অর্পণ আর সমর্পণ শব্দদুটির মধ্যে একটাই নির্ণায়ক পার্থক্য বা defining difference - স উপসর্গটির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি। যদিও 'স' মানে 'সঙ্গে' যেমন সজোরে মানে জোরের সঙ্গে, কিন্তু এক্ষেত্রে উপসর্গটির ব্যবহার স্বয়ং অর্থে স্ব-এর মতন - অর্পণ মানে দেওয়া আর সমর্পণ মানে নিজেকে দেওয়া। কিভাবে সমর্পণ করা যায়? প্রথমে এই ধারণা বদ্ধমূল হওয়া দরকার যে আমি মালিক নই, 'পরের জায়গা পরের জমিন, ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো সেই ঘরের মালিক নই'। মহাভারতের শান্তিপর্বে ভীষ্ম একজায়গায় যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়ে বলছেন,
"যচ্চ কামসুখং লোকে যচ্চ দিব্যং মহত্সুখম্৷
তৃষ্ণাক্ষয়সুখস্যৈতে নার্হতঃ ষোড়শীং কলাম্৷৷" অর্থাৎ, লৌকিক বাসনাপূর্তি বা অভ্যন্তর-শৌচ জনিত যে সুখ তা তৃষ্ণা ক্ষয় হওয়ার যে সুখ, সেই সুখের তুলনায় ষোল ভাগের এক ভাগও নয়। এখানে তৃষ্ণা মানে ভোগ-তৃষ্ণা। যতক্ষণ 'আমি' ভাব আছে ততক্ষণই ভোগের ইচ্ছা, যেই নিজেকে গুরু বা ইষ্টের হাতে অর্পণ করে দেওয়া গেল, অমনি 'আমি রথ, তুমি রথী, যেমন চালাও তেমনি চলি' হয়ে গেল, তখন 'তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে'।
এ কথা মুখে বলা যত সোজা, কাজে করে দেখানো ততটাই কঠিন কারণ মাঝখানে একটি দেহের সাথে সম্পৃক্ত পরিচয়সূচক 'আমি' সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে যে, যাকে অস্বীকার করা একটা দুরূহ ব্যাপার। অথচ না করলেও নয় কারণ ঠাকুরের পার্ষদ শ্রীশ্রীবাবুরাম মহারাজ একজায়গায় ভক্তদের বলছেন, "অহংকারের লেশমাত্র থাকলে বকলমা দেওয়া যায় না। ঠাকুর বলতেন এতে ঝরে এঁটো পাতার মতো থাকতে হয়। যেমন বিড়ালী তার ছা কে কখনো বড়লোকের বিছানায়, আবার কখনো বা ছাইয়ের গাদায় শুইয়ে রাখে। সুখে-দুঃখে যিনি বিচলিত না হয়ে তাঁতে মনোনিবেশ করে রাখতে পারেন, যিনি নিষ্ঠুর কর্তব্যের মধ্যেও বলতে পারেন 'ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি', তিনিই প্রকৃত বকলমা দিয়েছেন।" (কথাপ্রসঙ্গে স্বামী প্রেমানন্দ, পৃ ১২৯)
এখন, দেহ থাকলে দেহবোধ থাকাটাই তো স্বাভাবিক। দেহবোধ থাকবে অথচ দেহযুক্ত আমি-বোধ থাকবে না, এ বড় গোলমেলে ব্যাপার - a very evolved State - ও বেশিরভাগেরই কম্ম নয়। ওদিকে, বকলমা দিতে গেলে তো সেই 'আমি'কেই অর্পণ করতে হবে। 'আমি'র পারে যাওয়ার একটা পথ, বস্তুত জ্ঞানের পথ, মহামন্ডলেশ্বর স্বামী স্বরূপানন্দজি মহারাজ একজায়গায় দেখিয়েছেন,
'দেহ না থাকিলে তুমি আত্মার পরিচয় পাইতে না। দেহ আছে বলিয়াই তুমি অনুভব করিতে পারিতেছ যে, এই দেহের ভিতরে "তুমি" আছ।
সেই "তুমি" দেখিতে কেমন, তাহা তুমি এখনও জান না।
কিন্তু তুমি অনুমান করিতে সমর্থ হইতেছ যে, এই দেহকে যেমন সহজে দেখিতে পাওয়া যায়, দেহের ভিতরে "তুমি" নামে পরিচিত যিনি আছেন, তাঁহাকে তেমন সহজে দেখা যায় না, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেহ সসীম কিন্তু সেই "তুমি" অসীম।
"তুমি" অসীম বলিয়াই তোমার শ্লাঘা, সম্মান, মর্য্যাদা এবং আত্মপ্রসাদ অসীম হইবে।
তুমি তোমার জীবনের প্রতিটি পাদ-সঞ্চালনে, তোমার এই অসীমত্বের ধারণাটীকে সঙ্গে লইয়া চলিও।'
