয়েছি? শিক্ষার আলো নিয়ে গিয়েছি, জ্ঞানের উজ্জ্বল শিখা নিয়ে গিয়েছি, শাশ্বত সনাতন ধর্মের বাণী নিয়ে গিয়েছি। ঋষি অগস্ত‍্য যখন ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছেন, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন বেদ চতুষ্টয়, অঙ্করভটে কেল্লা নয়, বিষ্ণুর মন্দির তৈরি হচ্ছে, অতীশ দীপঙ্কর যখন চীন যাচ্ছেন বুদ্ধের অমৃতবাণী নিয়ে যাচ্ছেন ঝোলায় বয়ে আর সম্রাট অশোকের সন্তান যখন শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছেন, পবিত্র বোধিবৃক্ষের চারা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন যত্ন করে। 


এই যে এ দেশে এতগুলি ঋষির আশ্রম, এত গুরুকুল, গ্রামে গ্রামে এত পাঠশালা, রত্নাগিরি, জগদ্দল, বিক্রমশীলা, পুষ্পগিরি, ওদান্তপুরী, সোমপুরা, নালন্দা, তক্ষশীলা, বলভী আর বিক্রমপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন এতগুলি উৎকৃষ্ট জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল, তা কি ধর্মবোধ না থাকলে হয়? আমরা জানি যে বারেবারে ভিন্ন ভিন্ন শরীর নিয়ে এখানেই ফিরে আসতে হবে, ফলে জীবনকে এমনভাবে চালনা করো, উন্নত থেকে উন্নততর করো, যাতে তা 'সর্বজন হিতায়, সর্বজন সুখায়'-এর নিমিত্তে নিবেদিত হয়, কেবল 'আমি' নয়, 'আমরা' - সারা বিশ্বসংসার, যাতে কোনো না কোনো এক জন্মে পরা থেকে অপরার দিকে আমাদের যাত্রাপথ সুগম হয়। অনেকদিন হয়ে গেল ঔপনিবেশিক ভাবধারার প্রভাবে নিজেদের শাস্ত্রনির্দেশিত ধর্মবোধকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ভুলটাকে নির্দ্বিধায় উচ্চৈঃস্বরে ভুল বলতে পারলে তাকে বর্জন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়, একটা স্তরে closure হয় তো বটেই। Let us stop romanticising what is intrinsically anticultural - যা আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির পরিপন্থী তা অবশ্যই বর্জনীয়। চলুন পাল্টাই।

Tuesday, February 13, 2024

মা বিশালাক্ষ্মী, কাশী

আজ বলবো গত ৭ই ফেব্রুয়ারি রাতে কাশীতে হটাৎই অযাচিতভাবে মা বিশালাক্ষ্মীর দর্শন পাওয়ার সৌভাগ্যের কথা। লক্ষ্য করে দেখেছি, আমার ক্ষেত্রে দেবদর্শনের সংযোগগুলি অদ্ভুতভাবেই ঘটে, খুব যে একটা পূর্বযোজনা অনুযায়ী চলা যায়, তা কিন্তু সচারচর নয়। কাশীর পবিত্র ভূমিতে ছয়টি এমন পূণ্যক্ষেত্র আছে যেগুলি ষষ্ঠাঙ্গ যোগের দ্যতক - বাবা বিশ্বনাথের মন্দির, মা বিশালাক্ষ্মীর মন্দির, মা গঙ্গা স্বয়ং, বাবা কালভৈরবের মন্দির (যিনি মা বিশালাক্ষ্মীর ভৈরবও বটে), ধুন্ডি বিনায়ক মন্দির (শিব-পার্বতীপুত্র শ্রীগণেশের মন্দির) আর দণ্ডপাণির শিবমন্দির - এগুলি অবশ্য গন্তব্য। এবারে কাশীতে শেষদিনে বড্ড অসুস্থ হয়ে পড়ায় শেষ দুটি মন্দির এবারে আর দর্শন করা সম্ভব হয়নি, পরেরবার শুরুই করবো ওখান থেকে। 

যাইহোক, এক শুভানুধ্যায়ীনি মা বিশালাক্ষ্মীকে দর্শন করার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন যে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরের পাশের এক গলিতে এই মন্দির। কাশী বিশ্বনাথ করিডোরের মধ্যে এখন অনেকগুলি প্রাচীন মন্দির সমাহিত, এবং সেখানে একটি বিশালাক্ষ্মীর মন্দিরও আছে, ফলে আমি ভেবেছিলাম বোধহয় এইটির কথাই তিনি লিখেছিলেন। খটকা লাগলো যখন বিশ্বনাথ গলিতে একদিন সকালে দক্ষিণভারতীয় এক যুবক রাস্তায় আমার কাছে বিশালাক্ষ্মী মন্দিরের পথনির্দেশ চাইলেন কারণ তিনি সদ্য বাবাকে দর্শন করেই বেরিয়েছিলেন। 

সেইদিনই রাতের শৃঙ্গার আরতি দর্শন করে আর বেশি হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না কারণ তার আগেই ধর্মশালায় আমার বেশ বারকয়েক বমি হয়ে গিয়েছিল। তাই পুলিশকে ওই করিডোর থেকে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে যাওয়ার কোনো শর্টকাট আছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে উনি গঙ্গার দিকে 'উডিপি টু মুম্বাই' রেস্টুরেন্টের ঠিক লাগোয়া ডানদিকের একটি গলি দেখিয়ে দিলেন যা মিরঘাট লাহোরিটোলা হয়ে এঁকেবেঁকে দশাশ্বমেধ পৌঁছে যায়। বেশ রাত, প্রায় নিঝুম গলি, দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করেছে, আমরা দুজন বাঁ দিক ডানদিক করতে করতে কখনো আন্দাজে কখনো দিশা জিজ্ঞেস করে হাঁটছি, হটাৎ এক বাঁকের ঠিক আগে মাথার ওপর দেখি এক প্রায়ান্ধকার বোর্ডে লেখা 'শ্রীকাশী বিশালাক্ষ্মী মন্দির'। মাথার ভেতর কে যেন হটাৎ একটা টোকা মেরে বললো - এটাই।

ঘুরতেই ডানহাতে মন্দির, দরজার ওপর দক্ষিণভারতীয় কোনো ভাষায় কিসব যেন লেখা, ভেতরে একটি দক্ষিণভারতীয় ভক্ত পরিবার পূজারত, এমনকি বাইরে, ফটকের ডানহাতে যে বৃদ্ধা গোলাপের মালা ইত্যাদি নিয়ে বসে আছেন, তিনিও দক্ষিণ ভারতীয় এবং আমাদের দেখে নিজের ভাষায় কি যে বললেন কিছুই বোধগম্য হলো না, বোধহয় পূজার সামগ্রী নেবার কথা বলছিলেন। ভেতরে উঁকি মারতেই দেখি সামনেই মা - একেবারে জ্বলজ্বল করছেন। 

বিশালাক্ষ্মী অর্থাৎ বিশাল আঁখি যাঁর - সত্যিই বিশাল নেত্রদ্বয় মায়ের। এই সতীপীঠে হয় মায়ের আঁখি পড়েছিল (যার সম্ভাবনা সমূহ) অথবা কানের মণিকুন্তল, যদিও পুরোহিত বললেন দেবীভাগবৎ পুরাণের মতে মায়ের গোটা মুখটাই নাকি এখানে পড়েছিল, এখন মাতৃমূর্তির পেছনে সযত্নে সুরক্ষিত আছে। কুলার্নব তন্ত্রে যে অষ্টাদশ পীঠের উল্লেখ আছে সেই তালিকায় এটি ষষ্ঠ। কেন দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তদের এত উৎসাহ জানতে গিয়ে জানা গেল যে তাঁরা মূলত তিনরূপে দেবীমহাশক্তির উপাসক - বিশালাক্ষ্মী, কামাক্ষ্মী এবং মিনাক্ষ্মী, বাকি দুজন দক্ষিনেই আছেন, ফলে অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য, কেবল ইনি কাশীতে, ফলে ওঁর প্রতি দক্ষিণীদের এত আকর্ষণ। কাশী-তামিল সঙ্গমের বিষয়টি যে কোন স্তরে কত গভীরভাবে ব্যঞ্জনাময়, সেটা বোধগম্য হলো এতদিনে। 

