Friday, June 30, 2023

হিন্দুত্বেই আসল সাম্যবাদ

হিন্দুত্বের মধ্যে right wing conservatism বলে কিছু নেই। কেউ যদি সত্যিকারের হিন্দু হন, তিনি সারাক্ষনই evolve করবেন কারণ একমাত্র continuous evolutionই তাঁর এত হাজার হাজার বছর ধরে প্রাসঙ্গিক থাকার একমাত্র চাবিকাঠি। Conservatism মানে এমন একটা ধারণা যে xyz যা কিছুই তৈরি হয়েছে তা অসাধারণ, তাকে ঠিক সেই রূপেই সংরক্ষণ করতে হবে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এর থেকে ঠিক একইমাত্রায় সুখ বা শিক্ষা enjoy করতে পারে। 

এই যে ইউরোপের রাজারাজরাদের guardরা সব মান্ধাতার আমলের পোশাকআশাক পরে আজও কুচকাওয়াজ করে বেড়ান, এতে সে যুগের imperial power projectionকে আজকের গণতান্ত্রিক যুগেও সেসব দেশের লোকেদের মনে একটা ভ্রান্ত superiority complex তৈরি করতে ব্যবহার করা ছাড়া আর কি কাজে লাগে জানিনা। 

Right wing মানে সবকিছুই written in stone - সংগীত, নৃত্য সবকিছুই লিখিত, evolve করার কোনো স্থান নেই। ধরা যাক বিটোফেন - উনি ওনার সমস্ত সিম্ফনি যে ভাবে লিখে গেছেন আজকের যুগেও ঠিক সেভাবেই কমা ফুলস্টপসহ পড়ে পড়ে বাজানো হয়, হাজার বছর পরেও হবে। আর এখানেই হিন্দুত্বের মূল ধারার সাথে right wing conservatism এর মূল পার্থক্য। 

দরবারী কানারা তানসেনও গেয়েছেন, উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খানসাহেবও গেয়েছেন, আজকের যুগে উস্তাদ রশিদ খানও গান - কোনোটাই একরকমের নয়। রাগের structureটা এক কিন্তু কিভাবে সেটা বিস্তার করবেন, কতক্ষনের আলাপ, কখন তানকারি, কিভাবে শেষ করবেন সেটা সম্পূর্ণ শিল্পীর নিজস্ব স্বাধীন চিন্তা ও ঘরানার ফসল, কোনো ধরা বাঁধা কিছু নেই। 

ঠিক একই characteristic হিন্দুদের বিভিন্ন দর্শনের evolutionএর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য - কখনো একটা অন্যটার antithesis, কখনো বা নানা মতের synthesis, কখনো atheism, কখনো monotheism - ফলে সারাক্ষন সমাজজুড়ে সংবাদ ও মতের আদানপ্রদান চলতেই থাকে কিন্তু তা কখনোই বিবাদে পরিণত হয়না কারণ এই সংবাদের সাক্ষী হিসেবে হিন্দুর মনে একইসাথে বিভিন্ন viewpointএর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়, যা one God, one Book, one Prophetএর conservatismএর একেবারে বিপরীত। 

আমেরিকায় White conservative Christian জাতীয়তাবাদীরা সাধারণত Republican Partyর সদস্য হন কারণ তাঁদের মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা White supremacyর ভূত লুকিয়ে থাকে - আমরাই বন্য স্থানীয়দের মেরে ধরে তাড়িয়ে নিজেদের বুদ্ধির জোরে আমেরিকাকে আমেরিকা বানিয়েছি। আর উল্টোদিকে যাঁরা সাম্যে বিশ্বাসী, তাঁদের Democrat বলা হয় এবং যেহেতু তাঁরা conservative নন, ফলে আমেরিকার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের left wing বলা হয়ে থাকে। ইদানিং অবশ্য আমেরিকাতেও ঝোলাওয়ালারা ঢুকে পড়ে post truth এর আড়ে leftismকে ultra leftismএর দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। 

এখন মুস্কিল হলো, যেহেতু ওখানে White Christian জাতীয়তাবাদীরা অধিকাংশই  right wing conservative, তার সাথে তাল মিলিয়ে, হিন্দুত্বকে না জেনে না বুঝে, ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদেরও right wing বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, যা হিন্দুত্বের মূলধারার সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আসলে এ দেশে হিন্দুরাই সবচেয়ে বেশি উদার এবং constantly evolving আর যাঁরা তথাকথিত left wing, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি গোঁড়া, অপরিবর্তিনশীল এবং prejudiced কারণ ওই একই - one God - সর্বহারার একনায়কতন্ত্র, one book Das Capital আর one Prophet Karl Marx। 

ফলে, ভারতে সত্যিকারের conservative হলেন তথাকথিত বামপন্থীরা কারণ তাঁদের tunnel vision - একমুখী, একপেশে, এঁড়ে। আর সত্যিকারের left wing হলেন হিন্দুত্ববাদীরা, যাঁরা বহুমুখী, সমাবেশী, উদার - যাঁরা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চান, যাঁরা দিনে পাঁচবার তারস্বরে নিজেদের পন্থীয় বিশ্বাসের সরাসরি বিরোধিতা শুনেও এ কান দিয়ে ঢুকিয়ে ও কান দিয়ে বের করে দেন। স্বভাবতই ভারতীয় ভন্ড বামপন্থীরা যেহেতু হিন্দু সভ্যতার মূল সর্বসমাবেশী existential ethosএর বিরোধী কারণ 'নানা মুনির নানা মত' তাঁদের স্বপ্নের one party systemএর ধারণার পরিপন্থী, তাঁরা ভারতীয়দের ছোট ছোট ভাগে ভেঙে নিজেদের isolated circles of influence গড়ে তুলতে চান, এবং মনে করেন একদিন এই সমস্ত বিচ্ছিন্ন গ্রুপকে একত্রিত করে তাঁরা হিন্দু ভারতের অহিন্দু শাসক হয়ে উঠবেন। তাই কখনো দলিত, কখনো আদিবাসী, কখনো শ্রমিক, কখনো কৃষক, কখনো সমাজের পিছিয়ে পড়া কোনো section অথবা এমন কোনো গোষ্ঠী যাঁদের কোনো false sense of entitlement-জনিত ক্ষোভ বা খিদে আছে, তাঁদের মধ্যে এঁরা নিজেদের প্রভাব কায়েম করতে চেষ্টা করেন। 

এদেশের ভন্ড বামপন্থীরা সমাজকে ভাঙতে চান কারণ হিন্দুত্বের সর্বংসহা আপন-করে-নেওয়া বিপরীত আবহে ওটাই ওঁদের টিকে থাকার একমাত্র উপায়। এই প্রয়াস ব্রিটিশ আমল থেকেই করা হয়েছে, যখন থেকে caste based census থেকে নিয়ে seperate electorate অবধি নানা বিভাজনকারী tools সৃষ্টি করা হয়, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল দেশভাগ। ওই একই প্রয়াস ব্রিটিশদেরই তৈরি করা একটি রাজনৈতিক দলের হাত ধরে এখনো এ দেশে সংগঠিত হচ্ছে, যার মন্ত্রণা দিচ্ছেন এখনকার ঝোলাওয়ালারা। এই যে সেদিন বারাক ওবামা আবার নতুন করে ভারতভাগের সম্ভাবনার কথা বললেন, সেটা ওই একই ভারতীয় ভন্ড বামপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতার প্রতিফলন। 

ভারতে এই মুহূর্তে যে রাজনৈতিক লড়াইটা হচ্ছে সেটা আসল উদার সাম্যবাদী হিন্দুত্বের সাথে সংকীর্ণ ভন্ড বামপন্থার। অবশ্যই এই লড়াইয়ের মধ্যে দুদিকেই নাম ভাঁড়িয়ে সপরিবারে কিছু চোর ডাকাত বাটপারও ঢুকে পড়েছে যাদের যুযুধান দুপক্ষের মতাদর্শের সাথে কোনো লেনদেন নেই, তালেগোলের বাজারে যদি ফোকোটে কিছু কামিয়ে নেওয়া যায়, সেটাই একমাত্র ধান্দা। অন্যভাবে দেখতে গেলে লড়াইটা শাশ্বত ভারতের সাথে অসাম্যবাদীদের লড়াই, জাতীয়র সাথে বিজাতীয়র লড়াই, ধর্মের সাথে অধর্মের লড়াই। এ লড়াই হিন্দুদের কাছে নতুন নয়, কয়েক হাজার বছর ধরে এই একই লড়াই তাঁরা লড়ে চলছেন এবং এখনো অবধি বহুলাংশে সুরক্ষিত এবং অপরিবর্তিতই থেকেছেন। আসলে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির fundamentals এতটাই strong যে একে কমতর কোনো idea দিয়ে damage করা যায়না। আমাদের চেয়েও উন্নত কোনো idea যদি কেউ আনতে পারেন তখন না হয় ভেবে দেখা যেতে পারে কিন্তু ততক্ষন অবধি সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা প্রয়াস ঔর সবকা বিশ্বাসই চলবে। সর্বে ভবন্তু সুখীনঃ। সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ। সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ্ভবেৎ।।

