ঠাকুর তাঁর শিষ্যদের শুধু নাম করতে বলতেন না, বলতেন সেই সাথে নামীর ধ্যান-ধারণাও করতে হয়। ঠাকুরের অনেক সন্তানই তাঁর এই কথাটি বলেছেন বটে কিন্তু কিভাবে যে ঠাকুর নামীর ধ্যান-ধারণা করতে শেখাতেন, সেই বিষয়টি আর বলেননি। একবার বলরাম মন্দিরে এক ভক্ত লাটু মহারাজকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "ধ্যেয় একমাত্র ভগবান। ভগবান ছাড়া আবার কার ধ্যান-ধারণা করবে? যাঁকে ধরেই এগোও না কেন, শেষে তাঁরই কাছে গিয়ে পৌঁছবে।"
এই উত্তরেও কিন্তু modus operandi নেই, কেবল ইঙ্গিত আছে। সত্যিই তো, আমার পছন্দের ভগবান কালী হন বা কৃষ্ণ, শিব হন বা ব্রহ্মা, তাঁর যে মূর্তিই পছন্দ করি না কেন, তাঁকে তো চাক্ষুষ দেখিনি, কেবল স্তব স্তোত্র পুরাণ পড়ে তাঁর সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করবো কি করে? ধারণা করবো গুরুকে দেখে। লাটু মহারাজ বলছেন, "গুরু - সচ্চিদানন্দ। ... আসলি গুরুর মন সবসময় তাঁতেই যুক্ত থাকে, জানবে। তাই তাঁর (ভগবান) সাথে আসলি গুরুর কোনো ভেদ থাকে না। শাস্ত্রে তাই লেখা আছে - 'গুরু ব্রহ্ম এক'।"
যাঁদের গুরুই ইষ্ট এবং ইষ্টই গুরু, তাঁদের ক্ষেত্রে নাম ও নামীর ধ্যান-ধারণা কি ভাবে করা যায়, এটা তার একটা সূত্র বৈকি। আমাদের রামকৃষ্ণ ভাবধারায় ঠাকুরই গুরু, আবার তিনিই ইষ্ট। যেহেতু আমরা ঠাকুরের একাধিক আসল photograph দেখতে পাই, তাঁর থাকার জায়গা, তাঁর ব্যবহার করা জিনিষ্পত্তর, তাঁর হাতে পোঁতা আঁটির আমগাছ ইত্যাদি স্বচক্ষে দেখতে পাই আর কথামৃত, লীলাপ্রসঙ্গ এবং অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীদের লেখায় তাঁর মুখের ভাষা শুনতে পাই, তিনি কিভাবে থাকতেন, কি কি করতেন ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে পারি, ফলে এক্ষেত্রে নাম আর নামীকে এক জেনে তাঁর সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়না।
একই ব্যাপার শ্রীশ্রীমায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মা কালীর মূর্তি যতই দার্শনিকভাবে অজ্ঞানীর অজ্ঞানকে ধ্বংস করে ভগবৎকৃপায় জ্ঞানের আলো জ্বালানোর প্রতীকী অপার্থিবরূপ হোন না কেন, তাঁর মাতৃরূপকে ধারণা করা সাধারণ ভক্তের পক্ষে খুব একটা সহজসাধ্য নয়, সাধক হলে অন্য কথা। কিন্তু মাকে আপন মা, কল্যাণদাত্রী, মঙ্গলময়ী, মুর্তিময়ী বাৎসল্য বলে বুঝে নিতে মোটেও বেগ পেতে হয়না, ও বড় সহজ। ঠাকুরের তাও নাহয় কিছু বাছবিচার ছিল, মায়ের তো অবারিতদ্বার - একাধারে তিনি একদিকে সর্বংসহা, মমতার প্রতিমূর্তি, যেন আমাদের রক্তমাংসের মা আবার অন্যদিকে পরমজ্ঞানদাত্রী, জগ্গজননী, মহাশক্তি, জগন্মাতা, মোক্ষপ্রদায়িনী মহামায়া, সত্যিকারের মা। মা কালীকে আমরা হয়তো ভক্তি করতে পারি, দূর থেকে প্রণাম করতে পারি কিন্তু এই মায়ের কাছে আবদার করা যায়, ঘ্যান ঘ্যান করা যায়, মাকে বিরক্ত করা যায়, মায়ের আঁচল ধরে টানা যায় আর মায়ের পার্থিবরূপ মনের মধ্যে দেখা যায়, তাঁকে অকপটে সুখ-দুঃখের কথা বলা যায়, প্রাত্যহিক যাপনে তাঁর স্নেহাশীর্বাদ অনুভব করা যায়, তাঁর চরণ স্পর্শ করে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়।
