Saturday, July 30, 2022

আবার কুরুক্ষেত্র

স্বর্গলোক, ভূলোক আর পাতাললোক আসলে মনেরই তিন অবস্থা, বাস্তবেও যার প্রতিফলিতরূপ দেখা যায়। স্বর্গলোক হলো সেই মানসিক অবস্থান যেখানে সৃষ্টি আর স্রষ্টা সর্বদা একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন, অর্থাৎ আধ্যাত্মলোক। যদি গুণের দিক দিয়ে দেখা হয় তাহলে এই অবস্থায় মন সত্ত্ব রজঃ তম তিনটি গুণেকেই অতিক্রম করে প্রকৃতির পারে চলে যায়। 

ভুলোক হলো সেইসব জীবের বাসভূমি যারা জড় শরীরে আবদ্ধ হয়েও চেতনের খোঁজে ফেরে আর যদিও সত্ত্বগুণ সুখে আসক্তি সৃষ্টি করে এবং রজগুণ কর্মে আসক্তি সৃষ্টি করে তাদের প্রকৃত স্বরূপ ভুলিয়ে রাখে, তবুও কোনো না কোনো সময় নশ্বরতার অসারত্ব অনুভব করে সেই জীব জড়ের উর্দ্ধে উঠতে চায়। 

শেষে আসে পাতাললোক যেখানে বিবেককে ঢাকা দিয়ে প্রমাদে নিমজ্জিত করে তমগুণ জীবের ওপর নিজের একাধিকার স্থাপন করে। চরম ভোগবিলাসে নিমজ্জিত, ইন্দ্রিয়তাড়িত, ধর্মবোধহীন cult নির্ভর, চরম স্বার্থপর, মতবাদ বা পদ্ধতির নামে হানাহানিতে মত্ত এমন এক ভয়ংকর যাপন যা মানুষকে অমানুষ করে তোলে। 

গীতার চতুর্দশ অধ্যায় অর্থাৎ গুণত্রয়বিভাগ যোগে শ্রীভগবান এই তিনগুণ সম্পর্কে অর্জুনকে বলছেন, "হে মহাবাহো! সত্ত্ব, রজ ও তম— এই তিন গুণ প্রকৃতির দ্বারা উৎপন্ন। কিন্তু প্রকৃতির কাজ শরীরের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক মান্য করার কারণে এই গুণ অবিনাশী জীবাত্মাকে নাশবান জড় শরীরে আবদ্ধ করে দেয়। হে নিষ্পাপ অর্জুন! সেই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল (স্বচ্ছ) হওয়ার কারণে রজগুণ ও তমগুণের তুলনায় প্রকাশক ও নির্বিকার হয়। সে সাত্ত্বিক সুখ ও সাত্ত্বিক জ্ঞানের আসক্তির সাহায্যে জীবাত্মাকে বেঁধে দেয়। অর্থাৎ তাঁকে গুণাতীত হতে দেয় না।" 

বলছেন, "হে কৌন্তেয়! তৃষ্ণা ও আসক্তি উৎপন্নকারী রজগুণকে তুমি রাগস্বরূপ বিবেচনা কর। এটি কর্মের আসক্তিতে জীবাত্মাকে আবদ্ধ করে। হে ভারত! তমোগুণ অজ্ঞানতা থেকে উৎপন্ন হয় এবং সম্পূর্ণ মনুষ্যকে মোহিত করে। অর্থাৎ তাঁদের মধ্যে বিবেক উৎপন্ন হতে দেয় না। সে প্রমাদ, আলস্য ও নিদ্রার দ্বারা জীবাত্মাকে শরীরে বেঁধে দেয় অর্থাৎ তাঁর লৌকিক, পরলৌকিক উন্নতি হতে দেয় না।"

আমরা যদি আমাদের চারপাশে তাকিয়ে দেখি তাহলেই এই তিনলোক স্পষ্ট দেখতে পাবো। যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হিমালয়ের কোনো নির্জন গুহায় তপস্যারত, প্রচন্ড শীত বা অন্নাভাব যাঁকে স্পর্শ করতে পারেনা, বাহ্যিক সমস্ত অনুভূতির পারে গিয়ে যিনি আত্মমগ্ন, তিনি স্বর্গলোকের বাসিন্দা। 

আবার যে সন্ন্যাসী লোকালয়ে কোলাহলের মধ্যে থাকেন কিন্তু যাঁর নিজের কোনো কামনা বাসনা নেই, আর্তের কান্না যিনি সহ্য করতে পারেননা, শিবজ্ঞানে জীবসেবা করাই যাঁর জীবনের ব্রত, ঈশ্বরের সৃষ্টির মধ্যেই যিনি তাঁর দৈবীপ্রকাশকে সর্বদা অনুভব করেন এবং যাঁর কাছে কায়া আর তার ছায়া এক এবং অবিভাজ্য বলে মনে হয়, তিনিও স্বর্গলোকের বাসিন্দা। আবার গৃহী হয়েও মানুষকে ঈশ্বরের রূপ বলেই মনে করে নির্লোভি হয়ে সারাজীবন যিনি জনসেবা করে যান, যেমন বোলপুরের সদ্যপ্রয়াত 'এক টাকার ডাক্তার' ডঃ সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁরাও শরীরে থাকাকালীনই ওই স্বর্গলোকের বাসিন্দা।

ভারতে ভূলোকবাসীদের আমরা আকছারই দেখতে পাই, হয়তো সবসময় চিনতে পারিনা। সরকারি কর্মক্ষেত্রে ঘুষ-সংস্কৃতির মধ্যে বসে সারাজীবন চাকরি করেও এবং ঘুষ নেওয়াই যেখানে রীতি সেখানে ব্যতিক্রমী স্বচ্ছতা দেখিয়ে যিনি সারাজীবন সৎপথের ন্যায্য রোজগারটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন, তিনি ভুলোকের বাসিন্দা। মানুষের মধ্যে সত্ত্বগুণ যখন বৃদ্ধি পায়, তখন ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণে নিদ্রা, আলস্য, প্রমাদ ইত্যাদি মিটে গিয়ে স্বচ্ছতা আসে এবং বিবেক প্রকট হয়। এইখান থেকেই গুণের অতীত যাওয়ার পথচলা শুরু হয়।

তবে এই স্তরে পৌঁছানোর আগে আরো একটি স্তর অতিক্রম করতে হয় যেটি রজগুণের। বাড়ির একতলায় যেমন বন্যার জল ঢুকে পড়ে লোকসান করে দেয় কিন্তু দোতলা অক্ষত থাকে, ভূলোকেই রজগুণ হলো বাড়ির একতলা। লাভ করার ইচ্ছে, ভোগ করার ইচ্ছে, নতুন নতুন কাজ খোঁজা যাতে আরো অর্থ উপার্জন করা যায়, জীবনে অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তি আর অশান্তিকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনা, এসব হলো ভূলোকেরই অংশ। আর এই করতে করতেই একদিন মানুষ এর অসারতা বুঝতে পেরে সত্যিকারের শান্তির পথ খুঁজতে শুরু করে।

শেষে হলো পাতাললোক। বহুমূল্য অত্যাধুনিক প্রমোদতরণী ভেসে যাচ্ছে সাগরে, তার আয়নাখচিত নাচঘরে অর্ধনগ্ন সুন্দরী নারীরা নেচে নেচে বিত্তশালী বৈভবশালী কামুক পৃষ্ঠপোষকদের বিনোদিত করছেন, লক্ষ লক্ষ টাকার মদের ফোয়ারা ছুটছে, ওই তো পাতাললোক। অথবা মতবাদের নামে, cult-এর নামে, বিশ্বাসের নামে একজন আর একজনের গলা কাটছে, কমজোরের ওপর কতৃত্ব কায়েম করার জন্য শক্তিশালী তাদের বাসভূমি বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে অথবা কোনো একনায়ক ভিন্নমতের লোকের ওপর অকথ্য অত্যাচার করছে, এরাই তো পাতাললোকের বাসিন্দা আর এই তো পাতাললোক। যে সময় মনে তমোগুণ বাড়ে, সে সময় ইন্দ্রিয়সংযম ও কাজে স্বচ্ছতা থাকে না, কোনও সৎকাজ করার ইচ্ছা হয়না, প্রমাদ শুরু হয় এবং অন্তঃকরণ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে প্রায় গোটা পৃথিবীটাই যে পাতাললোক হয়ে উঠেছে, আশাকরি সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

সাত্ত্বিক কর্মের ফল নির্মল, রাজস কর্মের ফল দুঃখদায়ী ও তামস কর্মের ফল বিবেকহীনতা হয়। সত্ত্বগুণের কারণে জ্ঞান (বিবেক), রজগুণের কারণে লোভ ও তমগুণের কারণে প্রমাদ, মোহ ও অজ্ঞানতা উৎপন্ন হয়। মনের মধ্যে তমগুণ বৃদ্ধি পেলে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ, বৃক্ষ, লতা ইত্যাদি নীচ যোনিতে জন্মগ্রহণ করে। সৃষ্টিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে গেলে তাই তম নাশ করে মানুষের মনের অভিমুখ তার স্বরূপ অন্বেষণের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। সেইজন্যই এখন আবার দৈবশক্তি নির্মিত আবহে ধর্মযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সময় এসে গেছে।

Friday, July 29, 2022

আসন্ন মহাযুদ্ধ

কলিযুগ শেষ হচ্ছে, মরুভূমিতে বন্যা হচ্ছে আর শৈলভূমিতে দাবদাহ, আবার একটা মহাযুদ্ধ আগতপ্রায়। তাই বিশ্বজুড়ে মহাভারতকালের সমস্ত চরিত্ররাই এখন নতুন শরীরে আবারো বর্তমান এবং প্রারব্ধ অনুযায়ী পাণ্ডব ও কৌরব দুপক্ষই এখন আবার ধীরে ধীরে নিজেদের জোটসঙ্গীসংখ্যা বাড়িয়ে বাড়িয়ে নির্ণায়ক মহারণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 

যেহেতু এই মহাযুদ্ধটি আসলে ধর্মযুদ্ধ এবং এর মূল কান্ডারি স্বয়ং শ্রীভগবান নিজে, এটি শুরু হওয়ার আগেই অধর্মিকদের মধ্যে নানারকম ছোটখাটো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, যার মাত্রা একসময় এমন বেড়ে যাবে যে সেখান থেকেই কোনো এক স্ফুলিঙ্গ এবার মহাভারতে বর্ণিত বিনাশকালের মতো প্রলয়ের সূচনা করবে এবং সেই সাথে সাথে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন শান্তিময় যুগেরও সূচনা হয়ে যাবে। 

নিশ্চিত থাকুন যে যাদের মধ্যে এতটুকুও আসুরিক প্রবৃত্তি আছে, তারা কেউ রেহাই পাবে না, সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পূজাপদ্ধতি নির্বিশেষে সনাতন ধর্মের পথই একমাত্র ঈশ্বর নির্দিষ্ট পথ এবং ভৌতিক অগ্রগতি যাই হোক না কেন, জীবনচক্রে ধর্মের জয় নিশ্চিত করতেই যুগে যুগে অধর্মের বিনাশ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। 

বিশ্বজুড়ে এখন পাপের ঘড়া এতটাই পূর্ণ হয়ে গেছে যে তা খালি না করতে পারলে ধর্মপ্রাণ মানুষের জীবনরক্ষা করাই কঠিন। এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে তাঁদের মুক্তি দিতে হলে অধর্মের নাশ করা ছাড়া শ্রীভগবানের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। আগামী ২০২৫ থেকে নিয়ে দশ বছর ধরে যে শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া চলবে, তার শেষে ধর্মের জয় এবং অধর্মের পরাজয় নিশ্চিত। 

এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রই কেবল বদলে যাবেনা, পুণ্যভূমি ঋদ্ধভূমি বেদভূমি ভারতবর্ষের ঈশ্বরর্নির্দিষ্ট অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মশক্তির প্রভাব এমনভাবে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে যে ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক সীমা অতিক্রম করে সারা বিশ্বজুড়ে ভারতবর্ষ এক নতুন ঐশীপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে, যার কথা স্বামী বিবেকানন্দ এবং ঋষি অরবিন্দ বলে গেছেন। 