Thursday, June 29, 2023

গো মাতা

রাস্তায় যখন কোনো অচেনা বৃদ্ধা মহিলাকে ডেকে কোনো কথা বলতে হয় আমরা তাঁকে কি বলে ডাকি? ট্যাঁশ হলে হয়তো 'ম্যাডাম শুনছেন' বলে ডাকেন, আমরা অধিকাংশই সাধারণত তাঁকে 'মা শুনছেন' বা 'জেঠিমা শুনছেন' বা 'মাসিমা শুনছেন' বলে ডেকে থাকি। কেন? তিনি কি সত্যি সত্যি আমাদের মা বা জেঠিমা বা মাসিমা? মোটেও তা নন। কিন্তু তাঁকে দেখলে ওই মাতৃস্থানীয়াদের কথা মনে আসে, তাই ওই শ্রদ্ধার সম্বোধন। মাতৃস্থানীয়া, কারণ মায়েদের যে বিশেষ গুণাবলী, সেটি তাঁর মধ্যেও বিদ্যমান - তিনিও কারো মা, কারো জেঠিমা বা কারো মাসিমা। ঠিক এই কারণেই আমরা যখন গাভীকে মা বলি, তাঁকে গোমাতা বলে গোপাষ্টমীর দিন পুজো করি, আমরা গাভীর মধ্যে গর্ভধারিণী মায়েরই প্রকৃতি খুঁজে পাই এবং তাকেই স্বীকৃতি দিই। এমন কত মানুষ মাই তো আছেন, হরমোনের বিকৃতির কারণে সন্তান ধারণের পরপরই যাঁদের বুকে যথেষ্ট বা একেবারেই দুধ আসেনা, শিশু অভুক্ত থাকে, ক্রমাগত কাঁদে। এখনকার কালে নাহয় বিকট দামি দামি সব ফর্মুলা ওয়ান ইত্যাদি বেরিয়েছে, আগেকার কালে গরুর দুধে পরিমান মতন জল মিশিয়ে পাতলা করে ঝিনুকে করে শিশুকে খাইয়েই তার প্রাণরক্ষা করা হতো, প্রসূতি মাও সেই গরুর দুধ খেয়েই স্বাস্থ্যোদ্ধার করতেন, গ্রামেগঞ্জে আজও হয়। আর আজও কিশোর-কিশোরী থেকে নিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ক্ষেত্রেও গরুর দুধই পুষ্টির অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে সমাদৃত, তা ছাড়া ঘি, মাখন, চিজ, দই, ছাঁচ ইত্যাদি তো আছেই। এখন, যাঁর দুধ খাই তাঁকে মাতৃবৎ মনে করব না তো কাকে মনে করব? রাস্তায় কোনো অচেনা বৃদ্ধাকে দেখলে মাতৃবৎ ছাড়া কি প্রিয়বান্ধবী বলে মনে হবে? ফলে আমাদের বৈদিক সংস্কৃতিতে মাতৃহত্যার মতোই গোহত্যাকেও মহাপাতকের কাজ বলে মনে করা হয় এবং তাতে আমাদের প্রাচীন সভ্যতার ধর্মবোধ এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হয়। এই ভাবনাটি অত্যন্ত progressive, অত্যন্ত liberal এবং অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। দুঃখের ব্যাপার হলো, অতি উন্নত ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হয়েও, বিজাতীয় ও বিধর্মী কুশিক্ষার প্রভাবে নিজেদের সংস্কৃতির মূল মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধাচরণ করাটা ইংরেজ আমল থেকেই কিছু অনুকরণপ্রিয় অতিবাদীদের কাছে হয়তো fashionable হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সেটা আদপেই কতটা regressive তা হয়তো তাঁদের জানা নেই। যেদিন এঁরা সূত্রটি বুঝতে পারবেন, সেদিন বীফভুনা বা বীফরোল খেতে গিয়ে এঁদেরও বমি উঠে আসবে। ততদিন নাহয় রোগ জর্জরিত বৃদ্ধা গোমাংস খেয়ে এই ভন্ডরা অন্যের খুশিতে শামিল হোন। আমরা কেবল এটুকুই প্রার্থনা করতে পারি যে অস্তিত্বের চরম সংকটের সম্মুখীন হওয়ার আগেই যেন এঁদের সদবুদ্ধির উদয় হয় কারণ ভারতীয় উপমহাদেশে গো হত্যা মূলতঃ ইচ্ছাকৃত এবং প্ররোচনামূলকভাবে কেবলমাত্র ভারতীয় সংস্কৃতি ও হিন্দু সভ্যতার ভিত্তিকে defy করার জন্যই করা হয়, এর পেছনে কোনো পন্থীয় নির্দেশ বা যৌক্তিকতা নেই। প্রসঙ্গত, আমাদের উপমহাদেশে পাশ্চাত্যের মতন শুধু খাদ্য হিসেবে আলাদা করে গোপালন করা হয়না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখানে কেবল এঁড়ে বা বৃদ্ধ বা রুগ্ন গরুকেই কসাইকে বেচে দেওয়া হয়। ফলে গোটা প্রক্রিয়াটি কেবল অশাস্ত্রীয় নয়, খুবই অস্বাস্থ্যকরও বটে।

Monday, June 26, 2023

শুদ্ধতা

শুদ্ধতা

শুদ্ধ অন্ন, শুদ্ধ চিন্তা আর শুদ্ধ জীবন - এগুলি পরপর ঠিক এই ক্রমেই চলে। অর্থাৎ শুদ্ধ অন্ন ছাড়া শুদ্ধ চিন্তা করার আত্মিক শক্তি জুটবে না, আর শুদ্ধ চিন্তা না করতে পারলে শুদ্ধ জীবনযাপন সম্ভব নয়। শুদ্ধ মানে কি? শুদ্ধ শব্দটি একটি বিশেষণ, বিশেষ্য নয়। অর্থাৎ অশুদ্ধ থেকে শুদ্ধ হতে হয়, তা সে জড়ই হোক বা চেতন। শুদ্ধ মানে শুচি, পবিত্র, যে গুণটি কোনো এক বিশেষ শোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। বস্তুত শুদ্ধ হওয়াটা একটা পরিণতি, যদিও ভগবৎকৃপায় কেউ কেউ জন্মশুদ্ধও হন। শ্রীশ্রীমা একজন মহিলার শুদ্ধতার প্রসঙ্গক্রমে একবার একটি মন্তব্য করেছিলেন, যা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত শুদ্ধস্বত্তারই পরিচায়ক, "এ মেয়ে শুদ্ধমতি, বড় সরল। এরকম ক্বচিৎ দেখা যায়।... একরকম মেয়ে আছে, মন তা'র সদাই ভোগে আবদ্ধ আবার একরকম আছে, শত সেজেগুজে থাকুক, সে যেন আগলা সাজ, মনের আসক্তি তা'তে নেই। এ মেয়ে সে জাতের।... জামাসেমিজ সাজসজ্জায় কিছু শুচিতা রক্ষে হয় না। নারী শুদ্ধ থাকে যদি তার দেহমন শুদ্ধ থাকে। সারাটি জীবন যদি শুদ্ধ থাকে, তবেই তো তা'কে বলি সতী।..."

শুদ্ধ অন্ন কি? এর মূলত তিনটি দিক আছে। এক, যে অন্ন মেহনতের কামাই, চুরি বা ছিনতাই করে বা কাউকে ঠকিয়ে জোগাড় করা নয়। দুই, যে অন্ন বিষমুক্ত, প্রাকৃতিক, অর্থাৎ যা শরীরে প্রবেশ করে দৈবনির্ধারিত শক্তি সঞ্চারণ করতে পারে এবং শারীরিক পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্য প্রদানের সাথে সাথে মানসিক শান্তি ও বিকাশের সহায়ক হয়। আর তিন, যে অন্ন স্বাত্বিক। সাত্ত্বিক শব্দটির উদ্ভব মূল সংস্কৃত শব্দ সত্ত্ব থেকে, যার অর্থ হলো ধার্মিকতা, ইতিবাচকতা, সত্য, শান্ততা, ভারসাম্য, শান্তিপূর্ণতা, এবং মহত্ত্বের গুণ যা মানুষকে ধর্ম ও জ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়। ফলে স্বাত্বিক আহার এমন আহার যা মানুষের মনের মধ্যে তিনটি গুণের মধ্যে থেকে উচ্চতম সত্বগুণটিকে জাগিয়ে তোলে, যা সত্যনিষ্ঠ, শান্ত ও সৎ হওয়ার দৈবশক্তি প্রদানকারী। যে অন্ন নিশ্চিন্তে ঈশ্বরকে নিবেদন করা যায় এবং তাঁর প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করা যায় তাই শুদ্ধান্ন।

শুদ্ধান্ন থেকে জন্ম নেয় শুদ্ধ চিন্তা। যেহেতু শুদ্ধ অন্নের মধ্যে দৈব শক্তি নিহিত থাকে, ধীরে ধীরে সেই শক্তি মনের মধ্যে ধর্মবোধ জাগিয়ে তোলে। আর যত বেশি অধর্মের প্রতি বিরূপতা জন্মায় তত বেশি মন অন্যায় এবং কুকর্ম করতে অসমর্থ হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে একজন ঘোর সংসারী জাগতিক লাভ লোকসান সচেতন মানুষও দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনের চাহিদা মেটানোর জন্য কেমন জানি অনুপযুক্ত হয়ে পড়েন। আর যত তিনি পারিপার্শ্বিক জাগতিক কূটকচালি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তত তিনি অন্তর্মুখী হতে থাকেন এবং তাঁর মনের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে এমন কিছু প্রশ্ন জাগতে শুরু করে যার উত্তর এই শুকনো ইঁট কাঠ পাথরের বাসিন্দা দুনিয়াদারেরা দিতে একেবারেই অপারগ। এতদিনের যাপনটি তাঁর যেন কেমন বেমানান লাগতে শুরু করে। আর এই জীবনজিজ্ঞাসা থেকেই ধীরে ধীরে মনের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার পাপড়ি মেলা শুরু হয়। এই পথ যেহেতু একেবারে আলাদা এবং এযাবৎ অনস্বাদিত হওয়ার কারণে অচেনাও, এই বিন্দু থেকেই শুদ্ধ জীবন শুরু হয়।

