Friday, December 31, 2021

কল্পতরু উৎসব

তিনটি মাত্র শব্দ উচ্চারিত হলো, "তোমাদের চৈতন্য হোক", আর গোটা দুনিয়ার আত্মঅন্বেষী অনন্বেষী সকলের ভবিষ্যৎটি চিরকালের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেল, আধাত্ম পথে না এগোনোর উপায়ন্তরটিই আর রইলো না। আপাতদৃষ্টিতে এটি একজন কর্কট রোগাক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী কপর্দকশূন্য মানবদেহী গুরুর শেষ আশীর্বচন, কিন্তু সত্যিই কি তাই? যদি তাই হতো তাহলে আকন্ঠ জ্ঞানতৃষ্ণা নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের স্মৃতিবিজড়িত প্রতিটি স্থানে আজ লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামতো কি? কিসের আশায় তাঁরা কত দূর দূর থেকে কত কষ্ট করে দলে দলে আসেন, কেন বছরের পর বছর পয়লা জানুয়ারিতে কাশিপুরে, দক্ষিণেশ্বরে, বেলুড়ে, কামারপুকুরে, বলরাম বাটিতে, সারা বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মন্দিরে তাঁরা ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দেন - for nothing? এটি আসলে এক ঈশ্বরকল্প পুরুষের পরম আশ্বাসবচন, an ultimate declaration - 'কেন তুমি বোধ বুদ্ধি বিবেকযুক্ত মানবশরীর পেয়েছ, সেটা কোনো না কোনো জন্মে ঠিকই বুঝতে পারবে আর তারপর তোমার final destination-ও তুমি ঠিক খুঁজে পাবে, আমি আশীর্বাদ করছি'। 


তিনটি শব্দের প্রথম শব্দটি "তোমাদের"। লক্ষণীয় যে এটি বহুবচন এবং direct। যখন 'তোমাদের' বলছেন তখন কি কেবল সেদিন কাশিপুরের বাগানে ওঁর চোখের সামনে যাঁরা আছেন, তাঁদের কথা বলছেন? যিনি সারা পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে সনাতন ধর্মের পথ দেখাতে এসেছেন (যার নিদর্শন এখন আমরা সারা বিশ্ব জুড়ে নানা ভাষাভাষী, নানা বর্ণের, নানা পন্থের মানুষের তাঁর এবং বেদান্তের প্রতি যথাক্রমে অনুরাগ এবং অনুসন্ধিৎসা থেকে দেখতে পাই), তিনি কেবল গুটিকতক ভক্তকে address করবেন, এও কি সম্ভব? ভুলে গেলে চলবে না যে যে ঠাকুর একদিন সমাধিভঙ্গ হওয়ার পর বলেছিলেন যে তিনি দেখলেন অনেক দূরের দেশে কিছু সাদা সাদা মানুষ তাঁর ছবিকে পুজো করছে, সেই তিনি কি নিজেকে কেবল একটি বাগানেই আবদ্ধ রাখবেন? হয় কখনো? এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বিষয় হলো কাল অর্থাৎ সময়। শ্রীরামকৃষ্ণ দেশ কালের অতীত, তিনি ত্রিগুনাতীত, অনন্তের messenger, জগৎগুরু। তিনি সমস্ত মানুষকে আলো দেখাতে এসেছেন, ফলে তাঁর কথাগুলো কখনোই একটি বিশেষ কালখণ্ডে সীমিত নয়। তাই ওনার মুখে 'তোমাদের' শুধুমাত্র বর্তমানে restricted নয়, তা ভবিষ্যতের সমস্ত প্রজন্মকেও address করে। মোদ্দা কথা, এই 'তোমাদের' মানে সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এবং তাঁর সময়ের সমস্ত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বটে, যার মধ্যে আমি আপনি সবাই পড়ি।


দ্বিতীয় শব্দটি হলো "চৈতন্য"। এই শব্দটি বেশ মজার। সাধারণত এর তিন রকমের মানে হয়, ১ হুঁশ, সংজ্ঞা, বাহ্যজ্ঞান (আঘাত পেয়ে চৈতন্য হারাল); ২ বোধ, চেতনা, অনুভূতি (কবে আর তোমার চৈতন্য হবে?); ৩ টিকি। কিন্তু হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর iconic বঙ্গীয় শব্দকোষে চৈতন্যের অর্থ করেছেন, ১ চেতনভাব, চেতনা, জ্ঞান, বুদ্ধি; ২ (বেদান্তে) চিৎস্বরূপ পরমাত্মা; ৩ (ন্যায়ে) আত্মরূপ চেতনা; ৪ প্রকৃতি। এই প্রত্যেকটি মানে যদি আমরা contextually ভাবি, তাহলে ন্যায়শাস্ত্রের মানেটিই বোধহয় এখানে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী, 'চৈতন্য' অর্থাৎ সেই জ্ঞান বা 'আত্মরূপ চেতনা'র উন্মেষ ঘটায়, যাকে শঙ্কর বলেছিলেন 'আত্মবোধ'। কি সম্পর্কে চেতনা? না প্রত্যেক মানুষের অন্তরে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম বাস করেন এবং সেই বোধ জাগলে সে তার আত্মপরিচয় উপলব্ধি করে, যাকে বেদান্তশাস্ত্রে মহাবাক্য হিসেবে 'অহম ব্রহ্মাস্মি' (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌, যজুর্বেদ, ১.৪.১০) বা 'অয়ং আত্মা ব্রহ্ম' (মাণ্ডুক্য উপনিষদ্‌, অথর্ববেদ, ১।২), 'আমিই ব্রহ্ম' বলা হয়েছে।


এরপর আসি শেষ শব্দটিতে, "হোক"। 'হবে' নয় কিন্তু, 'হোক'। অর্থাৎ ভবিষ্যৎবাণী নয়, ইচ্ছার প্রকাশ বা আশীর্বাদ। উনি ওই জায়গায় একবার 'হবে' বললেই কেল্লাফতে হয়ে যেত। কাউকে আলাদা করে আর কোনো চেষ্টাই করতে হতো না, আত্মবোধ জাগরণের ভার উনি ওঁর নিজের ওপরই নিয়ে নিতেন, কিছু না করলেও সবাই তরে যেতো, তা সে জন্ম জন্ম ধরে যত খারাপ কর্মফলই জড়ো করে থাকুক না কেন - মুড়ি মিছড়ি সব একদর হয়ে যেত। তাই সেটা কিন্তু বললেন না, বললেন 'হোক' - মানে 'চেষ্টাটি তোমাকেই করতে হবে, কিন্তু করলে যে নিশ্চিত ফল পাবে, সেই আশীর্বাদ আমি তোমায় করলাম'। একটি কথা কম নয়, একটি কথাও বেশি নয়, - একেবারে precise, to the point, unambiguous, সোজাসাপ্টা। এবারে প্রশ্ন উঠতেই পারে, যদি আমি চেষ্টা না করি তাহলে কি আমার চৈতন্য হবেনা? এখানেই আসল catch। যেহেতু এটি একজন অবতার পুরুষের আশীর্বাদ, পুরুষ-প্রকৃতি যতই মায়ার খেলা খেলুন না কেন, কারো সাধ্য নেই যে তা বিফলে যায়। ফলে this is a statement of fact, not just of hope - আত্মোপলব্ধির চেষ্টা করিয়েই ছাড়বে। প্রারব্ধ আর কর্মফলের ওপর নির্ভর করে হয়তো কারো কয়েকটি বেশি জন্ম লাগবে, কারো হয়তো কিছু কম, কিন্তু প্রত্যেক মানুষের ভেতর একদিন না একদিন সেই পরমাত্মার আলোর উন্মেষ ঘটবেই, কল্পতরুরূপী গরিব বামুনের কথা কখনো মিথ্যা হতে পারেনা।

Thursday, December 30, 2021

মায়া ও মন

 মায়ার আক্ষরিক অর্থ বিভ্রম বা যাদু। ব্রহ্ম মায়া সৃষ্টি করেছেন নির্গুণ থেকে সগুন হয়ে সৃষ্টির মজা উপভোগ করার উদ্দেশ্যে। তারপর মায়া এই মহাজাগতিক বিভ্রম সৃষ্টি করেছেন - যেন বিশ্বব্রহ্মান্ড সব সত্যিকারের অর্থাৎ নিত্য, indestructible - তবে খেলুড়েরা কেউ এই মায়ার জগৎকে অনুধাবনই না করতে পারলে ব্রহ্মের আর মজা করা হলো কই? সেইসূত্রেই মানুষের মন তৈরি করেছেন তিনি। মন মায়ার এক অনন্য এবং অনবদ্য সৃষ্টি যা apparent বাস্তবের ভেতরেও আরো আরো apparent বাস্তব তৈরি করে একেবারে ভড়কে দিতে পারে - সেটা কখনো ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে, কখনো বা জাগ্রত অবস্থায় কল্পনায়।


মানুষের মনের কি অসীম ক্ষমতা ভাবুন, একবার ঘুমালেই হলো, চোখের নিমেষে একটা গোটা virtual world তৈরি করে ফেলে তাতে একেবারে বাস্তবের মতন সব অনুভূতি, সব অভিজ্ঞতাকে নিখুঁতভাবে recreate করে দেয় - এত যে মানুষের বোধ, বুদ্ধি, বিচার - সেইসময় সব ফেল! আবার এই মনই মনে মনে নানারকম তথ্য proccess করে প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনার চেতনায় plan A plan B plan C ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে আর বুদ্ধি আর বিবেকের সাথে মিটিং করে স্থির করে দেয় কোন পরিস্থিতিতে কখন ঠিক কোন কাজটা করণীয়। সামনে দেখছি কাঠের টেবিল, সেটা আলো হয়ে চোখ দিয়ে ঢুকে তড়িৎ তরঙ্গ হয়ে ব্রেনে গিয়ে টোকা মারছে আর তারপর সেই তথ্যকে process করে মন বলছে এর ওপর পা তুলে দিয়ে আরাম করে বোস আবার বুদ্ধি মনকে বলছে না, এর ওপর বই আছে, মা সরস্বতী, ওখানে পা দেওয়া উচিত নয় - তখন মন সেই উপদেশ মেনে নিয়ে নিজের আগের command withdraw করছে। 


শরীর কিন্তু তাই তাই করে চলেছে যা মন তাকে বলছে - একবার পা দুটি এগিয়ে দিয়েই মাঝপথে গুটিয়ে নিচ্ছে - কি মজা, তাই না? তাহলে মোদ্দা কথা কি দাঁড়ালো? আমাদের এই 'বাস্তব' দৈহিক অস্তিত্বের একটি মূল বিন্দু হলো শরীরের boss-রূপী মন। আর মনের boss বুদ্ধি, তার ওপর বুদ্ধির boss - 'আমি'। সত্যিকারের আমি। হয় মন বুদ্ধি - এরা আমায় control করবে অথবা আমি এদের control করবো - তার ওপরে নির্ভর করছে how I shall be able to utilise this human lifetime. কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সংসার চালানার জন্য domestic help এর ওপর নির্ভরশীল আর কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সত্যিকারের কর্তা - সংসার তাঁদের পরিচালনার ওপর নির্ভরশীল, including all subordinates. 


তাই এই 'আমি'টা যে ঠিক কে, সে কেমন, এটা define করা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। Clearly, 'আমি' কারো subservient নই নাহলে আমার শরীর, আমার মন, আমার বুদ্ধি ইত্যাদি বলা হতো না, উল্টে আমি তাদের, এমনটা বলা হতো। প্রতিদিন যেহেতু বাস্তবে দেখছি শরীর মনের instruction-এর ওপর নির্ভরশীল আর মন তার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বোধ বুদ্ধি বিবেক ইত্যাদির রায়ের ওপর নির্ভরশীল, আর ওগুলি আবার আমার ভাবের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু আমিই হলাম আসল প্রভু। তাহলে বুদ্ধি কেমনভাবে চলবে - না আমি যেভাবে চালাবো - কুবুদ্ধি হলে জগতের ক্ষতি হবে আর সুবুদ্ধি হলে উপকার হবে। জগৎ মানে কি, না বিভিন্ন আধারে মায়ার বিভিন্ন illusory প্রকাশ। যেমন বিভিন্ন পুকুর থেকে শুরু করে প্রতিটি নদী নালা খাল বিল ডোবায় প্রতিদিন সেই একই সূর্য্যের প্রতিবিম্ব দেখি, যেগুলোর যে কোনোটাতে জল শুকিয়ে গেলেই সূর্য্যদেব ভোজবাজির মতন সেটি থেকে গায়েব হয়ে যান।


এ কোন মায়া? যে মায়ার প্রভাবে আমি যেন আসল আমি নই - জীবরূপী। এই 'না-আমি'র এক নিজস্ব অহঙ্কার তৈরি হয় আর প্রভু হওয়া স্বত্তেও কখনো নিজেকে বুদ্ধি ভেবে ভ্রমিত হই, কখনো মন ভেবে, আবার কখনো বা শরীর। আমি তাহলে আসলে কি? আমি সেই অনন্ত অসীম অনাদি আনন্দময় অবর্ণনীয় সত্যস্বত্তা - purety personified - pure existence, pure consciousness, pure bliss - সৎ চিৎ আনন্দ - সচ্চিদানন্দ - ব্রহ্ম। এই পুরো মায়ার জগৎটাই যেহেতু আমার existential আনন্দ দিয়ে আমারই আনন্দবর্ধনের জন্য তৈরি, আমি যেহেতু আমারই প্রকাশের বুদ্ধিকে অহঙ্কার দিয়ে ভ্রমিত করে তার মনকে নিয়ে ছেলেখেলা করা দেখে আনন্দ পাই, আবার সেই মন যখন আমারই দ্বারা প্রেরিত অবতার এবং সদগুরুর tutorial-এ তালিম পেয়ে আমার লুকোচুরি খেলাটা ধরে ফেলে সমস্ত proccessed information বুদ্ধির সামনে তুলে ধরে তাকে চমকে দেয় আর বুদ্ধি দৌড়ে এসে আমাকে ছুঁয়ে বলে 'আব্বুলিশ', তখনও আমারই খেলা জেতার ultimate আনন্দ হয়। 


তাই প্রতিটি জীবের আনন্দময় কোষের ভেতর আমার বাস, তাদের সূক্ষ্ম শরীর আর কারণ শরীরের সমস্ত লম্ফঝম্ফের আমি দ্রষ্টা, অলক্ষ্যে থেকে identity গুলিয়ে দিয়ে মজা আমিই দেখি আর স্বরূপ ধরা পড়ে গেলে আমিই চরম উপভোগ করি। আমি তো ধরা দিতেই চাই - ওটাই তো খেলার ultimate objective, কিন্তু আত্মবোধের খেলাটা খেলতে চাইতে হবে তো! 


আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে

দেখতে আমি পাই নি,

তোমায় দেখতে আমি পাই নি।

বাহির-পানে চোখ মেলেছি,     

আমার হৃদয়-পানে চাই নি ॥

আমার সকল ভালোবাসায়    

সকল আঘাত সকল আশায়

তুমি ছিলে আমার কাছে, আমি তোমার কাছে যাই নি ॥

তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়--

আনন্দে তাই ভুলেছিলেম, কেটেছে দিন হেলায়।

গোপন রহি গভীর প্রাণে         

আমার দুঃখসুখের গানে সুর দিয়েছ তুমি, 

আমি তোমার গান তো গাই নি ॥

Wednesday, November 10, 2021

ব্রাহ্মমুহূর্তে জপধ্যান

 আজ পাড়ায় সূর্যউপাসক পুণ্যার্থীরা ব্রাহ্মমুহূর্তে বিকট জোরে পটকা ফাটিয়ে ফাটিয়ে এত বিরক্ত করলো যে বলবার নয়। আসলে দোষ এদের নয়, দোষ শিক্ষার। ব্রাহ্মমূহুর্ত বা সূর্যোদয়ের আগে রাত্রির শেষ এক চতুর্থাংশ সময়ে "ব্রহ্মন" বা সৃষ্টিকর্তার নিজস্ব সময়। ওই সময়ে সাধনা করলে নিজেকে তাঁর ইচ্ছে মতো গড়ে তোলা সম্ভব হয়। তাই প্রতিদিন রাত ৩.৩০-৫.৩০ পর্যন্ত জপ-ধ্যানের সবচেয়ে উপযুক্ত কালখন্ড বলে ঋষিরা জানিয়েছেন। অষ্টপ্রহরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এই বিশেষ সময়ে অবশ্যই মন সবচেয়ে বেশি শান্ত থাকে আর একাগ্র হয়ে ধ্যান করলে কুলকুন্ডলিনীদেবীর জাগরণ বোধহয় কিছুটা সহজতর হয়।  


শ্রীরামকৃষ্ণদেব নিজে নহবতে শ্রীশ্রীমা ও ভাইঝি লক্ষ্মীমণিদেবীসহ দক্ষিনেশ্বরে রাত্রিবাসরত তাঁর শিষ্যদের প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতেন। লক্ষ্মীদেবী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, 'ঠাকুরের  তো রাত্তিরে বেশি ঘুমই হতো না। প্রায় রাত তিনটেয় তিনি ঝাউতলায় শৌচে যেতেন। যাবার সময় নহবতের পাশে এসে আমায় ডাকতেন : "ও লক্ষ্মী, ওঠরে ওঠ। তোর খুড়িকে তোলরে। আর কতো ঘুমুবি? রাত পোহাতে চললো। গঙ্গাজল মুখে দিয়ে মার নাম কর, ধ্যান-জপ আরম্ভ করে দে।"... সাড়া না পেলে বা আমরা উঠিনি মনে হলে তিনি দরজার নিচে দিয়ে জল ঢেলে দিতেন। সব ভিজে যাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি আমাদের উঠে পড়তে হতো।' 


ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে প্রথম প্রথম এলার্মের সাহায্য লাগলেও পরে বডিক্লক নিজেই এই প্রাত্যহিক রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক সময় আপনাআপনিই ঘুম ভেঙে যায়, আর আলাদা করে ভোরে ওঠার চেষ্টা করতে হয়না। এই সময়টা কিন্তু exclusively আমার সময়, একান্তই আমার। এই সময় বাহ্যিক কোনো কিছুর সাথে আমি সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কহীন। বাহ্যিক অর্থে ভৌতিক। অবশ্যই ধ্যানে আমার ইষ্টদেব তাঁর মর্তলীলার রূপ ধরেই আসবেন, কিন্তু সেটা বাহ্যিক নয়। আসলে এই সময় যেহেতু মন স্বভাবতই অন্তর্মুখী থাকে, তাই সাধারণত দেহের চাহিদাগুলোকে অপ্রয়োজনীয় বোধ হয় - ফলে ধ্যান ভালো জমে। আবার বাসনাকে ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যেও প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে নিজের মনকে গুটিয়ে একজায়গায় করে ফেলার অভ্যেসটি খুব দরকার। অবশ্য এসব কথা তাঁদের জন্য যাঁরা আত্মবোধের পথযাত্রী, সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।


কথামৃতে দেখছি ২৪শে অগস্ট ১৮৮২ সালে ঠাকুর মাষ্টারমশাইকে বলছেন :

শ্রীরামকৃষ্ণদেব — অন্তরে কি আছে জানবার জন্য একটু সাধন চাই।

মাস্টারমশাই — সাধন কি বরাবর করতে হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণদেব — না, প্রথমটা একটু উঠে পড়ে লাগতে হয়। তারপর আর বেশি পরিশ্রম করতে হবে না। যতক্ষণ ঢেউ, ঝড়, তুফান আর বাঁকের কাছ দিয়ে যেতে হয়, ততক্ষণ মাঝির দাঁড়িয়ে হাল ধরতে হয়, — সেইটুকু পার হয়ে গেলে আর না। যদি বাঁক পার হল আর অনুকুল হাওয়া বইল, তখন মাঝি আরাম করে বসে, হালে হাতটা ঠেকিয়ে রাখে, — তারপর পাল টাঙাবার বন্দোবস্ত করে তামাক সাজতে বসে। কামিনী-কাঞ্চনের ঝড় তুফানগুলো কাটিয়ে গেলে তখন শান্তি।


আসলে সবটাই অভ্যেসের ব্যাপার, নিজের চেষ্টার সত্যিই কোনো alternative নেই। পরম পূজনীয় রাজা মহারাজ বলছেন, "প্রত্যহ কিছু-কিছু ধ্যান করবে। কোন দিন বাদ দেবে না। মন বালকের ন্যায় চঞ্চল, ক্রমাগত ছুটাছুটি করে। উহাকে বারবার টেনে এনে ইষ্টের ধ্যানে মগ্ন করবে। এইরূপ দুই-তিন বৎসর করলেই দেখবে যে,  প্রাণে অনির্বচনীয় আনন্দ আসছে, মনও স্থির হচ্ছে"। তবে সব শেষে মায়ের কৃপা ছাড়া কিছুই পাওয়ার নয়, ঐখানেই ঝুঁটিটি ধরা আছে - যেমন চাইবেন তেমন হবে। প্রতিদিন জপের আগে আর ফল অর্পণের পর তাই মহামায়ীর কৃপা প্রার্থনা ভীষণ ভীষণ জরুরি।


ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে কয়েকটি অভ্যেস করলে মন একাগ্র করতে সুবিধা হয়।

১. প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল এবং সন্ধ্যায় ভজন বা ঈশ্বরীয় কথা শোনা। এখন ইউটিউবের দৌলতে এসব খুবই সহজলভ্য। কেবল কিছুক্ষন সবার কাছ থেকে সরে গিয়ে ঘরের একটা কোনে me time আর একটা হেডফোন - ব্যাস।

২. প্রতিদিন তেরো ঘন্টার উপবাস - সন্ধ্যে ৭.০০ থেকে পরদিন সকাল ৮.০০ পর্য্যন্ত। নির্জলা নয় কিন্তু।

৩. প্রতিদিন সন্ধ্যে ৭.০০টার মধ্যে একটু মুড়ি-বাদাম বা দুটো কলা বা শুকনো চিঁড়েভাজা আর সঙ্গে আধ লিটার গরুর দুধ - এটাই রাতের খাবার - এতে শরীর ঝরঝরে থাকে আর জপ-ধ্যানে সুবিধে হয়।

৪. কোনো বিবাদে না জড়ানো, কারো সঙ্গে তর্ক না করা, কোনকিছু পছন্দ না হলে সেখান থেকে চুপচাপ সরে আসা - মোদ্দা কথা মন যাতে agitated হবে এবং পরে ধ্যানে মন বসাতে কষ্ট হবে, সেসব করে সময় নষ্ট না করা। 

৫. জাগতিক বিষয়ে যতদূর সম্ভব নির্লিপ্ত থাকা, সামাজিকতার ব্যাপারে involved না হওয়া - তাতে কে কি ভাববেন বলে মাথা না ঘামিয়ে কি কি করলে মায়ের কৃপালাভ হবে - গোটা মনের orientationটা সংসারের যাঁতাকলে থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে সেইদিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া।

৬. বিষয়ী লোকের সঙ্গ যতদূর সম্ভব পরিহার করে চলা এবং যে যে সঙ্গে বা পরিবেশে মন নিচে নেমে যায়, পার্থিব বাসনা জেগে ওঠে, সেসব থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকা। 

৭. There is nothing to be apologetic about being a seeker. If others don't understand that goal, no sweat. Sometimes ignoring them is alright.

৮. নিয়মিত দেবদর্শন, তীর্থভ্রমণ, সন্ন্যাসীর সঙ্গ, ধর্মালোচনা, সাত্ত্বিক আহার, সাত্ত্বিক জীবন, gradual withdrawal from worldly wants and engagements আর শুদ্ধচিন্তা - একটা বয়সের পর এটাই routine হওয়া দরকার।


বাকি, মায়ের ইচ্ছা। আমরা যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী।

Sunday, October 31, 2021

হিন্দুর কেন শত্রুবোধ থাকবে?

আজকাল প্রযুক্তির যুগে যা শুনতে চাইনা, তাও কিভাবে যেন ঠিক কানে চুঁইয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কবে যেন শোনা গেল একজন বিদগ্ধজন একটি চমৎকার বক্তৃতার শেষে বলছেন যে আজকে হিন্দুদের 'শত্রুবোধ' থাকা উচিত। ভদ্রলোক কি অর্থে এই কথাটি বলেছেন আমি তার মধ্যে ঢুকছি না কিন্তু কাকে আমরা শত্রু বলছি, সবার আগে বোধহয় সেই বোধটা থাকা দরকার - তারপর প্রয়োজনীয়তা বা অপ্রয়োজনীয়তার প্রশ্ন আসে। ইংরেজিতে কয়েকটি উৎকৃষ্ট শব্দ আছে, যার মধ্যে কোনটা যে ঠিক ঠিক শত্রুত্বকে ব্যাখ্যা করে, স্পষ্ট করে বুঝতে পারলে বড় সুবিধা হতো। Enemy, Opponent, Adversary, Foe না Antagonist - কে আসল শত্রু কারণ সবই তো কেবল ভিন্ন ভিন্ন স্তরের অ-মিত্রতা? 

বাংলা অভিধানেও শত্রুর অর্থ হিসেবে দুটি আলাদা পর্যায়ের অ-মিত্রতার ব্যাখ্যা আছে - ১. মনে মনে বা প্রকাশ্যে ঘৃণা করে কিংবা ক্ষতিসাধন করে এমন ব্যক্তি; অরি, বৈরী; ২. প্রতিপক্ষ, বিপক্ষ। আবার আমাদের প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে একটু অন্যরকম শত্রু দেখছি - তার কয়েকটি negative, আবার কয়েকটি positive ও বটে। ওতে যেমন বাতশত্রু, পিত্তশত্রু, কাফশত্রু ইত্যাদি আছে, তেমনিই ঘৃতশত্রু, দুগ্ধশত্রুও আছে আবার বুদ্ধিশত্রু, জ্ঞানশত্রু আর আত্মশত্রুও আছে। বিষয়টা তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় যে শত্রুতা একটি দৈহিক বা মানসিক অবস্থান বিশেষ, যাকে opportunityতে বদলে দেওয়ার উপায় খোঁজাই হলো সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি।

আবার অন্যদিকে ঋগ্বেদে প্রথম যেখানে শত্রুতার উল্লেখ পাচ্ছি তা বৈরী মানসিকতা সংক্রান্ত, সরাসরি বৈরীতা সংক্রান্ত নয়। ঋষি প্রশ্ন করেছেন,

ज्योक्चि॒दत्र॑ तस्थि॒वांसो॑ अक्रञ्छत्रूय॒तामध॑रा॒ वेद॑नाकः ॥ ১.৩৩.১৫

jyok cid atra tasthivāṃso akrañ chatrūyatām adharā vedanākaḥ ||

ইংরেজিতে: “do you inflict sharp pains on those of hostile minds, who have long stood against us.”

