Tuesday, December 26, 2023

শ্রীরাম ও বাম

শ্রীরামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা দিবসে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের দ্বারা সিপিএমের নেতাদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর পরাধীন পলিটব্যুরোর বিদেশি প্রভু-নির্দেশিত প্রেস বিবৃতিটি পড়লাম। যথারীতি, ভারতের কোটি কোটি মানুষের দানের অর্থে গড়ে ওঠা ভারতীয় অস্মিতার প্রতীক এই পুনর্নির্মিত মন্দিরটিকে সরকার এবং একটি বিশেষ দলের সাথে জুড়ে দিয়ে নিজেদের ধর্মবিরোধী এবং ভারতবিরোধী অবস্থানকেই তারা আবার ব্যক্ত করেছে, যা ১৯৬২ সালে চিনের ভারত আক্রমণের সময় চিনকে সমর্থন করার সময় থেকেই এই মতাবলম্বীরা দৃঢ়ভাবে পালন করে আসছে।

আসলে জরুরি অবস্থা জারি করে বিরোধী দলগুলির নেতাদের জেলে পুরে ভগ্ন সংসদে সম্পুর্ন অনৈতিকভাবে সংবিধানের মূলে আঘাত করে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যে দুটি শব্দ ঢুকিয়েছিলেন - সমাজবাদী আর পন্থনিরপেক্ষ, তাকেই নিজেদের স্বার্থে অতঃপর ছদ্মবামপন্থীরা ধর্মনিরপেক্ষ বলে সংজ্ঞায়িত করেছে। ইন্দিরার সংবিধানও কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে না, পন্থনিরপেক্ষতার কথা বলে - ধর্ম আর পন্থ সম্পূর্ণ আলাদা, যে পার্থক্যটা এই অশুভ শক্তির ইচ্ছে করেই গুলিয়ে দিতে চায়। এরা 'ধর্ম মানি না' বলে আসলে ধর্মাশ্রিত প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার একাত্মতার মূল ভিত্তিটিকে কেটে ফেলতে চেয়েছে, যাতে anarchy সৃষ্টি করে ভারতবিরোধী শক্তিদের উদ্দেশ্য সাধন করা যায়।

শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, মহাবীর, শ্রীচৈতন্য, গুরুনানক,  শ্রীরামকৃষ্ণ - এঁরা সমাজ জীবনে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে এসেছিলেন, সম্প্রদায় গড়তে নয় কারণ মানবিকতার ভিত্তিই ধর্ম। পরে ওঁদের কারো কারো অনুসারীরা আলাদা আলাদা সম্প্রদায় গড়ে তোলেন, সেটা অন্য বিষয়। যারা অমানবিক, পাপাচারী, দুর্জন তারাই অধার্মিক, ফলে ভারতের অন্যতম মুখ্য এবং পুরোধা ধর্মপ্রবর্তনকারীর স্মৃতিমন্দির নির্মাণের মাধ্যমে যখন বৃহত্তর সমাজ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে আবার হারিয়ে যাওয়া ধর্মবোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে, তখন তার বিরোধিতা কারা করছে সেটা মানুষের কাছে স্পষ্ট না হলে মানুষ বুঝবেন কিভাবে যে নেতৃত্বের নিরিখে সমাজের ধর্মবোধ রক্ষার স্বার্থে কাকে বর্জন আর কাকে আলিঙ্গন করতে হবে?

ব্যাক্তিগতভাবে আমি খুব খুশি হয়েছি যে অমন পবিত্র দিনে এই অপবিত্র মতাদর্শের ছায়া ওই পবিত্র স্থানে পড়বে না। আরো কিছু কলুষিত চরিত্র ট্রাস্টের আমন্ত্রণ অস্বীকার করলে আমি আরো খুশি হবো। ভারতের ভিত্তিই হলো ধর্ম। 'ভয়ম্ রতম্ ইতি ভারতম্' - 'ভ' অর্থাৎ আলোর খোঁজে যে রত, সেই ভারত। সেই আলো বেদান্তের আলো, অন্তরাত্মার আলো, ধর্মের আলো, সভ্যতার আলো, মর্য্যাদার আলো, মানবিকতার আলো, সদাচারের আলো। যে আলো ভারত থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, বহির্বিশ্ব থেকে ভারতে আসেনি। যারা তা মানে না এবং আলো ছেড়ে অন্ধকারের পেছনে দৌড়োয়, আলোর দিশারীর মন্দিরে তাদের কি কাজ?

Sunday, December 24, 2023

লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ

কলকাতার গীতা জয়ন্তী বলতে ছেলেবেলায় আমরা দক্ষিণ কলকাতার ট্রায়াংগুলার পার্কের এককোনে প্যান্ডেল করে সপ্তাহখানেক ধরে চলা গীতাপাঠ, কীর্তন, গান, প্রবচন ইত্যাদির কথাই জানতাম। খুব মেরেকেটে জনা পঞ্চাশ-ষাটেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সন্ধ্যাবেলায় বসে শুনতেন, দিনেরবেলায় খিচুড়ি ভোগ খাওয়ানোর সময় ছাড়া অতজন শ্রোতাও হতো না। কাপড়া যখন বহুবছর যতীন দাস রোডে ছিল, তখন ওই দিনগুলোতে মাঝেমাঝেই আমি ওখানে গীতাপাঠ বা কীর্তন ইত্যাদি শুনতে যেতাম।

আর আজ সেই অবহেলিত গীতা জয়ন্তীকে এক সম্পূর্ণ অন্য রূপ নিতে দেখলাম। কি উদ্দীপনা, কি involvement, কি ব্যাপ্তি ! বাঙালি যেন হটাৎ করে জেগে উঠেছে ! কেউ কেউ এতে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন, কেউ হিন্দু consolidation দেখছেন, কেউ বা সাম্প্রদায়িকতা খুঁজছেন, কেউ কেউ আরো এগিয়ে গিয়ে এরই মধ্যে প্রচুর টাকার বেসাতিও বুঝে ফেলেছেন। 

সে যার যেমন রুচি সেই মোতাবেক ভাবতেই পারেন কিন্তু আমি দেখছি এতদশকের বামপন্থী influence কাটিয়ে অবশেষে হিন্দু বাঙালির নিজের মূলকে খোঁজার শুরু হওয়া। নিন্দুকে আবার taunt করে জিজ্ঞেস করছে 'কজন বাঙালি ছিল?' আরে, আজ ময়দানে ১,৩৭,০০০ মানুষজন শতকরা ১০০% বাঙালিই ছিলেন রে মূর্খ, এই প্রদেশের যাঁরা বাসিন্দা তাঁরা সবাই তো বাঙালিই কারণ এই প্রদেশ তো আর ভাষার ভিত্তিতে তৈরি হয়নি, পন্থের ভিত্তিতে হয়েছিল। 

আর কি দেখলাম আমরা? বন্ধুবর সৈকত বসু দারুন বিশ্লেষণ করলেন।  আমরা দেখলাম discipline, যা নাকি বাঙালি হারিয়ে ফেলেছে। আর কি দেখলাম? ধর্মের পুনরুত্থানের জন্য বঙ্গের সমস্ত মঠ, মিশন, সাধু, sect সবাই এককথায় এক হয়ে যেতে পারেন - এর মাধ্যমে বাঙালি হিন্দুর জন্য এক অসীম সম্ভাবনার দরজা কিন্তু খুলে গেল। আর কি দেখলাম? The star power of Sri Krishna - একবার খবরটা ঠিক মতন ছড়িয়ে দিতে পারলেই হলো - কি রাম, কি কৃষ্ণ, কি শিব, কি কালী - এই level-এর আকর্ষণীশক্তি কোনো মেগা মাপের রাজনীতিবিদ বা ফিল্মস্টারেরও নেই। 

একজন দেখলাম লিখেছেন যে গীতা সবার জন্য নয়। একদম ভুলভাল কথা। একমাত্র গীতাই সবার জন্য। Infact পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো জাতির যে কোনো পন্থাবলম্বী যদি নিজের জীবনকে ধর্মপথে চালনা করতে চান তাহলে একমাত্র গীতাতেই তিনি তাঁর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেতে পারেন। গীতা সবার জন্য নয় বলে তাকে তুলে রাখলে হবে? পড়বে, তবে তো জানবে রে বাবা! আমি সাচ্চা সনাতনী হবো অথচ আমার guiding philosophical principlesই জানবো না, এ আবার কি কথা?

