Thursday, December 21, 2023

কৃপা অর্থাৎ সদবুদ্ধি

যুদ্ধকাণ্ডে বানরসেনার হাতে রাবণের গুপ্তচরেরা ধরা পড়ার পর যখন সুগ্রীব তাদের হত্যা করার জন্য উদ্যত হলেন, তখন আর উপায়ন্তর না দেখে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে তারা প্রাণভিক্ষা করাতে কৃপানিধান সুগ্রীবকে আটকে দিয়ে বলছেন,
"সকৃদেব প্রপন্নায় তবাস্মীতি চ যাচতে ।
অভয়ং সর্বভূতেভ্যো দদাম্যেতদ্ ব্রতং মম ।।" (১৮/৩৩)
অর্থাৎ, যে একবার আমার শরণাগতি যাচনা করবে, তাকে সর্বভূতে অভয় প্রদান করা আমার ব্রত। এখন, শরণাগত হওয়া কি আর ঈশ্বরের কৃপা ব্যতীত সম্ভব? 

এইখানেই প্রশ্ন ওঠে ঈশ্বরের কৃপা বলতে আমরা কি বুঝি? তিনি কি নিজে চেক কেটে আমাদের ল্যাম্বরগিনি হুরাকান কিনে দেবেন নাকি আমাদের নিজেদের ধনসম্পদ আর সন্তান-সন্ততিদের প্রচুর রোজগার এবং তাদের মনের সব জাগতিক বাসনা মেটানোর বন্দোবস্ত করে দেবেন? লোকে চায় বটে, কার কাছেই বা আর চাইবে, কিন্তু এই ক্ষুদ্রবুদ্ধি যতক্ষণ আছে ততক্ষণ বুঝতে হবে ঈশ্বরের কৃপা হয়নি। তাঁর কৃপা হওয়া মানে তিনি সর্বদা এমন সদবুদ্ধি যোগাবেন যাতে জীবনে যে যে সময়ে ধর্মত যা যা করণীয়, তাই তাই করার মতন মানসিক স্থিতি নিজে থেকেই সৃষ্টি হয়ে যাবে। 

আমরা গৃহস্থরা যখন যে আশ্রমে আছি তখন ধর্মত সেই আশ্রমের জন্য যা যা নির্ধারিত কর্তব্য তা যদি ঠিক ঠিক নির্বাহ করতে পারি, সেটাই ঈশ্বরের কৃপা। যেমন, ব্রহ্মচর্যাশ্রম হলো জ্ঞান আহরণের সময় এবং তার ভিত্তিতে নিজের জীবনের মানক নির্ধারণ করার সময়। ঠাকুর বলতেন 'একটা খুঁটি ধরে ঘুরলে আর পড়বি না'। তখন সেদিকে concentrate না করে যদি আমরা পলিটিক্স ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকি, বুঝতে হবে আমাদের ভেতরের অসুর তখনো জেগে আছে। 

তেমনিই, যখন গার্হস্থ্যাশ্রমের সময় তখন বাপ-মা, স্ত্রী-পরিবার, আশ্রিত-পরিজনদের ভরণপোষণ করা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য যা যা একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির করণীয় এবং তার জন্য সৎপথে যতটা আয়, ব্যয় এবং সঞ্চয় করা প্রয়োজন তা না করে যদি ক্লাব, পার্টি, শুঁড়িখানায় হৈহৈ করে বেড়াই, যদি গৃহীচিত ব্রহ্মচর্য্য রক্ষা করতে না পারি অর্থাৎ বহুগামী হৈ, বুঝতে হবে যে ঈশ্বরের কৃপা পাওয়ার আমরা তখনও যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি। 

তারপর বানপ্রস্থের সময় যদি আমরা বিষয়-সম্পত্তি যশ-প্রতিপত্তি আর কর্তৃত্বের অহঙ্কার ত্যাগ না করতে পারি, যদি ৮০ বছর বয়সেও গায়ে গাউন চাপিয়ে কোর্টে গিয়ে জেনেশুনে দোষীর পক্ষে সওয়াল করি, তখন বুঝতে হবে এই শরীরে এবারে হয়তো আর কৃপালাভ হবে না। বানপ্রস্থের পরেই সন্ন্যাস - মানসিকভাবে ওটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। গৃহীর সন্ন্যাসাশ্রম আর সন্ন্যাসীর সন্ন্যাসের nature কিন্তু আলাদা কিছু নয়, কেবল দুটির মাঝখানে অনেক অনেক জন্মের শুভকর্মফলজনিত প্রারব্ধ, জন্মাবধি ঈশ্বরকৃপা আর কয়েক দশকের সাধনার ব্যবধান থাকে। 

পূজ্যপাদ স্বামী ঈশ্বাত্মানন্দজী মহারাজ তাঁর প্রবচনে বলেন ঈশ্বর মানে প্রেম আর নিঃস্বার্থতা। তাহলে নিশ্চয় সন্ন্যাস মানে 'আমি'কে ত্যাগ করে নিঃস্বার্থ হয়ে সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে যাওয়া। এই প্রেম জাগতিক প্রেম নয়, আত্মপ্রেম। এই মানুষরূপী শরীরের উদ্দেশ্যই হলো নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করতে চেষ্টা করা। সন্ন্যাসীর যেহেতু কোনো পিছটান থাকে না, পুরো সময়টাই এতে ব্যয় করা যায়, সেটা একটা মস্ত বড় সুবিধা। তাঁর সব কাজই নিরাসক্ত সেবা আর গৃহীর অধিকাংশ কাজই বাসনাপূর্তির অঙ্গ। 

গৃহস্থের জীবনে এই শেষ আশ্রমের চেয়ে শুভসময় আর কিছু নেই, মুক্তকচ্ছ হয়ে ঈশ্বরের কৃপা অনুভব করার এটাই তো শ্রেষ্ঠ সময়। শরীর হয়তো ক্রমশ অশক্ত হতে থাকবে কিন্তু সেই শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও ঈশ্বরের এই বার্তাই তো আছে যে এখন যা করছো তার memory তুমি পরের শরীরেও carry forward করবে আর ওটাই তখন তোমার প্রারব্ধ হয়ে যাবে। এই করতে করতেই একদিন কোনো না কোনো এক শরীরে তুমি সুস্থাবস্থায় কমবয়সেই সন্ন্যাসী হয়ে এই নশ্বর সংসারের মায়াকে ত্যাগ করবে আর তারপর তো it is just a matter of time, তোমার আত্মজ্ঞান হবেই হবে। 

পরিবারের কাছে ছোটবেলা থেকে ঠিক ঠিক সংস্কার পেলে এ পথে এগোনো খানিকটা সহজ হয় কারণ দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ কজনই বা আর হন? যখন কোনো শিশুর সংস্কারিত পরিবারে জন্ম হয়, সেটাই তার ওপর ঈশ্বরের প্রথম কৃপার নিদর্শন। তারপরের দায়িত্ব তার বাপ-মায়ের, তার গুরুর আর সবচেয়ে বেশি তার নিজের। মনে রাখা প্রয়োজন যে বেশিরভাগ মানুষকেই কিন্তু কৃপা অর্জন করতে হয়, মাত্র কয়েকজন অতি ভাগ্যবানই তা অহেতুকি পান - যেমন দীক্ষান্তে শিষ্য শ্রী ক্ষীরোদ মুখোপাধ্যায়কে শ্রীশ্রীমা কৃপা করেছিলেন, "আজ থেকে তােমার ইহকাল ও পরকালের পাপ গেল।" বাপরে !!

No comments:

Post a Comment