এক্ষেত্রে এমন একজনকে আঘাত করার কথা বলা হচ্ছে যিনি বৈরী মানসিকতার বশবর্তী হয়ে দীর্ঘদিন বিরুদ্ধতা করে আসছেন। অর্থাৎ যিনি একত্রে মানসিকরূপে ও সামাজিকরূপে আমার বিরোধী এবং যাঁর কর্মকান্ডের ফলে আমি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত - তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, প্রয়োজনে প্রত্যাঘাতও করা যায়, কিন্তু সবটাই অনেকদিন সহ্য করার পর এবং ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে। উল্লেখ্য যে এখানে গোটা প্রতিক্রিয়াটাই কিন্তু retrospective ও reciprocal - পূর্বনির্ধারিত বা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, অর্থাৎ শত্রুবোধজাত নয় - কর্তব্যজাত, প্রতিকারগত, deterrent।

প্রাচীন ভারতে মর্য্যাদা-আধারিত সামাজিক সীমারেখার বিশেষ সন্মান ছিল এবং এই মর্য্যাদা নির্ধারিত হতো ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত ধর্মবোধের দ্বারা। সমস্ত সম্পর্কের ভিত্তি ছিল এই স্বতন্ত্রতার সীমারেখা আর তা লঙ্ঘন করা পাপ বলেই বিবেচিত হতো। শ্রীরামচন্দ্রের বা শ্রীকৃষ্ণের জীবন দেখলেই আমরা বুঝতে পারি যে কিভাবে ধর্মভিত্তিক দায়িত্ববোধ তাঁদের সমস্ত নির্ণয়কে আলোকিত করতো। সাথে সাথে এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিরোধিতা কখনোই শক্তির প্রমাণ নয়। শক্তিমান তিনি, যিনি সহনশীল, সহ্য করতে পারেন। সাধারণত অপরে সীমারেখা অতিক্রম করলে ক্রোধ উৎপন্ন হয় আর ক্রোধ থেকেই শত্রুবোধের জন্ম হয়। ক্রোধ বুদ্ধিকে বিচলিত করে তোলে। আর বুদ্ধিবিভ্রাট মানেই পতন। যখন হৃদয় থেকে ক্রোধ দূর হয়ে যায়, তখনই সহনশক্তি ধর্মের শক্তিতে পরিণত হয়। ক্রোধ থেকে প্রতিশোধের জন্ম হয় আর ধর্ম থেকে ন্যায়ের। এই দুই অবতারের জীবনে শুধুই ন্যায়, মর্য্যাদারক্ষা আর কর্তব্যবোধ, কোথাও কোনো ক্রোধও নেই, শত্রুবোধও নেই। এটা শিক্ষণীয়।

আসলে মানুষের সত্যিকারের শত্রুকে চিহ্নিত করার উপায় শ্রীকৃষ্ণ গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন:

উদ্ধরেদাত্মনাত্মনং নাত্মনমবসাদয়েৎ। 

আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।।৫।।

অনুবাদঃ মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্বারা আত্মাকে  অধঃপতিত করা কখনই উচিত নয়। মনই জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে। 

বন্ধুরাত্মনস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ। 

অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ।।৬।।

অনুবাদঃ যিনি তাঁর মনকে জয় করেছেন, তাঁর মন তাঁর পরম বন্ধু কিন্তু ‍যিনি তা করতে অক্ষম, তাঁর মনই তাঁর পরম শত্রু। 


আসল জীবনটা তো সরলরেখায় চলে না, ফলে সামাজিক শত্রুতারও বিভিন্নতা আছে, সময় বিশেষে যার স্তরান্তরণও ঘটে, বাস্তবিকই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। মতান্তর থেকে মনান্তর, মনান্তর থেকে ক্রোধ, ক্রোধ থেকে বিদ্বেষ, বিদ্বেষ থেকে শত্রুভাবাপন্নতা, এবং শত্রুভাব থেকে অনাত্মীয়তা, অসামাজিকতা, অসহিষ্ণুতা এবং দৌরাত্ম - এটাই যেন ইদানিং অহিন্দুসুলভ অসামাজিক যাপনের অঙ্গ হয়ে পড়েছে। বস্তুতঃ, মতান্তর যদি শত্রুতার ভিত্তি হয় তাহলে সামাজিক ভিন্নতা এবং বহুমাত্রিকতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে এবং সমাজে মানুষের স্বাধীন চিন্তার কোনো স্থান থাকে না, যা হিন্দুদের সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতির একেবারে বিপরীত। আমাদের প্রত্যেকের ভেবে দেখা উচিত ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য শত্রুবোধের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে নাকি ধর্মবোধ আর নিজের সমাজ-সংস্কৃতিকে রক্ষা করার প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা ও উপলব্ধিসঞ্জাত কর্তব্যবোধই যথেষ্ট।


আমাদের ভেবে দেখা দরকার যে ভবিষ্যতে আমরা আদৌ প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতির প্রকৃত ধারক এবং বাহকরূপে এক স্থিতপ্রজ্ঞ বহুমাত্রিক modern achiever race হিসেবে চিহ্নিত হতে চাই নাকি পন্থতান্ত্রিকদের মতন ভিন্নতাবিরোধী কুপমণ্ডূক জঙ্গি মানসিকতাসম্পন্ন এক ঘৃণ্য জনগোষ্ঠী হিসেবে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করতে চাই। চিরায়ত ভারত এই অনিত্য শত্রুবোধ-মিত্রবোধের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে জীবনের আসল মানে খুঁজে পেয়েছিল। সেটাই শাশ্বত, বাকিটা কেবল দুপয়সার সস্তা রাজনীতি।

Monday, October 25, 2021

কর্পোরেট বার্নআউট থেকে মুক্তির উপায়

 চোখের সামনে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে কর্পোরেট বার্নআউটের বীভৎস রূপটি দেখছি আর ভাবছি মানুষের মনে জাগতিক চাহিদা সম্পর্কে একটু awareness জগলেই তারা আখেরে কি পাওয়ার জন্য 'চাই চাই' করে দিকবিদিকজ্ঞানশূন্যের মতন আচরণ করতে শুরু করে? এত কষ্ট করে চোখকান বন্ধ করে পড়াশুনা করা, এত compitition এর মধ্যে দিয়ে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করা, তারপর কর্পোরেট হানিমুন শেষ হয়ে গেলেই গুচ্ছের বিরক্তি, অশান্তি, ভয়, বেদনা, anxity, stress নিয়ে আধপাগল হয়ে যাওয়া- আখেরে কিসের জন্য? 


জীবনধারণের জন্য রোজগার চাই, অবশ্যই চাই - সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু জীবনের মূল উদ্দেশ্যটাই যদি রোজগারের হাঁড়িকাঠে বলি হয়ে যায়, তাহলে সেই প্রাণঘাতি রোজগারের প্রয়োজন কোথায়? কর্পোরেটদের যাঁতাকলে পিষে পিষে - এটাকেই সারা জীবনের ভবিষৎ বলে ধরে নিয়ে জীবনের প্রতিই কি মারাত্মক bitterness জন্মায় - অবিশ্বাস্য! সমস্ত সময় মন খারাপ, সমস্ত সময় অপ্রাপ্তি, সর্বক্ষণ দুঃশ্চিন্তা, কিছুতেই শান্ত না হতে পারা, কোনোকিছুই নিরবিচ্ছিন্নভাবে সম্পুর্নরূপে উপভোগ করতে না পারা - এই জন্যই কি ঈশ্বর মানুষের দেহ-মন দিয়েছেন?


এরা কেউ আশেপাশে থাকলে অজান্তেই একটা অশান্তির বলয় সৃষ্টি হয়। এদের আচার-ব্যবহারে কিছু telltale signs থাকে যেমন কথায় কথায় বিরক্তি প্রকাশ করা, ঝাঁঝিয়ে উঠে কথা বলা, যেখানে সম্ভব oneupmanship, একটু নরম মাটি পেলেই ভেতরের যন্ত্রণার ঠান্ডা বা গরম ক্রোধরূপে বহিঃপ্রকাশ, সর্বক্ষণ স্মার্টফোনে আর ল্যাপটপে ডুবে থাকা, মন সম্পূর্ণরূপে নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, জাগতিক খেলনায় ক্ষনিকের আনন্দ খোঁজা আর পয়সার জন্য সর্বদা লালায়িত - যেন অনেক বেশি পয়সা জমানো থাকলেই মন নিশ্চিন্ত থাকবে আর সমস্ত দুঃখকষ্টের অবসান হবে! আবার মজার ব্যাপার হলো, হাতে টাকা থাকা স্বত্তেও এরা ফস করে যেখানে সেখানে ক্রেডিট কার্ড বের করেন কারণ ক্রেডিট হিস্ট্রি তৈরি করা দরকার - ঋণী হওয়ার পথ সুগম করার জন্য! হায়রে! 


আসলে এদের দোষ নেই - দুনিয়াটাই ভুল ছন্দে চলছে। ছোটবেলা থেকে মানুষ শিখছে কিভাবে অন্যের দুঃখে সুখী হতে হয়, কিভাবে অনিত্যের নিরিখে নিজের মূল্যায়ন করতে হয়, কিভাবে অন্দরের দ্বার বন্ধ করে শুধুমাত্র বাইরে সুখের চাবিকাঠির জন্য হাতড়ে মরতে হয়। লেখাপড়ার মধ্যে ইতিহাস, ভূগোল, রসায়ন, পদার্থ সবকিছু আছে, কেবল উপলব্ধির অঙ্কটি নেই। শিক্ষার পুরো বৃত্তটাই জাগতিক - সেই জগৎ যা নতুন শরীর ধারণ করলে আর চেনার উপায় নেই - সেই ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, সম্পত্তি, সোনাদানা, পরিবার পরিজন যা প্রতিদিন গভীর ঘুমে গায়েব হয়ে যায় আর চোখ খুললেই ফিরে আসে কিন্তু বর্তমান শরীর parmanently চোখ বোঝার পর parmanently গায়েব হয়ে যায় - নতুন শরীর নিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও যাকে আর চেনা যায়না - এর জন্যই জীবনপাতের কুশিক্ষা এবং যুক্তিহীন যাপন।


বাবা মা হিসেবে আমাদের ভেবে দেখা দরকার কি ধরণের সংস্কার আমরা আমাদের সন্তানদের দিচ্ছি - তারা কিন্তু আমাদের দেখেই শিখছে। যা নিয়ে তারা জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে নামছে তার ভেতর চক্রবুহ্য থেকে বেরোনোর শিক্ষাও আছে তো? আমরা আমাদের নিজেদের সারাজীবনের অকারণ পাগলামি তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি না তো? আমরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মচিন্তন আর আত্মবোধ শেখাচ্ছি তো? তবে সবার আগে, আমরা নিজেরা ইঁদুর দৌড়ের অসারতা উপলব্ধি করে তার থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছি তো? কাজ তো করতেই হবে, জরুরিও বটে। কিন্তু সেই কাজের উদ্দেশ্যটি কি আমরা ছেলেমেয়েদের শিখিয়েছি? শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী খুব সহজ করে বুঝিয়েছেন, “কাজ করা চাই বইকি; কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন কেটে যায়, তবে নিষ্কাম ভাব আসে। একদন্ডও কাজ ছেড়ে থাকা উচিত নয়”। কিন্তু সেই কর্ম নিষ্কাম হতে হবে, বাসনা থাকলেই বিপদ। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলছেন, "যতক্ষন তোমার সঙ্গে বাসনা, ততক্ষণই ভাবনা আর এই ভাবনাই হল তোমার দুঃখ কষ্ট মোহ মায়ার কারণ.."। এই হলো লাখ কথার এক কথা।


প্রথম শিক্ষা হলো প্রেম - সার্বজনীন প্রেম। উদাহরণস্বরূপ, আমার ফুসফুস কি শুধুই আমার শরীরের ভেতরে, তার বাইরে নেই? ওই যে জানলা দিয়ে রাস্তার ধারের গাছটা দেখতে পাচ্ছি, সে কি আমার ফুসফুসের অন্য অংশটি নয়? সে যা ছাড়ছে সেটাই তো আমার প্রাণবায়ু - সেই অক্সিজেন দিয়েই তো আমার ফুসফুস কাজ করছে। আর আমি যা ছাড়ছি সেটা ওই গাছটির প্রাণবায়ু, তা দিয়ে সে বেঁচে আছে, আমার জন্য অক্সিজেন তৈরি করছে। তাহলে আমারই ফুসফুসের অন্য অংশটির ক্ষতি কি আমার ক্ষতি নয়? তারপর ধরুন তাতে যে পাখিরা বাসা বেঁধে আছে, তার ফুলের মধু খেতে যে মৌমাছিরা আসছে - তাদের মাধ্যমেই তো তার বীজ ছড়াচ্ছে, তার ফল ফলছে, আমার জন্য আরো প্রাণবায়ু তৈরি হচ্ছে - তারাও কি আমার অস্তিত্বের অংশ নয়, তাদের প্রত্যেকের প্রতি প্রেমও কি আমার আত্মপ্রেমেরই প্রকাশ নয়? শ্রীশ্রীমা বলছেন, “জগৎকে নিজের করে নিতে শেখো | কেউ পর না, জগৎ তোমার”। সর্বজনে প্রেম, সর্বভূতে প্রেম - এই অখিল ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি কণা আমারই extension, ফলে ভেতরে বাইরে সবই আমি আর সবই আমার - এটা হলো প্রথম শিক্ষা।


দ্বিতীয় শিক্ষা হলো মন ও মনের মধ্যে ক্রমাগত বুদবুদের মতন ভেসে ওঠা বাসনাদের নিয়ন্ত্রণ - যেটুকু প্রয়োজন শুধু সেটুকুই চাওয়া, তার ওপরে বাকি সব চাওয়া হলো চৌর্যবৃত্তি, অর্থাৎ অন্যের allocation এ ভাগ বসানো। বাসনা প্রসঙ্গে ঠাকুর বলছেন, "যার যেমন ভাব তার তেমনি লাভ; ভগবান্ কল্পতরু। তাঁর কাছে যে যা চায়, সে তাই পায়। গরীবের ছেলে লেখাপড়া শিখে হাইকোর্টের জজ হয়ে মনে করে, "আমি বেশ আছি।" ভগবানও তখন বলেন, "তুমি বেশ থাক।" তারপর যখন সে পেনশন নিয়ে ঘরে বসে, তখন সে বুঝতে পারে এ জীবনে কল্লুম কি? ভগবানও তখন বলেন, "তাই তো, তুমি কল্লে কি?"। আবার অন্য একজনকে বাসনাহীনতা সম্পর্কে বলছেন, "বাসনাহীন মন কেমন জান? যেন শুকনো দেশলাই - একবার ঘষলে দপ করে জ্বলে উঠে। আর ভিজে হলে ঘষতে ঘষতে কাঠি ভেঙ্গে গেলেও জ্বলে না। সেইমত সরল, সত্যনিষ্ঠ, নির্মল-স্বভাব লোককে একবার উপদেশ দিলেই ঈশ্বরানুরাগের উদয় হয়। বিষয়াসক্ত ব্যক্তিকে শত শতবার উপদেশ করলেও কিছু হয় না।" এই বাসনা নিয়ন্ত্রণ একমাত্র সবার প্রতি প্রেম থেকেই আসে অর্থাৎ 'আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেলে আমারই আত্মজর জন্য খাবার কম পড়ে যাবে, বেচারা অভুক্ত থাকবে' - এই একাত্মবোধটা থাকা খুব দরকার। এর থেকেই দয়াভাব আসে। শ্রীশ্রীমা বলছেন, “যে অল্পেতে তুষ্ট থাকে, তার কাছে এই পৃথিবীর সব কষ্ট সহজ হয়ে যায়”। আবার অন্য আরেকজনকে শ্রীশ্রীমা বলছেন, “ভগবান দর্শন বলো, ধ্যান বল, সবই মন। নিত্য ধ্যান করবে। কাঁচা মন কিনা? ধ্যান করতে করতে মন স্থির হয়ে যাবে। সর্বদা বিচার করবে। যে বস্তুতে মন যাচ্ছে তা অনিত্য চিন্তা করে ভগবানে মন সমর্পণ করবে”। এই হলো দ্বিতীয় শিক্ষা।


