Saturday, August 20, 2022

এক থেকে বহু, বহু থেকে এক


আমি যখন 'আমি' বলছি তখন একজনকেই বোঝাচ্ছি, singular number, একবচন - নিজেকে, অর্থাৎ নিজেকে আমি যা বলে মনে করি, তাকে। সেটা যদি আয়নায় দেখা আকারটি হয় তাহলে তাইই। কিন্তু সেই আমিই যখন 'তুমি' বলছি তখন কিন্তু সেটি অনেকজনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য - তুমি, তুমি এবং তুমি - plural number, বহুবচন, যদিও ব্যাকরণের হিসেবে ওটিও একবচনই বটে। 

এখন, 'আমি' যেমন specific, যতক্ষণ না পরমজ্ঞান হচ্ছে ততক্ষণ স্থান ও কাল নির্বিশেষে অপরিবর্তিত, 'তুমি' কিন্তু স্থান কাল পাত্র অনুযায়ী বদলে বদলে যেতে পারে। এক্ষুনি ঘরের ভেতরে গিন্নিকে তুমি বললাম, পরক্ষণেই রাস্তায় বেরিয়ে প্রতিবেশীকে তুমি বললাম আবার তারপর অফিসে পৌঁছে সহকর্মীকে তুমি বললাম - সবাই 'তুমি', সবাই বুঝলেন সেই বিশেষ সময় এবং সেই বিশেষ স্থানে specifically তাঁকেই সম্বোধন করছি, অর্থাৎ ডাকটা 'তোমরা'র মতন generalised নয় অথচ 'আমি'র মতন specificও নয়। 

'আমি' ধ্রুবক কিন্তু 'তুমি' পরিবর্তনশীল, যদিও ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দুটিই কিন্তু attached to a particular individual and indicative of only that person at any given time and space - বিশেষক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের নির্দিষ্ট পরিচায়ক। এর বিশেষত্ব হলো কে যিনি 'তুমি' বলে ডাকছেন তাঁর মনে যেমন সেই সময় যাঁকে ডাকছেন তাঁর identity নিয়ে কোনো ambiguity নেই, তেমনি যিনি সারা দিচ্ছেন তাঁর মনেও কিন্তু তাঁকেই যে ডাকা হচ্ছে - সে বিষয়ে কোনো ambiguity নেই। এই যে দুতরফেই given time and space এ understanding of identity থাকে, সেটাই দুটি ভিন্নস্বত্তার মধ্যে singular যোগসূত্র তৈরি করে দেয়। খুব জটিল ব্যাপার, তাইনা? 

বস্তুর ব্যাপারে সমস্যা কিন্তু আরো জটিল। 'গেলাস', 'জলের গেলাস', 'আমার জলের গেলাস' আর 'আমার নীলরঙের কাঁচের জলের গেলাস' এক হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। অন্যদিকে 'আমি' এবং 'তুমি' দুজনেই যে মানুষ সে বিষয়ে যেমন চরিত্রগত কোনো confusion নেই, বস্তুর ক্ষেত্রে কিন্তু বস্তুর বস্তুর ওপর তার চরিত্র নির্ভর করে, আবার করেও না। কাঁচের গেলাস, কাঁসার গেলাস আর রূপোর গেলাস যদিও উপাদানের নিরিখে চরিত্রগতভাবে একেবারেই এক নয়, কিন্তু উপযোগিতার দিক দিয়ে একই। কাঁচ একটি বস্তু আর গেলাস একটি আকৃতি বিশেষ - দুটির চরিত্র মিলে সহজেই যখন একটি বস্তুবিশেষ হয়ে যায় তখন তাদের পৃথক করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। 

এর মধ্যে অবশ্য নিত্য আর অনিত্যের মানকের বিষয়টিও এসে পড়ে। যদিও শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন যা কিছু নিত্য তাই সত্য আর যা কিছু অনিত্য তাই অসত্য, কেবলমাত্র বিষয়টি সহজতর করার জন্য আমরা এখানে ক্ষণস্থায়ী আর দীর্ঘস্থায়ী দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনা টানবো। উদাহরণস্বরূপ, একটা পাহাড় যেহেতু একজন মানুষের চেয়ে ঢের বেশি বছর অক্ষত থাকে, তাই বর্তমানে সেই পাহাড়ের মালিক যেটিকে 'আমার পাহাড়' বলে স্বত্ব আরোপ করেন, ভবিষ্যতে তাঁর মৃত্যুর পর নতুন মালিক একইভাবে ওই পাহাড়টিকেই আবার 'আমার পাহাড়' বলে স্বত্ব আরোপ করেন - তাতে কিন্তু পাহাড়ের চরিত্র একবিন্দু পাল্টে যায় না। অর্থাৎ 'আমি' পাল্টে গেলেও বস্তু পাল্টায় না, যদিও তার আরোপিত ও কৃত্তিম 'মালিকানা'র বর্ণনা পাল্টে যায়।

আবার এর উল্টোটাও হয়। ছাতুবাবু-লাটুবাবু কবে শরীর ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু উত্তর কলকাতায় ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ি এখনো ওই নামেই খ্যাত, যদিও তার এখনকার প্রজন্মের মালিকরা আলাদা। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়ালো? বস্তু 'আমি'র নামে পরিচিত হতে পারে কিন্তু তাতে বস্তুর কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়না - পাহাড় পাহাড়ই থাকে এবং বাড়ি বাড়িই। যত গোলযোগ কেবল 'আমি' আর 'তুমি'র মধ্যে বস্তু ঢুকে পড়লে। মজার ব্যাপার হলো বস্তুর ক্ষেত্রে সোনার আংটি থেকে সোনা নিয়ে নিলে আর আংটি অবশিষ্ঠ থাকে না, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে আমি থেকে 'আমি' নিয়ে নিলে বা তুমি থেকে 'তুমি' নিয়ে নিলে কি হয়? ওইখানেই অদ্বৈত বেদান্তের শুরু। 

এত কথার প্রয়োজন কি? প্রয়োজন এই যে সাধারণত আমি, তুমি আর বস্তু নিয়েই জগৎ সংসার আর এদের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রকৃত অর্থ বোঝবার জন্যই কখনো গৌতম বুদ্ধ বোধিবৃক্ষের তলায় তপস্যায় বসেন বা মানুষকে এর অর্থ বোঝাবার জন্য কখনো আচার্য্য শঙ্কর ঘুরে ঘুরে সারা দেশের চারটি কোনায় চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। আবার অন্যদিকে এই একই বিষয়ে অবুঝ হলে কখনো কার্ল মার্ক্সের তল্পীবাহকেরা বস্তুর অধিকার আমার না তোমার - এই প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে কয়েক কোটি মানুষকে খুন করে বসে আর চীন অবলীলায় নানান অন্যদেশকে জোর করে নিজের দেশ বলে অধিগ্রহণ করে নেয়।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, 'তুমি আর তোমার' - এইটি জ্ঞান। 'আমি আর আমার' - এইটি অজ্ঞান। হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা আর আমি অকর্তা - এইটি জ্ঞান। হে ঈশ্বর দেহ মন গৃহ পরিবার জীব জগৎ - এ সব তোমার, আমার কিছুই নয় - এইটির নাম জ্ঞান। যে অজ্ঞান সেই বলে ঈশ্বর 'সেথায় সেথায়' - অনেক দূরে। যে জ্ঞানী সে জানে ঈশ্বর 'হেথায় হেথায়' - অতি নিকটে হৃদয়মধ্যে অন্তর্যামীরূপে, আবার নিজে এক একটি রূপ ধরে রয়েছেন।

