Friday, December 31, 2021

কল্পতরু উৎসব

তিনটি মাত্র শব্দ উচ্চারিত হলো, "তোমাদের চৈতন্য হোক", আর গোটা দুনিয়ার আত্মঅন্বেষী অনন্বেষী সকলের ভবিষ্যৎটি চিরকালের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেল, আধাত্ম পথে না এগোনোর উপায়ন্তরটিই আর রইলো না। আপাতদৃষ্টিতে এটি একজন কর্কট রোগাক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী কপর্দকশূন্য মানবদেহী গুরুর শেষ আশীর্বচন, কিন্তু সত্যিই কি তাই? যদি তাই হতো তাহলে আকন্ঠ জ্ঞানতৃষ্ণা নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের স্মৃতিবিজড়িত প্রতিটি স্থানে আজ লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামতো কি? কিসের আশায় তাঁরা কত দূর দূর থেকে কত কষ্ট করে দলে দলে আসেন, কেন বছরের পর বছর পয়লা জানুয়ারিতে কাশিপুরে, দক্ষিণেশ্বরে, বেলুড়ে, কামারপুকুরে, বলরাম বাটিতে, সারা বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মন্দিরে তাঁরা ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দেন - for nothing? এটি আসলে এক ঈশ্বরকল্প পুরুষের পরম আশ্বাসবচন, an ultimate declaration - 'কেন তুমি বোধ বুদ্ধি বিবেকযুক্ত মানবশরীর পেয়েছ, সেটা কোনো না কোনো জন্মে ঠিকই বুঝতে পারবে আর তারপর তোমার final destination-ও তুমি ঠিক খুঁজে পাবে, আমি আশীর্বাদ করছি'। 


তিনটি শব্দের প্রথম শব্দটি "তোমাদের"। লক্ষণীয় যে এটি বহুবচন এবং direct। যখন 'তোমাদের' বলছেন তখন কি কেবল সেদিন কাশিপুরের বাগানে ওঁর চোখের সামনে যাঁরা আছেন, তাঁদের কথা বলছেন? যিনি সারা পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে সনাতন ধর্মের পথ দেখাতে এসেছেন (যার নিদর্শন এখন আমরা সারা বিশ্ব জুড়ে নানা ভাষাভাষী, নানা বর্ণের, নানা পন্থের মানুষের তাঁর এবং বেদান্তের প্রতি যথাক্রমে অনুরাগ এবং অনুসন্ধিৎসা থেকে দেখতে পাই), তিনি কেবল গুটিকতক ভক্তকে address করবেন, এও কি সম্ভব? ভুলে গেলে চলবে না যে যে ঠাকুর একদিন সমাধিভঙ্গ হওয়ার পর বলেছিলেন যে তিনি দেখলেন অনেক দূরের দেশে কিছু সাদা সাদা মানুষ তাঁর ছবিকে পুজো করছে, সেই তিনি কি নিজেকে কেবল একটি বাগানেই আবদ্ধ রাখবেন? হয় কখনো? এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বিষয় হলো কাল অর্থাৎ সময়। শ্রীরামকৃষ্ণ দেশ কালের অতীত, তিনি ত্রিগুনাতীত, অনন্তের messenger, জগৎগুরু। তিনি সমস্ত মানুষকে আলো দেখাতে এসেছেন, ফলে তাঁর কথাগুলো কখনোই একটি বিশেষ কালখণ্ডে সীমিত নয়। তাই ওনার মুখে 'তোমাদের' শুধুমাত্র বর্তমানে restricted নয়, তা ভবিষ্যতের সমস্ত প্রজন্মকেও address করে। মোদ্দা কথা, এই 'তোমাদের' মানে সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এবং তাঁর সময়ের সমস্ত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বটে, যার মধ্যে আমি আপনি সবাই পড়ি।


