অবধে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার খুশিতে চতুর্দিকে তারস্বরে মাইকে রাম সংক্রান্ত গান বাজছে আর ঘন ঘন পটকা ফাটছে - আজ যেন নতুন এক দিওয়ালির দিন। মন্দির তো কতই তৈরি হয়, বিগ্রহের প্রাণপ্ৰতিষ্ঠাও হয়, কৈ, তাদের ঘিরে এমন আবেগ তো তৈরি হয় না? কেন? অযোধ্যাধামে শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির সবার থেকে আলাদা কারণ এই মন্দির মানুষের ইচ্ছায় তৈরি হয়নি। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি।
ভারতের মুখ্য চারটি উপাসনার ধারা হলো শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত ও রামায়িত। এছাড়া শিব-পার্বতীর পুত্র কন্যারাও সবাই আলাদা আলাদাভাবে পূজিত হন। লক্ষ্য করে দেখবেন মোটামুটি একই কালখণ্ডে আক্রমণকারীরা মুখ্য ধারাগুলির মধ্যে প্রত্যেকটির মুখ্য পূজাস্থলী - কাশীতে বাবা বিশ্বেশ্বরের জ্ঞানবাপি মন্দির, গোয়ায় শ্রীমাঙ্গেসি শিবমন্দির, মথুরায় শ্রীকৃষ্ণজন্মভূমি মন্দির, অযোধ্যায় শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির, কাশ্মীরে মা ক্ষীরভবানীর মন্দির, কাশ্মীরেই সারদাপীঠ, পাঁচকুলায় ভীমাদেবীর মন্দির, হিরাপুরের চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির ইত্যাদি ধ্বংস করেছিল - অর্থাৎ হিন্দুদের প্রতিটি ধারার মূলেই আঘাত করা হয়েছিল।
এত অনাচার কি ভগবতেচ্ছা ছাড়াই সম্ভব হয়েছিল যেখানে সবাই জানেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না? যা হয়েছিল তা ভারতবাসীকে ধর্মপথে আনার জন্য ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়েছিল। দীর্ঘদিন বিত্তের জোয়ারে গা ভাসিয়ে আমরা ক্রমশ ধর্মভ্রষ্ট হয়ে পড়ছিলাম এবং আমাদের মধ্যে স্বার্থপরতা তুঙ্গে উঠেছিল। ফলে আমরা একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেছিলাম।
ভেবে দেখবেন, যে সময় যবন আক্রমণ হয় ভারত এক অত্যন্ত উন্নত এবং বড়লোক দেশ ছিল, যার সে সময়ের লোকসংখ্যা অন্ততপক্ষে ১৫/১৬কোটি, অথচ একদল বর্বর গরিব মরুভূমিবাসী ট্রাইবাল লুটেরা এসে আমাদের দেশের বেশ কিছুটা অংশের ওপর ৮০০ বছর ধরে প্রভুত্ব করে গেল যেহেতু আমরা বিভক্ত ছিলাম আর দস্যুরা ছিল একাট্টা।
একই ব্যাপার ইংরেজ বা পর্তুগিজদের ক্ষেত্রেও খাটে। কজনই বা ইংরেজ থাকতো ভারতবর্ষে? খুব বেশি হলে লাখখানেক। এই লাখখানেক ইংরেজ ৩০ কোটি ভারতীয়র ওপর ২০০ বছর শাসন আর শোষণ করে গেল, ওই একই কারণে - ওরা এক ছিল আর আমরা বিভক্ত। ওরা শান্তি, মনুষ্যত্ব, সৌহার্দের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আমাদের প্রাচীন সভ্যতাকে ভয় করতো কারণ ভালোকে মন্দ চিরকালই ভয় পায়। ফলে ওরা শিক্ষার নাম করে আমাদের নিজেদের সনাতন সংস্কৃতিকেই ঘেন্না করতে শিখিয়েছিল।
সেই সনাতন সংস্কৃতির মূলে প্রাচীন ভারতীয় ঋষি দর্শন বা সনাতন ধর্মবোধ। ধর্ম হলো সেই স্থায়ী মানক যা মানুষকে জাতি, বর্ণ, পন্থ, প্রাদেশিকতা নির্বিশেষে একটা আদর্শ জীবনকে যাপনের জন্য বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। আর যে মুহূর্তে জাতির মধ্যে ধর্মবোধ জাগরিত হয়, সেই মুহূর্তে জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় - সে অনেক বেশি খোলামেলা হয়, অনেক বেশি সহ্যশীল হয়, অনেক বেশি বিবেকবান হয়, তার কামনা পূর্তি আর অর্থলাভের পথ ধর্মের অনুসারী হয় এবং শেষে সে মোক্ষ লাভ করে।
রাম হলেন মূর্তিমান ধর্ম। তিনি মর্য্যাদাপুরুষোত্তম। জাতি হিসেবে যখন আমরা ধীরে ধীরে ধর্মের পথ থেকে সরে যাচ্ছিলাম এবং অতিরিক্ত ভোগবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছিলাম, তখন রামের ইচ্ছাতেই তাঁর মন্দির ধ্বংস হয়েছিল। তারপর গত পাঁচশ বছর ধরে ভারতীয়রা অজস্র মানসিক জ্বালা যন্ত্রণা আর দৈহিক অত্যাচার সহ্য করতে করতে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তাদের ভুলটা কি ছিল। তাই আজ তাদের সকলের হয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
এখন, এত শতাব্দী পরে কেন রামজন্মভূমি মন্দিরের পুনঃপ্রকাশ ঘটলো? কারণ শ্রীরাম চাইলেন, তাই। জাতি হিসেবে আমাদের শাস্তির মেয়াদ শেষ হলো। উনি চাইছেন যে আবার ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করুক এবং তা দেশের প্রত্যেকটি মানুষের ঐক্য ছাড়া সম্ভব নয়। সেই ঐক্য কিভাবে আসবে? একমাত্র ধর্মশ্রয়ী সনাতন সাংস্কৃতির মাধ্যমে। যেই মনে হবে আমরা ধর্মের মাপকাঠি থেকে বিচ্যুত হচ্ছি, অমনি রাম ওই একই অবস্থায় থাকলে কি করতেন, সেটা ভাবলেই সমাধান বেরিয়ে আসবে।
আজ ভারতের জনমানসে রাম আবার নতুন করে জাগ্রত হয়েছেন, জাতির ধর্মবোধ জাগ্রত হওয়ার এটাই পূর্বশর্ত। তাই ভেঙে দেওয়া সমস্ত মন্দিরগুলোর মধ্যে রামমন্দিরই প্রথম পুনর্নির্মিত হলো। রাম কেবল আস্থা নন, আধারও। এখন থেকে আগামী অনেক শতাব্দী এই দেশ রামের ইচ্ছাতেই চলবে, তিনিই পথপ্রদর্শক, তিনিই বিচারক, তিনিই সংস্কারক, মেলাবেন তিনিই মেলাবেন। রাম থাকলে রাক্ষসরা বাঁচতে পারেনা। রামের আশীর্বাদে ভারতে রামরাজ্য ফিরে আসার সূচনা হলো আজ।
No comments:
Post a Comment