পৃথিবীকে মাতৃরূপে দেখা আমাদের সংস্কৃতির বহু প্রাচীন এক পরম্পরা। সেই কবে অথর্ব বেদের দ্বাদশ কাণ্ডে প্রথম অনুবাকের প্রথম সূক্ত হিসেবে ৬৩টি মন্ত্রের সমাহারে 'পৃথ্বী সূক্তম্' বা 'ভূমি সূক্তম্' প্রকাশ করেছিলেন ঋষি অথর্বা, তারপর প্রকাশিত হয়েছিল তৈত্তিরীয় সংহিতা ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণম্-এ 'ভূ সূক্তম্', তাতেও ভূমি মাতা হিসেবে বর্ণিতা। ওই সময়ই বৈদিক সাহিত্যে প্রথম ধ্বনিত হলো সেই বিখ্যাত বাক্যবন্ধ, 'মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিব্যা' - বসুন্ধরা আমাদের মাতা আর আমরা সব তাঁর সন্তান। অতঃপর ওই সূক্তের শ্লোকে শ্লোকে ঋষি মাতৃরূপী পৃথিবীকে বন্দনা করে অনেক রকমের বর চাইলেন।
সূক্ত শুরু হচ্ছে এই পৃথিবীমায়ের বুকে যেন আমরা যথাযথ স্থান পাই, সেই প্রার্থনা দিয়ে। ঋষি বলছেন,
সত্যং বৃহদৃতমুগ্ৰং দীক্ষা তপো ব্ৰহ্ম যজ্ঞঃ পৃথিবীং ধারয়ন্তি।
সা নো ভূতস্য ভব্যস্য পরুং লোকং পৃথিবী নঃ কৃপোতু।।
অর্থাৎ, সত্য, ব্রহ্মাণ্ডের দিব্য নিয়মাবলী, দীক্ষা, ব্রহ্মের খোঁজে তপঃ ও আত্মসমর্পণ এবং যজ্ঞ - এগুলোই পৃথিবীর ধারক আবার পৃথিবীও এদের ধারণ করে আছেন।
তিনি, যিনি আমাদের অতীত এবং ভবিষ্যতের সাক্ষী, সেই পৃথিবী যেন আমাদের জীবনকে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিস্তৃত করেন।
তারপর ছত্রে ছত্রে সন্তান হিসেবে মায়ের কাছে তাঁর আবদার ফুটে উঠেছে। মূল সংস্কৃত শ্লোকসমূহের মধ্যে না ঢুকে সূক্তটির সারাংশ মোটামুটি এইরকম: "সর্বসাধন-সামর্থ-সম্পন্না পৃথিবী আমাদের কামনা পূর্ণ করুন। পৃথিবী আমাদের গো ও অন্নযুক্ত করুন। জগৎ সংসারের আশ্রয়ভূত অগ্নির ধারয়িত্ৰী পৃথিবী আমাদের কৃষিজাত নানাবিধ দ্রব্যাদি প্রদান করুন। দেবরক্ষিত পৃথিবী আমাদের রাষ্ট্রবল, মধুর-ধন এবং তেজঃ, ও ঐশ্বর্য প্রদান করুন।…যে পৃথিবীকে অশ্বিনীকুমারদ্বয় নির্মাণ করেছিলেন, যাঁর উপর বিষ্ণুদেব বিক্রমণ করেছিলেন, ইন্দ্র যাঁকে আপন অধিকারভুক্ত করে শত্রুহীন করেছিলেন, সেই পৃথিবী, মাতা কর্তৃক পুত্রকে দুগ্ধ পান করানোর মতো, আমাদের সার রূপ জল প্রদান করুন।"
"পৃথিবীর স্থাবর জঙ্গম সব কিছুই আমার সুখপ্রদ হোক। আমি বহু-রত্ন-শালিনী ইন্দ্রগুপ্তা পৃথিবীতে ক্ষয়রহিত ও পরাজয়রহিত হয়ে যেন সদা প্রতিষ্ঠিত থাকি। আমাদের শত্রুগণ পৃথিবী কর্তৃক বিনষ্ট হোক সূর্য-রশ্মিসমূহ আমাদের নিমিত্ত প্রজা (সন্তান) ও মৃদুল বানীকে দোহন করুক। পৃথিবীর সকল দিক আমাকে বিচরণ-শক্তি প্রদান করুক, পৃথিবী সকল দিক হতে আমাকে রক্ষা করুন।