দ্বিতীয় শব্দটি হলো "চৈতন্য"। এই শব্দটি বেশ মজার। সাধারণত এর তিন রকমের মানে হয়, ১ হুঁশ, সংজ্ঞা, বাহ্যজ্ঞান (আঘাত পেয়ে চৈতন্য হারাল); ২ বোধ, চেতনা, অনুভূতি (কবে আর তোমার চৈতন্য হবে?); ৩ টিকি। কিন্তু হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর iconic বঙ্গীয় শব্দকোষে চৈতন্যের অর্থ করেছেন, ১ চেতনভাব, চেতনা, জ্ঞান, বুদ্ধি; ২ (বেদান্তে) চিৎস্বরূপ পরমাত্মা; ৩ (ন্যায়ে) আত্মরূপ চেতনা; ৪ প্রকৃতি। এই প্রত্যেকটি মানে যদি আমরা contextually ভাবি, তাহলে ন্যায়শাস্ত্রের মানেটিই বোধহয় এখানে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী, 'চৈতন্য' অর্থাৎ সেই জ্ঞান বা 'আত্মরূপ চেতনা'র উন্মেষ ঘটায়, যাকে শঙ্কর বলেছিলেন 'আত্মবোধ'। কি সম্পর্কে চেতনা? না প্রত্যেক মানুষের অন্তরে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম বাস করেন এবং সেই বোধ জাগলে সে তার আত্মপরিচয় উপলব্ধি করে, যাকে বেদান্তশাস্ত্রে মহাবাক্য হিসেবে 'অহম ব্রহ্মাস্মি' (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌, যজুর্বেদ, ১.৪.১০) বা 'অয়ং আত্মা ব্রহ্ম' (মাণ্ডুক্য উপনিষদ্‌, অথর্ববেদ, ১।২), 'আমিই ব্রহ্ম' বলা হয়েছে।


এরপর আসি শেষ শব্দটিতে, "হোক"। 'হবে' নয় কিন্তু, 'হোক'। অর্থাৎ ভবিষ্যৎবাণী নয়, ইচ্ছার প্রকাশ বা আশীর্বাদ। উনি ওই জায়গায় একবার 'হবে' বললেই কেল্লাফতে হয়ে যেত। কাউকে আলাদা করে আর কোনো চেষ্টাই করতে হতো না, আত্মবোধ জাগরণের ভার উনি ওঁর নিজের ওপরই নিয়ে নিতেন, কিছু না করলেও সবাই তরে যেতো, তা সে জন্ম জন্ম ধরে যত খারাপ কর্মফলই জড়ো করে থাকুক না কেন - মুড়ি মিছড়ি সব একদর হয়ে যেত। তাই সেটা কিন্তু বললেন না, বললেন 'হোক' - মানে 'চেষ্টাটি তোমাকেই করতে হবে, কিন্তু করলে যে নিশ্চিত ফল পাবে, সেই আশীর্বাদ আমি তোমায় করলাম'। একটি কথা কম নয়, একটি কথাও বেশি নয়, - একেবারে precise, to the point, unambiguous, সোজাসাপ্টা। এবারে প্রশ্ন উঠতেই পারে, যদি আমি চেষ্টা না করি তাহলে কি আমার চৈতন্য হবেনা? এখানেই আসল catch। যেহেতু এটি একজন অবতার পুরুষের আশীর্বাদ, পুরুষ-প্রকৃতি যতই মায়ার খেলা খেলুন না কেন, কারো সাধ্য নেই যে তা বিফলে যায়। ফলে this is a statement of fact, not just of hope - আত্মোপলব্ধির চেষ্টা করিয়েই ছাড়বে। প্রারব্ধ আর কর্মফলের ওপর নির্ভর করে হয়তো কারো কয়েকটি বেশি জন্ম লাগবে, কারো হয়তো কিছু কম, কিন্তু প্রত্যেক মানুষের ভেতর একদিন না একদিন সেই পরমাত্মার আলোর উন্মেষ ঘটবেই, কল্পতরুরূপী গরিব বামুনের কথা কখনো মিথ্যা হতে পারেনা।