নিজেদের অন্তরাত্মার ডাককে দীর্ঘদিন অবহেলা করার ফলে ভারতের মধ্যে যে সমস্ত অধার্মিক শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে এবং এই দশকের মধ্যেই তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তবে অন্যান্য দেশের মতন ভারতের অভ্যন্তরীন যুদ্ধটি রক্তক্ষয়ী হবে না, সেটি হবে মূল্যবোধাশ্রয়ী, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক। এই মহাভারতে ভারতের ভূমিকা হলো সঞ্জয়ের মতন - একজন দৈব আশীর্বাদপ্রাপ্ত দ্রষ্টার। সেই দ্রষ্টা, যিনি কেবল দূরদৃষ্টিই অর্জন করেননি, অর্জুনের সাথে সাথে যাঁর বিশ্বরূপদর্শনও হয়েছিল।

Monday, July 25, 2022

কর্ম ও ফল

আজ সকাল থেকে টিভির পর্দায় দুটি ঘটনা একসাথে ভেসে উঠছিল - আমাদের প্রজাতন্ত্রের নতুন প্রথম নাগরিক হিসেবে মহামহিম রাষ্ট্রপতি শ্রীমতি দ্রৌপদী মুর্মুর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আর আকন্ঠ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রাজ্যমন্ত্রীসভার কার্যত দুনম্বর বর্তমান শিল্প এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী ও শাসকদলের মহাসচিব শ্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে হেফাজতে নিয়ে প্রবর্তন নির্দেশনালয়ের ভুবনেশ্বর যাত্রা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কখনো এটা কখনো ওটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল দুটি ক্ষেত্রেই কি অদ্ভুত সমাপতন। 

একদিকে সমস্ত ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রতিকূলতাকে জয় করে বছরের পর বছর ধরে মানুষের সেবায় নিযুক্ত থেকে রাষ্ট্রের শীর্ষপদ অলঙ্কৃত করতে চলা একজন নির্মল স্বচ্ছ সৎ বিনয়ী মাতৃস্থানীয়া ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব আর অন্যদিকে লিপ্সা লোভ লালসা আর রিপুর তাড়নায় অবদমিত একজন অভিযুক্ত কলঙ্কিত উদ্ধত জনপ্রতিনিধি, যিনি মানুষের সেবা করার কর্তব্যকে অবহেলা করে অন্যায়ভাবে তাঁদের সাথে চরম প্রতারণা করেছেন বলে অভিযোগ।

একদিকে একজন দরিদ্র প্রান্তিক মানুষ, যাঁর মতন লক্ষ লক্ষ আদিবাসী জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে এই সমাজের একেবারে নিচের পরতে কোথায় যেন প্রতিনিয়ত হারিয়ে যান, তিনি কেবলমাত্র তাঁর চরিত্রবল এবং স্থির সংকল্পের কারণে আজ সর্বজনবন্দিত। আর একজন সমাজের উচ্চশ্রেণীর উচ্চশিক্ষিত মানুষ, কেবলমাত্র নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে সর্বোপরি ভেবে যুবসমাজের সাথে এমন বেইমানি করলেন বলে অভিযোগ যে গোটা দেশ আজ তাঁর কথিত কান্ডকারখানা দেখে ছিঃ ছিঃ করছে। 

রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের প্রথম ভাষণে মহামহিম আজ বলেছেন, "আমার এই জীবনে আমি বুঝেছি মানুষের জন্য কাজ করাই হলো আসল কথা। জগন্নাথক্ষেত্রের কবি ভিমভইয়ের কবিতা থেকে একটি লাইন আমি বলছি: 'মো জীবন পাছে নারকে পডি থাউ জগৎ'। এর অর্থ, নিজের জন্য কাজ না করে জগতের জন্য কাজ করো"। এই যাঁর মানসিকতা, তাঁকে যে সারা দেশ মাথায় তুলে রাখবে, সেটাই তো স্বাভাবিক ও কাম্য। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দের জীবনদর্শনও একইরকমের ছিল। এই হলো শাশ্বত ভারতের সনাতন সংস্কৃতিতে বর্ণিত আদর্শ রাজধর্ম, যার প্রতিফলন আমরা আজ দেশের শীর্ষতম পদাধিকারীদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। এর সুপ্রভাব ক্রমশঃ সমাজের সর্বস্তরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামতে বাধ্য।

যিনি বহু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হন, প্রিয় হন, সম্মানীয় হন, যিনি সমাজে ব্যাপকরূপে প্রভাবশালী হন, তাঁর ওপর যে ঈশ্বরের বিশেষ কৃপা আছে, এটি বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। এটি বহুজন্মলব্ধ প্রারব্ধ থেকেই আসে। দেখা যায় যে কেউ সেই কৃপার সদ্ব্যবহার করেন, কেউ বা দুর্ব্যবহার। নিজের জীবনকে কেউ কিভাবে চালনা করবেন, সেটা কিন্তু একেবারেই তাঁর নিজস্ব বিষয়, যার দায় সম্পূর্ণভাবে তাঁরই। যখন রাষ্ট্রপতি শ্রীমতি দ্রৌপদী মুর্মুর মতো ঈশ্বরভক্তকে দেখি ধর্মপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশঃ আরো বেশি বেশি করে সেবাব্রতী হয়ে উঠতে, তখন কত আনন্দ হয়। আর একইসাথে, যখন ঠিক এর উল্টোটা হতে দেখি তখন সত্যিই খুব দুঃখ হয়। বহু ভাল কর্মফল জমলে পরে জীবসেবা করার সুযোগ মেলে। আগের আগের সমস্ত জন্মের সুকর্মকে নস্যাৎ করে দিয়ে সেই সুযোগকে যখন কেউ নিজের দোষে দুর্যোগে পর্যবসিত করে নিজেরই হাতে ইতরযোনি প্রাপ্তির দরজা খুলে ফেলেন, তখন বুকটা হায় হায় করে ওঠে। এতটা এগিয়ে এসে শেষে সেই কুহকিনী মায়ার গাড্ডাতেই পড়তে হলো? বড্ড করুণা হয় গো, বড্ড করুণা হয়।

Monday, July 18, 2022

শ্রীম

 আজ শুভ নাগপঞ্চমী, কথামৃতকার পূজ্যপাদ শ্রীমর জন্মতিথি। শ্রীম শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এমন এক অনন্য শিষ্য যাঁর লেখনীর মধ্যে দিয়ে ঠাকুর আজও আমাদের সঙ্গে কথা কন আর ভবিষ্যতেও বিভিন্ন দেশ-জাতি জুড়ে সেই কথোপকথন চলতেই থাকবে। ঠাকুরের অন্য সন্ন্যাসী ও গৃহী পার্ষদরাও ঠাকুরের কথা বলেছেন, কেউ কেউ লিখেওছেন, কিন্তু শ্রীমলিখিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত তার অনন্যতায় ব্যতিক্রমী হয়েই রয়েছে। 


শ্রীমর একটি বিশেষত্ব হলো কথামৃতে স্থান কাল পাত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, যার ফলে পড়তে পড়তে আমাদের মনের মধ্যে একেবারে সেই দিনটির, সেই বিশেষ মুহূর্তটির যেন স্পষ্ট একটা ছবি তৈরি যায় - আমরা যেন ঠাকুরকে চলতে ফিরতে দেখি, তাঁর গরম লাগছে না ঠান্ডা লাগছে, তাঁর আশেপাশে কারা কারা আছেন, তিনি কি খাচ্ছেন, কি পরছেন, কখন সমাধিস্থ হচ্ছেন, সমাধি ভাঙছে - সবকিছু যেন আমাদের উপস্থিতিতে চোখের সামনেই ঘটছে বলে মনে হয়। সেই জন্যই ঠাকুরকে কৃত্তিম বা দূরের বলে বোধ হয়না, আর তাঁর দেখানো পথও সাধনযোগ্য বলেই মনে হয়।


এযাবৎ যত অবতার পুরুষ এসেছেন, প্রত্যেকের বাণীই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে কেউ না কেউ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে একজন রক্ত মাংসের শরীরধারীরূপে শ্রীম যেমনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন, এমনটা এর আগে আর কোনোকালে হয়নি। ঠাকুর হাসছেন গাইছেন খাচ্ছেন স্নান করছেন, বার্নিশকরা জুতো পরছেন, মোলস্কিনের র‍্যাপার গায়ে দিচ্ছেন, পড়ে গিয়ে তাঁর হাত ভেঙে যাচ্ছে, ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছেন, শিষ্যদের শাসন করছেন, শিক্ষা দিচ্ছেন, রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কচুরি খাচ্ছেন, থিয়েটার দেখছেন, সার্কাস দেখছেন, একদিকে শিশুর সারল্য আর অন্যদিকে সাক্ষাৎ অবতারবরিষ্ঠায় - জীবন্ত প্রাণবন্ত প্রত্যয়ী রসিক একজন দেবমানুষ, শ্রীম না থাকলে এই ব্যক্তিগত শ্রীরামকৃষ্ণকে হয়তো আমারা এমনভাবে পেতামই না।


এই যে ধ্যানালোকে আমরা বিভিন্নভাবে ঠাকুরকে দেখি, তার অধিকাংশ দৃশ্যকল্পেরই রচয়িতা শ্রীম। উনি প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের পাঁচটি খন্ড লিখেছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন, গোটাটার সময়কাল ১৯০২-৩২, যার প্রথম চারটি খন্ড আট বছরের মধ্যে প্রকাশিত হয় আর শেষেরটি ২২ বছর পর। ডায়েরিতে সাংকেতিক এন্ট্রি দেখে দেখে গুরুর সাথে প্রতিটিদিনের সাক্ষাৎকার যদি বহুবছর পরেও অত বিশদে এবং নির্ভুলভাবে শ্রীম অনুধ্যান না করতে পারতেন, তাহলে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনে, বিশেষতঃ গৃহস্থদের ক্ষেত্রে, ভক্তিমার্গের অপেক্ষাকৃত সহজ পথ এত প্রশস্ত হতো না। কথামৃতে ব্যবহৃত 'ভক্তি' শব্দের মোট সংখ্যা ৪০৯৪ আর ভক্তি-শব্দ বিযুক্ত পৃষ্ঠার সংখ্যা ১৩১। 


শ্রীম নিজে লিখছেন, 'ঠাকুরের ভক্তির কথা যত ভাবিতেছি ততই অবাক হইতেছি। কেশব সেন হরিনাম করেন, অমনি তাঁকে দেখতে ছুটছেন, অমনি কেশব আপনার লোক হলেন। তখন কাপ্তেনের কথা আর শুনলেন না। তিনি বিলাতে গিয়েছিলেন, সাহেবের সঙ্গে খেয়েছেন, কন্যাকে ভিন্ন জাতিতে বিবাহ দিয়েছেন - এসব কথা ভেসে গেল। কুলটি খাই, কাঁটায় আমার কি কাজ? ভক্তিসূত্রে সকারবাদী, নিরাকারবাদী, এক হয়; হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান এক হয়; চারি বর্ণ এক হয়। ভক্তিরই জয়। ধন্য শ্রীরামকৃষ্ণ! তোমারই জয়!'। 


ইংরিজি ১৮৮১-৮৬ সালের মধ্যে মোট ১৯৬ দিনের বিবরণ আছে কথামৃতে, যা শ্রীশ্রীমা স্বয়ং কেবল নিয়মিত শুনতে ভালোবাসতেনই না, অন্যদেরও পড়তে উৎসাহ দিতেন। মা বলেছিলেন, "মাষ্টার কি সুন্দরভাবে সব মনে করে লিখেছে! শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ সামনে সব কথা হচ্ছে। কি বর্ণনা! আর এসব কথা যেন হৃদয়ে গেঁথে থাকে। এই সমস্ত পড়ে-শুনেই তো আজকাল এত লোক তাঁর দিকে ঝুঁকছে। শান্তি পাচ্ছে। এসব অমোঘ কথা।..." এটাই আধ্যাত্মিক পথের যাত্রীদের কাছে শ্রীমর আসল দান। ঠাকুর শ্রীমকে বলেছিলেন, "তোমাকে গৌরাঙ্গর দলে দেখেছিলাম"। তাই ঠাকুরের সেই কল্পতরু অবস্থার আশীর্বাদ 'তোমাদের চৈতন্য হোক', শ্রীমর লেখনীর মাধ্যমেই বুঝি আমাদের সকলের ওপর সতত বর্ষিত হচ্ছে।