এক অচেনা গলিতে হটাৎ করে মন্দিরটি আবিষ্কার করার সময়ই আমার স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল যে আমি মা বিশালাক্ষ্মীকে দর্শন করতে যাইনি, উনিই অহেতুকি কৃপা করে টেনে এনে আমায় দর্শন দিয়েছেন। আমি তো জানতাম করিডোরের ভেতরেই আমার ওঁকে দর্শন করা হয়ে গেছে কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতি উনি সৃষ্টি করলেন যাতে ওঁর মন্দিরের রাস্তা আমায় ধরতেই হয় এবং বেশ রাতে প্রায় ফাঁকা মন্দিরে একদম সামনে থেকে দুচোখ ভরে আমি ওঁকে দেখতে পারি, ওঁকে প্রণাম করতে পারি, চরণামৃত পান করতে পারি। কি অপূর্ব মা আমার, নিকষ কালো, ডাগর আঁখি, সুগন্ধি ফুলের মালার অঙ্গরাগে সুসজ্জিতা। ওই চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথার ভেতর কেমন কেমন যেন লাগে, মনে হয় এবার বোধহয় বাহ্যজ্ঞান লোপ পাবে। ছবি তোলা নিষেধ না থাকলে মায়ের সেদিনের রূপ আপনাদেরও দেখাতে পারতাম, আপাতত সেটি আমার মনের মধ্যে ধরা আছে। যে ছবিটি দিলাম সেটি নেট থেকে নেওয়া। বাকি ছবিগুলি মন্দিরের বহিরঙ্গের।

সঙ্কটমোচন, কাশী

আজ সকালে তীর্থযাত্রা সেরে বাড়ি ফিরে এসেছি কিন্তু মন জুড়ে শুধুই তাঁরা সবাই, যাঁদের সান্নিধ্যে গত একটা সপ্তাহ কাটিয়ে এলাম। চোখ বন্ধ করে তো বটেই, চোখ খুলেও তাঁদেরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। গত ৫ই ফেব্রুয়ারি কাশীতে নেমেই এযাত্রায় প্রথম দর্শন করেছিলাম সঙ্কটমোচনকে। এখনো আমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছি আর ঠিক তাঁর বুক বরাবর উল্টোদিকের এক অতি প্রাচীন মন্দিরে বিরাজমান তাঁর ইষ্টদেবকেও, যাঁকে এই মুহূর্তেও হৃদয়ে ধারণ করে তিনি মর্তে বিরাজ করছেন। 

আজ যখনই চোখের সামনে সঙ্কটমোচন ভেসে উঠছেন অমনি মনে পড়ছে তুলসীদাসবাবাজিকেও কারণ তাঁর নিজের হাতে মাটি দিয়ে গড়া ওই অপুরূপ বিগ্রহের মধ্যেই শুধু নয়, তুলসী ছড়িয়ে আছেন ওই ভূমির প্রতিটি কণায়। রচিত হওয়ার সাথে সাথে মানসের কত না দোহা প্রথম শুনেছেন তাঁর প্রাণনাথ আমাদের বাল ব্রহ্মচারী, ওখানকার জঙ্গলের বৃক্ষরাজি, ওখানকার আকাশ, বাতাস, মাটি। 

এখনো ক্রমাগত তাঁর রচিত স্তবই পাঠ হয়ে চলেছে ওই মন্দির চত্বরে, কথক লাগাতার ব্যাখ্যা করে চলেছেন মানসের, ভক্তরা তাঁরই প্রদর্শিত পথে ওখানে যে যাঁর মতন জায়গা খুঁজে নিয়ে রামনামের জপে-ধ্যানে মগ্ন। আমাকে একজন মহাত্মা বলেছিলেন যে মহাবীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গেলে তাঁর সামনে আর তাঁর নিজের সুখ্যাত করতে নেই, রামের গুণগান গাইতে হয়, তাহলেই উনি যারপরনাই প্রসন্ন হন। 

গেট থেকে বাগানের পথ পেরিয়ে আমি যখন তাঁকে দর্শন করতে পৌঁছিয়েছিলাম তখন মন্দিরে বেশ কয়েকজন সমবেত কণ্ঠে জোরে জোরে হনুমান চল্লিশা পাঠ করছিলেন, আমি চুপ করে এককোণে দাঁড়িয়ে প্রথমে মন দিয়ে গোটাটা শুনলাম। তারপর তাঁদের পাঠ শেষ হলে 'জয় রাম জয় রাম জয় জয় রাম' গাইতে গাইতে মহাবীরের সামনে যেতেই কেন জানি না অনুভব হলো যে উনি আমার গান শুনছেন - আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উনি রাম নাম শুনছেন।

ভিড় না থাকলেও লাইন তো একটা ছিলই কিন্তু কেউ আমায় ধাক্কা দিলেন না, কেউ ঠেলে সরিয়ে দিলেন না, ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিশ্চিন্তে তিন তিনবার গোটা নামমন্ত্রটা গাইলাম, তারপর প্রণাম করে ওনার সামনে থেকে চুপচাপ বাঁদিকে সরে গেলাম - এটা আমার মনে আছে। যতক্ষন আমি ওনার সামনে ছিলাম, আমার এই ক্ষীণদৃষ্টি নিয়েই ওই মেটে সিঁদুরের প্রলেপ ভেদ করে ওনার চোখদুটিকে একটু ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করছিলাম আর আমি নিশ্চিত যে উনিও মাথাটা সামান্য বেঁকিয়ে একদৃষ্টিতে আমার দিকেই তখন তাকিয়েছিলেন। 

তুলসী লিখেছিলেন 'শঙ্কর সুবন কেশরী নন্দন, তেজ প্রতাপ মহাজগবন্দন', যদিও তুলসীপীঠাধিশ্বর স্বামী রামভদ্রাচার্য্যজির মতে ওটা ভুল, আসলে তুলসী লিখেছিলেন 'শঙ্কর স্বয়ং কেশরী নন্দন, তেজ প্রতাপ মহাজগবন্দন', যা পরে সাধারণ মানুষের মুখে 'সুবন' হয়ে যায়। আসলে, কেশরী নন্দন মহাদেবের অবতারই হন বা মহাদেব স্বয়ং, তাতে সত্যিই কিই বা আসে যায়?  

দেখি কখনো তিনি রামেশ্বররূপে শ্রীরামচন্দ্রের আরাধ্য, আবার কখনো হনুমানরূপে শ্রীরামচন্দ্রই তাঁর আরাধ্য, এখানে কে ভক্ত আর কেই বা ভগবান, সবই তো এক! ওখানে প্রদক্ষিণ করতে করতে এই কথাটাই ভাবছিলাম আর মনে পড়ে যাচ্ছিল ঠাকুর বলতেন 'ভাগবত ভক্ত ভগবান, তিন এক'। শিব, মহাবীর, রাম, মানস, কাশী - সব এক, সব এক। 

সঙ্কটমোচনে কাশীপতি আর অযোধ্যাপতি দুজনে যেন মিলেমিশে যাচ্ছেন, আবার মন চাইলে আলাদা আলাদা হয়েই চোখের সামনে এখন ভেসেও উঠছেন। এঁদের মধ্যে কে যে কার ভক্ত আর কে যে কার আরাধ্য, তাঁরাই জানেন। মা বলতেন না, 'যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন' - ওটাই সার কথা। সঙ্গে একটি ছবি দিলাম রাম-জানকি মন্দিরের গর্ভগৃহের, অত সুন্দর রামমূর্তি আমি খুবই কম দেখেছি। পরেরবার যখন কাশী যাবো তখন ঐ মন্দিরে দীর্ঘক্ষণ কাটানোর ইচ্ছা প্রবল।

