আজ পাড়ায় সূর্যউপাসক পুণ্যার্থীরা ব্রাহ্মমুহূর্তে বিকট জোরে পটকা ফাটিয়ে ফাটিয়ে এত বিরক্ত করলো যে বলবার নয়। আসলে দোষ এদের নয়, দোষ শিক্ষার। ব্রাহ্মমূহুর্ত বা সূর্যোদয়ের আগে রাত্রির শেষ এক চতুর্থাংশ সময়ে "ব্রহ্মন" বা সৃষ্টিকর্তার নিজস্ব সময়। ওই সময়ে সাধনা করলে নিজেকে তাঁর ইচ্ছে মতো গড়ে তোলা সম্ভব হয়। তাই প্রতিদিন রাত ৩.৩০-৫.৩০ পর্যন্ত জপ-ধ্যানের সবচেয়ে উপযুক্ত কালখন্ড বলে ঋষিরা জানিয়েছেন। অষ্টপ্রহরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এই বিশেষ সময়ে অবশ্যই মন সবচেয়ে বেশি শান্ত থাকে আর একাগ্র হয়ে ধ্যান করলে কুলকুন্ডলিনীদেবীর জাগরণ বোধহয় কিছুটা সহজতর হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব নিজে নহবতে শ্রীশ্রীমা ও ভাইঝি লক্ষ্মীমণিদেবীসহ দক্ষিনেশ্বরে রাত্রিবাসরত তাঁর শিষ্যদের প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতেন। লক্ষ্মীদেবী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, 'ঠাকুরের তো রাত্তিরে বেশি ঘুমই হতো না। প্রায় রাত তিনটেয় তিনি ঝাউতলায় শৌচে যেতেন। যাবার সময় নহবতের পাশে এসে আমায় ডাকতেন : "ও লক্ষ্মী, ওঠরে ওঠ। তোর খুড়িকে তোলরে। আর কতো ঘুমুবি? রাত পোহাতে চললো। গঙ্গাজল মুখে দিয়ে মার নাম কর, ধ্যান-জপ আরম্ভ করে দে।"... সাড়া না পেলে বা আমরা উঠিনি মনে হলে তিনি দরজার নিচে দিয়ে জল ঢেলে দিতেন। সব ভিজে যাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি আমাদের উঠে পড়তে হতো।'
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে প্রথম প্রথম এলার্মের সাহায্য লাগলেও পরে বডিক্লক নিজেই এই প্রাত্যহিক রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক সময় আপনাআপনিই ঘুম ভেঙে যায়, আর আলাদা করে ভোরে ওঠার চেষ্টা করতে হয়না। এই সময়টা কিন্তু exclusively আমার সময়, একান্তই আমার। এই সময় বাহ্যিক কোনো কিছুর সাথে আমি সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কহীন। বাহ্যিক অর্থে ভৌতিক। অবশ্যই ধ্যানে আমার ইষ্টদেব তাঁর মর্তলীলার রূপ ধরেই আসবেন, কিন্তু সেটা বাহ্যিক নয়। আসলে এই সময় যেহেতু মন স্বভাবতই অন্তর্মুখী থাকে, তাই সাধারণত দেহের চাহিদাগুলোকে অপ্রয়োজনীয় বোধ হয় - ফলে ধ্যান ভালো জমে। আবার বাসনাকে ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যেও প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে নিজের মনকে গুটিয়ে একজায়গায় করে ফেলার অভ্যেসটি খুব দরকার। অবশ্য এসব কথা তাঁদের জন্য যাঁরা আত্মবোধের পথযাত্রী, সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
কথামৃতে দেখছি ২৪শে অগস্ট ১৮৮২ সালে ঠাকুর মাষ্টারমশাইকে বলছেন :
শ্রীরামকৃষ্ণদেব — অন্তরে কি আছে জানবার জন্য একটু সাধন চাই।
