শ্রীরামচরিতমানসটি আবার পড়তে পড়তে কৌতূহলবসত মাঝে মাঝে মূল বাল্মীকি রামায়ণটিও আবার উল্টেপাল্টে দেখছি আর অন্যান্যবার যে সমস্ত শ্লোক নজর এড়িয়ে গিয়েছিল, সেগুলি এবার চোখে পড়ছে আর তাতে বিস্ময়ের অন্ত নেই। শ্রীরামের প্রতি ছোটভাই লক্ষণের শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা, আনুগত্য ইত্যাদির বিষয়ে তো আমরা সকলেই জানি, কিন্তু শ্রীরাম যে লক্ষণের মধ্যে নিজের পিতা মহারাজ দশরথের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে মানসিকভাবে তাঁর ওপর কতটা নির্ভর করতেন, সেটা কি আমরা লক্ষ্য করেছি? দুটি শ্লোক উল্লেখ করছি, একটি শ্রীরামের নিজের মুখের কথা আর একটি মা জানকির।
অরণ্যকাণ্ডে একজায়গায় শ্রীরাম লক্ষণকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, "ভাবজ্ঞেন কৃতজ্ঞেন ধর্মজ্ঞেন চ লক্ষণ । ত্বয়া পুত্রেণ ধর্মাত্মা ন সংবৃতঃ পিতা মম ।।" অর্থাৎ হে লক্ষণ, তুমি ভাবজ্ঞ, কৃতজ্ঞ ও ধর্মজ্ঞ। আমাদের ধর্মাত্মা পিতার প্রতিমূর্তি হিসেবে তুমিই তাঁর স্থান গ্রহণ করেছ (অরণ্য ১৫/২৯)। লক্ষণ সম্পর্কে এই একই কথা আবার সুন্দরকাণ্ডে মা সীতাও হনুমানকে বলছেন "যং দৃষ্টা রাঘবো নৈব বৃত্তমার্যমনুস্মরেৎ" অর্থাৎ যাঁকে দেখলে রাম আর পিতার অনুপস্থিতি অনুভব করেন না (সুন্দর ৩৮/৬১)। বনবাসকালে লক্ষণ যে ধীরে ধীরে শ্রীরামের পিতার স্থান, যাকে ইংরেজিতে বলে strength and stay, অধিকার করে নিয়েছেন, এটা যেমন বিস্ময়কর তেমনিই মধুর। আসলে লক্ষণ যে শ্রীরামচন্দ্রের জীবনে কতখানি জুড়ে ছিলেন তা মা সীতার একটি কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, "মত্তঃ প্রিয়তরো নিত্যং ভ্রাতারামস্য লক্ষণঃ", আমার চেয়েও ভ্রাতা লক্ষণ রামের বেশি প্রিয় (সুন্দর ৩৮/৬০)।
আর একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না, যদিও এর context সম্পূর্ণ আলাদা। রাম লক্ষণ আর সীতা বনে চলে যাওয়ার পর শোকে অধীর হয়ে মহারানী কৌশল্যা মহারাজ দশরথকে বহু কটুবাক্য শোনানোর পর যখন realise করেছেন যে পুত্রশোকে বিহ্বল হয়ে নিজের ধর্মপরায়ণ স্বামীকে যা বলার নয় তাও বলে ফেলেছেন, তখন আক্ষেপ করে বলছেন, "শোকো নাশয়তে ধৈর্যং শোকো নাশয়তে শ্রুতম্ । শোকো নাশয়তে সর্বং শোকসমো রিপুঃ ।।" অর্থাৎ শোক ধৈর্য নাশ করে, শোক শিক্ষা নাশ করে, শোক সমস্ত গুনাগুন নাশ করে, শোকের সমান শত্রু নেই (অযোধ্যা ৬২/১৫)। পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম যে এইখানে শোকের জায়গায় হিংসে, অহংকার, রাগ, ঘৃণা, দ্বেষ, স্বার্থপরতা, যা ইচ্ছে দুর্গুণ লাগানো যেতে পারে - মানুষের পক্ষে তার ফল একই রকমের বিনাশকারী হবে।
No comments:
Post a Comment