Friday, January 26, 2024

ধর্ম ছাড়া গতি নেই

আমরা যখন জন্মেছিলাম তখন বিশ্বজুড়ে বামপন্থার খুব রমরমা এবং সারা ভারতের মধ্যে অগ্রগণ্য আমাদের এই রাজ্যের সর্বনাশ করার জন্য একদিকে বামেরা আর অন্যদিকে অতিবাম নকশালরা তাদের নিজের নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী তথাকথিত জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য জমি প্রস্তুত করা শুরু করে দিয়েছে। সে হলো কোল্ডওয়ারের যুগ, পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুই ভাবধারাকে আশ্রয় করে দুই মহাশক্তির জোটের মধ্যে শীতল যুদ্ধ, যেখানে আমাদের দেশকে কেউ তেমন পাত্তাই দিত না। 

একটু জ্ঞান হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন বলতে আমরা বুঝতাম খুব উচ্চ কোয়ালিটির কাগজে ছাপা খুবই সস্তার ম্যাগাজিনের রংচঙে হাসিখুশি এক স্বপ্নের মুলুক আর চীন বলতে বুঝতাম প্রচন্ড ডিসিপ্লিনড, কর্মঠ একটা জাতি যেখানে সবাই কাজ পায়, খাবার পায়, চিকিৎসা পায়, ঘর পায়, সবাই সুখী - আমাদের দেশের মতন অভাগা নয়, অসুখী নয়, আমাদের মতন ভয়ঙ্কর অভাবী, ভয়ঙ্কর গরিব, ঘনঘন লোডশেডিং আক্রান্ত, গুচ্ছের শিক্ষিত বেকারওয়ালা, সতীদাহ-জাতপাত কলঙ্কিত, গুরুবাদ-কবলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাপখেলা-বাঁদরখেলা সর্বস্ব একটা অনুন্নত দেশ নয়। 

এদিকে দিদি-জামাইবাবু আমেরিকায় গেল, সেখান থেকে জাপানে, পিকচার পোস্টকার্ডে চিঠি পাঠাতো, দেখে বিস্মিত হতাম। সেও তো স্বর্গ! তারপর দাদারা সব স্কলারশিপ নিয়ে নিয়ে আমেরিকায় পড়তে গেল, গল্প শুনতাম, বিস্মিত হতাম, নিজেদের সাথে মেলাতে পারতাম না। ছোট ছিলাম তো, আমাদের দেশের এই বেহাল দশার অত কার্য কারণ বুঝতাম না, খালি মনে হতো আহা, আমাদের দেশটাও যদি ঐ ছবির দেশগুলোর মতন হতো! সোভিয়েত ইউনিয়নের বইগুলো খুব সস্তায় পাওয়া যেত ফলে ছোটবেলায় যত না আমি ইংলিশ ক্লাসিকাল লিটারেচার পড়েছি তার চেয়ে ঢের বেশি পড়েছি পুশকিন, দোস্তোভয়েসকি, গোর্কি, তলস্তয়, প্রমুখ। 

ব্রন্টে বা ডিকেন্স বা অরওয়েল বা মার্ক টোয়েন বা এইচ জি ওয়েলস বা ডুমা ইত্যাদি ইস্কুলের লাইব্রেরী থেকে নিয়ে পড়েছি, কিনে পড়িনি কোনোদিন কারণ এফর্ড করতে পারতাম না, বাবা ছিলেন না তো। আর পড়েছি বাড়ির আলমারিতে থাকা পোকায় না কাটা বা অল্পকাটা বইগুলো - রবীন্দ্র রচনাবলী, স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী, রামকৃষ্ণ কথামৃত, কিছু পুরাণ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, কালকূট, লীলা মজুমদার, শিবরাম চক্রবর্তী, এলডাস হাক্সলে, বার্থনার্ড রাসেল, জঁ পল সাত্রে, এলবার্ট কামু, ভল্টেয়ার, কান্ট, কে নয় - বুঝি, না বুঝি অবিচারে পড়ে গেছি। 

আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্যি যে আমি বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, শরৎচন্দ্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আশাপূর্না দেবী, বুদ্ধদেব বসু, শক্তি, সুনীল, সমরেশ বসু, বিদ্যা নয়পল, ওরহান পামুখ, গ্যাব্রিয়েল সানচেজ ইত্যাদি অনেকের লেখাই ভালোভাবে পড়েছি অনেক পরে, যবে নিজে রোজগার করে কিনতে পেরেছি। একটা সুবিধা অবশ্য আমার ছিল, আমি যখন যেখানে পড়াশুনা করেছি, ফরচুনেটলি কোথাওই স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নামক রাজনৈতিক অনাচারটির খপ্পরে আমায় পড়তে হয়নি, ফলে আমি 'দাস ক্যাপিটাল' আর 'লেকচার্স ফ্রম কলম্বো টু আলমোড়া' একই উৎসাহের সাথে পড়ার সুযোগ পেয়েছি, কেউ আমার মাথায় ism-এর হাতুড়ি দিয়ে কখনো আঘাত করেনি। 

তাই আমার যে ওয়ালর্ড  ভিউ সেটা সংকীর্ণ নয়, তাতে সবাই আছেন এবং সবটাই অভিজ্ঞতাভিত্তিক। সেই কারণেই তার মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার ব্যাপার তো থেকেই যায়, তাই না? যেদিন সিএনএনের পর্দায় তিয়ানআনমেন স্কয়ারে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে ট্যাঙ্ক চালিয়ে দিতে দেখলাম সেদিন মনে হলো দেং জিয়াও পেং তো মাওয়ের দুষ্ট চতুষ্টয়ের চেয়ে কিছু আলাদা নন, একইরকমের নৃশংস। এরপর যেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল আর একের পর এক সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলোয় মানুষ বিদ্রোহ করতে শুরু করলেন, সেদিন বুঝলাম বৈকি যে ঐ চকচকে ভাবটা কেবল ম্যাগাজিনের প্রোপাগান্ডাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, আসলে তো আম জনতার ঢুঁ ঢুঁ গোপাল আর চাউসেস্কুর বাথরুমে সোনার কল। 

এই ঘটনার অবিলম্বেই যেদিন নিজের রাজ্যে মনের মতন চাকরি না পেয়ে পেটের তাগিদে পৈতৃক বাড়ি, বৃদ্ধা মা, বন্ধুবান্ধব এবং প্রেয়সীকে ছেড়ে চলে যেতে হলো, সেদিন বুঝলাম আমার জন্মের সময়কার ভরা সংসারগুলোকে বামপন্থীরা কিভাবে শ্মশান বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তারপর তো সারা পৃথিবী ঘুরেছি, কত কিছু দেখেছি, কত কিছু পড়েছি, কত অভিজ্ঞতা, জীবনকে উভয়ত কাছ থেকে এবং দূর থেকে দেখতে শিখেছি। যেহেতু কোনো রঙিন কাঁচের বালাই ছাড়াই খোলা মন নিয়ে জীবনকে দেখতে পেরেছি আর ভালো মন্দের বিচার করতে পেরেছি, আমি বিশ্বাস করি আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা objectivity আছে, যা অনেক indoctrinated মানুষেরই নেই। 

এখন সার কথা এই বুঝেছি যে ধর্ম ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানক নেই যার নিরিখে জীবনকে evaluate করা যায়। আমাদের ছেলেবেলায় পা-চাটা আমলা অনেক কমসংখক ছিলেন তো, মন্ত্রী কোনো বেআইনি আদেশ করলে প্রথমে বুঝিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করতেন আর নেহাত fail করলে বলতেন, "লিখে দিন"। ওটাই মোক্ষম দাওয়াই ছিল, বাবা-কাকাদের কাছে শুনেছি। ধর্ম হলো সেই কাগজ যাতে লিখতে গেলে কলজে লাগে। Moralityর বাইরে মন যেতে চাইলেই বলতে হয় "লিখে দিন"। Indic religionগুলো ছাড়া অন্যান্য মতবাদের বহু বইও পড়েছি, তাতে অনেক জায়গাতেই দেখেছি যা লেখা আছে তা ধর্মত ঠিক দাঁড়ায় না, শোধরানো দরকার। কিন্তু যেখানে অন্ধ বিশ্বাসের প্রশ্ন, সেখানে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবেটা কে? সৌদি আরবের যুবরাজ আশার আলো জ্বালিয়েছেন বটে, কতদূর সফল হন সেটা দেখার। 