তুমি, তুমি আর তুমি - বহুরূপে সম্মুখে তুমি, তবু 'সেথায় সেথায়' করে আমরা ঈশ্বরকে অন্যত্র খুঁজে মরি। বস্তুতঃ 'আমি' আর 'তুমি' যে একই, সেই একই অদ্বৈত স্বত্তা, তোমার আর আমার মধ্যে যে পৃথক কোনো কিছু নেই, সে কথা বুঝতে বুঝতেই তো কত কত জন্ম জন্মান্তর কেটে যায়, তারপর হয়তো তাঁর কৃপা হয়। বস্তুত, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনো বহুবচন নেই, সবটা মিলিয়ে একটাই একবচন। আত্মা চেতন, সদামুক্ত তবু সে জড়ে আসক্তিবশতঃ জীবরূপে দেহবোধে আবদ্ধ থাকে, ফলে তার এক কৃত্তিম অবস্থা এবং অন্য এক কৃত্তিম অবস্থার মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে যাওয়াটা কেবল অর্থহীন বস্তুবিচারের বিষয়মাত্র। তবে বৈচারিকস্তরে সমস্ত প্রানীতে এক অবিভক্ত চিন্ময়ভাব দর্শন কল্পনা করা গেলেও মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করা এবং সেইভাবে নিজের 'আমি'কে 'তুমি'তে মিশিয়ে দেওয়াটি কিন্তু খুব খুব শক্ত কাজ এবং গুরুকৃপা ছাড়া সম্ভবই নয়।

১৮৬৮ সালে শ্রীরামকৃষ্ণদেব কাশীতে ত্রৈলঙ্গস্বামীকে দর্শন করতে গিয়েছিলেন। ঠাকুর তাঁকে বলতেন 'হাঁটা-চলা করা, কথা বলা কাশীর জ্যান্ত বিশ্বেশ্বর'। মণিকর্ণিকা ঘাটে গিয়ে ঠাকুর দেখলেন ত্রৈলঙ্গস্বামী সেখানে শুয়ে আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পদধ্বনি শুনে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন তিনি। কেউই কোনো কথা বললেন না। শুধু দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমেই সেরে নিলেন ভাবের আদানপ্রদান। তখনই ইশারায় ঠাকুর প্রশ্ন করলেন, "ঈশ্বর এক না অনেক?" স্বামীজী ইশারাতেই তাঁকে উত্তর দিলেন, "সমাধিস্থ হয়ে দেখলে এক, না হলে যতক্ষণ আমি, তুমি, জীব, জগৎ ইত্যাদির ভেদ রয়েছে ততক্ষণ অনেক।"

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের একেবারে শেষে সঞ্জয়ের কথা দিয়ে গীতা শেষ হচ্ছে। সেখানে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন,
রাজন্ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য সংবাদমিমমদ্ভুতম্। 
কেশবার্জুনয়োঃ পুণ্যং হৃষ্যামি চ মুহুর্মুহুঃ।।৭৬।।
তচ্চ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য রূপমত্যদ্ভুতং হরেঃ। 
বিষ্ময়ো মে মহান্ রাজন্ হৃষ্যামি চ পুনঃ পুনঃ।।৭৭।।
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম।।৭৮।।
অর্থাৎ
হে রাজন্! শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের এই পুণ্যজনক অদ্ভুত সংবাদ স্মরণ করতে করতে আমি বারংবার রোমাঞ্চিত হচ্ছি। ৭৬
হে রাজন্! শ্রীকৃষ্ণের সেই অত্যন্ত অদ্ভুত রূপ স্মরণ করতে করতে আমি অতিশয় বিস্ময়াভিভূত হচ্ছি এবং বারংবার হর্ষান্বিত হচ্ছি। ৭৭
যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে। সেটিই আমার অভিমত। ৭৮

সঞ্জয় কাদের মধ্যে পুণ্যজনক অদ্ভুত সংবাদ শুনে রোমাঞ্চিত? তুমি ও আমি, ঈশ্বর ও জীব, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সংবাদ - যেখানে স্রষ্টা কৃপা করে divergence ও delusionকে convergence ও truthএ পরিণত করছেন, দ্বৈতবোধ থেকে অদ্বৈতবোধে উত্তরণ ঘটাচ্ছেন, আত্মার আসক্তি সরে গিয়ে পরমাত্মার সাথে তার সাক্ষাৎকার ঘটছে। কোন অত্যন্ত অদ্ভুত রূপ স্মরণ করতে করতে সঞ্জয় অতিশয় বিস্ময়াভিভূত এবং বারংবার হর্ষান্বিত হচ্ছেন? তিনি বিশ্বরূপ দর্শন করেছেন। তিনি দেখেছেন যে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কিছুই আলাদা নয়, জড় ও চেতন অর্থাৎ বস্তু এবং জীব সব একই নির্গুণ ব্রহ্মের স্বগুণ রূপ এবং এই পরমজ্ঞানের চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু নেই। আর একদম শেষে সঞ্জয় যে 'শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি'র কথা বলছেন সেটা হলো নিষ্কাম কর্মের outcome - কর্মফলের কামনা ত্যাগ করতে পারলে যোগেশ্বরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ হয়। এর ফলে যে আত্মবোধের শক্তি উৎপন্ন হয়, তার দ্বারা মায়াকে জয় করে জীবনের আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ ব্রহ্মত্ব অর্জন করা যায়। এটাই সমাধি। এটি পুরোটাই কিন্তু একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, শোনা কথা নয়।

আর যাঁর সত্যি সত্যিই সমাধির অনুভব হয়েছে, যিনি নিজে এই পরম অবস্থাকে experience করেছেন, সেই স্বামী বিবেকানন্দ এইভাবে তাঁর অনুভূতিকে বর্ণনা করেছেন:
নাহি সূর্য নাহি জ্যোতিঃ নাহি শশাঙ্ক সুন্দর।
ভাসে ব্যোমে ছায়া-সম ছবি বিশ্ব-চরাচর॥
অস্ফুট মন আকাশে, জগত সংসার ভাসে,
ওঠে ভাসে ডুবে পুনঃ অহং-স্রোতে নিরন্তর॥
ধীরে ধীরে ছায়া-দল, মহালয়ে প্রবেশিল,
বহে মাত্র ‘আমি আমি’ - এই ধারা অনুক্ষণ॥
সে ধারাও বদ্ধ হল, শূন্যে শূন্য মিলাইল,
‘অবাঙমনসোগোচরম্’, বোঝে প্রাণ বোঝে যার॥

মানসিকভাবে এখন যে যেখানে আছি সেইখান থেকে এইখানে পৌঁছতে হবে। হয়তো আরো অনেকগুলো জন্ম লেগে যাবে, হয়তো রাস্তাটা সহজ হবে না, কিন্তু এই গোটা journeyটাতে যাতে লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারি, সেটাই আমাদের আসল প্রার্থনার বিষয়। 'আমি' নয় - 'তুমি', আবার 'তুমি' নয় - 'আমি', কোনো এক শুভক্ষণে সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যাক।

Thursday, August 18, 2022

অবতার

শ্রীকৃষ্ণ বন্দে জগৎগুরুম্!

শ্রীকৃষ্ণের জন্মের রাত ছিল সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে, যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয়। সেই রাত ছিল গভীর অন্ধকার এবং ঘোর বৃষ্টিময়। কংসের কারাগার আলো করে তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পিতা বসুদেব দেখলেন শিশুটির চারটি হাত এবং তাতে তিনি শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করে আছেন। বাসুদেব বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গলার্থে স্বয়ং নারায়ণ তাঁদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। বসুদেব করজোড়ে প্রণাম ও বন্দনার পর দেবকীও নবজাতকের কাছে প্রার্থনা করলেন এবং তখন শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন মাতা দেবকীর অষ্টম সন্তান।

এর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পর তীর্থ ভ্রমণে গয়ায় এসে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন। গদাধর বিষ্ণু তাঁকে দেখা দিয়ে তাঁর ঘরে পুত্ররূপে আসতে চাইলেন। ক্ষুদিরাম ছিলেন ঈশ্বরগতপ্রাণ। দরিদ্র তিনি, তাঁর ঘরে এলে প্রভুর কত কষ্ট হবে, তা অকপটে নিবেদন করলেন। নারায়ণ কিন্তু হেসে আবার তার ঘরেই আসতে চাইলেন। এদিকে কামারপুকুরে চন্দ্রমণি দেবীরও এক অদ্ভুত দর্শন হয়েছিল। বাড়ির কাছে যুগীদের শিব মন্দিরে গিয়েছিলেন তিনি। অকস্মা‌ৎ এক জ্যোতি শিববিগ্রহ থেকে নির্গত হয়ে প্রবেশ করেছিল তাঁর দেহে। ক্ষুদিরাম ও চন্দ্রমণি, উভয়েরই বিশ্বাস হয়েছিল ভগবান পুত্ররূপে তাঁদের কাছে আসছেন। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে ১৮ই ফেব্রুয়ারী (৬ই ফাল্গুন, শুক্লা দ্বিতীয়া তিথি) কামারপুকুরে ক্ষুদিরামের বাড়ীর ঢেঁকিশালে তাঁর তৃতীয় পুত্র গদাধরের জন্ম হয়েছিল।

