কজ্জল কে ঘর মে যেতনা সিয়ানা রহে,
থোড়া বুঁদ লগে পর লগে, কাম জাগে পর জাগে।
সঙ্ঘগুরুরূপে যতদিন তিনি শরীরে ছিলেন ততদিন আমার পরমারাধ্য গুরুদেব আমার ইষ্টদেবের সচল বিগ্রহরূপেই পূজ্য ছিলেন, আর তাঁর মহাসমাধির পর ইষ্টপদে বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণে তাঁদের দুজনের সেই পার্থিব শারীরিক ব্যবধানটুকুও বহুদিন হলো মিটে গেছে। এখন যিনি আমার ইষ্ট তিনিই আমার গুরু, তিনিই সূক্ষ্মশরীরে ধ্যানগম্য হয়ে আমার হৃদয়ে প্রতিনিয়ত অবস্থান করছেন। আমি যখন প্রতিদিন 'জয় শ্রীগুরুমহারাজজি কি জয়' 'জয় মহামায়ী কি জয়' বলে জয়ঘোষ দিই, তখন গুরু আর ইষ্টকে এক এবং অভিন্ন জেনেই এই বাক্যগুলি বলি। এই জয়ঘোষ দেওয়ার সময় আমার বড় রোমাঞ্চ বোধ হয়, বড় ভালো লাগে।
তিনি কৃপা করে তাঁর শ্রীচরণে আশ্রয় দিয়েছিলেন বলেই না আজ তাঁকে নিজের ভেতর অনুভব করার চেষ্টা করতে পারছি, তা না হলে কোথায় তিনি এক সর্বজনপূজ্য সর্বত্যাগী ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ আর কোথায় আমি এক ঘোর সংসারী জীবনাশক্ত অর্বাচীন। তার ওপর, তাঁর শিক্ষা তো আর একমুখী কোনো বিশ্বাসতন্ত্রের নয়, ভারতের অন্তরাত্মায় নিহিত ঋষিদর্ষিত আত্মজ্ঞানের একটা গোটা আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার, যা ঠাকুরের হাত ধরে জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম আর রাজযোগের perfect synthesis বা পূর্ণাঙ্গ সংশ্লেষণরূপে এ যুগের উপযোগী হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আসলে বাবুরাম মহারাজের কথায়, ঠাকুর হলেন 'জীবন্ত উপনিষদ' - উনি একাধারে শ্রীকৃষ্ণের নিষ্কাম কর্ম, বুদ্ধদেবের ত্যাগ, আচার্য্য শঙ্করের জ্ঞান আর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমের ধারার সমাবেশক।
এই যে আমার গুরুবাড়ি, যে মঠে আমার গুরুদেব সশরীরে থাকতেন, তা তো আর কেবল ইঁট কাঠ পাথরের গোটাকতক বাড়িঘর বা মন্দির নয়, একটা অনবদ্য অপ্রতিম প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে মধ্যমনি হয়ে মূলমন্দিরে আমার ইষ্টদেব স্বয়ং বসে আছেন, এখানেই গঙ্গাতীরে সঙ্ঘজননী জগজ্জননী মহামায়ার পূতপবিত্র মহাশক্তিপীঠরূপী মাতৃমন্দির আছে, আর আছে ঠাকুরের দুই প্রধান লীলাসহচরের দুটি সমাধিমন্দির, ঠাকুরের অধিকাংশ পার্ষদদের দাহক্ষেত্রের ওপর নির্মিত স্মৃতিসৌধ, সঙ্ঘাধ্যক্ষ ও সন্ন্যাসীদের দাহক্ষেত্র, এবং বিভিন্ন অফিস, মঠ বাড়ি, মিউজিয়াম, ভোজনশালা, অতিথিশালা ইত্যাদি। এই মঠের প্রতিটি ইঞ্চি ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষদের সান্নিধ্যধন্য এক দৈব বিচরণক্ষেত্র। বহু বহু উচ্চকোটির সন্ন্যাসীদের aura বা সাধনালব্ধ অলৌকিক আভামন্ডলের ধারকও এই মহাপূণ্যভূমি। বাবুরাম মহারাজ বেলুড় মঠ সম্পর্কে বলতেন 'এ তো বৈকুণ্ঠ'।
কিন্তু এসবের বাইরে এই প্রতিষ্ঠানের যেটি মূল সম্পদ সেটি হলো সনাতন ধর্ম, দর্শন এবং আধ্যাত্ম সম্পর্কিত বিশুদ্ধ জ্ঞানের এক অফুরন্ত প্রবাহমান ধারা। ঠাকুর মা স্বামীজী এবং ঠাকুরের পার্ষদ ও শ্রীশ্রীমা ও স্বামীজীর শিষ্যদের সম্মিলিত বাণী ও রচনায় তো তা প্রতিফলিত বটেই, পরবর্তীকালে যাঁরা সঙ্ঘগুরু হয়েছেন এবং যে সব মহাজ্ঞানী সন্ন্যাসীরা ঠাকুরের প্রদর্শিত পথে ভারতীয় আধ্যাত্মিক ভাবধারার সর্বসমাবেশী রূপটি নিয়ে চিন্তন মনন ও গ্রন্থন করেছেন, তাঁদের সকলের সম্মিলিত প্রজ্ঞার প্রকাশিত রূপ এই প্রতিষ্ঠানের সাহিত্যভান্ডার। ফলে রামকৃষ্ণ মিশন সনাতনী ধর্মজীবন এবং সনাতন সংস্কৃতির এমন একটি অমূল্য repository, যেটি অনবদ্য, সহজলভ্য এবং যে কেউ চাইলেই এর মধ্যে ডুব দিতে পারেন।