এতদিন ধরে এতকিছু দেখে আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাদের ছেলেবেলায় যে অনুন্নত ভারত আমরা দেখেছি তা আমাদের ধর্মহীনতার ফল। রাষ্ট্রের জীবনে ধর্ম যদি আবার অর্থ এবং কামকে guide করতে শুরু করে, তাহলে এককালে যেমন ভারত বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে বিত্তশালী, সবচেয়ে আধ্যাত্মিক, সবচেয়ে বিজ্ঞানমনস্ক এবং সাংস্কৃতিকভাবেও সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ ছিল, সেই জায়গাটা সে কয়েক দশকের মধ্যেই ফের ফিরে পাবে। হাজারটা মতবাদ থাকতে পারে, হাজার রকমের বিজাতীয় influence থাকতে পারে, কিন্তু এ দেশের প্রাণভোমরা বেদ আর উপনিষদের মধ্যেই বসে আছে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার অন্যথা হয়নি। 

তর্জমা ছাড়া ওগুলো মূল ভাষায় পড়বো বলেই আমি নিজের চেষ্টায় অল্পস্বল্প সংস্কৃত শিখেছি, খানিকটা পড়েছি, এখনো পড়ছি, ভবিষ্যতেও যতদিন চোখে দেখতে পাবো পড়বো। আমি না পড়ে বা না জেনে বা না ভেবে কোনো কথা বলছি না। যা আমাদের ঋষিরা বলে গেছেন, ওগুলোই ধ্রুববাক্য, আমাদের আর বাইরের মানক দরকার নেই। এত প্রাচীন একটা চলমান সভ্যতার অভিজ্ঞতার ফলে এমন কোনো প্রশ্ন নেই যার উত্তর ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতিতে নেই। যাঁরা এর ছোঁয়া পাননি তাঁরা ডক্টরেট হয়েও মহামূর্খ। আর যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা সামান্য অক্ষরজ্ঞানযুক্ত হলেও মহাজ্ঞানী। প্রমান চাই? একবার রামকৃষ্ণ মিশনের দিকে ভালভাবে তাকিয়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন।

Monday, January 22, 2024

রামের ইচ্ছা

অবধে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার খুশিতে চতুর্দিকে তারস্বরে মাইকে রাম সংক্রান্ত গান বাজছে আর ঘন ঘন পটকা ফাটছে - আজ যেন নতুন এক দিওয়ালির দিন। মন্দির তো কতই তৈরি হয়, বিগ্রহের প্রাণপ্ৰতিষ্ঠাও হয়, কৈ, তাদের ঘিরে এমন আবেগ তো তৈরি হয় না? কেন? অযোধ্যাধামে শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির সবার থেকে আলাদা কারণ এই মন্দির মানুষের ইচ্ছায় তৈরি হয়নি। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি। 

ভারতের মুখ্য চারটি উপাসনার ধারা হলো শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত ও রামায়িত। এছাড়া শিব-পার্বতীর পুত্র কন্যারাও সবাই আলাদা আলাদাভাবে পূজিত হন। লক্ষ্য করে দেখবেন মোটামুটি একই কালখণ্ডে আক্রমণকারীরা মুখ্য ধারাগুলির মধ্যে প্রত্যেকটির মুখ্য পূজাস্থলী - কাশীতে বাবা বিশ্বেশ্বরের জ্ঞানবাপি মন্দির, গোয়ায় শ্রীমাঙ্গেসি শিবমন্দির, মথুরায় শ্রীকৃষ্ণজন্মভূমি মন্দির, অযোধ্যায় শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির, কাশ্মীরে মা ক্ষীরভবানীর মন্দির, কাশ্মীরেই সারদাপীঠ, পাঁচকুলায় ভীমাদেবীর মন্দির, হিরাপুরের চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির ইত্যাদি ধ্বংস করেছিল - অর্থাৎ হিন্দুদের প্রতিটি ধারার মূলেই আঘাত করা হয়েছিল। 

এত অনাচার কি ভগবতেচ্ছা ছাড়াই সম্ভব হয়েছিল যেখানে সবাই জানেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না? যা হয়েছিল তা ভারতবাসীকে ধর্মপথে আনার জন্য ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়েছিল। দীর্ঘদিন বিত্তের জোয়ারে গা ভাসিয়ে আমরা ক্রমশ ধর্মভ্রষ্ট হয়ে পড়ছিলাম এবং আমাদের মধ্যে স্বার্থপরতা তুঙ্গে উঠেছিল। ফলে আমরা একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেছিলাম।

ভেবে দেখবেন, যে সময় যবন আক্রমণ হয় ভারত এক অত্যন্ত উন্নত এবং বড়লোক দেশ ছিল, যার সে সময়ের লোকসংখ্যা অন্ততপক্ষে ১৫/১৬কোটি, অথচ একদল বর্বর গরিব মরুভূমিবাসী ট্রাইবাল লুটেরা এসে আমাদের দেশের বেশ কিছুটা অংশের ওপর ৮০০ বছর ধরে প্রভুত্ব করে গেল যেহেতু আমরা বিভক্ত ছিলাম আর দস্যুরা ছিল একাট্টা। 

একই ব্যাপার ইংরেজ বা পর্তুগিজদের ক্ষেত্রেও খাটে। কজনই বা ইংরেজ থাকতো ভারতবর্ষে? খুব বেশি হলে লাখখানেক। এই লাখখানেক ইংরেজ ৩০ কোটি ভারতীয়র ওপর ২০০ বছর শাসন আর শোষণ করে গেল, ওই একই কারণে - ওরা এক ছিল আর আমরা বিভক্ত। ওরা শান্তি, মনুষ্যত্ব, সৌহার্দের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আমাদের প্রাচীন সভ্যতাকে ভয় করতো কারণ ভালোকে মন্দ চিরকালই ভয় পায়। ফলে ওরা শিক্ষার নাম করে আমাদের নিজেদের সনাতন সংস্কৃতিকেই ঘেন্না করতে শিখিয়েছিল।

সেই সনাতন সংস্কৃতির মূলে প্রাচীন ভারতীয় ঋষি দর্শন বা সনাতন ধর্মবোধ। ধর্ম হলো সেই স্থায়ী মানক যা মানুষকে জাতি, বর্ণ, পন্থ, প্রাদেশিকতা নির্বিশেষে একটা আদর্শ জীবনকে যাপনের জন্য বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। আর যে মুহূর্তে জাতির মধ্যে ধর্মবোধ জাগরিত হয়, সেই মুহূর্তে জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় - সে অনেক বেশি খোলামেলা হয়, অনেক বেশি সহ্যশীল হয়, অনেক বেশি বিবেকবান হয়, তার কামনা পূর্তি আর অর্থলাভের পথ ধর্মের অনুসারী হয় এবং শেষে সে মোক্ষ লাভ করে।

রাম হলেন মূর্তিমান ধর্ম। তিনি মর্য্যাদাপুরুষোত্তম। জাতি হিসেবে যখন আমরা ধীরে ধীরে ধর্মের পথ থেকে সরে যাচ্ছিলাম এবং অতিরিক্ত ভোগবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছিলাম, তখন রামের ইচ্ছাতেই তাঁর মন্দির ধ্বংস হয়েছিল। তারপর গত পাঁচশ বছর ধরে ভারতীয়রা অজস্র মানসিক জ্বালা যন্ত্রণা আর দৈহিক অত্যাচার সহ্য করতে করতে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তাদের ভুলটা কি ছিল। তাই আজ তাদের সকলের হয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