শ্রীবিষ্ণু কি সত্যি সত্যিই বারেবারে সশরীরে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন? স্বমুখে শ্রীকৃষ্ণ যেমন তাঁর আত্মপরিচয় দিয়ে গিয়েছেন তেমনি একদিন দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বাবুরাম প্রভৃতি ভক্তদের সঙ্গে বসে ছিলেন, দিনটি ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ, ৭ই মার্চ, বেলা ৩টা-৪টা হবে, ভক্তেরা পদসেবা করছেন, এমন সময় শ্রীরামকৃষ্ণ একটু হেসে ভক্তদের বললেন, "এর (অর্থাৎ পদসেবার) অনেক মানে আছে।" তারপর নিজের হৃদয়ে হাত রেখে বললেন, "এর ভিতর যদি কিছু থাকে (পদসেবা করলে) অজ্ঞান অবিদ্যা একেবারে চলে যাবে।"

তারপর হঠাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ গম্ভীর হয়ে গেলেন, যেন কি গুহ্যকথা বলবেন। তারপর ভক্তদের ঠাকুর বললেন, "এখানে বাহিরের লোক কেউ নাই, তোমাদের একটা গুহ্যকথা বলছি। সেদিন দেখলাম, আমার ভিতর থেকে সচ্চিদানন্দ বাইরে এসে রূপ ধারণ করে বললে, আমিই যুগে যুগে অবতার। দেখলাম পূর্ণ আর্বিভাব, তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য।" কথামৃতকার লিখছেন, 'ভক্তেরা এই সকল কথা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন। কেহ কেহ গীতোক্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহাবাক্য স্মরণ করিতেছেন —
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্‌ ৷৷
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্‌
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ৷৷'

ঠাকুরের যখন প্রেমোন্মাদ অবস্থা, লোকে যখন ওঁকে পাগল ভাবছে, তখন ভৈরবী ব্রাহ্মণী কিন্তু ঠাকুরের পরিবর্তনগুলিকে ঠিক ঠিক চিনতে পেরেছিলেন। এগুলি যে কোন রোগ নয়, কেবল সাধকের বিশেষ অবস্থার বাহ্যিক লক্ষণ মাত্র, তা তিনি শাস্ত্রের গভীর অধ্যয়ন ও প্রতীতি থেকেই বুঝেছিলেন। ফুলের মালা পরলে বা গায়ে চন্দনের প্রলেপ দিলে যে এই যন্ত্রণার উপশম হয়, তাও তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। শ্রীমতি রাধারানী থেকে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য পর্যন্ত যোগী আচার্যদের জীবনে আধ্যাত্মিক অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে যে অনুরূপ শারীরিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল - ভক্তিগ্রন্থসমূহ ও শাস্ত্রসমূহ উদ্ধৃত করে ভৈরবী তা সোচ্চারে ঘোষণা করতে একবিন্দু দ্বিধা করেননি। 

তারপর মথুরবাবু সে কালের বিখ্যাত পন্ডিত বৈষ্ণবচরণকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে। যে প্রধান উনিশটি ভাব বা অবস্থার সম্মিলনকে ভক্তিশাস্ত্রে মহাভাব বলা হয়, যা আগে শ্রীরাধিকা ও শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনে দেখা গিয়েছিল, বৈষ্ণবচরণ সেই সবকটি লক্ষণই দেখতে পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে। পরবর্তিকালে শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে তান্ত্রিক সাধক গৌরী পন্ডিতের অহংকারও খর্ব হয়েছিল। তিনি ঠাকুরকে চিনেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বররূপে ও ঈশ্বরলাভের জন্য সংসার ত্যাগ করেছিলেন।

মহাসমাধির কয়েকদিন আগে নরেন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে তাঁর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ঠাকুর সমাধিস্থ হন। নরেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল ঠাকুরের দেহ থেকে সূক্ষ্ম তেজরশ্মি, তড়ি‌ৎকম্পনের মত তাঁর শরীরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। সমাধিভঙ্গ হলে অশ্রু বিসর্জন করে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন,"আজ যথাসর্বস্ব তোকে দিয়ে ফকির হলুম, তুই এই শক্তিতে জগতের কাজ করবি। কাজ শেষ হলে ফিরে যাবি।" ঠাকুর কি সত্যিই অবতার, এই সংশয় তখনও সম্পূর্ণ নিরসন হয়নি যুক্তিবাদী নরেন্দ্রনাথের হৃদয় থেকে। অন্তর্যামী ঠাকুর তা উপলব্ধি করে বলেছিলেন, "সত্যি সত্যি বলছি, যে রাম যে কৃষ্ণ সেই ইদানিং এই শরীরে রামকৃষ্ণ – তবে তোর বেদান্তের দিক দিয়ে নয়।"

এসবের অনেকবছর পরে স্বামীজী যখন আমেরিকায় গীতা ও নারদসূত্রাদি গ্রন্থ অবলম্বন করে ভক্তিযোগ নামক গ্রন্থ লিখছেন, তখন শ্রীরামকৃষ্ণকে স্মরণ করে তাতে তিনি বলছেন, "Higher and nobler than all ordinary ones, is another set of teachers, the Avataras of Ishvara, in the world. They can transmit spirituality with a touch, even with a mere wish. The lowest and the most degraded characters become in one second saints at their command. They are the Teachers of all teachers, the highest manifestations of God through man. We cannot see God except through them. We cannot help worshipping them; and indeed they are the only ones whom we are bound to worship."

আমেরিকাতেই 'Christ the Messenger' নামক বক্তৃতায় স্বামীজী আরো বিস্তারিতভাবে অবতারত্বের প্রসঙ্গ বুঝিয়ে বলছেন, "Thou hast seen me and not seen the Father? I and my Father are one! The kingdom of Heaven is within you! If I am pure enough I will also find in the heart of my heart, I and my Father are one. That was what Jesus of Nazareth said.

"It has been said by the same Messenger (Christ) 'None hath seen God, but they have seen the Son.' And that is true. And where to see God but in the Son? It is true that you and I, the poorest of us, the meanest even, embody that God — even reflect that God. The vibration of light is everywhere, omnipresent; but we have to strike the light of the lamp there and then we human beings see that He is Omnipresent. The Omnipresent God of the Universe cannot be seen until He is reflected by these giant lamps of the earth; the Prophets, the Man-Gods, the Incarnations, the embodiments of God .... They are all manifestations of the same Infinite God. They were all pure and unselfish; they struggled, and gave up their lives for us, poor human beings. They all and each of them bore Vicarious atonement for every one of us and also for all that are to come hereafter."

