শুদ্ধতা
শুদ্ধ অন্ন, শুদ্ধ চিন্তা আর শুদ্ধ জীবন - এগুলি পরপর ঠিক এই ক্রমেই চলে। অর্থাৎ শুদ্ধ অন্ন ছাড়া শুদ্ধ চিন্তা করার আত্মিক শক্তি জুটবে না, আর শুদ্ধ চিন্তা না করতে পারলে শুদ্ধ জীবনযাপন সম্ভব নয়। শুদ্ধ মানে কি? শুদ্ধ শব্দটি একটি বিশেষণ, বিশেষ্য নয়। অর্থাৎ অশুদ্ধ থেকে শুদ্ধ হতে হয়, তা সে জড়ই হোক বা চেতন। শুদ্ধ মানে শুচি, পবিত্র, যে গুণটি কোনো এক বিশেষ শোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। বস্তুত শুদ্ধ হওয়াটা একটা পরিণতি, যদিও ভগবৎকৃপায় কেউ কেউ জন্মশুদ্ধও হন। শ্রীশ্রীমা একজন মহিলার শুদ্ধতার প্রসঙ্গক্রমে একবার একটি মন্তব্য করেছিলেন, যা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত শুদ্ধস্বত্তারই পরিচায়ক, "এ মেয়ে শুদ্ধমতি, বড় সরল। এরকম ক্বচিৎ দেখা যায়।... একরকম মেয়ে আছে, মন তা'র সদাই ভোগে আবদ্ধ আবার একরকম আছে, শত সেজেগুজে থাকুক, সে যেন আগলা সাজ, মনের আসক্তি তা'তে নেই। এ মেয়ে সে জাতের।... জামাসেমিজ সাজসজ্জায় কিছু শুচিতা রক্ষে হয় না। নারী শুদ্ধ থাকে যদি তার দেহমন শুদ্ধ থাকে। সারাটি জীবন যদি শুদ্ধ থাকে, তবেই তো তা'কে বলি সতী।..."
শুদ্ধ অন্ন কি? এর মূলত তিনটি দিক আছে। এক, যে অন্ন মেহনতের কামাই, চুরি বা ছিনতাই করে বা কাউকে ঠকিয়ে জোগাড় করা নয়। দুই, যে অন্ন বিষমুক্ত, প্রাকৃতিক, অর্থাৎ যা শরীরে প্রবেশ করে দৈবনির্ধারিত শক্তি সঞ্চারণ করতে পারে এবং শারীরিক পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্য প্রদানের সাথে সাথে মানসিক শান্তি ও বিকাশের সহায়ক হয়। আর তিন, যে অন্ন স্বাত্বিক। সাত্ত্বিক শব্দটির উদ্ভব মূল সংস্কৃত শব্দ সত্ত্ব থেকে, যার অর্থ হলো ধার্মিকতা, ইতিবাচকতা, সত্য, শান্ততা, ভারসাম্য, শান্তিপূর্ণতা, এবং মহত্ত্বের গুণ যা মানুষকে ধর্ম ও জ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়। ফলে স্বাত্বিক আহার এমন আহার যা মানুষের মনের মধ্যে তিনটি গুণের মধ্যে থেকে উচ্চতম সত্বগুণটিকে জাগিয়ে তোলে, যা সত্যনিষ্ঠ, শান্ত ও সৎ হওয়ার দৈবশক্তি প্রদানকারী। যে অন্ন নিশ্চিন্তে ঈশ্বরকে নিবেদন করা যায় এবং তাঁর প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করা যায় তাই শুদ্ধান্ন।
শুদ্ধান্ন থেকে জন্ম নেয় শুদ্ধ চিন্তা। যেহেতু শুদ্ধ অন্নের মধ্যে দৈব শক্তি নিহিত থাকে, ধীরে ধীরে সেই শক্তি মনের মধ্যে ধর্মবোধ জাগিয়ে তোলে। আর যত বেশি অধর্মের প্রতি বিরূপতা জন্মায় তত বেশি মন অন্যায় এবং কুকর্ম করতে অসমর্থ হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে একজন ঘোর সংসারী জাগতিক লাভ লোকসান সচেতন মানুষও দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনের চাহিদা মেটানোর জন্য কেমন জানি অনুপযুক্ত হয়ে পড়েন। আর যত তিনি পারিপার্শ্বিক জাগতিক কূটকচালি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তত তিনি অন্তর্মুখী হতে থাকেন এবং তাঁর মনের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে এমন কিছু প্রশ্ন জাগতে শুরু করে যার উত্তর এই শুকনো ইঁট কাঠ পাথরের বাসিন্দা দুনিয়াদারেরা দিতে একেবারেই অপারগ। এতদিনের যাপনটি তাঁর যেন কেমন বেমানান লাগতে শুরু করে। আর এই জীবনজিজ্ঞাসা থেকেই ধীরে ধীরে মনের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার পাপড়ি মেলা শুরু হয়। এই পথ যেহেতু একেবারে আলাদা এবং এযাবৎ অনস্বাদিত হওয়ার কারণে অচেনাও, এই বিন্দু থেকেই শুদ্ধ জীবন শুরু হয়।