তৃতীয় শিক্ষা হলো মায়াকে বোঝা ও তাকে পাশ কাটিয়ে আত্মোপব্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়া। আসলে ঠাকুরের মতন সহজ করে বোঝানো মুশকিল, তাই এই প্রসঙ্গেও ঠাকুরের কথাই তুলে ধরা যাক, "জীবাত্মা-পরমাত্মার মধ্যে এক মায়া-আবরণ আছে। এই মায়া-আবরণ না সরে গেলে পরস্পরের সাক্ষাৎ হয় না। যেমন অগ্রে রাম, মধ্যে সীতা এবং পশ্চাতে লক্ষ্মণ। এস্থলে রাম পরমাত্মা ও লক্ষ্মণ জীবাত্মাস্বরূপ, মধ্যে জানকী মায়া-আবরণ হয়ে রয়েছেন। যতক্ষণ মা জানকী মধ্যে থাকেন, ততক্ষণ লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পান না। জানকী একটু সরে পাশ কাটালে তখন লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পান"। আবার অন্যত্র ঠাকুর বলছেন, "মায়া কাকে বলে জান? - বাপ, মা, ভাই, ভগ্নী, স্ত্রী, পুত্র, ভাগ্নে, ভাইপো, ভাইঝি - এই সব আত্মীয়দের প্রতি টান ও ভালবাসা; আর দয়া মানে - সর্বভূতে আমার হরি আছেন এই জেনে সকলকে সমান ভালবাসা"। কথায় বলে মায়ার সংসার বা সংসারের মায়া - দুটি যেন সমার্থক।


কথামৃত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংসার প্রসঙ্গে শ্রীমতি মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ব্লগে বড় ভালো লিখেছেন:

'সংসার। বড় মোহের আর বড় মায়ার জায়গা। মায়া নেই তো সংসারও নেই। মায়া থেকেই তো বহু। আর বহু থেকেই সংসার।

উপনিষদের আদি অনন্ত নিরাকার সত্তা যেদিন ইচ্ছে করেছিলেন—‘বহু স্যাম’, আমি বহু হব, প্রকৃতপক্ষে সেদিন থেকেই সংসারের শুরু।

মায়া জাগল তাঁর। যোগমায়া। আপন স্বরূপকেই ভিন্ন ভিন্ন রূপ দিতে শুরু করলেন।

তবে যোগমায়ায় যোগ আছে। ইচ্ছেমাত্র যোগে যুক্ত হতে পারেন। সমস্ত খণ্ড আবার এক বিরাট ‘আমি’তে লয় পেতে পারে।

অনন্তের সে সংসার বিদ্যার সংসার।

আর আমাদের?

সংসার মানে বহু তো বটেই। তবে শুধু জনে নয়, মনে বহু।

বাবা মা ভাই বোন স্বামী স্ত্রী ছেলে মেয়ে—মাথাগুন্তি এত বহু‘র সমাহারে সংসার আর একা থাকলে নেই, তা কিন্তু নয়।

সংসার আসলে মনে।

সংসার আসলে চিন্তায়।

যার যেমন প্রকৃতি, যার যেমন সঙ্গ, তার চিন্তাও সেই অনুযায়ী।'


চতুর্থ এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা হলো আত্মজ্ঞান। ঠাকুর বলছেন, "মানুষ আপনাকে চিনতে পারলে ভগবানকে চিনতে পারে। 'আমি কে' ভালরূপ বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, 'আমি' বলে কোন জিনিস নেই। হাত, পা, রক্ত, মাংস ইত্যাদি - এর কোনটা 'আমি'? যেমন প্যাঁজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কেবল খোসাই বেরোয়, সার কিছু থাকে না, সেইরূপ বিচার কল্লে 'আমি' বলে কিছুই পাইনে! শেষে যা থাকে, তাই আত্মা - চৈতন্য। 'আমার' 'আমিত্ব' দূর হলে ভগবান্ দেখা দেন"। আবার বলছেন, "যতক্ষণ সেথা সেথা (অর্থাৎ বাহিরে), ততক্ষণ অজ্ঞান; যখন হেথা হেথা (অন্তরের দিকে), তখন জ্ঞান। যার হেথায় আছে (অর্থাৎ অন্তরে ভাব আছে), তার সেথায়ও আছে (অর্থাৎ ভগবৎপদে স্থান আছে)"। 


কি দারুন কথা! একবার যদি বোঝা যায় যে আমি বলে আলাদা কিছু নেই, তখন কিসের ভেদাভেদ আর কিসের লোভ - সব দ্বন্ধ মিটে গিয়ে তো জীবনের অভিমুখটাই ঘুরে যাবে। এমন হলে কুলোক, কুচিন্তা ইত্যাদি আশেপাশে ভিড়তে পারেনা, তাদের মনমতো কিছু এখানে পাওয়া যায়না বলে। তার মানে কিন্তু কাজকম্ম ছেড়ে মুক্তকচ্ছ হয়ে 'শিবোহম শিবোহম' বলে চেঁচিয়ে বেড়ানো নয়। রামচন্দ্র নামক এক জটাজূটধারী ব্রহ্মচারী একদিন ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে দর্শন করতে এসেছিলেন। তিনি বসে অন্য কোন কথাবার্তা না বলে কেবল 'শিবোঽহম্' 'শিবোঽহম্' করতে লাগলেন। ঠাকুর খানিকক্ষণ চুপ ক'রে থেকে অবশেষে বল্লেন, "কেবল 'শিবোঽহম্' 'শিবোঽহম্' করলে কি হবে? যখন সেই সচ্চিদানন্দ শিবকে হৃদয়ে ধ্যান ক'রে তন্ময় হয়ে গিয়ে বোধে বোধ হয়, সেই অবস্থায় বলা চলে। তা ছাড়া শুধু মুখে 'শিবোঽহম্' বল্লে কি হবে? যতক্ষণ তা না হয়, ততক্ষণ সেব্য-সেবক-ভাবে থাকাই ভাল।" ঠাকুরের এইরূপ নানা উপদেশে ব্রহ্মচারীর চৈতন্য হল এবং তিনি নিজের ভ্রম বুঝতে পারলেন। যাবার সময় দেওয়ালের গায়ে লিখে রেখে গেলেন, "স্বামী-বাক্যে আজ হতে রামচন্দ্র ব্রহ্মচারী সেব্য-সেবক-ভাব প্রাপ্ত হল"। তাহলে সংসারে আনন্দে থাকার উপায় কি? 


এক ব্যক্তি ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, "সংসারে থেকে ঈশ্বর-উপাসনা কি সম্ভব?" পরমহংসদেব একটু হেসে বললেন, "ও দেশে দেখেছি, সব চিড়ে কোটে; একজন স্ত্রীলোক এক হাতে ঢেঁকির গড়ের ভেতর হাত দিয়ে নাড়ছে, আর এক হাতে ছেলে কোলে নিয়ে মাই খাওয়াচ্ছে, ওর ভেতর আবার খদ্দের আসছে, তার সঙ্গে হিসাব করছে - 'তোমার কাছে ওদিনের এত পাওনা আছে, আজকের এত দাম হল।' এই রকম সে সব কাজ করছে বটে, কিন্তু তার মন সর্বক্ষণ ঢেঁকির মুষলের দিকে আছে; সে জানে যে ঢেঁকিটি হাতে পড়ে গেলে হাতটি জন্মের মতো যাবে। সেইরূপ সংসারে থেকে সকল কাজ কর; কিন্তু মন রেখো তাঁর প্রতি। তাঁকে ছাড়লে সব অনর্থ ঘটবে"। শ্রীশ্রীমা এই একই কথা খুব সহজভাবে বোঝাচ্ছেন, "যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি আর তিনিই মা। দরকার নেই ফুল, চন্দন, ধূপ, বাতি,  উপাচারের। মাকে আপন করে পেতে শুধু মনটাকে দেও তাঁরে”। এর ওপরে আর কথা নেই, তা যিনি যতই কর্পোরেট হঞ্চ হন না কেন। মনটা কর্পোরেটকে নয়, নিজেকে দিলেই আসল কাজ হয়ে যাবে। বাইরে নিষ্কামভাবে কাজ করে যাওয়া আর মনটা নিজের ভেতরে ঘুরিয়ে দেওয়া - ব্যাস, সব অশান্তি, অপ্রাপ্তির শেষ।


আবার শ্রীমতি মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্লগের সূত্র ধরেই সকলের শান্তি কামনা করে শেষ করি:

'যার যেমন প্রকৃতি, যার যেমন সঙ্গ, তার চিন্তাও সেই অনুযায়ী।

কোনও একটিমাত্র চিন্তা নয়। চিন্তার স্রোত। তরঙ্গ।

সেই তরঙ্গ কোনও ব্যক্তি মানুষকে নানা কাজে প্রবৃত্ত করে।

তার জন্য তার আশপাশে কেউ আছে কি নেই, তাতে বিশেষ কিছু যায় আসে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ এর পরে যেমন বলবেন, তিন কুলে কেউ না থাকলেও মহামায়া একটা বেড়াল পুষিয়েও সংসার করান।

অর্থাৎ সংসারের মূল হল মনের প্রকৃতি।

এখন একবার জড়িয়ে গেলে জড়াতেই থাকে। তার কারণ আসক্তি। প্রতিটি কাজ বা চিন্তার সঙ্গে আমার আমিকে ওতপ্রোত যুক্ত করে ফেলি।

সেই আমি যত সঙ্কুচিত হয়, তাকে জড়িয়ে ধরা জালটা তত সমুদ্রের মতো অনন্ত হয়ে পড়ে।

এখন উপায়?

শ্রীরামকৃষ্ণ বলবেন, বড় মানুষের বাড়ির দাসীর মতো থাকতে হবে। সবই করা হচ্ছে অথচ অনাসক্ত ভাব। মনে জানে, এরা আমার নিজের কেউ নয়।

তবে নিজের কে?

সেই মাস্তুল। যাঁকে ধরলে সমুদ্রে ডোবার ভয় আর নেই।

মাস্টারমশাই চিনলেন ওই বারান্দাতেই। সংসার কী আর তার কর্ণধার কে।

এবার তাঁর অন্য আমি-র জাগরণ। সে আমি ভক্তের আমি।'

ওঁ শান্তি শান্তি শান্তিঃ।

Sunday, August 29, 2021

কাল আর যাপন

যেটুকু বুঝেছি, generally হিন্দু সভ্যতায় কালচক্র (time cycle) হলো প্রায় সব দর্শনেরই মধ্যবিন্দু। যেমন ছয়টি ঋতুই কালের নিয়মে একের পর এক নির্দিষ্ট cycle মেনে চলতে থাকে তেমনিই ঋত (Cosmic order), সত্য (Truth), ধর্ম (Universal Law) এবং ঋণ (Debts owed to ancestors, Rishis and nature) ওই একই প্রথায় একটি নির্দিষ্ট cycle মেনে চলতে থাকে। পূর্বপুরুষের প্রজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে, ধর্মের পথ ধরে, সত্যকে আশ্রয় করে পরমসত্যে লীন হয়ে যাওয়া একটা গোটা জন্মচক্রের পরিণতি। সেই জন্যই বারেবারে জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের cycle চলে আর সেইজন্যই ধর্মাশ্রয়ী সুকর্মের মাধ্যমে বাজে কর্মফল ক্ষয় করে করে শেষে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করার সুযোগ সবার আছে, ফলে eternal hell বা eternal heaven বলে আমাদের দর্শনে কিছু নেই। এবং পুরো দর্শনটিই বিজ্ঞানের (science) ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যা মূলত প্রত্যক্ষ প্রমান (empirical evidence) নির্ভর কিন্তু তারপরেও stage by stage ধীরে ধীরে মানুষের বোধবুদ্ধি অনুযায়ী অনুমান (inference), উপমান (analogy), অর্থপ্রাপ্তি (deductive evidence) ও শেষে শব্দ (scriptural authority) অবধি নামতে পারে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো শব্দ কিন্তু last resort আর প্রত্যক্ষ প্রমান সবচেয়ে ওপরে কারণ time cycle চোখের সামনে দেখা যায়, তাকে জীবনের প্রতিটি বিষয়ের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে বোঝা যায় - উদাহরণ স্বরূপ সুখ এবং দুঃখ একটা cyclical order এ চলতে থাকে, ক্ষুধা একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর পর পায়, জাগরণ এবং ঘুম দিন আর রাতের cycle এর সাথে জোড়া, ফুলের পর ফল হয়, ইত্যাদি। মূল কথা হলো কেউই ব্রাত্য নন, যিনি যখন realise করবেন যে তাঁর সত্যিকারের আমিটাকে খোঁজা প্রয়োজন, সেই দিন থেকেই তাঁর reverse osmosis চালু হয়ে যাবে এবং এখানে final day of judgement এর কোনো আষাঢ়ে গল্প নেই - সবটাই জীবের নিজের হাতে। সত্যিকারের আমির না কোনো শুরু না শেষ, না তার কোনো ঈশ্বর, না কোনো শব্দ - সে সনাতন, অব্যক্ত ও অবিভক্ত। নামরূপী ও অনামরূপী সবকিছুই শুধুমাত্র আদি ও অনন্ত ব্রহ্মের (Universal Consciousness) বিভিন্ন কায়িক বা দার্শনিক manifestation মাত্র।