Wednesday, July 13, 2022

গুরুদেব

যদিও প্রতিদিনই জপ-ধ্যানের সময় পূজ্যপাদ গুরুদেবের শ্রীমুর্তিটি স্মরণ করা হয়, তবুও গুরুপূর্ণিমার দিনে বিশেষভাবে নিজের গুরুর কথা মনে পড়বে না, এ কেমন করে হতে পারে? গুরুদেব শরীরে থাকলে আজকের দিনে তাঁকে বেলুড়ে গিয়ে প্রণাম করাটাই স্বাভাবিক হতো কিন্তু যেহেতু তিনি এখন ধ্যানলোকের বাসিন্দা, তাই ঠাকুরের মধ্যেই তাঁর প্রকাশ জেনে তাঁকে মানসপটে প্রণাম করাটাই কেবল সম্ভবপর হয়। তবে যতদিন শিষ্যরা শরীরে থাকেন ততদিন গুরুদের ছুটি নেই কারণ মন্ত্রদীক্ষা দানের মাধ্যমে যে আধ্যাত্মিক পথনির্দেশের ভার উনি নিয়েছেন, তা আর কারো পক্ষে বইবার যে যো নেই। শরীরে থাকুন আর নাই থাকুন, গুরু আজীবন শিষ্যের হাত ধরে থাকেন আর যেই সে আধ্যাত্মপথে এক পা এগোতে চায়, তিনি অমনি তাকে কোলে তুলে পাঁচ পা এগিয়ে দেন। শিষ্য যতই ভুল করুক, গুরুর চেয়ে ধৈর্যবান, গুরুর চেয়ে ক্ষমাশীল আর গুরুর চেয়ে দয়াময় আর কেউ হননা। শিষ্য যখন গুরুকে ভুলে থাকে, গুরু তখনো শিষ্যের কর্তব্যটি নীরবে নিজে করে যান আর যখন তার সম্বিৎ ফেরে, সে একফোঁটা কৃপা চাইলে গুরু তাকে একঘটি দিয়ে দেন। আমি নিজের জীবনে গুরুকৃপার এমনসব পরিচয় পেয়েছি যে এ আর শোনা কথা নয়, একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয়।

আমাদের শ্রীরামকৃষ্ণ পরম্পরায় গুরুরা অধ্যাত্মিকভাবে দারুন অভিব্যক্ত ও ক্ষমতাবান হন কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই ব্রহ্মস্বরূপ ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন্তরূপ, তাঁর প্রতিনিধি। যে শক্তি তাঁরা বিচ্ছুরণ করেন, সেটি আসলে স্বয়ং ঠাকুর ও শ্রীশ্রীময়ের দৈবীশক্তি। যে মন্ত্র তাঁরা প্রদান করেন সেটি ঠাকুর, মা, স্বামীজী বা ঠাকুরের পার্ষদদের দেওয়া সিদ্ধমন্ত্রগুলির মধ্যে একটি। আর যে সংস্কার তাঁরা বপন করেন সেটি সেই বৈদিকযুগ থেকে অবিচ্ছিন্নভাবে বহতী ঋষিলব্ধ সনাতন ধর্মের মূল সংস্কার। ফলে আমাদের গুরুকে ইষ্টের প্রতিরূপ বলে ভাবতে মোটেও অসুবিধা হয়না এবং ধ্যানে তিনি খুব সহজেই ইষ্টের মধ্যে বিলীন হয়ে যান। এই কারণে আমার গুরুদেব সঙ্ঘাধক্ষ থাকা কালে শ্রীশ্রীঠাকুর, মা, স্বামীজী ও ঠাকুরের পার্ষদ ছাড়া রামকৃষ্ণসঙ্ঘের বাকি সমস্ত গুরুদের জন্মতিথি পালনের প্রথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন কারণ শ্রীশ্রীঠাকুর ব্যতিরেকে তাঁদের কারোরই আলাদা করে কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই পরম্পরা আজও চলছে। তবু যাঁকে চোখের সামনে স্বয়ং ঠাকুরের প্রতিমূর্তি বলে দুচোখভরে দেখেছি, যাঁকে প্রণাম করে স্বয়ং ঠাকুরকে প্রণাম করার প্রসাদ লাভ করেছি, মাথার ওপর যাঁর আশীর্বাদী স্পর্শ স্বয়ং ঠাকুরের স্পর্শ বলে জেনেছি, যাঁর উপদেশ ঠাকুরের উপদেশ বলে মনে করে যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করেছি আর আজও যাঁর মূর্তিকে হৃদয়ে ধারণ করে উপাসনা শুরু করি, সেই গুরুকে ভুলি কি করে?

আমার শ্রীগুরুদেব পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজের নামের মধ্যেই বীরেশ্বর শিব ছিলেন। ওঁর পূর্বাশ্রমের নাম ছিল পাণ্ডুরঙ্গ প্রভু, সেটির ভেতরেও শ্রীবিষ্ণু ছিলেন। আর ওঁর আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে তিনি ব্রহ্মার মতোই সৃষ্টিশীল ও জ্ঞানের আকর হিসেবে সুবিদিত ছিলেন। খুব ছোটবেলায় গুরুদেব স্বয়ং স্বামীজীর স্নেহাশীর্বাদ পেয়েছিলেন, শ্রীশ্রীমা তাঁকে জয়রামবাটিতে মন্ত্রদীক্ষা দিয়ে কৃপা করেছিলেন আর তাঁর সন্ন্যাসজীবন সযত্নে গড়ে তুলেছিলেন ঠাকুরের নিজস্ব পার্ষদরা। ফলে, আমি তাঁর কাছ থেকে একেবারে নির্ভেজাল সারবস্তুটুকুই পেয়েছিলাম, নিজে তখন তার মূল্য বুঝিনি, সে অন্য কথা। তাঁর দানে কোনো কার্পণ্য ছিল না, আমিই গ্রহণের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারিনি।

গুরুদেব যেমন সুরসিক ছিলেন তেমনই বাস্তববাদী ছিলেন, সেটি তাঁর জীবনীগ্রন্থ পড়লেই বোঝা যায়। শ্রীমৎ স্বামী চেতনানন্দজী মহারাজ তাঁর 'প্রাচীন সাধুদের কথা' গ্রন্থে একজায়গায় গুরুদেবের রসবোধ সম্পর্কে লিখেছেন, '১৯৭৭ সালে জুলাই মাসে হলিউড থেকে প্রথম মঠে এলাম। প্রভু মহারাজকে প্রণাম করতেই তিনি হেসে সেবককে বললেন, “ওর মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দে। একটা চেয়ার দে।” আমি মেঝেতে তাঁর পায়ের কাছে বসে বললাম, “মহারাজ, আপনার সামনে চেয়ারে বসতে লজ্জা করে।” তখন তিনি হেসে বললেন, “তাহলে ওকে একটা টেবিল দে।” তারপর তাঁর সঙ্গে পাশ্চাত্যের কাজকর্ম সম্বন্ধে অনেক কথা হয়।' গুরুদেবের উচ্চ-নিচ বাছবিচার ছিলনা। যাঁরা ওঁকে চিনতেন তাঁরা জানতেন যে ঐ কঠোর অবয়বের মধ্যে একটা অতিকোমল মাতৃহৃদয় বাস করে, ওঁর কাছে নিঃসংকোচ হওয়া যায়। স্বামী চেতনানন্দজী লিখেছেন, 'বেলুড় মঠে থাকাকালের কতকগুলি ঘটনা মনে পড়ছে। মহারাজ তখন জেনারেল সেক্রেটারি। পুরানাে মিশন অফিসের ওপরের ঘরে আমি মহারাজের সঙ্গে কথা বলছি। এমনসময় মঠের নাপিত রামমুরত ঘরে ঢুকে মহারাজের পায়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে বলল, “প্রভু, মেরে অবগুণ চিত না ধরাে।” মহারাজ হাে-হাে করে হেসে ফেললেন। মহারাজের মাথা কামানাের দিন ছিল, কিন্তু রামমুরত তা ভুলে যায়। তাই সন্ধ্যার সময় ঐ কথা বলে ক্ষমা চাইল।'

আর, একদিকে যিনি ব্রহ্মসূত্রের শঙ্করভাষ্যের ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, তিনিই আবার এক বক্তৃতায় বলেন, "সাধারণত ত্যাগের আদর্শ এখন নেই। আমরা সন্ন্যাসীরা স্বর্গ থেকে আসিনি, এসেছি সমাজ থেকে। নৈতিক স্বাস্থ্যবান দৃঢ় চরিত্রবলসম্পন্ন সমাজই মাত্র পারে আদর্শ সন্ন্যাসী সৃষ্টি করতে। যদি আমরা সাধারণের সঙ্গে না মিশি এবং তাদের মধ্যে কাজ না করে এড়িয়ে চলি, তাহলে তারা কেমন করে নিজেদের সংশোধন করবে এবং ঠিক পথে চলবে? যদি তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি না হয়, তাহলে আমরাও বা কেমন করে সে সমাজ থেকে তেজস্বী-ত্যাগী ছেলেদের পাব? আর যদি এইরকম দুর্বল সমাজ থেকে ছেলেরা আসে সাধু হবার জন্য, তারা হবে যেমন 
— শ্রীধর স্বামী তাঁর গীতার টীকায় বলেছেন, 
‘পিশুনাঃ কলহোৎসুকাঃ’ 
— সবসময় পরের দোষান্বেষী এবং ঝগড়াটে! সুতরাং আমাদের নিজেদের স্বার্থে আমাদের কর্তব্য জনসাধারণের কাছে গিয়ে তাদের নৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করা। অধিকন্তু সাধু হিসাবে সমাজের কাছে আমাদের ঋণও রয়েছে। কেননা এতদিন আমরা সমাজের কাছে সেবা পেয়েছি। তাই জনসাধারণের অবস্থার উন্নতির চেষ্টা করে এবং উন্নততর ভিত্তির ওপর সমাজ-পুনর্গঠনে তাদের সাহায্য করে আমাদের সেই ঋণ অবশ্যই পরিশোধ করা উচিত।" (গ্রন্থসূত্র: স্বামী বীরেশ্বরানন্দ - এক দিব্য জীবন)

গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর 
গুরুরেব পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ

Thursday, July 7, 2022

মা কালী

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি রামপ্রসাদী গান খুব গাইতেন, 
কে জানে কালী কেমন, ষড় দর্শনে না পায় দরশন।
আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন,
সে যে ঘটে ঘটে বিরাজ করে ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।
কালীর উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা বুঝ কেমন,
যেমন শিব বুঝেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন।
মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন,
কালী পদ্মবনে হংস-সনে, হংসীরূপে করে রমণ।
প্রসাদ ভাষে, লোকে হাসে, সন্তরণে সিন্ধু-তরণ,
আমার মন বুঝেছে, প্রাণ বুঝে না; ধরবে শশী হয়ে বামন।