শুদ্ধ জীবন মানে সাধকের জীবন। সাধক মানেই গভীর জঙ্গলে গিয়ে কৌপিন পরে চব্বিশঘন্টা ধ্যানে ডুবে থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। জ্ঞানত কোনো কুচিন্তা করবো না, কুকথা বলবো না, কুকাজ করবো না আর কুসংসর্গে পড়বো না - এটুকু দিয়ে শুরু করতে পারলেই বিকল্প কি তা আপনেআপই স্পষ্ট হয়ে যাবে। সুচিন্তার জন্য উপযোগী যা কিছু আছে - পড়া, শোনা, দেখা, ভাবা ইত্যাদি, সে সবকে অঙ্গীভূত করা আর যা কিছু ক্রুর, যা মনকে বিচলিত করে, সে সব থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকা। নেহাতই কুচক্রী ব্যক্তি ছাড়া, সাধারণত আমরা আগে যা ভাবি পরে তাই তো বলি, ফলে কুচিন্তা ত্যাগ করতে পারলে কুকথাও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। কথায় বলে 'সন্ন্যাসীর রাগ জলের দাগ' - ওঁদের কটুকথা গায়ে মাখতে নেই কারণ তার মধ্যেও বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়র ভাবনা অন্তর্নিহিত থাকে। আমরা কিন্তু সন্ন্যাসী নই, ফলে আমাদের বলা কথা যেন কাউকে বা কারো স্বার্থকে আঘাত না করে, নিজেদের জিবের ওপর রাশ যেন নিজেদের হাতেই থাকে, এটা সুনিশ্চিত করাটা খুবই জরুরি। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা না বলা আর বললেও সেই কথা যেন কড়া না হয়, তাতে যেন কারো অস্বস্তি না হয়, সেই কথা যেন হিতকারী হয়, তাতে যেন তেতে থাকা পরিস্থিতি শান্ত হয়ে ওঠে, এটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত। কথা হোক নিজের সাথে, বাইরের সাথে নয়।
সুকাজ কি? যে কাজ যুগপৎ উপযোগী এবং উপকারী। স্বামী বিবেকানন্দ এক কথায় এই সুকাজকে সংজ্ঞায়িত করে গেছেন - 'আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ' - যে কাজে নিজের মোক্ষলাভও হবে আবার জগতের কল্যাণও হবে। অর্থাৎ জপ ধ্যান সাধনার দ্বারা নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া এবং সেইসাথে শিবজ্ঞানে জীবসেবা। এই পথের শুরু থেকে শেষ, স্বামীজী যাকে বলতেন প্র্যাকটিক্যাল বেদান্ত, তার গোটা প্রক্রিয়াটির প্রেসক্রিপশন স্বামীজী স্বয়ং করে দিয়ে গেছেন, ফলে তাঁর বাণী ও রচনা পড়লেই ধারণাটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর একবার এই ধারণাটি আত্মস্থ করে নিলে জীবনে কুকাজ করার স্পৃহা বা প্রয়োজনীয়তা কোনোটাই আর থাকবে না। এরপর আসে সাধুসঙ্গ। কুসংসর্গ ত্যাগ করার পরেই মন সাধুসঙ্গের দিকে ঘুরে যায় কারণ তখন মনের খিদেটা ১৮০° পাল্টে যায়। ভক্ত শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে জিজ্ঞেস করছেন, সাধুসঙ্গে কি উপকার হয়? শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, "ঈশ্বরে অনুরাগ হয়। তাঁর উপর ভালবাসা হয়। ব্যাকুলতা না এলে কিছুই হয় না। সাধুসঙ্গ করতে করতে ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়। যেমন বাড়িতে কারুর অসুখ হলে সর্বদাই মন ব্যাকুল হয়ে থাকে, কিসে রোগী ভাল হয়।... সাধুসঙ্গ করলে আর একটি উপকার হয়। সদসৎ বিচার। সৎ — নিত্য পদার্থ অর্থাৎ ঈশ্বর। অসৎ অর্থাৎ অনিত্য। অসৎপথে মন গেলেই বিচার করতে হয়। হাতি পরের কলাগাছ খেতে শুঁড় বাড়ালে সেই সময় মাহুত ডাঙস মারে।”
এরপরেও যদি কারো মনে আশঙ্কা থাকে যে এযাবৎ এত অশুদ্ধ জীবন যাপন করেছি, এখন, এই বয়সে এসে কি আর জীবনের মোড় ঘোরানো সম্ভব? শ্রীশ্রীমা তার উত্তর দিয়েছেন। প্রথমে নিজেকে ইঙ্গিত করে মা অভয় দিয়ে বলেছেন যে মা থাকতে আবার ভয় কি? আর তারপর আরো ভরসা দিয়ে বলেছেন, "জীবনে যা কিছু অন্যায় ক'রে ফেলেছো, শৌচাদির যেমন কেহ হিসাব রাখেনা, তেমনি ও সবের আর কোন হিসাব না রেখে, কোন চিন্তা মনে না এনে, সরলভাবে শ্রীশ্রীঠাকুরের চরণে মন দাও।" এরপর তো আর কোনো আশঙ্কার অবকাশ থাকেনা রে ভাই। আমাদের সংস্কৃতিতেই তো বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাসের বিধান আছে, যা আজকের প্রেক্ষাপটে সংসারে থেকেও নিজেকে নিস্পৃহ এবং নির্লিপ্ত রেখে পালন করা যায়। যব জাগো তব সভেরা।
No comments:
Post a Comment