এরপর আসে, যাঁরা অনুসন্ধানে বেরোবেন, তাঁদের ideal living এর বিষয়। পাঁচটি 'পরিহার' অর্থাৎ অহিংসা, সত্যবাদিতা, অচৌর্য, অপরিগ্রহ এবং কামশুন্যতার মধ্যে অপরিগ্রহ হলো বেশ কঠিন একটি concept। অপরিগ্রহ মানে হলো মূলত অনাসক্তি কিন্তু তার মধ্যেও অন্তঃপ্রবৃত্তি (নিজের পছন্দ/অপছন্দ) ও বাহ্যপ্রবৃত্তির (বিষয়েচ্ছা/ভোগেচ্ছা ইত্যাদি) মধ্যে পার্থক্য থাকতে বাধ্য। অবশ্য অপরিগ্রহ বলতে সাধারণ ব্যাখ্যায় 'কেউ নিজে থেকে দিলে ভিক্ষা নেব কিন্তু নিজে আগবাড়িয়ে কিছু চাইবো না' বোঝায়, যা আপাতদৃষ্টিতে হয়তো কেবলমাত্র স্থূল শারীরিক চাহিদাপূরণের ক্ষেত্রে একটি মানসিক restraint-এর ইঙ্গিত, কিন্তু এর পেছনে আসলে ঈশ্বরের ইচ্ছার ওপর সম্পুর্ন নির্ভরতা, আস্থা এবং তাঁতে পূর্ণ সমর্পণের ভাব কাজ করে। এছাড়াও সত্য দম দয়া অক্রোধ আর্জব সন্তোষ তপস্যা স্বাধ্যায় শৌচ এবং মিতাহার - সবটা মিলিয়ে যাপনের একটা গোটা eco-system। দম মানে হলো দমন - নিজের কুপ্রবৃত্তিকে দমন, কমেচ্ছাকে দমন ইত্যাদি; আর্জব মানে ঋজুতা বা সারল্য আর স্বাধ্যায় মানে শাস্ত্রপাঠ। এগুলি জৈনদের কৃত্য বটে কিন্তু যিনিই আত্মানুসন্ধানে ব্রতী হবেন তাঁদের সকলের পক্ষেই এইগুলি common factor। হিন্দু সভ্যতায় কোনো religious dogma নেই, সবটাই way of life। ওটি মানতে পারলে মন আপনা থেকেই এমন আধ্যাত্মিক উচ্চতায় উঠে যাবে যে তারপর আর rigidity-র কোনো জায়গা থাকে না - সব পথকেই নিজের পথ বলে মনে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাধন-জীবন নানা পথ ধরে শেষে সেই একই সনাতন সত্য বা eternal truth-এর উপলব্ধির মূর্তরূপ। এর আগের অবতারে শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন এই শাশ্বত দর্শনের ব্যবহারিক প্রতিরূপ আর শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন এর বৌদ্ধিক প্রতিরূপ।

Tuesday, August 10, 2021

জাতির প্রারব্ধ

একজন মানুষ যেমন আগের আগের জন্মের কর্মফলের নিট ফলাফল-স্বরূপ প্রারব্ধ ঘাড়ে করে নিয়ে জন্মান এবং এই জন্মের সু অথবা কু কর্মফলের কারণে সেই প্রারব্ধকে হয় খণ্ডন অথবা বর্ধন করেন, ঠিক সেইরকমই যেকোনো জাতির জীবনেও ওই একই প্রারব্ধ আর কর্মফলের সূত্র কাজ করে, তবে সমষ্টিগতভাবে, যা সামাজিক জীব হিসেবে ব্যক্তির জীবনকেও প্রভাবিত করে। আমরা কোন দেশে জন্মেছি, কোন প্রদেশে জন্মেছি, কোন পরিবারে জন্মেছি, কোন সংস্কারে লালিত পালিত হচ্ছি - সবটাই আমাদের প্রারব্ধ। আর আমরা যে এই জাতিতেই জন্মেছি এবং আমাদের কর্মফল জাতিকেও ভোগ করতে হচ্ছে, এটা সেই জাতির প্রারব্ধ। দেখবেন অনেক সময় এমন হয় যে একেবারে হওয়া কাজ ঘেঁটে গেল, চরম অশান্তির কারণ হয়ে উঠলো, অথচ এমনটা ঘটার কোনো পূর্ব ইঙ্গিতই ছিলনা - প্রারব্ধ। জাতির ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। হটাৎ বলা নেই কওয়া নেই কোত্থেকে হৈ হৈ করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিছু বর্বর এসে লুটপাট করে, বহু মন্দির আর শ্রীবিগ্রহ ভেঙেচুরে, শাস্ত্রগ্রন্থ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, জোর করে নিজেদের বর্বরতা কিছু মানুষের মধ্যে বপন করে, গোটা সমাজকে কলুষিত করে দিয়ে চলে গেল - কি বলবেন, জাতির প্রারব্ধ নয়? যদি নিজেদের মধ্যে জাতবিচার না করে, জাতি সু আর কু-এর মধ্যে জাতবিচার করতো আর সবাই মিলে একসাথে এক জাতি হিসেবে বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতো তাহলে সেই কর্মফলের দ্বারা পরাধীনতার প্রারব্ধ খণ্ডন হয়ে যেত, কিন্তু জাতি পারলো না। বারবার অবতারেরা এলেন, তাঁদের দূতরা এলেন, বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে সমগ্র বিশ্বের কল্যাণহেতু মানবতার ধাত্রীভূমি আমাদের এই পবিত্র হিন্দুভূমির নিজের ক্ষমতা এবং খামতি সম্পর্কে আত্মপোলব্ধির বড় প্রয়োজন, কিন্তু জাতি জাগলো না আর দীর্ঘ সময় ধরে জন্মজন্মান্তরের সঞ্চিত পাপও আর স্খলন করা গেলনা। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য - দেশভাগ থেকে শুরু করে এখন যে শ্রদ্ধাহীনতা, ক্ষুদ্রতা, অপরিসীম লোভ, লালসা, হিংসা, পরনির্ভরতা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি সব মিলিয়ে এক সার্বজনীন নৈরাজ্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটাও বাঙ্গালী জাতির প্রারব্ধ - তারা সত্যিকারের শ্রীচৈতন্যকে বুঝতে পারেনি, মহীরুহকে লতাগুল্ম বানিয়ে ছেড়েছে। যাইহোক, জন্মান্তরবাদ তত্বের মতে অহেতুকি ভগবৎ কৃপায় কোনো না কোনো এক জন্মে মানুষের বোধোদয় ঠিকই হয় এবং তার জীবন অবশেষে প্রারব্ধশূন্যতার দিকে মোড় নেয়। জাতির জীবনেও এমনটাই হয়। সারা বিশ্ব জুড়ে বহু সভ্যতার উত্থান ও পতন এবং পুনরুত্থানের মধ্যেই এর প্রমাণ ছড়িয়ে আছে, ইহুদীরা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এখনই বাঙ্গালীর জাগার সময় হয়েছে কিনা আমি জানিনা, কিন্তু ভারত আবার জাগছে। আর ভারত জাগলে বঙ্গভূমিও আজ নয় কাল জাগতে বাধ্য। ভবিষ্যৎ আশাময়।

মনের মধ্যে পাহাড়

বরফঘেরা পাহাড়ের ছবি দেখছিলাম, দেখতে দেখতে মনে হলো পাহাড়ের চূড়ায় যেখানে বরফ লেগে থাকে, সেটা ধাক্কাধাক্কির সময় সবচেয়ে প্রথম বেসামাল হয়েছিল আর ঠেলা সামলাতে না পেরে ধীরে ধীরে অতটা ওপরে উঠে গিয়েছিল। বাকি গোটা পাহাড় এইভাবেই তৈরি - গোটাটাই বিভিন্ন পর্যায়ে নিচের ধাক্কার চোট সামলাতে না পেরে উর্ধতনস্তরের ভার ঠেলতে ঠেলতে নিজেরাও হাজার হাজার ফুট উঁচু হয়ে গেছে। মধ্যাকর্ষণ প্রতিনিয়ত চূড়াকে টানে, কিন্তু পাহাড়ের নিম্নদেশ এমনই বলবান, সেটা মাটিকে এমনভাবে সবলে আঁকড়ে ধরে রয়েছে যে চুড়োর আর নিচে নামবার উপায় নেই। মাঝেমাঝে হয়তো পাহাড়ের গা থেকে ভূস করে খানিকটা মাটি পাথর গড়িয়ে নেমে আসে, হয়তো কখনো পাহাড়ের খানিকটা অংশ ভেঙে পড়ে, মাথার বরফ গলে গলে জীবনদায়ী নদী হয়েও নেমে আসে ধরাতলে, কিন্তু পাহাড় নামে না। আসলে ওই উচ্চতায় একবার উঠে গেলে আর নামবার যো থাকে না। আমাদের মনের মধ্যে বরফঢাকা পাহাড়চূড়া দেখলে যে অদ্ভুত এক শান্তির অনুভূতি হয়, সেটা আসলে মনে মনে তার উচ্চতার এবং নির্লিপ্ততার স্বীকৃতি - সে মাটির সব কলুষতা, সব ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা তো জানি যে একেবারে পাদদেশে যে পাথর, চূড়াতেও তাই, তবু কেন শ্রদ্ধা হয়? কারণ আমরাও আর টাল সামলাতে পারছি না, আমাদেরও নানাবিধ অশান্তি চতুর্দিক থেকে ঘিরে নিয়ে ভয়ানক ঠেলছে, আমাদেরও আর এই রোজকার চিঁড়েচেপ্টা হওয়া ভালো লাগছেনা, আমরাও চাইছি অশান্তির উৎসের কাঁধে ভর দিয়েই ওগুলোর উর্ধে উঠে যেতে। আসলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই তো কত পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে দেখা যায় - কই তাদের তো ডেডলাইন মিট না করার গালাগাল খেয়ে, নিজের মনকে ছোট করে পেটের রসদ জোগাড় করতে হয়না, তাদের তো দেখনদারী করার জন্য ক্রেডিটকার্ডের বোঝার তলায় ডুবে যেতে হয়না, তাহলে আমাদের কেন হয়? তারা যদি অতটুকু বুদ্ধি নিয়ে প্রকৃতি থেকেই নিজেদের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু অক্লেশে মিটিয়ে নিতে পারে, আমরা এত বুদ্ধি নিয়েও কেন তা পারিনা? নিজেদের চারপাশে নিজেদেরই গড়ে তোলা এই যে একটা কৃত্তিম বাসনার ইঁট আর বাসনাপূর্তির সিমেন্ট দিয়ে তৈরি দেওয়াল, ওই দেওয়াল চাপা পড়ে মরাই যেন আমাদের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা সবাই পাহাড়চূড়ার শীতলতা চাই, অবিচ্ছিন্ন নীরবতা চাই, অবিক্ষুব্ধ যাপন চাই, অথচ কতজন এই অপ্রয়োজনীয় ধাক্কাধাক্কি থেকে আসলে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারি? আমাদের চতুরাশ্রম কিন্তু সেই কথাই বলে। বলে যে একটা বয়সের পর আর আহারের দিকে নয়, পাহাড়ের দিকে তাকাও। বহুদিন ধরে চাপ সহ্য করতে করতে একসময় টাল হারিয়ে ফেলাটা কোনো অন্যায় নয়, আমাদের সংস্কৃতিতে ওটাই প্রত্যাশিত। যিনি পারেন তিনি শান্তির পথে এগিয়ে যান। যিনি পারেননা, তাঁর চোখদুটি সামনের দিকে হলেও, আপাতত দৃষ্টি পশ্চাদগামী। তবে তিনিও জন্মের পর জন্ম ধরে বিতৃষ্ণা অর্জন করার জন্য সময় পান, কেউই আসলে বাদ নন।