Thursday, December 30, 2021

মায়া ও মন

 মায়ার আক্ষরিক অর্থ বিভ্রম বা যাদু। ব্রহ্ম মায়া সৃষ্টি করেছেন নির্গুণ থেকে সগুন হয়ে সৃষ্টির মজা উপভোগ করার উদ্দেশ্যে। তারপর মায়া এই মহাজাগতিক বিভ্রম সৃষ্টি করেছেন - যেন বিশ্বব্রহ্মান্ড সব সত্যিকারের অর্থাৎ নিত্য, indestructible - তবে খেলুড়েরা কেউ এই মায়ার জগৎকে অনুধাবনই না করতে পারলে ব্রহ্মের আর মজা করা হলো কই? সেইসূত্রেই মানুষের মন তৈরি করেছেন তিনি। মন মায়ার এক অনন্য এবং অনবদ্য সৃষ্টি যা apparent বাস্তবের ভেতরেও আরো আরো apparent বাস্তব তৈরি করে একেবারে ভড়কে দিতে পারে - সেটা কখনো ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে, কখনো বা জাগ্রত অবস্থায় কল্পনায়।


মানুষের মনের কি অসীম ক্ষমতা ভাবুন, একবার ঘুমালেই হলো, চোখের নিমেষে একটা গোটা virtual world তৈরি করে ফেলে তাতে একেবারে বাস্তবের মতন সব অনুভূতি, সব অভিজ্ঞতাকে নিখুঁতভাবে recreate করে দেয় - এত যে মানুষের বোধ, বুদ্ধি, বিচার - সেইসময় সব ফেল! আবার এই মনই মনে মনে নানারকম তথ্য proccess করে প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনার চেতনায় plan A plan B plan C ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে আর বুদ্ধি আর বিবেকের সাথে মিটিং করে স্থির করে দেয় কোন পরিস্থিতিতে কখন ঠিক কোন কাজটা করণীয়। সামনে দেখছি কাঠের টেবিল, সেটা আলো হয়ে চোখ দিয়ে ঢুকে তড়িৎ তরঙ্গ হয়ে ব্রেনে গিয়ে টোকা মারছে আর তারপর সেই তথ্যকে process করে মন বলছে এর ওপর পা তুলে দিয়ে আরাম করে বোস আবার বুদ্ধি মনকে বলছে না, এর ওপর বই আছে, মা সরস্বতী, ওখানে পা দেওয়া উচিত নয় - তখন মন সেই উপদেশ মেনে নিয়ে নিজের আগের command withdraw করছে। 


শরীর কিন্তু তাই তাই করে চলেছে যা মন তাকে বলছে - একবার পা দুটি এগিয়ে দিয়েই মাঝপথে গুটিয়ে নিচ্ছে - কি মজা, তাই না? তাহলে মোদ্দা কথা কি দাঁড়ালো? আমাদের এই 'বাস্তব' দৈহিক অস্তিত্বের একটি মূল বিন্দু হলো শরীরের boss-রূপী মন। আর মনের boss বুদ্ধি, তার ওপর বুদ্ধির boss - 'আমি'। সত্যিকারের আমি। হয় মন বুদ্ধি - এরা আমায় control করবে অথবা আমি এদের control করবো - তার ওপরে নির্ভর করছে how I shall be able to utilise this human lifetime. কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সংসার চালানার জন্য domestic help এর ওপর নির্ভরশীল আর কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সত্যিকারের কর্তা - সংসার তাঁদের পরিচালনার ওপর নির্ভরশীল, including all subordinates. 