শুদ্ধ জীবন মানে সাধকের জীবন। সাধক মানেই গভীর জঙ্গলে গিয়ে কৌপিন পরে চব্বিশঘন্টা ধ্যানে ডুবে থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। জ্ঞানত কোনো কুচিন্তা করবো না, কুকথা বলবো না, কুকাজ করবো না আর কুসংসর্গে পড়বো না - এটুকু দিয়ে শুরু করতে পারলেই বিকল্প কি তা আপনেআপই স্পষ্ট হয়ে যাবে। সুচিন্তার জন্য উপযোগী যা কিছু আছে - পড়া, শোনা, দেখা, ভাবা ইত্যাদি, সে সবকে  অঙ্গীভূত করা আর যা কিছু ক্রুর, যা মনকে বিচলিত করে, সে সব থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকা। নেহাতই কুচক্রী ব্যক্তি ছাড়া, সাধারণত আমরা আগে যা ভাবি পরে তাই তো বলি, ফলে কুচিন্তা ত্যাগ করতে পারলে কুকথাও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। কথায় বলে 'সন্ন্যাসীর রাগ জলের দাগ' - ওঁদের কটুকথা গায়ে মাখতে নেই কারণ তার মধ্যেও বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়র ভাবনা অন্তর্নিহিত থাকে। আমরা কিন্তু সন্ন্যাসী নই, ফলে আমাদের বলা কথা যেন কাউকে বা কারো স্বার্থকে আঘাত না করে, নিজেদের জিবের ওপর রাশ যেন নিজেদের হাতেই থাকে, এটা সুনিশ্চিত করাটা খুবই জরুরি। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা না বলা আর বললেও সেই কথা যেন কড়া না হয়, তাতে যেন কারো অস্বস্তি না হয়, সেই কথা যেন হিতকারী হয়, তাতে যেন তেতে থাকা পরিস্থিতি শান্ত হয়ে ওঠে, এটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত। কথা হোক নিজের সাথে, বাইরের সাথে নয়।

সুকাজ কি? যে কাজ যুগপৎ উপযোগী এবং উপকারী। স্বামী বিবেকানন্দ এক কথায় এই সুকাজকে সংজ্ঞায়িত করে গেছেন - 'আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ' - যে কাজে নিজের মোক্ষলাভও হবে আবার জগতের কল্যাণও হবে। অর্থাৎ জপ ধ্যান সাধনার দ্বারা নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া এবং সেইসাথে শিবজ্ঞানে জীবসেবা। এই পথের শুরু থেকে শেষ, স্বামীজী যাকে বলতেন প্র্যাকটিক্যাল বেদান্ত, তার গোটা প্রক্রিয়াটির প্রেসক্রিপশন স্বামীজী স্বয়ং করে দিয়ে গেছেন, ফলে তাঁর বাণী ও রচনা পড়লেই ধারণাটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর একবার এই ধারণাটি আত্মস্থ করে নিলে জীবনে কুকাজ করার স্পৃহা বা প্রয়োজনীয়তা কোনোটাই আর থাকবে না। এরপর আসে সাধুসঙ্গ। কুসংসর্গ ত্যাগ করার পরেই মন সাধুসঙ্গের দিকে ঘুরে যায় কারণ তখন মনের খিদেটা ১৮০° পাল্টে যায়। ভক্ত শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে জিজ্ঞেস করছেন, সাধুসঙ্গে কি উপকার হয়? শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, "ঈশ্বরে অনুরাগ হয়। তাঁর উপর ভালবাসা হয়। ব্যাকুলতা না এলে কিছুই হয় না। সাধুসঙ্গ করতে করতে ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়। যেমন বাড়িতে কারুর অসুখ হলে সর্বদাই মন ব্যাকুল হয়ে থাকে, কিসে রোগী ভাল হয়।... সাধুসঙ্গ করলে আর একটি উপকার হয়। সদসৎ বিচার। সৎ — নিত্য পদার্থ অর্থাৎ ঈশ্বর। অসৎ অর্থাৎ অনিত্য। অসৎপথে মন গেলেই বিচার করতে হয়। হাতি পরের কলাগাছ খেতে শুঁড় বাড়ালে সেই সময় মাহুত ডাঙস মারে।”

এরপরেও যদি কারো মনে আশঙ্কা থাকে যে এযাবৎ এত অশুদ্ধ জীবন যাপন করেছি, এখন, এই বয়সে এসে কি আর জীবনের মোড় ঘোরানো সম্ভব? শ্রীশ্রীমা তার উত্তর দিয়েছেন। প্রথমে নিজেকে ইঙ্গিত করে মা অভয় দিয়ে বলেছেন যে মা থাকতে আবার ভয় কি? আর তারপর আরো ভরসা দিয়ে বলেছেন, "জীবনে যা কিছু অন্যায় ক'রে ফেলেছো, শৌচাদির যেমন কেহ হিসাব রাখেনা, তেমনি ও সবের আর কোন হিসাব না রেখে, কোন চিন্তা মনে না এনে, সরলভাবে শ্রীশ্রীঠাকুরের চরণে মন দাও।" এরপর তো আর কোনো আশঙ্কার অবকাশ থাকেনা রে ভাই। আমাদের সংস্কৃতিতেই তো বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাসের বিধান আছে, যা আজকের প্রেক্ষাপটে সংসারে থেকেও নিজেকে নিস্পৃহ এবং নির্লিপ্ত রেখে পালন করা যায়। যব জাগো তব সভেরা।

মা বসুন্ধরা

পৃথিবীকে মাতৃরূপে দেখা আমাদের সংস্কৃতির বহু প্রাচীন এক পরম্পরা। সেই কবে অথর্ব বেদের দ্বাদশ কাণ্ডে প্রথম অনুবাকের প্রথম সূক্ত হিসেবে ৬৩টি মন্ত্রের সমাহারে 'পৃথ্বী সূক্তম্' বা 'ভূমি সূক্তম্' প্রকাশ করেছিলেন ঋষি অথর্বা, তারপর প্রকাশিত হয়েছিল তৈত্তিরীয় সংহিতা ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণম্-এ 'ভূ সূক্তম্', তাতেও ভূমি মাতা হিসেবে বর্ণিতা। ওই সময়ই বৈদিক সাহিত্যে প্রথম ধ্বনিত হলো সেই বিখ্যাত বাক্যবন্ধ, 'মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিব্যা' - বসুন্ধরা আমাদের মাতা আর আমরা সব তাঁর সন্তান। অতঃপর ওই সূক্তের শ্লোকে শ্লোকে ঋষি মাতৃরূপী পৃথিবীকে বন্দনা করে অনেক রকমের বর চাইলেন। 

সূক্ত শুরু হচ্ছে এই পৃথিবীমায়ের বুকে যেন আমরা যথাযথ স্থান পাই, সেই প্রার্থনা দিয়ে। ঋষি বলছেন,
সত্যং বৃহদৃতমুগ্ৰং দীক্ষা তপো ব্ৰহ্ম যজ্ঞঃ পৃথিবীং ধারয়ন্তি। 
সা নো ভূতস্য ভব্যস্য পরুং লোকং পৃথিবী নঃ কৃপোতু।।
অর্থাৎ, সত্য, ব্রহ্মাণ্ডের দিব্য নিয়মাবলী, দীক্ষা, ব্রহ্মের খোঁজে তপঃ ও আত্মসমর্পণ এবং যজ্ঞ - এগুলোই পৃথিবীর ধারক আবার পৃথিবীও এদের ধারণ করে আছেন। 
তিনি, যিনি আমাদের অতীত এবং ভবিষ্যতের সাক্ষী, সেই পৃথিবী যেন আমাদের জীবনকে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিস্তৃত করেন।

তারপর ছত্রে ছত্রে সন্তান হিসেবে মায়ের কাছে তাঁর আবদার ফুটে উঠেছে। মূল সংস্কৃত শ্লোকসমূহের মধ্যে না ঢুকে সূক্তটির সারাংশ মোটামুটি এইরকম: "সর্বসাধন-সামর্থ-সম্পন্না পৃথিবী আমাদের কামনা পূর্ণ করুন। পৃথিবী আমাদের গো ও অন্নযুক্ত করুন। জগৎ সংসারের আশ্রয়ভূত অগ্নির ধারয়িত্ৰী পৃথিবী আমাদের কৃষিজাত নানাবিধ দ্রব্যাদি প্রদান করুন। দেবরক্ষিত পৃথিবী আমাদের রাষ্ট্রবল, মধুর-ধন এবং তেজঃ, ও ঐশ্বর্য প্রদান করুন।…যে পৃথিবীকে অশ্বিনীকুমারদ্বয় নির্মাণ করেছিলেন, যাঁর উপর বিষ্ণুদেব বিক্রমণ করেছিলেন, ইন্দ্র যাঁকে আপন অধিকারভুক্ত করে শত্রুহীন করেছিলেন, সেই পৃথিবী, মাতা কর্তৃক পুত্রকে দুগ্ধ পান করানোর মতো, আমাদের সার রূপ জল প্রদান করুন।" 