Thursday, December 21, 2023

কৃপা অর্থাৎ সদবুদ্ধি

যুদ্ধকাণ্ডে বানরসেনার হাতে রাবণের গুপ্তচরেরা ধরা পড়ার পর যখন সুগ্রীব তাদের হত্যা করার জন্য উদ্যত হলেন, তখন আর উপায়ন্তর না দেখে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে তারা প্রাণভিক্ষা করাতে কৃপানিধান সুগ্রীবকে আটকে দিয়ে বলছেন,
"সকৃদেব প্রপন্নায় তবাস্মীতি চ যাচতে ।
অভয়ং সর্বভূতেভ্যো দদাম্যেতদ্ ব্রতং মম ।।" (১৮/৩৩)
অর্থাৎ, যে একবার আমার শরণাগতি যাচনা করবে, তাকে সর্বভূতে অভয় প্রদান করা আমার ব্রত। এখন, শরণাগত হওয়া কি আর ঈশ্বরের কৃপা ব্যতীত সম্ভব? 

এইখানেই প্রশ্ন ওঠে ঈশ্বরের কৃপা বলতে আমরা কি বুঝি? তিনি কি নিজে চেক কেটে আমাদের ল্যাম্বরগিনি হুরাকান কিনে দেবেন নাকি আমাদের নিজেদের ধনসম্পদ আর সন্তান-সন্ততিদের প্রচুর রোজগার এবং তাদের মনের সব জাগতিক বাসনা মেটানোর বন্দোবস্ত করে দেবেন? লোকে চায় বটে, কার কাছেই বা আর চাইবে, কিন্তু এই ক্ষুদ্রবুদ্ধি যতক্ষণ আছে ততক্ষণ বুঝতে হবে ঈশ্বরের কৃপা হয়নি। তাঁর কৃপা হওয়া মানে তিনি সর্বদা এমন সদবুদ্ধি যোগাবেন যাতে জীবনে যে যে সময়ে ধর্মত যা যা করণীয়, তাই তাই করার মতন মানসিক স্থিতি নিজে থেকেই সৃষ্টি হয়ে যাবে। 

আমরা গৃহস্থরা যখন যে আশ্রমে আছি তখন ধর্মত সেই আশ্রমের জন্য যা যা নির্ধারিত কর্তব্য তা যদি ঠিক ঠিক নির্বাহ করতে পারি, সেটাই ঈশ্বরের কৃপা। যেমন, ব্রহ্মচর্যাশ্রম হলো জ্ঞান আহরণের সময় এবং তার ভিত্তিতে নিজের জীবনের মানক নির্ধারণ করার সময়। ঠাকুর বলতেন 'একটা খুঁটি ধরে ঘুরলে আর পড়বি না'। তখন সেদিকে concentrate না করে যদি আমরা পলিটিক্স ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকি, বুঝতে হবে আমাদের ভেতরের অসুর তখনো জেগে আছে। 

তেমনিই, যখন গার্হস্থ্যাশ্রমের সময় তখন বাপ-মা, স্ত্রী-পরিবার, আশ্রিত-পরিজনদের ভরণপোষণ করা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য যা যা একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির করণীয় এবং তার জন্য সৎপথে যতটা আয়, ব্যয় এবং সঞ্চয় করা প্রয়োজন তা না করে যদি ক্লাব, পার্টি, শুঁড়িখানায় হৈহৈ করে বেড়াই, যদি গৃহীচিত ব্রহ্মচর্য্য রক্ষা করতে না পারি অর্থাৎ বহুগামী হৈ, বুঝতে হবে যে ঈশ্বরের কৃপা পাওয়ার আমরা তখনও যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি। 

তারপর বানপ্রস্থের সময় যদি আমরা বিষয়-সম্পত্তি যশ-প্রতিপত্তি আর কর্তৃত্বের অহঙ্কার ত্যাগ না করতে পারি, যদি ৮০ বছর বয়সেও গায়ে গাউন চাপিয়ে কোর্টে গিয়ে জেনেশুনে দোষীর পক্ষে সওয়াল করি, তখন বুঝতে হবে এই শরীরে এবারে হয়তো আর কৃপালাভ হবে না। বানপ্রস্থের পরেই সন্ন্যাস - মানসিকভাবে ওটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। গৃহীর সন্ন্যাসাশ্রম আর সন্ন্যাসীর সন্ন্যাসের nature কিন্তু আলাদা কিছু নয়, কেবল দুটির মাঝখানে অনেক অনেক জন্মের শুভকর্মফলজনিত প্রারব্ধ, জন্মাবধি ঈশ্বরকৃপা আর কয়েক দশকের সাধনার ব্যবধান থাকে। 

পূজ্যপাদ স্বামী ঈশ্বাত্মানন্দজী মহারাজ তাঁর প্রবচনে বলেন ঈশ্বর মানে প্রেম আর নিঃস্বার্থতা। তাহলে নিশ্চয় সন্ন্যাস মানে 'আমি'কে ত্যাগ করে নিঃস্বার্থ হয়ে সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে যাওয়া। এই প্রেম জাগতিক প্রেম নয়, আত্মপ্রেম। এই মানুষরূপী শরীরের উদ্দেশ্যই হলো নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করতে চেষ্টা করা। সন্ন্যাসীর যেহেতু কোনো পিছটান থাকে না, পুরো সময়টাই এতে ব্যয় করা যায়, সেটা একটা মস্ত বড় সুবিধা। তাঁর সব কাজই নিরাসক্ত সেবা আর গৃহীর অধিকাংশ কাজই বাসনাপূর্তির অঙ্গ। 

গৃহস্থের জীবনে এই শেষ আশ্রমের চেয়ে শুভসময় আর কিছু নেই, মুক্তকচ্ছ হয়ে ঈশ্বরের কৃপা অনুভব করার এটাই তো শ্রেষ্ঠ সময়। শরীর হয়তো ক্রমশ অশক্ত হতে থাকবে কিন্তু সেই শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও ঈশ্বরের এই বার্তাই তো আছে যে এখন যা করছো তার memory তুমি পরের শরীরেও carry forward করবে আর ওটাই তখন তোমার প্রারব্ধ হয়ে যাবে। এই করতে করতেই একদিন কোনো না কোনো এক শরীরে তুমি সুস্থাবস্থায় কমবয়সেই সন্ন্যাসী হয়ে এই নশ্বর সংসারের মায়াকে ত্যাগ করবে আর তারপর তো it is just a matter of time, তোমার আত্মজ্ঞান হবেই হবে। 

পরিবারের কাছে ছোটবেলা থেকে ঠিক ঠিক সংস্কার পেলে এ পথে এগোনো খানিকটা সহজ হয় কারণ দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ কজনই বা আর হন? যখন কোনো শিশুর সংস্কারিত পরিবারে জন্ম হয়, সেটাই তার ওপর ঈশ্বরের প্রথম কৃপার নিদর্শন। তারপরের দায়িত্ব তার বাপ-মায়ের, তার গুরুর আর সবচেয়ে বেশি তার নিজের। মনে রাখা প্রয়োজন যে বেশিরভাগ মানুষকেই কিন্তু কৃপা অর্জন করতে হয়, মাত্র কয়েকজন অতি ভাগ্যবানই তা অহেতুকি পান - যেমন দীক্ষান্তে শিষ্য শ্রী ক্ষীরোদ মুখোপাধ্যায়কে শ্রীশ্রীমা কৃপা করেছিলেন, "আজ থেকে তােমার ইহকাল ও পরকালের পাপ গেল।" বাপরে !!