কথামৃতে একটা বেশ মজার কথোপকথন আছে, দিনটি ছিল ১৮ই অক্টোবর, ১৮৮৫। নাট্যাচার্য্য গিরিশ চন্দ্র ঘোষের সাথে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের আলোচনা হচ্ছে।
ডাক্তার - 'অবতার আবার কি! যে মানুষ হাগে মোতে তার পদানত হব! হাঁ, তবে Reflection of God's light (ঈশ্বরের জ্যোতি) মানুষে প্রকাশ হয়ে থাকে তা মানি।' উত্তরে গিরিশবাবু তাঁর বিশ্বাসের কথা বলছেন এমন সময় ঠাকুর হস্তক্ষেপ করলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ - এ-সব যা কথা হচ্ছে, এ কিছুই নয়। .... যতক্ষণ কাঁচা ঘি, ততক্ষণই কলকলানি শোনা যায়। পাকা হলে আর শব্দ থাকে না। যার যেমন মন, ঈশ্বরকে সেইরূপ দেখে। আমি দেখেছি, বড় মানুষের বাড়ির ছবি - কুইন-এর ছবি আছে। আবার ভক্তের বাড়ি - ঠাকুরদের ছবি! .... পূর্ণজ্ঞানের লক্ষণ আছে। বিচার বন্ধ হয়ে যায়। যা বললুম, কাঁচা থাকলেই ঘিয়ের কলকলানি।
ডাক্তার - পূর্ণজ্ঞান থাকে কি? সব ঈশ্বর! তবে তুমি পরমহংসগিরি করছো কেন? আর এরাই বা এসে তোমার সেবা করছে কেন? চুপ করে থাক না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) - জল স্থির থাকলেও জল, হেললে দুললেও জল, তরঙ্গ হলেও জল।

Saturday, August 13, 2022

অখন্ড ভারত

আজ ১৪ই অগাস্ট, পাকিস্তানের জন্মদিন। আজকের দিনেই আমাদের দেশমায়ের দুটি বাহু কেটে নিয়ে পাকিস্তানের দুটি প্রান্ত তৈরি হয়েছিল। আসলে আক্রান্তার বেশে ভিনদেশি দানবরা এসে আমাদেরই কয়েকজনকে ধরে বেঁধে, মাথা মুড়িয়ে, এমন দানবিক বিষ তাদের মননে ঢেলে দিয়ে গিয়েছিল যে কয়েক প্রজন্ম পরে তারা ভুলেই গেল যে তারা আসলে কারা। 

সামান্য পূজাপদ্ধতি পাল্টে গিয়ে তারা যেন হটাৎ এক ভিন্ন জাতি, ভিন্ন মানুষ হয়ে গেল। আর যত তারা রাষ্ট্রের বৃহত্তর সমাজের মূলধারা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিতে লাগলো বা সমাজও তাদের নিত্যনতুন বিজাতীয় চাহিদা মেটাতে অক্ষমতা জাহির করতে শুরু করলো, তত তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আমাদের প্রাচীন উন্নত মানবিক উদার সভ্যতা ও ধর্মসংস্কৃতির প্রভাব কমতে কমতে একসময় এমন হলো যে তারা হিতাহিত জ্ঞান খুইয়ে নিজেদের ছেড়ে আসা রক্তের সম্পর্কের সনাতনী আত্মীয়-বন্ধুদেরই পরমশত্রু বলে ভাবতে শুরু করলো। দুর্ভাগ্যবশত, সেই ভাবনা আজো বেঁচে আছে কারণ দেশভাগের ৭৫ বছর পরেও দেশের ভেতরে ও বাইরে সেই একই বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকে উস্কে দেওয়ার ষড়যন্ত্রকারী লোকের অভাব নেই। 

পাকিস্তান কোনো ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক স্বত্তা নয়, ওটি আসলে নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের ইতিহাস, বস্তুত নিজেদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধেই কিছু অবুঝ অর্বাচীনের বিদ্রোহ, যার কোনো সারবত্তা নেই। পাকিস্তান থেকে ভাষার ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের অবস্থানও তাই। যে জাতি অন্যের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতির পদতলে নিজের পূর্বপুরুষের সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দেয়, তাদের আসলে একূল ওকূল দুকূলই যায়। বেচারাদের পায়ের তলায় মাটি থাকলেও আসলে এরা সবাই ছিন্নমূল।

পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো মেকি দেশ ১০০ বছরের বেশি টেকেনি, হয়তো আগামী ২৫ বছরে আমাদের উপমহাদেশের মানচিত্রটিও অনেকটাই বদলে যাবে। কিন্তু আজকের দিনে, যেদিন প্রেমজীভাই মেঘজী ঠক্করের নাতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজের ভারতীয়ত্ব বিসর্জন দিয়ে একটি কৃত্তিম দেশের প্রথম গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন, সেদিন কি সত্যি সত্যিই তার কোনো আদর্শের ভিত্তি ছিল নাকি কেবল ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বজনবৈরিতা, সেটা আজ পাকিস্তানের ঘোর বেহাল দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখিয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক মতবাদ কোনো কৃত্তিমভাবে তৈরি করা দেশকে ধরে রাখতে পারেনা, মধ্যপ্রাচ্য দেখিয়ে দিয়েছে ভাষা এক হলেও স্থানীয় সংস্কারের ভিত্তিতে নানা দেশ তৈরি হতে পারে আর বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে পন্থীয় একতাও কোনো কৃত্তিমভাবে তৈরি করা দেশকে ধরে রাখতে পারেনা। অন্যদিকে জার্মানি দেখিয়ে দিয়েছে যে জাতির মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন থাকলে কৃত্তিমভাবে বিভাজিত দেশও একদিন আপনাআপনিই জুড়ে গিয়ে আবার এক হয়ে যায়। 

এই সংস্কৃতিই হলো মূল কথা, যে কোনো সভ্যতার ওটাই আসল অবদান। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কথা ছেড়ে দিয়ে আপাতত আমরা যদি আমাদের নিজেদের দেশে বসবাসকারী সমস্ত নাগরিককে সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতির রঙ্গে না রাঙিয়ে তুলতে পারি, তাহলে এই স্বাধীনতা অর্থহীন। আমরা স্বাধীন বলে তখনই গণ্য হবো যখন আমাদের নিজেদের সভ্যতার কথা আমরা সোচ্চারে বলতে পারবো। এই রাষ্ট্র হিন্দুরাষ্ট্র কারণ আমরা সবাই হিন্দু সভ্যতার ধারক ও বাহক - ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে এ কথা বলার মধ্যে যতদিন দ্বিধাবোধ থাকবে ততদিন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন নৈ। 

হয়তো আজ যে কথা কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, আর কয়েকবছর পর তা সোচ্চারে শোনা যাবে কারণ এক বৃহৎসংখ্যক জনগণের মধ্যে সার্বিকভাবে সংস্কৃতি-সচেতনতা বাড়ছে। আজকের মতো দিন হলো সংকল্প নেওয়ার দিন, যেদিন শেষবার জোর করে আমাদের দেশমাতৃকার অঙ্গহানি করা হয়েছিল। আমরা যে এক জাতি এক প্রাণ - এই কথাটা আমাদের নিজেদের দেশের মধ্যে আগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আর তার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নিয়ে রাষ্ট্রের সমস্ত নীতি এবং তন্ত্রকে একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ দিতে হবে। যেদিন আমরা সেটা করতে ফেলতে পারবো, তার সুফল এমন আকর্ষক ও কার্যকরী হবে যে আশেপাশের সব মেকি দেওয়াল এমনি এমনিই খসে পড়বে। সেদিন আর কোনো ১৪ই অগাস্টও থাকবে না, শুধুই ১৫ই।

Wednesday, August 10, 2022

নামীর ধ্যান-ধারণা

ঠাকুর তাঁর শিষ্যদের শুধু নাম করতে বলতেন না, বলতেন সেই সাথে নামীর ধ্যান-ধারণাও করতে হয়। ঠাকুরের অনেক সন্তানই তাঁর এই কথাটি বলেছেন বটে কিন্তু কিভাবে যে ঠাকুর নামীর ধ্যান-ধারণা করতে শেখাতেন, সেই বিষয়টি আর বলেননি। একবার বলরাম মন্দিরে এক ভক্ত লাটু মহারাজকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "ধ্যেয় একমাত্র ভগবান। ভগবান ছাড়া আবার কার ধ্যান-ধারণা করবে? যাঁকে ধরেই এগোও না কেন, শেষে তাঁরই কাছে গিয়ে পৌঁছবে।" 

এই উত্তরেও কিন্তু modus operandi নেই, কেবল ইঙ্গিত আছে। সত্যিই তো, আমার পছন্দের ভগবান কালী হন বা কৃষ্ণ, শিব হন বা ব্রহ্মা, তাঁর যে মূর্তিই পছন্দ করি না কেন, তাঁকে তো চাক্ষুষ দেখিনি, কেবল স্তব স্তোত্র পুরাণ পড়ে তাঁর সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করবো কি করে? ধারণা করবো গুরুকে দেখে। লাটু মহারাজ বলছেন, "গুরু - সচ্চিদানন্দ। ... আসলি গুরুর মন সবসময় তাঁতেই যুক্ত থাকে, জানবে। তাই তাঁর (ভগবান) সাথে আসলি গুরুর কোনো ভেদ থাকে না। শাস্ত্রে তাই লেখা আছে - 'গুরু ব্রহ্ম এক'।" 