ভাষা ও যাপন

 গতকাল বিকেলে দুজন অগ্রজপ্রতিম দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্যাফেতে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে বেশ একটা মজার অভিজ্ঞতা হলো। অন্য একজন গ্রাহক আগে থেকেই বসে ছিলেন, ধীরে ধীরে আরো কিছু মানুষ যোগদান করলেন, বেশ একটা গ্রূপ তৈরি হয়ে গেল। যা বুঝলাম এঁদের মধ্যে একটি কাপেল আর বাকিরা সব বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী মিলিয়ে সিঙ্গেল যুবক এবং যুবতী। বোঝা গেল যে ওঁরা আগামী শুক্রবার দল বেঁধে দার্জিলিং বেড়াতে যেতে চান, সেই বিষয়েই আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার উদ্দেশ্যেই এই একত্রিত হওয়া। বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ আবহাওয়ায় আলোচনা শুরু হলো, সবাই উচ্চকিত, ঝপাঝপ খাওয়ার এবং পানীয়র অর্ডার দেওয়া শুরু হলো, হাসি ঠাট্টায় একেবারে যাকে বলে উৎসবের পরিবেশ। আমি ফিস ফ্রাই খাচ্ছি আর চুপচাপ দেখছি, শুনছি। তারপর যত সময় এগোতে থাকলো তত পরিবেশ বদলাতে থাকলো এবং প্রথম মতভেদ শুরু হলো mode of transport নিয়ে - কেউ প্লেনে যেতে চান তো কেউ ট্রেনে, কেউ এসিতে যেতে চান তো কেউ স্লিপার ক্লাসে, প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে। তারপর বিরোধ লাগলো বাসস্থান নিয়ে - কারো ইচ্ছে হোম স্টে, কেউ বা লোকাল কালচারে আগ্রহী নন, তাঁরা চান হোটেলের আরাম। যত পারা চড়ছে তত বিভিন্ন সাব-গ্রূপে ভাগ হয়ে সমমনোভাবাপন্নরা বাইরে গিয়ে ঘন ঘন সিগারেট ফুঁকে আসছেন আর ফিরে এসেই দ্বিগুন উৎসাহে নিজেদের মতের সপক্ষে নতুন যুক্তিজাল ছড়াচ্ছেন। আমি দেখছি, মিটিমিটি হাসছি আর ততক্ষনে ফ্রাই শেষ করে চিকেন কাটলেটে হাত দিয়েছি। এরমধ্যে হটাৎ করে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রবল মতানৈক্য দেখা দিল, বন্ধুগোষ্ঠীর একদিকে স্বামী,  তো স্ত্রী আর একদিকে। স্বামীটি অবাঙ্গালী এবং স্ত্রীটি খাঁটি মেড ইন বঙ্গ ক্যালকেসিয়ান। উচ্চৈঃস্বরের মধ্যে একবার হিমশীতলগলায় 'ঔকাত' শব্দটি কানে এলো এবং তৎক্ষণাৎ স্বামী ভদ্রলোক নিজের পিঠের বোঁচকা তুলে সটান বাইরে হাঁটা দিলেন, তাঁর পেছনে পেছনে কয়েকজন 'আরে শুন শুন' বলতে বলতে দৌড়ালেন। গোটা জায়গাটা জুড়ে যেন অকস্মাৎ শ্মশানের শান্তি নেমে এলো, টেবিল প্রায় ফাঁকা, দুটো থমথমে ঘন কালো মেঘে ঢাকা মুখ, আর এরই মধ্যে একগাদা খাবার নিয়ে কয়েকজন ওয়েটার হাসিহাসিমুখে সশব্দে থরে থরে প্লেট গ্লাস কাঁটা চামচ ইত্যাদি সব টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখতে লাগলেন, কাঁচের বাইরে ফুটপাথে তখন চরম উত্তেজনা, ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ওঁদেরই মধ্যে যিনি সবার আগে এসে বসেছিলেন, তিনি বাইরে বেরোনোর আগে বিব্রতকণ্ঠে আমাদের দিকে ফিরে বলে গেলেন, "আমি কিন্তু যাবো না, এমনিই এসেছি"; এটা বলার কোনো প্রয়োজন ভদ্রমহিলার ছিলনা কিন্তু কেন বললেন সেটা হয়তো আন্দাজ করা কঠিন নয়। সম্পুর্ন নির্লিপ্ত হয়ে চোখের সামনে সামান্য কালখণ্ডের মধ্যে যেন গোটা জীবনের অসারত্বের একটা চলছবি দেখলাম, যার প্রয়োজনীয়তা আদপেই আছে কিনা ভাবা দরকার, খুবই দরকার। মানুষ নাকি কথা না বললে বাঁচে না। সে কি বাঁচার গুণাত্মক আর পরিমাণাত্মক দিকের পার্থক্য বোঝে আর যদি বোঝে তাহলে কথার প্রয়োজনীয়তা এবং প্রভাবকে কি সে স্বেচ্ছায় গ্রহণ বা বর্জন করার ক্ষমতা ধরে? নিজের মন বুদ্ধি আর অহংকার থেকে উৎপন্ন বাসনা - সেটা প্রকাশের ভাষা, আর অন্যের মন বুদ্ধি আর অহংকারের ওপর সেই বাহ্যিক ভাষার প্রভাব - সব মিলিয়ে বড় গোলমেলে সব ব্যাপার স্যাপার। হয়তো যত বাক্যহীন থাকা যায়, নিজেকে আত্মস্থ রাখা যায়, ততই যাপন অর্থবহ হয়।

কর্মফল ও পুনর্জন্ম

 কর্মফল ও পুনর্জন্ম


আমাদের সংস্কৃতিতে কর্ম তিন প্রকারের যথা: ক্রীয়মান, সঞ্চিত, এবং প্রারব্ধ। যখন কেউ তার শ্রমের ফল তার জীবদ্দশাতেই উপভোগ করতে পারে, তখন তাকে বলা হয় ক্রীয়মান; তার শ্রমের ফল ভোগ করার পূর্বেই যদি সে মারা যায়, তবে তাকে বলা হয় সঞ্চিত কর্ম। পূর্ব জন্মের সঞ্চিত কর্মের উদ্বৃত্ত অংশ ভোগ করার জন্য যদি তার পুনর্জন্ম হয়, তবে তাকে বলা হয় প্রারব্ধ। সাধনার গুণে কারো পক্ষে ক্রীয়মান ও সঞ্চিতের প্রভাব নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলা যেতে পারে কিন্ত্তু প্রারব্ধ কর্মের প্রভাব মুছে ফেলা সম্ভব নয়। পার্থিব উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা যতক্ষণ কোন ব্যক্তি আবিষ্ট থাকে ততক্ষণ তাকে নিশ্চিতভাবে জন্ম-মৃত্যুর অন্তহীন ভ্রমণ গ্রহণ করতে হবে। জীবাত্মা কখনও কখনও নাক্ষত্রিক জগতে ভ্রমণ করার জন্য স্থূল দেহ ত্যাগ করে যাকে বলা হয় প্রেত লোক। এর কর্মের প্রভাবের মধ্য দিয়ে যাবার পর এটি স্থূল দেহের সাথে স্থূল জগতে ফিরে আসে তার অতিরিক্ত বাসনাসমূহ যা তার পূর্ব জন্মে ছিল তা পূরণ করার জন্য। এ ব্যাপারে অজ্ঞ হয়ে কিভাবে এটি এক জগত থেকে অন্য জগতে চলাফেরা করে তা এক বড় রহস্যের বিষয়। যোগীরা এ রহস্য স্পষ্টভাবে হৃদয়ঙ্গম বা প্রত্যক্ষ করতে পারেন এবং জীবের পূর্ব সংস্কার সম্পর্কে বলতে পারেন।


বেদান্তসূত্রে সৃষ্টিকর্তা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, জগৎকে সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মকেও জীবের কর্মের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। কেননা, এই সৃষ্টিজগৎ আপ্তকাম ব্রহ্মের লীলা (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৩) হলেও, জগৎ-স্রষ্টা হিসেবে ব্রহ্মর পক্ষপাতিত্ব ও নিষ্ঠুরতার আপত্তি উত্থাপিত হয়। বস্তুত জগতে- মানব সমাজে- যে বৈষম্য দেখা যায়, অনেকেই শ্রম করতে করতে অনাহারে মৃতপ্রায় হলেও কেউ কেউ বিনা পরিশ্রমেই অন্যের শ্রমের ফল ভোগ করে বিলাসী জীবন কাটায়। তাদের দেখেই পুরোহিতবর্গ দেবলোকের কল্পনা করেছেন। আবার মনুষ্য থেকে ক্ষুদ্রতম কীট পর্যন্ত প্রাণিজগতে যে ভীষণ সংহার দেখা যায় যায় তা জগৎ-স্রষ্টা ব্রহ্মকে বড়ই হৃদয়হীন বলে প্রমাণ করে, এবং তার থেকে আত্মরক্ষার জন্যই উপনিষদে পূর্বজন্মকৃত কর্মসিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে-


‘তাদের মধ্যে যারা (পূর্বজন্মে) রমণীয় আচরণ বা পুণ্যকর্ম করে তারা দেহান্তরে শীঘ্রই ব্রাহ্মণযোনিতে বা ক্ষত্রিয়যোনিতে বা বৈশ্যযোনিতে জন্মলাভ করে। আবার যারা (পূর্বজন্মে) কপূয়াচরণ অর্থাৎ কুৎসিত বা অশুভ কর্ম করে তাদের শীঘ্রই কুকুরযোনিতে বা শূকরযোনিতে বা চণ্ডালযোনিতে পুনর্জন্ম হয়।’- (ছান্দোগ্য-৫/১০/৭)।


একই বিষয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদেও বলা হয়েছে এভাবে-

‘…তিনি কর্মকেই আশ্রয় করে থাকেন। তাই পুণ্য কাজ করলে ভালো আর পাপ কাজ করলে মন্দ ভোগ করতে হয়। পাপ-পুণ্যের আবর্তে জীব-পুরুষকে জন্মচক্রে পাক খেতে হয়। তাই কর্ম হলো জীবের গতি, কর্ম হলো জীবের মুক্তি। কর্মই স্থির করে দেবে জীব-পুরুষের অবস্থান।’- (বৃহদারণ্যক-৩/২/১৩)।


অর্থাৎ পূর্বজন্মের কর্মফলই নির্ধারণ করে দিচ্ছে এজন্মে কিভাবে এই ফল ভোগ করতে হবে, এই জন্মে সুখ ভোগ করবে, না কি দুঃখ ভোগ করবে। তৎকালীন সামাজিক ব্যবস্থা- শোষক-শোষিত, প্রভু-ভৃত্য প্রথার- দৃঢ় সমর্থক বাদরায়ণও একে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে বলেছেন-


(বৈষম্যনৈর্ঘৃণ্যে ন, সাপেক্ষত্বাৎ, তথা হি দর্শয়তি), ‘জগতে সুখ দুঃখাদি দেখে ব্রহ্মকে পক্ষপাতযুক্ত বা নিষ্ঠুর বলা যায় না- কারণ শাস্ত্রে এই বৈষম্যের হেতু এবং ব্রহ্মের স্বরূপ প্রদর্শিত হয়েছে।’- (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৪)।

এবং জীবের এই কর্মফল দাতা যে ঈশ্বরই, তা স্পষ্ট সিদ্ধান্ত করেই তিনি বলেন-

‘ফলমতঃ, উপপত্তেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৩৮)।।

ভাবার্থ : জীবের কর্মফলদাতা যে ঈশ্বর তাই যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত (ব্রঃ-৩/২/২৮)।


এখানে হয়তো একটি আপত্তি উঠতে পারে যে, কর্ম তো একটা সময়ে করা হয়ে থাকে, তার আবার আগের জগতের কথা কী করে আসে ? কিংবা প্রশ্নটি এভাবেও হতে পারে যে, যেহেতু প্রথম সৃষ্টির পূর্বে জীবাত্মার পক্ষে তার পূর্বে কোন অবস্থান সম্ভব নয়, তাই কর্মফল থাকাও সম্ভব নয়, তাহলে প্রথম সৃষ্টির সময়েই জীবের মধ্যে অবস্থার পার্থক্য আসবে কোত্থেকে- যদি না ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করে এই ভেদ সৃষ্টি করে থাকেন ? এই আপত্তির উত্তরে বাদরায়ণ বলেন যে, সৃষ্টি অনাদি, অতএব কর্মও অনাদি-

(ন কর্মাবিভাগাদিতি চেৎ, ন, অনাদিত্বাৎ), ‘সৃষ্টির পূর্বে জীব ও ব্রহ্মের কোন ভেদ ছিলো না। সৃষ্টির সময়েই ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করে ভেদ সৃষ্টি করেছেন যদি এরূপ বলা হয়, তাহলে এর উত্তরে বলা যায় যে, না জীবজগৎও অনাদি।’- (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৫)।


পুনর্জন্মের বিষয়ে বাদরায়ণ উপনিষদের সিদ্ধান্তকে সু-ব্যবস্থিতরূপে একত্রিত করেছেন। ছান্দোগ্য উপনিষদের (ছাঃ-৫/১০/৭) শ্রুতিতে সুকৃতি-দুষ্কৃতির মাধ্যমে পুনর্জন্মের যে ধারণা অভিপ্রেত হয়েছে, তার থেকেই পরবর্তী উপনিষদগুলিতে জীবের পুনর্জন্মচক্রের একটা দার্শনিক রূপরেখাও তৈরি হয়ে গেছে। যেমন, প্রশ্ন-উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘তেজো হ বা উদানঃ তস্মাৎ উপশানততেজাঃ। পুনর্ভবম্ ইন্দ্রিয়ৈঃ মনসি সম্পদ্যমানৈঃ’। (প্রশ্নোপনিষদ-৩/৯)।। 

‘যৎ চিত্তন্তেনঃ এষঃ প্রাণম্ আয়াতি। প্রাণঃ তেজসা যুক্তঃ সহাত্মনা যথাসঙ্কল্পিতং লোকং নয়তি’। (প্রশ্নোপনিষদ-৩/১০)।।

অর্থাৎ :

অগ্নিই উদান। মানুষের যখন মৃত্যু হয় তখন তার শরীর শীতল হয়ে যায়। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন মনে লীন হয় এবং সে জন্মান্তরের জন্য প্রস্তুত হয় (প্রশ্ন-৩/৯)। মৃত্যুকালে জীবাত্মা প্রাণে প্রবেশ করে। সঙ্গে থাকে মন এবং সেই সময়কার মনের যত সংস্কার বা চিন্তা ও বাসনা সমূহ। প্রাণ তখন অগ্নি অর্থাৎ উদানের সঙ্গে যুক্ত হয় (কেননা উদানই তাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়)। আত্মা যে লোক কামনা করে প্রাণ তাকে সেই লোকেই নিয়ে যায়। তারপরে আত্মা নতুন জন্ম গ্রহণ করে (প্রশ্ন-৩/১০)।


এই ধারণারই আরেকটু বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদে-


‘স যত্র অয়মাত্মাহ্বল্যং ন্যেত্য সংমোহমিব ন্যেতি অথৈনমেতে প্রাণা অভিসমায়ন্তি স এতাস্তেজোমাত্রাঃ সমভ্যাদদানো হৃদয়মেব অন্ববক্রামতি ষ যত্রৈষ চাক্ষুষঃ পুরুষঃ পরাঙ্ পর্যাবর্ততে, অথ অরূপজ্ঞ ভবতি’। (বৃহদারণ্যক-৪/৪/১)।। 

‘একীভবতি ন পশ্যতীতি আহুঃ, একীভবতি ন জিয়তীতি আহুঃ, একীভবতি ন রসয়ত ইতি আহুঃ, একীভবতি ন বদতীতি আহুঃ, একীভবতি ন শৃণোতীতি আহুঃ, একীভবতি ন মনুতে ইত্যাহুঃ, একীভবতি ন স্পৃশতীতি আহুঃ একীভবতি ন বিজানাতীত্যাহুঃ। তস্য হি এতস্য হৃদয়স্যাগ্রং প্রদ্যোততে, তেন প্রদ্যোতেন এষ আত্মা নিষ্ক্রামতি চক্ষুষ্টো বা মূর্ধ্নো বা অন্যেভ্যো বা শরীরদেশেভ্যঃ। তং উৎক্রমন্তং প্রাণোহনুৎক্রামতি, প্রাণমনুৎক্রামন্তং সর্বে প্রাণা অনুৎক্রামন্তি, সবিজ্ঞানো ভবতি, সবিজ্ঞানমেব অন্ববক্রামতি। তং বিদ্যাকর্মণী সমন্বারভেতে পূর্বপ্রজ্ঞা চ’। (বৃহদারণ্যক-৪/৪/২)।। 

