শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়-ধ্যানযোগে শ্রীকৃষ্ণ আর অর্জুনের মধ্যে একটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথোপকথন আছে। শ্রীভগবান বলছেন,
সর্বভূতস্থমাত্মনং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।।
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।
সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ।
সর্বথা বর্তমানোহপি স যোগী ময়ি বর্ততে।।
আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন।
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ।।
অনুবাদঃ
- প্রকৃত যোগী সর্বভূতে আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতে সব কিছু দর্শন করেন। যোগযুক্ত আত্মা সর্বত্রই আমাকে দর্শন করেন।
- যিনি সর্বত্র আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতেই সমস্ত বস্তু দর্শন করেন, আমি কখনও তাঁর দৃষ্টির অগোচর হই না এবং তিনিও আমার দৃষ্টির অগোচর হন না।
- যে যোগী সর্বভূতে আমাকেই স্থিত জেনে আমার ভজনা করেন, তিনি সর্ব অবস্থাতেই আমাতে অবস্থান করেন।
- হে অর্জুন! যিনি সমস্ত জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখের অনুরূপ সমানভাবে দর্শন করেন, আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।
অর্জুনের মতন অমন উচ্চকোটির যোগী, স্বয়ং ভগবান যাঁর সখা এবং যিনি নিজে বিশ্বরূপ দর্শন করার অধিকারী মহাধার, তিনি পর্য্যন্ত এই সমদর্শনভাবকে খুব সহজে অনুশীলনযোগ্য বলে মনে করতে পারছেন না। বলছেন,
যোহয়ং যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন।
এতস্যাহং ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্।।
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্।
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্।।
- হে মধুসূদন! তুমি সর্বত্র সমদর্শনরূপ যে যোগ উপদেশ করলে, মনের চঞ্চল স্বভাববশত আমি তার স্থায়ী স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না।
- হে কৃষ্ণ ! মন বড় চঞ্চল, বিক্ষেপ-উৎপাদক, জেদি এবং অত্যন্ত বলবান, তাই তাকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি৷
তখন শ্রীভগবান উত্তর দিচ্ছেন,
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।।
অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ।
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোহবাপ্তুমুপায়তঃ।।
- হে মহাবাহো! মন যে দুর্দমনীয় ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়, ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যর দ্বারা মনকেও বশীভূত করা যায়।
- অসংযত চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে আত্ম-উপলব্ধি দুষ্প্রাপ্য বটে কিন্তু যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ উপায় অবলম্বন করে মনকে বশ করতে চেষ্টা করেন, তিনি অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করেন। এটিই আমার অভিমত।
কুরুক্ষেত্রে এই বাক্যালাপের প্রায় আট হাজার বছর পরে, আমাদের এই বঙ্গদেশে, শ্রীকৃষ্ণেরই আর একজন অবতারের সাথে তাঁর কথামৃতকার শিষ্য মাস্টারমশাইয়ের কথোপকথনেও এই একই ভাব একদম বাস্তব হয়ে ফুটে উঠেছে। ২৭শে ডিসেম্বর ১৮৮৪, দেবী চৌধুরাণীর প্রসঙ্গ টেনে ঈশ্বর কি প্রত্যক্ষ হন, এই কথা হচ্ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — মনের প্রত্যক্ষ। সে এ-মনের নয়। সে শুদ্ধমনের। এ-মন থাকে না। বিষয়াসক্তি একটুও থাকলে হয় না। মন যখন শুদ্ধ হয়, শুদ্ধমনও বলতে পার, শুদ্ধ আত্মাও বলতে পার।
মাস্টার — মনের দ্বারা প্রত্যক্ষ যে সহজে হয় না, এ-কথা একটু পরে আছে। বলেছে প্রত্যক্ষ করতে দূরবীন চাই। ওই দূরবীনের নাম যোগ। তারপর যেমন গীতায় আছে, বলেছে, যোগ তিনরকম — জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ। এই যোগ-দূরবীন দিয়ে ঈশ্বরকে দেখা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এ খুব ভাল কথা। গীতার কথা। ....প্রতিমায় ঈশ্বরের পূজা হয় আর জীয়ন্ত মানুষে কি হয় না? তিনিই মানুষ হয়ে লীলা করছেন।
"কি অবস্থা গেছে। হরগৌরীভাবে কতদিন ছিলুম। আবার কতদিন রাধাকৃষ্ণভাবে! কখন সীতারামের ভাবে! রাধার ভাবে কৃষ্ণ কৃষ্ণ করতুম, সীতার ভাবে রাম রাম করতুম!
