Monday, August 8, 2022

স্থিরমতি হও

আমরা যখন চাকরি করতাম তখন যে কাজের চাপ কিছু কম ছিল, তা নয়। কর্মক্ষেত্রের রাজনীতি থেকে নিয়ে দমবন্ধ করা ডেডলাইন, সহকর্মীদের সাথে টিফিন ভাগ করে নেওয়া থেকে নিয়ে তাদের সাথেই কর্পোরেটদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার তীব্র প্রতিযোগিতা এবং ব্যক্তিগত দড়ি টানাটানি, সবই ছিল। আর যেমন যেমন ওপরে ওঠা গেছে তেমন তেমন নিচুতলা থেকে ছেঁকে উঠে আসা বিশুদ্ধ থেকে বিশুদ্ধতর সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে, আরো একাকী থেকে একাকীতর হতে হয়েছে, আরো অনেক সহকর্মীদের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে অনেক বেশি চাপ নিতে হয়েছে নিজের ঘাড়ে। তবু আমরা বার্নড আউট হয়ে যাইনি। ক্বচিৎকদাচিত বিনিদ্র রাত্রি যাপন করতে হলেও, ঘুমের ওষুধ খেয়ে জোর করে ঘুমাতে হয়নি কখনো। 

আশেপাশে দেখছি আমাদেরই ঘরের এখনকার ছেলেমেয়েদের কিন্তু হাঁড়ির হাল হচ্ছে। একেবারে এন্ট্রিলেভেল ম্যানেজমেন্ট এক্সিক্যুটিভরাও দেখছি চাপের চোটে নাজেহাল। আমরা অফিসটাকে অফিসেই রেখে আসতে পারতাম, এদের অনেকের জীবনে তো দেখি কাজ আর অবসরের মধ্যে কোনো ভারসাম্যই নেই। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ঠেলায় এরা সারা দিনরাতই অফিস মাথায় করে ঘুরছে আর কর্মক্ষেত্রজনিত উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও দুশ্চিন্তায় এদের অনেকেরই এমন দুর্দশা যে এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে আজ গাদা গাদা টাকা খরচ করে মনস্তত্ববিদদের সাহায্য নিতে হচ্ছে, স্ট্রেস কমানোর জন্য ওষুধ পর্য্যন্ত খেতে হচ্ছে। 

এরপর যখন এদের বিয়ে-থা হবে, যখন জীবনে সত্যিকারের চাপ আসবে, একদিকে সাংসারিক জীবনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং অন্যদিকে কর্মজীবনে ক্রমবর্ধমান দায়িত্বের বোঝা একসাথে মাথায় চাপবে, তখন যে এদের কি দশা হবে, ভাবলেই ভয় হয়। এই জন্যই কি আজকালকার ছেলেমেয়েরা এত ঘন ঘন চাকরি পাল্টায়? আর এই কারণেই কি বিবাহবিচ্ছেদও আজকাল এত বেড়ে গেছে? হয়তো তাই, ঠিক জানিনা। বা হয়তো এরা সেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার এবং সন্তুষ্ট থাকার শিক্ষাটুকু পায়নি যা আমাদের প্রজন্ম পেয়েছিল এবং তার জন্য আমরাই দায়ী। আমরা রাঙ্গাপিসি সেজমাসী ফুলকাকা আর নমামাদের দেখে বড় হয়েছি, আমরা জানতাম আমাদের সমস্ত জ্যাটতোতো খুড়তোতো মাসতোতো আর মামাতো ভাইবোনেরা মিলে একটাই বৃহৎ পরিবার। আমাদের একা একা নিজস্ব ঘুড়ি ওড়াতে নেই, লুকিয়ে লুকিয়ে নিজস্ব কিছু খেতেও নেই, বস্তুত যা কিছু বাড়িতে আছে তাতে সকলের সমান অধিকার। এই বেড়ে ওঠাটাই আজ উঠে গেছে যে।

আসলে এখনকার শিক্ষিত চাকরিরত প্রজন্ম বাইরে বাইরে যে রেহাইয়ের খোঁজ করছে, সেটা কিন্তু বাইরে নেই, সে আছে অন্তরে। সুখ কখনোই নিজের মনের বাইরে থাকে না, অপ্রয়োজনীয় এবং অন্তহীন চাহিদাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের মনের সুখকে মনের মধ্যেই সযত্নে লালন করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়।" আর তারপর বলেছেন, "এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ,
তাই মান অভিমান,
তাই এত হায় হায়।
প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।"

কেন এত ছোট বয়সে এদের এত এংক্সাইটি, এটা নিয়ে ইদানিং অনেক ভেবেছি। আমার মনে হয়েছে যে আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি ঈশ্বর অনিৰ্ভর, ফলে আমরা যেমন মহাশক্তির ওপর ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি, এরা সবটাই নিজেদের ওপর নিয়ে নিয়ে সারারাত ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বসে থাকে। আর যত এদের মনের ওপর চাপ বাড়তে থাকে, তত এরা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়কে কম্পিউটার গেমস, পার্টি, নাইট লাইফ ইত্যাদি বাইরের উদ্দীপক বস্তুতে খরচা করে নিজেদের শারীরিক ঘড়ির বারোটা বাজিয়ে ফেলে, যার আবার নিজস্ব ভোগান্তি আছে।