এখন, এত শতাব্দী পরে কেন রামজন্মভূমি মন্দিরের পুনঃপ্রকাশ ঘটলো? কারণ শ্রীরাম চাইলেন, তাই। জাতি হিসেবে আমাদের শাস্তির মেয়াদ শেষ হলো। উনি চাইছেন যে আবার ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করুক এবং তা দেশের প্রত্যেকটি মানুষের ঐক্য ছাড়া সম্ভব নয়। সেই ঐক্য কিভাবে আসবে? একমাত্র ধর্মশ্রয়ী সনাতন সাংস্কৃতির মাধ্যমে। যেই মনে হবে আমরা ধর্মের মাপকাঠি থেকে বিচ্যুত হচ্ছি, অমনি রাম ওই একই অবস্থায় থাকলে কি করতেন, সেটা ভাবলেই সমাধান বেরিয়ে আসবে।

আজ ভারতের জনমানসে রাম আবার নতুন করে জাগ্রত হয়েছেন, জাতির ধর্মবোধ জাগ্রত হওয়ার এটাই পূর্বশর্ত। তাই ভেঙে দেওয়া সমস্ত মন্দিরগুলোর মধ্যে রামমন্দিরই প্রথম পুনর্নির্মিত হলো। রাম কেবল আস্থা নন, আধারও। এখন থেকে আগামী অনেক শতাব্দী এই দেশ রামের ইচ্ছাতেই চলবে, তিনিই পথপ্রদর্শক, তিনিই বিচারক, তিনিই সংস্কারক, মেলাবেন তিনিই মেলাবেন। রাম থাকলে রাক্ষসরা বাঁচতে পারেনা। রামের আশীর্বাদে ভারতে রামরাজ্য ফিরে আসার সূচনা হলো আজ।

রাক্ষসবধ

রাক্ষসরা বারেবারে ঋষিদের যজ্ঞ পন্ড করার চেষ্টা করতো, মনে আছে তো? এখনো করে। তখনও শ্রীরাম রাক্ষস বধ করে ঋষিদের পরিত্রাণ করেছিলেন, আজ আবার নতুন মন্দিরে নতুন বিগ্রহে তাঁর প্রাণপ্রতিষ্ঠা হলো, আবার তিনিই ভারতের ত্রাতা, তিনিই এখন থেকে ধর্মপ্রাণ সৎ ব্যক্তিদের রক্ষা করবেন। আগামী ৯০০ দিনের মধ্যে ভারত আবার রাক্ষসমুক্ত হবে। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আগামী ৯০ দিনের মধ্যেই তার পূর্ণ আভাস আপনারা অনুভব করবেন, তখন মিলিয়ে নেবেন। 

এমনি এমনি তো আর প্রধানমন্ত্রী ওই নতুন কালচক্রের শুরুর কথা বলেননি, উনি অকারণে একটিও শব্দ খরচ করেন না। শ্রীরামকে রাষ্ট্রের চেতনার সঙ্গে জুড়ে যে চারটি কথা উনি বলেছেন, তার মধ্যেই এর অন্তর্নিহিত বার্তা লুকিয়ে আছে, ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন। উনি বলেছেন, "রাম আগুন নন, রাম প্রেরণা। রাম বিবাদ নন, রাম সমাধান। রাম শুধু আমাদের নন, রাম সবার। রাম শুধু বর্তমান নন, রাম অনন্তকাল।" আজ উনি বারেবারে বলেছেন, "দেবতা থেকেই দেশ, আর রাম থেকেই রাষ্ট্রের চেতনা" - বুঝো লোক যে জানো সন্ধান। 

রামের রাক্ষসবধ রাজনীতির ক্ষেত্র দিয়ে শুরু হবে আর সমাজচেতনায় গিয়ে শেষ হবে, যার পরে কেন "আমাদের প্রজন্মকে কালজয়ী হিসেবে বাছা হয়েছে" সেটা সারা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। আজ থেকে হাজার বছর পর নরেন্দ্র মোদি অবশ্যই শরীরে থাকবেন না কিন্তু রাষ্ট্রচেতনারূপী শ্রীরাম থাকবেন কারণ "রামমন্দির স্থাপনা শুধুই বিজয়ের নয়, বিনয়েরও"।

একআধবার যে না ভেবেছি তা তো নয় যে কেন মাত্র বছর পঞ্চাশেক আগে জন্মালুম না, শ্রীশ্রীমাকে সশরীরে দেখতে পেতাম, ঠাকুরের সন্তানদের দেখতে পেতাম, রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পেতাম, ডাক্তারজিকে দেখতে পেতাম, নেতাজিকে দেখতে পেতাম, ইত্যাদি। মনে হতো হয়ত জন্মজন্মান্তরে এত সুকৃতি জমা হয়নি যে ওঁদের সাক্ষাৎ দর্শন পাবো। আজ বুঝছি সেই ভাবনাটা ঠিক ছিল না, আমার জন্যেও মা এক অনাবিল আনন্দের হাট খুলে রেখেছিলেন। 

এই বিশেষ সময়টাতে কেন আমি এই শরীরটায় আছি? নিজের চোখে রামমন্দিরের পুনর্নির্মাণ, রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা এবং তদ্পরবর্তীকালে মর্য্যাদা পুরুষোত্তমের আশীর্বাদে ভারতবর্ষের জনমানসে ধর্ম-আধারিত ব্যাপক সদর্থক পরিবর্তন এবং শ্রীজির আশীর্বাদে পুনরায় ভারতের জগৎশীর্ষে আরোহণ স্বজ্ঞানে অনুভব করতে পারবো বলে। এই তো প্রারব্ধ। This life is certainly worth living. জয় শ্রীরাম, জয় জয় শ্রীরাম। যেমন শ্রী অর্থাৎ সীতা ছাড়া রাম অসম্পূর্ণ, তেমনই রাম ছাড়া ভারতও শ্রীহীন, মলিন।

Saturday, January 20, 2024

শ্রীরামমন্দির

আমরা ভারতীয়রা এবং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ যে মন্দিরটির জন্য নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী কিছু না কিছু অর্থ বা শ্রমদান করেছি, শ্রীরামচন্দ্র ভগবানের সেই মন্দির আজ সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। যা প্রয়োজন ছিল তার দশগুন বেশি অর্থদান দিয়েছি আমরা, ফলে মন্দির প্রাঙ্গণ দশগুন বেশি ভব্য হয়ে উঠছে, যে দরজা কাঠের হওয়ার কথা ছিল, তা সোনার হয়েছে। এই মন্দির আমাদের সকলের একান্ত ইচ্ছা, আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং দীর্ঘ সংঘর্ষের প্রতীক - এক কথায় বলতে গেলে শ্রীরামজন্মভূমি মহাতীর্থক্ষেত্র সামগ্রিকভাবে আধুনিক ভারতীয়দের ধর্মাশ্রিত জীবনযাপনের ইচ্ছার প্রতিভূ, যে ধর্মবোধ হাজার হাজার বছরের আঘাত সহ্য করেও আমাদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে এখনো জীবন্ত এবং চলমান রাখতে সাহায্য করেছে। 

আমরা অন্যদের চেয়ে আলাদা, তাই আজ পর্যন্ত কেউ গায়ের জোরে বা লোভ দেখিয়ে আমাদের গিলে ফেলতে পারেনি - এই মন্দির সেই অন্যনতার জ্বলন্ত নিদর্শন। আমরা সবাই মিলে চেয়েছি, তাই রামমন্দির সম্ভব হয়েছে। এ কেবল আমাদের আস্থার বিষয় নয়, এ আমাদের জাতীয় অস্মিতার বিষয়, আমাদের মূল সংস্কারকে সংরক্ষিত রাখার বিষয়, জাতি হিসেবে আমাদের সম্মিলিত চেতনার বিষয়। আগামীকাল যখন শ্রীশ্রীরামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে, তখন আমরা প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ ভারতবাসী যজমান হিসেবে ওখানেই উপস্থিত থাকবো - হয়তো সশরীরে নয়, আমাদের প্রতিনিধি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে। এবং প্রধানমন্ত্রী সেটা জানেন বলেই ১১দিন ধরে যজমানের কৃতকর্তব্য হিসেবে এত যম-নিয়ম-দর্শন পালন করছেন। 