দীক্ষান্তে গুরুদেব যখন প্রথম তাঁর দক্ষিণহস্তটি আশীর্বাদস্বরূপ আমার মাথার ওপর রেখেছিলেন, তখন আমার ১৪-১৫ বছর বয়স, সেই মুহূর্তে কোন দরজা যে আমার জন্য খুলে যাচ্ছে তা বোঝার মতন বুদ্ধিই আমার ছিল না। স্বামীজীর অন্যতম প্রিয় বই The imitation of Christ এ একজায়গায় লেখা আছে, 'What canst thou see abroad which thou seest not at home? Behold the heaven and the earth and the elements, for out of these are all things made.' আমার চোখে তখন পার্থিব পৃথিবীটাকে উল্টেপাল্টে দেখার স্বপ্ন, পঞ্চতত্বীয় দর্শনের গভীরতার আমি কি বুঝবো? গুরুদেবের প্রতি ভক্তিতে ওনার শঙ্করভাষ্যের ব্যাখ্যাসহ একটি 'ব্রহ্মসূত্র' কিনে এনেছিলাম এবং একবর্ন বুঝতে না পেরে ভক্তিভরে তুলে রেখে দিয়েছিলাম।
কিন্তু তাঁর কৃপা এমনই যে কৈশোর-আসন্ন যৌবনের অপুষ্ট মননকে উপেক্ষা করেই গুরুদেব সেদিন আমার হাতে একটা ঝাঁঝরি ধরিয়ে দিয়েছিলেন আর যে বীজ উনি কানের মধ্যে দিয়ে হৃদয়ে বপন করেছিলেন, আমার দায়িত্ব ছিল কেবল রোজ তার ওপর অল্প অল্প জল ঢালা, ওটুকুও আমি সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। এখন বুঝি কত অবুঝ ছিলাম। কিন্তু এমনই তাঁর অহেতুকি কৃপা যে আমায় কাজের কাজ কিছুই করতে হয়নি। বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম কখন হলো আমি জানিনা, তাতে কে বেড়া দিলেন আমি জানি না, ঝাঁজরির জল ফুরিয়ে যাওয়ার পরে তাতে নতুন করে জল কে ভরে দিলেন তাও আমি জানিনা, সে গাছ যে আমার অজ্ঞাতেই কবে বড় হয়ে আমারই মাথার ওপর ছাতা হয়ে দাঁড়ালো, তার কিছুই আমি জানিনা। 'আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল তিমিরনিবিড় রাতে।'
আমার গুরুদেব শ্রীশ্রীমায়ের আশ্রিত সন্তান ছিলেন, ফলে ছেলের মাধ্যমে জগজ্জননীর কোন আশীর্বাদ সেদিন এই অকিঞ্চনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল তার আমি কি জানি? আমি শুধু জানি যে যখন ঘুম ভাঙল তখন সেই গাছে ফুল ফুটেছে, আর বুকের মধ্যে কে যেন বলছে এবার কাজে লাগো মালি, একটু যত্নআত্তি করো, তবে না ফল ফলবে। স্বামীজীর সেই প্রিয় বইটির কথা যেন তাঁরই নির্দেশ হয়ে কানে বেজে উঠলো, 'Loose not, brother, thy loyal desire of progress to things spiritual. There is yet time, the hour is not passed. Why whilt thou put off thy resolution? Arise, begin this very moment, and say, "Now is the time to do: now is the time to fight, now is the proper time for amendment."
ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি গুরুকৃপা কোনো কথার কথা মাত্র নয়, ও সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করার চাবি। যত দিন যাচ্ছে তত বুঝতে পারছি গুরুর মাধ্যমে কিভাবে ইষ্ট কাজ করেন আর একবার তাঁর কৃপা হলে 'মুকং করতি বাচালং পঙ্গুং লংঘয়তে গিরিম্' - মুকও গড়গড় করে কথা বলে, পঙ্গুও পাহাড় ডিঙিয়ে যায়। খাওয়া ঘুম সব কমে গেছে, মনটা ধীরে ধীরে যেন কাদার মতন নরম হয়ে যাচ্ছে। বাইরের কুটিল জগতের সাথে লেনদেন, কোলাহল, বিষয়-আশয়, স্বার্থযুক্ত কাজ ইত্যাদিতে আর রুচি নেই, নেহাত সংসারের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষা করা গৃহস্থের কর্তব্য, তাই প্রয়োজনটুকুই কেবল সম্পন্ন করি। আমি যা শুনতে ভালোবাসি তার ধরণ বদলে গেছে, যা পড়তে ভালোবাসি, তার ধরণ পাল্টে গেছে আর যা দেখতে ভালোবাসি, তার ধরণও এখন ভিন্ন। আমি যে ক্রমশ বদলাচ্ছি, সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি।
পশু পাখি কীটপতঙ্গ সব যেন আপন বলে মনে হচ্ছে - কোন কুকুর বেড়াল কাঠবেড়ালি খেতে পেল না, কার চোট লাগলো, কে নির্দয়ভাবে গাছের ডাল কাটছে - ওদের যন্ত্রণা আমায় বড় পীড়া দেয়। আজকাল ফুল তুলতে দ্বিধা হয়, পোকাও মারতে পারিনা, বুকে বাজে। কাউকে অভুক্ত বা বিপদগ্রস্ত দেখলে চোখে জল আসে, মনে হয় কি করে একটু সেবা করতে পারি। আমি কি ছিলাম আর নিজেরই অজান্তে ইদানিং কি হয়েছি, ভাবলে নিজেই বড় বিস্মিত হই। মাঝেমাঝে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করে পরম কৃতজ্ঞচিত্তে দীনতার সাথে ঠাকুর আর মাকে কেবল এটুকুই বলি,
আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে।
তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর
তুমি তাই এসেছ নীচে।।
No comments:
Post a Comment