সত্যিই তো, কে জানে কালী কেমন? নানা তন্ত্রে মায়ের নানারূপের বর্ণনা থাকলেও, আমরা বাঙালিরা মায়ের দক্ষিণাকালিকা রূপটিকেই বেশি পছন্দ করি। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে নবদ্বীপের বিশিষ্ট তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ এই কালীমূর্তির প্রচলন করেছিলেন। মহাকাল সংহিতা অনুসারে আদ্যাকালীই দক্ষিণাকালী। জনশ্রুতি যে দক্ষিণদিকে যমের অবস্থান, কালী নামে ভীত হয়ে সে ছুটে পালায়, এজন্যেই ত্রিজগতে কালিকাদেবী ‘দক্ষিণা’ নামে পরিচিতা। তবে আসল কারন আলাদা। ঋগবেদে আছে 'তমঃ আসীত্তমসা গূঢ়মগ্রে' মানে অগ্রে অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে ছিল তমঃ। সেই তমসায় সমস্তই আচ্ছন্ন ছিল (ঋকবেদ ১০/১২৯/৩)। আবার মৈত্রায়ণী-উপনিষদেও বলা হয়েছে 'তমো বা ইদমেকমাস', অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র তমঃ ছিল (মৈ-উপঃ, ৪র্থ প্রপাঠক)। এই আদি তমঃই কালী, তাই মা কালো। 

মহানির্বাণতন্ত্রে (১৩/৫-৬) বলা হয়েছে,
স্বেতপীতাদিকো বর্ণে যথা কৃষ্ণে বিলীয়তে।
প্রবিশন্তি তথা কাল্যাং সর্বভূতানি শৈলজে।।
অতস্তস্যাঃ কালশক্তের্নিগুণায়া নিরাকৃতেঃ।
হিতায়াঃ প্রাপ্তযোগানাং বর্ণঃ কৃষ্ণো নিরূপিতঃ।।
অর্থাৎ, শ্বেত পীতাদি বর্ণ যেমন কৃষ্ণ বর্ণে বিলীন হয়ে যায় তেমনি সর্বভূত কালীর মধ্যে বিলীন হয়। এইজন্য যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাঁরা নির্গুণা নিরাকারা কল্যাণময়ী কালশক্তির কৃষ্ণবর্ণ নিরূপণ করেছেন। “পরাশক্তি অরূপা সুতরাং বর্ণহীন। যেখানে সর্ববর্ণের অভাব তাহাই নিবিড় কৃষ্ণাবর্ণ, একথা বিজ্ঞানসম্মত। বিজ্ঞান আরও বলে যে-জ্যোতিঃ আমাদের চক্ষু ধারনা করিতে পারে না, তাহাই নিবিড় কৃষ্ণবর্ণ দেখায়। তাই মহাজ্যোতিঃ কালী কৃষ্ণাবর্ণা। কিন্তু জ্ঞাননেত্রে মহাজ্যোতিঃ রূপে দৃশ্য হন।”

কালের কোলে সবকিছুই একদিন লয় হয়। কাল সৃষ্টির শুরু থেকে সমস্তই ‘কলন’ অর্থাৎ গ্রাস বা কালগ্রস্ত করছেন, তাই তাঁকে জগৎ-সংহারক ‘মহাকাল’ বলা হয়। সেই মহাকালকেও যিনি গ্রাস করেন বা নিজের মধ্যে বিলীন করে নেন, তিনিই কালী। কালী শব্দটি উচ্চারণ করলে ‘কাল-ঈ’ বোঝায়। ঈ অর্থাৎ ঈশ্বরী। অনাদি ও অনন্ত মহাকাল অর্থাৎ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানরূপী কালকে লয়-লীলার মধ্যেও যিনি সতত ‘ঈ’ অর্থাৎ ‘ঈক্ষণ’ অথবা দর্শন করছেন, তিনিই কাল-ঈ = কালী। 

মহাকালের অন্তর্গত খন্ডকালের মধ্যে সংসারের নিত্য সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় কার্য্য যা অহরহঃ অবিরত ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাও তিনি ‘ঈ’ বা ঈক্ষণ করছেন। আবার সেই অনাদি কাল থেকেই কাল-সংহারিণী কালীর করালবদনের মধ্যে নিত্য কত কি যে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, সে সবও তিনি সতত ‘ঈ’ বা ঈক্ষণ অথবা দর্শন করছেন, তাই তিনি ‘কালী’। শ্রীশ্রীচন্ডীতে মাকে 'সর্বভূতেষু চেতনেত্যাবিধীয়তে' বলা হচ্ছে, অর্থাৎ সকল প্রাণীতে যিনি চেতনা বলে অভিহিত হন। কালী হলেন স্বগুন ব্রহ্ম, মহাশক্তি, মহামায়া। যা ছিল, যা আছে এবং যা থাকবে, ভূত বর্তমান ভবিষ্যৎ আদি অনন্ত সব মায়ের মধ্যেই আছে।

কালী বা মহাকালী দক্ষিনা আদি অষ্ট কালীরূপে সাধকের ধ্যেয়। যেরূপেই তিনি ধ্যেয় হন না কেন, কালী হলেন আদি, অনন্ত, অক্ষয়, 'বাক্যমনাতীত মনোবচনৈকাধার'। তিনি ত্রিগুণময়ী। তাই মহানির্বাণতন্ত্রে সদাশিব দেবীকে বলেছেন,
সৃষ্টেরাদৌ ত্বমেকাসীৎ তমোরূপমগোচরম।
পুনঃ স্বরূপনাসাদ্য তমোরূপং নিরাকৃতিঃ।।
বাচাতীতং মনোহগম্যং ত্বমেকৈবাবশিষ্যসে।
সৃষ্টির পূর্বে বাক্য ও মনের অতীত তমোরূপে তুমি একা বিরাজমানা ছিলে। (প্রলয়ের পর) তুমিই আবার তোমার নিরাকার, বাক্যের অতীত ও মনের অগম্য তমোরূপ স্বরূপ প্রাপ্ত হও এবং তখন অদ্বিতীয়া তুমিই কেবল অবশিষ্ট থাকো।

দক্ষিণাকালী সম্পর্কে তন্ত্রতত্ত্বের আলোচনা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। শিবচন্দ্র লিখেছেন, "পুরুষের নাম দক্ষিন (দক্ষিনাঙ্গস্বরূপ বলে) এবং শক্তির নাম বামা (বামাঙ্গস্বরূপ বলে)। যতদিন এই বাম আর দক্ষিন, স্ত্রী ও পুরুষ সমবলে অবস্থিত, ততদিন সংসার বন্ধন। সাধনার প্রখর প্রভাবে বামাশক্তি জাগরিতা হলে তিনি দক্ষিনশক্তি পুরুষকে জয় করে তদুপরি স্বয়ং দক্ষিণানন্দে নিমগ্না হয়েন অর্থাৎ কি বাম, কি দক্ষিন উভয় অংশই যখন তাঁর প্রভাবে পূর্ণ হয়ে যায়, তখন সেই কেবলানন্দরূপিণী জীবের মহামোক্ষ প্রদান করেন। তাই ত্রৈলোক্য-মোক্ষদা মায়ের নাম দক্ষিণাকালী"।

মা আদিশক্তি, আদ্যাশক্তি। উনিই জগতের মূল শক্তি। উনি মহা সরস্বতী, উনিই মহা লক্ষ্মী। উনি মহিষমর্দিনী চণ্ডী, চামুন্ডা, কৌষিকী, দুর্গা ভগবতী।উনি রুদ্রানী শিবানী আবার উনিই ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী। উনি নারায়নের শক্তি নারায়নী, শিবের শক্তি শিবানী। উনি নারসিংহী, বারাহী, কৌমারী, গন্ধেশ্বরী। উনি শ্রীরামচন্দ্রের শক্তি সীতাদেবী (আদ্যাস্তোত্রে 'রামস্য জানকী ত্বং হি রাবণধ্বংসকারিনী), উনিই শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি আবার উনিই ব্রহ্মাগ্নিস্বরূপ 'যে রাম যে কৃষ্ণ সেই এই শরীরে' শ্রীরামকৃষ্ণের দাহিকাশক্তি শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী। এই ব্রহ্মাণ্ডে তাঁর ইচ্ছা ব্যতিরেকে কোনো কিছুই হওয়ার যো নেই। ঠাকুর বলতেন, মায়ের ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না।

মায়ের মূর্তি বাইরে থেকে ভয়াবহ দেখালেও, আসলে তা এক ভক্তবৎসলা মোক্ষপ্রদায়িনী মহাশক্তির আধ্যাত্মিক প্রতীকীরূপ। শ্রীশ্রীচন্ডীর চতুর্থ অধ্যায়ের ২২নং শ্লোকে মায়ের রূপ সম্পর্কে বলা হচ্ছে,
চিত্তে কৃপা সমরনিষ্ঠুরতা চ দৃষ্টা।
ত্বয্যেব দেবী বরদে ভূবনত্রয়েহপি।।
অর্থাৎ, দেবী, কার সাথে তোমার এই পরাক্রমের তুলনা হতে পারে? শত্রুভীতিজনক এবং এত মনোরম সৌন্দর্য কোথায় আছে? বরদে, হৃদয়ে কৃপা এবং যুদ্ধে কঠোরতা ত্রিভুবনে একমাত্র তোমাতেই দেখা যায়। ওই শ্রীশ্রীচন্ডীতেই একাদশ অধ্যায়ের ৫৪-৫৫ নং শ্লোকে 'পাতানো মা নয়, সত্যিকারের মা' আশ্বাসবাণী দিচ্ছেন,
"ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি।
তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্।"
অর্থাৎ, যখনই দানবোদ্ভুত বিঘ্ন উপস্থিত হবে, তখনই আমি আবির্ভূতা হয়ে অসুরদের বিনাশ করবো।

মা ত্রিনয়না - অতীত, বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্তই সেই ত্রিগুণময়ী ত্রিকালদর্শিনী মায়ের নয়নপথে সর্বক্ষণ প্রতিভাত হয়ে রয়েছে। মায়ের একটি নয়ন চন্দ্রস্বরূপ, দ্বিতীয়টি সূর্যস্বরূপ আর তৃতীয়টি অগ্নিস্বরূপ। প্রথমটিতে মায়ের শান্তভাব, দ্বিতীয়টিতে জ্যোতি আর তৃতীয়টিতে তেজ প্রকাশ পায়। মায়ের চক্ষু রক্তবর্ণ কারণ রক্তই জীবের জীবনীশক্তিস্বরূপ, ফলে তাঁর নয়নত্রয় শক্তি-সহযোগে রক্তবিস্ফুরিত হয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে রয়েছে। মায়ের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে 'দেবীং লোলজিহ্বাং দিগম্বরীং'। মা আমাদের দিগম্বরী। এর অর্থ তিনি কোন কিছুরই বন্ধনে আবদ্ধ নন, তিনি দেশ কাল পাত্রের অতীত। এক দিকে তিনি বিশ্বমধ্যে, আবার অন্য দিকে তিনি বিশ্বব্যাপী ও বিশ্বাতীত। যাঁর স্বরূপ এমন, তাঁকে কি কোনও বাহ্যিক জাগতিক আবরণ দিয়ে ঢাকা যায়? বাসনামুক্ত হয়ে সম্পূর্ণভাবে অহং ও অবিদ্যাকে ত্যাগ করলে, তবেই মায়ের কাছে পৌঁছানো যায়।

মাযের মূর্তিতে আমরা দেখি তাঁর জিব বের করা, মা দাঁত দিয়ে জিব কামড়ে আছেন। এই ভঙ্গিমাকেই লোলজিহ্বা বলা হচ্ছে। জিবের অন্য নাম রসনা, যা সমস্ত রকমের রস ভোগ করার প্রতীক। রসনা ও উপস্থ, এই দুটি ইন্দ্রিয়জনিত ভোগ লালসার মূল যন্ত্র এবং অষ্টাঙ্গযোগ সাধনার শুরুতে এ দুটিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই যম বা সংযম ক্রিয়া অভ্যাস করতে হয়। স্থুলদেহের সংযমের কেন্দ্রবিন্দু বীর্য্য রক্ষা এবং সূক্ষ্মদেহের প্রথম স্তর বাক্য-সংযম ও পক্ষান্তরে রসনা সংযম। মন-সংযমও এরই অন্তর্গত অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম ক্রিয়া। মা নিজের জিব নিজের দাঁত দিয়ে কেটে আসলে সর্ববিধ লালসা-সংযমেরই ইঙ্গিত করছেন। অন্যভাবে দেখলে, রজোগুণ সাধারণতঃ সত্ত্বগুণের দ্বারাই বশীভূত হয়। রজো হলো লাল আর সত্ত্ব হলো সাদা। লাল জিবকে সাদা দাঁত দিয়ে কামড়ে মা সাধককে সত্ত্বগুণকে দিয়ে রজোগুণকে নিয়ন্ত্রণ করার বার্তা দিচ্ছেন, বলছেন ত্যাগের দ্বারা ভোগকে জয় করো।