যখনই সামাজিক মাধ্যমে ফুটে ওঠা শ্রীরামমন্দিরের দিব্য সাজসজ্জার ছবি দেখছি, গর্বে আনন্দে শ্রদ্ধায় বিশ্বাসে আমার মাথা নত হয়ে যাচ্ছে। আহা, এ কি মনোরম রূপ তুমি গ্রহণ করেছ প্রভু, দেখে দেখে যে আর আশ মেটে না ! ছোটবেলা থেকে শুনতাম চোখের দেখা সার্থক হলো কিন্তু তার সত্যিকারের মানে কখনো বুঝিনি, আজ বুঝলাম। যা দেখছি তা আমার স্বপ্নের প্রতিরূপ, আমার অভিলাষার প্রতিরূপ, আমার অস্তিত্বের প্রতিরূপ, আমার বোধের প্রতিরূপ, আমার ভারতীয়ত্বের প্রতিরূপ। কেবল এই তীর্থদর্শনটুকুর স্বাদ পাওয়ার জন্যই বারেবারে যেন এ দেশের মাটিতেই আমার জন্ম হয়, কারণ এর মাধ্যমেই একদিন আমি শুদ্ধ মুক্ত চৈতন্য হবো।

বিভীষণ

বিভীষণ - বিশেষরূপে ভীষণ - কার জন্য? প্রজাপতি ব্রহ্মার বরে বিভীষণ অমর, ফলে যুদ্ধারোপিত মৃত্যুভয়ে তো আর তিনি রামের পক্ষ অবলম্বন করেননি, রাজ্যলাভের লোভেও নয় কারণ তিনি যে জন্মাবধি ধর্মাত্মা, তাঁর জন্মের সময় দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করেছিলেন (তস্মিন্ জাতে মহাসত্ত্বে পুষ্পবর্ষং পপাত হ - উত্তরকান্ড ৯/৩৬)। রাবণের ভয়ঙ্কর ক্রোধ এবং তাঁর চাটুকার সভাসদদের অবজ্ঞার মুখেও আমরা কিন্তু বিভীষণকে অটল দেখি - যিনি অবলীলায় রাবণের মুখের ওপর "রাজার পাপেই রাজ্য নষ্ট হয়" বলে দিতে পারেন, তাঁর বুক কাঁপে না। 

বিভীষণ সম্পর্কে তাঁর অন্যান্য ভাইবোনদের কি মহৎ ধারণা সেটা আমরা সূর্পনখার কথাতেই দেখতে পাই - "বিভীষণস্তু ধর্মাত্মা ন তু রাক্ষসচেষ্টিতঃ" - রাক্ষসকুলে একমাত্র বিভীষণই ধর্মনিষ্ঠ (অরণ্যকান্ড ১৭/২৩)। তাহলে মোদ্দা কথা এই যে ঠোঁটকাটা তপঃক্লিষ্ট ধর্মনিষ্ঠ নির্ভীক বিবেকবান ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত অমর বিভীষণকে সবচেয়ে বেশি ভয় কে পেতেন? রাবণ নিজে। আসলে বিভীষণ রাবণের কাছে বিশেষরূপে ভীষণ বা ভয়ঙ্কর বিভীষিকা ছিলেন কারণ দুর্যধনের মতোই রাবণও জানতেন যে তিনি অধার্মিক। 

সেই বিভীষণকে বাঙালি কি বলতে শিখেছে? 'ঘরশত্রু'। ঠিক যেমন দেশের জন্য নিজের প্রাণ হেলায় বলিদান দেওয়া হুতাত্মা বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে বাঙালি 'বার খাওয়া ক্ষুদিরাম' বলে অপমান করে। আজ যখন অযোধ্যাধামে শ্রীরামচন্দ্র স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন তখন বাঙালি তার মানসিক দৈন্য ঝেড়ে ফেলে আবার ধর্মপথে ফিরে যাবে কিনা সেটা বাঙালিকেই ঠিক করতে হবে। অনেক তো নষ্টামী হলো, এবার রাবণ অনুরাগ ত্যাগ করে শাশ্বতকে মানক বলে মেনে নিলে ভালো হয়না?

Wednesday, January 17, 2024

র‍্যালিতে রাম নেই

সনাতন ধর্ম বিশ্বাস নির্ভর নয়, চিন্তন, মনন এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতি নির্ভর। হ্যাঁ, কারোর integrity-র ওপর যদি আমার অপার আস্থা থাকে, তাঁর প্রত্যক্ষ অনুভূতির কথা যদি যুক্তি দিয়ে নতুন করে independently বিচার করার কোনো প্রয়োজনই বোধ না হয়, তাঁর মুখের কথাকেই যদি আমি সত্য বলে বিশ্বাস করি, সেটা অন্য বিষয় যেমন শিশু সরল বিশ্বাসে তার মায়ের কথা মেনে নেয়। কিন্তু by and large ভারতীয় সংস্কৃতিতে blind faith-এর কোনো চলন নেই, প্রশ্ন করার, বাজিয়ে নেওয়ার, তর্ক করার এবং convinced না হলে না মেনে নেওয়ারও সম্পুর্ন অবকাশ আছে। 

ফলে এই ধরণের খোলা মনের চিন্তক এবং তার্কিক একটি সমাজের পক্ষে বিনা বিতর্কে কেবল বিশ্বাস নির্ভর কোনো মতাদর্শকে মেনে নেওয়া তার মূল প্রাচীন কাঠামোটারই পরিপন্থী। এইজন্যই ধর্ম আর পন্থ (faith) আলাদা। There can be a dialogue between faiths, there could even be an interfaith congress where, in the garb of finding commonality, everyone tries to establish how infaliable or brilliant his own faith is (always as a counter perspective to other faiths), but there can never be real harmony between faiths as faith is essentially blind. একজন অন্যজনের মতবাদ সহ্য করতে পারেনা। শ্রীরামকৃষ্ণদেব কেন 'যত মত তত পথ' বলেছিলেন, কেন 'যত ধর্ম' বলেননি, সেটা ভেবে দেখার বিষয় বৈকি।

এখানেই all faith rally নিরর্থক হয়ে যায় কারণ পন্থ নয়, সেই ধর্মবোধ যার আদিও নেই, অন্তও নেই, বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন জাতির মানুষকে একমাত্র সেইই জীবনযাপনের দিশা দেখাতে পারে, সবাইকে মনুষ্যত্বের ছাতার তলায় একাট্টা করতে পারে কারণ তা হাজার হাজার বছর ধরে বহমান human values ভিত্তিক সভ্যতার উপলব্ধির ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে। শ্রীরাম ধর্মের প্রতীক, পন্থের নয়। শ্রীরামকে নিয়ে গত ৭০০০ বছর ধরে যত কাটাছেঁড়া হয়েছে, তাঁর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় যেমন বালীবধ, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, বনবাস এবং মা ধরিত্রীর বুকে ফিরে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর ভূমিকা নিয়ে যত তর্কবিতর্ক হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এটা কিন্তু ভারতবর্ষ ধর্মবোধি বলেই সম্ভব হয়েছে। 

শ্রীরামকে একদিকে বিষ্ণুর অবতার বলে পূজা করা হচ্ছে আর অন্যদিকে তাঁকে নিয়ে তির্যক সমালোচনা চলছে, এটির মূলে একমাত্র পারম্পরিক righteousness, এতটা ছুট অক্ষরে অক্ষরে পন্থীয় নির্দেশ মেনে চলা blind faithful-রা তাঁদের এক-ঈশ্বর সম্পর্কে কল্পনাও করতে পারেন না। ফলে, আগামী ২২শে জানুয়ারি গোটা ভারতবর্ষ এবং সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মের পুনর্জাগরণের পূণ্যদিন, ওদিন মোটেও বিভিন্ন গোঁড়া পন্থাবলম্বীদের একত্রিত করে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার দিন নয়। অবশ্য এর একটা অন্যদিকও আছে। যদি অযোধ্যাধামে পুনর্নির্মিত শ্রীরামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার দিনে এই কার্যক্রমের আড়ে 'পন্থ যার যার, সনাতন ধর্ম সবার' বার্তা দেওয়াই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বিষয়টি অবশ্য অন্য মাত্রা পায়। আমি তো রাজনীতি বুঝি না, ফলে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল ঠিক ধরতে পারছি না।