তদ্ যথা তৃণজলায়ুকা তৃণস্যান্তং গত্বাহন্যমাক্রমম্ আক্রম্যাত্মানম্ উপসংহরত্যেবং এবায়মাত্মা ইদং শরীরং নিহত্যাহবিদ্যাং গময়িত্বাহন্যমাক্রমং আক্রম্যাত্মানং উপসংহরতি’। 

(বৃহদারণ্যক-৪/৪/৩)।।

অর্থাৎ :

এই শারীর-পুরষ আত্মা দুর্বলতার কারণে যখন সংজ্ঞালোপ পাবার মতো অবস্থায় আসে তখন সবকটি প্রাণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় এসে জড়ো হয় আত্মার কাছে। যে তেজশক্তি নিয়ে ইন্দ্রিয়রা ছিলো প্রকাশমান, করছিলো আপন-আপন নির্দিষ্ট কাজ, তাদের সেই তেজকে নিয়ে প্রবেশ করে হৃদয়ে। সঙ্গত কারণেই চাক্ষুষ-পুরুষ আদিত্যের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে, চোখ আর কেমন করে রূপ দেখবে ? তাই মুমূর্ষুর চোখে কোন রূপই ধরা পড়ে না (বৃঃ-৪/৪/১)। আত্মার সঙ্গে এক হয়ে মিশে গেলে, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে কি আর স্বাতন্ত্র্য থাকে ? একীভূত হয়ে থাকার ফলে, লোকে বলে শুনতে, চিন্তা করতে, স্পর্শ করতে পারছে না, কিছু জানতেও পারছে না। সেই সময় তার হৃদয়ের অগ্রভাব দীপ্তিযুক্ত হয়ে ওঠে, প্রকাশিত হয় হৃদয়পথে নির্গমন দ্বার। দেহকে ছেড়ে জ্যোতির সাহায্যে সেই আত্মা জীবের কামনা অনুযায়ী অনুরূপ পথ দিয়ে বেরিয়ে যান। যদি তার সাধনা থাকে আদিত্যলোকের তবে আত্মা নিষ্ক্রান্ত হন চক্ষুপথে, ব্রহ্মলোকের জন্য ব্রহ্মতালু পথে, আবার নানা-বাসনা, নানা কর্মানুসারে অনুরূপ অপরাপর ইন্দ্রিয়পথে। আত্মা নির্গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যপ্রাণ তাঁর অনুগমন করে, সেই সঙ্গে অপরাপর প্রাণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ও তাঁর অনুগমন করে। আত্মা তখন বিজ্ঞানময়। এই বিজ্ঞানময় আত্মার অনুগমন করে বিদ্যা, কর্ম আর সংস্কার (বৃঃ-৪/৪/২)। জলায়ুক বা জলৌকা অর্থাৎ জোঁক যেমন ঘাসের এক ডগা ছেড়ে আর এক ডগায় গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নেয়, আত্মাও তেমনি দেহত্যাগের পর অবিদ্যা দূর করে, স্থূল শরীরটাকে পরিত্যাগ করে আশ্রয়রূপ অন্য দেহকে অবলম্বন করে (বৃহদারণ্যক-৪/৪/৩)।


এই শ্রুতিকেই প্রামাণ্য স্বীকার করে তাই বাদরায়ণও বলেন-


‘তদন্তরপ্রতিপত্তৌ রংহতি সম্পরিষ্বক্তঃ, প্রশ্ননিরূপণাভ্যাম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১)।।

‘প্রাণগতেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/৩)।।

অর্থাৎ :

জীব সূক্ষ্মভূত-সমন্বিত হয়ে দেহত্যাগান্তে অন্যদেহ প্রাপ্তির জন্য গমন করে- তা শ্রুতি বর্ণিত প্রশ্নোত্তর থেকে অবগত হওয়া যায় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১)। বৃহদারণ্যক শ্রুতি বলেন যে, জীব উৎক্রান্ত হলে জীবের সাথে ইন্দ্রিয়সকলও গমন করে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/৩)।


এই প্রাণসকল বা সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়সহ উৎক্রান্ত জীব কোথায় গমন করে ? এর একটা বিবরণ ছান্দোগ্য উপনিষদেই পাওয়া যায়। যেমন-


‘স জাতো যাবৎ-আয়ুষম্ জীবতি তং প্রেতং দিষ্টমিতম্ অগ্নয়ঃ এব হরন্তি যত এবেতো যতঃ সম্ভূতো ভবতি’। (ছান্দোগ্য-৫/৯/২)।। 

‘তদ্ য ইত্থং বিদুর্যে চ ইমে অরণ্যে শ্রদ্ধা তপ ইত্যুপাসতে তে অর্চিষম্ অভিসংভবন্তি অর্চিষঃ অহঃ অহ্নঃ আপূর্যমাণপক্ষম্ আপূর্যমাণপক্ষাদ্ যান্ ষট্ উদঙ্ এতি মাসাংস্তান্’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/১)।। 

‘মাসেভ্যঃ সংবৎসরং সংবৎসরাৎ আদিত্যম্ আদিত্যাৎ চন্দ্রমসং চন্দ্রমসো বিদ্যুতং তৎ পুরুষঃ অমানবঃ স এনান্ ব্রহ্ম গময়তি এষঃ দেবযানঃ পন্থাঃ ইতি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/২)।। 

‘অথ য ইমে গ্রাম ইষ্টাপূর্তে দত্তম্ ইতি উপাসতে তে ধূমম্ অভিসম্ভবন্তি ধূমাৎ রাত্রিম্ রাত্রেঃ অপরপক্ষম্ অপরপক্ষাৎ যান্ ষট্ দক্ষিণা এতি মাসাংস্তান্নৈতে সংবৎসরম্ ন অভি প্রাপ্নুবন্তি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৩)।। 

‘মাসেভ্যঃ পিতৃলোকং পিতৃলোকাৎ আকাশম্ আকাশাৎ চন্দ্রমসম্ এষঃ সোমো রাজা তৎ দেবানাম্ অন্নম্ তং দেবা ভক্ষয়ন্তি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৪)।। ‘তস্মিন্ যাবৎ সম্পাতম্ উষিত্বা অথ এতম্ অধ্বানম্ এব পুনঃ নিবর্তন্তে যথা ইতম্ আকাশম্ আকাশাৎ বায়ুম্ বায়ুঃ ভূত্বা ধূমঃ ভবতি ধূমঃ ভূত্বা অভ্রং ভবতি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৫)।।

অর্থাৎ :

(সন্তান) জন্মগ্রহণ করে যতদিন তার আয়ু ততদিন জীবিত থাকে। (তারপর যখন) যথানির্দিষ্ট রূপে (অর্থাৎ কর্মফল অনুযায়ী লোক লাভের জন্য) দেহত্যাগ করে, তখন (তার পুত্র ও শিষ্যরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য) তাকে ঘর থেকে সেই অগ্নিতে নিয়ে যায়- যে অগ্নি থেকে সে এসেছে, যে অগ্নি থেকে সে উৎপন্ন হয়েছে (ছাঃ-৫/৯/২)। যাঁরা পঞ্চাগ্নিবিদ্যা জানেন এবং যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তাঁরা মৃত্যুর পর অর্চিলোক অর্থাৎ জ্যোতির্লোক প্রাপ্ত হন। (অতঃপর) অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয় মাসে- (ছাঃ-৫/১০/১)। সেখান থেকে সংবৎসরে, সংবৎসর থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে চন্দ্রলোকে এবং চন্দ্রলোক থেকে বিদ্যুৎ-লোক প্রাপ্ত হন। সেই স্থানে (ব্রহ্মলোক থেকে) এক অমানব অর্থাৎ জ্যোতির্ময় পুরুষ এসে তাদের ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায়। এই পথই দেবযান অর্থাৎ দেবলোকের পথ (ছাঃ-৫/১০/২)। আর যে সকল গৃহস্থ যজ্ঞ, সমাজসেবামূলক কর্ম এবং দান ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেন তাঁরা (মৃত্যুর পর) ধূমকে প্রাপ্ত হন। (তারপর তাঁরা) ধূম থেকে রাত্রি, রাত্রি থেকে কৃষ্ণপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ থেকে দক্ষিণায়ণের ছয়মাসে গমন করেন। এঁরা (দেবযানপথে গমনকারীদের মতো) সংবৎসরকে প্রাপ্ত হন না (ছাঃ-৫/১০/৩)। দক্ষিণায়ণের ছয়মাস থেকে পিতৃলোকে, পিতৃলোক থেকে আকাশে, আকাশ থেকে চন্দ্রলোকে গমন করেন। ইনিই (অর্থাৎ উজ্জ্বল চন্দ্রই) রাজা সোম। ইনি দেবতাদের অন্ন, দেবতারা এঁকে ভোগ করেন (ছাঃ-৫/১০/৪)। কর্মফল ক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত চন্দ্রলোকে বাস করে তারপর যে পথে তাঁরা গিয়েছিলেন সেই পথেই পুনরায় (পৃথিবীতে) ফিরে আসেন। তাঁরা প্রথমে আকাশ ও পরে বায়ুকে প্রাপ্ত হন। বায়ু হয়ে ধূম, ধূম হয়ে কুয়াশা হন (ছান্দোগ্য-৫/১০/৫)।


শ্রুতিতে এই যে জীবের উৎক্রমণের পর আবার কর্মফল ভোগের জন্য পৃথিবীতে অবতরণ প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়, তাই বাদরায়ণও বলেন-


‘কৃতাত্যয়ে অনুশয়বান্, দৃষ্টস্মৃতিভ্যাম্ যথেতমনেবং চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/৮)।।

ভাবার্থ : শ্রুতি-স্মৃতি থেকে জানা যায় যে, জীব যে-পথে চন্দ্রলোকে গিয়েছিলো, কর্মফল ভোগের পর আবার সেই পথেই এবং অন্যভাবেও ভুক্তাবশিষ্ট কর্মসহ পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করে (ব্রঃ-৩/১/৮)।


কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসে যে, এ সকল ব্যক্তির আত্মা কি বাস্তবিকপক্ষে আকাশ, ধূম ইত্যাদির সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়, অথবা এরা কি একটি প্রকৃতিগত সাদৃশ্য প্রাপ্ত হয় ? বিষয়টি স্পষ্ট করতে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-


‘তৎসাভাব্যাপত্তিঃ, উপপত্তেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২২)।।

ভাবার্থ : চন্দ্রমণ্ডল হতে অবতরণকালে জীব আকাশাদির সদৃশ হয়। আকাশস্বরূপ হয় না- কারণ সদৃশ হওয়াই যুক্তিসঙ্গত (ব্রঃ-৩/১/২২)।


অর্থাৎ, শ্রুতিটিতে আকাশ ইত্যাদির সাথে অভিন্নত্বের কথা বলা হয়নি। শ্রুতিটির অর্থ হলো, এরা আকাশ ইত্যাদির প্রকৃতিগত একটি সাদৃশ্য প্রাপ্ত হয়- আকাশ, বায়ু প্রভৃতির মতো হয়ে যায়। তার মানে, জীব আকাশের মতো একটি সূক্ষ্ম আকার ধারণ করে বায়ুর অধীনে আসে এবং ধূম ইত্যাদির সাথে সংযুক্ত হয়। এই পুনর্জন্ম প্রক্রিয়ায় তারপরে ছান্দোগ্য উপনিষদে আরো বলা হয়েছে-


‘অভ্রং ভূত্বা মেঘো ভবতি মেঘো ভূত্বা প্রবর্ষতি ত ইহ ব্রীহি-যবাঃ ওষধি-বনস্পতয়ঃ তিলমাষাঃ ইতি জায়ন্তে অতঃ বৈ খলু দুর্নিষ্প্রপতরং যঃ যঃ হি অন্নম্ অত্তি যঃ রেতঃ সিঞ্চতি তৎ ভূয়ঃ এব ভবতি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৬)।।

অর্থাৎ :

কুয়াশা হয়ে মেঘ হন, মেঘ হয়ে বর্ষণ করেন। তারপর জীবগণ এই পৃথিবীতে ব্রীহি, যব, ওষধি, বনস্পতি, তিল ও মাষ ইত্যাদি রূপে জাত হন। এই শষ্যাদি থেকে নিষ্ক্রমণ দুঃসাধ্য। (সন্তান উৎপাদনে সমর্থ) যে যে প্রাণী ওই (ব্রীহি প্রভৃতি) অন্ন আহার করে এবং সন্তান উৎপন্ন করে, সেই সেই প্রাণিরূপে জীবগণ পুনরায় জন্মগ্রহণ করে (ছান্দোগ্য-৫/১০/৬)।


এখানে একটি প্রশ্ন উঠে যে, চন্দ্রলোক হতে প্রত্যাবর্তনকারী জীবাত্মা যখন আকাশ, বায়ু প্রভৃতির সাথে সাদৃশ্যপ্রাপ্ত হয় তখন কি তা বেশ দীর্ঘকালই ঐ অবস্থায় থাকে, না কি শীঘ্রই এক অবস্থা হতে অবস্থান্তর প্রাপ্ত হয় ? এবং অন্য প্রশ্নটি হলো, জীবাত্মা কি ব্রীহি ইত্যাদি উদ্ভিজ্জরূপে জাত হয় ? এ প্রেক্ষিতে বাদরায়ণ বলেন-

‘নাতিচিরেণ, বিশেষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৩)।।

‘অন্যাধিষ্ঠিতে পূর্ববৎ, অভিলাপাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৪)।।

‘রেতঃ-সিক্-যোগঃ অথ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৬)।।

‘যোনেঃ শরীরম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৭)।।

ভাবার্থ :