"পৃথিবীর স্থাবর জঙ্গম সব কিছুই আমার সুখপ্রদ হোক। আমি বহু-রত্ন-শালিনী ইন্দ্রগুপ্তা পৃথিবীতে ক্ষয়রহিত ও পরাজয়রহিত হয়ে যেন সদা প্রতিষ্ঠিত থাকি। আমাদের শত্রুগণ পৃথিবী কর্তৃক বিনষ্ট হোক সূর্য-রশ্মিসমূহ আমাদের নিমিত্ত প্রজা (সন্তান) ও মৃদুল বানীকে দোহন করুক। পৃথিবীর সকল দিক আমাকে বিচরণ-শক্তি প্রদান করুক, পৃথিবী সকল দিক হতে আমাকে রক্ষা করুন।…যে পৃথিবী ইন্দ্রকে বরণ করেছিলেন, যিনি বীর্যবানের অধীনে অবস্থান করেন, যার উপর বেদমন্ত্রের ধ্বনি (বা গান) উৎসারিত হয়, যেস্থানে সোমপান হয়, যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, দেবপূজন হয়, সেই পৃথিবী আমাদের অভীষ্ট ধন প্রদান করুন।…হে পৃথিবী! গ্রাম, জঙ্গল, সভা, যুদ্ধ-মন্ত্রণা, যুদ্ধ ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই আমরা তোমার বন্দনা করছি। …হে পৃথিবীমাতা! আমরা তোমাকে হবিঃ প্রদান করছি! আমরা যেন রোগরহিত হই, দীর্ঘায়ু হই, মঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত থাকি।"

এই যে ভারতীয় দর্শনের আধ্যাত্মিক মূলধারার সাথে জাগতিক অস্তিত্বের সুদৃঢ় বন্ধন, এটাই সভ্যতা হিসেবে আমাদের সমস্ত সমসাময়িক সভ্যতার চেয়ে বৌদ্ধিকস্তরে উন্নততর করে তুলেছিল। আমরা যখন মাতৃরূপা পৃথিবীর ধারক হিসেবে একাধারে সত্য তপঃ দীক্ষা ইত্যাদির কথা চিন্তা করছি তখন একইসাথে তাঁর পবিত্রতা ও বিশালতাকে আশ্রয় করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার ইচ্ছাও ব্যক্ত করছি, এটা মানুষের বোধ একটা বিশেষ পর্যায়ে না পৌঁছলে কল্পনা করাই সম্ভব নয়। এই যে ধর্মকে মুলাধার করে ধর্মপথে অর্থ এবং কাম চরিতার্থ করে, তাকে পরিবার প্রতিপালন এবং লোকহিতে ব্যয় করে শেষে জাগতিকভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে সংসার ত্যাগ করে মোক্ষলাভ অর্থাৎ আত্মজ্ঞানলাভের যাত্রায় বেরিয়ে পড়া, এটাই আমাদের সামাজিক জীবনের এক আশ্চর্য্য সমাপতন যেখানে ব্রহ্মও সত্য আবার জগৎও সত্য কারণ সবটাই ওই একই অনন্তের ভিন্ন রূপ। 

তাই যখন সুদূর আমেরিকার সংসদ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে 'কৃষি ও ঋষি যাত্রা'র মূলমন্ত্র 'মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিব্যা' উচ্চারিত হতে শুনি তখন মনে হয় কোথায় যেন প্রাচীন ভারতের ঋষির শাশ্বত বাণী আজকের বিশ্বকে ধর্মপথ দেখাতে আবার উদ্যোগী হচ্ছে; কোথায় যেন এই পৃথিবীমায়ের সন্তানরা কয়েক দশকব্যাপী অত্যধিক লোভ লালসাদুষ্ট যাপনের উর্দ্ধে উঠে আবার সেই প্রাচীন ভারতীয় কৃষিসংস্কৃতিকে অবলম্বন করতে চলেছেন - যে সংস্কৃতি বলে শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ - গোটা পৃথিবীজুড়ে সবই অমৃতের সন্তান - এই বিশ্ব সবার, এর প্রাকৃতিক সম্পদ সবার, এখানে সবার জন্য আহার আছে, দৈবের কৃপায় আহারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুস্বাস্থ্য ও বৌদ্ধিক চেতনা আছে, মাতা পৃথিবী ওপর সমস্ত জীবের সমান অধিকার আছে - তোমরা লোভ করো না, পরিবেশ, খাদ্য ও পানীয়কে বিষিয়ে দিও না, সবাই মিলেমিশে থাকো, সুখে থাকো, শান্তিতে থাকো, ধর্মপথে থাকো, অল্পে সন্তুষ্ট থাকো, আনন্দে থাকো।

Monday, June 12, 2023

আমাদের ভারত


জম্বুদ্বীপে ভারতখণ্ডে আর্য্যবর্তে ভারতবর্ষে...

আমরা যদি ভারতবর্ষের মানচিত্র দেখি, তাহলে দেখবো যে দেবাত্মা হিমালয়ের কোল থেকে নেমে সিন্ধুর দিকে এগোতে এগোতে ধীরে ধীরে এই পূণ্যভূমি প্রথমে চওড়া হয়েছে আর তারপর যত সে জলের দিকে এগিয়েছে তত সে একীভূত হতে হতে শেষে ধানসকড়িতে একটি বিন্দুতে গিয়ে মিশেছে। যতক্ষণ এই দেশের বিস্তার ততক্ষণ সে ভূমির সাথে যুক্ত। আর যে মুহূর্তে সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে ওমনি তাকে আড়াল করতে, বা বলা ভালো আগলে রাখতে, তিনদিক থেকে জলসিন্ধু ঘিরে ধরেছে। আমরা যদি কোনো মহাত্মাকে আগে শিষ্যপরিবৃত অবস্থায় দেখি আর তারপর তাঁকে ধীরে ধীরে বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে শেষে ধ্যানমুদ্রা ধারণ করতে দেখি তাহলে তাঁর এই অবস্থান্তরের মধ্যেও ঠিক যেন ভারতবর্ষের ভৌগোলিক বৈশিষ্টটিকেই দেখতে পাবো। 

এই যে ভারতে এত সাধু মহাত্মা ঋষিদের জন্ম, এই যে এই ভূমিতে বেদের সাক্ষাৎ দর্শন, এই যে ভারতের সুপ্রাচীন আধ্যাত্মিক পরম্পরা, এই যে এখানে এতগুলি উদার, মানবিক ও সর্বসমাবেশী পন্থের জন্ম ও বৃদ্ধি,  এই যে এইখান থেকে সারা বিশ্বজুড়ে জীবনযাপনের মানক হিসেবে সনাতন ধর্মের তত্ব ছড়িয়ে পড়া - এসব কি এমনি এমনি হয়েছে? এ দেশের দৈহিক গঠনের মধ্যেই ঈশ্বরীয় ইচ্ছা প্রকাশিত, ফলে আমরা যখন ভারতকে পূণ্যভূমি বলি তখন সেটি বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নয়। সারা বিশ্বে গণিতশাস্ত্র থেকে নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে নিয়ে কলাতত্ব, ধর্মবোধ থেকে নিয়ে নানান দর্শন - সভ্যতার অগ্রগতি এবং আধ্যাত্মিক চেতনা বিকাশের জন্য গোটা মানবজাতির যখন যেমন জ্ঞানপিপাসা জেগেছে, তা মেটানোর উপাদান এই পুণ্যভূমিতে সৃষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভারতের যে জীবনদর্শন তা চারটি মূল ক্রমান্বয়ী সূত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে - ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ। আবার ভারতের মানচিত্রের দিকে তাকানো যাক। শিয়রে দেবভূমি হিমালয় - ধর্ম। তারপর ভূবিস্তার - অর্থ এবং কাম। তারপর একটি বিন্দুতে গিয়ে বিলয় - মোক্ষ। এই ভৌগোলিক বৈচিত্র্যকে অন্যভাবেও দেখা যায়। ভারতীয় দর্শনের তিনটি মূল ধারা, যাকে গল্পচ্ছলে শ্রীরামকৃষ্ণদেব সহজ করে বুঝিয়েছিলেন, "রামকে হনুমান বলেছিলেন, ‘রাম, কখন ভাবি তুমি পূর্ণ, আমি অংশ; তুমি প্রভু, আমি দাস; আর যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি তুমিই আমি, আমিই তুমি।’ এই তিন অবস্থার নাম দ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত এবং অদ্বৈত। যেখানে দেবাত্মা হিমালয়ের সাথে সমতলের যোগ সেখানে 'তুমি পূর্ণ, আমি অংশ'। যেখানে দৈহিকভাবে পূর্ণ বিস্তার কিন্তু একটি অখন্ডভূমির অংশবিশেষ বোধ প্রবলভাবে বিদ্যমান সেখানে 'তুমি প্রভু, আমি দাস'। আর যেখানে একটি বিন্দুতে সমাগত, যেখানে আর পূর্ব-পশ্চিম নেই, পৃথক প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক পরিচয় নেই, যেখানে গোটা ভারত অভিন্ন, অভেদ, অদ্বৈত, সেখানে 'তুমিই আমি, আমিই তুমি'।