Saturday, January 13, 2024

রামলালা ও রোমলালা

ইউটিউবে আজ অযোধ্যায় রামপথ, ধর্মপথ ইত্যাদির শোভা দেখতে দেখতে আমার শ্রদ্ধেয় লালকৃষ্ণ আদবানিজি, শ্রদ্ধেয় মুরলি মনোহর যোশীজি, স্বর্গীয় প্রমোদ মহাজনজি, মা স্বাদ্ধী ঋতম্ভরাজি, মা উমা ভারতীজি, আচার্য্য গিরিরাজ কিশোরজি, শ্রদ্ধেয় অশোক সিংহলজি, শ্রদ্ধেয় বিনয় কাটিয়ারজি, শ্রদ্ধেয় কল্যাণ সিংজি, শ্রদ্ধেয় প্রবীণ তোগাড়িয়াজি, শ্রদ্ধেয় বিষ্ণু হরি ডালমিয়াজি, এমন আরো কত মহান বিভূতিদের কথা মনে পড়ছে, যাঁরা হিন্দু সমাজকে প্রেরণা না যোগালে আজ এই পূণ্যদিন হয়তো আমরা দেখতেই পেতাম না। 

৫০০ বছর ধরে অজস্র সংঘর্ষের কথা যদি ছেড়েও দিই, আমাদের জীবদ্দশাতেই কি কঠিন যে ছিল এই লড়াই, যাঁরা মুলায়ম সিংয়ের আদেশে রামভক্তদের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখেছেন বা যাঁরা দিগ্বিজয় সিংয়ের আদেশে রাত আড়াইটার সময় মা ঋতম্ভরাজির গ্রেফতারি এবং তারপর চারদিন ধরে আদালতে পেশ না করে অবৈধভাবে জেলে নির্যাতন করার কথা শুনেছেন অথবা যাঁরা লালু প্রসাদ যাদবের আদেশে পাটনায় শ্রী লালকৃষ্ণ আদবানিজিকে গ্রেফতার করা দেখেছেন, যাঁরা ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দলকে ব্যান করে দেওয়া দেখেছেন বা রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জনপ্রিয় নির্বাচিত সরকারদের বরখাস্ত করে দেওয়া দেখেছেন, তাঁরা জানেন। 

কিছু করেই কেউ কিছু আটকাতে পারেনি, রামমন্দির আজ এক reality, এমনি এমনিই হলো? প্রভু চেয়েছিলেন তাই ধ্বংস হয়েছিল, আজ প্রভু চেয়েছেন, তাই পুনর্নির্মিত হচ্ছে। আর কোনো মহৎ কাজই বলিদান ছাড়া সম্ভব হয় না, যেমন প্রোপাগান্ডায় বিপ্লবীদের আত্মবলিদান আর সুভাষ বসুর সর্বোচ্চ sacrificeকে লুকিয়ে দিয়ে দেশভাগ করা যেতে পারে কিন্তু কোনোদিন স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা যায় না। কিছু ধূর্ত দেখছি রামজন্মভূমি ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক শ্রী চম্পত রাইজিকে নিয়ে প্রচুর জলঘোলা করছেন। ওরা জানেন কি যে কেমেস্ট্রির অধ্যাপক শ্রী রাইকে এমার্জেন্সির সময় ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ১৮মাস জেলবন্ধি করে রেখেছিলেন এবং উনি না থাকলে ওই অবৈধ ধাঁচাটা হয়তো আজও অক্ষত থাকতো? যত্তসব!

দুটো কথা:
১.
ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহু ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ।
যৎস্যাদ্ধারণ সংযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ।।
(মহাভারত : কর্ণপর্ব, ৬৯. ৫৮)
সমাজকে, জনসাধারণকে যা ধারণ করে রাখে, তাই ধর্ম। তাই যাতে জনসাধারণের, সমাজের সমৃদ্ধি এবং কল্যাণ হয়, তার সাথে যুক্ত হওয়াই ধর্ম, এ কথা নিশ্চিতরূপে জেনো।
২.
ন বিভেতি রণাদ্ যো বৈ সংগ্রামেঽপ্যপরাঙ্মুখঃ।
ধর্মযুদ্ধে মৃতো বাপি তেন লোকত্রয়ং জিতম্।। (মহানির্বানতন্ত্র : ৮.৬৭)
যিনি যুদ্ধে ভয় পান না, যিনি সংগ্রামে অপরাঙ্মুখ বা যিনি ধর্মযুদ্ধে মৃত হন, তিনি ত্রিভুবন জয় করেন। যদি স্বদেশের বা স্বধর্মের জন্য যুদ্ধ করিয়া গৃহস্থের মৃত্যু হয় - যোগিগণ ধ্যানের দ্বারা যে পদ লাভ করেন, তিনিও সেই পদ লাভ করিয়া থাকেন। (অনুবাদ: স্বামী বিবেকানন্দ)

আর রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
মুক্ত করো ভয়, নিজের’পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।
ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরি দিয়ো কঠিন পরিচয়॥

Thursday, January 11, 2024

অধিকারবোধ

আমার গুরুবাড়িতে একটি অপূর্ব মাতৃসংগীত গাওয়া হয়, যার কয়েকটা লাইন এমন:
'অহেতুক তব এই ভালোবাসা পারি কিগো মোরা বুঝিতে,
শত জনমের যত পাপ হায় 
দিয়াছি ঢালিয়া ওই রাঙা পায়ে,
সকলই তো তুমি সহিলে হেলায় কোল দিতে কত তাপিতে।'
সত্যি সত্যিই মায়ের শ্রীচরণে দেওয়ার মতন প্রারব্ধ আর কর্মফল ছাড়া কিই বা আছে আমাদের? বাকি কিছুই তো থাকে না - এই শরীর, সম্পত্তি, নাম-যশ সবই তো চলে যায়, একমাত্র কর্মফলটাই বয়ে বেড়াতে হয় জন্ম থেকে জন্মান্তরে। তা, ব্রহ্মময়ীর কাছে ওই কর্মফলটুকু ছাড়া নিবেদন করার মতন আমাদের আর কিই বা আছে? একমাত্র তিনিই তো পারেন প্রারব্ধ নাশ করে মুক্তি দিতে, ফলে ঐটি যদি ঠিকঠিক তাঁর পায়ে সঁপে দেওয়া যায়, কাজ হয়ে যায়। 

বলে নাকি ঈশ্বর যখন অবতার বেশে আসেন, তখন নিজের অসীম ক্ষমতা ভুলে সাধারণ মানুষের মতোই থাকেন, তাঁদের স্বরূপের কথা মনে করিয়ে দিতে হয়। হনুমানজীর ক্ষেত্রে বা শ্রীরামচন্দ্রের ক্ষেত্রে, এমনকি ঠাকুরের ক্ষেত্রেও আমরা বারবার তা দেখেছি। সেই অবতারত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অবস্থাতেও আমরা দেখেছি ঠাকুর মায়ের পায়ে তাঁর সারা জীবনের সাধনার ফল, মায় জপের মালা পর্য্যন্ত অর্পণ করে দায়মুক্ত হচ্ছেন! তবে মা কিন্তু চিরকাল জানতেন তিনি কে, তবুও নিজের রূপ খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখতেন যাতে আমরা সহজেই তাঁর কাছে পৌঁছতে পারি, আবদার করতে পারি, তাঁকে দেবীরূপে নয়, মাতৃরূপে আপনার জন ভাবতে পারি। মা ধরা দেবেন বলেই তো এসেছিলেন, নইলে তাঁকে ধরে এমন সাধ্য কার?