(প্রবুদ্ধ যৌবন, শ্রীশ্রীস্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব)
কিন্তু এর আরো একটা পথ আছে, যা অপেক্ষাকৃত সহজ, যা ভক্তির পথ এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকেই যার নির্যাস গ্রহণ করা যায় - মায়ের ওপর শিশুসন্তানের সম্পুর্ন নির্ভরতার পথ। বাবুরাম মহারাজ বলছেন, "মার কাছে ঠাকুর বকলমা দিয়ে দেহ ধারণ করেছিলেন" - কত বড় কথা! সমর্পণের এই পথ জ্ঞানের নয়, স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস আর অধিকারবোধের পথ। গর্ভধারিণী মা আর জগজ্জননী মায়ের মধ্যে মাতৃত্বের বহমান ধারাটি তো একই, তাই এতে একদিকে যেমন মায়ের আপত্যস্নেহ যা উঁচ-নিচ বিচার করে না, অন্যদিকে সন্তানের সম্পুর্ন নির্ভরতা - আমার অসুবিধে হলেই আমি ট্যাঁ করে কেঁদে উঠবো আর মা ছুটে এসে আমার দুঃখমোচন করবেন। এছাড়া মা আমাকে যখন যেভাবে মোড়ামুড়ি দিয়ে যেখানেই শুইয়ে রাখবেন, আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ওখানেই সম্পূর্ন সুরক্ষিত অবস্থায় শুয়ে থাকবো।
কোনো বড় কাজ করার আগে মাকে একবার জানিয়ে রাখা, কোথাও বেরোনোর আগে মাকে বলে বেরোনো, কোনো অসুবিধে হলে মাকে স্মরণ করা, সারাদিনের শেষে মাকে একবার দিনলিপি জানিয়ে দেওয়া - এগুলো করতে তো কোনো অসুবিধা নেই, এতে নির্ভরতা বাড়ে। ওই যে মাকে "মা আসছি" বলে বেরোলাম, জানি পেছন থেকে মা "দুর্গা দুর্গা" বলছেন, আমি সুরক্ষিত। হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবো, মাকে আগে তার details জানিয়ে, pros and cons সব বলে অনুমতি চাইলাম - যদি দেখি নিজের মনের মধ্যে কোনো দ্বিধা উৎপন্ন হলো না, জানলাম মায়ের এতে সম্মতি আছে। যখন দিনের শেষে সারাদিনের কাজের ফিরিস্তি দিচ্ছি, তখন সব কাজ ধর্মত ঠিক ঠিক হয়েছে কিনা তার হিসেবও তো সাথে সাথে হয়ে যাচ্ছে - কোনো ভুল করে থাকলে তা সুধরোবার উপায়ও মায়ের ইচ্ছায় মনের মধ্যেই ভেসে উঠবে, ইত্যাদি।
মায়ের ওপর আমাদের নির্ভরতা কেমন হবে, বাঁদরের বাচ্চার মতন হবে যে মাকে নিজের চার হাত-পা দিয়ে সর্বক্ষণ আঁকড়ে ধরে থাকে নাকি বেড়ালের বাচ্চার মতন হবে যাকে ঘেঁটি ধরে মা যেখানে নিয়ে গিয়ে রাখে, সে সেখানেই পড়ে থাকে, তা আমাদের নিজেদের স্বভাবের ওপর নির্ভর করছে। ওই যে বাবুরাম মহারাজ পাণ্ডবগীতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন না, "ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি", রবীন্দ্রনাথ তার ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে:
'এ শ্লোকের মানে এমন নয় যে, আমি ধর্মেই থাকি আর অধর্মেই থাকি তুমি আমাকে যেমন চালাচ্ছ আমি তেমনি চলছি। এর ভাব এই যে, আমার প্রবৃত্তির উপরেই যদি আমি ভার দিই তবে সে আমাকে ধর্মের দিকে নিয়ে যায় না, অধর্ম থেকে নিরস্ত করে না ; তাই হে প্রভু, স্থির করেছি তোমাকেই আমি হৃদয়ে রাখব এবং তুমি আমাকে যেদিকে চালাবে সেই দিকে চলব। স্বার্থ আমাকে যেদিকে চালাতে চায় সেদিকে চলব না, অহংকার আমাকে যে পথ থেকে নিবৃত্ত করতে চায় আমি সে পথ থেকে নিবৃত্ত হব না। অতএব তাঁকে হৃদয়ের মধ্যে স্থাপিত করে তাঁর হাতে নিজের ভার সমর্পণ করা, প্রত্যহ আমাদের ইচ্ছাশক্তির এই একটিমাত্র সাধনা হোক।'
No comments:
Post a Comment