মায়ের গলায় ৫০টি কাটা মুন্ডু আসলে ৫০টি সংস্কৃত বর্ণমালার প্রতীক, যার মধ্যে ১৪টি স্বরবর্ণ আর ৩৬টি ব্যঞ্জন বর্ণ। এখানে প্রতিটি বর্ণ মানে এক একটি বীজমন্ত্র। শব্দই ব্রহ্ম। তাই এখানে অক্ষররূপ বীজমন্ত্রগুলি শক্তির উৎস। দেবী স্বয়ং শব্দব্রহ্মরূপিণী। কামধেনু তন্ত্রে তাই মা নিজেই বলছেন,
"মম কণ্ঠে স্থিতং বীজং পঞ্চাশদ্ বর্ণমদ্ভুতম্"।
রামপ্রসাদ সেই শুনে গেয়েছেন,
যত শোন কর্ণপুটে সকল মায়ের মন্ত্র বটে।
কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে।
আসলে মায়ের গলার মুন্ডমালা হল জ্ঞানশক্তির প্রতীক। দেবী ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন - তিনি চেতনা দান করেন। আবদ্ধ জীবকে তিনি আলোর পথ দেখান। আর মায়ের কোমরবন্ধ হিসেবে মানুষের কাটা রক্তঝরা হাতের মাধ্যমে কর্মফলকে বোঝানো হয়েছে। তিনি ইচ্ছা করলেই কর্মফল ঘুচিয়ে দিয়ে এই জীবন-মৃত্যুর বৃত্ত থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি দিতে পারেন।

তন্ত্রে বলছে কালী 'মুন্ডমালিনীং দিব্যা সতত অট্টহাস্যকারীনিম।
শবরূপী মহাদেব হৃদয়পরি সংস্থিতাম।।'
অর্থাৎ মা গলায় মুন্ডমালা পরে দিব্যজ্যোতি ছড়িয়ে সারাক্ষন অট্টহাস্য করছেন আর শবরূপী মহাদেবের হৃদয়ের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মহাদেব দেবীর পদতলে কেন বিরাজ করছেন? কারণ শিব নিষ্ক্রিয় পুরুষ আর কালী হলেন সক্রিয় প্রকৃতি। তাই তি‌নি শবরুপী শিব, মা আদিপ্রকৃতির অধীনস্থ। সাংখ্য অনুসারে পুরুষ সাক্ষীস্বরূপ আর প্রকৃতি ক্রিয়াময়ী। তাই শ‌ক্তির পদত‌লে শি‌ব। শঙ্করাচার্য্যও বলে‌ছেন, শ‌ক্তিযুক্ত না হ‌লে শিবেরও স্পন্দন ক্ষমতা নেই । তাই দেবীর পা‌য়ের তলায় নিশ্চল হ‌য়ে প‌ড়ে র‌য়ে‌ছেন শিব।‌ তন্ত্রমতে, শ‌ক্তির দু‌টি অবস্থা, নি‌ষ্ক্রিয় ও ক্রিয়‌াশীল। শ‌ক্তি যখন নি‌ষ্ক্রিয় তখন তিনি শিব। আর যখন তিনি ক্রিয়াশীল ও জাগ্রত তখন তিনি কালী। তাই কালী ও শিব দুইই নিত্যরূপে একই মূ‌র্তি‌তে প্রকা‌শিত। দ‌ক্ষিণাকালীর মূ‌র্তি‌তে দেবী শি‌বের উপর বিপরীতরতাতুরা বা র‌তি‌ক্রিয়ার বিপরীত ভ‌ঙ্গিতে উপ‌বিষ্টা, যা নির্বাসনার প্রতীক। অপরদিকে রামপ্রসাদ বলেছেন অন্য তত্ত্ব। তিনি বলেছেন,
'দৈত্য‌বেটা ভূ‌মে প‌ড়ে,
মা দা‌ড়ি‌য়ে তার উপ‌রে, 
মা‌য়ের পাদস্প‌র্শে দানব‌দেহ 
শিবরূপ হয় রণস্থ‌লে।' 
অর্থাৎ মায়ের পাদস্পর্শে দৈত্য অর্থাৎ অশিব শিবে রূপান্তরিত হয়েছেন। এও যুগলমূর্তিকে দেখার একটা উপায় বটে।

মায়ের কাছে যেতে গেলে আগে মায়ের মেজাজটা তো বুঝতে হবে, নাকি? তাঁর রূপ যেমন প্রতীকী, তাঁর পূজাপদ্ধতিও তেমনই প্রতীকী। যাঁরা বোঝেন না তাঁদের মনে নানা প্রশ্ন জাগতেই পারে, সেটা তাঁদের কর্মফল। মায়ের বাহ্যিক রূপ দেখে তাঁরা ভাবতেই পারেন যে মা যে অসুরদের বিনাশ করেন তারা কারা আর কিভাবেই বা কোনো মা তাঁর নিজের সন্তানকে বধ করেন? তাঁরা মায়ের পূজায় অর্পণ করা উপাচারগুলির গুঢ়ার্থও স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারেন না। আসলে মা বধ করেন না, সংহার করেন। তিনি সংহাররুপিনী। সংহার শব্দের অর্থ ধ্বংস নয়, সংহরন, নিজের ভিতরে প্রত্যাকর্ষণ। যেমন সমুদ্রের বুকে ঢেউ ওঠে আবার সমুদ্রেই লয় হয়। আসলে মা তাঁর সাধক-সন্তানের অন্তরের কামাদি রিপুরূপ আসুরীপ্রবৃত্তিগুলির সাথে সর্বদা সমর-রতা। মানব হলো নিষ্কাম দেবতা আর বাসনাপূর্ন দানব - উভয় অবস্থারই প্রতীক-স্বরূপ। মানবের মনের ভিতরে নিয়তই দেবাসুরের ভীষণ যুদ্ধ ঘটে চলেছে। তাই নিষ্ঠাভরে প্রার্থনা করলে মা আজও রিপুরূপদানব-দলনের জন্য আবির্ভূতা হয়ে অন্তরের অসুরনাশ করে দেবত্বকে জাগিয়ে দেন। 

আরে মানুষ তো কোন ছাড়, স্বয়ং ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর তাঁর কাছে মুক্তি ভিক্ষা করেন। রামপ্রসাদ গেয়েছেন,
মুক্ত কর মা মুক্তকেশী
ভবে যন্ত্রনা পাই দিবানিশি।
মায়ের মুক্তকেশ একাধারে মোহমায়ার পাশ আর তার থেকে মুক্তির প্রতীক। কালী মায়াতীতা কিন্তু স্বগুণশক্তিরূপে অনন্ত জীবকোটিকে মায়াপাশে বদ্ধ করেন। তাই একদিকে তাঁর মুক্তকেশজাল মায়াপাশের প্রতীক আবার অন্যদিকে মা কালী ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবেরও মুক্তিবিধান করেন বলে তিনি মুক্তকেশী। ক-অ-ঈশ= কেশ। ক ব্রহ্মা, অ বিষ্ণু এবং ঈশ শিব। কাজেই কেশ বলতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব বোঝায়। তাই 'কেশ'কে মুক্ত করেন বলে মা মুক্তকেশী। যোগশাস্ত্রে মুক্তকেশ বৈরাগ্যের প্রতীক। মায়ের যে চিরবৈরাগ্য। তিনি কৃপা করে জ্ঞানখড়্গের দ্বারা লৌকিক বা জাগতিক অষ্টপাশ ছিন্ন করে সাধককে মুক্ত করে দেন, যা তাঁর বাঁহাতে ধরা কাটা মুন্ডুতে প্রতিবিম্বিত।

সিস্টার নিবেদিতা তাঁর বিখ্যাত Kali the Mother বইটিতে বেবি লেগেট নামের একটি শিশুকে চিঠিতে লিখছেন (২৫শে ডিসেম্বর, ১৮৯৮),
BABY DARLING, what is the very first thing you remember? Is it not lying on mother's lap, and looking up into her eyes, and laughing?

Did you ever play hide and seek with mother? Mother's eyes shut, and baby was not. She opened them, and there was baby! Then baby's eyes shut, and where was mother? But they opened again, and--oh!

When mother's eyes were shut, where was she? There all the time. But you could not see her eyes. Yet she was there.

Baby, some people think God is just like that. A great great Mother--so great that all this big world is Her baby. God is playing with Her world, and She shuts Her eyes. Then, all our lives long, baby darling, we try to catch the Great Mother peeping. And if any of us can do that, if any of us can look into the eyes of God, just once, just for a minute,--do you know what happens? . . . That person at once knows all secrets, and he becomes strong and wise and loving, and he never, never forgets that moment.

And when you win like that, when you catch the Mother looking, something else happens. Something lovely. All Her other children come and play with you. The little birds come, and the wee lambs love you, and the wild rabbits touch your feet, and the poor children in the streets, who are cold and hungry perhaps--poor children that the Great Mother loves most of all, because they seem to have no father or mother, and perhaps no home--poor children trust you, and make a place for you with them. We are all sitting on the Mother's lap, but these sit closest of all to Her breast.

And what do we call the Mother with Her eyes shut? We call her Kali.

Tuesday, July 5, 2022

মৃত্যু-দর্শন

এক বন্ধু আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি অতুলপ্রসাদের গান পাঠালেন, 'আমি বাঁধিনু তোমার তীরে তরণী আমার'। শুনতে শুনতে মনে হলো রবীন্দ্রনাথ একজায়গায় বলেছেন, 'জীবনকে সত্য বলে জানতে গেলে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার পরিচয় পেতে হবে। যে মানুষ ভয় পেয়ে মৃত্যুকে এড়িয়ে জীবনকে আঁকড়ে রয়েছে, জীবনের পরে তার যথার্থ শ্রদ্ধা নেই বলে জীবনকে সে পায়নি। যে লোক নিজে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বন্দি করতে ছুটেছে, সে দেখতে পায়, যাকে সে ধরেছে সে মৃত্যুই নয়, সে জীবন' (ফাল্গুনী, ১৩২২)। কবি জীবনস্মৃতিতে ‘মৃত্যু শোক’ পর্যায়ে লিখেছেন ‘জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্ব প্রয়োজন, মৃত্যু দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার ওপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বড়ো মনোহর।'


মৃত্যু যে আসলে কি, সেটা আমরা হিন্দুরা যেভাবে বুঝি, বোধহয় অন্য কোনো ধর্ম সংস্কৃতির মানুষ তেমনভাবে বোঝেন না। অন্য সবার কাছে ঈশ্বর একজন আলাদা মহাশক্তি, যিনি এই জগতের বাইরে কোনো এক স্বর্গলোকে থাকেন ও সেখান থেকে সমগ্র জীবজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং জগৎ তাঁর অধীন, আজ্ঞাবহ। আমাদের হিন্দুদের কাছে কিন্তু ঈশ্বর, যাঁকে আমরা ব্রহ্ম বলি, বাইরের কোনো শক্তি নন, আমরা স্বয়ংই ঈশ্বর, যদিও সেটা হয়তো আমরা সারা জীবন বুঝতেই পারিনা। ঈশ্বর যেহেতু অনন্ত, নিত্য, সত্য, অবিকার, ফলে আমরাও ঠিক তাইই - আমরা অমর। আমরা সাময়িকভাবে একটা শরীর ধারণ করি বটে যাতে এই সারসত্যটি উপলব্ধি করা যায় এবং সেই শরীরটি থাকাকালীন তা করা সম্ভব না হলে একসময় সেই শরীরটির মৃত্যু হয় এবং আবার নতুন করে একটি অন্য শরীর ধারণ করতে হয় কিন্তু তার সাথে আত্মার জন্ম-মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই - সে চিরন্তন, অক্ষয়। 


