Friday, June 2, 2023

হিন্দুরাষ্ট্র



কিছু মানুষ কেন যে এই মুহূর্তে হিন্দুরাষ্ট্র হিন্দুরাষ্ট্র করে বৃথাই চেঁচাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। রামরাজ্য বা ধর্মরাজ্যের অবধারণা ছেড়ে একেবারে সোজাসুজি হিন্দুরাষ্ট্র! আমাদের দেশ আছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্র কোথায়? ভারত এক প্রাচীন সভ্যতার জন্মভূমি, পর্যটক ও পড়শীরা যার ভূমিপুত্রদের নাম দিয়েছিলেন 'হিন্দু'। ফলে ভারত হিন্দুদের দেশ এই সত্যটি তো অনস্বীকার্য, তা সে ভারতীয়দের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত পূজা পদ্ধতি যার যাই হোক না কেন। হ্যাঁ, অবশ্যই বিদেশি আক্রান্তারা বারেবারে এই সভ্যতাকে ধ্বংস করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে এবং পৃথ্বীরাজ চৌহান থেকে নিয়ে শিবাজী মহারাজ, লচিত বরফুকুন থেকে নিয়ে মহারাজা রণজিৎ সিংরা তাদের প্রতিহত করেছেন, পরাজিত করেছেন, নানা সময়ে তাঁরা হিন্দু-পাদ-পাদশাহী বা হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতেই চেয়েছেন। কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্র?

প্রাচীনকালে হিন্দু সভ্যতা যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাতে নানা দেশ, নানা বেশ, নানা বর্ণ, নানা পন্থ, নানা ধরনের স্থানীয় মান্যতা ইত্যাদি সমবেশিত হয়ে এবং সেখানকার বাসিন্দারা হিন্দু সভ্যতার সর্বসমাবেশী দার্শনিক, বৌদ্ধিক এবং সামাজিক ভাবকে আত্মসাৎ করার ফলে যে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক হিন্দুরাষ্ট্ৰচেতনার সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি আজ বিক্ষিপ্ত এবং অসংহত, এই সত্যটিকেও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

আমি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে এই প্রাচীন রাষ্ট্রের অবশিষ্টাংশ দেখেছি, আর দেখেছি জাভায়, ক্যাম্বোডিয়ায়, চীনে, পাকিস্তানে, বাংলাদেশে, মায়ানমারে, শ্রীলঙ্কায়, মরিশাসে, ফিজিতে আর সেনেগালে। হয়তো বিশ্বের আরো অনেক দেশে এই প্রাচীন সভ্যতার প্রভাবের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে, হয়তো এক সময় সে সব দেশের বাসিন্দারা মানসিকভাবে হিন্দুত্বের সঙ্গে জুড়ে ছিলেন, কিন্তু আমার নিজের চোখে তা দেখা হয়নি। আমি যাঁদের দেখেছি তাঁদের মধ্যেও এক রাষ্ট্র - এক সংস্কৃতি - একতার যে বৈচারিক মানসিক এবং সামাজিক পরিকাঠামো - সেটি আর খুব সক্রিয়ভাবে অবশিষ্ট নেই। আর যেখানে রাষ্ট্র্ববোধ নেই সেখানে রাষ্ট্রবাদও নেই। 

ইদানিং একটি বৈষ্ণবীয় যাজকসম্প্রদায়ের কল্যাণে অন্যতম এক Indic পন্থের যে প্রভাব এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা দেশে দৃশ্যমান, তার সাথে কিন্তু বহুমাত্রিক হিন্দুরাষ্ট্রীয় চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই। ওটি অন্যান্য যাজকবৃত্তির প্রভাবেরই সমকক্ষ, যদিচ এঁদের প্রভাববিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা, হিন্দু দর্শনের একটি বিশেষ ধারা এবং হিন্দু সংস্কৃতি ও লোকাচারের কিছু কিছু বিশিষ্ট দিক সম্পর্কে নিঃসন্দেহে বিশ্ব নতুন করে অনুসন্ধিৎসু হয়েছে। বরং এমন কিছু কিছু হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছেন যাঁরা বিদেশিদের পন্থের বদলে সনাতন ধর্মবোধ ও দর্শন শেখাচ্ছেন, তাঁদের প্রভাব হয়তো এতটা বিস্তৃত নয় কিন্তু বৌদ্ধিকভাবে অনেক বেশি গভীর। সেইখান থেকে কোনো একদিন হিন্দু রাষ্ট্রবোধের উদয় হওয়াটা হয়তো অস্বাভাবিক নয় কারণ সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদ মুলত একটি বৌদ্ধিক এবং বৈচারিক উপলব্ধি। 