যাঁদের গুরুই ইষ্ট এবং ইষ্টই গুরু, তাঁদের ক্ষেত্রে নাম ও নামীর ধ্যান-ধারণা কি ভাবে করা যায়, এটা তার একটা সূত্র বৈকি। আমাদের রামকৃষ্ণ ভাবধারায় ঠাকুরই গুরু, আবার তিনিই ইষ্ট। যেহেতু আমরা ঠাকুরের একাধিক আসল photograph দেখতে পাই, তাঁর থাকার জায়গা, তাঁর ব্যবহার করা জিনিষ্পত্তর, তাঁর হাতে পোঁতা আঁটির আমগাছ ইত্যাদি স্বচক্ষে দেখতে পাই আর কথামৃত, লীলাপ্রসঙ্গ এবং অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীদের লেখায় তাঁর মুখের ভাষা শুনতে পাই, তিনি কিভাবে থাকতেন, কি কি করতেন ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে পারি, ফলে এক্ষেত্রে নাম আর নামীকে এক জেনে তাঁর সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়না।

একই ব্যাপার শ্রীশ্রীমায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মা কালীর মূর্তি যতই দার্শনিকভাবে অজ্ঞানীর অজ্ঞানকে ধ্বংস করে ভগবৎকৃপায় জ্ঞানের আলো জ্বালানোর প্রতীকী অপার্থিবরূপ হোন না কেন, তাঁর মাতৃরূপকে ধারণা করা সাধারণ ভক্তের পক্ষে খুব একটা সহজসাধ্য নয়, সাধক হলে অন্য কথা। কিন্তু মাকে আপন মা, কল্যাণদাত্রী, মঙ্গলময়ী, মুর্তিময়ী বাৎসল্য বলে বুঝে নিতে মোটেও বেগ পেতে হয়না, ও বড় সহজ। ঠাকুরের তাও নাহয় কিছু বাছবিচার ছিল, মায়ের তো অবারিতদ্বার - একাধারে তিনি একদিকে সর্বংসহা, মমতার প্রতিমূর্তি, যেন আমাদের রক্তমাংসের মা আবার অন্যদিকে পরমজ্ঞানদাত্রী, জগ্গজননী, মহাশক্তি, জগন্মাতা, মোক্ষপ্রদায়িনী মহামায়া, সত্যিকারের মা। মা কালীকে আমরা হয়তো ভক্তি করতে পারি, দূর থেকে প্রণাম করতে পারি কিন্তু এই মায়ের কাছে আবদার করা যায়, ঘ্যান ঘ্যান করা যায়, মাকে বিরক্ত করা যায়, মায়ের আঁচল ধরে টানা যায় আর মায়ের পার্থিবরূপ মনের মধ্যে দেখা যায়, তাঁকে অকপটে সুখ-দুঃখের কথা বলা যায়, প্রাত্যহিক যাপনে তাঁর স্নেহাশীর্বাদ অনুভব করা যায়, তাঁর চরণ স্পর্শ করে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়। 

শ্রীশ্রীমায়ের অন্যান্য নানা ভক্তদের মতোই, শ্রীমতি সরযুবালা দেবীর স্মৃতিকথাতেও মায়ের মাতৃরূপটি এমনভাবে ধরা আছে, যাঁকে যে কোনো সময়ে 'মা কেমন আছো' বলে জড়িয়ে ধরা যায়। উনি লিখছেন, 'একদিন স্কুলের ছুটি হলে গৌরীমার আশ্রম হতে মায়ের শ্রীচরণদর্শন করতে গেলুম। গ্রীষ্মকাল। সেদিন একটু পরিশ্রান্তও হয়েছিলুম। দেখি, মা একঘর স্ত্রী-ভক্তের মধ্যে বসে আছেন। আমি গিয়ে প্রণাম করতেই মূখপানে চেয়ে মশারির উপর হতে তাড়াতাড়ি পাখাখানি নিয়ে আমায় বাতাস করতে লাগলেন। ব্যস্ত হয়ে বললেন, "শীগগির গায়ের জামা খুলে ফেল, গায়ে হাওয়া লাগুক।" কি অপূর্ব স্নেহ-ভালবাসা! অত লােকের মধ্যে এত আদর-যত্ন! আমার ভারি লজ্জা করতে লাগল—সবাই চেয়ে দেখছিল; মা নিতান্ত ব্যস্ত হয়েছেন দেখে জামা খুলতেই হল। আমি যত বলি, "পাখা আমাকে দিন, আমি বাতাস খাচ্ছি," ততই স্নেহভরে বলতে লাগলেন, "তা হােক, তা হােক; একটু ঠাণ্ডা হয়ে নাও!" তারপর প্রসাদ ও এক গ্লাস জল এনে খাইয়ে তবে শান্ত হলেন।'

ঠাকুরের সন্তানরাও তাঁর সম্পর্কে যে স্মৃতিচারণা করে গেছেন, সেখানে তাঁর সান্নিধ্য শ্রীশ্রীমায়ের মতন এত সহজলভ্য না হলেও, তিনিও যে অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং ভক্তবৎসল ছিলেন, তা ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে। লাটু মহারাজ সকালবেলায় প্রথমে ঠাকুরের মুখ না দেখে অন্য কোনোদিকে তাকাতেন না। একদিন ঠাকুরকে ঘরে দেখতে না পেয়ে উনি ঘরের ভেতর থেকেই চিৎকার করে ডাকছেন। ঠাকুর তাঁকে ঘরের বাইরে আসতে বললেন। পশ্চিমদিকের বারান্দায় এসে লাটু মহারাজ দেখলেন যে ঠাকুর ফুল-বাগানে কিছু খুঁজছেন। উনি জিজ্ঞেস করলেন, "ওখানে কি খুঁজছেন মশাই?" ঠাকুর - "ওরে! কাল যে চটিজোড়া (...) এনে দিলে, তার একপাটি রয়েছে, আর একপাটি বোধহয় শেয়ালে নিয়ে গেছে। দেখছি, এখানে এনেছে কিনা!" ঠাকুর জুতো খুঁজছেন শুনে লাটু মহারাজ শিউরে উঠলেন, বললেন, "চলে আসুন, মশাই! আর আপুনাকে খুঁজতে হবে না!" ঠাকুর - "তাই তো রে! নতুন জুতোজোড়াটি তোর ভোগে হলো না। কাল সবে এনে দিলে, মাত্র একবার পায়ে দিয়েছিস।" এই কথা শুনে লাটু মহারাজ উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠেছিলেন - "আপুনি চলে আসুন মশাই! এতে যে হামার অকল্যাণ হবে। আপুনাকে ওসব খুঁজতে নেই - আজ দেখছি সারা দিনটা হামার বিলকুল খারাপ যাবে।" তাঁর কথা শুনে ঠাকুর হাসতে হাসতে বললেন, "দিন কি ওতে খারাপ যায় রে? যেদিন ভগবানের নাম হয়না, সেইদিনই খারাপ যায়।"

ঠাকুর হলেন সমস্ত পুরুষ দেবতাদের জীবন্ত রূপ আর মা হলেন সমস্ত শক্তিরূপিণী দেবীদের জীবন্তরূপ, যদিও দুইই এক, সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম। যাঁর যে নাম আর যে ইষ্টমূর্তিই ভালো লাগুক না কেন, নামীর সাক্ষাৎ ধ্যান-ধারণা করতে গেলে পুরুষ আর প্রকৃতির একেবারে জীবন্ত ফলিতরূপ হলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব আর শ্রীশ্রীমা। তাই ওঁদের কোনো বিশেষ sect নেই, কোনো বিশেষ মতবাদ নেই, কোনো গোঁড়ামী নেই - যত মত তত পথ। আমরা আমাদের ইষ্টকে যেভাবেই কল্পনা করি না কেন, ঠাকুর আর মায়ের মধ্যে গুণময় থেকে গুণাতীত সবটাই আছে। আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে ভগবানকে আমরা ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে পেয়েছি আর তাঁদের নাম জপ করার সময় তাঁদের পার্থিবরূপ এবং অনন্তরূপকে একাধারে ধ্যান-ধারণা করার মতো সুযোগ করে দিয়ে আমাদের সবাইকে তাঁরা অহেতুকি কৃপা করেছেন। এটাকেই আসলে কল্পতরু বলে।