শিহড়ে সারদা মঠে এখনো সেই বেলগাছটি আছে যার তলায় দিদিমা শ্যামাসুন্দরী দেবী বসেছিলেন আর তখনই লাল চেলি পরা একটি ফুটফুটে পাঁচ-ছ বছরের মেয়ে গাছ থেকে নেমে এসে পিঠের দিক থেকে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে, 'আমি তোমার ঘরে এলাম মা' বলে তাঁর উদরে প্রবেশ করে আর তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েন। মা তো তাঁর জন্মবৃত্তান্ত জানতেন, নিজের মুখেই পরে বলেছেন। মায়ের সেবক স্বামী সারদেশানন্দজী লিখেছেন, 'মায়ের করতল ছিল রক্তাভ, অনেকেই তা দেখার সুযোগ পেয়েছেন। পদতলও ছিল লাল - ঠিক স্থলপদ্মের আভা।... দৃষ্টি প্রশান্ত, স্থির, কৃপা মাখানো - যা সকলের অন্তরে সর্বদা করুণা বর্ষণ করতো। প্রশস্ত উজ্জ্বল কপাল, প্রসন্ন মুখ - দেখলেই চিত্ত শান্ত হয়ে যায়'। মায়ের স্বরূপ সম্পর্কে তাঁর নিকটজনদের কোনো বিভ্রান্তি ছিল না, কিন্তু তাও তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ভাব গোপন করে রাখতেন। এই জন্যই তিনি কেবল মা, সকলের মা, তাঁর ঘরের আগল তিনি নিজেই খুলে দিয়েছেন। মায়ের অবারিত দ্বার, যা আর কোনো অবতারে আমরা পাইনা। ঠাকুরের কাছেও কিন্তু অত সহজে যাওয়া যায় না।

আমি আজ ভোরবেলায় ভাবছিলাম মাকে কিভাবে সবচেয়ে বেশি আপন করে পাওয়া যায় - ভক্তি দিয়ে, মনন দিয়ে, তাঁর মনের মতন কাজ দিয়ে, নাকি ভালোবাসা দিয়ে। তারপর মনে হলো মা তো দুহাত বাড়িয়েই রয়েছেন, নিজের মায়ের সাথে কি কেউ লৌকিকতা করে? মা মানেই মাঠ থেকে ধুলো কাদা সব মেখে এসে সন্তানের অধিকারবোধ থেকে নির্বিকারে 'মা খেতে দাও' বলে হাঁক পারা। তারপর মা ঘটি ঘটি জল ঢেলে চান করিয়ে গামছা দিয়ে গা মুছিয়ে পরিষ্কার জামাটামা পরিয়ে ভাত বেড়ে দেবেন, ওটাই মাতৃত্ব। মুখে হয়তো বকাবকি করবেন, কিন্তু ওই একটা জায়গায় কোনো শাস্তির বিধান নেই। ওই কাদা মাখা অবস্থায় বাবার ঘরে ঢুকলে হয়তো সোজা তাড়িয়ে দেবেন, মা কিন্তু কাদা ধোয়ার জন্যই উন্মুখ কারণ রান্না তিনি করেই রেখেছেন আর সন্তান পেটভরে তৃপ্তি করে খেলে, তবেই তাঁর সুখ। তাই মাকে কাছে পেতে গেলে অধিকারবোধ চাই। আমার মা, আমার উদ্ভব যাঁর থেকে, তিনি কোলে টেনে নেবেন না তো কি অন্য পাড়ার খগেন নেবে? আমি যতই কালিঝুলি মেখে আসি না কেন, মা ঠিক পরিষ্কার করে দেবেন, কারণ তিনি আমার মা, আমার নিজের মা। ব্যাস এটুকুই।

আজকের বাঙালি

রাস্তায় বেরোলেই দেখি লোকজন কেমন যেন ক্ষেপে রয়েছে, যেন ধনুকে তির লাগানোই আছে বা ছাইচাপা আগুন, একটু ঘি পড়লেই দপ করে যেন জ্বলে উঠবে। বাড়ির ভেতরে বসেও প্রায়ই শুনি রাস্তায় অচেনা লোকেরা তারস্বরে ঝগড়া করছে, যেন একজন আর একজনকে চূড়ান্ত হেয় করতে পারলে খানিক শান্তি পায়! ঠাকুর বলেছিলেন 'শ স ষ - যে সয় সে রয়, যে না সয় সে নাশ হয়'। সইবার ক্ষমতা তো কোন ছাড়, এখন তো দেখি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে অন্যের ওপর গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে যেন মানুষ একটু হালকা হতে চাইছে, ভেতরে এমন পরিমানে অতৃপ্তির বিষ জমে আছে! 

একজায়গায় শুনেছিলাম একজন যুবক সাধু তাঁর ঊর্ধ্বতন কোনো প্রিয় প্রবীণ সাধুকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে আশ্রমের toxic পরিবেশ তাঁর আর সহ্য হচ্ছে না, তিনি ছেড়ে চলে যাবেন। ভেবেছিলেন বুঝি সহানুভূতি পাবেন। এক লাইনের উত্তর এসেছিল, 'মনে রেখো তোমাকেও অন্যরা সহ্য করছে'। বাঙালি তো বাংলাভাগ পর্য্যন্ত মুখবুজে সহ্য করেছে, আজ তার হটাৎ কি হলো? এত খারাপ মুখের ভাষা, এত কদর্য অঙ্গভঙ্গি, অসুস্থ বা বয়স্ক বা মহিলা বা শিশুর জন্য কোনো বিবেচনা নেই, নামতে নামতে এতটা নীচে নেমে যাওয়া কেন? আমাদের মায়েরাই তো একদিন রাসবিহারী বোস, যতীন মুখার্জি, নরেন দত্ত বা অরবিন্দ ঘোষদের জন্ম দিয়েছিলেন, আজ তাঁরা কোথায় গেলেন?

সেদিন মেট্রো চড়ে কোথাও যাচ্ছিলাম, দেখলাম প্রবীণদের জন্য সংরক্ষিত আসনে এক চ্যাংড়া বসে আছে আর সামনে যে পক্ককেশ মানুষটি হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর দিকে যেন দেখেও দেখছে না। এক ধমক দিতে বাধ্য হলাম, তখন 'দেখে নেব' ভাব করে সে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে কৃতার্থ করলো। আর একদিন অটোয় করে ফিরবো, স্ট্যান্ডে পেছনেই বসে ছিলাম, এক ভদ্রমহিলা আসাতে উঠে সামনে বসতে যাচ্ছি, অটোর চ্যাংড়া হটাৎ তাঁকে বলে কিনা 'এত নখরা থাকলে অটোয় ওঠেন কেন'? ভদ্রমহিলা কিছুই করেননি, আমিই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলাম, ফলে অপমানে থতমত খেয়ে গেছেন। আসলে মহিলা তো, কুশিক্ষার জন্য চ্যাংড়ারা বোধহয় মায়ের জাতকে নরম মাটি ভাবে, তাই একেবারে খ্যাঁক করে উঠলো। বোঝাতে হলো, বেশ কড়া করেই বোঝাতে হলো। স্ট্যান্ডের মাতব্বররা রং দেখাতে এসেছিল, আমাকেও ফোঁস করতে হলো। আসলে এগুলো যেন সব বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। 

নৈরাশ্য থেকে নৈরাজ্য, দশকের পর দশক ধরে সামাজিক, আর্থিক আর নৈতিক অধঃপতন আর স্বপ্নহীনতা এই রাজ্যকে সামাজিকভাবে এমন এক চরম সংকটের মুখে এনে ফেলেছে, যে নিজেরাই নিজেদের আর সহ্য করতে পারছে না, সুযোগ পেলেই একে ওপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পাকিস্তানের টিটিপি যখন পাকিস্তানেরই আর্মিকে আক্রমণ করে, আমরা হাসি আর টিটকিরি দিই। আজ সারা ভারত যে আমাদের দেখে হাসে, টিটকিরি দেয়, সেটা কি আমরা বুঝি? ঠাকুরের পার্ষদ গঙ্গাধর মহারাজ বলেছিলেন, "মাথায় গীতা, হাতে লাঙ্গল আর মুখে রামনাম, তবেই আমাদের পরিত্রাণ"। যত তাড়াতাড়ি এই গুঢ় কথার সারমর্ম বাঙালি অনুধাবন করতে পারবে, ততই তার মঙ্গল।