এখন প্রশ্ন হলো হিন্দুরাষ্ট্র বলে গলার জোরে চেঁচালেই কি আবার দিগ্বিদিকে সেই প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐক্যবন্ধন রাতারাতি গড়ে উঠবে না হিন্দুরাষ্ট্রের পুনঃস্থাপনা হয়ে যাবে? আমাদের সাধকশ্রেষ্ঠ ঋষিরা তাঁদের গভীর ধ্যানলব্ধ উন্নততম দার্শনিক তত্বজ্ঞান, উন্নততম জীবনবোধ এবং আধ্যাত্মিক চৈতন্যবিকাশের পথনির্দেশ দিতে পেরেছিলেন বলেই তাঁদের গুরু মেনে নিয়ে হিন্দু সভ্যতার প্রভাব এই উপমহাদেশের বাইরেও বিস্তৃত হয়ে প্রাচীন হিন্দুরাষ্ট্রের অবতারণা হয়েছিল। ভারত প্রকৃতঅর্থে বিশ্বগুরু হয়ে উঠতে পেরেছিল বলেই না প্রাদেশিক জাতীয়তাবাদের ঊর্দ্ধে উঠে এক বৃহৎ আত্মীয়তার যোগসূত্র গঠিত হয়েছিল? 

আজ বাস্তবিক অবস্থা এমন যে আমাদের নতুন সংসদে সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্যের প্রাচীন নামযুক্ত একটি মানচিত্র রাখা হলে মাত্র পঁচাত্তর বছর আগে গঠিত পাকিস্তান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার প্রতিবাদ জানায় - হায় এই নাকি হিন্দুরাষ্ট্র! ভারতকে বিশ্বগুরু বলে অন্যান্য দেশ আজ নতুন করে কেন মানবে? নতুন নতুন পয়সা হচ্ছে বলে, সামরিক শক্তি বাড়ছে বলে, নানা রকম জিনিষ বানাচ্ছি আর বিশ্বকে সাপ্লাই করছি বলে, অন্যতম বৃহত্তম বাজার বলে নাকি জনসংখ্যার নিরিখে সবাইকে টেক্কা দিচ্ছি বলে? এর প্রত্যেকটি বিষয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে কেউ না কেউ গত কয়েক শতাব্দী ধরে বসে আছে - তাঁদের প্রভাবে কোনো রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে কি? উপনিবেশ অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্র? তারা মানুষের বাইরেটা ছুঁয়েছে, ভেতরটা ছুঁতে পারেনি।

হিন্দুরাষ্ট্র তখনই আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে যখন ভারত তার বিশ্বগুরুর জায়গাটা ফিরে পাবে আর তার জন্য প্রথমে ভারতের আম জনতাকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হিন্দু জীবনবোধকে আত্মস্থ করে নিজেরা আগে সত্যিকারের হিন্দু হয়ে উঠতে হবে। ঋষি বলবেন 'অহম ব্রহ্মাস্মি' আর জনতা বলবে 'আয় তোর নিই' - তেলে আর জলে মিশ খাবে কি করে? আমরা যে হিন্দু সেটা যেন আমাদের আচার আচরণ আর জীবনদর্শন থেকেই বোঝা যায়। আমাদের পারিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্ষেত্রটিও যেন এমন হয় যে প্রতিটি ভারতীয় শিশুর মধ্যে আমাদের ইতিহাস, আমাদের সংস্কৃতি আর আমাদের ধর্মবোধ জন্মাবধি একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে যায়। সংবিধান তো ভারত নামক দেশের, তাতে কিছু ধারা পরিবর্তন করে কি আর কখনো হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়? এটা বালখিল্যতা।

নিজের মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষাকে অবহেলা করে ইংরেজ হতে গিয়ে বিফল হয়ে একসময় মাইকেল মধুসূদন দত্ত আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, 
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;--
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!...
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে, --
"ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে।"

কেবল 'বঙ্গ' শব্দটির বদলে 'হিন্দু' বসিয়ে দিলেই কেন আমাদের হিন্দুরাষ্ট্র আজ অলীক কল্পনামাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে আর কেন ভারতীয় উপমহাদেশে পর্য্যন্ত আজ হিন্দু সভ্যতার প্রভাব ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু, তার কারণটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই মুহূর্তে প্রথমেই একেবারে সংকল্প করে আমাদের হিন্দুদের নিজেদের অনুকরণপ্রিয়তা এবং দাস্যভাব ছাড়তে হবে। তার অর্থাৎ এই নয় যে আমাদের সভ্যতা কোনো আস্ফালনের বিষয় - ঋষিদের প্রজ্ঞার সামনে নতজানু হয়ে, তাঁদের দর্শনের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তাঁদের শিক্ষাকে নিজেদের ব্যক্তি জীবনের পাথেয় করে, নিঃস্বার্থভাবে বিশ্বসংসারের কাছে তাঁদের মহৎ বার্তা বিলিয়ে দিতে হবে। সেই বার্তাটি কি? সেই বার্তাটি হিন্দুসভ্যতার মূলমন্ত্র - ভোগ নয়, ত্যাগ।