Monday, August 8, 2022

স্থিরমতি হও

আমরা যখন চাকরি করতাম তখন যে কাজের চাপ কিছু কম ছিল, তা নয়। কর্মক্ষেত্রের রাজনীতি থেকে নিয়ে দমবন্ধ করা ডেডলাইন, সহকর্মীদের সাথে টিফিন ভাগ করে নেওয়া থেকে নিয়ে তাদের সাথেই কর্পোরেটদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার তীব্র প্রতিযোগিতা এবং ব্যক্তিগত দড়ি টানাটানি, সবই ছিল। আর যেমন যেমন ওপরে ওঠা গেছে তেমন তেমন নিচুতলা থেকে ছেঁকে উঠে আসা বিশুদ্ধ থেকে বিশুদ্ধতর সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে, আরো একাকী থেকে একাকীতর হতে হয়েছে, আরো অনেক সহকর্মীদের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে অনেক বেশি চাপ নিতে হয়েছে নিজের ঘাড়ে। তবু আমরা বার্নড আউট হয়ে যাইনি। ক্বচিৎকদাচিত বিনিদ্র রাত্রি যাপন করতে হলেও, ঘুমের ওষুধ খেয়ে জোর করে ঘুমাতে হয়নি কখনো। 

আশেপাশে দেখছি আমাদেরই ঘরের এখনকার ছেলেমেয়েদের কিন্তু হাঁড়ির হাল হচ্ছে। একেবারে এন্ট্রিলেভেল ম্যানেজমেন্ট এক্সিক্যুটিভরাও দেখছি চাপের চোটে নাজেহাল। আমরা অফিসটাকে অফিসেই রেখে আসতে পারতাম, এদের অনেকের জীবনে তো দেখি কাজ আর অবসরের মধ্যে কোনো ভারসাম্যই নেই। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ঠেলায় এরা সারা দিনরাতই অফিস মাথায় করে ঘুরছে আর কর্মক্ষেত্রজনিত উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও দুশ্চিন্তায় এদের অনেকেরই এমন দুর্দশা যে এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে আজ গাদা গাদা টাকা খরচ করে মনস্তত্ববিদদের সাহায্য নিতে হচ্ছে, স্ট্রেস কমানোর জন্য ওষুধ পর্য্যন্ত খেতে হচ্ছে। 

এরপর যখন এদের বিয়ে-থা হবে, যখন জীবনে সত্যিকারের চাপ আসবে, একদিকে সাংসারিক জীবনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং অন্যদিকে কর্মজীবনে ক্রমবর্ধমান দায়িত্বের বোঝা একসাথে মাথায় চাপবে, তখন যে এদের কি দশা হবে, ভাবলেই ভয় হয়। এই জন্যই কি আজকালকার ছেলেমেয়েরা এত ঘন ঘন চাকরি পাল্টায়? আর এই কারণেই কি বিবাহবিচ্ছেদও আজকাল এত বেড়ে গেছে? হয়তো তাই, ঠিক জানিনা। বা হয়তো এরা সেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার এবং সন্তুষ্ট থাকার শিক্ষাটুকু পায়নি যা আমাদের প্রজন্ম পেয়েছিল এবং তার জন্য আমরাই দায়ী। আমরা রাঙ্গাপিসি সেজমাসী ফুলকাকা আর নমামাদের দেখে বড় হয়েছি, আমরা জানতাম আমাদের সমস্ত জ্যাটতোতো খুড়তোতো মাসতোতো আর মামাতো ভাইবোনেরা মিলে একটাই বৃহৎ পরিবার। আমাদের একা একা নিজস্ব ঘুড়ি ওড়াতে নেই, লুকিয়ে লুকিয়ে নিজস্ব কিছু খেতেও নেই, বস্তুত যা কিছু বাড়িতে আছে তাতে সকলের সমান অধিকার। এই বেড়ে ওঠাটাই আজ উঠে গেছে যে।

আসলে এখনকার শিক্ষিত চাকরিরত প্রজন্ম বাইরে বাইরে যে রেহাইয়ের খোঁজ করছে, সেটা কিন্তু বাইরে নেই, সে আছে অন্তরে। সুখ কখনোই নিজের মনের বাইরে থাকে না, অপ্রয়োজনীয় এবং অন্তহীন চাহিদাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের মনের সুখকে মনের মধ্যেই সযত্নে লালন করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়।" আর তারপর বলেছেন, "এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ,
তাই মান অভিমান,
তাই এত হায় হায়।
প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।"

কেন এত ছোট বয়সে এদের এত এংক্সাইটি, এটা নিয়ে ইদানিং অনেক ভেবেছি। আমার মনে হয়েছে যে আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি ঈশ্বর অনিৰ্ভর, ফলে আমরা যেমন মহাশক্তির ওপর ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি, এরা সবটাই নিজেদের ওপর নিয়ে নিয়ে সারারাত ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বসে থাকে। আর যত এদের মনের ওপর চাপ বাড়তে থাকে, তত এরা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়কে কম্পিউটার গেমস, পার্টি, নাইট লাইফ ইত্যাদি বাইরের উদ্দীপক বস্তুতে খরচা করে নিজেদের শারীরিক ঘড়ির বারোটা বাজিয়ে ফেলে, যার আবার নিজস্ব ভোগান্তি আছে।

এদের তৃতীয় সমস্যা হলো ধ্যানহীনতা; অর্থাৎ নিজের মনটাকে সংযত করে, একাগ্র করে, নিজের ভেতরে ডুব দেওয়ার অভ্যাসের অভাব। অবশ্য নির্দিষ্ট ইষ্ট না থাকলে ধ্যানে মনোনিবেশ করা খুবই কঠিন কিন্তু আজকাল যাকে মেডিটেশন বলে, আদপে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা, সেটাও এরা বেশিরভাগই করে না। এদের অনেকের মধ্যেই দেখেছি গভীর ধর্মবোধ আছে কিন্তু একইসাথে পন্থবিমুখতা এদের মধ্যে এমন একটা আত্মদ্রোহ সৃষ্টি করছে, যা এদেরকে পূর্বপুরুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জুড়তে দিচ্ছে না। ফলে এই যে আমাদের নিজেকে খোঁজার বিরাট এক ঐতিহ্য, এই যে ত্যাগের মাধ্যমে ভোগের প্রাচীন দর্শন, এই যে কামের পরে মোক্ষের উদ্দেশ্যে যাত্রা, এই গভীর জীবনবোধ থেকে এরা অনেকেই বঞ্চিত।

বেচারাদের প্রধান খামতি হলো রোজগারের আসল উদ্দেশ্যকে বুঝতে না পারা। আমাদের কালে ছেলেদের ২৬-২৭এর মধ্যে বিয়ে হয়ে যেত, ৩০-৩২এর মধ্যে পরিবার কমপ্লিট। আমরা যখন চাকরি করতাম তখন আমরা জানতাম যে নিজের সংসার চালানোর দায় যেহেতু নিজেকেই নিতে হবে তাই রোজগার খুবই দরকার, চাকরির মানে কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। হ্যাঁ, যেমন যেমন প্রয়োজন বাড়বে তেমন তেমন রোজগারও বাড়াতে হবে, ফলে প্রোমোশনের জন্য লড়াই অবশ্যই ছিল কিন্তু আমরা অনেকেই যাকে আদ্যপান্ত কেরিয়ারিস্ট বলে, তা ছিলাম না। আমাদের বেশিরভাগেরই ধরাবাঁধা জীবন ছিল, অফিস পরিবার আর অবসরযাপনের মধ্যে একটা ঠিকঠাক সামঞ্জস্য ছিল, আর সন্তুষ্ট হতে বেশি বেগ পেতে হতো না।

