রাস্তায় বেরোলেই দেখি লোকজন কেমন যেন ক্ষেপে রয়েছে, যেন ধনুকে তির লাগানোই আছে বা ছাইচাপা আগুন, একটু ঘি পড়লেই দপ করে যেন জ্বলে উঠবে। বাড়ির ভেতরে বসেও প্রায়ই শুনি রাস্তায় অচেনা লোকেরা তারস্বরে ঝগড়া করছে, যেন একজন আর একজনকে চূড়ান্ত হেয় করতে পারলে খানিক শান্তি পায়! ঠাকুর বলেছিলেন 'শ স ষ - যে সয় সে রয়, যে না সয় সে নাশ হয়'। সইবার ক্ষমতা তো কোন ছাড়, এখন তো দেখি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে অন্যের ওপর গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে যেন মানুষ একটু হালকা হতে চাইছে, ভেতরে এমন পরিমানে অতৃপ্তির বিষ জমে আছে!
একজায়গায় শুনেছিলাম একজন যুবক সাধু তাঁর ঊর্ধ্বতন কোনো প্রিয় প্রবীণ সাধুকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে আশ্রমের toxic পরিবেশ তাঁর আর সহ্য হচ্ছে না, তিনি ছেড়ে চলে যাবেন। ভেবেছিলেন বুঝি সহানুভূতি পাবেন। এক লাইনের উত্তর এসেছিল, 'মনে রেখো তোমাকেও অন্যরা সহ্য করছে'। বাঙালি তো বাংলাভাগ পর্য্যন্ত মুখবুজে সহ্য করেছে, আজ তার হটাৎ কি হলো? এত খারাপ মুখের ভাষা, এত কদর্য অঙ্গভঙ্গি, অসুস্থ বা বয়স্ক বা মহিলা বা শিশুর জন্য কোনো বিবেচনা নেই, নামতে নামতে এতটা নীচে নেমে যাওয়া কেন? আমাদের মায়েরাই তো একদিন রাসবিহারী বোস, যতীন মুখার্জি, নরেন দত্ত বা অরবিন্দ ঘোষদের জন্ম দিয়েছিলেন, আজ তাঁরা কোথায় গেলেন?
সেদিন মেট্রো চড়ে কোথাও যাচ্ছিলাম, দেখলাম প্রবীণদের জন্য সংরক্ষিত আসনে এক চ্যাংড়া বসে আছে আর সামনে যে পক্ককেশ মানুষটি হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর দিকে যেন দেখেও দেখছে না। এক ধমক দিতে বাধ্য হলাম, তখন 'দেখে নেব' ভাব করে সে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে কৃতার্থ করলো। আর একদিন অটোয় করে ফিরবো, স্ট্যান্ডে পেছনেই বসে ছিলাম, এক ভদ্রমহিলা আসাতে উঠে সামনে বসতে যাচ্ছি, অটোর চ্যাংড়া হটাৎ তাঁকে বলে কিনা 'এত নখরা থাকলে অটোয় ওঠেন কেন'? ভদ্রমহিলা কিছুই করেননি, আমিই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলাম, ফলে অপমানে থতমত খেয়ে গেছেন। আসলে মহিলা তো, কুশিক্ষার জন্য চ্যাংড়ারা বোধহয় মায়ের জাতকে নরম মাটি ভাবে, তাই একেবারে খ্যাঁক করে উঠলো। বোঝাতে হলো, বেশ কড়া করেই বোঝাতে হলো। স্ট্যান্ডের মাতব্বররা রং দেখাতে এসেছিল, আমাকেও ফোঁস করতে হলো। আসলে এগুলো যেন সব বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে।
নৈরাশ্য থেকে নৈরাজ্য, দশকের পর দশক ধরে সামাজিক, আর্থিক আর নৈতিক অধঃপতন আর স্বপ্নহীনতা এই রাজ্যকে সামাজিকভাবে এমন এক চরম সংকটের মুখে এনে ফেলেছে, যে নিজেরাই নিজেদের আর সহ্য করতে পারছে না, সুযোগ পেলেই একে ওপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পাকিস্তানের টিটিপি যখন পাকিস্তানেরই আর্মিকে আক্রমণ করে, আমরা হাসি আর টিটকিরি দিই। আজ সারা ভারত যে আমাদের দেখে হাসে, টিটকিরি দেয়, সেটা কি আমরা বুঝি? ঠাকুরের পার্ষদ গঙ্গাধর মহারাজ বলেছিলেন, "মাথায় গীতা, হাতে লাঙ্গল আর মুখে রামনাম, তবেই আমাদের পরিত্রাণ"। যত তাড়াতাড়ি এই গুঢ় কথার সারমর্ম বাঙালি অনুধাবন করতে পারবে, ততই তার মঙ্গল।
No comments:
Post a Comment