তাই শ্রীমদ্ভগবদগীতার ২য় অধ্যায়ের ২০নং শ্লোকে শ্রীভগবান বলছেন,

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্

নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥

অর্থাৎ, (আত্মার) না জন্ম হয়, না মৃত্যু হয় অথবা না কখনো উৎপন্ন হয় বা হবে বা হয়েছে। এ জন্মরহিত, নিত্য, চিরস্থায়ী, শরীর হত হলেও এ নিহত হয়না।

এটাই তো সেই শাশ্বত সত্য, যার ওপর গোটা বেদান্ত টিকে আছে। পার্থক্য কেবল এই, যে গীতায় আমরা স্বয়ং শ্রীভগবানের মুখ থেকে শুনতে পাই যে পরমাত্মা আর জীবাত্মা এক এবং অবিচ্ছেদ্য ফলে আত্মার মৃত্যু নেই, যা এর আগে ঋষিরা বহুবার বহুভাবে বলে গেছেন। এই শ্লোকের মধ্যেই তো বেদের সেই মহাবাক্যগুলি লুকিয়ে আছে, যা আমাদের শেখায় 'সোহহমস্মি = সঃ + অহম্ + অস্মি' - সেই পুরুষই আমি অথবা 'অয়মাত্মা ব্রহ্ম = অহম্ + আত্মা + ব্রহ্ম' - আমি আত্মা ব্রহ্ম ইত্যাদি। 


যজুর্বেদে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বলছেন,

হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্। 

তৎ ত্বং পূষন্নাপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।

পূষন্নেকর্ষে যম সূর্য প্রাজাপত্য ব্যূহ রশ্মীন্।

সমূহ তেজো যত্তে রূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি।

যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি।

বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম্।

অর্থাৎ, জ্যোতির্ময় পাত্রের দ্বারা সত্যব্রহ্মের স্বরূপটি আবৃত রয়েছে। হে পূষণ, সত্যধর্মা, আমার দর্শনের জন্য আপনি সেটি উন্মোচন করুন। হে পূষণ, হে একর্ষি, হে যম, হে সূর্য, হে প্রজাপতিপুত্র, আপনি কিরণরাজি অপসৃত করুন। তেজ সংযত করুন; আপনার যেটি কল্যাণতম রূপ, আমরা যেন সেটাই দেখতে পাই। সেই পুরুষই তো আমি, আমিই সেই, আমিই অমৃত। আমার প্রাণবায়ু মহাবায়ুতে লীন হোক। এই শরীর ভস্মীভূত হোক।


যিনি সর্বভূতের হৃদয়ে বাস করেন, প্রাণ ও বুদ্ধিরূপে সমস্ত জগৎকে পূর্ণ করেন, যিনি পুরুষাকার - তাঁকেই এখানে পুরুষ বলা হয়েছে। সেই পুরুষই আমার চৈতন্য স্বরূপ। আমি আর সেই পুরুষ অভিন্ন। বলা হচ্ছে যে পরমসত্য স্বরূপ সেই অগ্নিনামক ব্রহ্ম বা ওঁ-কার স্বরূপ ব্রহ্ম আর আমি অভেদ। বেদে বর্ণিত মহাজাগতিক সৃষ্টির ভিত্তি হলো পঞ্চভূত - ক্ষিতি, বরুণ, মরুত, তেজ ও ব্যোম। এখানে বরুণ বা বায়ুকে উপলক্ষ করে বিষয়টি বোঝানো হয়েছে - প্রাণবায়ু আর মহাবায়ুর মাধ্যমে। 


নিঃশ্বাসের মধ্যে দিয়ে যখন মহাবায়ু দেহে প্রবেশ করে, সেটি আমার বলে মনে হয়। আর্থাৎ আমার দেহে আবদ্ধ বায়ুর মালিক আমি। যতক্ষণ দেহ ততক্ষণ আমিত্ব আর ততক্ষণ দেহ নামক পাত্রে মহাবায়ু আর প্রাণবায়ুর ভেদজ্ঞান। দেহের মৃত্যুর সাথেসাথেই প্রাণবায়ু আবার মহাবায়ুতেই বিলীন হয়। মূলত এখানে বায়ুই মূখ্য। মহাবায়ুই আমাকে জীবন্ত রেখেছে। আমার দেহে আবদ্ধ যে বায়ু তা কিন্তু কখনোই মহাবায়ু থেকে আলাদা ছিল না। কিন্তু দেহ নামক পাত্রের জন্য সেটি আবদ্ধ ও ভিন্ন বলে মনে হচ্ছিল। দেহ না থাকলেই এই পার্থক্য ঘুচে যাবে। ঠিক সেইরকমই, আমিই সেই পুরুষ, কিন্তু সেই পুরুষ হিরণ্ময় পাত্রের দ্বারা আবৃত। পাত্র মানে দেহ। অর্থাৎ এই আবরণের অপসারণ ঘটলেই জীব ও ব্রহ্মের অভিন্নতা প্রকাশ পাবে। এই আবরণ মুক্ত করার জন্যই ঋষি উপাসনা করছেন। আর ঋষিবাক্য পড়তে পড়তে আমরাও হয়তো বুঝতে পারছি যে গভীর মনোযোগ দিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে মৃত্যুচিন্তা করতে পারলে একদিন না একদিন, কোনো না কোনো জন্মে, 'আমিই ব্রহ্ম' - এই সত্য আমাদের মধ্যে উদ্ভাসিত হবেই।


আমাদের যুগের ঋষি রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে শুরু হয়েছিল, ওনাকে দিয়েই নাহয় আজ শেষ হোক।  আমাদের মাতৃভাষাতেই এইভাবে কবি তাঁর মৃত্যু-দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন:

এ মৃত্যু ছেদিতে হবে, এই ভয়জালে,

এই পুঞ্জপুঞ্জীভূত জড়ের জঞ্জালে,

মৃত আবর্জনা। ওরে, জাগিতেই হবে

এ দীপ্ত প্রভাতকালে, এ জাগ্রত ভবে

এই কর্মধামে। দুই নেত্র করি আঁধা

জ্ঞানে বাধা, কর্মে বাধা, গতিপথে বাধা,

আচারে বিচারে বাধা, করি দিয়া দূর

ধরিতে হইবে মুক্ত বিহঙ্গের সুর

আনন্দে উদার উচ্চ।

সমস্ত তিমির

ভেদ করি দেখিতে হইবে ঊর্দ্ধশির

এক পূর্ণ জ্যোতির্ময়ে অনন্ত ভুবনে।

ঘোষণা করিতে হবে অসংশয়মনে--

"ওগো দিব্যধামবাসী দেবগণ যত,

মোরা অমৃতের পুত্র তোমাদের মতো।"

(নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থের ৬১নং কবিতা)

Saturday, July 2, 2022

সর তন সে যুদা

মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে গত ২১শে জুন শ্রী উমেশ প্রহ্লাদরাও কোলেকেও উদয়পুরের কানহাইয়াজী মতোই একই কারণে একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনাটি আমরা কেউ জানতে পারিনি কারণ তৎকালীন হিন্দুবিরোধী রাজ্যসরকার খবরটা চেপে দিয়েছিলেন। আজ NIA তদন্তে নেমেছে, ওখানেও সত্য উদ্ঘাটিত হবে। 

মুস্কিলটা হলো, এই যে আমাদের দেশে পরের পর 'সর তন সে যুদা' ঘটে চলেছে, সেই নৃশংসতার মূলে যাওয়ার বদলে একশ্রেণীর সাংবিধানিক পাদাধিকারী পর্য্যন্ত সস্তা হাততালি কুড়োবার আশায় উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেদের তামাশার পাত্র করে বসছেন। তাঁরা কেউই হয় বুঝছেন না বা বুঝতে চাইছেন না যে এর প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে।

যা ঘটেছে, বা বলা ভালো ঘটানো হচ্ছে, তার পেছনে যে অপ্রকৃতিস্থ মানসিকতা কাজ করছে, সেটা সেই আদি অকৃত্তিম ভয় দেখিয়ে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে খারাপকে ভালো বলানোর আপ্রাণ অপচেষ্টা, যা ভারতীয় সংস্কৃতির একেবারে পরিপন্থী। আমাদের সভ্যতায় ভদ্রতা, নম্রতা, সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদিকে চারিত্রিক উৎকর্ষ বলে গণ্য করা হয় কারণ মান্যতা এই, যে গাছ যত ফলবতী হয় তত সে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই আমরা বিবাদে নয়, সংবাদে বিশ্বাসী। সমালোচনা বা নিন্দাকে আমরা অপমান বলে মনে করিনা, বরং তাকে গঠনমূলকভাবেই দেখা হয়।

আমাদের সমাজে প্রবাসীর দৃষ্টিতে যাঁকে দীনহীন বলে মনে হতে পারে বাস্তবিকই তিনি হয়তো সর্বজনশ্রদ্ধেয় এবং তাঁর সান্নিধ্য ও মার্গদর্শন পেলে আমরা গৌরবান্বিত বোধ করি। সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতিতে সর্বত্যাগীরা দয়াপরবশ হয়ে ভিক্ষা গ্রহণ করে সামাজিক জীবকে ধন্য করেন, যা বিশ্বের আর কোনো সভ্যতায় বোধহয় নেই। এই যে আমরা বাকি সমস্ত অপেক্ষাকৃত নব্যসংস্কৃতির চেয়ে আলাদা, এটাই আমাদের শক্তি, দুর্বলতা নয়। এর জোরেই আমরা আজও বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির মধ্যে একমাত্র জীবন্ত আদিসভ্যতা। 

আমাদের ভাষাগুলিতে যেহেতু মূলত আমাদেরই মানসিকতা প্রতিফলিত, তাই হয়তো আমাদের দেশের হাজারো ভাষার মধ্যে blasphemy শব্দটির কোনো প্রতিশব্দ নেই। আমরা স্বভাবত জ্ঞানপিপাসু, আমরা অন্যের মতকে তার দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখতে সর্বদা আগ্রহী। আমরা হিন্দু কারণ আমাদের মনের জানলা দরজা সবসময়ই খোলা। আমরা হিন্দু কারণ আমরা নতুনকে জানতে আগ্রহী। আমরা হিন্দু কারণ আমরা অন্যের ভালোটা শিখতে চাই আর অন্যকেও নিজেদের ভালোটি দিতে চাই। আমরা সহ্যশীল, উদার, গ্রহণক্ষম এবং ধারণক্ষম।

না জানি কত হাজার হাজার বছরের পুরানো ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে এই পুণ্যভূমিতে কত শত পূজাপদ্ধতির জন্ম হয়েছে, উত্থান হয়েছে, পতন হয়েছে, পুনরুত্থান হয়েছে, পরিমার্জন হয়েছে, পরিবর্ধন হয়েছে কিন্তু একটাই বস্তু অপরিবর্তিত থেকেছে - ধর্মবোধ। গোলমাল হয়েছে লুটেরাদের দ্বারা বাইরে থেকে আমদানি করে নিয়ে আসা কিছু মতবাদের ক্ষেত্রে। ঠিক যেমন তাদের কুবুদ্ধির ফসল blasphemy-র কোনো ভারতীয় প্রতিশব্দ নেই তেমনি এদেশের আধ্যাত্মিক চেতনাদ্ভুত সনাতন ধর্মেরও কোনো বিজাতীয় প্রতিশব্দ নেই। সনাতন ধর্মবোধ বিশ্বজনীন হলেও একান্তই এদেশীয়। 