…যে পৃথিবী ইন্দ্রকে বরণ করেছিলেন, যিনি বীর্যবানের অধীনে অবস্থান করেন, যার উপর বেদমন্ত্রের ধ্বনি (বা গান) উৎসারিত হয়, যেস্থানে সোমপান হয়, যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, দেবপূজন হয়, সেই পৃথিবী আমাদের অভীষ্ট ধন প্রদান করুন।…হে পৃথিবী! গ্রাম, জঙ্গল, সভা, যুদ্ধ-মন্ত্রণা, যুদ্ধ ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই আমরা তোমার বন্দনা করছি। …হে পৃথিবীমাতা! আমরা তোমাকে হবিঃ প্রদান করছি! আমরা যেন রোগরহিত হই, দীর্ঘায়ু হই, মঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত থাকি।"
এই যে ভারতীয় দর্শনের আধ্যাত্মিক মূলধারার সাথে জাগতিক অস্তিত্বের সুদৃঢ় বন্ধন, এটাই সভ্যতা হিসেবে আমাদের সমস্ত সমসাময়িক সভ্যতার চেয়ে বৌদ্ধিকস্তরে উন্নততর করে তুলেছিল। আমরা যখন মাতৃরূপা পৃথিবীর ধারক হিসেবে একাধারে সত্য তপঃ দীক্ষা ইত্যাদির কথা চিন্তা করছি তখন একইসাথে তাঁর পবিত্রতা ও বিশালতাকে আশ্রয় করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার ইচ্ছাও ব্যক্ত করছি, এটা মানুষের বোধ একটা বিশেষ পর্যায়ে না পৌঁছলে কল্পনা করাই সম্ভব নয়। এই যে ধর্মকে মুলাধার করে ধর্মপথে অর্থ এবং কাম চরিতার্থ করে, তাকে পরিবার প্রতিপালন এবং লোকহিতে ব্যয় করে শেষে জাগতিকভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে সংসার ত্যাগ করে মোক্ষলাভ অর্থাৎ আত্মজ্ঞানলাভের যাত্রায় বেরিয়ে পড়া, এটাই আমাদের সামাজিক জীবনের এক আশ্চর্য্য সমাপতন যেখানে ব্রহ্মও সত্য আবার জগৎও সত্য কারণ সবটাই ওই একই অনন্তের ভিন্ন রূপ।
তাই যখন সুদূর আমেরিকার সংসদ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে 'কৃষি ও ঋষি যাত্রা'র মূলমন্ত্র 'মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিব্যা' উচ্চারিত হতে শুনি তখন মনে হয় কোথায় যেন প্রাচীন ভারতের ঋষির শাশ্বত বাণী আজকের বিশ্বকে ধর্মপথ দেখাতে আবার উদ্যোগী হচ্ছে; কোথায় যেন এই পৃথিবীমায়ের সন্তানরা কয়েক দশকব্যাপী অত্যধিক লোভ লালসাদুষ্ট যাপনের উর্দ্ধে উঠে আবার সেই প্রাচীন ভারতীয় কৃষিসংস্কৃতিকে অবলম্বন করতে চলেছেন - যে সংস্কৃতি বলে শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ - গোটা পৃথিবীজুড়ে সবই অমৃতের সন্তান - এই বিশ্ব সবার, এর প্রাকৃতিক সম্পদ সবার, এখানে সবার জন্য আহার আছে, দৈবের কৃপায় আহারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুস্বাস্থ্য ও বৌদ্ধিক চেতনা আছে, মাতা পৃথিবী ওপর সমস্ত জীবের সমান অধিকার আছে - তোমরা লোভ করো না, পরিবেশ, খাদ্য ও পানীয়কে বিষিয়ে দিও না, সবাই মিলেমিশে থাকো, সুখে থাকো, শান্তিতে থাকো, ধর্মপথে থাকো, অল্পে সন্তুষ্ট থাকো, আনন্দে থাকো।
No comments:
Post a Comment