Saturday, December 16, 2023

মাতৃগুরু

শ্রীহনুমানচল্লিশা এক চমৎকারী স্তবমালা, সেটা যাঁরা মানেন তাঁরা জানেন। নানান পন্ডিত ব্যক্তি নানান দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর নানা রকমের ব্যাখ্যা করেছেন, ব্যক্তিগতভাবে তুলসীপিঠাধীশ্বর স্বামী রাম্ভদ্রাচার্য্যজী মহারাজের টিকা এবং চল্লিশার সংস্কারিত সংস্করণ আমার সবচেয়ে ভালো লাগে, যার মানে মোটেও এই নয় যে অন্যগুলি খারাপ। যাইহোক, যাঁরা শ্রীহনুমানচল্লিশা পাঠ করেন তাঁরা জানেন যে মঙ্গলাচারণের পরে এবং মূল স্তব শুরু করার আগে ভক্তশিরোমণি শ্রীতুলসীদাস গোস্বামীজী তাঁর শ্রীগুরুর চরণবন্দনা করে একটি প্রতিজ্ঞাবাক্য লিখেছিলেন,
শ্রীগুরু-চরণ-সরোজ-রজ    নিজ-মন-মুকুর সুধাহি
বরণওঁ রঘুবর-বিমল-যশ     যো দায়ক ফল চারি ।।
[শ্রীগুরুদেবের চরণকমলের পরাগরূপ ধূলি দিয়ে নিজের মনরূপ দর্পণকে পরিষ্কার করে (তাতে ফুটে ওঠা) রঘুকূলশ্রেষ্ঠ শ্রীরামচন্দ্রের উজ্জ্বল যশের বর্ণনা করছি, যা চারটি ফলই (ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) প্রদান করবে।]

স্বামীজী এই 'শ্রীগুরু' শব্দটির দুর্দান্ত ব্যাখ্যা করেছেন। ওনার কথাগুলোই আমি মূল হিন্দি থেকে নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী যথাসম্ভব বাংলায় ভাবানুবাদ করার চেষ্টা করছি। উনি লিখছেন যে গোস্বামীজী প্রতিজ্ঞাবাক্যে প্রথমেই 'শ্রী' শব্দটি আদিশক্তি শ্রীসীতাজীকে স্মরণ করে ব্যবহার করেছেন কারণ সীতাজী হলেন ব্রহ্মময়ী মহাশক্তি, স্বয়ং ব্রহ্মরূপী শ্রীরামচন্দ্রের বাম দিকে অবস্থান করে জীবের ভগবৎপ্রতিকূলতাকে নিরস্ত করেন। 'শ্রীগুরু' শব্দটির দুরকমের সমাস হয়:
১. মধ্যমপদলোপী তৃতীয়াততৎপুরুষ সমাস - শ্রীয়া অনুগৃহীতৌ গুরুঃ ইতি শ্রীগুরুঃ, অর্থাৎ শ্রীজীর (মহাশক্তির) অনুগ্রহপ্রাপ্ত গুরুদেব হলেন শ্রীগুরু। এর কারণ এই যে শক্তির কৃপা বিনা অবিদ্যার দোষ খন্ডন করা যায় না, ফলে যিনি সদগুরু, অর্থাৎ যাঁর অজ্ঞানতা দূর হয়েছে, তাঁর মধ্যে মহাশক্তির কৃপা প্রকাশিত। 
২. কর্মধারায় সমাস - শ্রীরেব গুরুঃ ইতি শ্রীগুরুঃ, অর্থাৎ শ্রীসীতাই হলেন গুরু। লক্ষণীয় যে শ্রীসম্প্রদায়ের জগৎবিখ্যাত সব আচার্য্যরা, যেমন শ্রীরামানুজাচার্য্যজী বা শ্রীরামানন্দাচার্য্যজীরা, শ্রীজীকেই পরমগুরু বলে স্বীকার করেছেন। এঁরা সীতাজীইকেই শ্রীহনুমানজীর আধ্যাত্মিক আচার্য্য মানেন, যে হনুমানজী কিনা আবার দেবগুরু বৃহস্পতিরও গুরু। তাই শ্রীহনুমানচল্লিশা যে শ্রীহনুমানজীর গুরুকে স্মরণ করে শুরু করা হয়েছে, এতে আশ্চর্যের তো কিছু নেই। 

আমরা গুরুপ্রণাম করতে গিয়ে বলি না, 'গুরুরেব পরং ব্রহ্ম', শ্রীরামকৃষ্ণদেব সেই তত্বটিই সহজ করে বুঝিয়ে বলেছেন, "ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে, শক্তিকে ছেড়ে ব্রহ্মকে ভাবা যায় না।…আদ্যাশক্তি লীলাময়ী, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, বহ্মই কালী। একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয় সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কোনও কাজ করছেন না– এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ।" শ্রীরামচন্দ্র আর শ্রীসীতামাতা একই, ঠিক যেমন পরবর্তী অবতারে শ্রীরামকৃষ্ণ আর শ্রীশ্রীমা এক এবং অভিন্ন। ঠাকুর নিজেই তো বলেছেন, "ও কি যে সে! ও আমার শক্তি!" তাইতো ঠাকুর ভাবস্থ অবস্থায় দক্ষিনেশ্বরের গঙ্গাতীরে দেখা শ্রীশ্রীসীতামায়ের হাতে পরা ছিলেকাটা বালা দেখে ওইরকমই বালাজোড়া শ্রীশ্রীমায়ের জন্যেও গড়িয়ে দিয়েছিলেন। জয় শ্রীগুরুমহারাজজী কি জয় ! জয় মহামায়ী কি জয় !

লক্ষণ

শ্রীরামচরিতমানসটি আবার পড়তে পড়তে কৌতূহলবসত মাঝে মাঝে মূল বাল্মীকি রামায়ণটিও আবার উল্টেপাল্টে দেখছি আর অন্যান্যবার যে সমস্ত শ্লোক নজর এড়িয়ে গিয়েছিল, সেগুলি এবার চোখে পড়ছে আর তাতে বিস্ময়ের অন্ত নেই। শ্রীরামের প্রতি ছোটভাই লক্ষণের শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা, আনুগত্য ইত্যাদির বিষয়ে তো আমরা সকলেই জানি, কিন্তু শ্রীরাম যে লক্ষণের মধ্যে নিজের পিতা মহারাজ দশরথের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে মানসিকভাবে তাঁর ওপর কতটা নির্ভর করতেন, সেটা কি আমরা লক্ষ্য করেছি? দুটি শ্লোক উল্লেখ করছি, একটি শ্রীরামের নিজের মুখের কথা আর একটি মা জানকির। 

