Monday, June 12, 2023

আমাদের ভারত


জম্বুদ্বীপে ভারতখণ্ডে আর্য্যবর্তে ভারতবর্ষে...

আমরা যদি ভারতবর্ষের মানচিত্র দেখি, তাহলে দেখবো যে দেবাত্মা হিমালয়ের কোল থেকে নেমে সিন্ধুর দিকে এগোতে এগোতে ধীরে ধীরে এই পূণ্যভূমি প্রথমে চওড়া হয়েছে আর তারপর যত সে জলের দিকে এগিয়েছে তত সে একীভূত হতে হতে শেষে ধানসকড়িতে একটি বিন্দুতে গিয়ে মিশেছে। যতক্ষণ এই দেশের বিস্তার ততক্ষণ সে ভূমির সাথে যুক্ত। আর যে মুহূর্তে সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে ওমনি তাকে আড়াল করতে, বা বলা ভালো আগলে রাখতে, তিনদিক থেকে জলসিন্ধু ঘিরে ধরেছে। আমরা যদি কোনো মহাত্মাকে আগে শিষ্যপরিবৃত অবস্থায় দেখি আর তারপর তাঁকে ধীরে ধীরে বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে শেষে ধ্যানমুদ্রা ধারণ করতে দেখি তাহলে তাঁর এই অবস্থান্তরের মধ্যেও ঠিক যেন ভারতবর্ষের ভৌগোলিক বৈশিষ্টটিকেই দেখতে পাবো। 

এই যে ভারতে এত সাধু মহাত্মা ঋষিদের জন্ম, এই যে এই ভূমিতে বেদের সাক্ষাৎ দর্শন, এই যে ভারতের সুপ্রাচীন আধ্যাত্মিক পরম্পরা, এই যে এখানে এতগুলি উদার, মানবিক ও সর্বসমাবেশী পন্থের জন্ম ও বৃদ্ধি,  এই যে এইখান থেকে সারা বিশ্বজুড়ে জীবনযাপনের মানক হিসেবে সনাতন ধর্মের তত্ব ছড়িয়ে পড়া - এসব কি এমনি এমনি হয়েছে? এ দেশের দৈহিক গঠনের মধ্যেই ঈশ্বরীয় ইচ্ছা প্রকাশিত, ফলে আমরা যখন ভারতকে পূণ্যভূমি বলি তখন সেটি বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নয়। সারা বিশ্বে গণিতশাস্ত্র থেকে নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে নিয়ে কলাতত্ব, ধর্মবোধ থেকে নিয়ে নানান দর্শন - সভ্যতার অগ্রগতি এবং আধ্যাত্মিক চেতনা বিকাশের জন্য গোটা মানবজাতির যখন যেমন জ্ঞানপিপাসা জেগেছে, তা মেটানোর উপাদান এই পুণ্যভূমিতে সৃষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভারতের যে জীবনদর্শন তা চারটি মূল ক্রমান্বয়ী সূত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে - ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ। আবার ভারতের মানচিত্রের দিকে তাকানো যাক। শিয়রে দেবভূমি হিমালয় - ধর্ম। তারপর ভূবিস্তার - অর্থ এবং কাম। তারপর একটি বিন্দুতে গিয়ে বিলয় - মোক্ষ। এই ভৌগোলিক বৈচিত্র্যকে অন্যভাবেও দেখা যায়। ভারতীয় দর্শনের তিনটি মূল ধারা, যাকে গল্পচ্ছলে শ্রীরামকৃষ্ণদেব সহজ করে বুঝিয়েছিলেন, "রামকে হনুমান বলেছিলেন, ‘রাম, কখন ভাবি তুমি পূর্ণ, আমি অংশ; তুমি প্রভু, আমি দাস; আর যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি তুমিই আমি, আমিই তুমি।’ এই তিন অবস্থার নাম দ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত এবং অদ্বৈত। যেখানে দেবাত্মা হিমালয়ের সাথে সমতলের যোগ সেখানে 'তুমি পূর্ণ, আমি অংশ'। যেখানে দৈহিকভাবে পূর্ণ বিস্তার কিন্তু একটি অখন্ডভূমির অংশবিশেষ বোধ প্রবলভাবে বিদ্যমান সেখানে 'তুমি প্রভু, আমি দাস'। আর যেখানে একটি বিন্দুতে সমাগত, যেখানে আর পূর্ব-পশ্চিম নেই, পৃথক প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক পরিচয় নেই, যেখানে গোটা ভারত অভিন্ন, অভেদ, অদ্বৈত, সেখানে 'তুমিই আমি, আমিই তুমি'।