ভারতবর্ষকে আর পাঁচটা দেশের মতন ভাবলে ভুল হবে কারণ ভারত ধর্মের রক্ষক। ধর্ম যে ভারত নিজের বুদ্ধিতে আবিষ্কার করেছে তা তো নয়, ভারতের শরীর ও মন বলে দিচ্ছে যে যেমন মানুষের শরীর ও মন অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় চেতনার বিকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত, ঠিক তেমনই ঈশ্বরের ইচ্ছায় বিশ্বের বাকি সমস্ত দেশের নিরিখে ভারত বৌদ্ধিকভাবে ধর্মের ভাব গ্রহণ করার সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত বলেই এই পূণ্যভূমিতে ধর্মের উদয় হয়েছে। একমাত্র এইজন্যই হাজার বছর ধরে ক্রমাগত আক্রমণ ও অধীনতার চক্রবুহ্য রচনা করেও দৈহিক বলশালীরা এই বৌদ্ধিক জাতির অস্তিত্বগত বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করতে পারেনি। কালক্রমে ভারত নামক প্রাচীন রাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে খন্ড বিখন্ড হয়েছে কিন্তু ভারতের শারীরিক বৈশিষ্ট্য যেমন আজো অক্ষুন্ন আছে, তেমনিই ভারতের অন্তরাত্মাও খণ্ডিত হয়নি, সেটি আজো ধর্মাশ্রয়ী। আসলে যা দৈবনির্ধারিত তাকে পাল্টাবার ক্ষমতা যে সামান্য মনুষ্যজাতির নেই।

ভারত কেবল ঋষিদের দেশ নয়, ঋষিতুল্য দেশ। জগতের কল্যাণ করার জন্যই ভারতের জন্ম এবং কলিকালের অন্তে জগতের কল্যাণের জন্যই বিশ্বশক্তি হিসেবে ভারতের উদয় আসন্ন। এর আগে আমরা নানা শক্তিশালী দেশকে পৃথিবীজুড়ে তান্ডব করতে দেখেছি - ইতিহাসের বিভিন্ন কালখণ্ডে কেউ পন্থীয় প্রেরণায় বিশ্বজয় করতে বেরিয়েছে, কেউ রাজশক্তির প্রতিষ্ঠাকল্পে ঔপনিবেশিক মহাশক্তি হয়ে উঠেছে, কেউ ভয় দেখিয়ে বিশ্বকে পদানত করেছে আর কেউ বা লোভ দেখিয়ে। এবার ভারতের সময় আগত, ভারত কি সেই রাস্তাতেই হাঁটবে যে রাস্তায় বাকি বলশালীরা হেঁটেছিল? কখনোই না, কোনো অবস্থাতেই না। না তো ভারত কাউকে ভয় দেখাবে, না ভারত কারো সাথে প্রতারণা করবে। বিশ্বশক্তি ভারতকে মানুষ শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে, অনুসরণ করবে, অনুকরণ করবে। বিশ্বজোড়া মহামারীর সময় অসমর্থের ত্রাতা হিসেবে নিজের ভূমিকা পালন করার ভারত তার সেই শাশ্বত জীবনবোধকে আবার নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরেছে - বসুধা এব কুটুম্বকম্ - গোটা বসুধা প্রকৃতপক্ষে একটাই পরিবার - 'বসুধৈব কুটুম্বকম্'। ভারত তার অনুভূতিলব্ধ ঋষিদর্শনকে ভিত্তি করে আবার জোরগলায় সবাইকে বুকে টেনে নিয়ে বলছে, 'শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা' - সমস্ত বিশ্বজুড়ে সবাই অমৃতের সন্তান - কেউ পর নয়, সবাই আপন। এক ভারত, শ্রেষ্ট ভারত।

Thursday, June 8, 2023

ভারত - চীন

যেহেতু আজ (৯.৬.২০২০) চীনা সৈন্য লাদাখ সীমান্ত থেকে আবার পূর্বস্থানে ফিরে গেছে, এবারের স্বস্তিকায় প্রকাশিত আমার ভারত-চীন সম্পর্ক সম্বন্ধীয় প্রবন্ধটি আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম :

এই বছরে চীনের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৭০ তম বর্ষপূর্তি। ফলে দুই দেশ জুড়ে সত্তরটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা উজ্জাপন করার পূর্বপরিকল্পনা ছিল, কোরোনা নামক এক চীনা ভাইরাস সে স্বপ্নে যবনিকা টেনে দিয়েছে। তবে শুধুমাত্র সংক্রমণের উৎস ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্ধিহান হওয়া অবধি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েন থেমে থাকেনি। ভুটানের ডোকালাম সীমান্তের ৭২ দিন ধরে চোখে-চোখ-রাখা পরিস্থিতি শান্ত হতে না হতেই এই বিশ্বব্যাপী কোরোনা প্রকোপের মধ্যেই   পূর্ব লাদাখে গালোয়ান উপত্যকায় লাইন অফ একচ্যূয়াল কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর  চীন আবার নতুন করে তাদের আগ্রাসী মনোভাব দেখাতে শুরু করেছে। আপাতদৃষ্টিতে যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক নৈকট্যই বেইজিংয়ের উদ্বেগের মূল কারণ, তাৎক্ষণিক সমস্যা হলো আকসাই চীন সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদি সরকারের নীতি পরিবর্তন ও ভারতের লাগাতার জাতীয়তাবাদী পদক্ষেপ। 

আকসাই চীন এলাকাটি চিরকাল ভারতীয় মানচিত্রের অংশ এবং লাদাখের বিজেপি সাংসদ জামিয়াং শেরিং নামগিয়ালের স্পষ্ট বক্তব্য হলো জওহরলাল নেহরুর কারণেই ১৯৬২র চীন-ভারত যুদ্ধের ফলস্বরূপ আকসাই চীন ভারতের হাতছাড়া হয়েছিল। কেন্দ্রে ২০১৪য় বিজেপির সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই লাদাখ সীমান্তের গালোয়ান উপত্যকা ঘেঁষে ভারত যেভাবে রাস্তাঘাট সহ অবকাঠামো তৈরি করতে শুরু করেছে তাতে চীন প্রথমবার সত্যিকারের প্রতিদ্বন্ধিতার মুখে পড়েছে এবং ভয়ও পেয়েছে। লাদাখে ভারতের রাস্তা নির্মাণকে তাই চীন একটি হুমকি হিসাবেই দেখতে শুরু করেছে। বিশেষ করে পশ্চিম জিনজিয়াং প্রদেশের কাসগর শহর থেকে তিব্বতের রাজধানী লাশা পর্যন্ত সামরিক কৌশলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে মহাসড়কটি চীন তৈরি করেছে, তার নিয়ন্ত্রণ ভবিষ্যতে আদৌ আর তাদের হাতে থাকবে কিনা, সেই বিষয়ে চীন আর নিশ্চিত হতে পারছেনা। এমনিতেই এই দুটো প্রত্যন্ত প্রদেশের বাসিন্দাদের আনুগত্য নিয়ে চীন সবসময়েই  সংশয়িত। উপরন্তু এই মহাসড়কটি আকসাই চীনের মধ্য দিয়ে গেছে আর চীন জানে যে আজকের নরেন্দ্র মোদির ভারত আর সেদিনের নেহেরুর ভারত এক নয়।

চীনের হৃদয়গতি আরো বাড়িয়ে দিয়ে ৫ই অগাস্ট ২০১৯এ সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা খারিজের বিতর্কে সংসদে এক বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন যে জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে নেওয়া যে কোনও সিদ্ধান্ত পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং আকসাই চিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে গালোয়ান উপত্যকায় এখন চীন পদক্ষেপ করছে, সেখানে একসময় সাময়িকভাবে অত্যন্ত দুর্বল ভারতের হাতে বিপুল শক্তিশালী চীনা ফৌজকে চরম লোকসান পোয়াতে হয়েছিল। বস্তুতঃ ১৯৬২র যুদ্ধে গালোয়ান উপত্যকায় চীন যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, সেই স্মৃতি এখনো তাদের তাড়া করে ফেরে। Snow of the Himalayas: Sino-Indian War Records (Chinese edition 1991) বইতে পিপলস লিবারেশন আর্মির প্রাক্তন অফিসার সুন জিয়াও লেখেন, "যুদ্ধের শুরু থেকেই ভারতীয় সেনার গোলাবারুদের ব্যবহার ভয়ানক ক্ষতিকারক ছিল। দুঘন্টার প্রচন্ড যুদ্ধের পর চীনা সেনা যদিও গালোয়ান উপত্যকা দখল করতে সক্ষম হয়, তার জন্য মারাত্মক দাম চোকাতে হয়েছিল। ৮৭৪ জন সৈন্যকে আমরা ওই বরফ ঢাকা উপত্যকায় হারাই, ১৯৮০-৮২ সালে যাদের মধ্যে ৮০০র বেশি সেনার দেহাবশেষ ওখান থেকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়"। এবার চীন এখনো পর্য্যন্ত নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করেনি কিন্তু করলে কি হবে, সেটা তাদের অজানা নয়। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বলয় বিস্তারের চেষ্টা চীন বেশ কিছুদিন ধরেই করে চলেছে। করোনাভাইরাস মহামারিতে সারা বিশ্ব যখন ব্যস্ত, তখন বেইজিং এটাকে একটা লক্ষ্য হাসিলের সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছে। সারা বিশ্বের শেয়ার বাজারের ধসের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির কোটি কোটি শেয়ার কানাকড়ির দামে কিনে নিয়ে বিশ্বঅর্থনীতির সরবরাহের গোটা দিকটাকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ায় চেষ্টা করেছে। শুধু ভারত সীমান্তে চাপ সৃষ্টি করাই নয়, হংকংয়ে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে চীন। গোটা সাউথ চায়না সি জুড়ে চীনের সৈনিক গতিবিধিও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরেও সংকটে পড়া দেশগুলোকে ঋণ-সাহায্য দিয়ে বেইজিং এমনভাবেই তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিল। তবে ২০০৮ আর ২০২০ র মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। এবারে কিন্তু কোরোনা পরবর্তী কালখণ্ডে চীনের অভ্যন্তরীন পরিস্থিতি ভিন্ন এবং ব্যাপক বেরোজগারি ও খাদ্যসংকটকে কেন্দ্র করে চীনে ভয়ানক গণঅসন্তোষ দানা বাঁধছে। রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং-এর নেতৃত্ব আজ প্রশ্নের মুখে। প্রিমিয়ার লির সাথে ওঁর নীতিগত মতভেদও প্রকাশ্যে এসে গেছে। ওদিকে চীনের ভেতরেই চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির গ্রহণযোগ্যতা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে কমছে। যেভাবেই হোক শি জিন পিং অভ্যন্তরীন সংকটের দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন। চীনের ইদানীংকার সমস্ত পদক্ষেপই সেই আলোকেও দেখা প্রয়োজন।