অরণ্যকাণ্ডে একজায়গায় শ্রীরাম লক্ষণকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, "ভাবজ্ঞেন কৃতজ্ঞেন ধর্মজ্ঞেন চ লক্ষণ । ত্বয়া পুত্রেণ ধর্মাত্মা ন সংবৃতঃ পিতা মম ।।" অর্থাৎ হে লক্ষণ, তুমি ভাবজ্ঞ, কৃতজ্ঞ ও ধর্মজ্ঞ। আমাদের ধর্মাত্মা পিতার প্রতিমূর্তি হিসেবে তুমিই তাঁর স্থান গ্রহণ করেছ (অরণ্য ১৫/২৯)। লক্ষণ সম্পর্কে এই একই কথা আবার সুন্দরকাণ্ডে মা সীতাও হনুমানকে বলছেন "যং দৃষ্টা রাঘবো নৈব বৃত্তমার্যমনুস্মরেৎ" অর্থাৎ  যাঁকে দেখলে রাম আর পিতার অনুপস্থিতি অনুভব করেন না (সুন্দর ৩৮/৬১)। বনবাসকালে লক্ষণ যে ধীরে ধীরে শ্রীরামের পিতার স্থান, যাকে ইংরেজিতে বলে strength and stay, অধিকার করে নিয়েছেন, এটা যেমন বিস্ময়কর তেমনিই মধুর। আসলে লক্ষণ যে শ্রীরামচন্দ্রের জীবনে কতখানি জুড়ে ছিলেন তা মা সীতার একটি কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, "মত্তঃ প্রিয়তরো নিত্যং ভ্রাতারামস্য লক্ষণঃ", আমার চেয়েও ভ্রাতা লক্ষণ রামের বেশি প্রিয় (সুন্দর ৩৮/৬০)।

আর একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না, যদিও এর context সম্পূর্ণ আলাদা। রাম লক্ষণ আর সীতা বনে চলে যাওয়ার পর শোকে অধীর হয়ে মহারানী কৌশল্যা মহারাজ দশরথকে বহু কটুবাক্য শোনানোর পর যখন realise করেছেন যে পুত্রশোকে বিহ্বল হয়ে নিজের ধর্মপরায়ণ স্বামীকে যা বলার নয় তাও বলে ফেলেছেন, তখন আক্ষেপ করে বলছেন, "শোকো নাশয়তে ধৈর্যং শোকো নাশয়তে শ্রুতম্ । শোকো নাশয়তে সর্বং শোকসমো রিপুঃ ।।" অর্থাৎ শোক ধৈর্য নাশ করে, শোক শিক্ষা নাশ করে, শোক সমস্ত গুনাগুন নাশ করে, শোকের সমান শত্রু নেই (অযোধ্যা ৬২/১৫)। পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম যে এইখানে শোকের জায়গায় হিংসে, অহংকার, রাগ, ঘৃণা, দ্বেষ, স্বার্থপরতা, যা ইচ্ছে দুর্গুণ লাগানো যেতে পারে - মানুষের পক্ষে তার ফল একই রকমের বিনাশকারী হবে।

Saturday, December 9, 2023

গুরুকৃপা

কজ্জল কে ঘর মে যেতনা সিয়ানা রহে,
থোড়া বুঁদ লগে পর লগে, কাম জাগে পর জাগে।

সঙ্ঘগুরুরূপে যতদিন তিনি শরীরে ছিলেন ততদিন আমার পরমারাধ্য গুরুদেব আমার ইষ্টদেবের সচল বিগ্রহরূপেই পূজ্য ছিলেন, আর তাঁর মহাসমাধির পর ইষ্টপদে বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণে তাঁদের দুজনের সেই পার্থিব শারীরিক ব্যবধানটুকুও বহুদিন হলো মিটে গেছে। এখন যিনি আমার ইষ্ট তিনিই আমার গুরু, তিনিই সূক্ষ্মশরীরে ধ্যানগম্য হয়ে আমার হৃদয়ে প্রতিনিয়ত অবস্থান করছেন। আমি যখন প্রতিদিন 'জয় শ্রীগুরুমহারাজজি কি জয়' 'জয় মহামায়ী কি জয়' বলে জয়ঘোষ দিই, তখন গুরু আর ইষ্টকে এক এবং অভিন্ন জেনেই এই বাক্যগুলি বলি। এই জয়ঘোষ দেওয়ার সময় আমার বড় রোমাঞ্চ বোধ হয়, বড় ভালো লাগে।

তিনি কৃপা করে তাঁর শ্রীচরণে আশ্রয় দিয়েছিলেন বলেই না আজ তাঁকে নিজের ভেতর অনুভব করার চেষ্টা করতে পারছি, তা না হলে কোথায় তিনি এক সর্বজনপূজ্য সর্বত্যাগী ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ আর কোথায় আমি এক ঘোর সংসারী জীবনাশক্ত অর্বাচীন। তার ওপর, তাঁর শিক্ষা তো আর একমুখী কোনো বিশ্বাসতন্ত্রের নয়, ভারতের অন্তরাত্মায় নিহিত ঋষিদর্ষিত আত্মজ্ঞানের একটা গোটা আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার, যা ঠাকুরের হাত ধরে জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম আর রাজযোগের perfect synthesis বা পূর্ণাঙ্গ সংশ্লেষণরূপে এ যুগের উপযোগী হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আসলে বাবুরাম মহারাজের কথায়, ঠাকুর হলেন 'জীবন্ত উপনিষদ' - উনি একাধারে শ্রীকৃষ্ণের নিষ্কাম কর্ম, বুদ্ধদেবের ত্যাগ, আচার্য্য শঙ্করের জ্ঞান আর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমের ধারার সমাবেশক। 

এই যে আমার গুরুবাড়ি, যে মঠে আমার গুরুদেব সশরীরে থাকতেন, তা তো আর কেবল ইঁট কাঠ পাথরের গোটাকতক বাড়িঘর বা মন্দির নয়, একটা অনবদ্য অপ্রতিম প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে মধ্যমনি হয়ে মূলমন্দিরে আমার ইষ্টদেব স্বয়ং বসে আছেন, এখানেই গঙ্গাতীরে সঙ্ঘজননী জগজ্জননী মহামায়ার পূতপবিত্র মহাশক্তিপীঠরূপী মাতৃমন্দির আছে, আর আছে ঠাকুরের দুই প্রধান লীলাসহচরের দুটি সমাধিমন্দির, ঠাকুরের অধিকাংশ পার্ষদদের দাহক্ষেত্রের ওপর নির্মিত স্মৃতিসৌধ, সঙ্ঘাধ্যক্ষ ও সন্ন্যাসীদের দাহক্ষেত্র, এবং বিভিন্ন অফিস, মঠ বাড়ি, মিউজিয়াম, ভোজনশালা, অতিথিশালা ইত্যাদি। এই মঠের প্রতিটি ইঞ্চি ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষদের সান্নিধ্যধন্য এক দৈব বিচরণক্ষেত্র। বহু বহু উচ্চকোটির সন্ন্যাসীদের aura বা সাধনালব্ধ অলৌকিক আভামন্ডলের ধারকও এই মহাপূণ্যভূমি। বাবুরাম মহারাজ বেলুড় মঠ সম্পর্কে বলতেন 'এ তো বৈকুণ্ঠ'।

কিন্তু এসবের বাইরে এই প্রতিষ্ঠানের যেটি মূল সম্পদ সেটি হলো সনাতন ধর্ম, দর্শন এবং আধ্যাত্ম সম্পর্কিত বিশুদ্ধ জ্ঞানের এক অফুরন্ত প্রবাহমান ধারা। ঠাকুর মা স্বামীজী এবং ঠাকুরের পার্ষদ ও শ্রীশ্রীমা ও স্বামীজীর শিষ্যদের সম্মিলিত বাণী ও রচনায় তো তা প্রতিফলিত বটেই, পরবর্তীকালে যাঁরা সঙ্ঘগুরু হয়েছেন এবং যে সব মহাজ্ঞানী সন্ন্যাসীরা ঠাকুরের প্রদর্শিত পথে ভারতীয় আধ্যাত্মিক ভাবধারার সর্বসমাবেশী রূপটি নিয়ে চিন্তন মনন ও গ্রন্থন করেছেন, তাঁদের সকলের সম্মিলিত প্রজ্ঞার প্রকাশিত রূপ এই প্রতিষ্ঠানের সাহিত্যভান্ডার। ফলে রামকৃষ্ণ মিশন সনাতনী ধর্মজীবন এবং সনাতন সংস্কৃতির এমন একটি অমূল্য repository, যেটি অনবদ্য, সহজলভ্য এবং যে কেউ চাইলেই এর মধ্যে ডুব দিতে পারেন। 