শ্রুতি বলেন জীবের চন্দ্রলোক হতে নানা অবস্থার (ব্রীহি, যব ইত্যাদি) মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আসতে বেশি বিলম্ব হয় না। এ বিষয়ে বিশেষ শ্রুতি তাই বলেন (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৩)। জীব ব্রীহি ইত্যাদি রূপ প্রাপ্ত হয় বলা হয়েছে; তার অর্থ হলো সেই সেই ব্রীহিতে অবস্থান হয় মাত্র, কারণ শ্রুতিতে এ প্রসঙ্গে আকাশাদি সম্বন্ধে যেরূপ উল্লেখ আছে, ব্রীহির সম্বন্ধেও সেরূপই উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৪)। চন্দ্রলোক-প্রত্যাগত জীব ধান ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার পর যারা শুক্রনিষেক করে জন্মদান করতে সমর্থ তাদের দেহে প্রবিষ্ট হয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৬)। যোনিকে (গর্ভকে) আশ্রয় করেই জীব স্বীয় ভোগায়তনদেহ লাভ করে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৭)।।


অতএব, সংক্ষিপ্ত করে বললে, দেহত্যাগান্তে পরলোক ভ্রমণ করে প্রত্যাগত জীব কর্মফল অনুযায়ী ইহলোকে পুনরায় জীবন শুরু করে। পুণ্যবানগণ চন্দ্রলোকে যান। নবকলেবর ধারণের জন্য চন্দ্রমা থেকে মেঘ, জল, অন্নাদির যে রাস্তার কথা উপনিষদে বলা হয়েছে তাতে ফিরে আসতে দেরি হয় না। যে ধান্যশস্যাদির সঙ্গে জীব মাতৃগর্ভে প্রবিষ্ট তাতে সে নিজে নয়, অন্যজীবের অধিষ্ঠাতা হওয়ার সময় এরূপ করে। সুতরাং অবতরণকারী জীবাত্মা অন্য জীবাত্মার দ্বারা (সঞ্জীবিত) প্রাণবন্ত বৃক্ষাদির মধ্যে অবস্থান মাত্র করে- যে পর্যন্ত না নতুন কোন জন্মের সুযোগ পায়। সেই শস্য ভক্ষণের পর আবার রক্ত-বীর্য-যোনির সংযোগ হয়, যার ফলে হয় নতুন শরীর সৃষ্টি। অর্থাৎ পরিশেষে জীবাত্মা একজন সন্তান-উৎপাদনসক্ষম (রেতঃসিঞ্চনকারী) পুরুষের সংস্পর্শে এসে নারীর গর্ভে প্রবেশ করে এবং সেখানে একটি নতুন দেহ লাভ করে, যে দেহ (ছান্দোগ্য-৫/১০/৭ অনুযায়ী) পূর্ব-কৃত-কর্মের ভুক্তাবশিষ্ট ফল ভোগ করার জন্য সমর্থ।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠে যে, ইহলোক থেকে যারা উৎক্রমণ করে তাদের সকলেই কি চন্দ্রলোকে গমন করে থাকে ? যে-সকল জীবের কর্মফল চন্দ্রলোক গমনের পক্ষে যথেষ্ট নয়, অর্থাৎ যারা যজ্ঞাদি বা কোন ধর্মানুষ্ঠান করে না, কিংবা অনিষ্টকারী ব্যক্তি, মৃত্যুর পর তাদের কী গতি হয় ? এ বিষয়ে ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘অথ এতয়োঃ পথোর্ন কতরেণচন তানীমানি ক্ষুদ্রাণি অসকৃৎ আবর্তীনি ভূতানি ভবন্তি জায়স্ব ম্রিয়স্ব ইতি এতৎ তৃতীয়ং স্থানম্ তেন অসৌ লোকঃ ন সম্পূর্যতে তস্মাৎ জুগুপ্সেত’।। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৮)।।

অর্থাৎ :

যারা (অর্থাৎ যে জীবগণ উপাসনা বা ইষ্টপূর্তাদি কর্ম করে না) উভয় পথের কোন পথ দিয়েই যায় না, তারা পুনঃ পুনঃ (জন্ম-মৃত্যু চক্রে) আবর্তনশীল ক্ষুদ্র প্রাণিরূপে জন্মগ্রহণ করে। (এদের বিষয়ে বলা যায়)- জন্মাও আর মরো (অর্থাৎ এরা এতো ক্ষণস্থায়ী যে জন্মগ্রহণ করেই মরে যায়। জন্ম-মৃত্যু ছাড়া এদের জীবনে অন্য কোন ঘটনা নেই)। এই হলো তৃতীয় স্থান। এজন্যেই এই লোক (অর্থাৎ স্বর্গ বা চন্দ্রলোক) পূর্ণ হয় না। সুতরাং (এই গতিলাভকে) ঘৃণা করবে (ছান্দোগ্য-৫/১০/৮)।


অর্থাৎ অনিষ্টকারী ব্যক্তি স্বর্গে গমন করে না। তাহলে কোথায় যায় ? সংশয় দূর করতে বাদরায়ণ বলেন-


‘সংযমনে তু অনুভূয় ইতরেষাম্ আরোহাবরোহৌ, তদ্গতিদর্শনাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৩)।।

ভাবার্থ : অনিষ্টকারী ব্যক্তি যমলোকে গমন করে; কারণ অনিষ্টকারীর সংযমী নামক যমপুরে যাওয়ার কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে (ব্রঃ-৩/১/১৩)।


কারণ, কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘ন সাম্পরায়ঃ প্রতিভাতি বালং প্রমাদ্যন্তং বিত্তমোহেন মূঢ়ম্ ।

অয়ং লোকো নাস্তি পর ইতি মানী পুনঃ পুনর্বশম্ আপদ্যতে মে’।। (কঠোপনিষদ-১/২/৬)।।

অর্থাৎ :

যম বলছেন, সংসারী মানুষ মাত্রই নিজ নিজ পরিবারের প্রতি অতিশয় আসক্ত। ধন-সম্পদের মোহ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাদের বুদ্ধি অপরিণত। তারা তাদের চারপাশের জগৎকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করে। এর বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, সে খোঁজ রাখে না। ইহলোকই আছে, পরলোক বলে কিছু নেই- যে-ব্যক্তি এ কথা মনে করে সে বারবার আমার অধীন হয়। অর্থাৎ তার পুনঃ পুনঃ জন্মমৃত্যু ঘটে থাকে (কঠ-১/২/৬)।


চন্দ্রলোকে আরোহণ শুধুমাত্র শুভকর্মের ফল ভোগেরই জন্য- অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। সুতরাং অনিষ্টকারিরা চন্দ্রলোকে যায় না। তাদের গন্তব্য হয় নরকে। কৃতকর্মের কষ্টভোগের মাধ্যমে পাপমুক্ত হয়ে পূর্ব-কৃত-কর্মের ভুক্তাবশিষ্ট ফল ভোগ করার জন্য পুনরায় জন্মগ্রহণ করে জীব দেহধারী হয়। তাই বাদরায়ণ বলেন-


‘স্মরন্তি চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৪)।।

‘অপি চ সপ্ত’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৫)।।

‘বিদ্যাকর্মণোঃ ইতি তু প্রকৃতত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৭)।।

ভাবার্থ :

স্মৃতিশাস্ত্রেও (যথা মনুস্মৃতি) পাপীদের নরক গমনের কথা দৃষ্ট হয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৪)। অধিকন্তু পাপীদের ভোগের জন্য সাতটি নরক আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৫)। পাপীদের চন্দ্রলোকে গমন হয় না, কারণ, বিদ্যাদ্বারা দেবযান এবং কর্মের দ্বারা পিতৃযান প্রাপ্তির কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৭)।

হারিদ্বার

হারিদ্বার

এখনো এই শরীরে শিবপুত্রী মা নর্মদার দর্শনলাভ হয়নি আমার। তবে শুনেছি মা গঙ্গা সারাদিন ধরে গঙ্গোত্রী থেকে সাগর পর্য্যন্ত গোটা তট জুড়ে সমস্ত পাপীতাপি স্নানার্থীদের মনঃক্লেদ নিজের শরীরে ধারণ করে একটি কৃষ্ণবর্ণ গাভীর রূপ ধরে সন্ধ্যায় পরমপাবন রেবানদীতে অবগাহন করেন আর স্নানের পর শ্বেতশুভ্র নির্মল গোরূপ ধরে শুচিশুদ্ধা হয়ে উঠে আসেন। মহাদেবকন্যার পবিত্র সলিল-শরীর স্পর্শ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে বহুবার পবিত্র গঙ্গাদর্শন এবং গঙ্গাস্নানের সৌভাগ্য হয়েছে এবং সেই সূত্রে মা গঙ্গার সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে গোটা জীবন জুড়ে। এই সম্পর্কটি বোধহয় শুধুমাত্র এক জন্মের নয়, হয়তো জন্মান্তরেরও। আর এই যোগসূত্র কিন্তু ভাগীরথী-হুগলি তীরবর্তী কলকাতাবাসের সুবাদে নয়, মূলতঃ হরিদ্বারের কল্যাণে। কোনোদিন হরিদ্বারের অভিজ্ঞতার কথা আগে লিখিনি, গিন্নি এবং দুজন বন্ধু ছাড়া বলিওনি কাউকে। 


যখনই শুনি পরিচিত কেউ হরিদ্বার যাচ্ছেন বা হরিদ্বার পেরিয়ে দেবভূমিতে আরো ওপরে যাবেন, মনটা কেমন যেন বড্ড বেশি 'যাই যাই' করে নেচে ওঠে। বহুদশক আগে যেবার প্রথম হরিদ্বার দর্শন করি, সেবার রাস্তায় চলতে চলতে মনে হয়েছিল এসব আমার খুব চেনা। রামঘাটে সন্ধ্যায় বসে থাকতে থাকতে মনে হয়েছিল এই জায়গা আমার চেনা, এর বাতাসের গন্ধ আমার চেনা, এর প্রকৃতিও আমার চেনা। তারপর বহুবার ফিরে ফিরে গেছি হরিদ্বারে, সুযোগ পেলেই কিছুদিন করে থেকেছি, আর পায়ে হেঁটে সকাল থেকে সন্ধ্যে অলিতেগলিতে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, টেরটিও পাইনি। হরিদ্বার আমায় টানে, ভীষণভাবে টানে। হরিদ্বার আমার নিজস্ব জায়গা, এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। ওখানে যে শরীরের বাস ছিল তার ঠিকানা হয়তো এই শরীর জানেনা, সেই শরীরের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের কথা হয়তো এখনকার শরীরের স্মরণে নেই, কিন্তু স্থানমাহাত্ম যাবে কোথায়? 


তবে একেবারে কিছুই কি মনে নেই? যে ক'বারই গেছি, প্রথম দর্শনেই বড় আপন মনে হওয়া গঙ্গাপারের একটি নির্দিষ্ট বহুপুরানো একতলা বাড়ির আশেপাশে পান্থশালা খুঁজে নিয়েছি প্রতিবার, ইচ্ছে করে। আশেপাশে ঘুরতে ফিরতে বারবার ওটার কালো রংচটা খোলা বা বন্ধ দরজাটার দিকে অজানা তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থেকেছি। প্রতিবার অনেকখানি হেঁটে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট দোকানে মাটির ভাঁড়ে গরম দুধ খেয়ে অন্যান্য সব জায়গার চেয়ে বেশি তৃপ্তি পেয়েছি আর গঙ্গার তীরে যেখানে এখন পুণ্যার্থীরা কমার্শিয়াল গঙ্গা আরতির জন্য ভিড় জমান, সেসব পেরিয়ে নির্জন শ্রীগঙ্গাজি মহারাজ ভগীরথজির প্রাচীন মন্দিরের চাতালে নিভৃতে গঙ্গাস্তব গেয়ে অনাবিল আনন্দ পেয়েছি। কয়েকবার মনে হয়েছে ওই ক্ষয়া ক্ষয়া বাড়িটার ততোধিক ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের সদর দরজাটা ঠেলে খুলে ভেতরের শানবাঁধানো উঠোনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াই, বাড়ির ভেতরটা একটু ভালো করে দেখি, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠিনি। হয়তো সবটাই কল্পনা, শুধুমাত্র বুকের টানটা ছাড়া। তিনদশক ধরে অনেক চলমান ছবি তুলেছি হরিদ্বারের, সেসব কোনো এক হার্ডডিস্কে বন্ধ রয়েছে, ইচ্ছে করলেই মনের স্ক্রিনে ফুটিয়ে তোলা যায়। বড় চেনা, বড় চেনা এই শহর। আগামীকাল গিন্নি রওনা হচ্ছেন দেবভূমির উদ্দেশ্যে, হরিদ্বার হয়েই যাবেন এবং ফিরবেন। আমারও ইচ্ছে করছে দৌড়ে পৌঁছে যাই, মা গঙ্গার দর্শন করি, গঙ্গাস্নান করে স্নিগ্ধ হৈ, কিন্তু এবারে আর হলো না। হয়তো পরে কোনো একদিন অথবা পরের কোনো এক শরীরে আবার - কে জানে?


সদ্যঃ পাতকসংহন্ত্রী সদ্যোদুঃখবিনাশিনী।

সুখদা মোক্ষদা গঙ্গা গঙ্গৈব পরমা গতিঃ।।


২০১১সালে মনে হয়েছিল এবারে হয়তো হরিদ্বারে একটা স্থায়ী আস্তানা গড়া যাবে, শেষমেশ আশাপূরণ হয়নি। তার পরের বছর একটি পোস্টে গঙ্গাদ্বার হরিদ্বার সম্পর্কে লিখেছিলাম:

Gangadwára.....where the palace of King Daksha used to be and where lived Lord Shiva's consort Devi Sati......where a drop of Amrit fell in what is now called the Brahma Kund during the churning of the oceans or Samudra Manthan, spilled accidentally from the pitcher carried by Garuda.......which is refered to as a Tirtha by Rishi Dhaumya to Yudhistir in the Vanaparva of the Mahabharat.......where Rishi Agastya did his penance with the help of his wife Lopamudra........where Sage Kapila is said to have an ashram giving it another ancient name Kapila or Kapilastan.........now known both as Haridwar (gateway to Lord Vishnu in Badrinath) and Hardwar (gateway to Lord Shiva in Kedarnath)