এছাড়াও, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের স্বার্থে এমন কিছু অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ করেছেন যা ভারত এবং চীনের এযাবৎকার সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। প্রথমত, বহুদিন ধরে চীন ভারতের প্রধাণ বাণিজ্যিক সহযোগী ছিল, যদিও রপ্তানির চেয়ে চীন থেকে ঢের বেশি আমদানি করে ভারত। গতবছর বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৩০০ কোটি ডলার। ভারতে এখন মেক ইন ইন্ডিয়ার হওয়া বইছে, প্রধানমন্ত্রী চাইছেন দেশ আত্মনির্ভর হোক, বিশ্বের অগ্রণী উৎপাদনকারী শক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। ফলে ভারত এখন একদিকে যেমন চীন থেকে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ভারতে চলে এলে সবরকম সাহায্য দেবার কথা বলছে, অন্যদিকে চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়েও আর তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ভারত এতদশক পর প্রথমবার তার নিজস্ব স্বার্থরক্ষার প্রতি যে দায়বদ্ধতাটা প্রকাশ করছে, এতদিন ধরে একতরফা মুনাফা লুটে যাওয়া চীনের স্বভাবতই সেটা মোটেও ভালো লাগছে না। 

দ্বিতীয়ত, চীনের বেসরকারি মুখপত্র গ্লোবাল টাইমস সম্প্রতি তাদের বিভিন্ন লেখায় এমন কিছু মন্তব্য করেছে যাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ভারতকে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীন বিরোধী একটি অক্ষের অংশ হিসাবেই মনে করছে। ২৫শে মে, ২০১৯এর সংখ্যায় একজন চীনা বিশ্লেষক লং শিং চুং উপ-সম্পাদকীয়তে লেখেন, “ভারত সরকার যেন তাদের দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কামানোর গোলা হিসাবে ব্যবহৃত না হতে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপার দুই দেশকেই সতর্ক থাকবে হবে, কারণ যে কোনো সুযোগেই শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নষ্ট করা যুক্তরাষ্ট্রের স্বভাব।“ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, কোয়ালামপুরস্থিত চীন বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসিকে দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তিকে বাগে আনার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র গত এক দশকে যে একটি 'অক্ষশক্তি' তৈরি করেছে, ভারত তার অগ্রভাগে। আমেরিকা মনে করে চীনকে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে যে দেশটি তাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে সেটি হলো ভারত। এজন্য গত দশ বছরের তারা ভারতের কাছে ২০০ কোটি ডলারের মত অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে।“ ফলে নিজেদের সামরিক শক্তি নিয়ে চীন যতই আস্ফালন করুক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা এবং কূটনৈতিক নীতিনির্ধারণে যে এখন ভারতের গুরুত্ব ও প্রভাব ক্রমবর্ধমান, সেটা চীনকে বিচলিত এবং উত্তেজিত, দুটোই করছে।

চীন ও ভারতের মধ্যে তাদের ৩৩০০ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নতুন কিছু নয়। আকসাই চীন অঞ্চলের ১৫০০০ বর্গমাইল ভারতীয় এলাকাকে চীন দখল করে বসে আছে, যা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের পক্ষে আর মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য অরুণাচলকে চীন তাদের এলাকা বলে দাবি করে প্রতিনিয়ত উৎপাত সৃষ্টি করে, সেটাও বন্ধ হওয়া দরকার। কোরোনার সংক্রমণের ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন সারা বিশ্বে, বিশেষত পশ্চিমি দেশগুলো জুড়ে, চীনের কম্যুনিস্ট সরকারের প্রতি একটি বিতৃষ্ণার আবহ তৈরি হয়েছে, যা চীনের পক্ষে অশনিসংকেত। তার ওপর ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন্স, তাইওয়ান, তিব্বত, কাজকিস্তান এবং বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নামক অপরিশোধীয় ঋণ-অস্ত্র ব্যবহার করে এশিয়া এবং আফ্রিকা জুড়ে চীনা সাম্রাজ্যবাদের যে কদর্যরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়েছে, তাতে চীন আজ বাস্তবিকই একঘরে। ভারত সীমান্তে চীনের আস্ফালন আসলে এক মনস্তাত্বিক দাবাখেলা, যার জবাব ভারত ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে। গত ১৬ বছর ধরে সীমান্তবর্তী যে সমস্ত রাস্তা চুরির ফাঁদে আটকে ছিল, নরেন্দ্র মোদির সরকার সেগুলোকে প্রায় সম্পুর্ন করে ফেলেছেন। ওদিকে নিয়ন্ত্রণরেখার ওপার থেকে চীন চোখ রাঙাচ্ছে আর এদিকে বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন এগারোটা ট্রেন ভর্তি করে ১১,৮১৫ জন নতুন শ্রমিক নিয়ে গিয়ে ডারবুক-শয়ক-দৌলতবেগের রাস্তার কাজ সম্পুর্ন করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। চীনকে বুঝতে হবে যে এটা নতুন আত্মনির্ভর আত্মবিশ্বাসী ভারত। ব্যাপকহারে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেও নেহাৎ ব্যাবসায়িক মুনাফা পাইয়ে দেওয়ার দৌলতে এতদিন চীন পার পেয়ে গেছে। এখন তাদের ভয় দেখানোর দিন শেষ, ভয় পাওয়ার দিন শুরু হয়েছে। হয় নিজেরা শোধরাবে, নাহয় শুধরে দেওয়া হবে।

Friday, June 2, 2023

হিন্দুরাষ্ট্র



কিছু মানুষ কেন যে এই মুহূর্তে হিন্দুরাষ্ট্র হিন্দুরাষ্ট্র করে বৃথাই চেঁচাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। রামরাজ্য বা ধর্মরাজ্যের অবধারণা ছেড়ে একেবারে সোজাসুজি হিন্দুরাষ্ট্র! আমাদের দেশ আছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্র কোথায়? ভারত এক প্রাচীন সভ্যতার জন্মভূমি, পর্যটক ও পড়শীরা যার ভূমিপুত্রদের নাম দিয়েছিলেন 'হিন্দু'। ফলে ভারত হিন্দুদের দেশ এই সত্যটি তো অনস্বীকার্য, তা সে ভারতীয়দের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত পূজা পদ্ধতি যার যাই হোক না কেন। হ্যাঁ, অবশ্যই বিদেশি আক্রান্তারা বারেবারে এই সভ্যতাকে ধ্বংস করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে এবং পৃথ্বীরাজ চৌহান থেকে নিয়ে শিবাজী মহারাজ, লচিত বরফুকুন থেকে নিয়ে মহারাজা রণজিৎ সিংরা তাদের প্রতিহত করেছেন, পরাজিত করেছেন, নানা সময়ে তাঁরা হিন্দু-পাদ-পাদশাহী বা হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতেই চেয়েছেন। কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্র?

প্রাচীনকালে হিন্দু সভ্যতা যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাতে নানা দেশ, নানা বেশ, নানা বর্ণ, নানা পন্থ, নানা ধরনের স্থানীয় মান্যতা ইত্যাদি সমবেশিত হয়ে এবং সেখানকার বাসিন্দারা হিন্দু সভ্যতার সর্বসমাবেশী দার্শনিক, বৌদ্ধিক এবং সামাজিক ভাবকে আত্মসাৎ করার ফলে যে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক হিন্দুরাষ্ট্ৰচেতনার সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি আজ বিক্ষিপ্ত এবং অসংহত, এই সত্যটিকেও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

আমি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে এই প্রাচীন রাষ্ট্রের অবশিষ্টাংশ দেখেছি, আর দেখেছি জাভায়, ক্যাম্বোডিয়ায়, চীনে, পাকিস্তানে, বাংলাদেশে, মায়ানমারে, শ্রীলঙ্কায়, মরিশাসে, ফিজিতে আর সেনেগালে। হয়তো বিশ্বের আরো অনেক দেশে এই প্রাচীন সভ্যতার প্রভাবের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে, হয়তো এক সময় সে সব দেশের বাসিন্দারা মানসিকভাবে হিন্দুত্বের সঙ্গে জুড়ে ছিলেন, কিন্তু আমার নিজের চোখে তা দেখা হয়নি। আমি যাঁদের দেখেছি তাঁদের মধ্যেও এক রাষ্ট্র - এক সংস্কৃতি - একতার যে বৈচারিক মানসিক এবং সামাজিক পরিকাঠামো - সেটি আর খুব সক্রিয়ভাবে অবশিষ্ট নেই। আর যেখানে রাষ্ট্র্ববোধ নেই সেখানে রাষ্ট্রবাদও নেই। 