কি ত্যাগ করবো? লোভ, স্বার্থপরতা, হিংসা। ঈশ্বর আমাদের জন্য তাঁর অসীম শক্তি সঞ্চয় করে রেখেছেন সামান্য কিছু ঘাসের বীজে বা উদ্ভিদের ফলে - যা সাধারণ খাদ্য হয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে বোধ বুদ্ধি মেধা ও চেতনায় রূপান্তরিত হয়ে আমাদের মানুষ থেকে ঈশ্বর হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আমাদের প্রাচীন কৃষি সংস্কৃতি এই দৈবশক্তিকে নতমস্তকে স্বীকার করে নেয় এবং সেখান থেকেই কৃষি রাষ্ট্র্ববাদের জন্ম। সেই সংস্কৃতিই জন্ম দেয় ঋষিদের, জন্ম দেয় দর্শনের, জন্ম দেয় আধ্যাত্মিকতার। আজ কৃষি সংস্কৃতি ও ঋষি দর্শন ভুলে আমরা হিন্দুরা এখন কি করছি? মূলত যে পরিবারিক পরিবেশ থেকে সমাজের পথপ্রদর্শক গেরুয়া বসনধারীরা উঠে আসেন, সেই পরিবেশকে আমরা বিষাক্ত করে তুলেছি। ১৯৬১ সাল থেকে  দেশে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের প্রয়োগ শুরু হয়েছে, সবুজ বিপ্লবের নামে জমিতে বিষ মেশাতে মেশাতে ধীরে ধীরে আমরা তাকে নিষ্ফলা এবং বন্ধ্যা করে তুলেছি।

ডায়ামোনিয়াম ফসফেট ব্যবহার করে করে জমির নাইট্রোজেনের ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রাকৃতিক রাইসোবিয়াম ব্যাক্টেরিয়াকে মেরে ফেলে চাষের জমিতে ফসলের নামে আজ যে বিষ উৎপন্ন হচ্ছে, তার একমাত্র এন্টিডোট হলো গোবর সার আর গোমূত্র। আমাদের খাদ্য বিষমুক্ত করতে হলে গরু চাই আর বিষমুক্ত কৃষি উৎপাদনের সাথে সর্বাঙ্গীনভাবে গরুকে জুড়তে পারলে তবেই সত্যিকারের গোরক্ষা হবে, নচেৎ নয়। উল্টে, এখন একজোড়া বলদের জায়গা নিয়েছে কেঁচোর বসবাস ধ্বংসকারী বড় দাঁতওয়ালা এক্সট্র্যাক্টর আর সুপরিকল্পিতভাবে যে গোবর আর গোমূত্র বিনাপয়শায় জমির উর্বরতার কারিগর কেঁচোর খাদ্য যোগাতো, আমরা তার যোগান বন্ধ করিয়ে দিয়েছি। কেঁচো নেই, তাই ক্ষেতে পাখি নেই, রেনুর হাওয়াই সফর বাতিল। নিজের বাড়ির নিমপাতার তেল, গোমূত্র আর বেসনের ঘোল বানিয়ে খুব কম পয়সার যে জৈবিক কীটনিয়ন্ত্রক কৃষক ব্যবহার করতেন, তার জায়গায় তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছি বিশুদ্ধ কীটনাশক বিষ, যার ফলে আর মৌমাছি এবং খাদ্যবন্ধু কীটপতঙ্গ আসে না, পরাগ বিতরণ বন্ধ, কৃষক হাইব্রিড বীজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছেন। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি পরিশুদ্ধ জলের রিসার্ভ ভারতে, রাসায়নিক ও শিল্পবর্জ্যের কল্যানে সেই জলকেও আমরা তিলে তিলে বিষাক্ত করে তুলেছি। এইভাবে কি করে আমরা বিশ্বগুরু হবো? পাপ কিভাবে পূণ্যের জন্ম দেবে?

আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে প্রতিস্পর্ধার মানক কখনোই আমাদের Dollar reserve হতে পারে না, বিশ্বস্তরে আমাদের পারস্পরিক চর্চার বিষয় হতে হবে how to attain Divinity, যা জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে ভারতের ঋষিরা হাজার হাজার বছর ধরে অনুশীলনলব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রচার করে এসেছেন। বিশ্বের কাছে ভারতের অবদান বিত্ত নয়, লোভ নয়, লালসা নয়, হিংসা নয় - তার চিরন্তন কৃষি সংস্কৃতি এবং ঋষি দর্শন। অদ্বৈত বেদান্তের আলোয় জগতপ্রসবিনী মহামায়ার বিমূর্তরূপ এই প্রকৃতি মা ও পঞ্চভূতের সংরক্ষণ এবং দুঃখবিদীর্ণ পৃথিবীতে ধর্মনির্দেশিত পথে শান্তি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির ও মোক্ষপ্রাপ্তির হদিস - এটাই হিন্দুরাষ্ট্র সংরচনার পূর্ব-পরীক্ষিত এবং সফল ভিত্তি। মায়ের কৃপায় আশাকরি শাশ্বত ভারতের চিরন্তন বসুধৈব কুটুম্বকম ভাবধারা ও সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখভাগভবেৎ মন্ত্রের অন্তর্নিহিত শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের বাণী আবার দেশকালের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং তার মাধ্যমেই আবার নতুন করে ধর্মরাজ্যরূপী ভারতকে কেন্দ্র করে হিন্দুরাষ্ট্রের উত্থান হবে।

No comments:

Post a Comment