দুর্ভাগ্যবশত, কিছু লোকের ধর্মবোধ পছন্দ নয়, তারা মতপন্থ বা পূজাপদ্ধতিকেই ধর্ম বলে ভুল করেন। আমাদের জীবনদর্শন তাদের ঘোর অপছন্দের কারণ আমরা পন্থ নির্বিশেষে সনাতন ধর্মের অনুসারী। বিগত হাজার বছর ধরে বহু বহুবার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে, লুন্ঠন করে, মন্দির ধ্বংস করে, বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালিয়ে দিয়ে, জোর করে পন্থ পরিবর্তন করিয়ে, অমানুষিক নির্যাতন করে, অশেষ সন্ত্রাস করেও তারা আমাদের মূল যাপন পাল্টাতে পারেনি এবং সেই ক্ষোভ তাদের মনের মধ্যে প্রায় স্থায়ী বাসা বেঁধে ফেলেছে। লুটেরারা হয়তো চলে গেছে কিন্তু তাদের সেই অন্যেকে জোর করে বশ্যতা স্বীকার করানোর মানসিকতার রেশ তারা ছড়িয়ে দিয়ে গেছে আমাদেরই কারো কারো মধ্যে। যখনই ভারতের শত্রুরা কেউ তাতে হওয়া দেয়, অমনি তারা নির্বোধের মতন কুকাজ করে ফেলে। 

ওরা মনে করে হিন্দুরা ভীরু। ওরা ভীরুতা আর ধর্মভীরুতার পার্থক্য বোঝেনা। ওরা ভাবে যে কারো মাথা কেটে ওরা বাকিদের  মানতে বাধ্য করাতে পারবে যে ওদের মতবাদই হলো সর্বোপরি, আর সেই মতবাদ কোনো আলোচনা বা বাদ-সংবাদের বিষয় নয়, কেবল মুখবুজে মেনে চলার বিষয়। এর অন্যথা হলেই বলপ্রয়োগ করা ওদের পন্থসম্মত অধিকার।

এই গোঁড়ামি আমাদের প্রাচীন সভ্যতার সংস্কার ও সংস্কৃতির অংশ নয়, এ আমদানি করে একশ্রেণীর ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বিজাতীয় অসহিষ্ণুতা। এখানে ২০০২তে গোধরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা শবরমতী এক্সপ্রেসের তীর্থযাত্রীপূর্ন দুটি বগিকে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়াই হোক বা ২০২২শে অমরাবতী আর উদয়পুরের 'সর তন সে যুদা'ই হোক, প্রতিক্ষেত্রেই উপলক্ষটা বড় কথা নয়, বুকের মধ্যে পুষে রাখা অক্ষমতার যন্ত্রণায় তাড়িত হয়ে হঠাৎ হঠাৎ হিংস্র হয়ে ওঠার প্রবণতাটাই আসল।

এখন প্রশ্ন হলো, চিরকালের জন্য এই ধরণের হিংসা বন্ধ করতে হলে সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিকরূপে প্রতিহিংসার পথ ধরলে কি স্থায়ী সমাধান বেরোবে নাকি নিজেদের পূর্বপুরুষের সনাতন সংস্কৃতিকে ভোলানোর যে অবতন্ত্র তৈরি করা হয়েছে, সেটা ভেঙে দিতে পারলেই আসল সুরাহা হবে - সমাজকে এবং রাজনৈতিক নেতাদের এই মূল নির্ণয়টি নিতে হবে। গণতন্ত্রে বৃহত্তর সমাজ যা চাইবে রাজনৈতিক দল আখেরে তা করতে বাধ্য তবে আমি মনে করি দেশের স্বার্থে রাষ্ট্রশক্তির প্রয়োগ সংযত ও শুধুমাত্র দৃষ্টান্তস্বরূপ হওয়া উচিত আর সভ্য সমাজে ভিড়তন্ত্রের কোনো স্থান নেই।

সাময়িক প্রতিক্রিয়ার বদলে সমাজ যদি সরকারের ওপর এই চাপটি দেন যে এমনটা বাধ্যতামূলক করা হোক যে প্রত্যেকটি ভারতীয় শিশু ১২ ক্লাস অবধি একই পাঠ্যক্রম পড়বে এবং কোনো সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই আলাদা পন্থীয় শিক্ষাক্রম রাখা যাবে না, তাহলেই বোধহয় অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দ্বিতীয় যেটা করা দরকার তা হলো যে কোনো পন্থগুরু তাঁর পন্থীয় ভাষণে কি কি বলতে পারবেন না, সেটা একেবারে লিপিবদ্ধ করে দেওয়া এবং তা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছে কিনা সেবিষয়ে কড়া নজর রাখা ও প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। তৃতীয়, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো গবেষণার নামে চলা সমস্ত গোঁড়ামির দোকান চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। একশ্রেণীর নাগরিককে শেখানো হচ্ছে যে হিন্দু সভ্যতার সঙ্গে তাঁদের নাড়ির যোগ নেই, তাঁরা আমাদের থেকে আলাদা। মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে গত ২১শে জুন শ্রী উমেশ প্রহ্লাদরাও কোলেকেও উদয়পুরের কানহাইয়াজী মতোই একই কারণে একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনাটি আমরা কেউ জানতে পারিনি কারণ তৎকালীন হিন্দুবিরোধী রাজ্যসরকার খবরটা চেপে দিয়েছিলেন। আজ NIA তদন্তে নেমেছে, ওখানেও সত্য উদ্ঘাটিত হবে। 

মুস্কিলটা হলো, এই যে আমাদের দেশে পরের পর 'সর তন সে যুদা' ঘটে চলেছে, সেই নৃশংসতার মূলে যাওয়ার বদলে একশ্রেণীর সাংবিধানিক পাদাধিকারী পর্য্যন্ত সস্তা হাততালি কুড়োবার আশায় উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেদের তামাশার পাত্র করে বসছেন। তাঁরা কেউই হয় বুঝছেন না বা বুঝতে চাইছেন না যে এর প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে।

যা ঘটেছে, বা বলা ভালো ঘটানো হচ্ছে, তার পেছনে যে অপ্রকৃতিস্থ মানসিকতা কাজ করছে, সেটা সেই আদি অকৃত্তিম ভয় দেখিয়ে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে খারাপকে ভালো বলানোর আপ্রাণ অপচেষ্টা, যা ভারতীয় সংস্কৃতির একেবারে পরিপন্থী। আমাদের সভ্যতায় ভদ্রতা, নম্রতা, সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদিকে চারিত্রিক উৎকর্ষ বলে গণ্য করা হয় কারণ মান্যতা এই, যে গাছ যত ফলবতী হয় তত সে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই আমরা বিবাদে নয়, সংবাদে বিশ্বাসী। সমালোচনা বা নিন্দাকে আমরা অপমান বলে মনে করিনা, বরং তাকে গঠনমূলকভাবেই দেখা হয়।

আমাদের সমাজে প্রবাসীর দৃষ্টিতে যাঁকে দীনহীন বলে মনে হতে পারে বাস্তবিকই তিনি হয়তো সর্বজনশ্রদ্ধেয় এবং তাঁর সান্নিধ্য ও মার্গদর্শন পেলে আমরা গৌরবান্বিত বোধ করি। সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতিতে সর্বত্যাগীরা দয়াপরবশ হয়ে ভিক্ষা গ্রহণ করে সামাজিক জীবকে ধন্য করেন, যা বিশ্বের আর কোনো সভ্যতায় বোধহয় নেই। এই যে আমরা বাকি সমস্ত অপেক্ষাকৃত নব্যসংস্কৃতির চেয়ে আলাদা, এটাই আমাদের শক্তি, দুর্বলতা নয়। এর জোরেই আমরা আজও বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির মধ্যে একমাত্র জীবন্ত আদিসভ্যতা। 

আমাদের ভাষাগুলিতে যেহেতু মূলত আমাদেরই মানসিকতা প্রতিফলিত, তাই হয়তো আমাদের দেশের হাজারো ভাষার মধ্যে blasphemy শব্দটির কোনো প্রতিশব্দ নেই। আমরা স্বভাবত জ্ঞানপিপাসু, আমরা অন্যের মতকে তার দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখতে সর্বদা আগ্রহী। আমরা হিন্দু কারণ আমাদের মনের জানলা দরজা সবসময়ই খোলা। আমরা হিন্দু কারণ আমরা নতুনকে জানতে আগ্রহী। আমরা হিন্দু কারণ আমরা অন্যের ভালোটা শিখতে চাই আর অন্যকেও নিজেদের ভালোটি দিতে চাই। আমরা সহ্যশীল, উদার, গ্রহণক্ষম আর ধারণক্ষম।

না জানে কত হাজার হাজার বছরের পুরানো ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে এই পুণ্যভূমিতে কত শত পূজাপদ্ধতির জন্ম হয়েছে, উত্থান হয়েছে, পতন হয়েছে, পুনরুত্থান হয়েছে, পরিমার্জন হয়েছে, পরিবর্ধন হয়েছে কিন্তু একটাই বস্তু অপরিবর্তিত থেকেছে - ধর্মবোধ। গোলমাল হয়েছে লুটেরাদের দ্বারা বাইরে থেকে আমদানি করে নিয়ে আসা কিছু মতবাদের ক্ষেত্রে। ঠিক যেমন তাদের কুবুদ্ধির ফসল blasphemy-র কোনো ভারতীয় প্রতিশব্দ নেই তেমনি এদেশের আধ্যাত্মিক চেতনাদ্ভুত সনাতন ধর্মেরও কোনো বিজাতীয় প্রতিশব্দ নেই। সনাতন বোধ বিশ্বজনীন হলেও একান্তই এদেশীয়। 

দুর্ভাগ্যবশত, কিছু লোকের ধর্মবোধ পছন্দ নয়, তারা মতপন্থ বা পূজাপদ্ধতিকেই ধর্ম বলে ভুল করেন। আমাদের জীবনদর্শন তাদের ঘোর অপছন্দের কারণ আমরা পন্থ নির্বিশেষে সনাতন ধর্মের অনুসারী। বিগত হাজার বছর ধরে বহু বহুবার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে, লুন্ঠন করে, মন্দির ধ্বংস করে, বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালিয়ে দিয়ে, জোর করে পন্থ পরিবর্তন করিয়ে, অমানুষিক নির্যাতন করে, অশেষ সন্ত্রাস করেও তারা আমাদের মূল যাপন পাল্টাতে পারেনি এবং সেই ক্ষোভ তাদের মনের মধ্যে প্রায় স্থায়ী বাসা বেঁধে ফেলেছে। লুটেরারা হয়তো চলে গেছে কিন্তু তাদের সেই অন্যেকে জোর করে বশ্যতা স্বীকার করানোর মানসিকতার রেশ তারা ছড়িয়ে দিয়ে গেছে আমাদেরই কারো কারো মধ্যে। যখনই ভারতের শত্রুরা কেউ তাতে হওয়া দেয়, অমনি তারা নির্বোধের মতন কুকাজ করে ফেলে। 

ওরা মনে করে হিন্দুরা ভীরু। ওরা ভীরুতা আর ধর্মভীরুতার পার্থক্য বোঝেনা। ওরা ভাবে যে কারো মাথা কেটে ওরা বাকিদের  মানতে বাধ্য করাতে পারবে যে ওদের মতবাদই হলো সর্বোপরি, আর সেই মতবাদ কোনো আলোচনা বা বাদ-সংবাদের বিষয় নয়, কেবল মুখবুজে মেনে চলার বিষয়। এর অন্যথা হলেই বলপ্রয়োগ করা ওদের পন্থসম্মত অধিকার।

এই গোঁড়ামি আমাদের প্রাচীন সভ্যতার সংস্কার ও সংস্কৃতির অংশ নয়, এ আমদানি করে একশ্রেণীর ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বিজাতীয় অসহিষ্ণুতা। এখানে ২০০২তে গোধরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা শবরমতী এক্সপ্রেসের তীর্থযাত্রীপূর্ন দুটি বগিকে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়াই হোক বা ২০২২শে অমরাবতী আর উদয়পুরের 'সর তন সে যুদা'ই হোক, প্রতিক্ষেত্রেই উপলক্ষটা বড় কথা নয়, বুকের মধ্যে পুষে রাখা অক্ষমতার যন্ত্রণায় তাড়িত হয়ে হঠাৎ হঠাৎ হিংস্র হয়ে ওঠার প্রবণতাটাই আসল।