ভারতবর্ষকে আর পাঁচটা দেশের মতন ভাবলে ভুল হবে কারণ ভারত ধর্মের রক্ষক। ধর্ম যে ভারত নিজের বুদ্ধিতে আবিষ্কার করেছে তা তো নয়, ভারতের শরীর ও মন বলে দিচ্ছে যে যেমন মানুষের শরীর ও মন অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় চেতনার বিকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত, ঠিক তেমনই ঈশ্বরের ইচ্ছায় বিশ্বের বাকি সমস্ত দেশের নিরিখে ভারত বৌদ্ধিকভাবে ধর্মের ভাব গ্রহণ করার সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত বলেই এই পূণ্যভূমিতে ধর্মের উদয় হয়েছে। একমাত্র এইজন্যই হাজার বছর ধরে ক্রমাগত আক্রমণ ও অধীনতার চক্রবুহ্য রচনা করেও দৈহিক বলশালীরা এই বৌদ্ধিক জাতির অস্তিত্বগত বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করতে পারেনি। কালক্রমে ভারত নামক প্রাচীন রাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে খন্ড বিখন্ড হয়েছে কিন্তু ভারতের শারীরিক বৈশিষ্ট্য যেমন আজো অক্ষুন্ন আছে, তেমনিই ভারতের অন্তরাত্মাও খণ্ডিত হয়নি, সেটি আজো ধর্মাশ্রয়ী। আসলে যা দৈবনির্ধারিত তাকে পাল্টাবার ক্ষমতা যে সামান্য মনুষ্যজাতির নেই।

ভারত কেবল ঋষিদের দেশ নয়, ঋষিতুল্য দেশ। জগতের কল্যাণ করার জন্যই ভারতের জন্ম এবং কলিকালের অন্তে জগতের কল্যাণের জন্যই বিশ্বশক্তি হিসেবে ভারতের উদয় আসন্ন। এর আগে আমরা নানা শক্তিশালী দেশকে পৃথিবীজুড়ে তান্ডব করতে দেখেছি - ইতিহাসের বিভিন্ন কালখণ্ডে কেউ পন্থীয় প্রেরণায় বিশ্বজয় করতে বেরিয়েছে, কেউ রাজশক্তির প্রতিষ্ঠাকল্পে ঔপনিবেশিক মহাশক্তি হয়ে উঠেছে, কেউ ভয় দেখিয়ে বিশ্বকে পদানত করেছে আর কেউ বা লোভ দেখিয়ে। এবার ভারতের সময় আগত, ভারত কি সেই রাস্তাতেই হাঁটবে যে রাস্তায় বাকি বলশালীরা হেঁটেছিল? কখনোই না, কোনো অবস্থাতেই না। না তো ভারত কাউকে ভয় দেখাবে, না ভারত কারো সাথে প্রতারণা করবে। বিশ্বশক্তি ভারতকে মানুষ শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে, অনুসরণ করবে, অনুকরণ করবে। বিশ্বজোড়া মহামারীর সময় অসমর্থের ত্রাতা হিসেবে নিজের ভূমিকা পালন করার ভারত তার সেই শাশ্বত জীবনবোধকে আবার নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরেছে - বসুধা এব কুটুম্বকম্ - গোটা বসুধা প্রকৃতপক্ষে একটাই পরিবার - 'বসুধৈব কুটুম্বকম্'। ভারত তার অনুভূতিলব্ধ ঋষিদর্শনকে ভিত্তি করে আবার জোরগলায় সবাইকে বুকে টেনে নিয়ে বলছে, 'শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা' - সমস্ত বিশ্বজুড়ে সবাই অমৃতের সন্তান - কেউ পর নয়, সবাই আপন। এক ভারত, শ্রেষ্ট ভারত।

No comments:

Post a Comment