দীক্ষান্তে গুরুদেব যখন প্রথম তাঁর দক্ষিণহস্তটি আশীর্বাদস্বরূপ আমার মাথার ওপর রেখেছিলেন, তখন আমার ১৪-১৫ বছর বয়স, সেই মুহূর্তে কোন দরজা যে আমার জন্য খুলে যাচ্ছে তা বোঝার মতন  বুদ্ধিই আমার ছিল না। স্বামীজীর অন্যতম প্রিয় বই The imitation of Christ এ একজায়গায় লেখা আছে, 'What canst thou see abroad which thou seest not at home? Behold the heaven and the earth and the elements, for out of these are all things made.' আমার চোখে তখন পার্থিব পৃথিবীটাকে উল্টেপাল্টে দেখার স্বপ্ন, পঞ্চতত্বীয় দর্শনের গভীরতার আমি কি বুঝবো? গুরুদেবের প্রতি ভক্তিতে ওনার শঙ্করভাষ্যের ব্যাখ্যাসহ একটি 'ব্রহ্মসূত্র' কিনে এনেছিলাম এবং একবর্ন বুঝতে না পেরে ভক্তিভরে তুলে রেখে দিয়েছিলাম। 

কিন্তু তাঁর কৃপা এমনই যে কৈশোর-আসন্ন যৌবনের অপুষ্ট মননকে উপেক্ষা করেই গুরুদেব সেদিন আমার হাতে একটা ঝাঁঝরি ধরিয়ে দিয়েছিলেন আর যে বীজ উনি কানের মধ্যে দিয়ে হৃদয়ে বপন করেছিলেন, আমার দায়িত্ব ছিল কেবল রোজ তার ওপর অল্প অল্প জল ঢালা, ওটুকুও আমি সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। এখন বুঝি কত অবুঝ ছিলাম। কিন্তু এমনই তাঁর অহেতুকি কৃপা যে আমায় কাজের কাজ কিছুই করতে হয়নি। বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম কখন হলো আমি জানিনা, তাতে কে বেড়া দিলেন আমি জানি না, ঝাঁজরির জল ফুরিয়ে যাওয়ার পরে তাতে নতুন করে জল কে ভরে দিলেন তাও আমি জানিনা, সে গাছ যে আমার অজ্ঞাতেই কবে বড় হয়ে আমারই মাথার ওপর ছাতা হয়ে দাঁড়ালো, তার কিছুই আমি জানিনা। 'আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল তিমিরনিবিড় রাতে।'

আমার গুরুদেব শ্রীশ্রীমায়ের আশ্রিত সন্তান ছিলেন, ফলে ছেলের মাধ্যমে জগজ্জননীর কোন আশীর্বাদ সেদিন এই অকিঞ্চনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল তার আমি কি জানি? আমি শুধু জানি যে যখন ঘুম ভাঙল তখন সেই গাছে ফুল ফুটেছে, আর বুকের মধ্যে কে যেন বলছে এবার কাজে লাগো মালি, একটু যত্নআত্তি করো, তবে না ফল ফলবে। স্বামীজীর সেই প্রিয় বইটির কথা যেন তাঁরই নির্দেশ হয়ে কানে বেজে উঠলো, 'Loose not, brother, thy loyal desire of progress to things spiritual. There is yet time, the hour is not passed. Why whilt thou put off thy resolution? Arise, begin this very moment, and say, "Now is the time to do: now is the time to fight, now is the proper time for amendment."

ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি গুরুকৃপা কোনো কথার কথা মাত্র নয়, ও সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করার চাবি। যত দিন যাচ্ছে তত বুঝতে পারছি গুরুর মাধ্যমে কিভাবে ইষ্ট কাজ করেন আর একবার তাঁর কৃপা হলে 'মুকং করতি বাচালং পঙ্গুং লংঘয়তে গিরিম্' - মুকও গড়গড় করে কথা বলে, পঙ্গুও পাহাড় ডিঙিয়ে যায়। খাওয়া ঘুম সব কমে গেছে, মনটা ধীরে ধীরে যেন কাদার মতন নরম হয়ে যাচ্ছে। বাইরের কুটিল জগতের সাথে লেনদেন, কোলাহল, বিষয়-আশয়, স্বার্থযুক্ত কাজ ইত্যাদিতে আর রুচি নেই, নেহাত সংসারের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষা করা গৃহস্থের কর্তব্য, তাই প্রয়োজনটুকুই কেবল সম্পন্ন করি। আমি যা শুনতে ভালোবাসি তার ধরণ বদলে গেছে, যা পড়তে ভালোবাসি, তার ধরণ পাল্টে গেছে আর যা দেখতে ভালোবাসি, তার ধরণও এখন ভিন্ন। আমি যে ক্রমশ বদলাচ্ছি, সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি।

পশু পাখি কীটপতঙ্গ সব যেন আপন বলে মনে হচ্ছে - কোন কুকুর বেড়াল কাঠবেড়ালি খেতে পেল না, কার চোট লাগলো, কে নির্দয়ভাবে গাছের ডাল কাটছে - ওদের যন্ত্রণা আমায় বড় পীড়া দেয়। আজকাল ফুল তুলতে দ্বিধা হয়, পোকাও মারতে পারিনা, বুকে বাজে। কাউকে অভুক্ত বা বিপদগ্রস্ত দেখলে চোখে জল আসে, মনে হয় কি করে একটু সেবা করতে পারি। আমি কি ছিলাম আর নিজেরই অজান্তে ইদানিং কি হয়েছি, ভাবলে নিজেই বড় বিস্মিত হই। মাঝেমাঝে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করে পরম কৃতজ্ঞচিত্তে দীনতার সাথে ঠাকুর আর মাকে কেবল এটুকুই বলি,
আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে।
তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর
তুমি তাই এসেছ নীচে।।

Friday, December 8, 2023

সমর্পণ

অর্পণ আর সমর্পণ শব্দদুটির মধ্যে একটাই নির্ণায়ক পার্থক্য বা defining difference - স উপসর্গটির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি। যদিও 'স' মানে 'সঙ্গে' যেমন সজোরে মানে জোরের সঙ্গে, কিন্তু এক্ষেত্রে উপসর্গটির ব্যবহার স্বয়ং অর্থে স্ব-এর মতন - অর্পণ মানে দেওয়া আর সমর্পণ মানে নিজেকে দেওয়া। কিভাবে সমর্পণ করা যায়? প্রথমে এই ধারণা বদ্ধমূল হওয়া দরকার যে আমি মালিক নই, 'পরের জায়গা পরের জমিন, ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো সেই ঘরের মালিক নই'। মহাভারতের শান্তিপর্বে ভীষ্ম একজায়গায় যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়ে বলছেন, 
"যচ্চ কামসুখং লোকে যচ্চ দিব্যং মহত্সুখম্৷
তৃষ্ণাক্ষয়সুখস্যৈতে নার্হতঃ ষোড়শীং কলাম্৷৷" অর্থাৎ, লৌকিক বাসনাপূর্তি বা অভ্যন্তর-শৌচ জনিত যে সুখ তা তৃষ্ণা ক্ষয় হওয়ার যে সুখ, সেই সুখের তুলনায় ষোল ভাগের এক ভাগও নয়। এখানে তৃষ্ণা মানে ভোগ-তৃষ্ণা। যতক্ষণ 'আমি' ভাব আছে ততক্ষণই ভোগের ইচ্ছা, যেই নিজেকে গুরু বা ইষ্টের হাতে অর্পণ করে দেওয়া গেল, অমনি 'আমি রথ, তুমি রথী, যেমন চালাও তেমনি চলি' হয়ে গেল, তখন 'তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে'।