এখন প্রশ্ন হলো, চিরকালের জন্য এই ধরণের হিংসা বন্ধ করতে হলে সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিকরূপে প্রতিহিংসার পথ ধরলে কি স্থায়ী সমাধান বেরোবে নাকি নিজেদের পূর্বপুরুষের সনাতন সংস্কৃতিকে ভোলানোর যে অবতন্ত্র তৈরি করা হয়েছে, সেটা ভেঙে দিতে পারলেই আসল সুরাহা হবে - সমাজকে এবং রাজনৈতিক নেতাদের এই মূল নির্ণয়টি নিতে হবে। গণতন্ত্রে বৃহত্তর সমাজ যা চাইবে রাজনৈতিক দল আখেরে তা করতে বাধ্য তবে আমি মনে করি দেশের স্বার্থে রাষ্ট্রশক্তির প্রয়োগ সংযত ও শুধুমাত্র দৃষ্টান্তস্বরূপ হওয়া উচিত আর সভ্য সমাজে mobocracy-র কোনো স্থান নেই।

সাময়িক প্রতিক্রিয়ার বদলে সমাজ যদি সরকারের ওপর এই চাপটি দেন যে এমনটা বাধ্যতামূলক করা হোক যে প্রত্যেকটি ভারতীয় শিশু ১২ ক্লাস অবধি একই পাঠ্যক্রম পড়বে এবং কোনো সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই আলাদা পন্থীয় শিক্ষাক্রম রাখা যাবে না, তাহলেই বোধহয় অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দ্বিতীয় যেটা করা দরকার তা হলো যে কোনো পন্থগুরু তাঁর পন্থীয় ভাষণে কি কি বলতে পারবেন না, সেটা একেবারে লিপিবদ্ধ করে দেওয়া এবং তা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছে কিনা সেবিষয়ে কড়া নজর রাখা ও প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। তৃতীয়, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো গবেষণার নামে চলা সমস্ত গোঁড়ামির দোকান চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। একশ্রেণীর নাগরিককে শেখানো হচ্ছে যে হিন্দু সভ্যতার সঙ্গে তাঁদের নাড়ির যোগ নেই, তাঁরা আমাদের থেকে আলাদা।।মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে গত ২১শে জুন শ্রী উমেশ প্রহ্লাদরাও কোলেকেও উদয়পুরের কানহাইয়াজী মতোই একই কারণে একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনাটি আমরা কেউ জানতে পারিনি কারণ তৎকালীন হিন্দুবিরোধী রাজ্যসরকার খবরটা চেপে দিয়েছিলেন। আজ NIA তদন্তে নেমেছে, ওখানেও সত্য উদ্ঘাটিত হবে। 

মুস্কিলটা হলো, এই যে আমাদের দেশে পরের পর 'সর তন সে যুদা' ঘটে চলেছে, সেই নৃশংসতার মূলে যাওয়ার বদলে একশ্রেণীর সাংবিধানিক পাদাধিকারী পর্য্যন্ত সস্তা হাততালি কুড়োবার আশায় উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেদের তামাশার পাত্র করে বসছেন। তাঁরা কেউই হয় বুঝছেন না বা বুঝতে চাইছেন না যে এর প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে।

যা ঘটেছে, বা বলা ভালো ঘটানো হচ্ছে, তার পেছনে যে অপ্রকৃতিস্থ মানসিকতা কাজ করছে, সেটা সেই আদি অকৃত্তিম ভয় দেখিয়ে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে খারাপকে ভালো বলানোর আপ্রাণ অপচেষ্টা, যা ভারতীয় সংস্কৃতির একেবারে পরিপন্থী। আমাদের সভ্যতায় ভদ্রতা, নম্রতা, সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদিকে চারিত্রিক উৎকর্ষ বলে গণ্য করা হয় কারণ মান্যতা এই, যে গাছ যত ফলবতী হয় তত সে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই আমরা বিবাদে নয়, সংবাদে বিশ্বাসী। সমালোচনা বা নিন্দাকে আমরা অপমান বলে মনে করিনা, বরং তাকে গঠনমূলকভাবেই দেখা হয়।

আমাদের সমাজে প্রবাসীর দৃষ্টিতে যাঁকে দীনহীন বলে মনে হতে পারে বাস্তবিকই তিনি হয়তো সর্বজনশ্রদ্ধেয় এবং তাঁর সান্নিধ্য ও মার্গদর্শন পেলে আমরা গৌরবান্বিত বোধ করি। সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতিতে সর্বত্যাগীরা দয়াপরবশ হয়ে ভিক্ষা গ্রহণ করে সামাজিক জীবকে ধন্য করেন, যা বিশ্বের আর কোনো সভ্যতায় বোধহয় নেই। এই যে আমরা বাকি সমস্ত অপেক্ষাকৃত নব্যসংস্কৃতির চেয়ে আলাদা, এটাই আমাদের শক্তি, দুর্বলতা নয়। এর জোরেই আমরা আজও বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির মধ্যে একমাত্র জীবন্ত আদিসভ্যতা। 

আমাদের ভাষাগুলিতে যেহেতু মূলত আমাদেরই মানসিকতা প্রতিফলিত, তাই হয়তো আমাদের দেশের হাজারো ভাষার মধ্যে blasphemy শব্দটির কোনো প্রতিশব্দ নেই। আমরা স্বভাবত জ্ঞানপিপাসু, আমরা অন্যের মতকে তার দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখতে সর্বদা আগ্রহী। আমরা হিন্দু কারণ আমাদের মনের জানলা দরজা সবসময়ই খোলা। আমরা হিন্দু কারণ আমরা নতুনকে জানতে আগ্রহী। আমরা হিন্দু কারণ আমরা অন্যের ভালোটা শিখতে চাই আর অন্যকেও নিজেদের ভালোটি দিতে চাই। আমরা সহ্যশীল, উদার, গ্রহণক্ষম আর ধারণক্ষম।

না জানে কত হাজার হাজার বছরের পুরানো ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে এই পুণ্যভূমিতে কত শত পূজাপদ্ধতির জন্ম হয়েছে, উত্থান হয়েছে, পতন হয়েছে, পুনরুত্থান হয়েছে, পরিমার্জন হয়েছে, পরিবর্ধন হয়েছে কিন্তু একটাই বস্তু অপরিবর্তিত থেকেছে - ধর্মবোধ। গোলমাল হয়েছে লুটেরাদের দ্বারা বাইরে থেকে আমদানি করে নিয়ে আসা কিছু মতবাদের ক্ষেত্রে। ঠিক যেমন তাদের কুবুদ্ধির ফসল blasphemy-র কোনো ভারতীয় প্রতিশব্দ নেই তেমনি এদেশের আধ্যাত্মিক চেতনাদ্ভুত সনাতন ধর্মেরও কোনো বিজাতীয় প্রতিশব্দ নেই। সনাতন বোধ বিশ্বজনীন হলেও একান্তই এদেশীয়। 

দুর্ভাগ্যবশত, কিছু লোকের ধর্মবোধ পছন্দ নয়, তারা মতপন্থ বা পূজাপদ্ধতিকেই ধর্ম বলে ভুল করেন। আমাদের জীবনদর্শন তাদের ঘোর অপছন্দের কারণ আমরা পন্থ নির্বিশেষে সনাতন ধর্মের অনুসারী। বিগত হাজার বছর ধরে বহু বহুবার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে, লুন্ঠন করে, মন্দির ধ্বংস করে, বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালিয়ে দিয়ে, জোর করে পন্থ পরিবর্তন করিয়ে, অমানুষিক নির্যাতন করে, অশেষ সন্ত্রাস করেও তারা আমাদের মূল যাপন পাল্টাতে পারেনি এবং সেই ক্ষোভ তাদের মনের মধ্যে প্রায় স্থায়ী বাসা বেঁধে ফেলেছে। লুটেরারা হয়তো চলে গেছে কিন্তু তাদের সেই অন্যেকে জোর করে বশ্যতা স্বীকার করানোর মানসিকতার রেশ তারা ছড়িয়ে দিয়ে গেছে আমাদেরই কারো কারো মধ্যে। যখনই ভারতের শত্রুরা কেউ তাতে হওয়া দেয়, অমনি তারা নির্বোধের মতন কুকাজ করে ফেলে। 

ওরা মনে করে হিন্দুরা ভীরু। ওরা ভীরুতা আর ধর্মভীরুতার পার্থক্য বোঝেনা। ওরা ভাবে যে কারো মাথা কেটে ওরা বাকিদের  মানতে বাধ্য করাতে পারবে যে ওদের মতবাদই হলো সর্বোপরি, আর সেই মতবাদ কোনো আলোচনা বা বাদ-সংবাদের বিষয় নয়, কেবল মুখবুজে মেনে চলার বিষয়। এর অন্যথা হলেই বলপ্রয়োগ করা ওদের পন্থসম্মত অধিকার।

এই গোঁড়ামি আমাদের প্রাচীন সভ্যতার সংস্কার ও সংস্কৃতির অংশ নয়, এ আমদানি করে একশ্রেণীর ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বিজাতীয় অসহিষ্ণুতা। এখানে ২০০২তে গোধরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা শবরমতী এক্সপ্রেসের তীর্থযাত্রীপূর্ন দুটি বগিকে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়াই হোক বা ২০২২শে অমরাবতী আর উদয়পুরের 'সর তন সে যুদা'ই হোক, প্রতিক্ষেত্রেই উপলক্ষটা বড় কথা নয়, বুকের মধ্যে পুষে রাখা অক্ষমতার যন্ত্রণায় তাড়িত হয়ে হঠাৎ হঠাৎ হিংস্র হয়ে ওঠার প্রবণতাটাই আসল।

এখন প্রশ্ন হলো, চিরকালের জন্য এই ধরণের হিংসা বন্ধ করতে হলে সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিকরূপে প্রতিহিংসার পথ ধরলে কি স্থায়ী সমাধান বেরোবে নাকি নিজেদের পূর্বপুরুষের সনাতন সংস্কৃতিকে ভোলানোর যে অবতন্ত্র তৈরি করা হয়েছে, সেটা ভেঙে দিতে পারলেই আসল সুরাহা হবে - সমাজকে এবং রাজনৈতিক নেতাদের এই মূল নির্ণয়টি নিতে হবে। গণতন্ত্রে বৃহত্তর সমাজ যা চাইবে রাজনৈতিক দল আখেরে তা করতে বাধ্য তবে আমি মনে করি দেশের স্বার্থে রাষ্ট্রশক্তির প্রয়োগ সংযত ও শুধুমাত্র দৃষ্টান্তস্বরূপ হওয়া উচিত আর সভ্য সমাজে mobocracy-র কোনো স্থান নেই।

সাময়িক প্রতিক্রিয়ার বদলে সমাজ যদি সরকারের ওপর এই চাপটি দেন যে এমনটা বাধ্যতামূলক করা হোক যে প্রত্যেকটি ভারতীয় শিশু ১২ ক্লাস অবধি একই পাঠ্যক্রম পড়বে এবং কোনো সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই আলাদা পন্থীয় শিক্ষাক্রম রাখা যাবে না, তাহলেই বোধহয় অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দ্বিতীয় যেটা করা দরকার তা হলো যে কোনো পন্থগুরু তাঁর পন্থীয় ভাষণে কি কি বলতে পারবেন না, সেটা একেবারে লিপিবদ্ধ করে দেওয়া এবং তা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছে কিনা সেবিষয়ে কড়া নজর রাখা ও প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। তৃতীয়, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো গবেষণার নামে চলা সমস্ত গোঁড়ামির দোকান চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। একশ্রেণীর নাগরিককে শেখানো হচ্ছে যে হিন্দু সভ্যতার সঙ্গে তাঁদের নাড়ির যোগ নেই, তাঁরা আমাদের থেকে আলাদা। হিন্দুরা নিজেদের সমাজ নিজেরাই সংস্কার করেন অথচ একই পূর্বপুরুষের বংশধর হওয়া স্বত্তেও এঁদের কাছে সমাজসংস্কার পাপ। এই ভ্রান্ত ধারণাটি একবার ভেঙে দিতে পারলেই কাজের কাজ হয়ে যাবে।