শ্রীকৃষ্ণ বন্দে জগৎগুরুম্!
শ্রীকৃষ্ণের জন্মের রাত ছিল সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে, যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয়। সেই রাত ছিল গভীর অন্ধকার এবং ঘোর বৃষ্টিময়। কংসের কারাগার আলো করে তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পিতা বসুদেব দেখলেন শিশুটির চারটি হাত এবং তাতে তিনি শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করে আছেন। বাসুদেব বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গলার্থে স্বয়ং নারায়ণ তাঁদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। বসুদেব করজোড়ে প্রণাম ও বন্দনার পর দেবকীও নবজাতকের কাছে প্রার্থনা করলেন এবং তখন শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন মাতা দেবকীর অষ্টম সন্তান।
এর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পর তীর্থ ভ্রমণে গয়ায় এসে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন। গদাধর বিষ্ণু তাঁকে দেখা দিয়ে তাঁর ঘরে পুত্ররূপে আসতে চাইলেন। ক্ষুদিরাম ছিলেন ঈশ্বরগতপ্রাণ। দরিদ্র তিনি, তাঁর ঘরে এলে প্রভুর কত কষ্ট হবে, তা অকপটে নিবেদন করলেন। নারায়ণ কিন্তু হেসে আবার তার ঘরেই আসতে চাইলেন। এদিকে কামারপুকুরে চন্দ্রমণি দেবীরও এক অদ্ভুত দর্শন হয়েছিল। বাড়ির কাছে যুগীদের শিব মন্দিরে গিয়েছিলেন তিনি। অকস্মাৎ এক জ্যোতি শিববিগ্রহ থেকে নির্গত হয়ে প্রবেশ করেছিল তাঁর দেহে। ক্ষুদিরাম ও চন্দ্রমণি, উভয়েরই বিশ্বাস হয়েছিল ভগবান পুত্ররূপে তাঁদের কাছে আসছেন। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে ১৮ই ফেব্রুয়ারী (৬ই ফাল্গুন, শুক্লা দ্বিতীয়া তিথি) কামারপুকুরে ক্ষুদিরামের বাড়ীর ঢেঁকিশালে তাঁর তৃতীয় পুত্র গদাধরের জন্ম হয়েছিল।
শ্রীবিষ্ণু কি সত্যি সত্যিই বারেবারে সশরীরে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন? স্বমুখে শ্রীকৃষ্ণ যেমন তাঁর আত্মপরিচয় দিয়ে গিয়েছেন তেমনি একদিন দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বাবুরাম প্রভৃতি ভক্তদের সঙ্গে বসে ছিলেন, দিনটি ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ, ৭ই মার্চ, বেলা ৩টা-৪টা হবে, ভক্তেরা পদসেবা করছেন, এমন সময় শ্রীরামকৃষ্ণ একটু হেসে ভক্তদের বললেন, "এর (অর্থাৎ পদসেবার) অনেক মানে আছে।" তারপর নিজের হৃদয়ে হাত রেখে বললেন, "এর ভিতর যদি কিছু থাকে (পদসেবা করলে) অজ্ঞান অবিদ্যা একেবারে চলে যাবে।"
তারপর হঠাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ গম্ভীর হয়ে গেলেন, যেন কি গুহ্যকথা বলবেন। তারপর ভক্তদের ঠাকুর বললেন, "এখানে বাহিরের লোক কেউ নাই, তোমাদের একটা গুহ্যকথা বলছি। সেদিন দেখলাম, আমার ভিতর থেকে সচ্চিদানন্দ বাইরে এসে রূপ ধারণ করে বললে, আমিই যুগে যুগে অবতার। দেখলাম পূর্ণ আর্বিভাব, তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য।" কথামৃতকার লিখছেন, 'ভক্তেরা এই সকল কথা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন। কেহ কেহ গীতোক্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহাবাক্য স্মরণ করিতেছেন —
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ৷৷
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ৷৷'
ঠাকুরের যখন প্রেমোন্মাদ অবস্থা, লোকে যখন ওঁকে পাগল ভাবছে, তখন ভৈরবী ব্রাহ্মণী কিন্তু ঠাকুরের পরিবর্তনগুলিকে ঠিক ঠিক চিনতে পেরেছিলেন। এগুলি যে কোন রোগ নয়, কেবল সাধকের বিশেষ অবস্থার বাহ্যিক লক্ষণ মাত্র, তা তিনি শাস্ত্রের গভীর অধ্যয়ন ও প্রতীতি থেকেই বুঝেছিলেন। ফুলের মালা পরলে বা গায়ে চন্দনের প্রলেপ দিলে যে এই যন্ত্রণার উপশম হয়, তাও তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। শ্রীমতি রাধারানী থেকে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য পর্যন্ত যোগী আচার্যদের জীবনে আধ্যাত্মিক অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে যে অনুরূপ শারীরিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল - ভক্তিগ্রন্থসমূহ ও শাস্ত্রসমূহ উদ্ধৃত করে ভৈরবী তা সোচ্চারে ঘোষণা করতে একবিন্দু দ্বিধা করেননি।
তারপর মথুরবাবু সে কালের বিখ্যাত পন্ডিত বৈষ্ণবচরণকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে। যে প্রধান উনিশটি ভাব বা অবস্থার সম্মিলনকে ভক্তিশাস্ত্রে মহাভাব বলা হয়, যা আগে শ্রীরাধিকা ও শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনে দেখা গিয়েছিল, বৈষ্ণবচরণ সেই সবকটি লক্ষণই দেখতে পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে। পরবর্তিকালে শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে তান্ত্রিক সাধক গৌরী পন্ডিতের অহংকারও খর্ব হয়েছিল। তিনি ঠাকুরকে চিনেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বররূপে ও ঈশ্বরলাভের জন্য সংসার ত্যাগ করেছিলেন।
