শ্রীহনুমানচল্লিশা এক চমৎকারী স্তবমালা, সেটা যাঁরা মানেন তাঁরা জানেন। নানান পন্ডিত ব্যক্তি নানান দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর নানা রকমের ব্যাখ্যা করেছেন, ব্যক্তিগতভাবে তুলসীপিঠাধীশ্বর স্বামী রাম্ভদ্রাচার্য্যজী মহারাজের টিকা এবং চল্লিশার সংস্কারিত সংস্করণ আমার সবচেয়ে ভালো লাগে, যার মানে মোটেও এই নয় যে অন্যগুলি খারাপ। যাইহোক, যাঁরা শ্রীহনুমানচল্লিশা পাঠ করেন তাঁরা জানেন যে মঙ্গলাচারণের পরে এবং মূল স্তব শুরু করার আগে ভক্তশিরোমণি শ্রীতুলসীদাস গোস্বামীজী তাঁর শ্রীগুরুর চরণবন্দনা করে একটি প্রতিজ্ঞাবাক্য লিখেছিলেন,
শ্রীগুরু-চরণ-সরোজ-রজ নিজ-মন-মুকুর সুধাহি
বরণওঁ রঘুবর-বিমল-যশ যো দায়ক ফল চারি ।।
[শ্রীগুরুদেবের চরণকমলের পরাগরূপ ধূলি দিয়ে নিজের মনরূপ দর্পণকে পরিষ্কার করে (তাতে ফুটে ওঠা) রঘুকূলশ্রেষ্ঠ শ্রীরামচন্দ্রের উজ্জ্বল যশের বর্ণনা করছি, যা চারটি ফলই (ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) প্রদান করবে।]
স্বামীজী এই 'শ্রীগুরু' শব্দটির দুর্দান্ত ব্যাখ্যা করেছেন। ওনার কথাগুলোই আমি মূল হিন্দি থেকে নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী যথাসম্ভব বাংলায় ভাবানুবাদ করার চেষ্টা করছি। উনি লিখছেন যে গোস্বামীজী প্রতিজ্ঞাবাক্যে প্রথমেই 'শ্রী' শব্দটি আদিশক্তি শ্রীসীতাজীকে স্মরণ করে ব্যবহার করেছেন কারণ সীতাজী হলেন ব্রহ্মময়ী মহাশক্তি, স্বয়ং ব্রহ্মরূপী শ্রীরামচন্দ্রের বাম দিকে অবস্থান করে জীবের ভগবৎপ্রতিকূলতাকে নিরস্ত করেন। 'শ্রীগুরু' শব্দটির দুরকমের সমাস হয়:
১. মধ্যমপদলোপী তৃতীয়াততৎপুরুষ সমাস - শ্রীয়া অনুগৃহীতৌ গুরুঃ ইতি শ্রীগুরুঃ, অর্থাৎ শ্রীজীর (মহাশক্তির) অনুগ্রহপ্রাপ্ত গুরুদেব হলেন শ্রীগুরু। এর কারণ এই যে শক্তির কৃপা বিনা অবিদ্যার দোষ খন্ডন করা যায় না, ফলে যিনি সদগুরু, অর্থাৎ যাঁর অজ্ঞানতা দূর হয়েছে, তাঁর মধ্যে মহাশক্তির কৃপা প্রকাশিত।
২. কর্মধারায় সমাস - শ্রীরেব গুরুঃ ইতি শ্রীগুরুঃ, অর্থাৎ শ্রীসীতাই হলেন গুরু। লক্ষণীয় যে শ্রীসম্প্রদায়ের জগৎবিখ্যাত সব আচার্য্যরা, যেমন শ্রীরামানুজাচার্য্যজী বা শ্রীরামানন্দাচার্য্যজীরা, শ্রীজীকেই পরমগুরু বলে স্বীকার করেছেন। এঁরা সীতাজীইকেই শ্রীহনুমানজীর আধ্যাত্মিক আচার্য্য মানেন, যে হনুমানজী কিনা আবার দেবগুরু বৃহস্পতিরও গুরু। তাই শ্রীহনুমানচল্লিশা যে শ্রীহনুমানজীর গুরুকে স্মরণ করে শুরু করা হয়েছে, এতে আশ্চর্যের তো কিছু নেই।
আমরা গুরুপ্রণাম করতে গিয়ে বলি না, 'গুরুরেব পরং ব্রহ্ম', শ্রীরামকৃষ্ণদেব সেই তত্বটিই সহজ করে বুঝিয়ে বলেছেন, "ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে, শক্তিকে ছেড়ে ব্রহ্মকে ভাবা যায় না।…আদ্যাশক্তি লীলাময়ী, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, বহ্মই কালী। একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয় সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কোনও কাজ করছেন না– এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ।" শ্রীরামচন্দ্র আর শ্রীসীতামাতা একই, ঠিক যেমন পরবর্তী অবতারে শ্রীরামকৃষ্ণ আর শ্রীশ্রীমা এক এবং অভিন্ন। ঠাকুর নিজেই তো বলেছেন, "ও কি যে সে! ও আমার শক্তি!" তাইতো ঠাকুর ভাবস্থ অবস্থায় দক্ষিনেশ্বরের গঙ্গাতীরে দেখা শ্রীশ্রীসীতামায়ের হাতে পরা ছিলেকাটা বালা দেখে ওইরকমই বালাজোড়া শ্রীশ্রীমায়ের জন্যেও গড়িয়ে দিয়েছিলেন। জয় শ্রীগুরুমহারাজজী কি জয় ! জয় মহামায়ী কি জয় !
No comments:
Post a Comment