তাই এই 'আমি'টা যে ঠিক কে, সে কেমন, এটা define করা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। Clearly, 'আমি' কারো subservient নই নাহলে আমার শরীর, আমার মন, আমার বুদ্ধি ইত্যাদি বলা হতো না, উল্টে আমি তাদের, এমনটা বলা হতো। প্রতিদিন যেহেতু বাস্তবে দেখছি শরীর মনের instruction-এর ওপর নির্ভরশীল আর মন তার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বোধ বুদ্ধি বিবেক ইত্যাদির রায়ের ওপর নির্ভরশীল, আর ওগুলি আবার আমার ভাবের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু আমিই হলাম আসল প্রভু। তাহলে বুদ্ধি কেমনভাবে চলবে - না আমি যেভাবে চালাবো - কুবুদ্ধি হলে জগতের ক্ষতি হবে আর সুবুদ্ধি হলে উপকার হবে। জগৎ মানে কি, না বিভিন্ন আধারে মায়ার বিভিন্ন illusory প্রকাশ। যেমন বিভিন্ন পুকুর থেকে শুরু করে প্রতিটি নদী নালা খাল বিল ডোবায় প্রতিদিন সেই একই সূর্য্যের প্রতিবিম্ব দেখি, যেগুলোর যে কোনোটাতে জল শুকিয়ে গেলেই সূর্য্যদেব ভোজবাজির মতন সেটি থেকে গায়েব হয়ে যান।


এ কোন মায়া? যে মায়ার প্রভাবে আমি যেন আসল আমি নই - জীবরূপী। এই 'না-আমি'র এক নিজস্ব অহঙ্কার তৈরি হয় আর প্রভু হওয়া স্বত্তেও কখনো নিজেকে বুদ্ধি ভেবে ভ্রমিত হই, কখনো মন ভেবে, আবার কখনো বা শরীর। আমি তাহলে আসলে কি? আমি সেই অনন্ত অসীম অনাদি আনন্দময় অবর্ণনীয় সত্যস্বত্তা - purety personified - pure existence, pure consciousness, pure bliss - সৎ চিৎ আনন্দ - সচ্চিদানন্দ - ব্রহ্ম। এই পুরো মায়ার জগৎটাই যেহেতু আমার existential আনন্দ দিয়ে আমারই আনন্দবর্ধনের জন্য তৈরি, আমি যেহেতু আমারই প্রকাশের বুদ্ধিকে অহঙ্কার দিয়ে ভ্রমিত করে তার মনকে নিয়ে ছেলেখেলা করা দেখে আনন্দ পাই, আবার সেই মন যখন আমারই দ্বারা প্রেরিত অবতার এবং সদগুরুর tutorial-এ তালিম পেয়ে আমার লুকোচুরি খেলাটা ধরে ফেলে সমস্ত proccessed information বুদ্ধির সামনে তুলে ধরে তাকে চমকে দেয় আর বুদ্ধি দৌড়ে এসে আমাকে ছুঁয়ে বলে 'আব্বুলিশ', তখনও আমারই খেলা জেতার ultimate আনন্দ হয়। 


তাই প্রতিটি জীবের আনন্দময় কোষের ভেতর আমার বাস, তাদের সূক্ষ্ম শরীর আর কারণ শরীরের সমস্ত লম্ফঝম্ফের আমি দ্রষ্টা, অলক্ষ্যে থেকে identity গুলিয়ে দিয়ে মজা আমিই দেখি আর স্বরূপ ধরা পড়ে গেলে আমিই চরম উপভোগ করি। আমি তো ধরা দিতেই চাই - ওটাই তো খেলার ultimate objective, কিন্তু আত্মবোধের খেলাটা খেলতে চাইতে হবে তো! 


আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে

দেখতে আমি পাই নি,

তোমায় দেখতে আমি পাই নি।

বাহির-পানে চোখ মেলেছি,     

আমার হৃদয়-পানে চাই নি ॥

আমার সকল ভালোবাসায়    

সকল আঘাত সকল আশায়

তুমি ছিলে আমার কাছে, আমি তোমার কাছে যাই নি ॥

তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়--

আনন্দে তাই ভুলেছিলেম, কেটেছে দিন হেলায়।

গোপন রহি গভীর প্রাণে         

আমার দুঃখসুখের গানে সুর দিয়েছ তুমি, 

আমি তোমার গান তো গাই নি ॥