"তবে লীলাই শেষ নয়। এই সব ভাবের পর বললুম, মা এ-সব বিচ্ছেদ আছে। যার বিচ্ছেদ নাই, এমন অবস্থা করে দাও। তাই কতদিন অখণ্ড সচ্চিদানন্দ এই ভাবে রইলুম। ঠাকুরদের ছবি ঘর থেকে বার করে দিলুম।
"তাঁকে সর্বভূতে দর্শন করতে লাগলুম। পূজা উঠে গেল! এই বেলগাছ! বেলপাতা তুলতে আসতুম! একদিন পাতা ছিঁড়তে গিয়ে আঁশ খানিকটা উঠে এল। দেখলাম গাছ চৈতন্যময়! মনে কষ্ট হল। দূর্বা তুলতে গিয়ে দেখি, আর-সেরকম করে তুলতে পারিনি। তখন রোখ করে তুলতে গেলুম।
"আমি লেবু কাটতে পারি না। সেদিন অনেক কষ্টে, ‘জয় কালী’ বলে তাঁর সম্মুখে বলির মতো করে তবে কাটতে পেরেছিলুম। একদিন ফুল তুলতে গিয়ে দেখিয়ে দিলে, — গাছে ফুল ফুটে আছে, যেন সম্মুখে বিরাট — পূজা হয়ে গেছে — বিরাটের মাথায় ফুলের তোড়া! আর ফুল তোলা হল না!
"তিনি মানুষ হয়েও লীলা করছেন। আমি দেখি, সাক্ষাৎ নারায়ণ। কাঠ ঘষতে ঘষতে আগুন বেরোয়, ভক্তির জোর থাকলে মানুষেতেই ঈশ্বর দর্শন হয়। তেমন টোপ হলে বড় রুই কাতলা কপ্ করে খায়।
"প্রেমোন্মাদ হলে সর্বভূতে সাক্ষাৎকার হয়। গোপীরা সর্বভূতে শ্রীকৃষ্ণ দর্শন করেছিল। কৃষ্ণময় দেখেছিল। বলেছিল, আমি কৃষ্ণ! তখন উন্মাদ অবস্থা! গাছ দেখে বলে, এরা তপস্বী, শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করছে। তৃণ দেখে বলে, শ্রীকৃষ্ণকে স্পর্শ করে ওই দেখ পৃথিবীর রোমাঞ্চ হয়েছে।”
আমরা যাঁকে শ্রীশ্রীমায়ের ভান্ডারী বলে জানি সেই শরৎ মহারাজকে বালক বয়সে একদিন শ্রীরামকৃষ্ণদেব জিজ্ঞেস করেছিলেন, "কিরে, তুই কিছু চাইলি না যে?" সেদিন পরবর্তীকালের ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ শ্রীমৎ স্বামী সারদানন্দজী মহারাজ তাঁকে বলেছিলেন, "আমি যাতে সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শন করি, এরূপ করে দিন।" উত্তরে ঠাকুর বলেছিলেন, "ও যে শেষের কথা রে! তা তোর হবে।" এই গুরুবাক্য কিভাবে তাঁর জীবনে অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল তার একটি প্রমান 'প্রাচীন সাধুদের কথা' বইটিতে আছে। জনৈক ভক্ত একবার স্বামী সারদানন্দজীকে জিজ্ঞাসা করেন, "আপনি আমাদের এত ভালবাসেন কেন? দেখুন, শেষে জড়ভরতের মতো বদ্ধ না হয়ে যান।" স্বামী সারদানন্দজী কোন উত্তর দিলেন না। কয়েকদিন পর ঐ ভক্ত উদ্বোধনে এলে মহারাজ বললেন , "সেদিন বেলুড় মঠে গিয়ে ঠাকুরের সামনে প্রনাম করলাম। ঠাকুর আবির্ভুত হয়ে আমাকে বললেন ---- 'তুই সবাইকে ভালবাসিস কারন, তুই আমাকে সবার মধ্যে দেখিস।' সেদিন তুমি যে প্রশ্ন করেছিলে, এই হল তার উত্তর।" এই স্মৃতিচারণটি করে ছলছল চোখে তাঁরই শিষ্য এবং রামকৃষ্ণসঙ্ঘের দ্বাদশ সঙ্ঘগুরু শ্রীমৎ স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে গীতার সেই পূর্বোল্লেখিত শ্লোকটি বলেছিলেন,
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।
No comments:
Post a Comment