এদের তৃতীয় সমস্যা হলো ধ্যানহীনতা; অর্থাৎ নিজের মনটাকে সংযত করে, একাগ্র করে, নিজের ভেতরে ডুব দেওয়ার অভ্যাসের অভাব। অবশ্য নির্দিষ্ট ইষ্ট না থাকলে ধ্যানে মনোনিবেশ করা খুবই কঠিন কিন্তু আজকাল যাকে মেডিটেশন বলে, আদপে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা, সেটাও এরা বেশিরভাগই করে না। এদের অনেকের মধ্যেই দেখেছি গভীর ধর্মবোধ আছে কিন্তু একইসাথে পন্থবিমুখতা এদের মধ্যে এমন একটা আত্মদ্রোহ সৃষ্টি করছে, যা এদেরকে পূর্বপুরুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জুড়তে দিচ্ছে না। ফলে এই যে আমাদের নিজেকে খোঁজার বিরাট এক ঐতিহ্য, এই যে ত্যাগের মাধ্যমে ভোগের প্রাচীন দর্শন, এই যে কামের পরে মোক্ষের উদ্দেশ্যে যাত্রা, এই গভীর জীবনবোধ থেকে এরা অনেকেই বঞ্চিত।

বেচারাদের প্রধান খামতি হলো রোজগারের আসল উদ্দেশ্যকে বুঝতে না পারা। আমাদের কালে ছেলেদের ২৬-২৭এর মধ্যে বিয়ে হয়ে যেত, ৩০-৩২এর মধ্যে পরিবার কমপ্লিট। আমরা যখন চাকরি করতাম তখন আমরা জানতাম যে নিজের সংসার চালানোর দায় যেহেতু নিজেকেই নিতে হবে তাই রোজগার খুবই দরকার, চাকরির মানে কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। হ্যাঁ, যেমন যেমন প্রয়োজন বাড়বে তেমন তেমন রোজগারও বাড়াতে হবে, ফলে প্রোমোশনের জন্য লড়াই অবশ্যই ছিল কিন্তু আমরা অনেকেই যাকে আদ্যপান্ত কেরিয়ারিস্ট বলে, তা ছিলাম না। আমাদের বেশিরভাগেরই ধরাবাঁধা জীবন ছিল, অফিস পরিবার আর অবসরযাপনের মধ্যে একটা ঠিকঠাক সামঞ্জস্য ছিল, আর সন্তুষ্ট হতে বেশি বেগ পেতে হতো না।

আমরা অল্পতেই বেশি সুখী ছিলাম। আমাদের কাছে মাইনের মানে ছিল বউয়ের ছোট ছোট সাধপূরণ, ছেলেদের এবং পরিবারের প্রয়োজন এবং কিছুটা অপ্রয়োজনও মেটানো, জন্মদিনে শাড়ি উপহার পেয়ে মায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখা, মাঝে মাঝে সবাইকে নিয়ে ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া, নমাসে ছমাসে একবার সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, পরিবারের দোল দুর্গোৎসব বিয়ে অন্নপ্রাসন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে সবাইকে নিয়ে ফুর্তি করা, মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডা দেওয়া আর মাঠে গিয়ে ক্রিকেট ফুটবল খেলা দেখা, ইত্যাদি। আমাদের মধ্যে যারা ক্লাবে গিয়ে সন্ধ্যে কাটাতো তাদের কথা আলাদা, কিন্তু বেশিরভাগই ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে এবং তারা বিষয়টি ঠিকঠাক বুঝতে পারলেই যথেষ্ট সুখ পেতো। 

আমাদের মতন ঘরের এখনকার ছেলেদের মানসিকতা কিন্তু একেবারে আলাদা। এরা ৩২-৩৩এর আগে বিয়েই করেনা আর এদের কাছে মাইনের মানে নতুন নতুন গ্যাজেট, দামি দামি পোষাকঅসাক, আইফোন, দামি খেলনা, আরো কত কিই। কর্মজীবনের প্রাথমিক বছরগুলোয় এদের শুধু আমি আমি আমি - আমরা কোথাও নেই। আর ঘড়ি থেকে গাড়ি, সবেতেই অহেতুক কম্পিটিশন, প্লেন ছাড়া চড়া নেই, ছুটি কাটানোর জন্য খরচের মাবাবা নেই, আমদানির উদ্দেশ্যই হলো ভোগ, আরো ভোগ, অন্তহীন ভোগ। ফলে এদের যেমন ব্যক্তিগত অর্থের চাহিদার শেষ নেই, তেমনই উচ্চাকাঙ্ক্ষারও শেষ নেই আর বেশিরভাগকেই দেখি অর্থবান হওয়ার শর্টকাট পন্থা খুঁজে চলেছে। আমরা মধ্যবয়সী মা-বাপেরা অনেকেই নিজেরাও ইংরিজি মিডিয়াম স্কুল-কলেজে ইরফান হাবিব - রোমিলা থাপারদের লেখা গালগল্প পড়েই বড় হয়েছি কিন্ত আমরা আমাদের পারম্পরিক মূল্যবোধকে কখনো অস্বীকার করতে পারিনি কারণ আমাদের দাদু ঠাকুমা, আমাদের মা বাবা কাকা মামারা অকৃপণ হাতে সেটি আমাদের মধ্যে গেঁথে দিয়েছিলেন। অথচ আমরা আমাদের সন্তানদের ম্যাকলে নির্মিত সেই বিকৃত শিক্ষাব্যবস্থাটি হস্তান্তর করেছি ঠিকই কিন্তু ওদের মনের মধ্যে গড়ে ওঠা পারিবারিক সংস্কারের চারপাশে বেড়া দিতে ভুলে গিয়েছি, যার ফল বেচারারা আজ ভোগ করছে।