শ্রীশ্রীমায়ের অন্যান্য নানা ভক্তদের মতোই, শ্রীমতি সরযুবালা দেবীর স্মৃতিকথাতেও মায়ের মাতৃরূপটি এমনভাবে ধরা আছে, যাঁকে যে কোনো সময়ে 'মা কেমন আছো' বলে জড়িয়ে ধরা যায়। উনি লিখছেন, 'একদিন স্কুলের ছুটি হলে গৌরীমার আশ্রম হতে মায়ের শ্রীচরণদর্শন করতে গেলুম। গ্রীষ্মকাল। সেদিন একটু পরিশ্রান্তও হয়েছিলুম। দেখি, মা একঘর স্ত্রী-ভক্তের মধ্যে বসে আছেন। আমি গিয়ে প্রণাম করতেই মূখপানে চেয়ে মশারির উপর হতে তাড়াতাড়ি পাখাখানি নিয়ে আমায় বাতাস করতে লাগলেন। ব্যস্ত হয়ে বললেন, "শীগগির গায়ের জামা খুলে ফেল, গায়ে হাওয়া লাগুক।" কি অপূর্ব স্নেহ-ভালবাসা! অত লােকের মধ্যে এত আদর-যত্ন! আমার ভারি লজ্জা করতে লাগল—সবাই চেয়ে দেখছিল; মা নিতান্ত ব্যস্ত হয়েছেন দেখে জামা খুলতেই হল। আমি যত বলি, "পাখা আমাকে দিন, আমি বাতাস খাচ্ছি," ততই স্নেহভরে বলতে লাগলেন, "তা হােক, তা হােক; একটু ঠাণ্ডা হয়ে নাও!" তারপর প্রসাদ ও এক গ্লাস জল এনে খাইয়ে তবে শান্ত হলেন।'
ঠাকুরের সন্তানরাও তাঁর সম্পর্কে যে স্মৃতিচারণা করে গেছেন, সেখানে তাঁর সান্নিধ্য শ্রীশ্রীমায়ের মতন এত সহজলভ্য না হলেও, তিনিও যে অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং ভক্তবৎসল ছিলেন, তা ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে। লাটু মহারাজ সকালবেলায় প্রথমে ঠাকুরের মুখ না দেখে অন্য কোনোদিকে তাকাতেন না। একদিন ঠাকুরকে ঘরে দেখতে না পেয়ে উনি ঘরের ভেতর থেকেই চিৎকার করে ডাকছেন। ঠাকুর তাঁকে ঘরের বাইরে আসতে বললেন। পশ্চিমদিকের বারান্দায় এসে লাটু মহারাজ দেখলেন যে ঠাকুর ফুল-বাগানে কিছু খুঁজছেন। উনি জিজ্ঞেস করলেন, "ওখানে কি খুঁজছেন মশাই?" ঠাকুর - "ওরে! কাল যে চটিজোড়া (...) এনে দিলে, তার একপাটি রয়েছে, আর একপাটি বোধহয় শেয়ালে নিয়ে গেছে। দেখছি, এখানে এনেছে কিনা!" ঠাকুর জুতো খুঁজছেন শুনে লাটু মহারাজ শিউরে উঠলেন, বললেন, "চলে আসুন, মশাই! আর আপুনাকে খুঁজতে হবে না!" ঠাকুর - "তাই তো রে! নতুন জুতোজোড়াটি তোর ভোগে হলো না। কাল সবে এনে দিলে, মাত্র একবার পায়ে দিয়েছিস।" এই কথা শুনে লাটু মহারাজ উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠেছিলেন - "আপুনি চলে আসুন মশাই! এতে যে হামার অকল্যাণ হবে। আপুনাকে ওসব খুঁজতে নেই - আজ দেখছি সারা দিনটা হামার বিলকুল খারাপ যাবে।" তাঁর কথা শুনে ঠাকুর হাসতে হাসতে বললেন, "দিন কি ওতে খারাপ যায় রে? যেদিন ভগবানের নাম হয়না, সেইদিনই খারাপ যায়।"
ঠাকুর হলেন সমস্ত পুরুষ দেবতাদের জীবন্ত রূপ আর মা হলেন সমস্ত শক্তিরূপিণী দেবীদের জীবন্তরূপ, যদিও দুইই এক, সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম। যাঁর যে নাম আর যে ইষ্টমূর্তিই ভালো লাগুক না কেন, নামীর সাক্ষাৎ ধ্যান-ধারণা করতে গেলে পুরুষ আর প্রকৃতির একেবারে জীবন্ত ফলিতরূপ হলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব আর শ্রীশ্রীমা। তাই ওঁদের কোনো বিশেষ sect নেই, কোনো বিশেষ মতবাদ নেই, কোনো গোঁড়ামী নেই - যত মত তত পথ। আমরা আমাদের ইষ্টকে যেভাবেই কল্পনা করি না কেন, ঠাকুর আর মায়ের মধ্যে গুণময় থেকে গুণাতীত সবটাই আছে। আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে ভগবানকে আমরা ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে পেয়েছি আর তাঁদের নাম জপ করার সময় তাঁদের পার্থিবরূপ এবং অনন্তরূপকে একাধারে ধ্যান-ধারণা করার মতো সুযোগ করে দিয়ে আমাদের সবাইকে তাঁরা অহেতুকি কৃপা করেছেন। এটাকেই আসলে কল্পতরু বলে।
No comments:
Post a Comment