এ কথা মুখে বলা যত সোজা, কাজে করে দেখানো ততটাই কঠিন কারণ মাঝখানে একটি দেহের সাথে সম্পৃক্ত পরিচয়সূচক 'আমি' সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে যে, যাকে অস্বীকার করা একটা দুরূহ ব্যাপার। অথচ না করলেও নয় কারণ ঠাকুরের পার্ষদ শ্রীশ্রীবাবুরাম মহারাজ একজায়গায় ভক্তদের বলছেন, "অহংকারের লেশমাত্র থাকলে বকলমা দেওয়া যায় না। ঠাকুর বলতেন এতে ঝরে এঁটো পাতার মতো থাকতে হয়। যেমন বিড়ালী তার ছা কে কখনো বড়লোকের বিছানায়, আবার কখনো বা ছাইয়ের গাদায় শুইয়ে রাখে। সুখে-দুঃখে যিনি বিচলিত না হয়ে তাঁতে মনোনিবেশ করে রাখতে পারেন, যিনি নিষ্ঠুর কর্তব্যের মধ্যেও বলতে পারেন 'ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি', তিনিই প্রকৃত বকলমা দিয়েছেন।" (কথাপ্রসঙ্গে স্বামী প্রেমানন্দ, পৃ ১২৯)

এখন, দেহ থাকলে দেহবোধ থাকাটাই তো স্বাভাবিক। দেহবোধ থাকবে অথচ দেহযুক্ত আমি-বোধ থাকবে না, এ বড় গোলমেলে ব্যাপার - a very evolved State - ও বেশিরভাগেরই কম্ম নয়। ওদিকে, বকলমা দিতে গেলে তো সেই 'আমি'কেই অর্পণ করতে হবে। 'আমি'র পারে যাওয়ার একটা পথ, বস্তুত জ্ঞানের পথ, মহামন্ডলেশ্বর স্বামী স্বরূপানন্দজি মহারাজ একজায়গায় দেখিয়েছেন,
'দেহ না থাকিলে তুমি আত্মার পরিচয় পাইতে না। দেহ আছে বলিয়াই তুমি অনুভব করিতে পারিতেছ যে, এই দেহের ভিতরে "তুমি" আছ। 
সেই "তুমি" দেখিতে কেমন, তাহা তুমি এখনও জান না। 
কিন্তু তুমি অনুমান করিতে সমর্থ হইতেছ যে, এই দেহকে যেমন সহজে দেখিতে পাওয়া যায়, দেহের ভিতরে "তুমি" নামে পরিচিত যিনি আছেন, তাঁহাকে তেমন সহজে দেখা যায় না, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেহ সসীম কিন্তু সেই "তুমি" অসীম। 
"তুমি" অসীম বলিয়াই তোমার শ্লাঘা, সম্মান, মর্য্যাদা এবং আত্মপ্রসাদ অসীম হইবে। 
তুমি তোমার জীবনের প্রতিটি পাদ-সঞ্চালনে, তোমার এই অসীমত্বের ধারণাটীকে সঙ্গে লইয়া চলিও।'
(প্রবুদ্ধ যৌবন, শ্রীশ্রীস্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব)

কিন্তু এর আরো একটা পথ আছে, যা অপেক্ষাকৃত সহজ, যা ভক্তির পথ এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকেই যার নির্যাস গ্রহণ করা যায় - মায়ের ওপর শিশুসন্তানের সম্পুর্ন নির্ভরতার পথ। বাবুরাম মহারাজ বলছেন, "মার কাছে ঠাকুর বকলমা দিয়ে দেহ ধারণ করেছিলেন" - কত বড় কথা! সমর্পণের এই পথ জ্ঞানের নয়, স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস আর অধিকারবোধের পথ। গর্ভধারিণী মা আর জগজ্জননী মায়ের মধ্যে মাতৃত্বের বহমান ধারাটি তো একই, তাই এতে একদিকে যেমন মায়ের আপত্যস্নেহ যা উঁচ-নিচ বিচার করে না, অন্যদিকে সন্তানের সম্পুর্ন নির্ভরতা - আমার অসুবিধে হলেই আমি ট্যাঁ করে কেঁদে উঠবো আর মা ছুটে এসে আমার দুঃখমোচন করবেন। এছাড়া মা আমাকে যখন যেভাবে মোড়ামুড়ি দিয়ে যেখানেই শুইয়ে রাখবেন, আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ওখানেই সম্পূর্ন সুরক্ষিত অবস্থায় শুয়ে থাকবো। 

কোনো বড় কাজ করার আগে মাকে একবার জানিয়ে রাখা, কোথাও বেরোনোর আগে মাকে বলে বেরোনো, কোনো অসুবিধে হলে মাকে স্মরণ করা, সারাদিনের শেষে মাকে একবার দিনলিপি জানিয়ে দেওয়া - এগুলো করতে তো কোনো অসুবিধা নেই, এতে নির্ভরতা বাড়ে। ওই যে মাকে "মা আসছি" বলে বেরোলাম, জানি পেছন থেকে মা "দুর্গা দুর্গা" বলছেন, আমি সুরক্ষিত। হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবো, মাকে আগে তার details জানিয়ে, pros and cons সব বলে অনুমতি চাইলাম - যদি দেখি নিজের মনের মধ্যে কোনো দ্বিধা উৎপন্ন হলো না, জানলাম মায়ের এতে সম্মতি আছে। যখন দিনের শেষে সারাদিনের কাজের ফিরিস্তি দিচ্ছি, তখন সব কাজ ধর্মত ঠিক ঠিক হয়েছে কিনা তার হিসেবও তো সাথে সাথে হয়ে যাচ্ছে - কোনো ভুল করে থাকলে তা সুধরোবার উপায়ও মায়ের ইচ্ছায় মনের মধ্যেই ভেসে উঠবে, ইত্যাদি।

মায়ের ওপর আমাদের নির্ভরতা কেমন হবে, বাঁদরের বাচ্চার মতন হবে যে মাকে নিজের চার হাত-পা দিয়ে সর্বক্ষণ আঁকড়ে ধরে থাকে নাকি বেড়ালের বাচ্চার মতন হবে যাকে ঘেঁটি ধরে মা যেখানে নিয়ে গিয়ে রাখে, সে সেখানেই পড়ে থাকে, তা আমাদের নিজেদের স্বভাবের ওপর নির্ভর করছে। ওই যে বাবুরাম মহারাজ পাণ্ডবগীতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন না, "ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি", রবীন্দ্রনাথ তার ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে:
'এ শ্লোকের মানে এমন নয় যে, আমি ধর্মেই থাকি আর অধর্মেই থাকি তুমি আমাকে যেমন চালাচ্ছ আমি তেমনি চলছি। এর ভাব এই যে, আমার প্রবৃত্তির উপরেই যদি আমি ভার দিই তবে সে আমাকে ধর্মের দিকে নিয়ে যায় না, অধর্ম থেকে নিরস্ত করে না ; তাই হে প্রভু, স্থির করেছি তোমাকেই আমি হৃদয়ে রাখব এবং তুমি আমাকে যেদিকে চালাবে সেই দিকে চলব। স্বার্থ আমাকে যেদিকে চালাতে চায় সেদিকে চলব না, অহংকার আমাকে যে পথ থেকে নিবৃত্ত করতে চায় আমি সে পথ থেকে নিবৃত্ত হব না। অতএব তাঁকে হৃদয়ের মধ্যে স্থাপিত করে তাঁর হাতে নিজের ভার সমর্পণ করা, প্রত্যহ আমাদের ইচ্ছাশক্তির এই একটিমাত্র সাধনা হোক।'