সময়ের সাথে সাথে জীবনধারণের স্বাচ্ছন্দ্য অবশ্যই বেড়েছে কিন্তু জীবনবোধ বেড়েছে কি? বরং লিপ্সা বেড়েছে, স্বার্থপরতা বেড়েছে আর পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিষন্নতা। আজকাল আকছার শুনছি ৩৫-৪০ বছর বয়সে গভীর মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে যাওয়ার কাহিনী, যুবক-যুবতীদের হটাৎ ব্রেনস্ট্রোক বা হার্টএট্যাকে প্রদীপ নিবে যাওয়ার কাহিনী, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাপ সহ্য করতে না পেরে কেরিয়ারের মধ্যগগনে হাল ছেড়ে দেওয়ার কাহিনীও। দুচোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ২৩শে চাকরিতে ঢুকে ৩৩ পৌঁছতে না পৌঁছতেই কমপ্লিট কর্পোরেট বার্নআউট - তারপর বাকি বছরগুলো ভয়ানক অশান্তি, বিতৃষ্ণা আর ক্রোধের আবহে ক্ষয় হতে হতে কোনোমতে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া, এটা তো কোনো কাজের কথা নয়। তাহলে উপায় কি?

উপায় শ্রীকৃষ্ণের দেখানো পথ অনুসরণ করা। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর কর্মযোগ বক্তৃতায় ষষ্ঠ অধ্যায়, প্যারা ৮এ বলছেন, "যদি কেউ দর্শনের একটা সূত্রও না পাঠ করে, যদি সে ঈশ্বরের অস্তিত্বেই না বিশ্বাস করে, এবং যদি সারা জীবনে একবারও ঈশ্বরের আরাধনা না করে, তবু শুভ কর্মসমূহের সরলক্ষমতা তাকে সেই অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে যেখানে পরের জন্য সে তার জীবন ও অন্য সব কিছুই উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হবে । এক্ষেত্রে একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি তার আরাধনার মাধ্যমে আর একজন দার্শনিক তার জ্ঞানের জন্য যে বিন্দুতে পৌঁছবে সেও সেই বিন্দুতেই পৌঁছতে সক্ষম । সুতরাং তোমরা নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে দার্শনিক, কর্মী ও ভক্ত সকলে একই বিন্দুতে মিলিত হয়; আর সেই বিন্দুই হচ্ছে আত্মোৎসর্গীকৃত হওয়া।"

ওই বক্তৃতারই সপ্তম অধ্যায়ে স্বামীজী যা বলছেন তার নির্যাস হলো এই: 'নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু কর্মে আসক্তি ত্যাগ কর। কোন কিছুর সাথে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলো না। মনকে মুক্ত রাখো। যা কিছু দেখছো, দুঃখ কষ্ট সবই জগতের অপরিহার্য পরিবেশ মাত্র। এগুলো সবই ক্ষণস্থায়ী, এগুলো আমাদের স্বভাবগত নয়। আমাদের স্বরূপ দুঃখ ও সুখের পারে - প্রত্যক্ষ বা কল্পনার অতীত। ...আসক্তি হতেই দুঃখ আসে, কর্ম হতে নয়। যখনই আমরা কর্মের সাথে নিজেদের অভিন্ন করে ফেলি, তখনই আমরা দুঃখ বোধ করি, কিন্তু কর্মের সাথে ঐভাবে জুড়ে না হয়ে গেলে সেই দুঃখ আর অনুভব করি না।' গীতা ছাড়া গতি নেই। যেখানে জীবন গুলিয়ে যাবে, সেখানেই গীতা উদ্ধারকারীর ভূমিকা পালন করে। তাই আমি যুবক-যুবতীদের বিষাদগ্রস্ত দেখলেই গীতা পড়তে উজ্জীবিত করি। কর্মযোগে স্বামীজীর বক্তৃতার মধ্যেই মতিস্থির করার উপায় রয়েছে, "ক্রন্দন তো বন্ধনের চিহ্ন - দুর্বলতার চিহ্ন। একবিন্দু চোখের জল যেন না পড়ে। এইরূপ হবার উপায় কি? সম্পূর্ণ অনাসক্ত হও।"

No comments:

Post a Comment