Sunday, March 24, 2024

দোলযাত্রা ১৪৩০

আজ ১১ই চৈত্র ১৪৩০, শ্রীচৈতন্য পূর্ণিমা, বসন্তকাল, শুভ দোলোৎসব। প্রেম নামক যে ঈশ্বরীয় অনুভূতিটি সৃষ্টিকর্তা আমাদের সকলকে দিয়েছেন, তাঁর যে প্রেম দিয়ে তৈরি সহস্রদলপদ্মরূপী আসনে তিনি স্বয়ং আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে বিরাজমান, সেই নিত্য সত্য অনন্ত আনন্দময়ের আত্মপ্রেমের প্রকাশরূপে এই যে গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ড প্রতীয়মান, আজকের এই পবিত্র দিনটি সর্বতোরূপে সেই অদ্বৈতবোধকে উজ্জাপন করার দিন। বাইরে তাকিয়ে দেখুন - পলাশের শাখায় শাখায় যেন প্রেমের আগুন লেগেছে, কৃষ্ণচূড়া, কণকচাঁপা থেকে নিয়ে গাব, গামারি, মণিমালা পর্য্যন্ত প্রতিটি গাছ যেন বসন্তের প্রেমের ঔজ্জ্বল্যে একেবারে ফেটে পড়ছে। আর প্রকৃতির এই বাঁধভাঙা উচ্ছাসের মাধ্যমে যে অনন্তপ্রেমের বাণী তিনি দিচ্ছেন, তাকেই অনুসরণ মানুষ করে একে অপরকে রঙে রঙে রাঙিয়ে তুলে তাঁরই সৃষ্টির মধ্যে তাঁকে অনুভব করে তাঁর সাথে একাত্ম বোধ করতে চেষ্টা করছে, এ ঈশ্বরের লীলা বৈ আর কিই বা? বৃন্দাবনে শ্রীরাধা এবং শ্রীকৃষ্ণ একে অপরের গায়ে আবির ছুঁড়ে দোলযাত্রার সূচনা করেছিলেন। আসলে শ্রীরাধা আর শ্রীকৃষ্ণ এক এবং অদ্বিতীয় কারণ প্রেম দ্বৈতস্বত্তাকে অদ্বৈত করে তোলে, সেটাই তার প্রকৃতি। রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি আসলে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, অবিচ্ছেদ্য, অবর্ণনীয়, সগুন আর নির্গুণ ব্রহ্মের, পুরুষ ও প্রকৃতির, নিত্য ও অনিত্যের একত্রিত বাহ্যিক প্রতিফলন। এ এক অনন্ত প্রেম, যা বুঝতে গেলে প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে হবে। ফুটে ওঠা বেলকুঁড়ির সাথে বাতাসের যে প্রেম, সেটার চরিত্র কি? বসন্তের বার্তা বহন করে আনা বেলকুঁড়ি ফোটে, বাতাসে তার মিষ্টি গন্ধ মিশে যায়, বাতাস সেই সুগন্ধ বয়ে নিয়ে যায় বহু দূরে যেখানে আমি আপনি ছোট্ট বেলগাছটিকে চোখে দেখতে না পেলেও তার মিষ্টি আঘ্রানে পুলকিত হৈ, একইসাথে তার অস্তিত্বকে এবং বসন্তের আগমনকেও অনুভব করতে পারি। এই হলো প্রেমের সত্যিকারের চরিত্র - যা মেলায়, বা সসীমের মধ্যেও অসীমের বার্তা বহন করে আনে। আজ দোল, রঙের উৎসব, জীবনের উৎসব। জীবন মানেই প্রেম কারণ আমাদের প্রত্যেকের উৎস ওটাই। তাই আজ প্রেমের উৎসব, হয়তো সেই কারণেই প্রেমের জীবন্ত প্রতিমূর্তি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পূণ্য আবির্ভাব তিথিও বটে। তাঁর শ্রীচরণে প্রার্থনা করি,

রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, 

আমার সকল কর্মে লাগে,

সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, 

গভীর রাতের জাগায় লাগে॥

যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে,

রক্তে তোমার চরণ-দোলা লাগিয়ে দিয়ে।

আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে,

পাষাণগুহার কক্ষে নিঝর-ধারা জাগে,

মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে,

বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে,

তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও 

যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে,

কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে॥


আপনারা সকলে শুভ দোলযাত্রা উপলক্ষে আমার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানবেন। হরিবোল।

Friday, March 8, 2024

শিবমন্ত্র

ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারুণাত্রায় হেতবে। 

নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গত্বিং পরমেশ্বরম॥


এখানে কি বলা হচ্ছে? না, হে পরমেশ্বর শিব, আমি আমার আত্মাকে তোমার পায়ে নিবেদন করছি, তুমি তার গতি করো। এখন, শিব নিজে যেমন তেমনই তো গতি করবেন, উনি তো আর আমায় রাক্ষস বানিয়ে দেবেন না। তা, শিব কেমন? প্রথম লাইনে বলা হচ্ছে যে আমি সেই শিবকে প্রণাম করি যিনি শান্ত আর তিন কারণের হেতু। কি কি কারণ? সৃষ্টি, স্থিতি আর প্রলয়। শিবের স্তুতিতে আর একটি মন্ত্রে আছে, 'তস্মৈ নমঃ পরমকারণ কারণায়' অর্থাৎ হে কারণের পরম কারণ, তোমায় প্রণাম করি - মানে, এই যে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়যুক্ত বিশ্বব্রহ্মান্ড তৈরি হয়েছে, এও তোমারই ইচ্ছায়, অর্থাৎ তুমিই শক্তি, তুমিই ব্রহ্ম।


এই মন্ত্রের অলৌকিক দ্যোতনা বাদ দিলে, প্রাত্যহিক যাপনে শিবভক্তদের লৌকিক ব্যবহার কেমন হবে, তার নির্দেশও এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে। প্রথম কথা, আমায় বুঝতে হবে যে আমি আত্মা, এই শরীর-মন মাত্র নই। দুই, আমি শিবত্ব অর্থাৎ শিব-অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কারণ যাঁকে চিনি না, জানি না তাঁর কাছে তো আর নিজেকে নিবেদন করতে যাবো না। তিন, তিনি আমার কি গতি করবেন সে সম্পর্কেও আমার সম্যক ধারণা আছে কারণ সমস্ত জাগতিক বন্ধন থেকে তিনি আমায় মুক্ত করে দেবেন, সেটা মেনে নিয়ে এবং কামনা করেই আমি এই পথে হাঁটছি। চার, আমার যে কামনা তা পবিত্র, তা লোভ নয় কারণ আমার লক্ষ্য শিবত্ব প্রাপ্তি। 


শিবত্ব কি? শিবকে বর্ণনা করা হচ্ছে  'সত্যম-শিবম-সুন্দরম' বলে। শিব হচ্ছেন শাশ্বত, তাই একমাত্র চিরসত্য। শিব হচ্ছেন চিরপবিত্র, তাই একমাত্র চিরসুন্দর। এটা আসলে জৈব জীবন থেকে অনন্ত জীবনে উত্তরণের একটি ফর্মুলা। জীবাত্মা প্রথমে প্রবৃত্তির অস্থিরতাকে অতিক্রম করে শান্ত হবে। তারপর ক্রমশই সে নিজের মধ্যে পরমাত্মারূপী সেই অনন্ত অজর অমর চিরসত্যকে উপলব্ধি করে পবিত্রতার প্রতিরূপ হয়ে প্রতিভাত হবে। শিবলিঙ্গ অর্থাৎ শিবের প্রতিরূপের মাথায় জল দেওয়া হয়। জলই জীবন। শিবের মাথায় যখন অর্ঘ্য হিসেবে জল নিবেদন করা হয় তখন আসলে নিজেকেই নিবেদন করা হয় এবং উপরোক্ত মন্ত্রটি বলা হয়। আশাকরি এবার থেকে জল ঢালার এবং এই বিখ্যাত মন্ত্রটি উচ্চারণ করার সময় সচেতনভাবেই তা করা যাবে।