Thursday, December 7, 2023

বিধানসভায় বিজেপি

পশ্চিমবঙ্গের নেগেটিভ ধ্বংসাত্মক ব্যক্তিস্বার্থসর্বস্ব নীতিহীন রাজনীতি দেখে দেখে একসময় ক্লান্ত হয়ে গিয়ে নিজের ভূমিকার ওপর ঘেন্নায় আমি টিভিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছি, তাও বছর দুয়েক হয়ে গেল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি রাজনীতির ওপর আর নজর রাখি না। দেশের দশের খবর ঠিকই রাখি, তবে সেটা অবশ্যই চ্যানেলগুলোর অন্তঃসারশূন্য মারামারিসর্বস্ব টিভি ডিবেট দেখে নয়। 

যাইহোক, তিনটি রাজ্যে বিজেপির জয় নিয়ে এখানে অনেকেই দেখছি এটাকে সেমিফাইনাল ইত্যাদি বলে খুব লাফাচ্ছেন, যার মধ্যে সারবত্তা কিছুই নেই। বস্তুত এটা ভারতীয় মতদাতার প্রজ্ঞাকে অসম্মান করার সমান। ভারতে গণতন্ত্র এতটাই matured যে মতদাতা local body, legislature আর parliament-এর মধ্যে পার্থক্য খুব ভালো বোঝেন, তাঁদের যে স্তরে যে দলকে উপযোগী মনে হয়, সেই স্তরে তাকে ভোট দেন যেমন দিল্লির জনতা বিধানসভায় আম আদমি পার্টিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা দেওয়ার পরেই লোকসভার সাতটি আসনেই বিজেপিকে জেতান। 

এটা কেন সেমিফাইনাল নয়, সেই বিষয়ে ফিরে আসি। গতবার, অর্থাৎ ২০১৮তে এই তিনটি বিধানসভাতেই কংগ্রেস জিতেছিল আর তার ঠিক চার মাস পরে এই তিনটি রাজ্যের মিলিত ৬৫টি লোকসভা আসনে লড়ে কংগ্রেস জিততে পেয়েছিল মাত্র ৩টি আসন - ছত্তিশগড়ে ২টি, রাজস্থানে শূন্য এবং মধ্যপ্রদেশে ১টি - মনে পড়ে? এবারেও যদি বিজেপি এই তিনটি রাজ্যেই বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যেত তাতেও ২০২৪এর লোকসভার তাদের resultএ বিন্দুমাত্র আঁচ আসতো না, ওখানে শ্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই - অর্থাৎ দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনমানসে যে charisma আর হিমালয়সর্দিশ বিশ্বাসযোগ্যতা ওনার আছে, তার ধারেকাছেও অন্য কোনো নেতা নেই। 

এই যে বিশ্লেষকরা বলছেন না যে hidden Modi wave, তাঁরা বুঝতে পারেননি, আসলে কোনোকিছুই hidden নয়, সবটাই স্পষ্ট, কিন্তু এতটাই স্পষ্ট যে হয়তো নজর এড়িয়ে গেছে। আমিই তো কত সময় চোখে চশমাটা পরে ভুলে সেই চশমাই এখানে ওখানে খুঁজে বেড়াই। বহু মানুষ এখন মনে করতে শুরু করেছেন যে আমার রাজ্যের ক্ষেত্রেও এবার মোদিজি যে নেতৃত্বেকে choose করে বসাবেন, তিনিই রাজ্যটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবেন আর মানুষের এই আস্থা মোদিজি দেশের মুখিয়া হিসেবে তাঁর মন্ত্রীসভার performance এর ভিত্তিতেই অর্জন করেছেন। ভারতীয় মতদাতার বোধবুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও স্বাভিমানকে কখনো ছোট করে দেখবেন না। এদেশের গণতন্ত্র অত ঠুনকো নয়। 

নোট: আমার ভরসার দায়রা থেকে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা বাদ। এই দুটি প্রদেশের মানসিকতা আমি সত্যিই বুঝি না।

Wednesday, December 6, 2023

৬ই ডিসেম্বর

আমরা এমনই - খুবই গোঁয়ার। গোঁড়া নই কিন্তু, গোঁয়ার, অর্থাৎ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আপনি ১৭ বার সোমনাথের মন্দির ভাঙ্গুন, আমরা ১৭ বারই নতুন করে তৈরি করবো। আমরা তো আর রোমান না, আমরা হিন্দু। তাই আমাদের মন্দির আমরা reclaim করি, ওখানে আবার নতুন করে মূর্তি স্থাপনা করি, এপেলো বা ভেনাস বা মিনার্ভাদের পূজা করা ছেড়ে দিয়ে তাঁদের মিউজিয়ামে showpiece করে দাঁড় করিয়ে রাখি না। 

হিন্দু আর জাপানি শিন্তোরাই বোধহয় বিশ্বের দুটি মাত্র জীবন্ত মূর্তিউপাসক প্রাচীন সভ্যতা এবং সে জন্য আমরা ভীষণ গর্বিত। আমরা হিন্দুরা বিশ্বাস করি নুড়ি পাথর কাঠ কাটালি গাছ পালা ইঁদুর বাঁদর সব সেই একই ঈশ্বরের প্রতিরূপ, তাই তাঁরা সবাই শ্রদ্ধেয়, পূজ্য। আপনার সেই বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গি নেই, সেটা আপনার সমস্যা, আমাদের নয়। 

আবার বলছি, অজস্র বিধ্বংসী আক্রমণের পরও আমরা যে এত হাজার হাজার বছর ধরে বহাল তবিয়তে টিকে আছি, তার কারণ জাতি হিসেবে আমরা ভয়ানক গোঁয়ার। আপনি আমার সঙ্গে যত ইচ্ছে তর্ক করুন আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, কিন্তু যেই জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন সেটা আমি কিছুতেই মানবো না। আমি নিজে সেই বেড়া ভেঙে না ফেলতে পারলে আমার সন্তান সন্ততি কেউ না কেউ তা ভাঙবেই - সে আজ হোক বা পাঁচশ বছর পর - ভাঙবেই ভাঙবে।

এইভাবেই এমনই এক দিনে শ্রীরামজন্মভূমিকে ধ্বংস করে যে ধাঁচা মঙ্গোলরা গড়েছিল, তাকে করসেবকরা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন। সেই শৌর্যদিবসের পূণ্যদিনে মোঘলদের সঠিক নামে ডাকা শুরু হোক - মঙ্গোল। এই দানব আক্রমণকারীগুলো এসেছিল তুর্কমেনিস্থান-মঙ্গোলিয়া থেকে, ঠিক যেমন ইংরেজরা এসেছিল ইংল্যান্ড থেকে। দুটোই বিদেশি শক্তি, দুজনেরই উদ্দেশ্য এক ছিল - আমাদের গোলাম বানিয়ে আমাদের সম্পদ লুটে নেওয়া। খাঁড়ার ওপর বিষফোঁড়া, ওরা কেবল লুটেই সন্তুষ্ট ছিল না, আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নষ্ট করার খেলাতেও মেতে উঠেছিল। 

এই দস্যু মঙ্গোলগুলো আমাদের হাজার হাজার মন্দির ভেঙেছে, ভারতীয়দের জোর করে বা লোভ দেখিয়ে পন্থ পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে, এত অত্যাচার করেছে যে সারা উত্তরভারত জুড়ে মানুষ বাড়িতে ঠাকুরঘর তৈরি করে মন্দিরকে replace করতে বাধ্য হয়েছে, পূর্বভারতে দিনের আলোয় মেয়ের বিয়ে দেওয়াই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। 

যে সংস্কৃতিতে কন্যার সয়ম্বর হতো, সেই সমাজকে শিশুঅবস্থায় কন্যাকে গৌরীদান করতে এই লুটেররাই বাধ্য করেছে। ইংরেজও কিছু কম অত্যাচার করেনি, পাদ্রীদের মাধ্যমে ইংরিজি আর ভুলভাল ইতিহাস শিখিয়ে আর conversion করে করে আমাদের সমাজের ভিতকে নাড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। আমাদের নিজস্বতা claim back করার সময় এসে গেছে। যে যা, তাকে সেই নামে ডাকা দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হোক। আর তার জন্য আজকের চেয়ে শুভ দিন আর কি হতে পারে?

