আজ ১৪ই অগাস্ট, পাকিস্তানের জন্মদিন। আজকের দিনেই আমাদের দেশমায়ের দুটি বাহু কেটে নিয়ে পাকিস্তানের দুটি প্রান্ত তৈরি হয়েছিল। আসলে আক্রান্তার বেশে ভিনদেশি দানবরা এসে আমাদেরই কয়েকজনকে ধরে বেঁধে, মাথা মুড়িয়ে, এমন দানবিক বিষ তাদের মননে ঢেলে দিয়ে গিয়েছিল যে কয়েক প্রজন্ম পরে তারা ভুলেই গেল যে তারা আসলে কারা।
সামান্য পূজাপদ্ধতি পাল্টে গিয়ে তারা যেন হটাৎ এক ভিন্ন জাতি, ভিন্ন মানুষ হয়ে গেল। আর যত তারা রাষ্ট্রের বৃহত্তর সমাজের মূলধারা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিতে লাগলো বা সমাজও তাদের নিত্যনতুন বিজাতীয় চাহিদা মেটাতে অক্ষমতা জাহির করতে শুরু করলো, তত তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আমাদের প্রাচীন উন্নত মানবিক উদার সভ্যতা ও ধর্মসংস্কৃতির প্রভাব কমতে কমতে একসময় এমন হলো যে তারা হিতাহিত জ্ঞান খুইয়ে নিজেদের ছেড়ে আসা রক্তের সম্পর্কের সনাতনী আত্মীয়-বন্ধুদেরই পরমশত্রু বলে ভাবতে শুরু করলো। দুর্ভাগ্যবশত, সেই ভাবনা আজো বেঁচে আছে কারণ দেশভাগের ৭৫ বছর পরেও দেশের ভেতরে ও বাইরে সেই একই বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকে উস্কে দেওয়ার ষড়যন্ত্রকারী লোকের অভাব নেই।
পাকিস্তান কোনো ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক স্বত্তা নয়, ওটি আসলে নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের ইতিহাস, বস্তুত নিজেদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধেই কিছু অবুঝ অর্বাচীনের বিদ্রোহ, যার কোনো সারবত্তা নেই। পাকিস্তান থেকে ভাষার ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের অবস্থানও তাই। যে জাতি অন্যের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতির পদতলে নিজের পূর্বপুরুষের সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দেয়, তাদের আসলে একূল ওকূল দুকূলই যায়। বেচারাদের পায়ের তলায় মাটি থাকলেও আসলে এরা সবাই ছিন্নমূল।
পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো মেকি দেশ ১০০ বছরের বেশি টেকেনি, হয়তো আগামী ২৫ বছরে আমাদের উপমহাদেশের মানচিত্রটিও অনেকটাই বদলে যাবে। কিন্তু আজকের দিনে, যেদিন প্রেমজীভাই মেঘজী ঠক্করের নাতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজের ভারতীয়ত্ব বিসর্জন দিয়ে একটি কৃত্তিম দেশের প্রথম গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন, সেদিন কি সত্যি সত্যিই তার কোনো আদর্শের ভিত্তি ছিল নাকি কেবল ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বজনবৈরিতা, সেটা আজ পাকিস্তানের ঘোর বেহাল দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখিয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক মতবাদ কোনো কৃত্তিমভাবে তৈরি করা দেশকে ধরে রাখতে পারেনা, মধ্যপ্রাচ্য দেখিয়ে দিয়েছে ভাষা এক হলেও স্থানীয় সংস্কারের ভিত্তিতে নানা দেশ তৈরি হতে পারে আর বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে পন্থীয় একতাও কোনো কৃত্তিমভাবে তৈরি করা দেশকে ধরে রাখতে পারেনা। অন্যদিকে জার্মানি দেখিয়ে দিয়েছে যে জাতির মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন থাকলে কৃত্তিমভাবে বিভাজিত দেশও একদিন আপনাআপনিই জুড়ে গিয়ে আবার এক হয়ে যায়।
এই সংস্কৃতিই হলো মূল কথা, যে কোনো সভ্যতার ওটাই আসল অবদান। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কথা ছেড়ে দিয়ে আপাতত আমরা যদি আমাদের নিজেদের দেশে বসবাসকারী সমস্ত নাগরিককে সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতির রঙ্গে না রাঙিয়ে তুলতে পারি, তাহলে এই স্বাধীনতা অর্থহীন। আমরা স্বাধীন বলে তখনই গণ্য হবো যখন আমাদের নিজেদের সভ্যতার কথা আমরা সোচ্চারে বলতে পারবো। এই রাষ্ট্র হিন্দুরাষ্ট্র কারণ আমরা সবাই হিন্দু সভ্যতার ধারক ও বাহক - ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে এ কথা বলার মধ্যে যতদিন দ্বিধাবোধ থাকবে ততদিন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন নৈ।
হয়তো আজ যে কথা কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, আর কয়েকবছর পর তা সোচ্চারে শোনা যাবে কারণ এক বৃহৎসংখ্যক জনগণের মধ্যে সার্বিকভাবে সংস্কৃতি-সচেতনতা বাড়ছে। আজকের মতো দিন হলো সংকল্প নেওয়ার দিন, যেদিন শেষবার জোর করে আমাদের দেশমাতৃকার অঙ্গহানি করা হয়েছিল। আমরা যে এক জাতি এক প্রাণ - এই কথাটা আমাদের নিজেদের দেশের মধ্যে আগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আর তার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নিয়ে রাষ্ট্রের সমস্ত নীতি এবং তন্ত্রকে একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ দিতে হবে। যেদিন আমরা সেটা করতে ফেলতে পারবো, তার সুফল এমন আকর্ষক ও কার্যকরী হবে যে আশেপাশের সব মেকি দেওয়াল এমনি এমনিই খসে পড়বে। সেদিন আর কোনো ১৪ই অগাস্টও থাকবে না, শুধুই ১৫ই।
No comments:
Post a Comment