ইদানিং একটি বৈষ্ণবীয় যাজকসম্প্রদায়ের কল্যাণে অন্যতম এক Indic পন্থের যে প্রভাব এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা দেশে দৃশ্যমান, তার সাথে কিন্তু বহুমাত্রিক হিন্দুরাষ্ট্রীয় চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই। ওটি অন্যান্য যাজকবৃত্তির প্রভাবেরই সমকক্ষ, যদিচ এঁদের প্রভাববিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা, হিন্দু দর্শনের একটি বিশেষ ধারা এবং হিন্দু সংস্কৃতি ও লোকাচারের কিছু কিছু বিশিষ্ট দিক সম্পর্কে নিঃসন্দেহে বিশ্ব নতুন করে অনুসন্ধিৎসু হয়েছে। বরং এমন কিছু কিছু হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছেন যাঁরা বিদেশিদের পন্থের বদলে সনাতন ধর্মবোধ ও দর্শন শেখাচ্ছেন, তাঁদের প্রভাব হয়তো এতটা বিস্তৃত নয় কিন্তু বৌদ্ধিকভাবে অনেক বেশি গভীর। সেইখান থেকে কোনো একদিন হিন্দু রাষ্ট্রবোধের উদয় হওয়াটা হয়তো অস্বাভাবিক নয় কারণ সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদ মুলত একটি বৌদ্ধিক এবং বৈচারিক উপলব্ধি। 

এখন প্রশ্ন হলো হিন্দুরাষ্ট্র বলে গলার জোরে চেঁচালেই কি আবার দিগ্বিদিকে সেই প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐক্যবন্ধন রাতারাতি গড়ে উঠবে না হিন্দুরাষ্ট্রের পুনঃস্থাপনা হয়ে যাবে? আমাদের সাধকশ্রেষ্ঠ ঋষিরা তাঁদের গভীর ধ্যানলব্ধ উন্নততম দার্শনিক তত্বজ্ঞান, উন্নততম জীবনবোধ এবং আধ্যাত্মিক চৈতন্যবিকাশের পথনির্দেশ দিতে পেরেছিলেন বলেই তাঁদের গুরু মেনে নিয়ে হিন্দু সভ্যতার প্রভাব এই উপমহাদেশের বাইরেও বিস্তৃত হয়ে প্রাচীন হিন্দুরাষ্ট্রের অবতারণা হয়েছিল। ভারত প্রকৃতঅর্থে বিশ্বগুরু হয়ে উঠতে পেরেছিল বলেই না প্রাদেশিক জাতীয়তাবাদের ঊর্দ্ধে উঠে এক বৃহৎ আত্মীয়তার যোগসূত্র গঠিত হয়েছিল? 

আজ বাস্তবিক অবস্থা এমন যে আমাদের নতুন সংসদে সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্যের প্রাচীন নামযুক্ত একটি মানচিত্র রাখা হলে মাত্র পঁচাত্তর বছর আগে গঠিত পাকিস্তান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার প্রতিবাদ জানায় - হায় এই নাকি হিন্দুরাষ্ট্র! ভারতকে বিশ্বগুরু বলে অন্যান্য দেশ আজ নতুন করে কেন মানবে? নতুন নতুন পয়সা হচ্ছে বলে, সামরিক শক্তি বাড়ছে বলে, নানা রকম জিনিষ বানাচ্ছি আর বিশ্বকে সাপ্লাই করছি বলে, অন্যতম বৃহত্তম বাজার বলে নাকি জনসংখ্যার নিরিখে সবাইকে টেক্কা দিচ্ছি বলে? এর প্রত্যেকটি বিষয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে কেউ না কেউ গত কয়েক শতাব্দী ধরে বসে আছে - তাঁদের প্রভাবে কোনো রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে কি? উপনিবেশ অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্র? তারা মানুষের বাইরেটা ছুঁয়েছে, ভেতরটা ছুঁতে পারেনি।

হিন্দুরাষ্ট্র তখনই আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে যখন ভারত তার বিশ্বগুরুর জায়গাটা ফিরে পাবে আর তার জন্য প্রথমে ভারতের আম জনতাকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হিন্দু জীবনবোধকে আত্মস্থ করে নিজেরা আগে সত্যিকারের হিন্দু হয়ে উঠতে হবে। ঋষি বলবেন 'অহম ব্রহ্মাস্মি' আর জনতা বলবে 'আয় তোর নিই' - তেলে আর জলে মিশ খাবে কি করে? আমরা যে হিন্দু সেটা যেন আমাদের আচার আচরণ আর জীবনদর্শন থেকেই বোঝা যায়। আমাদের পারিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্ষেত্রটিও যেন এমন হয় যে প্রতিটি ভারতীয় শিশুর মধ্যে আমাদের ইতিহাস, আমাদের সংস্কৃতি আর আমাদের ধর্মবোধ জন্মাবধি একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে যায়। সংবিধান তো ভারত নামক দেশের, তাতে কিছু ধারা পরিবর্তন করে কি আর কখনো হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়? এটা বালখিল্যতা।

নিজের মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষাকে অবহেলা করে ইংরেজ হতে গিয়ে বিফল হয়ে একসময় মাইকেল মধুসূদন দত্ত আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, 
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;--
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!...
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে, --
"ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে।"

কেবল 'বঙ্গ' শব্দটির বদলে 'হিন্দু' বসিয়ে দিলেই কেন আমাদের হিন্দুরাষ্ট্র আজ অলীক কল্পনামাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে আর কেন ভারতীয় উপমহাদেশে পর্য্যন্ত আজ হিন্দু সভ্যতার প্রভাব ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু, তার কারণটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই মুহূর্তে প্রথমেই একেবারে সংকল্প করে আমাদের হিন্দুদের নিজেদের অনুকরণপ্রিয়তা এবং দাস্যভাব ছাড়তে হবে। তার অর্থাৎ এই নয় যে আমাদের সভ্যতা কোনো আস্ফালনের বিষয় - ঋষিদের প্রজ্ঞার সামনে নতজানু হয়ে, তাঁদের দর্শনের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তাঁদের শিক্ষাকে নিজেদের ব্যক্তি জীবনের পাথেয় করে, নিঃস্বার্থভাবে বিশ্বসংসারের কাছে তাঁদের মহৎ বার্তা বিলিয়ে দিতে হবে। সেই বার্তাটি কি? সেই বার্তাটি হিন্দুসভ্যতার মূলমন্ত্র - ভোগ নয়, ত্যাগ।

কি ত্যাগ করবো? লোভ, স্বার্থপরতা, হিংসা। ঈশ্বর আমাদের জন্য তাঁর অসীম শক্তি সঞ্চয় করে রেখেছেন সামান্য কিছু ঘাসের বীজে বা উদ্ভিদের ফলে - যা সাধারণ খাদ্য হয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে বোধ বুদ্ধি মেধা ও চেতনায় রূপান্তরিত হয়ে আমাদের মানুষ থেকে ঈশ্বর হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আমাদের প্রাচীন কৃষি সংস্কৃতি এই দৈবশক্তিকে নতমস্তকে স্বীকার করে নেয় এবং সেখান থেকেই কৃষি রাষ্ট্র্ববাদের জন্ম। সেই সংস্কৃতিই জন্ম দেয় ঋষিদের, জন্ম দেয় দর্শনের, জন্ম দেয় আধ্যাত্মিকতার। আজ কৃষি সংস্কৃতি ও ঋষি দর্শন ভুলে আমরা হিন্দুরা এখন কি করছি? মূলত যে পরিবারিক পরিবেশ থেকে সমাজের পথপ্রদর্শক গেরুয়া বসনধারীরা উঠে আসেন, সেই পরিবেশকে আমরা বিষাক্ত করে তুলেছি। ১৯৬১ সাল থেকে  দেশে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের প্রয়োগ শুরু হয়েছে, সবুজ বিপ্লবের নামে জমিতে বিষ মেশাতে মেশাতে ধীরে ধীরে আমরা তাকে নিষ্ফলা এবং বন্ধ্যা করে তুলেছি।

ডায়ামোনিয়াম ফসফেট ব্যবহার করে করে জমির নাইট্রোজেনের ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রাকৃতিক রাইসোবিয়াম ব্যাক্টেরিয়াকে মেরে ফেলে চাষের জমিতে ফসলের নামে আজ যে বিষ উৎপন্ন হচ্ছে, তার একমাত্র এন্টিডোট হলো গোবর সার আর গোমূত্র। আমাদের খাদ্য বিষমুক্ত করতে হলে গরু চাই আর বিষমুক্ত কৃষি উৎপাদনের সাথে সর্বাঙ্গীনভাবে গরুকে জুড়তে পারলে তবেই সত্যিকারের গোরক্ষা হবে, নচেৎ নয়। উল্টে, এখন একজোড়া বলদের জায়গা নিয়েছে কেঁচোর বসবাস ধ্বংসকারী বড় দাঁতওয়ালা এক্সট্র্যাক্টর আর সুপরিকল্পিতভাবে যে গোবর আর গোমূত্র বিনাপয়শায় জমির উর্বরতার কারিগর কেঁচোর খাদ্য যোগাতো, আমরা তার যোগান বন্ধ করিয়ে দিয়েছি। কেঁচো নেই, তাই ক্ষেতে পাখি নেই, রেনুর হাওয়াই সফর বাতিল। নিজের বাড়ির নিমপাতার তেল, গোমূত্র আর বেসনের ঘোল বানিয়ে খুব কম পয়সার যে জৈবিক কীটনিয়ন্ত্রক কৃষক ব্যবহার করতেন, তার জায়গায় তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছি বিশুদ্ধ কীটনাশক বিষ, যার ফলে আর মৌমাছি এবং খাদ্যবন্ধু কীটপতঙ্গ আসে না, পরাগ বিতরণ বন্ধ, কৃষক হাইব্রিড বীজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছেন। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি পরিশুদ্ধ জলের রিসার্ভ ভারতে, রাসায়নিক ও শিল্পবর্জ্যের কল্যানে সেই জলকেও আমরা তিলে তিলে বিষাক্ত করে তুলেছি। এইভাবে কি করে আমরা বিশ্বগুরু হবো? পাপ কিভাবে পূণ্যের জন্ম দেবে?

আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে প্রতিস্পর্ধার মানক কখনোই আমাদের Dollar reserve হতে পারে না, বিশ্বস্তরে আমাদের পারস্পরিক চর্চার বিষয় হতে হবে how to attain Divinity, যা জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে ভারতের ঋষিরা হাজার হাজার বছর ধরে অনুশীলনলব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রচার করে এসেছেন। বিশ্বের কাছে ভারতের অবদান বিত্ত নয়, লোভ নয়, লালসা নয়, হিংসা নয় - তার চিরন্তন কৃষি সংস্কৃতি এবং ঋষি দর্শন। অদ্বৈত বেদান্তের আলোয় জগতপ্রসবিনী মহামায়ার বিমূর্তরূপ এই প্রকৃতি মা ও পঞ্চভূতের সংরক্ষণ এবং দুঃখবিদীর্ণ পৃথিবীতে ধর্মনির্দেশিত পথে শান্তি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির ও মোক্ষপ্রাপ্তির হদিস - এটাই হিন্দুরাষ্ট্র সংরচনার পূর্ব-পরীক্ষিত এবং সফল ভিত্তি। মায়ের কৃপায় আশাকরি শাশ্বত ভারতের চিরন্তন বসুধৈব কুটুম্বকম ভাবধারা ও সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখভাগভবেৎ মন্ত্রের অন্তর্নিহিত শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের বাণী আবার দেশকালের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং তার মাধ্যমেই আবার নতুন করে ধর্মরাজ্যরূপী ভারতকে কেন্দ্র করে হিন্দুরাষ্ট্রের উত্থান হবে।

Thursday, June 1, 2023

ইয়ে গান্ধী ঝুটা হ্যায়

একজন 'আম' ভারতীয় নাগরিক আর্মচেয়ার লালদের স্বপ্নের দেশ আমৃগা গেছেন, ওখানে তাঁর ভরণপোষণ করছে IAMC - Indian American Muslim Council - যার মধ্যে ভারতীয় মূলের সদস্য কম এবং পাকিস্তানী মূলের এবং Muslim Brotherhoodএর প্রতিনিধিত্বই বেশি, যাঁরা ভারতীয় জাতীয় সংগীত বাজলে উঠে দাঁড়িয়ে দেশকে সন্মান জানাতে বিমুখ।

এই 'আম' যখন 'খাস' ছিলেন তখনো যে ধরণের আমৃগী আতিথ্য পেতেন, মানে শহরের মেয়র টেওর এসে খাতিরদারি করতেন, পাকিস্তানিমূলের জামাত-এ-ইসলামীর সমর্থক ইমাম জাভেদ আহমেদের নেতৃত্বাধীন ICNA - Islamic Circle of North America লোক জোটাতে সাহায্য করতেন, ওদেশের রাজ্য ও জাতীয়স্তরের কয়েকজন মার্কামারা 'মানবাধিকারকর্মী' 'গণতন্ত্রপ্রেমী' জনপ্রতিনিধিরাও ওঁর সঙ্গে দেখা করে 'অনুপ্রেরণা' দিতেন, এবারেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। 

উনি যথারীতি ভারতে ইসলামোফোবিয়া যে কি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তার বর্ণনা করছেন, তাঁর দল পরপর হিমাচল এবং কর্ণাটক জেতার পরেও ভারতে গণতন্ত্র কতটা বিপন্ন তা পাশ্চাত্যবাসীদের বুঝিয়ে বলছেন এবং দেশের লোককে ভুল বুঝিয়ে এখন কতটা বেশি হিন্দুত্ববাদী করা হচ্ছে তার প্রমাণ দিচ্ছেন, ইত্যাদি। উনি ওনার জন্য নির্দিষ্ট কাজ করছেন, তাতে আর কার কিই বা বলার থাকতে পারে? 

এর সাথেই ছোট্ট একটা খবর দিয়ে রাখা উচিত বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে আগামী বছর জানুয়ারি - ফেব্রুয়ারি নাগাদ জাতীয় নির্বাচন। আমৃগা অনেকদিন ধরেই চাইছে বাংলাদেশে একটা নিজস্ব মিলিটারি বেস তৈরি করতে কারণ মায়ানমারের মিলিটারি শাসকরা সব চীনের পোষ্য এবং ভবিষ্যতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চীন চাইলেই মায়ানমারের মধ্যে দিয়ে বঙ্গোপসাগর পর্য্যন্ত পৌঁছে যেতেই পারে। 

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আমৃগা বাহাদুরকে সেই জায়গাটা দিতে নারাজ, উনি চীনকেও চটাতে চান না আর অন্যের যুদ্ধে আব্দুল্লা দিওয়ানাও হতে চান না। ওনার দলের শীর্ষনেতৃত্বের ওপর বাঙালিত্বের প্রভাব ইসলামিক কট্টরপন্থার চেয়ে ঢের বেশি, ফলে জামাত-এ-ইসলামীর থেকে ওনারা যতটা দূরে, ওঁর প্রধান প্রতিপক্ষরা ততটাই ওই জিহাদিদের কাছাকাছি। 

বস্তুতঃ, ওঁর প্রধান প্রতিপক্ষ পাকিস্তানি সেনা এবং ISIএরও খুবই ঘনিষ্ঠ। আর যেখানেই কট্টরতা, সেখানেই অস্থিরতা। আর যেখানেই অস্থিরতা সেখানেই দুহাতে দুই মোক্ষম অস্ত্র democracy আর human rights নিয়ে আমৃগা বাহাদুর আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা ঢুকে পড়ার সুযোগ পেয়ে যান। শেখ হাসিনার সরকারকে যে ভারত পছন্দ করে এবং সর্বতোভাবে সাহায্য করে, সেটা আমৃগা বাহাদুরের একেবারেই না-পসন্দ।

ইদানিং আমৃগা বাংলাদেশের democracy নিয়ে খুবই চিন্তিত এবং বেগম হাসিনাকে আগামী নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার দল যাতে অংশগ্রহণ করে, সেটা সুনিশ্চিত করতে বাণিজ্যকে হাতিয়ার করে বিস্তর চাপে রেখেছে। একইসাথে তারা ভারতকে NATO+ এ অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে যাতে বকলমে মায়ানমারের কাছাকাছি কোনো বাংলাদেশি পোর্টে NATOর কোনো বন্ধুদেশ একটা সামরিক বেস গড়ে তুলতে পারে।

বাংলাদেশে ভারতের permanent সামরিক বেস ১৯৭১এই গড়া উচিত ছিল, কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। আর কয়েকদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী স্টেট ভিসিটে আমৃগা যাচ্ছেন, তাতে ভারত এবং আমৃগার মধ্যে যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের দেওয়াল এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তাতে চিড় ধরবে কিনা দেখা যাক। এই যে মাঝেমাঝেই অমুক ইন্ডেক্স আর তমুক ইন্ডেক্সে অহেতুক মিথ্যে মান দিয়ে বালখিল্যের মতন চিমটি কাটা হয়, সেগুলো বন্ধ হলে খানিকটা আভাস পাওয়া যাবে।

অবশ্য আমৃগা ভারতীয় উপমহাদেশে IAMC নামক যে ইসলামী ব্রহ্মাস্ত্রটি ব্যবহার করে থাকে (বা ক্ষেত্রবিশেষে আমৃগাস্থিত The Federation of Indian American Christian Organizations - FIACONA), তাদের আতিথ্য উপভোগ করে এবং 'বন্ধুদের' দ্বারা 'অনুপ্রাণিত' হয়ে তার আগেই আমাদের 'আম' আদমি দেশে ফিরে আসবেন। 

আমৃগা কেবল নিজের interest দেখে, তাতে বাংলাদেশ আর পাকিস্তান জিহাদিদের হাতে গিয়ে পড়লো বা না পড়লো তাতে তাদের কিছু আসে যায় না।  ভেতরে ও বাইরের জামাতিদের দিয়ে একদিকে যেমন ভারতকে প্রচন্ড চাপে রাখতে হবে যাতে একেবারে লাগামছাড়া হয়ে না যায়, অন্যদিকে চীনের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলে ভারতের মতন একজন বলিষ্ঠ সহযোগীও চাই - কি বিড়ম্বনা! 

আর যদি দেশহিতে ভারত আমৃগার পছন্দের সময় মাঠে নামতে অস্বীকার করে, তাই আমৃগার পা-চাটা প্রধানমন্ত্রীও চাই আবার পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশে নিজেদের সামরিক বেসও চাই। এখন, আমৃগার এই গোটা planটাকে handle করার জন্য সবচেয়ে আগে চাই একজন conduit - তাই কখনো দাঁড়ি বাড়ছে কখনো কমছে, কখনো পৈতে দেখা যাচ্ছে কখনো টুপি। কিন্তু গোটাটা ঘেঁটে দিয়ে মাঝখানে একটা অসম্ভব জনপ্রিয় ঝঞ্ঝাটে বুড়ো ক্রমাগত ব্যাগড়া দেওয়ার ফলে আখেরে বাহাদুরের কাজের কাজ আর হচ্ছে কই?