Monday, December 4, 2023

বিজেপিকেই চাই

ইদানিং ভারত যে দ্রুতগতিতে আবার এক উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার রাস্তায় এগিয়ে চলেছে, তার কারণ কি? কেউ হয়তো বলবেন মোদি কিন্তু আরো একটু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এটা আবহমান কাল ধরে চলে আসা হিন্দুর আত্মপরিচয়কে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, জনসঙ্ঘ এবং পরে বিজেপি মিলে পুনরুদ্ধার করে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করানোর ফল। 

এর মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকের বদবুদ্ধির ফসল caste census-এর মাধ্যমে ভারতীয়দের ওপর চাপিয়ে দেওয়া জাতপাতের বিভাজনকে হাতিয়ার করে একটা অতি উন্নত সভ্য জাতিকে দাবিয়ে রাখার যে ষড়যন্ত্র এখনো অবধি চলে আসছে, তার মূলে আঘাত করা হয়েছে। গত দশ বছরে বিজেপি পূর্ণ বহুমতের সরকার গড়তে সক্ষম হওয়ার ফলে এখন জাতপাত, প্রাদেশিক পরিচয় ইত্যাদির ওপরে উঠে অন্তত উত্তরভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে 'আমি হিন্দু' - এই ধারণাটি বেশ জেঁকে বসেছে, যা সমাজের একসাথে একইদিকে এগোনোর জন্য দারুন সহায়ক হচ্ছে, ফলে উন্নতিও দ্রুততর হচ্ছে। 

দেশে বিজেপির শাসন যত বেশিদিন বলবৎ থাকবে, একটা overall হিন্দুত্বের আবহ থাকার ফলে তত বেশি দিন বাকি হিন্দু সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনগুলিও তৃণমূলস্তরে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করতে পারবে এবং এই cultural integration আর common identity-র বন্ধন, যাকে 'সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদ' বলা হয়, তা ধীরে ধীরে প্ৰথমে দ্রাবিড় রাজনীতির ভুয়ো বিভাজনের শিকার দক্ষিণ ভারতে এবং পরে সংখ্যালঘুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। 

নিদেনপক্ষে আরো কুড়ি বছর ভারতে বিজেপির একচ্ছত্র শাসন চাই, তারপরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। তিনশ বছরের অপশাসন, অবনমন, অতিক্রমণ এবং বিভাজনের প্রক্রিয়াকে reverse করতে অন্তত ত্রিশ বছর তো চাই, নাকি? দিশা যেহেতু স্পষ্ট আর একত্রিত হওয়ার ফলও যেখানে হাতে হাতে পাওয়া যাচ্ছে, বহু মানুষ এবার আসল আর নকলের ফারাক বুঝতে পারছেন। এই 'বহু'টা একদিন 'সবাই' হবে। যেদিন হবে সেদিন ভারতবর্ষ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।

Friday, December 1, 2023

ভিক্ষা নৈব নৈব চ

যদি গৃহস্থ হন তাহলে কোনো তীর্থক্ষেত্রে কখনো কারো দান নেবেন না। ধরুন বৃন্দাবনে পরিক্রমা করছেন, দেখলেন হয়তো কেউ হালুয়া বিলোচ্ছেন, নমস্কার করে এগিয়ে যাবেন, মোটেও হাত পাতবেন না। একইভাবে, কোনো মঠে, মন্দিরে, মিশনে বিনা দান দিয়ে কখনো প্রসাদ গ্রহণ করবেন না বা থাকবেন না। অন্নসত্ৰ সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের জন্য, আমাদের জন্য নয়। গৃহস্থ ভিক্ষান্নের অধিকারী নন, ওই ব্যবস্থা কেবলমাত্র সন্ন্যাসীর জন্য, যা সমাজের ধর্মীয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাই সন্ন্যাসীকে খালি হাতে প্রণাম করতে নেই, সামর্থ অনুযায়ী কিছু না কিছু দিতে হয়। আর গৃহস্থ যদি অন্যের দান নিয়ে তীর্থযাত্রা করেন তাহলে তার পূণ্যফল সেই দানীর হয়, গৃহস্থের নয়। সন্ন্যাসীর সাথে আমরা গৃহস্থরা যেন কখনো নিজেদের গুলিয়ে না ফেলি। বেদে চারটি অত্যন্ত মূল্যবান মন্ত্র আছে, যা যে কোনো গৃহস্থের পক্ষে জীবনযাপনের মানক:

১. বিষয়মুখত্যাগং বা সমাজং প্রতি যৎ কর্তব্যম্ । 
তৎ ত্যাগং নৈব ত্যাগমীশ্বর প্রােণিতম্ 
কামপাশ - বিমােচনবিতি ত্যাগমীশ্বরসম্মতম । 
অর্থাৎ, দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করা ও সামাজিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি ঈশ্বরের অভিপ্রেত নয়। তিনি শুধু চান যে জীব বাসনা-কামনার পাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করুক।

২. প্রাণরক্ষার্থমাবশ্যকীয় দ্রব্যজাতস্য ভােগং ন তু পাপম্ । 
শরীরং স্বাস্থ্যরক্ষণং সবৈদ কর্তব্যং ধর্মসাধনার্থম্ । 
তেন বৈ বৰ্ততে প্রােজ্জ্বলঃ প্রজাপ্রদীপঃ সাধ্যতে চাধকৃৎ প্রতিরােধম্ । 
অর্থাৎ, জীবনের প্রয়ােজনসমূহ সাধন করা পাপ নয়, শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা কর্তব্য, নচেৎ জ্ঞানের প্রদীপ প্রজ্বলিত রাখা সম্ভব নয়, দুবৃর্তকে প্রতিহত করাও সম্ভব হয় না। 

৩. কামী ইন্দ্রিয়দাসােআস্তি কামভােগলালসা নীচত্বং নয়তি 
নিষ্ঠ জগতি পদ্মপত্রমিবাংভসা । এতদ্বৈ ঈশ্বরানুশাসনম্ । 
অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়াসক্ত ব্যক্তিরা প্রবৃত্তির দাস। ইন্দ্রিয় সুখের সন্ধান মানুষকে হীন করে। ঈশ্বরের বিধান মানুষকে পদ্মের পাপড়ির মতাে হতে হবে, জলের দ্বারা পরিবৃত হয়েও যে সিক্ত হয় না। 

৪. আস্তে ভগ আসীনস্য - চরৈবেতি চরৈবেতি 
চরণ্ বৈ মধু বিন্দতি চরন্ স্বাদু উদুম্বরম্ । 
পশ্য সূর্যস্য শ্ৰেমাণং যাে ন তন্দ্রয়তে চরণ্  
চরৈবেতি চরৈবেতি চরৈবেতি । 
অর্থাৎ, অকর্মন্য ব্যক্তির জন্য ঈশ্বর কপালে দুঃখ লিখে দেন। সুতরাং অক্লান্ত কর্মে ব্যাপৃত হও। অরণ্যে রােদন করলে মধু পাওয়া যায়। মধু আহরণের জন্য পরিশ্রম করতে হয়। দেখ সূর্য সারাক্ষণ এগিয়ে যাওয়ার ব্রত নিয়েছেন, কখনাে আলস্য করেন না, তাই সূর্য চিরযৌবনময়। ঈশ্বরে ভরসা রেখে কর্মকান্ডে এগিয়ে চলো, তাতেই সৌভাগ্যের দ্বার খুলবে।