মহাসমাধির কয়েকদিন আগে নরেন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে তাঁর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ঠাকুর সমাধিস্থ হন। নরেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল ঠাকুরের দেহ থেকে সূক্ষ্ম তেজরশ্মি, তড়িৎকম্পনের মত তাঁর শরীরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। সমাধিভঙ্গ হলে অশ্রু বিসর্জন করে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন,"আজ যথাসর্বস্ব তোকে দিয়ে ফকির হলুম, তুই এই শক্তিতে জগতের কাজ করবি। কাজ শেষ হলে ফিরে যাবি।" ঠাকুর কি সত্যিই অবতার, এই সংশয় তখনও সম্পূর্ণ নিরসন হয়নি যুক্তিবাদী নরেন্দ্রনাথের হৃদয় থেকে। অন্তর্যামী ঠাকুর তা উপলব্ধি করে বলেছিলেন, "সত্যি সত্যি বলছি, যে রাম যে কৃষ্ণ সেই ইদানিং এই শরীরে রামকৃষ্ণ – তবে তোর বেদান্তের দিক দিয়ে নয়।"
এসবের অনেকবছর পরে স্বামীজী যখন আমেরিকায় গীতা ও নারদসূত্রাদি গ্রন্থ অবলম্বন করে ভক্তিযোগ নামক গ্রন্থ লিখছেন, তখন শ্রীরামকৃষ্ণকে স্মরণ করে তাতে তিনি বলছেন, "Higher and nobler than all ordinary ones, is another set of teachers, the Avataras of Ishvara, in the world. They can transmit spirituality with a touch, even with a mere wish. The lowest and the most degraded characters become in one second saints at their command. They are the Teachers of all teachers, the highest manifestations of God through man. We cannot see God except through them. We cannot help worshipping them; and indeed they are the only ones whom we are bound to worship."
আমেরিকাতেই 'Christ the Messenger' নামক বক্তৃতায় স্বামীজী আরো বিস্তারিতভাবে অবতারত্বের প্রসঙ্গ বুঝিয়ে বলছেন, "Thou hast seen me and not seen the Father? I and my Father are one! The kingdom of Heaven is within you! If I am pure enough I will also find in the heart of my heart, I and my Father are one. That was what Jesus of Nazareth said.
"It has been said by the same Messenger (Christ) 'None hath seen God, but they have seen the Son.' And that is true. And where to see God but in the Son? It is true that you and I, the poorest of us, the meanest even, embody that God — even reflect that God. The vibration of light is everywhere, omnipresent; but we have to strike the light of the lamp there and then we human beings see that He is Omnipresent. The Omnipresent God of the Universe cannot be seen until He is reflected by these giant lamps of the earth; the Prophets, the Man-Gods, the Incarnations, the embodiments of God .... They are all manifestations of the same Infinite God. They were all pure and unselfish; they struggled, and gave up their lives for us, poor human beings. They all and each of them bore Vicarious atonement for every one of us and also for all that are to come hereafter."
কথামৃতে একটা বেশ মজার কথোপকথন আছে, দিনটি ছিল ১৮ই অক্টোবর, ১৮৮৫। নাট্যাচার্য্য গিরিশ চন্দ্র ঘোষের সাথে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের আলোচনা হচ্ছে।
ডাক্তার - 'অবতার আবার কি! যে মানুষ হাগে মোতে তার পদানত হব! হাঁ, তবে Reflection of God's light (ঈশ্বরের জ্যোতি) মানুষে প্রকাশ হয়ে থাকে তা মানি।' উত্তরে গিরিশবাবু তাঁর বিশ্বাসের কথা বলছেন এমন সময় ঠাকুর হস্তক্ষেপ করলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ - এ-সব যা কথা হচ্ছে, এ কিছুই নয়। .... যতক্ষণ কাঁচা ঘি, ততক্ষণই কলকলানি শোনা যায়। পাকা হলে আর শব্দ থাকে না। যার যেমন মন, ঈশ্বরকে সেইরূপ দেখে। আমি দেখেছি, বড় মানুষের বাড়ির ছবি - কুইন-এর ছবি আছে। আবার ভক্তের বাড়ি - ঠাকুরদের ছবি! .... পূর্ণজ্ঞানের লক্ষণ আছে। বিচার বন্ধ হয়ে যায়। যা বললুম, কাঁচা থাকলেই ঘিয়ের কলকলানি।
ডাক্তার - পূর্ণজ্ঞান থাকে কি? সব ঈশ্বর! তবে তুমি পরমহংসগিরি করছো কেন? আর এরাই বা এসে তোমার সেবা করছে কেন? চুপ করে থাক না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) - জল স্থির থাকলেও জল, হেললে দুললেও জল, তরঙ্গ হলেও জল।
No comments:
Post a Comment