আমরা অল্পতেই বেশি সুখী ছিলাম। আমাদের কাছে মাইনের মানে ছিল বউয়ের ছোট ছোট সাধপূরণ, ছেলেদের এবং পরিবারের প্রয়োজন এবং কিছুটা অপ্রয়োজনও মেটানো, জন্মদিনে শাড়ি উপহার পেয়ে মায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখা, মাঝে মাঝে সবাইকে নিয়ে ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া, নমাসে ছমাসে একবার সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, পরিবারের দোল দুর্গোৎসব বিয়ে অন্নপ্রাসন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে সবাইকে নিয়ে ফুর্তি করা, মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডা দেওয়া আর মাঠে গিয়ে ক্রিকেট ফুটবল খেলা দেখা, ইত্যাদি। আমাদের মধ্যে যারা ক্লাবে গিয়ে সন্ধ্যে কাটাতো তাদের কথা আলাদা, কিন্তু বেশিরভাগই ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে এবং তারা বিষয়টি ঠিকঠাক বুঝতে পারলেই যথেষ্ট সুখ পেতো। 

আমাদের মতন ঘরের এখনকার ছেলেদের মানসিকতা কিন্তু একেবারে আলাদা। এরা ৩২-৩৩এর আগে বিয়েই করেনা আর এদের কাছে মাইনের মানে নতুন নতুন গ্যাজেট, দামি দামি পোষাকঅসাক, আইফোন, দামি খেলনা, আরো কত কিই। কর্মজীবনের প্রাথমিক বছরগুলোয় এদের শুধু আমি আমি আমি - আমরা কোথাও নেই। আর ঘড়ি থেকে গাড়ি, সবেতেই অহেতুক কম্পিটিশন, প্লেন ছাড়া চড়া নেই, ছুটি কাটানোর জন্য খরচের মাবাবা নেই, আমদানির উদ্দেশ্যই হলো ভোগ, আরো ভোগ, অন্তহীন ভোগ। ফলে এদের যেমন ব্যক্তিগত অর্থের চাহিদার শেষ নেই, তেমনই উচ্চাকাঙ্ক্ষারও শেষ নেই আর বেশিরভাগকেই দেখি অর্থবান হওয়ার শর্টকাট পন্থা খুঁজে চলেছে। আমরা মধ্যবয়সী মা-বাপেরা অনেকেই নিজেরাও ইংরিজি মিডিয়াম স্কুল-কলেজে ইরফান হাবিব - রোমিলা থাপারদের লেখা গালগল্প পড়েই বড় হয়েছি কিন্ত আমরা আমাদের পারম্পরিক মূল্যবোধকে কখনো অস্বীকার করতে পারিনি কারণ আমাদের দাদু ঠাকুমা, আমাদের মা বাবা কাকা মামারা অকৃপণ হাতে সেটি আমাদের মধ্যে গেঁথে দিয়েছিলেন। অথচ আমরা আমাদের সন্তানদের ম্যাকলে নির্মিত সেই বিকৃত শিক্ষাব্যবস্থাটি হস্তান্তর করেছি ঠিকই কিন্তু ওদের মনের মধ্যে গড়ে ওঠা পারিবারিক সংস্কারের চারপাশে বেড়া দিতে ভুলে গিয়েছি, যার ফল বেচারারা আজ ভোগ করছে।

সময়ের সাথে সাথে জীবনধারণের স্বাচ্ছন্দ্য অবশ্যই বেড়েছে কিন্তু জীবনবোধ বেড়েছে কি? বরং লিপ্সা বেড়েছে, স্বার্থপরতা বেড়েছে আর পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিষন্নতা। আজকাল আকছার শুনছি ৩৫-৪০ বছর বয়সে গভীর মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে যাওয়ার কাহিনী, যুবক-যুবতীদের হটাৎ ব্রেনস্ট্রোক বা হার্টএট্যাকে প্রদীপ নিবে যাওয়ার কাহিনী, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাপ সহ্য করতে না পেরে কেরিয়ারের মধ্যগগনে হাল ছেড়ে দেওয়ার কাহিনীও। দুচোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ২৩শে চাকরিতে ঢুকে ৩৩ পৌঁছতে না পৌঁছতেই কমপ্লিট কর্পোরেট বার্নআউট - তারপর বাকি বছরগুলো ভয়ানক অশান্তি, বিতৃষ্ণা আর ক্রোধের আবহে ক্ষয় হতে হতে কোনোমতে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া, এটা তো কোনো কাজের কথা নয়। তাহলে উপায় কি?

উপায় শ্রীকৃষ্ণের দেখানো পথ অনুসরণ করা। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর কর্মযোগ বক্তৃতায় ষষ্ঠ অধ্যায়, প্যারা ৮এ বলছেন, "যদি কেউ দর্শনের একটা সূত্রও না পাঠ করে, যদি সে ঈশ্বরের অস্তিত্বেই না বিশ্বাস করে, এবং যদি সারা জীবনে একবারও ঈশ্বরের আরাধনা না করে, তবু শুভ কর্মসমূহের সরলক্ষমতা তাকে সেই অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে যেখানে পরের জন্য সে তার জীবন ও অন্য সব কিছুই উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হবে । এক্ষেত্রে একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি তার আরাধনার মাধ্যমে আর একজন দার্শনিক তার জ্ঞানের জন্য যে বিন্দুতে পৌঁছবে সেও সেই বিন্দুতেই পৌঁছতে সক্ষম । সুতরাং তোমরা নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে দার্শনিক, কর্মী ও ভক্ত সকলে একই বিন্দুতে মিলিত হয়; আর সেই বিন্দুই হচ্ছে আত্মোৎসর্গীকৃত হওয়া।"

ওই বক্তৃতারই সপ্তম অধ্যায়ে স্বামীজী যা বলছেন তার নির্যাস হলো এই: 'নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু কর্মে আসক্তি ত্যাগ কর। কোন কিছুর সাথে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলো না। মনকে মুক্ত রাখো। যা কিছু দেখছো, দুঃখ কষ্ট সবই জগতের অপরিহার্য পরিবেশ মাত্র। এগুলো সবই ক্ষণস্থায়ী, এগুলো আমাদের স্বভাবগত নয়। আমাদের স্বরূপ দুঃখ ও সুখের পারে - প্রত্যক্ষ বা কল্পনার অতীত। ...আসক্তি হতেই দুঃখ আসে, কর্ম হতে নয়। যখনই আমরা কর্মের সাথে নিজেদের অভিন্ন করে ফেলি, তখনই আমরা দুঃখ বোধ করি, কিন্তু কর্মের সাথে ঐভাবে জুড়ে না হয়ে গেলে সেই দুঃখ আর অনুভব করি না।' গীতা ছাড়া গতি নেই। যেখানে জীবন গুলিয়ে যাবে, সেখানেই গীতা উদ্ধারকারীর ভূমিকা পালন করে। তাই আমি যুবক-যুবতীদের বিষাদগ্রস্ত দেখলেই গীতা পড়তে উজ্জীবিত করি। কর্মযোগে স্বামীজীর বক্তৃতার মধ্যেই মতিস্থির করার উপায় রয়েছে, "ক্রন্দন তো বন্ধনের চিহ্ন - দুর্বলতার চিহ্ন। একবিন্দু চোখের জল যেন না পড়ে। এইরূপ হবার উপায় কি? সম্পূর্ণ অনাসক্ত হও।"

Wednesday, August 3, 2022

সমদর্শন

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়-ধ্যানযোগে শ্রীকৃষ্ণ আর অর্জুনের মধ্যে একটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথোপকথন আছে। শ্রীভগবান বলছেন,
সর্বভূতস্থমাত্মনং সর্বভূতানি চাত্মনি। 
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।।
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি। 
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।
সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ।
সর্বথা বর্তমানোহপি স যোগী ময়ি বর্ততে।।
আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন। 
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ।।
অনুবাদঃ 
- প্রকৃত যোগী সর্বভূতে আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতে সব কিছু দর্শন করেন। যোগযুক্ত আত্মা সর্বত্রই আমাকে দর্শন করেন। 
- যিনি সর্বত্র আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতেই সমস্ত বস্তু দর্শন করেন, আমি কখনও তাঁর দৃষ্টির অগোচর হই না এবং তিনিও আমার দৃষ্টির অগোচর হন না। 
- যে যোগী সর্বভূতে আমাকেই স্থিত জেনে আমার ভজনা করেন, তিনি সর্ব অবস্থাতেই আমাতে অবস্থান করেন। 
- হে অর্জুন! যিনি সমস্ত জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখের অনুরূপ সমানভাবে দর্শন করেন, আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। 