মাস্টারমশাই — সাধন কি বরাবর করতে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণদেব — না, প্রথমটা একটু উঠে পড়ে লাগতে হয়। তারপর আর বেশি পরিশ্রম করতে হবে না। যতক্ষণ ঢেউ, ঝড়, তুফান আর বাঁকের কাছ দিয়ে যেতে হয়, ততক্ষণ মাঝির দাঁড়িয়ে হাল ধরতে হয়, — সেইটুকু পার হয়ে গেলে আর না। যদি বাঁক পার হল আর অনুকুল হাওয়া বইল, তখন মাঝি আরাম করে বসে, হালে হাতটা ঠেকিয়ে রাখে, — তারপর পাল টাঙাবার বন্দোবস্ত করে তামাক সাজতে বসে। কামিনী-কাঞ্চনের ঝড় তুফানগুলো কাটিয়ে গেলে তখন শান্তি।
আসলে সবটাই অভ্যেসের ব্যাপার, নিজের চেষ্টার সত্যিই কোনো alternative নেই। পরম পূজনীয় রাজা মহারাজ বলছেন, "প্রত্যহ কিছু-কিছু ধ্যান করবে। কোন দিন বাদ দেবে না। মন বালকের ন্যায় চঞ্চল, ক্রমাগত ছুটাছুটি করে। উহাকে বারবার টেনে এনে ইষ্টের ধ্যানে মগ্ন করবে। এইরূপ দুই-তিন বৎসর করলেই দেখবে যে, প্রাণে অনির্বচনীয় আনন্দ আসছে, মনও স্থির হচ্ছে"। তবে সব শেষে মায়ের কৃপা ছাড়া কিছুই পাওয়ার নয়, ঐখানেই ঝুঁটিটি ধরা আছে - যেমন চাইবেন তেমন হবে। প্রতিদিন জপের আগে আর ফল অর্পণের পর তাই মহামায়ীর কৃপা প্রার্থনা ভীষণ ভীষণ জরুরি।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে কয়েকটি অভ্যেস করলে মন একাগ্র করতে সুবিধা হয়।
১. প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল এবং সন্ধ্যায় ভজন বা ঈশ্বরীয় কথা শোনা। এখন ইউটিউবের দৌলতে এসব খুবই সহজলভ্য। কেবল কিছুক্ষন সবার কাছ থেকে সরে গিয়ে ঘরের একটা কোনে me time আর একটা হেডফোন - ব্যাস।
২. প্রতিদিন তেরো ঘন্টার উপবাস - সন্ধ্যে ৭.০০ থেকে পরদিন সকাল ৮.০০ পর্য্যন্ত। নির্জলা নয় কিন্তু।
৩. প্রতিদিন সন্ধ্যে ৭.০০টার মধ্যে একটু মুড়ি-বাদাম বা দুটো কলা বা শুকনো চিঁড়েভাজা আর সঙ্গে আধ লিটার গরুর দুধ - এটাই রাতের খাবার - এতে শরীর ঝরঝরে থাকে আর জপ-ধ্যানে সুবিধে হয়।
৪. কোনো বিবাদে না জড়ানো, কারো সঙ্গে তর্ক না করা, কোনকিছু পছন্দ না হলে সেখান থেকে চুপচাপ সরে আসা - মোদ্দা কথা মন যাতে agitated হবে এবং পরে ধ্যানে মন বসাতে কষ্ট হবে, সেসব করে সময় নষ্ট না করা।
৫. জাগতিক বিষয়ে যতদূর সম্ভব নির্লিপ্ত থাকা, সামাজিকতার ব্যাপারে involved না হওয়া - তাতে কে কি ভাববেন বলে মাথা না ঘামিয়ে কি কি করলে মায়ের কৃপালাভ হবে - গোটা মনের orientationটা সংসারের যাঁতাকলে থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে সেইদিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া।
৬. বিষয়ী লোকের সঙ্গ যতদূর সম্ভব পরিহার করে চলা এবং যে যে সঙ্গে বা পরিবেশে মন নিচে নেমে যায়, পার্থিব বাসনা জেগে ওঠে, সেসব থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকা।
৭. There is nothing to be apologetic about being a seeker. If others don't understand that goal, no sweat. Sometimes ignoring them is alright.
৮. নিয়মিত দেবদর্শন, তীর্থভ্রমণ, সন্ন্যাসীর সঙ্গ, ধর্মালোচনা, সাত্ত্বিক আহার, সাত্ত্বিক জীবন, gradual withdrawal from worldly wants and engagements আর শুদ্ধচিন্তা - একটা বয়সের পর এটাই routine হওয়া দরকার।
বাকি, মায়ের ইচ্ছা। আমরা যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী।
No comments:
Post a Comment