অর্জুনের মতন অমন উচ্চকোটির যোগী, স্বয়ং ভগবান যাঁর সখা এবং যিনি নিজে বিশ্বরূপ দর্শন করার অধিকারী মহাধার, তিনি পর্য্যন্ত এই সমদর্শনভাবকে খুব সহজে অনুশীলনযোগ্য বলে মনে করতে পারছেন না। বলছেন,
যোহয়ং যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন। 
এতস্যাহং ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্।।
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্।
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্।।
- হে মধুসূদন! তুমি সর্বত্র সমদর্শনরূপ যে যোগ উপদেশ করলে, মনের চঞ্চল স্বভাববশত আমি তার স্থায়ী স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না। 
- হে কৃষ্ণ ! মন বড় চঞ্চল, বিক্ষেপ-উৎপাদক, জেদি এবং অত্যন্ত বলবান, তাই তাকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি৷

তখন শ্রীভগবান উত্তর দিচ্ছেন,
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।।
অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ। 
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোহবাপ্তুমুপায়তঃ।।
- হে মহাবাহো! মন যে দুর্দমনীয় ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়, ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যর দ্বারা মনকেও বশীভূত করা যায়। 
- অসংযত চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে আত্ম-উপলব্ধি দুষ্প্রাপ্য বটে কিন্তু যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ উপায় অবলম্বন করে মনকে বশ করতে চেষ্টা করেন, তিনি অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করেন। এটিই আমার অভিমত।

কুরুক্ষেত্রে এই বাক্যালাপের প্রায় আট হাজার বছর পরে, আমাদের এই বঙ্গদেশে, শ্রীকৃষ্ণেরই আর একজন অবতারের সাথে তাঁর কথামৃতকার শিষ্য মাস্টারমশাইয়ের কথোপকথনেও এই একই ভাব একদম বাস্তব হয়ে ফুটে উঠেছে। ২৭শে ডিসেম্বর ১৮৮৪, দেবী চৌধুরাণীর প্রসঙ্গ টেনে ঈশ্বর কি প্রত্যক্ষ হন, এই কথা হচ্ছে। 

শ্রীরামকৃষ্ণ — মনের প্রত্যক্ষ। সে এ-মনের নয়। সে শুদ্ধমনের। এ-মন থাকে না। বিষয়াসক্তি একটুও থাকলে হয় না। মন যখন শুদ্ধ হয়, শুদ্ধমনও বলতে পার, শুদ্ধ আত্মাও বলতে পার।

মাস্টার — মনের দ্বারা প্রত্যক্ষ যে সহজে হয় না, এ-কথা একটু পরে আছে। বলেছে প্রত্যক্ষ করতে দূরবীন চাই। ওই দূরবীনের নাম যোগ। তারপর যেমন গীতায় আছে, বলেছে, যোগ তিনরকম — জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ। এই যোগ-দূরবীন দিয়ে ঈশ্বরকে দেখা যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এ খুব ভাল কথা। গীতার কথা। ....প্রতিমায় ঈশ্বরের পূজা হয় আর জীয়ন্ত মানুষে কি হয় না? তিনিই মানুষ হয়ে লীলা করছেন।

"কি অবস্থা গেছে। হরগৌরীভাবে কতদিন ছিলুম। আবার কতদিন রাধাকৃষ্ণভাবে! কখন সীতারামের ভাবে! রাধার ভাবে কৃষ্ণ কৃষ্ণ করতুম, সীতার ভাবে রাম রাম করতুম!

"তবে লীলাই শেষ নয়। এই সব ভাবের পর বললুম, মা এ-সব বিচ্ছেদ আছে। যার বিচ্ছেদ নাই, এমন অবস্থা করে দাও। তাই কতদিন অখণ্ড সচ্চিদানন্দ এই ভাবে রইলুম। ঠাকুরদের ছবি ঘর থেকে বার করে দিলুম।

"তাঁকে সর্বভূতে দর্শন করতে লাগলুম। পূজা উঠে গেল! এই বেলগাছ! বেলপাতা তুলতে আসতুম! একদিন পাতা ছিঁড়তে গিয়ে আঁশ খানিকটা উঠে এল। দেখলাম গাছ চৈতন্যময়! মনে কষ্ট হল। দূর্বা তুলতে গিয়ে দেখি, আর-সেরকম করে তুলতে পারিনি। তখন রোখ করে তুলতে গেলুম।

"আমি লেবু কাটতে পারি না। সেদিন অনেক কষ্টে, ‘জয় কালী’ বলে তাঁর সম্মুখে বলির মতো করে তবে কাটতে পেরেছিলুম। একদিন ফুল তুলতে গিয়ে দেখিয়ে দিলে, — গাছে ফুল ফুটে আছে, যেন সম্মুখে বিরাট — পূজা হয়ে গেছে — বিরাটের মাথায় ফুলের তোড়া! আর ফুল তোলা হল না!

"তিনি মানুষ হয়েও লীলা করছেন। আমি দেখি, সাক্ষাৎ নারায়ণ। কাঠ ঘষতে ঘষতে আগুন বেরোয়, ভক্তির জোর থাকলে মানুষেতেই ঈশ্বর দর্শন হয়। তেমন টোপ হলে বড় রুই কাতলা কপ্‌ করে খায়। 

"প্রেমোন্মাদ হলে সর্বভূতে সাক্ষাৎকার হয়। গোপীরা সর্বভূতে শ্রীকৃষ্ণ দর্শন করেছিল। কৃষ্ণময় দেখেছিল। বলেছিল, আমি কৃষ্ণ! তখন উন্মাদ অবস্থা! গাছ দেখে বলে, এরা তপস্বী, শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করছে। তৃণ দেখে বলে, শ্রীকৃষ্ণকে স্পর্শ করে ওই দেখ পৃথিবীর রোমাঞ্চ হয়েছে।”

আমরা যাঁকে শ্রীশ্রীমায়ের ভান্ডারী বলে জানি সেই শরৎ মহারাজকে বালক বয়সে একদিন শ্রীরামকৃষ্ণদেব জিজ্ঞেস করেছিলেন, "কিরে, তুই কিছু চাইলি না যে?" সেদিন পরবর্তীকালের ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ শ্রীমৎ স্বামী সারদানন্দজী মহারাজ তাঁকে বলেছিলেন, "আমি যাতে সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শন করি, এরূপ করে দিন।" উত্তরে ঠাকুর বলেছিলেন, "ও যে শেষের কথা রে! তা তোর হবে।" এই গুরুবাক্য কিভাবে তাঁর জীবনে অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল তার একটি প্রমান 'প্রাচীন সাধুদের কথা' বইটিতে আছে। জনৈক ভক্ত একবার স্বামী সারদানন্দজীকে জিজ্ঞাসা করেন, "আপনি আমাদের এত ভালবাসেন কেন? দেখুন, শেষে জড়ভরতের মতো বদ্ধ না হয়ে যান।" স্বামী সারদানন্দজী কোন উত্তর দিলেন না। কয়েকদিন পর ঐ ভক্ত উদ্বোধনে এলে মহারাজ বললেন , "সেদিন বেলুড় মঠে গিয়ে ঠাকুরের সামনে প্রনাম করলাম। ঠাকুর আবির্ভুত হয়ে আমাকে বললেন ---- 'তুই সবাইকে ভালবাসিস কারন, তুই আমাকে সবার মধ্যে দেখিস।' সেদিন তুমি যে প্রশ্ন করেছিলে, এই হল তার উত্তর।" এই স্মৃতিচারণটি করে ছলছল চোখে তাঁরই শিষ্য এবং রামকৃষ্ণসঙ্ঘের দ্বাদশ সঙ্ঘগুরু শ্রীমৎ স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে গীতার সেই পূর্বোল্লেখিত শ্লোকটি বলেছিলেন, 
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি। 
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।